১৮. পাঞ্জাব মেল হাওড়া ছাড়িবার কয়েক মিনিট পূর্বে

পাঞ্জাব মেল হাওড়া ছাড়িবার কয়েক মিনিট পূর্বে কিশোর বিমলাকে লইয়া স্টেশনে উপস্থিত হইয়া দেখিল প্ল্যাটফর্মের উপর বিরাট জনতা,দেশী ও বিলাতী বহুবিধ ভদ্ৰশ্রেণীর যাত্রীর ভিড়ে কোথাও তিল ফেলিবার স্থান নাই। কিশোর আগে হইতে দুইখানি প্রথম শ্রেণীর বার্থ রিজার্ভ করিয়া রাখিয়াছিল, তাই গাড়িতে জায়গা পাওয়া সম্বন্ধে তাহার কোন দুভাবনা ছিল না। প্রত্যেক গাড়ির সম্মুখস্থ অলিকায় নিজের নাম খুঁজিতে খুঁজিতে শেষে নির্দিষ্ট গাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইল। বিমলাকে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া নিজে উঠিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় গাড়ির ভিতর হইতে একজনের পরিচিত সকৌতুক কণ্ঠস্বরে সে চমকিয়া উঠিল, এ কি কিশোরবাবু, আপনি কোথায় চলেছেন?

কিশোর মুখ তুলিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল,সম্মুখের বেঞ্চির গদির উপর বসিয়া যে মেয়েটি হাসিমুখে তাহার পানে তাকাইয়া আছে সে যে করবী হইতে পারে, তাহা যেন কিশোর সহসা বিশ্বাস করিতেই পারিল না।

করবী হাসিয়া বলিল, স্তম্ভিত হয়ে গেলেন যে! চিনতে পারছেন তো?

কিশোর হাঁ-না কোন কথাই বলিতে পারিল না। যে দিন সন্ধ্যাবেলা বিনয়বাবুর বাড়িতে সেই কাণ্ডটা ঘটিয়া গেল, সেদিন করবী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল; উপস্থিত না থাকিলেও সে ব্যাপার তাহার কণাগোচর হইতে বিলম্ব হইত না। কিশোর বুঝিয়াছিল, ইহার পর করবীদের সহিত তাহার নব-পিত বন্ধুত্বের সূত্র একেবারে ছিন্ন হইয়া গিয়াছে; তাহাদের সঙ্গে আবার দেখা হইবার সম্ভাবনাও সে কল্পনা করে নাই, এবং যদি দৈবাৎ দেখা হয় তাহা হইলে দুই পক্ষই যে দূর হইতে অপরিচিতের মত সরিয়া যাইবে, ইহাই সে স্বাভাবিক বলিয়া মনে করিয়া রাখিয়াছিল। অনুপম করবীর পিসতুত ভাই, তাহার উপস্থাপিত অভিযোগ যে করবী শেষ পর্যন্ত সত্য বলিয়া স্বীকার করিয়া কিশোরের সংসর্গ বর্জন করিবে, ইহাই তো সঙ্গত।

কিন্তু এ কি অচিন্তনীয় ব্যাপার! করবীর এই একান্ত বন্ধুভাবে সম্ভাষণের সহিত নিজের অন্তরঙ্গ বদ্ধমূল ধারণার আপোস করিতেই কিশোরের খানিকটা সময় কাটিয়া গেল। তারপর নিজের বিচ্ছিন্ন চেতনাকে সংহত করিয়া সে ভাবিয়া দেখিল, করবী ছেলেমানুষ, হয়তো সব দিক না ভাবিয়াই তাহার সম্বন্ধে এতটা সহৃদয়তা প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে; তাহার অভিভাবকরা জানিতে পারিলে নিশ্চয় অসন্তুষ্ট হইবেন। এবং একথা ভাবাও তাঁহাদের পক্ষে অসম্ভব নহে যে, কিশোরই গায়ে পড়িয়া তাঁহাদের সহিত পুনশ্চ ঘনিষ্ঠতা স্থাপনের চেষ্টা করিতেছে।

কিশোরের একবার ইচ্ছা হইল, এ গাড়ি ছাড়িয়া অন্য কোন খালি গাড়ি খুঁজিয়া লইয়া তাহাতে গিয়া উঠে; কিন্তু এখন সে পথও বন্ধ, কুলিরা ইতিমধ্যে মোটঘাট লইয়া এই গাড়িতে রাখিয়াছে, বৌদিদিও গাড়িতে উঠিয়া পড়িয়াছেন। এরূপ অবস্থায় আবার মোটঘাট তুলিয়া লইয়া অন্যত্র যাইবার চেষ্টাও যে অত্যন্ত বিশ্রী দেখাইবে, তাহা বুঝিয়া কিশোর সেই গাড়িতেই উঠিয়া পড়িল এবং সংযতভাবে করবীকে একটা নমস্কার করিয়া বলিল, আমরা কাশী যাচ্ছি।

করবী করতালি দিয়া সোল্লাসে বলিয়া উঠিল, আমরাও কাশী যাচ্ছি, বেশ হল, একসঙ্গে যাব। ইনি আপনার বৌদিদি তোক দেখেই চিনতে পেরেছি। আসুন বৌদি, এখানে এসে বসুন। আপনাদের সঙ্গে ট্রেনে এমনভাবে দেখা হবে তা ভাবিওনিভারি আশ্চর্য নয়? আচ্ছ, আপনারা কাশী যাচ্ছেন, আগে আমাদের খবর দেননি কেন? জানা থাকলে কত সুবিধা হত।

কিশোর নির্বাক হইয়া রহিল। শেষে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার সঙ্গে তো কাউকে দেখছি না, আপনি কি–?

করবী হাসিয়া বলিল, না, একলা যাচ্ছি না, বাবা সঙ্গে আছেন। মা আজ দুমাস হল কাশীতেই রয়েছেন কিনা—তাঁকেই আনতে যাচ্ছি। মার শরীর বড় খারাপ হয়ে পড়েছিল, তাই মামা এসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মামার বাড়ি কাশীতে, আপনি জানতেন না বুঝি?

কিশোর মাথা নাড়িয়া নিঃশব্দে বেঞ্চির এক কোণে গিয়া বসিল। কুলিগুলা মজুরির জন্য দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের ভাড়া চুকাইয়া দিতে দিতে ক্ষুব্ধমনে ভাবিতে লাগিল, এ কোন্ দৈবী দুষ্টবুদ্ধি সারা রাত্রির জন্য তাহাকে এই অনীতি সাহচর্যের মধ্যে ফেলিয়া দিল?

বিমলা এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিল, করবী উঠিয়া আসিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে নিজের কাছে লইয়া গিয়া বসাইল। বলিল, কিশোরবাবু তো পরিচয় করিয়ে দিলেন না, নিজেই নিজের পরিচয় দিই। আমি করবী–বোধ হয় ওঁর কাছে নাম শুনে থাকবেন।

বিমলা হাসিয়া বলিল, শুধু নাম নয়, অনেক প্রশংসা শুনেছি।

সুস্মিতমুখে কিশোরের দিকে একটা কটাক্ষপাত করিয়া করবী বলিল, সত্যি? এ তো আমার ভারি সৌভাগ্যের কথা। আমি জানতুম, উনি কেবল মুখের ওপর কমপ্লিমেন্ট দিতে পারেন। যাহোক, আড়ালেও আমার সুখ্যাতি করেছেন, এ আমার পক্ষে কম গৌরব নয়! বলিয়া হাসিতে লাগিল।

গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা পড়িতেই প্রমদাবাবু হন্তদন্ত হইয়া কোথা হইতে আসিয়া গাড়িতে চড়িয়া পড়িলেন এবং পরক্ষণেই নানাবিধ চিকার ও হুড়াহুড়ি সহযোগে গাড়ি ধীরে ধীরে আলোকদীপ্ত প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়া চলিতে আরম্ভ করিল।

অপরিচিত একটি স্ত্রীলোকের সহিত মুখোমুখি বসিয়া করবী কথা কহিতেছে দেখিয়া প্রমদাবাবু প্রথমটা বিস্মিত হইয়া তাকাইয়া রহিলেন, তারপর কিশোরের দিকে ফিরিয়া তাহাকে চিনিতে পারিয়া মহানন্দে বলিয়া উঠিলেন, আরে কিশোরবাবু যে। কিশোরের পাশে গিয়া বসিয়া বলিলেন, যাক, বাঁচা গেল। কে সি চক্রবর্তী আর মিসেস হালদারের নামে রিজার্ভ কার্ড দেখে ভয় হচ্ছিল, বুঝি একজোড়া বাঙালী মেমসাহেব বড়দিন করতে চলেছে সারাটা পথ জ্বালাতে জ্বালাতে যাবে। তারপর, এখন যাওয়া হচ্ছে কদূর? মোগলসরাই পর্যন্ত রিজার্ভ করেছেন দেখছি কাশী চলেছেন নাকি?

কিশোর বলিল, হাঁ—আপাতত কাশী যাচ্ছি।

প্রমদাবাবু বলিলেন, তার মানে বেড়াতে চলেছেন। বেশ বেশ, বড়দিনের ছুটিতে একটা কিছু করা চাই তো।এই দেখুন না, আমি তেঁতো মানুষ, কলকাতা ছেড়ে এক পা যেতে মন সরে না, আমাকেও বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। বুড়ো বয়সে শ্বশুরবাড়ি চলেছি।

করবী বলিল, বাবা, ইনি কিশোরবাবুর বৌদিদি। ইনি বলছেন, কিশোরবাবু এর কাছে আমার খুব প্রশংসা করেছেন। কিশোরবাবু ভারি ভাল লোক, নয়?

প্রমদাবাবু বলিলেন, তোমার প্রশংসা করলেই যদি ভাল লোক হওয়া যায়, তাহলে ভাল লোক হওয়া সহজ বলতে হবে। কিন্তু আমি এত সহজে কিশোরবাবুকে ভাল লোক বলতে রাজী নই। উনি আসব বলে কথা দিয়ে সেই একবার বই আমাদের বাড়িতে আর আসেননি। বিমলাকে নির্দেশ করিয়া বলিলেন, মা লক্ষ্মীকেও সঙ্গে আনবার কথা ছিল, তাও আনলেন না। আমি পুলিসের লোক, এই সব নানা রকম প্রমাণ থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি, উনি একজন নিতান্ত বদলোক। এমন কি ওঁকে বোমাবাজ বিপ্লবী বলেও সন্দেহ করা যেতে পারে।

প্রমদাবাবুর কথায় সকলে একসঙ্গে হাসিয়া উঠিল। কিশোরের বুক হইতে একটা ভারি বোঝ নামিয়া গিয়া মন প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। এমন প্রফুল্লতা সে বহুদিন অনুভব করে নাই। তাহার অকৃত অপ্রাধের জন্য সমস্ত পৃথিবী হইতে যেন সে একঘরে হইয়াছিল; সংসার তাহার প্রতি অন্যায় বিচার করিয়া তাহাকে দোষী সাব্যস্ত করিয়াছে; এই অভিমানে সে নিজেই পৃথক হইয়া দূরে সরিয়া গিয়াছিল। আজ প্রমদাবাবু হাত ধরিয়া যেন তাহাকে সেই পরিচিত সংসারের মধ্যে টানিয়া আনিলেন। তিনি যেন স্পষ্ট করিয়া বলিলেন, তোমার নামে কে কী কুৎসা রটনা করিয়াছে, তাহা আমরা জানিতে চাহি না। তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ যতই গুরু হোক, আমরা জানি তুমি নিদোষ, তোমার দ্বারা এত বড় অপরাধ কখনও সম্ভব হইতে পারে না। তোমাকে বিশ্বাস করি—ভালবাসি। তুমি আমাদের একজন।

কৃতজ্ঞতার এক অপূর্ব আবেগে কিশোরের কণ্ঠ পর্যন্ত বাষ্পরুদ্ধ হইয়া আসিল, সে বলিল, আমায় মাপ করুন, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। একটা কাজে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, সময় করে উঠতে পারিনি। সত্যি কিনা বৌদিদিকে জিজ্ঞাসা করুন।

ইহার পর তাহাদের মধ্যে কথাবার্তায় আর কোন সঙ্কোচ রহিল না। ট্রেন রাত্রির বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিল; দীর্ঘ ব্যবধানে এক-একবার ক্ষণকালের জন্য গতি সংহত করে, আমার সগর্জনে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাহির হইয়া পড়ে। স্থিতিকে স্থায়ী হইতে দিবে না, এই যেন তাহার পণ।

আর, সেই দীপালোকিত ক্ষুদ্র দারুকক্ষটির মধ্যে এই চারিটি প্রাণী যেন সংসার হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া কোন এক ইন্দ্রিয়াতীত মন্ত্রকুহকে পরম্পর অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়িলেন। মনের আড়াল যখন একবার ঘুচিয়া যায়, তখন বুঝি এমনই হয়। যে কথা অন্য সময় অতি অন্তরঙ্গের কাছেও প্রকাশ পাইত না, তাহা সহজে স্বচ্ছন্দে বাহির হইয়া আসিল। কৃত্রিম ব্যবধান যেখানে নাই, সেখানে কথারও অন্ত থাকে না। আনন্দের, দুঃখের, আকাঙ্ক্ষার কত কাহিনীই যে বিনিময় হইল তাহার ইয়ত্তা নাই।

শুধু একটা প্রসঙ্গ সকলেই সাবধানে এড়াইয়া গেলেন, সুহাসিনী সম্বন্ধে কোন কথা হইল না।

গল্প-গুজবে যখন অনেক রাত্রি হইয়া গেল, তখন প্রমদাবাবু এক রকম জোর করিয়াই উঠিয়া পড়িলেন এবং বিছানাপত্র পাতিয়া শয়নের যোগাড় করিতে লাগিলেন।

কিশোর তাড়াতাড়ি উঠিয়া প্রমদাবাবুর হোড়-অল খুলিয়া তোশক, বালিশ, লেপ ইত্যাদি বাহির করিয়া দিল। কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডার পর স্থির হইল, বিমলা করবী দুই পাশের বেঞ্চিতে শয়ন করিবে, প্রমদাবাবু ও কিশোর মেঝের স্বল্পপরিসর স্থানে বিছানা পাতিয়া শুইবেন। পথের জন্য বিমলা সামান্য একটা বিছানা জড়াইয়া লইয়াছিল, তাহাতে নিজের জন্য একটা মোটা ভুটিয়া কম্বল এবং কিশোরের জন্য লেপ বালিশ তোশক ছিল। কিশোর সেটা খুলিয়া বিছানা পাতিতে লাগিয়া গেল। প্রমদাবাবুকে বলিল, আপনি বসুন, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।

প্রথমে দুই বেঞ্চির উপর দুটা হোশক পাট করিয়া পাতিয়া তাহার উপর বালাপোশ বিছাইয়া বালিশের জন্য প্রমদাবাবুর বিছানার স্তুপ খুঁজিতে খুঁজিতে দুটি ছোট ছোট অতি সুন্দর চিকনের কাজকরা বালিশ বাহির হইয়া পড়িল। কিশোর সহাস্যমুখে করবীকে জিজ্ঞাসা করিল, এ দুটি বুঝি আপনার?

করবী বিব্রত হইয়া বলিল, যাঁ। কিন্তু আপনি ছেড়ে দিন, আমরা বিছানা পেতে নিচ্ছি।

কিশোর বলিল, আমাকে কি এতই অপদার্থ মনে করেন, বিছানা পাতবারও ক্ষমতা নেই?

বিমলা মুখ টিপিয়া হাসিয়া করবীকে বলিল, ওঁকে কিছু বোলো না, ঝি-চাকরের কাজ করতে উনি বড্ড ভালবাসেন।

কৃত্রিম কোপে চোখ পাকাইয়া কিশোর বলিল, ঝি-চাকরের কাজ—আচ্ছা বেশ-শয্যা প্রস্তুত শেষ করিয়া বলিল, এবার শুয়ে দেখুন, ঝি-চাকরের চেয়ে ভাল হয়েছে কিনা।

প্রমদাবাবু শুইয়া পড়িলেন, আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আঃ দিব্যি হয়েছে! এবার আলোর উপর পদার্টা টেনে দিয়ে যে যার ঘুমিয়ে পড়ো।

বিমলা নিজের নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে আসিয়া বসিয়া মদৃস্বরে বলিল, ঠাকুরপো, কম্বলটা আমায় দাও, নইলে সারারাত গা কুটকুট করবে, ঘুমোত পারবে না।

কিশোর মাথা নাড়িয়া বলিল, নাঃ, এতে আমার কোন কষ্ট হবে না।

বিমলা বলিল, আমি বলছি লক্ষ্মীটি, তুমি লেপ নাও। কম্বল আমার অভ্যেস আছে, তুমি লেপ না হলে ঘুমুতে পার না।

কিশোর বলিল, কম্বলটি নিজের জন্যে নেওয়া হয়েছিল, আমি তা বুঝতে পারিনি। তা তোমার বুঝি গা কুটকুট করতে নেই?

বিমলা বিরক্ত হইয়া বলিল, তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল যে, কম্বল নিজে নিয়ে লেপটি আমার ঘাড়ে চাপাবে। এমন একগুঁয়ে মানুষও যদি কোথাও দেখা যায়।

করবীও শুইয়া পড়িয়াছিল; লেপের ভিতর হইতে এতক্ষণ দুজনের তর্কাতর্কি শুনিতেছিল, এবার ঘাড় তুলিয়া বলিল, কিশোরবাবু, আপনার মাথায় বালিশ দেখছি না?

কিশোর বলিল, নিষ্প্রয়োজন। বালিশ না থাকলেও আমার নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না। বাহুই আমার শ্রেষ্ঠ উপাধান।

বিমলা ক্ষুব্ধস্বরে বলিল, আর বড়াই করতে হবে না। এই দেখ না, নিজের বালিশটি আমাকে দান করা হয়েছে। আমার বালিশের দরকার হয় না, তাই ওঁর জন্যে একটা বালিশ নিয়েছিলুম।

কিশোর আলো দুটি ঢাকা দিয়া কম্বলের মধ্যে প্রবেশ করিতে করিতে বলিল, বৌদি, এত রাত্তিরে যদি তর্ক আরম্ভ কর তাহলে ঘুম চটে যাবে। আর নয়, এবার চটপট ঘুমিয়ে পড়া যাক।

আবরিত বাতির ক্ষীণ প্রভায় কক্ষটি চমৎকার ছায়াময় হইয়াছিল; তাহার ভিতর হইতে ঈষৎ লজ্জিতকষ্ঠে করবী বলিল, কিন্তু আমার তো দুটো বালিশ রয়েছে, আপনি একটা নিন না, কিশোরবাবু।

না, না, তার দরকার নেই।

করবী ঝুপ করিয়া একটা বালিশ কিশোরের মাথার কাছে ফেলিয়া দিয়া বলিল, এই নিন।

কিশোর নরম বালিশটা নাড়িয়া-চাড়িয়া সযত্নে মাথার তলায় দিয়া একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, অন্যায় করলেন। ভেবেছিলুম যখন তীর্থযাত্রা করেছি, তখন পথেই কৃসাধন শুধু করে দেবতা আর আপনারা হতে দিলেন না।

কিছুক্ষণ আর কেহ কোন কথা কহিল না। প্রমদাবাবুর নাসানিঃসৃত শব্দ ঘোষণা করিতে লাগিল যে, তাঁহার নিদ্ৰাকৰ্ষণ হইয়াছে। গাড়ি অন্ধকারের বুক চিরিয়া উল্কার বেগে ছুটিয়াছে, বন্ধ কাচের শার্সির ভিতর দিয়া বাহিরের দৃশ্য কিছু দেখা যায় না। ভিতরে কক্ষটি স্বপ্নদৃষ্ট মায়া-লোকের মত অস্পষ্ট মোলায়েম হইয়া আছে।

অনেকক্ষণ পরে করবী মৃদুস্বরে বলিল, মনে হচ্ছে, আমরা যেন কোন নিরুদ্দেশের যাত্রী। এমনি ভাবে গাড়ি যদি চিরকাল চলতে থাকত, কি সুন্দর হত?

কেহ তাহার কথায় উত্তর দিল না, কিন্তু কিশোর ও বিমলার মনে সে কথার প্রতিধ্বনি জাগিয়া উঠিল! জীবনটা যদি এমনই নিশ্চিন্ত নিরবচ্ছিন্ন একটি যাত্রা হইত! এমনই নিরুদ্বেগ ছায়াময় রাজ্যের ভিতর দিয়া, সহযাত্রীদের সঙ্গে নিবিড় স্নেহবন্ধনে বদ্ধ হইয়া এই যাত্রাপথ যদি কখনও শেষ না হইত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *