ষষ্ঠী

ষষ্ঠী

প্রচলিত ধারণা অনুসারে হরপার্বতীর চারটি সন্তান— লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ।

কী কারণে জানি না, শাস্ত্র এঁদের পিতৃত্ব-মাতৃত্ব হরপার্বতীকে দিতে রাজি ছিল না। তাই লক্ষ্মী উঠলেন সমুদ্র থেকে, সরস্বতী বেরোলেন ব্রহ্মার মাথা থেকে। গণেশ একাই পার্বতীর সন্তান কিন্তু শনির দৃষ্টিতে তাঁর মাথা খসে যাওয়ায়, এক হাতির মাথা এনে তাঁর খসে-যাওয়া মাথার জায়গায় বসানো হল। মুশকিল হল কার্তিককে নিয়ে; তাঁর পিতৃত্ব প্রকারান্তরে শিবকে দেওয়া হলেও, মাতৃত্ব কিছুতেই পার্বতীকে দেওয়া গেল না। তাই শিবের বীর্যপাত ঘটল গঙ্গাতে। গঙ্গা তার অসহ্য তাপে অস্থির হয়ে সেটি ফেললেন নদীতটের এক শরবনে। সেখানে অতি সুন্দর এক শিশু জন্মাল। সমস্যা হল তার লালন নিয়ে। কাজেই ষট্ কৃত্তিকা তাঁর স্তন দান করবেন বলে তাঁর ছ’টি মুখ উদ্গত হল, তাই নাম যন্মুখ। অর্থাৎ কার্তিক শিবের ঔরসপুত্র কিন্তু পার্বতীর গর্ভজাত নয়।

এই ষট্ কৃত্তিকা থেকেই ষষ্ঠীর কল্পনা; কিন্তু কৃত্তিকারা ছ’-জন হলেও ষষ্ঠী একক দেবী। পরবর্তী দু’টি পুরাণে— ব্রহ্মবৈবর্ত ও দেবীভাগবত দু’টি উপাখ্যানে ষষ্ঠীকে তৎকালীন দেবমণ্ডলীতে স্বতন্ত্র দেবীর মর্যাদা দিয়ে উপস্থিত করা হয়। দু’টি উপাখ্যানের মাধ্যমে এঁদের মর্তে আবির্ভাব।

স্বয়ম্ভূমনুর পুত্র রাজা প্রিয়ব্রত পত্নী লাভের জন্য তপস্যা করলেন। পরে ব্রহ্মার আজ্ঞায় বিবাহ করেন। কিন্তু একটি পুত্রও লাভ করতে পারেননি। তখন পুত্রেষ্টি, কশ্যপ মুনির নির্দেশে তাঁর পত্নী মালিনীকে যজ্ঞচরু দান করলেন। মালিনীর গর্ভ দ্বাদশবর্ষব্যাপী হয়, অবশেষে সুদর্শন একটি পুত্র লাভ করেন। কিন্তু পুত্রটি মৃতই জন্মাল। সর্বাঙ্গসুন্দর ওই মৃত পুত্রটি ঊর্ধ্বলোচন হয়ে জন্মায়। তাকে দেখে পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন সকলেই কান্নাকাটি করতে লাগলেন, অনেকে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন।

কিছুক্ষণ পরে মৃত সন্তানটিকে কোলে নিয়ে রাজা অন্ত্যেষ্টির জন্যে শ্মশানে এলেন। এবং আত্মহনন করতে সংকল্প করলেন, এমন সময়ে হঠাৎ দেখলেন, স্বর্গ থেকে রথ নেমে আসছে, তাতে আসীন শুভ্রবসনা এক সুন্দরী দেবী। প্রিয়ব্রত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কার কন্যা, কার বধু, সুন্দরী।’ তিনি বললেন, আমি ব্রহ্মার মানসকন্যা, আমার নাম দেবসেনা পিতা আমাকে স্কন্দকে দান করেছেন। মাতৃকাদের মনে ষষ্ঠী এই নামে আমি বিখ্যাত। স্কন্দের ভার্যারূপে প্রসিদ্ধা, পৃথিবীতে ষষ্ঠী নামে পরিচিতা। আমি অপুত্রককে পুত্র দিই, নারীকে তাঁর প্রিয় এনে দিই, দরিদ্রকে ধন দিই, দুঃখীকে সুখ। কর্মবশে কেউ বহুপুত্রক হয়, আবার কেউ বা হয় পুত্রহীনা। রূপ, রস, ধন, যশ, আরোগ্য সবই কর্ম দ্বারাই মানুষ পায়। আমার বরেও পায়।

এ কথা বলে দেবী বালকটিকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। রাজা সেই জীবিত পুত্রটিকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, কিন্তু দেবী বালকটিকে নিয়ে আকাশে যেতে উদ্যত হলে, শুষ্কতালু হতাশ রাজা দেবীর স্তব করলেন। তুষ্টা দেবী বললেন, তুমি রাজা স্বয়ম্ভুমনুর পুত্র। যদি আমার পূজা সর্বত্র প্রচার করো, তবেই আমি তোমাকে তোমার পুত্র ফিরিয়ে দেব। ত্রিলোকের রাজা তুমি স্বয়ম্ভূমনুর পুত্র; সর্বত্র আমার পূজা ও স্তবের প্রবর্তন করো, তা হলে তোমাকে কুলের গৌরবস্বরূপ মনোহর পুত্র দেব। রাজা সম্মত হলেন, দেশে ষষ্ঠীপূজা প্রচলিত হল। এই কাহিনিটি দেবীভাগবত উপপুরাণে আছে।

আবার এই গ্রন্থে অন্যত্র শুনি— ষষ্ঠী, মঙ্গলচণ্ডী আর মনসা প্রকৃতিরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। ষষ্ঠী পুত্রহীনকে পুত্র দেন, স্বল্পায়ু পুত্র দীর্ঘায়ু করেন। অবশ্য পুত্রদের কর্মও এই সব ব্যাপারে ক্রিয়াশীল। রাজা অঙ্গীকার করলে, সুন্দর সুদর্শন পুত্রটিকে রাজাকে দিয়ে দেবী স্বর্গে গেলেন।

রাজা গৃহে এলে, বহু লোক এই কাহিনিটি শুনলেন। রাজা ব্রাহ্মণদের ধনদান করলেন, এবং বিধিমতো তিথিতে তিথিতে ষষ্ঠীপূজা করতে লাগলেন। অন্য যাঁরা তাঁর কাহিনি শুনেছিলেন, তাঁরাও এই ভাবে পূজা ও স্তবে ষষ্ঠী আরাধনা করতে লাগলেন। ফল, মূল, নৈবেদ্য, পাদ্য, অর্ঘ্য, স্তব ও মন্ত্র-সহকারে ষষ্ঠীপূজা ঘরে ঘরে হতে লাগল। ষষ্ঠীর কাছে ধন, যশ ইত্যাদি সবই চেয়ে পাওয়া যায়। বন্ধ্যা ও মৃতবৎসাও পুত্রবতী হতে লাগল। ষষ্ঠী অতি সমাদরে পূজিত হতে লাগলেন।

শিশুর জন্মের ষষ্ঠ দিনে দেবী ষষ্ঠী তাকে আশীর্বাদ করতে আসেন, এমন বিশ্বাস আছে। প্রকৃতির ষষ্ঠাংশ রূপিণী ষষ্ঠী (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড, ১ম অধ্যায়), সেই দিন ষষ্ঠীর পূজা করতে হয়, গ্রামে এটির নাম ‘যেটেরা’ পূজা। ষষ্ঠী ক্রুদ্ধ বা অসন্তুষ্ট হলে সন্তান আসবে না। এটি একটি প্রচলিত বিশ্বাস। ষষ্ঠী শুধু সন্তান জন্মের ষষ্ঠ দিনেই পূজিত হন না। সারা বছরে বিভিন্ন ষষ্ঠী তিথিতে বিভিন্ন নামে এঁর পূজা পরিচিত। স্কন্দপুরাণে বারো মাসে বারো নামে ষষ্ঠী পূজার কথা পাই— চান্দনী ষষ্ঠী, অরণ্য ষষ্ঠী, কাদসী ষষ্ঠী, লুণ্ঠন ষষ্ঠী, চপেটা ষষ্ঠী, দুর্গা ষষ্ঠী, নাড়ী ষষ্ঠী, মূলক ষষ্ঠী, অনু ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী, গোরূপিণী ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী। বাংলায় প্রচলিত ধুলা ষষ্ঠী, অরণ্য ষষ্ঠী, কোরা ষষ্ঠী, লোটন ষষ্ঠী, গোট ষষ্ঠী, মূলা ষষ্ঠী, পাটাই ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী, নীল ষষ্ঠী।

দেখতে পাচ্ছি, লৌকিক ধর্মে ষষ্ঠীর যথেষ্ট প্রাধান্য। এঁর উদ্ভব পুরাণে এবং অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের পুরাণে, অর্থাৎ এখন থেকে বারো-তেরোশো বছর আগেকার পুরাণে। এর আগে ষষ্ঠী তেমন ভাবে না থাকলেও ষট্ কৃত্তিকা ছিলেন, যাঁদের স্তন্যপান করে বাঁচতে হয়েছিল বলেই কার্তিকের ছ’টি মুখ— ষন্মুখ হন তিনি। এই ছয় কৃত্তিকা কেমন করে ষষ্ঠীতে পরিণত হন তা বোঝা যায় না, কিন্তু কৃত্তিকারা নেহাত গৌণ দেবী ছিলেন— এঁদের নাম ছিল দুলা, নিতত্নী, চুপুণিকা, অভ্রয়ন্তী, মেঘয়ন্তী, বর্ষয়ন্তী। শেষের তিনটির অর্থ পরিষ্কার; প্রথমটি মধ্যপ্রাচ্যের কোনও ভাষা (অর্থ ঢালা), দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির অর্থ আমাদের অজানা। মোটের ওপর বর্ষণের সঙ্গে এদের অর্থ সম্পৃক্ত।

কৃত্তিকারা বর্ষণের পরে আসেন, কার্তিক তাঁদের স্তন্যসন্তান। এই দেবসেনাপতি, আর্যাবর্তে কার্তিককুমার (নামও তাই)। দাক্ষিণাত্যে যেন ক্ষতিপূরণে কার্তিকের দুই স্ত্রী— বল্লী ও দেবসেনা এবং আর্যাবর্তে কার্তিক গৌণ দেবতা, দাক্ষিণাত্যে তাঁর নাম মুরুগণ এবং তিনি একজন মুখ্য দেবতা।

কিন্তু কথা হচ্ছিল ষষ্ঠীর, দেখা গেল, শিবের পরিত্যক্ত বীর্যজাত সন্তানটিকে যাঁরা স্তন্যদানে বাঁচিয়ে রাখলেন, তাঁরা ছ’-জন কৃত্তিকা, অতএব ষষ্ঠী। মহাভারতে ও অন্যত্রও ষষ্ঠী ছয় নয় একজনই, দেবী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অপুত্রক রাজার মৃত পুত্রকে প্রাণ দিলেন ষষ্ঠী এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন, যদি রাজা তাঁর পূজা মর্তে প্রবর্তন করেন, তবে ষষ্ঠী ধনে, পুত্রে, সৌভাগ্যে তাঁকে উজ্জ্বল জীবন দেবেন, এবং যে এই পূজা করবে, তাকেও অনুরূপ আশীর্বাদ দেবেন। সমস্যা যা রয়ে গেল তা হল, ছয় কৃত্তিকা কবে কেমন করে এক ষষ্ঠীতে পরিণত হলেন। এর কোনও সদুত্তর শাস্ত্রে নেই; বলা হয়েছে, জাতকের জন্মের ষষ্ঠ দিনে যিনি এসে তাকে আশীর্বাদ করেন, তিনিই ষষ্ঠী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ষষ্ঠী

ষষ্ঠী

ষষ্ঠী

প্রচলিত ধারণা অনুসারে হর পার্বতীর চারটি সন্তান—লক্ষ্মী সরস্বতী, কার্তিক গণেশ।

কী কারণে জানি না শাস্ত্র এদের পিতৃত্ব মাতৃত্ব হরপার্বতীকে দিতে রাজি ছিলেন না। তাই লক্ষ্মী উঠলেন সমুদ্র থেকে, সরস্বতী বেরোলেন ব্রহ্মার মাথা থেকে। গণেশ একাই পার্বতীর সন্তান কিন্তু শনির দৃষ্টিতে তাঁর মাথা খসে যাওয়ায় এক হাতির মাথা এনে তাঁর খসে যাওয়া মাথার জায়গায় বসানো হল। মুশকিল হল কার্তিককে নিয়ে তাঁর পিতৃত্ব প্রকারান্তরে শিবকে দেওয়া হলেও মাতৃত্ব কিছুতেই পার্বতীকে দেওয়া গেল না। তাই শিবের বীর্যপাত ঘটল গঙ্গাতে। গঙ্গা তার অসহ্য তাপে অস্থির হয়ে সেটি ফেললেন নদীতটের এক শরবনে। সেখানে অতি সুন্দর এক শিশু জন্মাল। সমস্যা হল তার লালন নিয়ে। কাজেই ষট কৃত্তিকা তাঁর স্তন দান করবেন বলে তাঁর ছটি মুখ উদগত হল, তাই নাম ষন্মুখ। অর্থাৎ কার্তিক শিবের ঔরসপুত্র কিন্তু পার্বতীর গর্ভজাত নয়।

এই ষটকৃত্তিকা থেকেই ষষ্ঠীর কল্পনা; কিন্তু কৃত্তিকারা ছ-জন হলেও ষষ্ঠী একক দেবী। পরবর্তী দুটি পুরাণে— ব্রহ্মবৈবর্ত ও দেবীভাগবত দুটি উপাখ্যানে ষষ্ঠীকে তৎকালীন দেবমণ্ডলীতে স্বতন্ত্র দেবীর মর্যাদা দিয়ে উপস্থিত করা হয়। দুটি উপাখ্যানের মাধ্যমে এঁদের মর্তে আবির্ভাব।

স্বয়ম্ভুমনুর পুত্র রাজা প্রিয়ব্রত পত্নী লাভের জন্য তপস্যা করলেন। পরে ব্রহ্মার আজ্ঞায় বিবাহ করেন। পরে কিন্তু একটি পুত্রও লাভ করতে পারেননি। তখন পুত্রেষ্টি, কশ্যপ মুনির নির্দেশে তাঁর পত্নী মালিনীকে যজ্ঞচরু দান করলেন। মালিনীর গর্ভ দ্বাদশবর্ষব্যাপী হয়, অবশেষে সুদর্শন একটি পুত্র লাভ করেন। কিন্তু পুত্রটি মৃতই জন্মাল। সর্বাঙ্গসুন্দর ওই মৃত পুত্রটি ঊর্ধ্বলোচন হয়ে জন্মায়। তাকে দেখে পিতা মাতা আত্মীয়স্বজন সকলেই কান্নাকাটি করতে লাগল, অনেকে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পরে মৃত সন্তানটিকে কোলে নিয়ে রাজা অন্ত্যেষ্টির জন্যে শ্মশানে এলেন। এবং পরে আত্মহনন করতে সংকল্প করলেন। এমন সময়ে হঠাৎ দেখলেন স্বর্গ থেকে রথ নেমে আসছে, তাতে আসীন শুভ্রবসনা এক সুন্দরী দেবী। প্রিয়ব্রত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কার কন্যা, কার বধু, সুন্দরী’। তিনি বললেন, আমি ব্রহ্মার মানসকন্যা, আমার নাম দেবসেনা, পিতা আমাকে স্কন্দকে দান করেছেন। মাতৃকাদের মনে ষষ্ঠী এই নামে আমি বিখ্যাত। স্কন্দের ভার্যা রূপে প্রসিদ্ধা, পৃথিবীতে ষষ্ঠী নামে পরিচিত। আমি অপুত্রককে পুত্র দিই, নারীকে তাঁর প্রিয় এনে দিই, দরিদ্রকে তার ধন দিই, দুঃখীকে সুখ। কর্মবশে কেউ বহুপুত্রক হয়, আবার কেউ বা হয় পুত্রহীনা। রূপ, রস, ধন যশ, আরোগ্য সবই কর্ম দ্বারাই মানুষ পায়। আমার বরেও পায়।

একথা বলে দেবী বালকটিকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। রাজা সেই জীবিত পুত্রটিকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, কিন্তু দেবী বালকটিকে নিয়ে আকাশে যেতে উদ্যত হলে শুষ্কতালু হতাশ রাজা দেবীর স্তব করলেন। তুষ্টা দেবী বললেন, তুমি রাজা স্বয়ম্ভু মনুর পুত্র। যদি আমার পূজা সর্বত্র প্রচার করো তবেই আমি তোমাকে তোমার পুত্র ফিরিয়ে দেব। ত্রিলোকের রাজা তুমি স্বয়ম্ভু মনুর পুত্র; সর্বত্র আমার পূজা ও স্তবের প্রবর্তন করো, তা হলে তোমাকে কুলের গৌরবস্বরূপ। মনোহর পুত্র দেব। রাজা সম্মত হলেন, দেশে ষষ্ঠী পূজা প্রচলিত হল। এই কাহিনিটি দেবীভাগবত উপপুরাণে আছে।

আবার এই গ্রন্থে অন্যত্র শুনি— ষষ্ঠী, মঙ্গলচণ্ডী আর মনসা প্রকৃতিরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। ষষ্ঠী পুত্রহীনকে পুত্র দেন, স্বল্পায়ু পুত্র দীর্ঘায়ু করেন। অবশ্য পুত্রদের কর্মও এই সব ব্যাপারে ক্রিয়াশীল। রাজা অঙ্গীকার করলে সুন্দর সুদর্শন পুত্রটিকে রাজাকে দিয়ে দেবী স্বর্গে গেলেন।

রাজা গুহে এলে বহু লোক এই কাহিনিটি শুনলেন। রাজা ব্রাহ্মণদের ধনদান করলেন, এবং বিধিমত তিথিতে তিথিতে ষষ্ঠীপূজা করতে লাগলেন। অন্য যাঁরা তাঁর কাহিনি শুনেছিলেন তাঁরাও এইভাবে পূজা ও স্তবে ষষ্ঠী আরাধনা করতে লাগলেন। ফল, মূল নৈবেদ্য, পাদ্য অর্ঘ্য, স্তব ও মন্ত্র সহকারে ষষ্ঠীপূজা ঘরে ঘরে হতে লাগল। ষষ্ঠীর কাছে ধন, যশ ইত্যাদি সবই চেয়ে পাওয়া যায়। বন্ধ্যা ও মৃতবৎসাও পুত্রবতী হতে লাগল। ষষ্ঠী অতি সমাদরে পূজিত হতে লাগলেন।

২.

শিশুর জন্মের ষষ্ঠ দিনে দেবী ষষ্ঠী তাকে আর্শীবাদ করতে আসেন এমন বিশ্বাস আছে। প্রকৃতির ষষ্ঠাংশ রূপিণী ষষ্ঠী (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ প্রকৃতি খণ্ড ১ম অধ্যায়) সেই দিন ষষ্ঠীর পূজা করতে হয়, গ্রামে এটির নাম ‘ষেটেরা’ পূজা। ষষ্ঠী ক্রুদ্ধ বা অসন্তুষ্ট হলে সন্তান আসবে না। এটি একটি প্রচলিত বিশ্বাস। ষষ্ঠী শুধু সন্তান জন্মের ষষ্ঠ দিনেই পূজিত হন না। সারা বছরে বিভিন্ন ষষ্ঠী তিথিতে বিভিন্ন নামে এঁর পূজা পরিচিত। স্কন্দপুরাণে বারো মাসে বারো নামে ষষ্ঠী পূজার কথা পাই— চান্দনী ষষ্ঠী, অরণ্য ষষ্ঠী, কার্দসী ষষ্ঠী, লুণ্ঠন ষষ্ঠী, চপেটা ষষ্ঠী, দুর্গা ষষ্ঠী, নাড়ী ষষ্ঠী, মূলক ষষ্ঠী, অনু ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী, গোরূপিনী ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী। বাংলায় আমরা প্রচলিত ধূলা ষষ্ঠী, অরণ্য ষষ্ঠী, কোরা ষষ্ঠী, লোটন ষষ্ঠী, গোট ষষ্ঠী, মূলা ষষ্ঠী, পাটাই ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী, নীল ষষ্ঠী।

দেখতে পাচ্ছি লৌকিক ধর্মে ষষ্ঠীর যথেষ্ট প্রাধান্য। এর উদ্ভব পুরাণে এবং অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের পুরাণে, অর্থাৎ এখন থেকে বারো তেরোশো বছর আগেকার পুরাণে। এর আগে ষষ্ঠী তেমনভাবে না থাকলেও ষটকৃত্তিকা ছিল, যাদের স্তন্যপান করে বাঁচতে হয়েছিল বলেই কার্তিকের ছটি মুখ—ষম্মুখ হন তিনি। এই ছয় কৃত্তিকা কেমন করে ষষ্ঠীতে পরিণত হন তা বোঝা যায় না, কিন্তু কৃত্তিকারা নেহাত গৌণ দেবী ছিলেন— এঁদের নাম ছিল দুলা, নিতত্নী, চুপুণিকা, অভয়ন্তী, মেঘয়ন্তী, বর্ষয়ন্তী। শেষের তিনটির অর্থ পরিষ্কার; প্রথমটি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো ভাষা (অর্থ ঢালা), দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির অর্থ আমাদের অজানা। মোটের ওপর বর্ষণের সঙ্গে এদের অর্থ সম্পৃক্ত।

কৃত্তিকারা বর্ষণের পরে আসে, কার্তিক তাদের স্তন্যসন্তান। এই দেবসেনাপতি, আর্যাবর্তে কার্তিক কুমার নামও তাই)। দাক্ষিণাত্যে যেন ক্ষতিপূরণে কার্তিকের দুই স্ত্রী বল্লী ও দেবসেনা, এবং আর্যাবর্তে কার্তিক গৌণ দেবতা, দাক্ষিণাত্যে তাঁর নাম মুরুগণ এবং তিনি একজন মুখ্য দেবতা। কিন্তু কথা হচ্ছিল ষষ্ঠীর। দেখা গেল, শিবের পরিত্যক্ত বীর্যজাত সন্তানটিকে যাঁরা স্তন্যদানে বাঁচিয়ে রাখলেন তাঁরা ছ-জন কৃত্তিকা, অতএব ষষ্ঠী। মহাভারতে ও অন্যত্রও ষষ্ঠী ছয় নয়। একজনই, দেবী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অপুত্রক রাজার মৃতপুত্রকে প্রাণ দিলেন ষষ্ঠী এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যদি রাজা তাঁর পূজা মর্তে প্রবর্তন করেন তবে ষষ্ঠী ধনে, পুত্রে, সৌভাগ্যে তাঁকে উজ্জ্বল জীবন দেবেন, এবং যে এই পূজা করবে তাকেও অনুরূপ আশীর্বাদ দেবেন। সমস্যা যা রয়ে গেল তা হল ছয় কৃত্তিকা কবে কেমন করে এক ষষ্ঠীতে পরিণত হলেন। এর কোনো সদুত্তর শাস্ত্রে নেই বলা হয়েছে, জাতকের জন্মের ষষ্ঠ দিনে যিনি এসে তাকে আশীর্বাদ করেন তিনিই ষষ্ঠী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *