২১. সংক্রামক ব্যাধির বিষাক্ত আবহাওয়া

সংক্রামক ব্যাধির বিষাক্ত আবহাওয়া ছাড়িয়া ভয়ার্ত মানুষ যেমন দিগ্বিদিক-জ্ঞানশুন্য হইয়া পলায়ন করে, বিনয়বাবুও তেমনি কন্যাকে লইয়া কলিকাতা হইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন। কোন একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থান ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ পান নাই, কেবল এই বাড়িটার দৃষিত স্মৃতি হইতে সুহাসিনীকে দূরে লইয়া যাওয়া যে একান্ত প্রয়োজন, এ কথাটাই অঙ্কুশের মত তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া অনিশ্চিত ও নিরুদ্দেশের পথে ঠেলিয়া দিয়াছিল।

সুহাসিনীও বাধা দেয় নাই। তাহার পক্ষাঘাতগ্রস্ত মনে বাধা দিবার বা আপত্তি করিবার শক্তি ছিল। তা ছাড়া পাশের বাড়িটার দুঃসহ সামীপ্য তাহার অবসন্ন মনকে তুষানলের মত অহরহ দগ্ধ করিতেছিল। ওই বাড়িটার দিকে চোখ পড়িলেই তাহার বুকের ভিতর হু হু করিয়া উঠিত, অথচ চোখে না পড়িয়া উপায় নাই। তাই পিতার প্রস্তাবে সে আগ্রহের সঙ্গেই সম্মতি জানাইয়াছিল।

কিন্তু বিনয়বাবু যখন কলিকাতার বাস একেবারে তুলিয়া দিয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন, তখন সুহাসিনী জোরের সহিত বলিল, না, তা হতে পারে না। বাড়ি ছাড়া হবে না। কাহারও অত্যাচারে দেশত্যাগী হইয়াছে, এ অপমানের গ্লানি এত বড় দুঃখের পরও সে কিছুতেই সহ্য করিতে পারিবে না।

সুহাসিনীর মনের ভাব বিনয়বাবুকে বুঝিলেন কিনা বলা যায় না, কিন্তু তিনি আর কোন কথা। বলিলেন না। বাড়িওয়ালাকে ছয় মাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়া দরজায় তালা লাগাইয়া একদিন অপরাহে পিতাপুত্রী বাহির হইয়া পড়িলেন।

মধুপুর ও দেওঘরে কিছুদিন কাটিল। কিন্তু সাঁওতাল পরগণার জলহাওয়ায় সুহাসিনীর শরীর আরও ক্ষীণ ও দুর্বল হইতেছে দেখিয়া ভীত বিনয়বাবু সাঁওতাল পরগণা ত্যাগ করিয়া বেহার-প্রান্তে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার নিজের শরীরও ক্রমশ অন্তঃসারশূন্য হইয়া পড়িতেছিল। সংসারের ভাবনা ভাবা যাঁহার কখনও অভ্যাস ছিল না, বৃদ্ধবয়সে এই দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা ও দুঃখের গুরুভার তাঁহার দেহ-মনকে যেন জাঁতায় পিষিয়া গুঁড়া করিয়া দিতে লাগিল। তাঁহার পুরাতন হাঁপানির রোগ পুনঃপুনঃ দেখা দিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু তিনি নিজের দেহকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া একমাত্র সুহাসিনীর কথা ভাবিয়া তাহাকে কি করিয়া একটু সুস্থ দেখিবেন, এই চিন্তাতেই মগ্ন হইয়া রহিলেন।

এইরূপ উদ্দেশ্যহীনভাবে নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইয়া মাস তিন-চার কাটিয়া গেল। দশ-পনেরো দিনের বেশী কোথাও মন টিকে না, তাই নূতন নূতন স্থানের সন্ধানে ইহারা প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে সমস্ত ভারতটা নিঃশেষ করিয়া ফেলিলেন। কিন্তু যে বস্তুর সন্ধানে ফিরিতেছিলেন, সেই শান্তির দর্শন পাওয়া তো দূরের কথা, এই অবিশ্রাম যাযাবর বৃত্তি তাঁহাদের মনকে আরও অস্থির উদ্ভ্রান্ত করিয়া তুলিল। সুহাসিনীর মুখে আবার হাসি ফুটিল বটে, কিন্তু সে হাসি এতই নিস্তেজ ও ম্রিয়মাণ যে তাহা দেখিয়া বিনয়বাবুর চোখ ফাটিয়া জল আসিয়া পড়িত। সুহাসিনী যে তাঁহাকে খুশি করিবার জন্যই হাসিবার চেষ্টা করিতেছে এ কথা সরলচিত্ত বিনয়বাবুর কাছে গোপন থাকিত না।

মানুষের সঙ্গ ছাড়িয়া যাহারা দূরে থাকিতে ইচ্ছা করে, তাহাদের পক্ষে বিদেশে অজ্ঞাতবাস হয়তো শান্তিদায়ক হইতে পারে, কিন্তু নিজের মনের নিকট হইতে যাহারা পালাইতে চাহে, তাহাদের পক্ষে নিঃসঙ্গতা যে কিরূপ ভয়াবহ অবস্থা তাহা যাহারা ভোগ করিয়াছে তাহারাই জানে।

শারদীয়া পূজা কখন আসিয়া নিঃশব্দে চলিয়া গেল, সুদূর প্রবাসে বিনয়বাবু ও সুহাসিনী তাহা ভাল করিয়া জানিতেও পারিলেন না। হেমন্ত শেষ হইয়া শীত আসিল। তখন একদিন সুহাসিনী হঠাৎ বলিল, চল বাবা, দেশে ফিরি।

বিনয়বাবু ব্যাকুলভাবে কন্যার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, যাবি মা? তবে তাই চল,—এ আর ভাল লাগছে না।

পিতার শীর্ণ মুখের এই আর্ত আগ্রহ দেখিয়া সুহাসিনী কাঁদিয়া ফেলিল, বলিল, ঘুরে ঘুরে তোমার শরীরে যে কিছু নেই বাবা, চল বাড়ি যাই।

বিনয়বাবু নিজেকে সংবরণ করিয়া বলিলেন, না না, আমার শরীরের জন্য তো ভাবনা নয়, তোকে সারাতে পারলুম না, এই দুঃখ। ভেবেছিলুম, নানা দেশ দেখে বেড়ালে তোর শরীরটাও ভাল হবে—

চোখ মুছিয়া সুহাসিনী বলিল, না, বাবা, আর পালিয়ে বেড়াব না। বাড়ি গেলে তোমারও শরীর ভাল হবে, আমিও ভাল থাকব। সেখানে করবী আছে—দীনবন্ধুকাকা আছেন—

দীনবন্ধুর কথায় বিনয়বাবু বলিলেন, ভাল কথা, কাল দীনবন্ধুর একখানা চিঠি পেয়েছি। চিঠিখানা অনেক জায়গা ঘুরে কাল এসে পৌঁছেছে।

কী লিখেছেন কাকাবাবু?

লিখেছে বড়দিনের ছুটিতে সে কাশী আসবে, আমরাও যদি যাই তাহলে দেখা হতে পারে।

তবে তাই চল বাবা, কাশী হয়ে বাড়ি যাওয়া যাক। আজ তো ডিসেম্বর মাসের তেইশে।

সেইদিন যাত্রা করিয়া দুইজনে যথাসময়ে কাশী পৌঁছিলেন। কাশীতে পরিচিত লোকের অভাব ছিল না—একজন বন্ধুর বাড়িতে গিয়া উঠিলেন। দীনবন্ধুরও সেইখানেই উঠিবার কথা, কিন্তু

জানিতে পারা গেল যে অকস্মাৎ স্ত্রী পীড়িত হইয়া পড়ায় তিনি আসিতে পারিলেন না।

বন্ধুর উপরোধে বিনয়বাবুকে দু-তিন দিন কাশীতে থাকিয়া যাইতে হইল। কাশী ছাড়িবার আগের দিন দুপুরবেলা তিনি সুহাসিনীকে লইয়া সারনাথ দেখিতে গেলেন। সেখানে যাহা ঘটিল পূর্ব অধ্যায়ে তাহা বর্ণিত হইয়াছে।

কিশোর ও করবীকে ঐরূপ অবস্থায় দেখিবার পর সুহাসিনী যখন টলিতে টলিতে বিনয়বাবুর কাছে ফিরিয়া গিয়া দাঁড়াইল, তখন তাহার মুখ দেখিয়া বিনয়বাবু ভয় পাইয়া গেলেন। কিন্তু কোন কথা উত্থাপন করিবার পূর্বেই সুহাসিনী ক্লিষ্টস্বরে বলিল, বাবা, ভারি শরীর খারাপ বোধ হচ্ছে—ফিরে চল।

সমস্ত পথটা বিনয়বাবু উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করিতে করিতে ও দুর্বল সুহাসিনীকে এইখানে টানিয়া আনার জন্য পরিতাপ করিতে করিতে গেলেন। সুহাসিনী কিন্তু কাঠের মত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল, পিতার সব কথা তাহার কানেও গেল না। আজ এই অজ্ঞাত স্থানে কিশোর ও করবীর সঙ্গে এমনভাবে দেখা হইবে তাহা কে ভাবিয়াছিল? তাহারা দুজনে যে ভাবে দাঁড়াইয়াছিল, তাহার একটি মাত্র অর্থ হয়, দ্বিতীয় অর্থের অবকাশ নাই। কিন্তু সাধারণের সহজগম্য প্রকাশ্য স্থানে এরূপ কদর্য নির্লজ্জতা কিশোরের পক্ষে স্বাভাবিক হইতে পারে, করবী তাহাতে যোগ দিল কী করিয়া? ঘৃণায় সুহাসিনীর শরীর কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। ব্যভিচারীরা কি স্থান অস্থান বিচার করে না? তাহাদের প্রবৃত্তি কি এতই প্রবল যে, দুর্নীতির আচরণ সাধারণ লোকলজ্জাও তাহার স্বচ্ছন্দে বিসর্জন দিতে পারে?

কিন্তু করবী? করবীকে সে ছেলেবেলা হইতে জানে। বিলাতী স্কুলে পড়ার ফলে সে একটু চটুলস্বভাব ও ফাজিল হইয়া পড়িয়াছে বটে, কিন্তু মন্দ সে তো নহে। তবে কি তাহার সরল প্রকৃতির সুযোগ বুঝিয়া এক বিবেকহীন লম্পট তাহার সর্বনাশ সাধনের চেষ্টা করিতেছে? করবী ও কিশোরের বাহুবদ্ধ যুগ্নমূর্তির চিত্র তাহার মনে জাগিয়া উঠিল। উঃ, কি নির্ভরশীলতাই করবীর আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। আর কিশোরের মুখে কোন ভাব প্রকাশ পাইয়াছিল। নিষ্ঠুর শিকারী এমনই কপট উৎকণ্ঠার ভাব দেখাইয়া বুঝি নির্বোধ নারীকে নিজের ফাঁদে টানিয়া আনে।

এই সকল কথা ভাবিতে ভাবিতে সুহাসিনী বাসায় গিয়া পৌঁছিল এবং একেবারে নিজের ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িল। চোখ বুজিয়া সে মন হইতে এই চিন্তাটাকে তাড়াইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু রক্তপায়ী জোঁকের মত তাহারই মর্মরুধিরে স্ফীত হইয়া চিন্তাটা তাহার মনে জুড়িয়া রহিল; যন্ত্রণায় ছটফট করিতে করিতে সে ভাবিতে লাগিল,কেন এমন হয়? যাহার সহিত চিরদিনের জন্য ছাড়াছাড়ি হইয়া গিয়াছে, যাহাকে সে দুর্নীতিপরায়ণ চরিত্রহীন বলিয়া জানে, তাহাকে অন্য স্ত্রীলোকের সহিত দেখিয়া তাহার অন্তদাহ আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিতেছে কেন? যে লম্পট, সে যদি স্ত্রীলোকের সর্বনাশ করে তাহাতে বিস্ময়ের কী আছে? এবং তাহারই বা কী আসে যায়? এমন তো পৃথিবীতে কত হইতেছে। তবে কি শুধু করবীর অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়াই তাহার এই অন্তদাহ?

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে সে সঙ্কল্প করিয়া শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল। করবীকে সাবধান করা দরকার। মুখে চোখে জল দিয়া বেশভূষার সামান্য পরিবর্তন করিয়া বিনয়বাবুর কাছে গিয়া বলিল, চল বাবা, করবীর মামার বাড়ি বেড়িয়ে আসি! কাল তো আর দেখা করবার সময় হবে না। হয়তো করবীরাও এসে থাকবে।

সুহাসিনীর শরীর লক্ষ্য করিয়া বিনয়বাবু দু-একবার আপত্তি করিলেন, কিন্তু তাহার আগ্রহাতিশয্য দেখিয়া শেষে গাড়ি ডাকাইয়া দুইজনে বাহির হইয়া পড়িলেন। করবীর মামার ঠিকানা পূর্ব হইতেই জানা ছিল, সেখানে উপস্থিত হইয়া শুনিলেন, করবী ও প্রমদাবাবু সম্প্রতি আসিয়াছেন। প্রমদাবাবু বাড়ি আছেন বটে কিন্তু করবী সারনাথ দেখিতে গিয়াছে, তখনও ফিরে নাই। বিস্মিত আনন্দিত বিনয়বাবু বৈঠকখানায় প্রমদাবাবুর সহিত কথাবাতা কহিতে লাগিলেন, সুহাসিনী অন্দরমহলে গেল। করবীর মা তাহাকে হাত ধরিয়া নিজের কাছে বসাইয়া কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। করবীর মামীদের সঙ্গে সুহাসিনীর পরিচয় ছিল না, তাঁহাদের সঙ্গেও আলাপ হইল। করবীর মা সুহাসিনীর মুখখানা তুলিয়া ধরিয়া গভীর সমবেদনার সহিত বলিলেন, শরীরে যে তোর কিছুই নেই, সুহাস। এত দেশ বেড়ালি, তবু শরীর সারল না?

মলিন হাসিয়া সুহাসিনী শুধু ঘাড় নাড়িল। করবীর মা ভিতরের সব কথাই জানিতেন, তাই কেবল একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। তাঁহার মন উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। কিশোর ও বিমলা যে এখানে আছে, তাহা সুহাসিনী জানে না; তাহারা ফিরিলে অন্তত বিমলার সহিত সুহাসিনীর সাক্ষাৎ অনিবার্য। তখন কী ঘটিবে, এই ভাবিয়া তাঁহার মন সঙ্কোচে ও আশঙ্কায় পূর্ণ হইয়া উঠিল।

বাহিরে মোটরের শব্দ হইল, পরক্ষণেই করবী দ্রুতপদে ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। অনেক দিন পরে দুই সখীতে দেখা কিন্তু কেহই সহজভাবে সম্ভাষণ করিতে পারিল না, কোথায় যেন বাধিয়া গেল। অপ্রতিভ ও ঈষৎ সঙ্কুচিতভাবে দুজনে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর করবী জোর করিয়া হাসিয়া সুহাসিনীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, হাসিদি,কদ্দিন পরে তোমাকে দেখলুম ভাই! মনে হচ্ছে যেন পাঁচ বছর।

সুহাসিনী অল্প হাসিল, কিন্তু করবীর কথাগুলা যে সহজ এবং স্বচ্ছন্দ নয়, বরং জোর করিয়া সহৃদয়তা দেখাইবার চেষ্টা, তাহা বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না। ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ করিয়া সুহাসিনীর বুকের ভিতরটা টনটন করিয়া উঠিল। তবু সে যথাসাধ্য স্বাভাবিক সুরে বলিল, সারনাথ দেখতে গিয়েছিলি, আগে দেখিসিনি বুঝি? কেমন দেখলি?

বেশ ভাল। চল এখন আমার ঘরে। বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে নিজের ঘরে লইয়া চলিল।

নিজের ঘরে লইয়া গিয়া সুহাসিনীকে খাটের উপর বসাইয়া করবী অনেকক্ষণ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। শেষে একটা বুকভাঙা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ধন্যি মেয়ে তুমি! এসো, একটু পায়ের ধুলো নি। বলিয়া সত্য সত্যই হাত বাড়াইয়া সুহাসিনীর পায়ে হাত দিয়া মাথায় ঠেকাইল।

বিস্মিত হইয়া সুহাসিনী বলিল, ও আবার কী! ও কী করছিস?

করবী পূর্বের মত আবার জোর করিয়া হাসিতে লাগিল, বলিল, কিছু না। তোমার পায়ে ধুলো নিলে পুণ্যি হয়, তাই একটু নিলুম। বোসো, এই কাপড়-চোপড়গুলো ছেড়ে ফেলি ভাই।

করবী কাপড় ছাড়িতে ছাড়িতে অনর্গল বকিয়া যাইতে লাগিল, সুহাসিনী চুপ করিয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। অন্তরের সত্যকার কথাটা গোপন রাখিবার জন্যই করবী এত বাজে বকিতেছে, তাহাতে সংশয় নাই, কিন্তু তবুও সুহাসিনীর মনে একটা খটকা বাজিতে লাগিল। সে যাহা সন্দেহ করিয়াছে তাহা নহে, করবী যেন অন্য কিছু লুকাইবার চেষ্টা করিতেছে!

নিঃসংশয় হইবার উদ্দেশ্যে সুহাসিনী এক সময় জিজ্ঞাসা করিল, একলা সারনাথে গিয়েছিলি, না সঙ্গে আর কেউ ছিল?

করবীর মুখখানা হঠাৎ জবাফুলের মত লাল হইয়া উঠিল। সে একটা গরম জামা পরিয়া তাহার বুকের বোম লাগাইতেছিল, মুখ না তুলিয়াই বলিল, এ দিকের শীত কী বিশ্রী দেখেছিস ভাই, যেন হাড় পর্যন্ত কালিয়ে দেয়। কলকাতায় শীত অন্য রকম-বেশ মোলায়েম। তুই যাই বলিস, আমার কিন্তু এত শীত ভাল লাগে না। ভাল জামাকাপড় পরবার জো নেই; দেখ না, এই মোটা গরম জামাটা গায়ে দিলেও শীত ভাঙে নাবলিতে বলিতে সে যেন সুহাসিনীর প্রশ্নটা শুনিতেই পায় নাই এমনিভাবে তাহার পাশে আসিয়া বসিল।

সুহাসিনী স্থির দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, কী হয়েছে তোর?

কী হবে আবার! কিছু না করবী তাড়াতাড়ি মুখ ফিরাইয়া লইয়া অন্য একটা প্রসঙ্গ উত্থাপনের চেষ্টা করিল। কিন্তু সুহাসিনী হাত দিয়া তাহার মুখ নিজের দিকে ফিরাইয়া বলিল, কিছু না তবে অমন করছিস কেন? আমার পানে চোখ তুলে তাকা দেখি।

করবী চোখ তুলিয়া তাকাইল বটে, কিন্তু সুহাসিনীর চোখের সহিত বেশীক্ষণ চোখ মিলাইয়া রাখিতে পারিল না। চোখ আপনি নত হইয়া পড়িল। পরমুহূর্তেই সে হঠাৎ সুহাসের কোলের উপর মুখ খুঁজিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। আত্মনিগ্রহ এবং পরকে প্রতারণা একসঙ্গে আর তাহার দ্বারা সম্ভব হইল না।

সুহাস দুই হাতে তাহার মুখ তুলিয়া ধরিয়া বলিল, কী হয়েছে আমায় বল।

উঠিয়া করবী ঘনঘন চোখ মুছিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে একটু শান্ত হইয়া ভারী গলায় বলিল, হসিদি, পুরুষের হাতে তুমিও কম লাঞ্ছনা সহ্য করনি, কিন্তু আমার লজ্জা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ভিক্ষে চাইবার দুর্মতি তো তোমার কখনও হয়নি!

সুহাসিনীর মুখ সাদা হইয়া হইয়া গেল, সে দুই হাতে করবীর হাত শক্ত করিয়া ধরিয়া বলিল, কী বলছিস, স্পষ্ট করে বল।

করবী তিক্ত হাসিয়া বলিল, একজনের কাছে যেচে ভালবাসা চাইতে গিয়েছিলুম। সে তার উপযুক্ত জবাব দিয়েছে, ভিক্ষে যে চাইলেই পাওয়া যায় না, তা বুঝিয়ে দিয়েছে। হাসিদি, আজ আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে করছে, কেন আমার এ দুর্বুদ্ধি হল? আমি যেচে নিজেকে তার পায়ে ফেলে দিলুম আর সে আমাকে নিলে না! আমার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখতে হাসিদি, সত্যিই কি আমি ফেলে দেবার মত? কিছু কি আমার নেই? অশ্রুসিক্ত মুখখানা করবী সুহাসিনীর মুখের কাছে তুলিয়া ধরিল।

সুহাসিনীর মাথা ঘুরিতে লাগিল, চোখে ভাল দেখিতে পাইল না। কিশোর করবীর ভালবাসা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। এই লজ্জাই করবী এতক্ষণ লুকাইবার চেষ্টা করিতেছিল। তবে সারনাথের সেই যুগ্নমূর্তির সে যে অর্থ করিয়াছিল, তাহা ভুল! কিশোর করবীকে প্রলুব্ধ করে নাই! কিন্তু তবু সংশয় দূর হইল না, সে ব্যাকুলস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, কে—কে সে, করবী,—যে তোকে নিলে না?

করবী বলিল, মরে গেলেও তার নাম বলতে পারব না। তুমি কখনও জানতে চেয়ো না, হাসিদি! আমার ওপর যদি তোমার এতটুকু দয়া থাকে, ঐ লজ্জা থেকে আমাকে রেহাই দিও।

কিন্তু রেহাই পাওয়া করবীর ভাগ্যে ছিল না। এই সময় সুরেন দ্বার ঠেলিয়া বলিতে বলিতে ঘরে ঢুকিল, করি-দি, কিশোরবাবু চলে গেলেন, বৌদিদিও চলে গেলেন। এখান থেকে সটান আগ্রা যাবেন। কিশোরবাবু বললেন—ওঃ— আর একজন অপরিচিত স্ত্রীলোক করবীর নিকট বসিয়া আছে দেখিয়া সুরেন থামিয়া গেল। অপ্রস্তুতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া দরজা ভেজাইয়া দিল।

একবার নিমেষের জন্য সুহাসিনীর সঙ্গে করবীর চোখাচোখি হইল। তারপর করবী বিছানার উপর শুইয়া পড়িয়া বালিশের মধ্যে মুখ খুঁজিয়া অসহ্য রোদনোহ্রাস দমন করিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিতে লাগিল।

মৃন্ময়মূর্তির মত সুহাসিনী বসিয়া রহিল। আর একদিনের কথা তাহার স্মরণ হইল, যেদিন কলিকাতায় ড্রয়িংরুমে মূর্ছা ভাঙিয়া সে দেখিয়াছিল করবী তাহার মাথা কোলে লইয়া বসিয়া আছে। অবস্থার আজ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে। কিন্তু সুহাসিনী একটা হাত নাড়িয়াও সেদিনকার ঋণ শোধ দিতে পারিল না। তাহার মুখ হইতে সান্ত্বনা বা সহানুভূতির বাণী যে বিদ্রূপের চাবুকের মত  করবীর গায়ে বাজিবে, তাহা বুঝিয়া সে নির্বাক বেদনায় পাংশু রক্তহীন মুখে বসিয়া রহিল। কেবল তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া নিঃশব্দে অশ্রুর ধারা ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *