১৭. বড়দিনের ছুটির আর বিলম্ব নাই

বড়দিনের ছুটির আর বিলম্ব নাই। স্কুল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে এবং দোকানদার মহলে বেশ একটু চাঞ্চল্যের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে।

শীত-প্রভাতের কাঁচা সোনালী রৌদ্র কলের চিমনির ধুমকুঙ্কুটি কাটাইয়া কলিকাতা শহরকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছে। পথের ধারের নির্জীব গাছগুলার পাতায় একটা শিশির-সজল চাকচিক্য দেখা যাইতেছে। বাতাসে বেশ একটু কামড় আছে। বেলা যত বাড়িতেছে, রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার দ্রুত যাতায়াত ও পথিকের সংখ্যা ততই বাড়িয়া চলিয়াছে। নানারঙের শাল র্যাপার ও মাঝে মাঝে। দু-একখানা বেগুনি রঙের বালাপোশ পথচারীদের অঙ্গে থাকিয়া রবিকরোজ্জ্বল দৃশ্যটাকে বেশ বর্ণবহুল করিয়া তুলিয়াছে।

ছাদের অনুচ্চ আলিসার ধারে দাঁড়াইয়া চুল শুকাইতে শুকাইতে বিমলা বাহিরের দিকে তাকাইয়া ছিল। কিশোর ভোরবেলাই বাহির হইয়া গিয়াছে, তখনও ফিরে নাই। আজ সে কলেজে যাইবে না, তাই রান্নারও বিশেষ তাড়া নাই।

পাশের বাড়িখানার দিকে দৃষ্টি পড়িতে বিমলা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। প্রায় চার মাস হইল বিনয়বাবুরা বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন। কোথায় গিয়াছেন, তাহা বোধ করি দীনবন্ধুবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলে জানা যাইতে পারি কিন্তু বিমলা কি কিশোর কেহই জিজ্ঞাসা করে নাই। তবে একেবারে বাস তুলিয়া দিয়া যে যান নাই, তাহা প্রশ্ন না করিয়াও জানা যায়। বেশীর ভাগ আসবাবপত্রই বাড়িতে পড়িয়া আছে। শুধু কয়েকটা বিছানা ও বাক্স লইয়া বাড়িতে তালা লাগাইয়া। তাঁহারা চলিয়া গিয়াছেন।

এই শূন্য বাড়িটার সঙ্গে একটা মর্মান্তিক বেদনার স্মৃতি বিমলার মনে জড়াইয়া গিয়াছিল। কিশোরের মনের ভাব কী তাহা বিমলা জানিত না, কিন্তু তাহা অনুমান করিয়া লওয়া কঠিন নহে। কিশোরের অন্তররাজ্যে যখন এই বিষম ওলট-পালট ঘটিয়া গেল, তখনও সে বাহিরে কিছুই প্রকাশ করিতে পারে নাই, কেবল বিমলার পুনঃপুনঃ প্রশ্নের উত্তরে ম্লান হাসিয়া বলিয়াছিল, থাক বৌদি, ও কথায় আর কাজ নেই। ওদের সঙ্গে আমাদের সব সম্বন্ধ চুকে গেছে। তাহার এই ব্যথিত নীরবতার হেতু বিমলা বুঝিয়াছিল এবং কেন যে উহাদের সঙ্গে সকল সম্বন্ধ নিঃশেষে চুকিয়া গেল, তাহা হৃদয়ঙ্গম করিতেও বিলম্ব হয় নাই।

তাই, যে সমস্যাটাকে একদিন বিমলা হঠকারিতার দ্বারাই নিষ্পন্ন করিয়া দিয়াছিল, তাহা আবার দ্বিগুণ জটিল হইয়া দেখা দিল। তাহাকে লইয়া বাপের সহিত কিশোরের বিচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে, ইহা না হয় সে সত্যের মুখ চাহিয়া, ন্যায়ের দিক দিয়া সহ্য করিয়াছে। কিন্তু এমনই করিয়া বন্ধু বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সকলের সঙ্গেই যদি কিশোরের ছাড়াছাড়ি হইতে থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত সে দাঁড়াইবে কাহাকে ভর করিয়া? কিশোরের সমস্ত ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙক্ষা যদি বিমলার সংসর্গ-দোষেই। এমনভাবে ব্যর্থ হইয়া যায়, তবে শুধু ন্যায়-ধর্মে দোহাই দিয়া বিমলা কোন মুখে কিশোরের গলায় পাথর হইয়া ঝুলিয়া থাকিবে? সংসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করিয়া তুলিয়া কিশোরের এমন মূল্যবান জীবন নষ্ট করিয়া দিবার অধিকার তাহার আছে কি?

সেদিন বিমলা কিশোরকে গিয়া বলিয়াছিল, ঠাকুরপো, আমাকে কাশী পাঠিয়ে দাও, এখানে আমার মন টিকছে না। মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিও, তাহলেই আমার চলে যাবে। কিশোর জবাব দিয়াছিল, তা হয় না, বৌদি। তোমার মনের কথা আমি বুঝেছি, কিন্তু আজ যদি তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাও, তাহলে মিথ্যাকে স্বীকার করে নেওয়া হবে।কাশীতে থাকতে চাও, বেশ চল, আমিও তোমার সঙ্গে থাকব।

কথাটা এইখানেই শেষ হইয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাই বলিয়া দুঃখের মাত্রা এক বিন্দুও লাঘব হয় নাই।

বিমলার যখনই ঐ জানালা-দরজা বন্ধ বাড়িটার প্রতি নজর পড়িত, তখনই অপরিসীম ব্যথার সহিত মনে হইত, কেন মানুষ মানুষকে এত ভুল বোঝে? এত বন্ধুত্ব, এত প্রণয় তাহার মধ্যেও কি সত্যকার পরিচয় হয় না? মানুষের মুখের দিকে চাহিয়া তাহার প্রকৃত স্বরূপ চিনিয়া লওয়া কি অসম্ভব? সুহাসকে সে তো চিনিয়াছিল, তবে সুহাস তাহাকে চিনিল না কেন? আর সকলের উপর সুহাস যাহাকে এত ভালবাসিয়াছিল, তাহাকে এমন করিয়া অবিশ্বাস করিল কি করিয়া?

কিশোরের নিগ্রহের পালা যে শেষ হয় নাই, তাহার ইঙ্গিতও বিমলা মাঝে মাঝে পাইত। কলেজ হইতে ফিরিবার পর এক-একদিন তাহার ক্লিষ্ট নির্যাতন-চিহ্নিত মুখের প্রতি চাহিয়া বিমলা নিরুদ্ধ যন্ত্রণায় ছটফট করিতে থাকিত। কিন্তু আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন মুখের উপর জাজ্বল্যমান দেখিয়াও, কে আঘাত করিল, কেন আঘাত করিল, জিজ্ঞাসা করিতে পারিত না। দুইজনের মাঝখানে অব্যক্ত ব্যথার ভার পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিত। যে বেদনার ভাগ লইবার কেহ নাই, সহানুভূতির দ্বারা সরল করিবারও উপায় নাই, তেমন দুর্বহ ব্যথা পৃথিবীতে বুঝি অল্পই আছে।

কিশোরের বাহ্য ব্যবহারে কোন পরিবর্তন লক্ষিত হইল না বটে, কিন্তু তাহার স্বচ্ছ আনন্দময় দর্পণের মত উজ্জ্বল প্রাণের উপর যেন একপুরু ধূলার পর্দা পড়িয়া গিয়াছিল, পূর্বের হাসি আমোদ কিছুই ছিল না। জোর করিয়া সমস্ত মন প্রাণ সে ল্যাবরেটরির কাজে ঢালিয়া দিয়াছিল। যতক্ষণ বাড়িতে থাকিত ল্যাবরেটরিতেই থাকিত, বিমলাও নির্বাক ছায়ার মত তাহার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করিয়া যাইত। পূর্বের মত এই সংযুক্ত কর্মের সময়টি রহস্যালাপের দ্বারা সরস হইয়া উঠিত না। নেহাত যখন অসহ্য হইয়া পড়িত, তখন কিশোর বলিত, আর পারি না। চল বৌদি, ও ঘরে বসে নিশ্চিন্দি হয়ে দুটো গল্প করিগে।

পাশের ঘরে গিয়া উদ্যোগ-আয়োজন করিয়া প্রথমটা গল্প বেশ সতেজেই আরম্ভ হইত, কিন্তু ক্রমে ভগ্নোদ্যম হইয়া অবশেষে অর্ধপথে নীরব হইয়া যাইত। জোর করিয়া বাজে কথার জের টানিয়া চলা আর কিছুতেই সম্ভব হইত না।

এমনই করিয়া প্রায় নিঃসঙ্গভাবে এই দুইটি নরনারীর জীবন বহিয়া চলিয়াছিল। পরিচিতদের মধ্যে কেবল দীনবন্ধুবাবু আসিয়া মাঝে মাঝে খোঁজ-খবর লইয়া পূর্বসম্বন্ধ বজায় রাখিবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু এই দুটি আত্ম-সমাহিত ব্যক্তির গম্ভীর স্বাতন্ত্র ভেদ করিতে পারিতেন না। ইহাদের দুর্জয় অভিমান যেন দুর্গদ্বার রোধ করিয়া তাঁহাকেও বাহিরে ফেলিয়া রাখিত।

সাড়ে নটার সময় বহিদ্বারে কিশোরের গলা শুনিয়া বিমলা শুষ্কপ্রায় এলো চুল জড়াইতে জড়াইতে তাড়াতাড়ি ছাদ হইতে নামিয়া আসিল।

কিশোর গায়ের শালখানা নামাইয়া রাখিয়া পকেট হইতে পুরু লম্বা গোছের একটা বন্ধ লেফাফা বাহির করিয়া বিমলার হাতে দিয়া বলিল, সব হয়ে গেল। নাও, এটাকে যত্ন করে রেখে দাও।

লেফাফা হাতে লইয়া বিমলা দেখিল, তাহার উপর বড় বড় অক্ষরে তাহার নাম লেখা রহিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল, কী এ?

ওতে তোমার পেটেন্টের কাগজপত্র আর বিক্রি কন্ট্রাক্টের দলিল আছে। উকিলবাড়ি থেকে এলুম। টাকাগুলো ব্যাঙ্কে জমা করে দিতে বলে এসেছি। অত টাকা ঘরে ফেলে রেখে কোন লাভ নেই, ব্যাঙ্কে থাকলে মোটা রকম সুদ পাবে।

বিমলা উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কত টাকায় বিক্রি হলে? কারা কিনলে?

চৌদ্দ হাজার টাকা নগদ আর শতকরা পঁচিশ টাকা রয়ালটি। সত্যি কথা বলতে কি, বৌদি, এত দাম যে পাওয়া যাবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। বেঙ্গল কেমিক্যালকে দিলুম, ওদের কাছ থেকেই। সবচেয়ে বেশী দর পাওয়া গেল। হাসিমুখে বলিল, আর আমার টাকার দুঃখ রইল না বৌদি, এবার। এই হতভাগা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বসে বসে তোমার অন্ন ধ্বংস করব।

বিমলা নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল। শেষে বলিল, টাকার দুঃখ তোমার রইল না, সে যেন বুঝলুম, কিন্তু আমার অন্ন ধ্বংস করবে তার মানে কি?

কিশোর হাসিতে হাসিতে বলিল, পেটেন্ট তোমার নামে নিয়েছি কিনা, আর টাকাটাও ব্যাঙ্কে তোমার নামেই জমা হবে।

কেন?

কেন, তোমার জিনিস—তোমার টাকা, তোমার নামে থাকবে না তো কার নামে থাকবে?

 ভীতভাবে বিমলা বলিল, এ কী করলে, ঠাকুরপো! এ কেন করতে গেলে?

কেন, অন্যায়টা কী করেছি?

অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া বিমলা বলিল, তোমার টাকা আমার নামে থাকলে কোন ক্ষতি নেই,—সে থাক। কিন্তু ঠাকুরপো, যে জিনিস এত পরিশ্রম করে আবিষ্কার করলে, তার সঙ্গে নিজের নামটা সংযুক্ত করে রাখতেও কি তোমার ইচ্ছে হল না?

আবিষ্কার যদি আমি করতুম, তাহলে আলবত সে ইচ্ছে হত। কিন্তু আবিষ্কার তত আমি করিনি বৌদি, তুমি করেছ। আমি তো শুধু কলের মত কাজ করে গেছি, নিজের বৈজ্ঞানিক শিক্ষাকে বুদ্ধির যন্ত্রে ফেলে মজুরের মত চাকা ঘুরিয়েছি। আসল যা প্রাণ–প্রেরণা, অধ্যবসায়—সবই তো তোমার। পাছে কেউ ভুল করে, কিংবা আমিই কোনদিন বুদ্ধির দোষে ওটাকে নিজের আবিষ্কার বলে মনে করে বসি, তাই ওর নাম কি দিয়েছি জানো, বৌদি?

বিমলা ক্ষীণস্বরে বলিল, কি?

বিমলা-সুধা। ঠিক হয়নি? তুমি মাথা নাড়বে জানি, কিন্তু এ আমি জোর করে বলতে পারি বৌদি, ওর যদি সত্যিকার কোন গুণ না-ও থাকে, তবুও শুধু তোমার নামের পুণ্যে বাংলাদেশের রুগ্ন শিশুদের কাছে অমৃততুল্য হয়ে উঠবে।  

ক্ষুব্ধস্বরে বিমলা বলিয়া উঠিল, না না ঠাকুরপো, এ তুমি ভাল করনি। টাকা তুমি যাকে ইচ্ছে দিতে পার কিন্তু ভালবাসার খাতিরেও নিজের ন্যায্য খ্যাতি বিলিয়ে দেবার অধিকার তোমার নেই। না, আমাকেও না। এ তুমি ভারি অন্যায় করেছ ভাই।

কিশোর মৃদুস্বরে বলিল, আমি খ্যাতির কাঙাল নই, বৌদি!

ব্যাকুল হইয়া বিমলা বলিল, কিন্তু আমি যে তোমার খ্যাতির কাঙাল। আমি যে চাই সকলে জানুক দেখুক যে, তুমি ছোট নও, সামান্য নওযারা দূরে সরে গিয়ে তোমার বিচার করতে চায়, তাদের চেয়ে তুমি অনেক উঁচু। তুমি যে আমার কত বড় গর্ব, কত বড় অহঙ্কার, তা আমি তাদের কি করে দেখাব, ঠাকুরপো? আমার সেই অহঙ্কারে তুমি বাদ সাধলে? বলিতে বলিতে তাহার স্বর কান্নার। ভারে ভাঙিয়া পডিল।

কিশোরও মনে মনে বিচলিত হইল, কিন্তু মুখে হাসিয়া বলিল, আচ্ছা মেনে নিচ্ছি বৌদি, অপরাধ পরাধ হয়েছে, বারদিগর আর এমন হবে না। তোমার অহঙ্কারের কথাটা ভেবে দেখিনি। এবার থেকে নিজের নামই জাহির করব।

চোখ মুছিয়া বিমলা বলিল, পরের কথা পরে হবে। এখন একে শোধরাবার কোন উপায় নেই?

কিশোর মাথা নাড়িল, না, যা হবার হয়ে গেছে। কিন্তু ও কথা এখন থাক।

থাক কেন?

আর একটা ভারি দরকারী কথা কদিন থেকে তোমায় বলব মনে করছি, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। সামনেই ছুটি, চল কিছুদিন কোথাও ঘুরে আসা যাক। কলকাতা আর ভাল লাগছে না।

কোথাও যাবে?

কোথাও তো বেশী দিন থাকা চলবে না, মাত্র দশ বারো দিনের ছুটি।–শুধু ঘুরে বেড়ানো, তা কাশী থেকে আগ্রা হয়ে বৃন্দাবন বেড়িয়ে ফিরে আসা যাক—কি বল? তোমার তীর্থদর্শন আর আমার তাজ-দর্শন দুই হবে।

একটু ভাবিয়া বলিল, বেশ, চল।

কিশোর খুশি হইয়া বলিল, তাহলে হাজারখানেক টাকা ও-থেকে রাখি, কেমন? ব্যাঙ্কে জমা দেবার পর আবার বার করা মুশকিল হবে। তোমার হাতে বোধ হয় কিছুই নেই?

বিমলা বলিল, সামান্যই আছে, তাতে চলবে না। কিন্তু হাজার টাকার দরকার নেই, পাঁচশ হলেই যথেষ্ট হবে।

কিশোর হাসিয়া বলিল, বেশ, তোমার টাকা, তুমি যদি পাঁচশর বেশী খরচ করতে না চাও, তাহলে তাই সই।

বিমলাও হাসিল, বলিল, তা তো বটেই। নিজের টাকা বলেই তো আমার অত দরদ, নইলে তোমার টাকায় কি আমার মায়া আছে?

চাবি দিয়া আলমারি খুলিয়া দলিলের লেফাফাখানা সযত্নে রাখিয়া দিয়া বিমলা বলিল, আর আমি দাঁড়াব না, এখনও রান্না চড়াইনি। তোমাকে তো আবার খেয়ে বেরুতে হবে?

হ্যাঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *