বুদ্ধের জীবন থেকে

বুদ্ধের জীবন থেকে

আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগেকার কথা। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন সারা পৃথিবীরই একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ, আজও তিনি সারা পৃথিবীর প্রথম সারির এক মহামানব। ইনি আমাদের কী দিয়ে গেলেন?

সেই সময় হিমালয়ের দক্ষিণে নেপাল বিহারের সীমার কাছে শাক্যবংশের রাজ্য ছিল, সেখানে রাজা তখন শুদ্ধোদন, তাঁর রাজধানী ছিল কপিলাবস্তু। শুদ্ধোদনের পাটরানি ছিলেন মায়াদেবী। এক বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে, মায়াদেবী তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম দেবার জন্যে যখন বাপের বাড়ি যাবেন বলে বেরিয়েছেন, তখন পথের মধ্যে দু’টি শালগাছের ফাঁকে জন্ম হল তাঁর ছেলের। ছেলের জন্মের সাত দিন পরেই মায়াদেবী মারা গেলেন, তাঁর বোন মহাপ্রজাপতি, শুদ্ধোদনের আর এক রানি, শিশুটিকে মানুষ করবার ভার নিলেন। ছেলের নাম হল সিদ্ধার্থ। গৌতম কুলে জন্ম বলে ওই নামটাও রইল।

ছেলের জন্মের কয়েকদিন পরেই রাজা জ্যোতিষীদের ডাকিয়ে এনে বললেন, তাঁরা যেন গণনা করে বলে দেন, ছেলে বড় হয়ে কী হবে। তাঁরা শুনে বললেন, ‘হয় এ ছেলে বড় হয়ে মস্ত রাজাধিরাজ হবেন, নয়তো এমন সাধু হবেন যিনি মানুষকে মুক্তির পথ বলে দেবেন।’ এর কয়েকদিন পরেই খুব বড় এক ঋষি এলেন রাজসভায়, নাম অসিত, দেখতে চাইলেন শিশুটিকে। ছেলেকে আনা হলে, দেখে অসিত প্রথমে হাসলেন। তার পরে কাঁদলেন। তা দেখে রাজা জানতে চাইলেন, কেন ঋষি এমন করলেন। অসিত বললেন, এ ছেলে বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবেন, মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবেন। এমন সুলক্ষণ ছেলেকে নিজের চোখে দেখতে পেয়েছেন বলে তিনি হেসেছেন; কিন্তু এখন তাঁর এত বয়স হয়েছে যে, যতদিন ছেলেটি বড় হয়ে ওই জ্ঞান লাভ করবেন, ততদিন তো তিনি বাঁচবেন না। তাই সেই শুভদিন দেখা তাঁর ভাগ্যে ঘটবে না, সেই দুঃখে তিনি কেঁদেছেন! এ কথা শুনে রাজার খুব দুশ্চিন্তা হল; কারণ, অসিতের আগে জ্যোতিষীরাও বলে গিয়েছিলেন যে, ছেলেটি সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। রাজা তো চান, ছেলে রাজাধিরাজই হন, তাই তিনি ভাবলেন, ছেলে যদি পৃথিবীর ভোগসুখে একেবারে মেতে থাকে তো আর সাধু হয়ে যাবে না। সেই উদ্দেশ্যে তিনি রাজবাড়িতে অনেক দাসদাসী, নাচগান, খাওয়াদাওয়া, কাপড়-গয়না, উৎসবের আয়োজন করলেন, যাতে ছেলে রাজবাড়িতেই আটকে থাকে। ছেলের কিন্তু সে সব দিকে মন ছিল না। গল্পকথা বলে যে, সিদ্ধার্থ বালক বয়সে প্রথম দিন পাঠশালায় গিয়ে গুরুমশায় ও অন্য ছাত্রদের সামনে বর্ণমালার এক একটি অক্ষর দিয়ে একটি করে ছড়া বেঁধে শোনাতেন, আমরা যেমন অ’য়ে অজগর আসেছ তেড়ে’ বলে অক্ষর শিখি, অনেকটা সেই রকমেরই, কেবল তাঁর ছড়াগুলোর মানে হল, মানুষ যেন ভোগসুখ থেকে মন সরিয়ে নেয়, মায়ামোহে আটকে না থাকে। সিদ্ধার্থের স্বভাব ছিল খুব চুপচাপ ধরনের। একবার রাজবাড়ির সকলে এক চাষি-গাঁয়ে বেড়াতে গেলেন। সকলে ঘুরে ফিরে দেখছেন, খানিক পরে দেখা গেল, রাজকুমার তাঁদের সঙ্গে নেই, খোঁজ করে দেখা গেল তিনি একটি গাছতলায় চুপ করে বসে আছেন, যেন ধ্যানে বসেছেন। লোকজনের ডাকাডাকিতে উঠে এলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর লেখাপড়া শেখা হল। ক্ষত্রিয়ের ছেলে, তাই তির ধনুকের ব্যবহার ও তলোয়ার চালানো এ সবও শিখতে হল; লেখাপড়ার মতো সব কিছুই তিনি অনায়াসে খুব ভাল করেই শিখে নিলেন।

খানিকটা বড় হলে শুদ্ধোদন মনে করলেন, এ বারে বিয়ে দিলে ছেলের মন সংসারে বসবে, তা হলে আর ভয় থাকবে না। দণ্ডপাণি নামে এক শাক্য নেতার মেয়ে গোপার (যশোধরা নামও কোথাও কোথাও পাওয়া যায়) সঙ্গে সিদ্ধার্থের বিয়ে হল। মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনই সৎ ও সাহসী। রাজা মনে করলেন, ছেলে এ বার সংসারী হল, আর ভয় নেই। কিছুকাল পরে একটি ছেলেও হল, তার নাম হল রাহুল। শুদ্ধোদন আরও নিশ্চিত হলেন, ছেলে সংসারে আটকে থাকবে। যাতে কোনও অনর্থ না হয় তাই তিনি ব্যবস্থা করলেন যাতে কোনও কষ্টের দৃশ্য সিদ্ধার্থের চোখে না পড়ে। এমনই রাজার কপাল যে, এত ব্যবস্থা সত্ত্বেও একদিন সিদ্ধার্থ বেড়াতে যাবার আগে দেখতে পেলেন একটি খুনখুনে বুড়ো অতি কষ্টে লাঠি ভর করে হাঁটছে; এমন দৃশ্য আগে দেখেননি তাই সারথি ছন্দক বলল, অনেক বয়স হলে সব মানুষই ওই রকম দুর্বল, অসহায় হয়ে পড়ে। শরীরে কোনও জোর থাকে না তো তাই লাঠি ভর করে হাঁটতে হয়। শুনে সিদ্ধার্থের মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। আরও একদিন বেড়াতে বেরিয়ে একটি মানুষকে দেখলেন, কঠিন অসুখে ভুগে ভুগে তার একেবারে হাড়-চামড়া-সার চেহারা হয়েছে। ছন্দক বলল, রোগব্যাধিতে ভুগলে মানুষ অমনই রোগা, দুর্বল হয়ে যায়। মনটা ভারী হয়ে গেল সিদ্ধার্থের। আবার একবার পথে দেখলেন, খাটিয়ায় শুইয়ে একটি শবদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ছন্দকের কথায় জানলেন, প্রত্যেক মানুষকেই একদিন ওই ভাবে মরতে হবে। বুঝতে পারলেন, ওই হল মৃত্যুর চেহারা, যে-মৃত্যু সমস্ত মানুষের জীবনের শেষ পরিণতি। তা হলে বেঁচে থাকার মানে কী? ভাবিয়ে তুলল রাজকুমারকে। আর একদিন পথে দেখতে পেলেন, এক সাধু চলেছেন ধীর পায়ে ভারী শান্ত, সুন্দর মুখের ভাব। ছন্দক বলল, লোকটি সংসারের মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে, তাই ওই রকম নিশ্চিন্ত চেহারা তার। এই চারটি দেখা নিয়ে অবিরত ভাবতে লাগলেন রাজকুমার। শুদ্ধোদন সর্বদাই রাজবাড়িতে খাওয়াদাওয়া, সুন্দরী মেয়েদের নাচগান ও নানা উৎসবের ব্যবস্থা করে রেখেছেন, কিন্তু সিদ্ধার্থের সে সবে মন নেই।

তাঁর বয়স যখন ঊনতিরিশ বছর তখন অনেকদিন ধরে অনেক ভেবে তিনি ঠিক করলেন, সংসারের ভোগসুখের মধ্যে জড়িয়ে থাকলে জীবনকে ঠিক করে বোঝা যাবে না। তখনকার লোকে বিশ্বাস করত যে, মানুষ মারা যাবার পরে আবার ভিন্ন ভিন্ন দেহ নিয়ে জন্মায়। এই জন্মান্তরের ধারার শেষ কোথায়? কীসে? এই সব ঠিক করে বুঝে নেবার জন্যে তাঁর মনে হল, পথে দেখা ওই সাধুটির মতো যদি কোনও পিছুটান না রেখে সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়েন, তা হলে হয়তো সব কিছুর কিনারা করতে পারবেন। রাজবাড়ির ভিড়, উৎসব, বিলাস, গোপা, রাহুল এ সবই বন্ধন, এর থেকে এখনই না বেরোতে পারলে আরও জড়িয়ে পড়তে হবে।

এক রাত্রে ঘুমন্ত স্ত্রী, ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে তাদের কাছে বিদায় নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে ছন্দককে বললেন, তাঁর প্রিয় ঘোড়া কণ্ঠককে নিয়ে আসতে। রথে চড়ে রাজপুরী থেকে খুব তাড়াতাড়ি অনেক দূরে চলে এলেন। রথ থেকে নেমে তাঁর যা রাজকুমারের পোশাক গয়না তা খুলে ছন্দককে দিলেন ও ছন্দক আর কণ্ঠককে বিদায় দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ছন্দক কাঁদতে কাঁদতে রাজবাড়িতে গিয়ে সব জানালেন। রাজকুমার একদিকে নিজের তলোয়ার দিয়ে চুল ছেঁটে নিলেন ও সাধারণ জামাকাপড় পরে পথে চলতে লাগলেন। রাজবাড়ি থেকে যখন খোঁজাখুঁজি শুরু হল, তার আগেই তিনি বহু পথ পেরিয়ে এসেছেন।

পথে দু’জন সাধুর সঙ্গে দেখা, তাঁদের নাম আরাড় কালাম ও রুদ্রক রামপুত্র। এঁদের কাছে দীক্ষা নিয়ে সিদ্ধার্থ ছ’-বছর ধরে খুব কঠিন তপস্যা করলেন। প্রথমে যৎসামান্য খেয়ে নানা কষ্টকর ভঙ্গিতে বসে-দাঁড়িয়ে শরীরকে নানা ভাবে কষ্ট দিয়ে একমনে সাধনা। ক্রমে নামমাত্র খাওয়া, তার পরে পুরো উপবাস, শরীর কঙ্কালসার হয়ে গেল। কিন্তু যে জ্ঞান পাবার জন্যে এত কষ্ট— কেন মানুষের জীবনে রোগের কষ্ট, বুড়ো বয়সের কষ্ট, মরণের যাতনা, ফিরে ফিরে জন্ম এই সব কিছুতেই ফিরে ফিরে ভোগা— তার কোনও কুলকিনারা পাওয়া গেল না। তখন তিনি ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, এটা ঠিক পথ নয়। রাজবাড়ির ভোগবিলাসে যেমন ঠিক করে জীবনকে বোঝা যায় না, তেমনই শুধু শুধু শরীরকে এত কষ্ট দিয়ে যে সাধনা, তা দিয়েও জীবনকে বোঝা যায় না, তখন ওই সাধনা ছেড়ে দেওয়াই ঠিক করলেন।

এই বার সিদ্ধার্থ নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করে উঠে দেখলেন, গ্রামের একটি মেয়ে, সুজাতা তাঁর জন্যে পায়েস রেঁধে এনেছে। বহুদিনের উপবাসের পরে ভারী তৃপ্তি করে পায়েসটা খেলেন। তাঁর তপস্যার সময়টায় তাঁর সেবা করত চারটি লোক, তারা যেই দেখল, তিনি কঠিন তপস্যা ছেড়ে স্নান-খাওয়া করলেন অমনি বিরক্ত ও হতাশ হয়ে তারা তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। তখন এক ঘেসেড়া তাঁকে এক মুঠো ঘাস দিল। একটা মস্ত ঝাঁকালো বটগাছের নীচে সেই ঘাস বিছিয়ে আসন তৈরি করে তিনি ধ্যানে বসলেন। ঠিক করলেন, ওই আসনে বসে তাঁর শরীর যদি শুকিয়ে যায়, চামড়া হাড় মাংস যদি শেষও হয়ে যায় তবুও বহুকালের সাধনায় যে দুর্লভ বোধ (সত্যজ্ঞান) পাওয়া যায়, তা না পেয়ে তিনি ওই আসন ছেড়ে উঠবেন না।

***

মানুষের সব ভাল কাজ পণ্ড করে একটি মন্দ শক্তি, এমন বিশ্বাস ছিল কিছু লোকের। তাঁরা এ শক্তিকে ‘মার’ নাম দিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থের একমনে সাধনা করার ব্যাপারে মারের টনক নড়ল। এ ভাবে যদি ইনি বোধি, সত্যজ্ঞান লাভ করেন, তা হলে তো পৃথিবীর মানুষ আর জরা-মরণের অধীন থাকবে না। মারের শক্তি অনেক, তাই তার ইচ্ছেয় হঠাৎ ভীষণ ঝড়বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বাজপড়া শুরু হয়ে গেল। এদিকে ‘মুচলিন্দ’ নাগ, প্রকাণ্ড বড় একটা সাপ, বুদ্ধের ওপর সদয় হয়ে তার মস্ত ফণা ছড়িয়ে রাখল সিদ্ধার্থের মাথার ওপরে, তাই ঝড়বৃষ্টিতে তাঁর কোনও ক্ষতিই হল না, তাঁর মনেও কোনও অস্থিরতা এল না, তিনি একমনে যেমন ধ্যান করছিলেন, তাই করতে লাগলেন। তখন নিরুপায় হয়ে মার সরাসরি তাঁর সামনে এসে বলল, ‘তোমাকে সারা পৃথিবীর রাজা করে দেব, তুমি এ সাধনা ছেড়ে উঠে পড়ো। আমার এমন শক্তি আছে যার বলে তুমি পরের জন্মে স্বর্গে জন্মাবে, ছেড়ে দাও এ তপস্যা।’ এমনই নানা লোভ ও ভয় দেখাতে লাগল মার, কিন্তু সিদ্ধার্থ একটুও বিচলিত হলেন না, যেমন একমনে ধ্যান করছিলেন তেমনই করতে লাগলেন। তখন মার হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। এ বার রাতে এক এক প্রহরে এক একটি চেতনা সিদ্ধার্থের মনে আসতে লাগল। তিনি বুঝলেন, মানুষের মনের লোভ ও বাসনা কামনাই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সারা জীবন, এবং মৃত্যুর পরেও এক জন্ম থেকে আর এক জন্ম। কোনও মতে যদি বাসনাকে মন থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে পারা যায়, তা হলে এই জন্ম— শৈশব, কৈশোর, যৌবন, জরা, ব্যাধি, মরণ, আবার ফিরে ফিরে জন্মানো এ সবের সুতোটা ছিঁড়ে যায়। কারণ, লোভ থেকেই সবের শুরু। মরণকালে মনে যে লোভ থাকে, তাই মেটাবার জন্যে আবার ফিরে আসতে হয়। জরা-অসুখ-মরণেরও পুনর্জন্মের বশে আসতে হয়। ওই লোভকে মন থেকে উপড়ে ফেলতে পারলেই এ সব থেকে ছুটি পাওয়া যায়।

চার সপ্তাহ কাটল ওই বটগাছের নীচে, এই চিন্তাগুলোকে স্পষ্ট করে বুঝে নিতে। বুঝলেন, দুঃখ যেমন আছে, তেমনই আছে দুঃখের কারণ, আর আছে দুঃখের শেষ এবং শেষ করবার উপায়। (এই চারটি সত্যকে বৌদ্ধরা বলেন দুঃখ, দুঃখহেতু, দুঃখহানন এবং হানোপায়। এই যে নতুন জ্ঞান তারই নাম বোধি, সে জ্ঞান মুক্তি আনে। বোধি লাভ করে সিদ্ধার্থ বুদ্ধ হতে চলেছেন দেখে, ভীষণ ভয় পেয়ে, মার তার সুন্দরী তিন মেয়েকে পাঠাল, তারা হাবভাব নাচগানের প্রলোভনে সিদ্ধার্থকে বোধির পথ থেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল, কিন্তু এ সবে তিনি ভুললেন না। তা দেখে মারের মেয়েরা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। মার ও তার মেয়েদের প্রলোভন জয় করে যে জ্ঞান তাঁর এল, সেই বোধি লাভ করে তিনি বুদ্ধ হলেন। তখন তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর।

চার সপ্তাহ ওই বোধি-বটগাছের নীচে ধ্যান করবার পর তাঁর কাছে দু’টি বণিক এল, নাম ত্রপুষ ও ভল্লিক। তারা বাণিজ্যের পথে যেতে যেতে, বোধিবটের নীচে বুদ্ধের শান্ত সুন্দর মূর্তি দেখে, ভক্তিভরে তাঁর কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করল, তাদের দেওয়া খাবার খেতে। পাথরের থালায় তাদের দেওয়া ভাত আর মধুভরা পিঠে খেলেন বুদ্ধ। তাদের শোনালেন তাঁর নতুন পাওয়া জ্ঞান, বোধির কথা, আশীর্বাদ করলেন। এই ত্রপুষ ও ভল্লিকই বুদ্ধের প্রথম গৃহী শিষ্য।

এর পরে বুদ্ধ বসে বসে ভাবতে লাগলেন, তাঁর এই নতুন জ্ঞান নিয়ে তিনি কী করবেন। লোকেদের মধ্যে প্রচার করলে, তারা কি ঠিকমতো ধরতে পারবে তাঁর কথা? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করলেন, বোধির জ্ঞান মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া চাই। প্রথমে খোঁজ করলেন, তাঁর আগের চেনা দুই সাধু, সেই আরাড় কালাম ও রুদ্রক রামপুত্রের; কিন্তু ততদিনে তাঁরা মারা গেছেন। কাজেই বুদ্ধ তখন চললেন, বারাণসীর পথে। আগেকার পরিচিত ছ’-টি সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন। এঁদের নাম নিপ্রস্থ জ্ঞাতপুত্র, অজিত কেশকম্বলী, পূরণ কাশ্যপ, ককুদ কাত্যায়ন, সঞ্জয় বৈরাটীপুত্র ও মস্করী গোশাল। বুদ্ধ যে কঠোর সাধনা ও শরীরকে পীড়া দেবার সাধনা ছেড়ে দিয়েছেন, এ কথা এঁরা আগেই শুনেছিলেন, তাই ঠিক করেছিলেন, দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে নমস্কার করবেন না। কিন্তু মুখে মধুর হাসি নিয়ে ধীর শান্ত পায়ে বুদ্ধ যখন তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন, তখন তাঁরা অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে পড়লেন; কী যে হল, আপনাআপনিই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার করলেন। বুদ্ধ তাঁদের কাছে তাঁর জ্ঞান প্রচার করলেন; এক দিকে যেমন পশুবধ করে যজ্ঞ করা অন্যায়, অন্য দিকে তেমনই শরীরকে কঠোর পীড়া দিয়ে যে-সাধনা তা-ও ঠিক পথ নয়, যেমন ঠিক নয় অতিরিক্ত ভোগবিলাসে ডুবে থাকা। যজ্ঞ আর কঠোর সাধনা এই দু’-ভাবেই আগেকার সমাজে লোক ধর্ম আচরণ করত; বুদ্ধ দুটোকেই বাদ দিলেন বলে তাঁর পথকে মধ্যম পন্থা বলে। বুদ্ধ তাঁর সাধু-শিষ্যদের বললেন, ‘মনের মধ্যে লোভ জয় করে লোকের বাড়ি ভিক্ষে চেয়ে একবেলা খেতে, সাধারণ পোশাক পরতে ও সাদাসিধে জীবনযাপন করতে। মানুষের মঙ্গল হয় এমন কাজ করতে ও লোকেদের তাঁর নতুন জ্ঞান শেখাতে। সে সময়ে সব শাস্ত্ৰই সংস্কৃত ভাষায় লেখা হত, পণ্ডিতরা ছাড়া সে ভাষা কেউই বুঝত না, তাই বুদ্ধ বিশেষ করে তাঁর শিষ্যদের বলে দিলেন যে, তারা যখন যে দেশে যাবে, সেখানকার ভাষাতেই প্রচার করবে, সংস্কৃতে নয়। এ কথা তাঁর শিষ্যরা মেনেছিলেন। উরুকে কাশ্যপ, নদী কাশ্যপ, গয়া কাশ্যপ এঁরা তখন যজ্ঞ করছিলেন, বুদ্ধ এসে দাঁড়ালেন তাঁদের সামনে, বাধা পড়ল যজ্ঞে, বুদ্ধ তখন তাঁর নতুন জ্ঞানের বাণী এঁদের শোনালেন, তাঁরা বুদ্ধের পথকে আপনার করে নিলেন। এর মধ্যে আরও বেশ কিছু গৃহীভক্ত হয়েছে তাঁর। ….দ্রিক, মহানাম, অশ্বজিৎ যশ ইত্যাদি পঞ্চাশ জনের মতো। বুদ্ধ এঁদের কাছেও ভাল করে তাঁর বাণী বুঝিয়ে বলে এদের পাঠালেন মানুষের কাছে প্রচার করতে।

গয়ায় এসে প্রচার করলেন বুদ্ধ, সেখান থেকে চলে গেলেন রাজগৃহে। গিয়ে শুনলেন, রোহিণী নদীর জলের ভাগ নিয়ে তুমুল ঝগড়া চলছে শাক্য আর কলীয়দের মধ্যে। তিনি দু’-দলকে ডেকে বিচার করে মিটমাট করে দিলেন। থেমে গেল বহু বছরের বিবাদ। রাজগৃহ ছিল মগধের রাজা বিম্বিসারের রাজধানী। বিম্বিসারের কাছে আগে এক সময় বুদ্ধ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবার পরে সেখানে আসবেন। এ বারে তাই এসে রাজার সঙ্গে দেখা করলেন। রাজা তাঁর আর তাঁর শিষ্যদের জন্যে অনেকখানি জমি সমেত মস্ত এক বাঁশবাগান দান করলেন, এটিই হল তাঁর ‘বেণুবনবিহার’। এই সব বিহারে বৌদ্ধরা অনেকে এক সঙ্গে থাকবার জন্য সঙ্ঘ তৈরি করত, বিশেষত বর্ষার মাস ক’টা নিরাপদে কাটানোর জন্যে। এই রাজগৃহেই সারিপুত্র ও মৌদ্‌গল্যায়ন নামে তাঁর দুই বিখ্যাত শিষ্য তাঁর কাছে দীক্ষা নেন। এখানে তাঁদের থাকার আশ্রমবাড়িতে কুমারভৃত্য (অর্থাৎ শিশুদের চিকিৎসক) জীবক অসুস্থ হলে, বুদ্ধ তাঁকে সুস্থ করে দেন ও দীক্ষা দেন।

বোধিলাভের এক বছর পরে পিতা শুদ্ধোদন বারবার তাঁকে ডেকে পাঠালে, বুদ্ধ অবশেষে কপিলাবস্তুতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। এ বার গোপার চোখে সন্ন্যাসীর চীরবাস পরা স্বামীকে যেন আগের চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাল। মায়ের কথায় ছেলে রাহুল এসে বাবার কাছে তাঁর সম্পত্তির ভাগ চাইল, বুদ্ধ তাকে দীক্ষা দিলেন। বললেন, এই-ই তার উত্তরাধিকার। পিতা শুদ্ধোদন বুদ্ধের কাছে একটি ভিক্ষা চাইলেন— মা-বাবার অনুমতি ছাড়া যেন কোনও ছেলেকে দীক্ষা না দেওয়া হয়। বুদ্ধ রাজি হলেন। এ অনুরোধের মূলে ছিল সমাজে বুদ্ধের নামে কিছু নালিশ— ছেলেরা দীক্ষা নেওয়াতে বহু সংসার ভেঙে যাচ্ছিল, মা-বাবা ছেলেকে, বোন ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে, ছেলেমেয়ে বাবাকে হারিয়েছিল। বহু সংসার নানা ভাবে ভেঙে পড়ছিল, তাই বুদ্ধ পরিবারের অনুমতি নেওয়ার কথায় রাজি হলেন।

শাক্যবংশের অনেক বড় বড় লোকেরা নিজের ইচ্ছেয় এসে বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিলেন। এঁদের মধ্যে বুদ্ধ সবচেয়ে আগে দীক্ষা দিলেন উপালি নামে এক নাপিতকে। এরা সব বুদ্ধের গৃহী ভক্ত। এর কিছু পরে শুদ্ধোদন মারা গেলেন, তখন বুদ্ধের মাসি মহাপ্রজাপতি গৌতমী, যিনি বুদ্ধকে সাতদিন বয়স থেকে মানুষ করেছিলেন, তিনি এসে বুদ্ধের কাছে প্রব্রজ্যা (সন্ন্যাস) নিতে চাইলেন, বুদ্ধ রাজি হলেন। এই প্রথম ধর্মজীবনে মেয়েরা একটা স্বাধীন অধিকার পেল, যা তাদের আগে ছিল না। মহাপ্রজাপতির ছেলে নদও দীক্ষা নিল।

ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে করতে বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে এসে পৌঁছলেন। সেখানে সুদত্ত নামে এক ধনী বহু গরিবদের খাওয়াতেন বলে লোকে তাঁকে ‘অনাথ পিণ্ডদ’ বলত। তিনি বুদ্ধের বিশ্রাম ও সাধনার জন্যে আর এক ধনী জেত-র কাছ থেকে প্রকাণ্ড বড় একটা বাগান কিনতে চাইলে জেত বলেন, পুরো জমিটাকে মোহরে ঢেকে দিলে যত মোহর হয় তা-ই হবে জমিটার দাম।

সুদত্ত সেই দামেই কিনলেন এবং বুদ্ধ ও তাঁর ভক্তদের উপহার দিলেন এই জেত বনবিহারটি। শ্রাবস্তীতে বিশাখা বলে এক ধনী মহিলাও গরিবদের খাওয়াতেন বলে লোকে তাঁর নাম রেখেছেন ‘অনাথপিণ্ডিকা’; ইনিও এসে বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিলেন। ওই দিকেই থাকত এক খুনে ডাকাত, যত লোককে সে মারত, তাদের একটি করে আঙুল কেটে নিয়ে সুতোয় গেঁথে মালা করে পরত বলে তার নাম হয়েছিল ‘অঙ্গুলিমাল’। বুদ্ধকে দেখে দেখে তার মনে ভক্তি হল বলে সে খুন-ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে মানুষের ভাল করবার জন্যে বেঁচে থাকতে চাইল। বুদ্ধের কাছে সে দীক্ষা নিল। আম্রপালী নামের মেয়েটার জীবনে শুচি ছিল না, সে যখন বুদ্ধের কাছে এসে তাঁকে লক্ষ করে দেখল ও তাঁর বাণী শুনল, তখন তার বাসনা হল, শুচি পরোপকারী জীবনে বাঁচতে। বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিয়ে সে তার মস্ত বড় আমবাগানটা বুদ্ধ ও ভক্তদের দিয়ে দিল। এমনি করে অনেক ধনী ভক্ত বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নেওয়া সাধকদের থাকবার জন্য সঙ্ঘারাম ও বিহার তৈরি করিয়ে দিত ও সাধুদের খাবার ব্যবস্থা করত।

নানা গ্রামে শহরে প্রচার করতে করতে বুদ্ধের যখন বাহাত্তর বছর বয়স হল, সেই সময়ে মগধের রাজা বিম্বিসারের ছেলে অজাতশত্রু বাবাকে মেরে সিংহাসন দখল করে। এই অজাতশত্রু বৌদ্ধধর্মকে তাড়িয়ে পুরনো ব্রাহ্মণ্যধর্মকে ফিরিয়ে আনার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল। এ ছিল বুদ্ধের মাসতুতো ভাই বুদ্ধের পরম শত্রু দেবদত্তের ভক্ত। দেবদত্ত বুদ্ধকে হিংসা করে নিজে প্রধান ধর্মগুরু হবার চেষ্টা করত। দেবদত্ত ভাড়াটে খুনি দিয়ে বুদ্ধকে মারবার চেষ্টা করে দু’-বার, কিন্তু পারেনি। একবার প্রকাণ্ড এক পাথর ছুড়ে বুদ্ধকে মারতে যায়, সেটা বুদ্ধের গায়ে লাগলই না। তার পর ‘নালাগিরি’ নামের এক মস্ত বড় হাতির পায়ের তলায় বুদ্ধকে গুঁড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করল, কিন্তু নালাগিরি এসে মাথা নোয়াল বুদ্ধের পায়ের কাছে। দেবদত্ত বুদ্ধের সঙ্গে রেষারেষি করে একটা সঙ্ঘ গড়ল বটে কিন্তু অল্পদিন পরে নিজেই মারা গেল। এই দেবদত্তের ভাই আনন্দ ছিল বুদ্ধের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। আগে শিষ্যরা এক একদিন এক একজন করে বুদ্ধের সেবা করত; সে ব্যবস্থায় বুদ্ধের অসুবিধে হওয়াতে তাঁর জীবনের শেষ পঁচিশ বছর দেবদত্তের ভাই একাই তাঁর সেবা করেছিলেন। নিজে যেমন কোনও বিশেষ সুবিধে নিতেন না আনন্দ, তেমনই লক্ষ রাখতেন অন্য ভক্তরাও যাতে বুদ্ধের সেবা করবার কিছু সুযোগ পায়, বুদ্ধের সুবিধা-অসুবিধের দিকে কড়া নজর ছিল আনন্দর।

কোশলের রাজা প্রসেনজিতের ছেলের সঙ্গে শাক্য রাজকন্যার বিয়ের কথা ছিল, কিন্তু প্রসেনজিতের মা নিচুবংশের মেয়ে ছিলেন বলে শাক্যরা তাঁর ছেলের সঙ্গে তাঁদের কানও রাজকন্যার বিয়ে না দিয়ে এক দাসীর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিল। তার ছেলে বড় হয়ে যখন একবার মামারবাড়িতে এল, তখন তাদের ব্যবহারে অবহেলা দেখে খোঁজখবর নিয়ে আসল ব্যাপারটা জানতে পারল এবং ভীষণ রেগে গেল। ফিরে গিয়ে সৈন্যসামন্ত এনে কপিলাবস্তু আক্রমণ করে সমস্ত শাক্যদের মেরে ফেলল। বুদ্ধ তাকে এ কাজ করতে বারবার বারণ করেছিলেন, সে শুনল না। বুদ্ধের বংশের সব মানুষকে এমন ভাবে মেরে ফেলাতে তিনি খুবই আঘাত পেয়েছিলেন।

***

বুদ্ধের বয়স যখন প্রায় আশি বছর, তখন তাঁর মনে হল, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। তাই আনন্দকে ডেকে ধর্ম বিষয়ে অনেক উপদেশ দিলেন। শরীরের বল কমে গেলেও কিন্তু বুদ্ধ কাজ ঠিকই করে যেতে লাগলেন, এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, এ শহর থেকে ও শহর ঘুরে ঘুরে তিনি লোকদের মধ্যে প্রচার করে যেতে লাগলেন, যে জ্ঞান বোধিতে পেয়েছিলেন তা-ই সকলকে বোঝাতে লাগলেন। পথে পাবাপুরীতে চুন্দ নামে এক কামারের বাড়িতে খেলেন ‘সুকুর মদ্দর’; কেউ বলে এটা হল ব্যাঙের ছাতা, কেউ বলে কচি শুয়োরের মাংস। যাই হোক, খাবার পর তাঁর খুব পেটের অসুখ করল। বুড়ো বয়সে অসুস্থ শরীরে আর হাঁটতে পারছিলেন না, তাই আনন্দকে বললেন, দুটো শালগাছের মাঝের ফাঁকে কাপড় বিছিয়ে দিতে। তাঁর জন্মও হয়েছিল লুম্বিনীতে দুই শালগাছের মধ্যে। আনন্দ তাঁকে সেখানে যত্ন করে শুইয়ে রেখে একটু দূরে গিয়ে খুব কাঁদলেন। বুদ্ধ তাঁকে ডেকে এনে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালেন যে, সমস্ত প্রাণীকেই একদিন মরতে হয়। এ নিয়ে এত বিচলিত হওয়া কি ঠিক? বললেন, তাঁর কিছু বলার কথা আছে, তাই আনন্দকে বললেন, শিষ্যদের ডেকে দিতে। দলে দলে লোকেরা এসে দাঁড়াল। বুদ্ধ তাদের বললেন, ধর্ম, সঙ্ঘ (সাধুদের আশ্রম) ও বুদ্ধকে মনে রেখে তারা যেন নিজেদের জীবন চালায়, যাতে বারেবারে জন্ম না হয় তার চেষ্টা যেন করে, সে জন্য যেন মন থেকে সব রকমের লোভকে সরিয়ে দেয়। খানিক পরে ধীরে ধীরে তাঁর নিঃশ্বাস থেমে গেল। সে দিনও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। সমস্ত লোকই গভীর ভাবে শোকে ডুবে রইল; ভক্তরা খুব ঘটা করে মৃতদেহের সৎকার করল। দ্রোণ নামে এক শিষ্য বললেন, গৌতম বুদ্ধর নির্দেশ, তাঁর দেহ যেন পূজার জন্যে ব্যবহার না করা হয়। তাই তাঁর দেহের অবশেষের কিছু কিছু নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আটটি স্তূপ করা হল।

তখনকার ধর্ম ছিল, বহু পশু বধ করে মহা ধুমধাম করে যাগযজ্ঞ করা; সেটা বুদ্ধ মানলেন না। আর এক রকমের ধর্ম ছিল, শরীরকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে উপবাস করে, না ঘুমিয়ে, নানা কষ্টকর অবস্থায় বসে-দাঁড়িয়ে ধ্যান করে যাওয়া; এ-ও বুদ্ধ মানলেন না। অতিরিক্ত ভোগসুখের জীবনকে যেমন তিনি বারণ করেছিলেন, বাড়াবাড়ি রকম কষ্টকর সাধনাতেও তেমনই তাঁর একেবারেই সায় ছিল না; তাই তাঁর মতকে ‘মধ্যম পন্থা’ বলা হয়। তাঁর মতে চারটি আর্য সত্য ছিল— মৈত্রী (সকল জীবনকে ভালবাসা), করুণা (সকল জীবের প্রতি দয়া), মুদিতা (সকল জীবের প্রতি সহানুভূতি) ও উপেক্ষা (মনটাকে শান্ত, অবিচল রাখা)। সংসারে নানা রকম দুঃখ আছে, সে সব দুঃখের কারণও আছে, দুঃখকে বিনাশ করাও যায় এবং তার উপায়ও আছে। উপায় হল, মন থেকে সমস্ত বাসনা ঝেড়ে ফেলা, লোভকে উপড়ে ফেলা। এটা করতে পারলেই মনে শান্তি থাকবে। নিজের সমস্ত সাধ্য দিয়ে সব জীবের ভাল করাই একমাত্র ধর্ম। বুদ্ধকে মাঝে মাঝেই লোকেরা ভগবান, আত্মা, পরলোক এ সব নিয়ে প্রশ্ন করত, তিনি কখনওই এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতেন না, চুপ করে থাকতেন। ভাবটা যেন, পৃথিবীতে এই জীবনের চোখের সামনে মানুষের এত দুঃখকষ্ট যখন দেখা যাচ্ছে, তখন সেগুলো দূর করাই তো প্রথম কাজ; ওই সব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকারই নেই।

বুদ্ধের কাছ থেকে পৃথিবী নতুন যা পেল তা হল, জীবমাত্রকেই ভালবাসতে হবে। সমস্ত জীবই তাঁর চোখে সমান ছিল। তাই জাতপাত তিনি একেবারেই মানতেন না, নাপিত উপালি ও তাঁর শিষ্য, যে আম্রপালী অশুচি জীবনযাপন করত, সে-ও যখন পুরনো জীবন থেকে নতুন দিকে মোড় ঘুরল তখন বুদ্ধের দয়া পেল, দীক্ষা নিয়ে তাঁর ভক্ত হল। খুনেডাকাত অঙ্গুলিমালও অন্যায় পথ ছেড়ে এসে তাঁর শিষ্য হল; কামারের ঘরে শুয়োরের মাংসও তাই তিনি খেতে পারেন। জাতিভেদ তখনকার সমাজের মস্ত বড় এক অভিশাপ ছিল, তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করলেন বুদ্ধ। বললেন, জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ বা চণ্ডাল হয় না, কর্মের দ্বারাই হয়। বড়লোকেরা বহু পশু মেরে খুব জাঁকজমক করে নানা যজ্ঞ করত, বুদ্ধ বললেন, ওতে ধর্ম নেই। ধর্ম তবে কীসে আছে? সকল প্রাণীকে ভালবাসার মধ্যে, যথাসাধ্য তাদের উপকার করাতেই আছে আসল, একমাত্র ধর্ম। তাঁর শাস্ত্র পড়ি, ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়, লোকানুকম্পায়ৈ, মহতো জনকায়স্যার্থায়, মানে, বহু মানুষের মঙ্গলের জন্যে, বহু মানুষের সুখের জন্য, প্রাণীদের প্রতি মমতার বশে, বৃহৎ মানবজাতির জন্যে।’

এর চেয়ে বড় করে ধর্মকে কেউ কখনও ভাবেনি, এর চেয়ে উঁচু করে ধর্মকে কেউ কখনও দেখেনি; তাঁর আগেও নয়, তাঁর পরেও নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বুদ্ধের জীবন থেকে

বুদ্ধের জীবন থেকে

বুদ্ধের জীবন থেকে

আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগেকার কথা। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন সারা পৃথিবীরই একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ, আজও তিনি সারা পৃথিবীর প্রথম সারির এক মহামানব। ইনি আমাদের কী দিয়ে গেলেন?

সেই সময় হিমালয়ের দক্ষিণে নেপাল বিহারের সীমার কাছে শাক্যবংশের রাজ্য ছিল, সেখানে রাজা তখন শুদ্ধোদন, তাঁর রাজধানী ছিল কপিলাবস্তু। শুদ্ধোদনের পাটরানি ছিলেন। মায়াদেবী। এক বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে মায়াদেবী তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম দেবার জন্যে যখন। বাপের বাড়ি যাবেন বলে বেরিয়েছেন তখন পথের মধ্যে দুটি শালগাছের ফাঁকে জন্ম হল তাঁর ছেলের। ছেলের জন্মের সাত দিন পরেই মায়াদেবী মারা গেলেন, তাঁর বোন মহাপ্রজাপতি, শুদ্ধোদনের আর এক রানি, শিশুটিকে মানুষ করবার ভার নিলেন। ছেলের নাম হল সিদ্ধার্থ। গৌতম কুলে জন্ম বলে ওই নামটাও রইল।

ছেলের জন্মের কয়েকদিন পরেই রাজা জ্যোতিষীদের ডাকিয়ে এনে বললেন, তাঁরা যেন গণনা করে বলে দেন, ছেলে বড়ো হয়ে কী হবে। তাঁরা শুনে বললেন, ‘হয় এ ছেলে বড়ো হয়ে মস্ত রাজাধিরাজ হবেন, নয়তো এমন সাধু হবেন যিনি মানুষকে মুক্তির পথ বলে দেবেন। এর কয়েকদিন পরেই খুব বুড়ো এক ঋষি এলেন রাজসভায়, নাম অসিত, দেখতে চাইলেন শিশুটিকে। ছেলেকে আনা হলে দেখে অসিত প্রথমে হাসলেন। তারপরে কাঁদলেন। তা দেখে রাজা জানতে চাইলেন কেন ঋষি এমন করলেন। অসিত বললেন, এ ছেলে বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবেন, মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবেন। এমন সুলক্ষণ ছেলেকে নিজের চোখে দেখতে পেয়েছেন বলে তিনি হেসেছেন; কিন্তু এখন তাঁর এত বয়স হয়েছে যে, যতদিন ছেলেটি বড়ো হয়ে ওই জ্ঞান লাভ করবেন, ততদিন তো তিনি বাঁচবেন না। তাই সেই শুভদিন দেখা তাঁর ভাগ্যে ঘটবে না, সেই দুঃখে তিনি কেঁদেছেন! এ কথা শুনে রাজার খুব দুশ্চিন্তা হল; কারণ অসিতের আগে জ্যোতিষীরাও বলে গিয়েছিলেন যে, ছেলেটি সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। রাজা তো চান ছেলে রাজাধিরাজই হন, তাই তিনি ভাবলেন, ছেলে যদি পৃথিবীর ভোগসুখে একেবারে মেতে থাকে তো আর সাধু হয়ে যাবে না। সেই উদ্দেশ্যে তিনি রাজবাড়িতে অনেক দাসদাসী, নাচগান, খাওয়াদাওয়া, কাপড়-গয়না, উৎসবের আয়োজন করলেন, যাতে ছেলে রাজবাড়িতেই আটকে থাকে। ছেলের কিন্তু সেসব দিকে মন ছিল না। গল্পকথা বলে যে, সিদ্ধার্থ বালক বয়সে প্রথমদিন পাঠশালায় গিয়ে গুরুমশায় ও অন্য ছাত্রদের সামনে বর্ণমালার এক একটি অক্ষর দিয়ে একটি করে ছড়া বেঁধে শোনাতেন, আমরা যেমন অ’য়ে অজগর আসছে তেড়ে’ বলে অক্ষর শিখি অনেকটা সেই রকমেরই, কেবল তাঁর ছড়াগুলোর মানে হল, মানুষ যেন ভোগসুখ থেকে মন

সরিয়ে নেয়, মায়ানমাহে আটকে না থাকে। সিদ্ধার্থের স্বভাব ছিল খুব চুপচাপ ধরনের। একবার রাজবাড়ির সকলে এক চাষি-গাঁয়ে বেড়াতে গেলেন। সকলে ঘুরে ফিরে দেখছেন, খানিক পরে দেখা গেল, রাজকুমার তাঁদের সঙ্গে নেই, খোঁজ করে দেখা গেল তিনি একটি গাছতলায় চুপ করে বসে আছেন, যেন ধ্যানে বসেছেন। লোকজনের ডাকাডাকিতে উঠে এলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর লেখাপড়া শেখা হল। ক্ষত্রিয়ের ছেলে, তাই তির ধনুকের ব্যবহার ও তলোয়ার চালানো এ সবও শিখতে হল; লেখাপড়ার মতো সব কিছুই তিনি অনায়াসে খুব ভাল করেই শিখে নিলেন।

খানিকটা বড়ো হলে শুদ্ধোদন মনে করলেন, এবারে বিয়ে দিলে ছেলের মন সংসারে বসবে, তা হলে আর ভয় থাকবে না। দণ্ডপাণি নামে এক শাক্য নেতার মেয়ে গোপার (যশোধরা নামও কোথাও কোথাও পাওয়া যায়) সঙ্গে সিদ্ধার্থের বিয়ে হল। মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনই সৎ ও সাহসী। রাজা মনে করলেন, ছেলে এবার সংসারী হল, আর ভয় নেই। কিছুকাল পরে একটি ছেলেও হল, তার নাম হল রাহুল। শুদ্ধোদন আরও নিশ্চিত হলেন, ছেলে সংসারে আটকে থাকবে। যাতে কোনো অনর্থ না হয় তাই তিনি ব্যবস্থা করলেন যাতে কোনো কষ্টের দৃশ্য সিদ্ধার্থের চোখে না পড়ে। এমনই রাজার কপাল যে, এত ব্যবস্থা সত্বেও একদিন সিদ্ধার্থ বেড়াতে যাবার আগে দেখতে পেলেন একটি খুনখুনে বুড়ো অতি কষ্টে লাঠি ভর করে হাঁটছে; এমন দৃশ্য আগে দেখেননি তাই সারথি ছন্দক বলল, অনেক বয়স হলে সব মানুষই ওইরকম দুর্বল, অসহায় হয়ে পড়ে। শরীরে কোনো জোর থাকে না তো তাই লাঠি ভর করে হাঁটতে হয়। শুনে সিদ্ধার্থের মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। আরো একদিন বেড়াতে বেরিয়ে একটি মানুষকে দেখলেন, কঠিন অসুখে ভুগে ভুগে তার একবারে হাড়-চামড়া-সার চেহারা হয়েছে। ছন্দক বলল, রোগব্যাধিতে ভুগলে মানুষ অমনই রোগা, দুর্বল হয়ে যায়। মনটা ভারী হয়ে গেল সিদ্ধার্থের। আবার একবার পথে দেখলেন, খাটিয়ায় শুইয়ে একটি শবদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ছন্দকের কথায় জানলেন, প্রত্যেক মানুষকেই একদিন ওইভাবে মরতে হবে, বুঝতে পারলেন, ওই হল মৃত্যুর চেহারা, যে মৃত্যু সমস্ত মানুষেরই জীবনের শেষ পরিণতি। তা হলে বেঁচে থাকার মানে কী? ভাবিয়ে তুলল রাজকুমারকে। আর একদিন পথে দেখতে পেলেন, এক সাধু চলেছেন ধীর পায়ে, ভারী শান্ত, সুন্দর মুখের ভাব। ছন্দক বলল, লোকটি সংসারের মায়ার বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে পড়েছে, তাই ওইরকম নিশ্চিন্ত চেহারা তার। এই চারটি দেখা নিয়ে অবিরত ভাবতে লাগলেন রাজকুমার। শুদ্ধোদন সর্বদাই রাজবাড়িতে খাওয়াদাওয়া, সুন্দরী মেয়েদের নাচগান ও নানা উৎসবের ব্যবস্থা করে রেখেছেন, কিন্তু সিদ্ধার্থের সে সবে মন নেই।

তাঁর বয়স যখন উনত্রিশ বছর তখন অনেকদিন ধরে অনেক ভেবে তিনি ঠিক করলেন, সংসারের ভোগসুখের মধ্যে জড়িয়ে থাকলে জীবনকে ঠিক করে বোঝা যাবে না। তখনকার লোকে বিশ্বাস করত যে, মানুষ মারা যাবার পরে আবার ভিন্ন ভিন্ন দেহ নিয়ে জন্মায়। এই জন্মান্তরের ধারার শেষ কোথায়? কীসে? এইসব ঠিক করে বুঝে নেবার জন্যে তাঁর মনে হল, পথে দেখা ওই সাধুটির মতো যদি কোনো পিছুটান না রেখে সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়েন তা হলে হয়তো সব কিছুর কিনারা করতে পারবেন। রাজবাড়ির ভিড়, উৎসব, বিলাস, গোপা, রাহুল এ সবই বন্ধন, এর থেকে এখনই না বেরোতে পারলে আরো জড়িয়ে পড়তে হবে।

এক রাত্রে ঘুমন্ত স্ত্রী ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে তাদের কাছে বিদায় নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে ছন্দককে বললেন, তাঁর প্রিয় ঘোড়া কণ্ঠককে নিয়ে আসতে। রথে চড়ে রাজপুরী থেকে খুব তাড়াতাড়ি অনেক দূরে চলে এলেন। রথ থেকে নেমে তাঁর যা রাজকুমারের পোশাক গয়না তা খুলে ছন্দককে দিলেন ও ছন্দক আর কণ্ঠককে বিদায় দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ছন্দক কাঁদতে কাঁদতে রাজবাড়িতে গিয়ে সব জানালেন। রাজকুমার একদিকে নিজের তলোয়ার দিয়ে চুল হেঁটে নিলেন ও সাধারণ জামাকাপড় পরে পথে চলতে লাগলেন। রাজবাড়ি থেকে যখন খোঁজাখুজি শুরু হল তার আগেই তিনি বহু পথ পেরিয়ে এসেছেন।

পথে দুজন সাধুর সঙ্গে দেখা, তাঁদের নাম আরাড় কালাম ও রুদ্রক রামপুত্র। এঁদের কাছে দীক্ষা নিয়ে সিদ্ধার্থ ছ-বছর ধরে খুব কঠিন তপস্যা করলেন। প্রথমে যৎসামান্য খেয়ে নানা কষ্টকর ভঙ্গিতে বসে দাঁড়িয়ে শরীরকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে একমনে সাধনা। ক্রমে নামমাত্র খাওয়া, তারপরে পুরো উপবাস, শরীর কঙ্কালসার হয়ে গেল। কিন্তু যে জ্ঞান পাবার জন্যে এত কষ্ট কেন মানুষের জীবনে রোগের কষ্ট, বুড়ো বয়সের কষ্ট, মরণের যাতনা, ফিরে ফিরে জন্মে এই সবকিছুতেই ফিরে ফিরে ভোগা— তার কোনো কূলকিনারা পাওয়া গেল না। তখন তিনি ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন এটা ঠিক পথ নয়। রাজবাড়ির ভোগবিলাসেও যেমন ঠিক করে জীবনকে বোঝা যায় না, তেমনই শুধু শুধু শরীরকে এত কষ্ট দিয়ে যে সাধনা তা দিয়েও জীবনকে বোঝা যায় না, তখন ওই সাধনা ছেড়ে দেওয়াই ঠিক করলেন।

এইবার সিদ্ধার্থ নৈরাঞ্জনা নদীতে স্নান করে উঠে দেখলেন গ্রামের একটি মেয়ে, সুজাতা তাঁর জন্যে পায়েস বেঁধে এনেছে। বহুদিনের উপবাসের পরে ভারী তৃপ্তি করে পায়েসটা খেলেন। তাঁর তপস্যার সময়টায় তাঁর সেবা করত চারটি লোক, তারা যেই দেখল তিনি কঠিন তপস্যা ছেড়ে স্নান খাওয়া করলেন অমনি বিরক্ত ও হতাশ হয়ে তারা তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। তখন এক ঘেসেড়া তাঁকে এক মুঠো ঘাস দিল। একটা মস্ত ঝাঁকালো বটগাছের নীচে সেই ঘাস বিছিয়ে আসন তৈরি করে তিনি ধ্যানে বসলেন। ঠিক করলেন, ওই আসনে বসে তাঁর শরীর যদি শুকিয়ে যায়, চামড়া হাড় মাংস যদি শেষও হয়ে যায় তবুও বহুকালের সাধনায় যে দুর্লভ বোধ (সত্যজ্ঞান) পাওয়া যায়, তা না পেয়ে তিনি ওই আসন ছেড়ে উঠবেন না।

মানুষের সব ভালো কাজ পণ্ড করে একটি মন্দ শক্তি, এমন বিশ্বাস ছিল কিছু লোকের। তাঁরা এ শক্তিকে ‘মার’ নাম দিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থের একমনে সাধনা করার ব্যাপারে মারের টনক নড়ল। এভাবে যদি ইনি বোধি, সত্যজ্ঞান লাভ করেন তা হলে তো পৃথিবীর মানুষ আর জরা মরণের অধীন থাকবে না। মারের শক্তি অনেক, তাই তার ইচ্ছেয় হঠাৎ ভীষণ ঝড়বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বাজপড়া শুরু হয়ে গেল। এদিকে ‘মুচলিন্দ’ নাগ, প্রকাণ্ড বড় একটা সাপ, বুদ্ধের ওপরে সদয় হয়ে তার মস্ত ফণা ছড়িয়ে রাখল সিদ্ধার্থের মাথার ওপরে, তাই ঝড়বৃষ্টিতে তাঁর কোনো ক্ষতিই হল না, তাঁর মনেও কোনো অস্থিরতা এল না, তিনি একমনে যেমন ধ্যান করছিলেন তাই করতে লাগলেন। তখন নিরুপায় হয়ে মার সরাসরি তাঁর সামনে এসে বলল, ‘তোমাকে সারা পৃথিবীর রাজা করে দেব তুমি এ সাধনা ছেড়ে উঠে পড়ো। আমার এমন শক্তি আছে যার বলে তুমি পরের জন্মে স্বর্গে জন্মাবে, ছেড়ে দাও এ তপস্যা।’ এমনই নানা লোভ ও ভয় দেখাতে লাগল মার, কিন্তু সিদ্ধার্থ একটুও বিচলিত হলেন না, যেমন একমনে ধ্যান করছিলেন তেমনই করতে লাগলেন। তখন মার হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। এবার রাতে এক এক প্রহরে এক একটি চেতনা সিদ্ধার্থের মনে আসতে লাগল। তিনি বুঝলেন মানুষের মনের লোভ ও বাসনা কামনাই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সারা জীবন, এবং মৃত্যুর পরেও এক জন্ম থেকে আর এক জন্ম। কোনোমতে যদি বাসনাকে মন থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে পারা যায়, তা হলে এই জন্ম— শৈশব, কৈশোর, যৌবন, জরা, ব্যাধি, মরণ, আবার ফিরে ফিরে জন্মানো এসবের সুতোটা ছিড়ে যায়। কারণ লোভ থেকেই সবের শুরু মরণকালে মনে যে লোভ থাকে তাই মেটাবার জন্যে আবার ফিরে আসতে হয়। জরা-অসুখ-মরণেরও পুনর্জন্মের বশে আসতে হয়। ওই লোভকে মন থেকে উপড়ে ফেলতে পারলেই এসব থেকে ছুটি পাওয়া যায়।

চার সপ্তাহ কাটল ওই বটগাছের নীচে এই চিন্তাগুলোকে স্পষ্ট করে বুঝে নিতে। বুঝলেন, দুঃখ যেমন আছে, তেমনই আছে দুঃখের কারণ, আর আছে দুঃখের শেষ এবং শেষ করবার উপায়। (এই চারটি সত্যকে বৌদ্ধরা বলেন দুঃখ, দুঃখহেতু, দুঃখহানন এবং হানোপায়)। এই যে নতুন জ্ঞান তারই নাম বোধি, যে জ্ঞান মুক্তি আনে। বোধি লাভ করে সিদ্ধার্থ বুদ্ধ হতে চলেছেন। দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে মার তার সুন্দরী তিন মেয়েকে পাঠাল, তারা হাবভাব নাচগানের প্রলোভনে সিদ্ধার্থকে বোধির পথ থেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল, কিন্তু এসবে তিনি ভুললেন না। তা দেখে মারের মেয়েরা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। মার ও তার মেয়েদের প্রলোভন জয় করে যে জ্ঞান তাঁর এল সেই বোধি লাভ করে তিনি বুদ্ধ হলেন। তখন তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর।

চার সপ্তাহ ওই বোধি-বটগাছের নীচে ধ্যান করবার পর তাঁর কাছে দুটি বণিক এল, নাম এপুষ ও ভল্লিক। তারা বাণিজ্যের পথে যেতে যেতে বোধিবটের নীচে বুদ্ধের শান্ত সুন্দর মূর্তি দেখে ভক্তিভরে তাঁর কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করল, তাদের দেওয়া খাবার খেতে। পাথরের থালায় তাদের দেওয়া ভাত আর মধুভরা পিঠে খেলেন বুদ্ধ। তাদের শোনালেন তাঁর নতুন। পাওয়া জ্ঞান, বোধির কথা, আশীর্বাদ করলেন। এই পুষ ও ভল্লিকই বুদ্ধের প্রথম গৃহী শিষ্য।

এরপরে বুদ্ধ বসে বসে ভাবতে লাগলেন, তাঁর এই নতুন জ্ঞান নিয়ে তিনি কী করবেন। লোকেদের মধ্যে প্রচার করলে তারা কি ঠিকমতো ধরতে পারবে তাঁর কথা? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করলেন, বোধির জ্ঞান মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া চাই। প্রথমে খোঁজ করলেন, তাঁর আগের চেনা দুই সাধু, সেই আরাড় কালাম ও রুদ্রক রামপুত্রের; কিন্তু ততদিনে তাঁরা মারা গেছেন। কাজেই বুদ্ধ তখন চললেন, বারাণসীর পথে। আগেকার পরিচিত ছ-টি সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন। এঁদের নাম নিপ্রস্থ জ্ঞাতপুত্র, অজিত কেশকম্বলী, পূরণ কাশ্যপ, ককুদ কাত্যায়ণ, সঞ্জয় বৈরাটীপুত্র ও মস্করী গোশাল। বুদ্ধ যে কঠোর সাধনা ও শরীরকে পীড়া দেবার সাধনা ছেড়ে দিয়েছেন, এ কথা এঁরা আগেই শুনেছিলেন, তাই ঠিক করেছিলেন দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে নমস্কার করবেন না। কিন্তু মুখে মধুর হাসি নিয়ে ধীর শান্ত পায়ে বুদ্ধ যখন তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন, তখন তাঁরা অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে পড়লেন; কী যে হল, আপনা আপনিই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার করলেন। বুদ্ধ তাঁদের কাছে তাঁর জ্ঞান প্রচার করলেন; একদিকে যেমন পশুবধ করে যজ্ঞ করা অন্যায়, অন্যদিকে তেমনই শরীরকে কঠোর পীড়া দিয়ে যে-সাধনা তা-ও ঠিক পথ নয়, যেমন ঠিক নয় অতিরিক্ত ভোগবিলাসে ডুবে থাকা। যজ্ঞ আর কঠোর সাধনা এই দু-ভাবেই তখনকার সমাজে লোকে ধর্ম আচরণ করত; বুদ্ধ দুটোকেই বাদ দিলেন বলে তাঁর পথকে মধ্যম পন্থা বলে। বুদ্ধ তাঁর সাধু-শিষ্যদের বললেন, ‘মনের মধ্যে লোভ জয় করে লোকের বাড়ি ভিক্ষে চেয়ে একবেলা খেতে, সাধারণ পোশাক পরতে ও সাদাসিধে জীবন যাপন করতে। মানুষের মঙ্গল হয় এমন কাজ করতে ও লোকেদের তাঁর নতুন জ্ঞান শেখাতে। সে সময়ে সব শাস্ত্রই সংস্কৃত ভাষায় লেখা হত, পণ্ডিতরা ছাড়া সে ভাষা কেউই বুঝত না, তাই বুদ্ধ বিশেষ করে তাঁর শিষ্যদের বলে দিলেন যে, তারা যখন যে দেশে যাবে, সেখানকার ভাষাতেই প্রচার করবে, সংস্কৃতে নয়। এ কথা তাঁর শিষ্যরা মেনেছিলেন। উরুবেল কাশ্যপ, নদী কাশ্যপ, গয়া কাশ্যপ এঁরা তখন যজ্ঞ করছিলেন বুদ্ধ এসে দাঁড়ালেন তাঁদের সামনে, বাধা পড়ল যজ্ঞে, বুদ্ধ তখন তাঁর নতুন জ্ঞানের বাণী এদের শোনালেন, তাঁরা বুদ্ধের পথকে আপনার করে নিলেন। এর মধ্যে আরো বেশ কিছু গৃহীভক্ত হয়েছে তাঁর, ভদ্রিক, মহানাম, অশ্বজিৎ, যশ ইত্যাদি পঞ্চাশ জনের মতো। বুদ্ধ এঁদের কাছেও ভালো করে তাঁর বাণী বুঝিয়ে বলে এদের পাঠালেন মানুষের কাছে প্রচার করতে।

গয়ায় এসে প্রচার করলেন বুদ্ধ, সেখান থেকে চলে গেলেন রাজগৃহে। গিয়ে শুনলেন রোহিণী নদীর জলের ভাগ নিয়ে তুমুল ঝগড়া চলছে শাক্য আর কলীয়দের মধ্যে। তিনি দু-দলকে ডেকে বিচার করে মিটমাট করে দিলেন। থেমে গেল বহু বছরের বিবাদ। রাজগৃহ ছিল মগধের রাজা বিম্বিসারের রাজধানী। বিম্বিসারের কাছে আগে একসময় বুদ্ধ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবার পরে সেখানে আসবেন। এবারে তাই এসে রাজার সঙ্গে দেখা করলেন। রাজা। তাঁর আর তাঁর শিষ্যদের জন্যে অনেকখানি জমি সমেত মস্ত এক বাঁশবাগান দান করলেন, এটিই হল তাঁর ‘বেণুবনবিহার’। এই সব বিহারে বৌদ্ধরা অনেকে একসঙ্গে থাকবার জন্য সঙ্ তৈরি করত, বিশেষত বর্ষার মাস কটা নিরাপদে কাটানোর জন্যে। এই রাজগৃহেই সারিপুত্র ও মৌদগল্যায়ন নামে তাঁর দুই বিখ্যাত শিষ্য তাঁর কাছে দীক্ষা নেন। এখানে তাঁদের থাকার আশ্রম বাড়িতে কুমারভৃত্য (অর্থাৎ শিশুদের চিকিৎসক) জীবক অসুস্থ হলে বুদ্ধ তাঁকে সুস্থ করে দেন ও দীক্ষা দেন।

বোধিলাভের একবছর পরে পিতা শুদ্ধোদন বারবার তাঁকে ডেকে পাঠালে বুদ্ধ অবশেষে কপিলাবস্তুতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। এবার গোপার চোখে সন্ন্যাসীর চীরবাস পরা স্বামীকে যেন আগের চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাল। মায়ের কথায় ছেলে রাহুল এসে বাবার কাছে তাঁর সম্পত্তির ভাগ চাইল, বুদ্ধ তাকে দীক্ষা দিলেন, বললেন, এই-ই তার উত্তরাধিকার। পিতা শুদ্ধোদন বুদ্ধের কাছে একটি ভিক্ষা চাইলেন— মা-বাবার অনুমতি ছাড়া যেন কোনো ছেলেকে দীক্ষা না দেওয়া হয়। বুদ্ধ রাজি হলেন। এ অনুরোধের মূলে ছিল সমাজে বুদ্ধের নামে কিছু নালিশ— ছেলেরা দীক্ষা নেওয়াতে বহু সংসার ভেঙে যাচ্ছিল, মা-বাবা ছেলেকে, বোন ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে, ছেলেমেয়ে বাবাকে হারিয়েছিল। বহু সংসার নানাভাবে ভেঙে পড়ছিল, তাই বুদ্ধ পরিবারের অনুমতি নেওয়ার কথায় রাজি হলেন।

শাক্য বংশের অনেক বড়ো বড়ো লোকেরা নিজের ইচ্ছেয় এসে বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিলেন। এদের মধ্যে বুদ্ধ সবচেয়ে আগে দীক্ষা দিলেন উপালি নামে এক নাপিতকে। এরা সব বুদ্ধের গৃহী ভক্ত। এর কিছু পরে শুদ্ধোদন মারা গেলেন, তখন বুদ্ধের মাসি মহাপ্রজাপতি গৌতমী, যিনি বুদ্ধকে সাতদিন বয়স থেকে মানুষ করেছিলেন, তিনি এসে বুদ্ধের কাছে প্রব্রজ্যা (সন্ন্যাস) নিতে চাইলেন, বুদ্ধ রাজি হলেন। এই প্রথম ধর্মজীবনে মেয়েরা একটা স্বাধীন অধিকার পেল, যা তাদের আগে ছিল না। মহাপ্রজাপতির ছেলে নদও দীক্ষা নিল।

ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে করতে বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে এসে পৌঁছোলেন। সেখানে সুদত্ত নামে এক ধনী বহু গরিবদের খাওয়াতেন বলে লোকে তাঁকে ‘অনাথ পিণ্ডদ’ বলত। তিনি বুদ্ধের বিশ্রাম ও সাধনার জন্যে আর এক ধনী জেত-র কাছ থেকে প্রকাণ্ড বড়ো একটা বাগান কিনতে চাইলে জেত বলেন, পুরো জমিটাকে মোহরে ঢেকে দিলে যত মোহর হয় তা-ই হবে জমিটার দাম।

সুদত্ত সেই দামেই কিনলেন এবং বুদ্ধ ও তাঁর ভক্তদের উপহার দিলেন এই জেত বনবিহারটি। শ্রাবস্তীতে বিশাখা বলে এক ধনী মহিলাও গরিবদের খাওয়াতেন বলে লোকে তাঁর নাম রেখেছেন ‘অনাথপিণ্ডিকা’; ইনিও এসে বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিলেন। ওই দিকেই থাকত এক খুনে ডাকাত, যত লোককে সে মারত, তাদের একটি করে আঙুল কেটে নিয়ে সুতোয় গেঁথে মালা করে পরত বলে তার নাম হয়েছিল ‘অঙ্গুলিমাল’। বুদ্ধকে দেখে দেখে তার মনে ভক্তি হল বলে। সে খুন-ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে মানুষের ভালো করবার জন্যে বেঁচে থাকতে চাইল। বুদ্ধের কাছে সে দীক্ষা নিল। আম্রপালী নামের মেয়েটার জীবন শুচি ছিল না, সে যখন বুদ্ধের কাছে এসে তাঁকে। লক্ষ করে দেখল ও তাঁর বাণী শুনল, তখন তার বাসনা হল, শুচি পরোপকারী জীবনে বাঁচতে। বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নিয়ে সে তার মস্ত বড়ো আমবাগানটা বুদ্ধ ও ভক্তদের দিয়ে দিল। এমনি করে অনেক ধনী ভক্ত বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নেওয়া সাধকদের থাকবার জন্য সঙ্ঘারাম ও বিহার তৈরি করিয়ে দিত ও সাধুদের খাবার ব্যবস্থা করত।

নানা গ্রামে শহরে প্রচার করতে করতে বুদ্ধের যখন বাহাত্তর বছর বয়স হল, সেই সময়ে মগধের রাজা বিম্বিসারের ছেলে অজাতশত্রু বাবাকে মেরে সিংহাসন দখল করে। এই অজাতশত্রু বৌদ্ধধর্মকে তাড়িয়ে পুরনো ব্রাহ্মণ্যধর্মকে ফিরিয়ে আনার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল। এ ছিল বুদ্ধের মাসতুতো ভাই বুদ্ধের পরম শত্রু দেবদত্তের ভক্ত। দেবদত্ত বুদ্ধকে হিংসা করে নিজে প্রধান ধর্মগুরু হবার চেষ্টা করত। দেবদত্ত ভাড়াটে খুনি দিয়ে বুদ্ধকে মারবার চেষ্টা করে দু-বার, কিন্তু পারেনি। একবার প্রকাণ্ড এক পাথর ছুঁড়ে বুদ্ধকে মারতে যায়, সেটা বুদ্ধের গায়ে লাগলই না। তারপর ‘নালাগিরি নামের এক মস্ত বড়ো হাতির পায়ের তলায় বুদ্ধকে গুঁড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করল, কিন্তু নালাগিরি এসে মাথা নোয়াল বুদ্ধের পায়ের কাছে। দেবদত্ত বুদ্ধের সঙ্গে রেষারেষি করে একটা সঙ্ গড়ল বটে কিন্তু অল্পদিন পরে নিজেই মারা গেল। এই দেবদত্তের ভাই আনন্দ ছিল বুদ্ধের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। আগে শিষ্যরা এক একদিন এক একজন করে বুদ্ধের সেবা করত; সে ব্যবস্থায় বুদ্ধের অসুবিধে হওয়াতে তাঁর জীবনের শেষ পঁচিশ বছর দেবদত্তের ভাই। একাই তাঁর সেবা করেছিলেন। নিজে যেমন কোনো বিশেষ সুবিধে নিতেন না আনন্দ, তেমনই লক্ষ রাখতেন অন্য ভক্তরাও যাতে বুদ্ধের সেবা করবার কিছু সুযোগ পায়, বুদ্ধের সুবিধা অসুবিধের দিকে কড়া নজর ছিল আনন্দর।

কোশলের রাজা প্রসেনজিতের ছেলের সঙ্গে শাক্য রাজকন্যার বিয়ের কথা ছিল, কিন্তু প্রসেনজিতের মা নিচু বংশের মেয়ে ছিলেন বলে শাক্যরা তার ছেলের সঙ্গে তাঁদের কোনো রাজকন্যার বিয়ে না দিয়ে এক দাসীর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিল। তার ছেলে বড়ো হয়ে যখন একবার মামার বাড়িতে এল, তখন তাদের ব্যবহারে অবহেলা দেখে খোঁজখবর নিয়ে আসল ব্যাপারটা জানতে পারল এবং ভীষণ রেগে গেল। ফিরে গিয়ে সৈন্যসামন্ত এনে কপিলাবস্তু আক্রমণ করে সমস্ত শাক্যদের মেরে ফেলল। বুদ্ধ তাকে এ কাজ করতে বারবার বারণ করেছিলেন। সে শুনল না। বুদ্ধের বংশের সব মানুষকে এমনভাবে মেরে ফেলাতে তিনি খুবই আঘাত পেয়েছিলেন।

বুদ্ধের বয়স যখন প্রায় আশি বছর, তখন তাঁর মনে হল, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। তাই আনন্দকে ডেকে ধর্ম বিষয়ে অনেক উপদেশ দিলেন। শরীরের বল কমে গেলেও কিন্তু বুদ্ধ কাজ ঠিকই করে যেতে লাগলেন, এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, এ শহর থেকে ও শহরে ঘুরে ঘুরে তিনি লোকদের মধ্যে প্রচার করে যেতে লাগলেন, যে জ্ঞান বোধিতে পেয়েছিলেন তা-ই সকলকে বোঝাতে লাগলেন। পথে পাবাপুরীতে চুন্দ নামে এক কামারের বাড়িতে খেলেন ‘সুকুর মদ্দর’; কেউ বলে এটা হল ব্যাঙের ছাতা, কেউ বলে কচি শুয়োরের মাংস। যাই হোক, খাবার পর তাঁর। খুব পেটের অসুখ করল। বুড়ো বয়সে অসুস্থ শরীরে আর হাঁটতে পারছিলেন না, তাই আনন্দকে বললেন, দুটো শালগাছের মাঝের ফাঁকে কাপড় বিছিয়ে দিতে। তাঁর জন্মও হয়েছিল লুম্বিনীতে দুই শালগাছের মধ্যে। আনন্দ তাঁকে সেখানে যত্ন করে শুইয়ে রেখে একটু দূরে গিয়ে খুব কাঁদলেন। বুদ্ধ তাঁকে ডেকে এনে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালেন যে, সমস্ত প্রাণীকেই একদিন মরতে হয়। এ নিয়ে এত বিচলিত হওয়া কি ঠিক? বললেন, তাঁর কিছু বলার কথা আছে, তাই আনন্দকে বললেন, শিষ্যদের ডেকে দিতে। দলে দলে লোকেরা এসে দাঁড়াল। বুদ্ধ তাদের বললেন, ধর্ম, সঙ্ (সাধুদের আশ্রম) ও বুদ্ধকে মনে রেখে তারা যেন নিজেদের জীবন চালায়, যাতে বারেবারে জন্ম না হয় তার চেষ্টা যেন করে, সে জন্য যেন মন থেকে সব রকমের লোভকে সরিয়ে দেয়। খানিক পরে ধীরে ধীরে তাঁর নিঃশ্বাস থেমে গেল। সেদিনও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। সমস্ত লোকই গভীরভাবে শোকে ডুবে রইল; ভক্তরা খুব ঘটা করে মৃতদেহের সক্কার করল। দ্রোণ নামে এক শিষ্য বললেন, গৌতম বুদ্ধর নির্দেশ, তাঁর দেহ যেন পূজার জন্যে ব্যবহার না করা হয় তাই তাঁর দেহের অবশেষের কিছু কিছু নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আটটি স্থূপ করা হল।

তখনকার ধর্ম ছিল বহু পশু বধ করে মহা ধুমধাম করে যাগযজ্ঞ করা; সেটা বুদ্ধ মানলেন না। আর এক রকমের ধর্ম ছিল, শরীরকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে উপবাস করে, না ঘুমিয়ে, নানা কষ্টকর অবস্থায় বসে দাঁড়িয়ে ধ্যান করে যাওয়া; এ-ও বুদ্ধ মানলেন না। অতিরিক্ত ভোগ সুখের জীবনকেও যেমন তিনি বারণ করেছিলেন, বাড়াবাড়ি রকম কষ্টকর সাধনাতেও তেমনই তাঁর একেবারেই সায় ছিল না; তাই তাঁর মতকে ‘মধ্যম পন্থা’ বলা হয়। তাঁর মতে চারটি আর্য সত্য ছিল— মৈত্রী (সকল জীবনকে ভালোবাসা), করুণা (সকল জীবের প্রতি দয়া), মুদিতা (সকল জীবের প্রতি সহানুভূতি) ও উপেক্ষা (মনটাকে শান্ত, অবিচল রাখা)। সংসারে নানারকম দুঃখ। আছে, সে সব দুঃখের কারণও আছে, দুঃখকে বিনাশ করাও যায় এবং তার উপায়ও আছে। উপায় হল, মন থেকে সমস্ত বাসনা ঝেড়ে ফেলা, লোভকে উপড়ে ফেলা। এটা করতে পারলেই মনে শান্তি থাকবে। নিজের সমস্ত সাধ্য দিয়ে সব জীবের ভালো করাই একমাত্র ধর্ম। বুদ্ধকে মাঝে মাঝেই লোকেরা ভগবান, আত্মা, পরলোক এসব নিয়ে প্রশ্ন করত, তিনি কখনোই এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতেন না, চুপ করে থাকতেন। ভাবটা যেন, পৃথিবীতে এই জীবনের চোখের সামনে মানুষের এত দুঃখকষ্ট যখন দেখা যাচ্ছে, তখন সেগুলো দূর করাই তো প্রথম কাজ; ওই সব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকারই নেই।

বুদ্ধের কাছ থেকে পৃথিবী নতুন যা পেল তা হল, জীবনমাত্রকেই ভালোবাসতে হবে। সমস্ত জীবই তাঁর চোখে সমান ছিল। তাই জাতপাত তিনি একেবারেই মানতেন না, নাপিত উপালিও তাঁর শিষ্য, যে আম্রপালী অশুচি জীবন যাপন করত, সে-ও যখন পুরনো জীবন থেকে নতুন দিকে মোড় ঘুরল তখন বুদ্ধের দয়া পেল, দীক্ষা নিয়ে তাঁর ভক্ত হল। খুনেডাকাত অঙ্গুলিমালও অন্যায় পথ ছেড়ে এসে তাঁর শিষ্য হল; কামারের ঘরে শুয়োরের মাংসও তাই তিনি খেতে পারেন। জাতিভেদ তখনকার সমাজের মস্ত বড়ো এক অভিশাপ ছিল, তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করলেন বুদ্ধ, বললেন, জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ বা চণ্ডাল হয় না, কর্মের দ্বারাই হয়। বড়লোকেরা বহু পশু মেরে খুব জাঁকজমক করে নানা যজ্ঞ করত, বুদ্ধ বললেন, ওতে ধর্ম নেই। ধর্ম তবে কীসে আছে? সকল প্রাণীকে ভালোবাসার মধ্যে যথাসাধ্য তাদের উপকার করাতেই আছে আসল, একমাত্র ধর্ম। তাঁর শাস্ত্র পড়ি, ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়, লোকানুকম্পায়ৈ, মহতো। জনকায়স্যার্থায়, মানে, বহু মানুষের মঙ্গলের জন্যে, বহু মানুষের সুখের জন্য, প্রাণীদের প্রতি মমতার বশে, বৃহৎ মানবজাতির জন্যে।’

এর চেয়ে বড়ো করে ধর্মকে কেউ কখনো ভাবেনি, এর চেয়ে উঁচু করে ধর্মকে কেউ কখনো দেখেনি; তাঁর আগেও নয়, তাঁর পরেও নয়।।

সৌজন্যে : নয়া উদ্যোগ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *