১২. পাঁচটা বাজিতে না বাজিতে

পাঁচটা বাজিতে না বাজিতে দীনবন্ধুবাবু আবার আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাহির হইতে কিশোরকে একটা ডাক দিয়া বিনয়বাবুর বাড়িতে প্রবেশ করিতে যাইবেন, এমন সময় একখানা গাড়ি সম্মুখে আসিয়া থামিল। গাড়ি হইতে করবী, অনুপম ও হেমাঙ্গিনী অবতরণ করিলেন। সকলের বেশভূষার কিছু অধিক পারিপাট্য দেখিয়া দীনবন্ধু বুঝিলেন, শুধু এখানে নয়, আর কোথাও যাইবার জন্য ইহারা প্রস্তুত হইয়া বাহির হইয়াছেন।

কথা কহিতে কহিতে সকলে একসঙ্গে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। কিছুক্ষণ পরে কিশোরও আসিয়া উপস্থিত হইল; তাহাকে দেখিয়া করবী আনন্দে বলিয়া উঠিল, এই যে, কিশোরবাবুও এসে পড়েছেন—বেশ হয়েছে। আমরা সুহাসদিকে বায়োস্কোপে ধরে নিয়ে যাব বলে এসেছি। আপনিও চলুন।

অনুপমের মুখ অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। কিন্তু দূরদর্শিনী হেমাঙ্গিনী করবীর কথায় সম্পূর্ণ সায় দিয়া। বলিলেন, হ্যাঁ—সেই বেশ হবে। করবীর সঙ্গে সারাক্ষণ কথা কইবার জন্য একজন চাই তো। বায়োস্কোপ দেখতে বসে রাজ্যের যত কথা ওর মনে আসে। আমি বাপু বুড়োমানুষ, ওর সঙ্গে বকতে পারব না। কিশোর, তুমি বাবা ওকে সামলে রেখো।

হেমাঙ্গিনীর সুমিষ্ট কথার মধ্য হইতে ইঙ্গিতটা গোপন রহিল না যে, করবীকে সঙ্গদান করিবার জন্য কিশোরের বায়োস্কোপে যাওয়া চলিতে পারে এবং ইহার ফলে ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে সুহাসিনীকে সঙ্গদান করিবার ভার বাধ্য হইয়া কাহার উপর পড়িবে তাহাও সহজেই অনুমান করিতে পারা যায়।

এই সহজে অনুমেয় তত্ত্বটি যিনি সর্বাগ্রে বুঝিয়াছিলেন সেই দীনবন্ধুবাবু কিন্তু বাদ সাধিলেন। ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, কিশোরকে আজ তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে, করবী। তোমাকে শ্যাপেরোন করবার সৌভাগ্য আজ ওর হল না। ওকে আমার একটু দরকার আছে।

কী দরকার জিজ্ঞাসিত হইয়াও দীনবন্ধুবাবু কিছু ভাঙিলেন না, শুধু বলিলেন, জরুরী কাজ, তা না হলে আটকাতুম না। অনুপম বাবাজী একলা তিনটি মহিলাকে নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়বেন বুঝতে পরছি, কিন্তু উপায় কি?

করবী একটু ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, আপনি সব মাটি করে দিলেন। ভেবেছিলুম আজ বকে বকে কিশোরবাবুর মাথা ধরিয়ে দেব, তা আর হল না। যাহোক, আমার নিমন্ত্রণ পেছিয়ে গেল মাত্র, আর একদিন হবে,—কি বলেন, কিশোরবাবু?

কিশোর স্মিতমুখে সম্মতি জানাইল।

বায়োস্কোপে যাইবার তাড়াতাড়ি বিশেষ ছিল না, তখনও যথেষ্ট সময় ছিল। তাই সকলে মিলিয়া সময় কাটাইবার জন্য গল্পসল্প করিতে লাগিলেন। করবী ও সুহাসিনী ঘরের একটা কোণে গিয়া গল্প জুড়িয়া দিল। তাহাদের মৃদু কথিত গলার আওয়াজ ও মাঝে মাঝে করবীর হাসির শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। হেমাঙ্গিনী দীনবন্ধুবাবুকে পাকড়াও করিয়া কথাচ্ছলে বুঝাইতে লাগিলেন যে, বর্তমান যুগে স্ত্রীলোক হইয়া বিষয়-সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করা কিরূপ কঠিন ব্যাপার এবং কলিকাতা শহরে ভাড়াটে নামক অর্থপিশাচ জীবগুলার নিকট হইতে মাসিক বাড়িভাড়া আদায় করা কী অমানুষিক ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার কাজ; দীনবন্ধু চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বোধ করি খুব মনোযোগ দিয়াই শুনিতে লাগিলেন।

দৈবক্রমে কিশোর, অনুপম ও বিনয়বাবু পরস্পর কাছাকাছি চেয়ারে বসিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহাদের মধ্যেও দল পাকাইয়া একটা কোন প্রসঙ্গের আলোচনা হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোন প্রসঙ্গই জমিতেছিল না। বিনয়বাবু বায়োস্কোপ সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে শিক্ষা বিস্তার লইয়া একটা আলোচনা আরম্ভ করিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু গোড়া হইতেই উৎসাহ ও প্রেরণার অভাবে উহা নির্জীব ভাব ধারণ করিয়া অকালে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। চুপচাপ মুখোমুখি বসিয়া থাকার অপেক্ষা যাহা হউক কিছু বলা দরকার মনে করিয়া কিশোরও একবার একটা কথা উত্থাপন করিবার চেষ্টা করিল কিন্তু কোথায় এই তিনজনের মনের মধ্যে অনেকখানি সংকোচ ও কুণ্ঠা লুকাইয়া ছিল, অম্নরসের মত তাহা বারংবার তাহাদের ঘনীভূত জল্পনার সকল উদ্যোগই ছিড়িয়া ব্যর্থ করিয়া দিতে লাগিল।

অনুপম এইবার গলাটা সাফ করিয়া লইয়া বলিল, আজ যশোর থেকে আমার এক বন্ধুর চিঠি পেলুম। তিনি কিশোরবাবুকে চেনেন।

কিশোর বলিল, আমাকে চেনেন! কী নাম বলুন তো?

ধনপতি চৌধুরী—ডাক্তার।

কিশোর চিন্তা করিয়া বলিল, কী জানি, আমি তো মনে করতে পারছি না। যশোরে আমি মাত্র একবার গিয়েছি, তাও এমন অবস্থায় যে—।

অনুপম মুখ অত্যন্ত গম্ভীর করিয়া বলিল, আপনি না চিনতে পারেন; তবে যাঁকে আপনি বৌদিদি বলে নিজের কাছে রেখেছেন, তিনি বিলক্ষণ চেনেন।

হঠাৎ ঘরের মধ্য দিয়া যেন একটা বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। কথাটা অনুপম ইচ্ছা করিয়াই বেশ জোর গলায় বলিয়াছিল, তাই সকলেই শুনিতে পাইলেন, এবং কথার অন্তর্নিহিত বক্রোক্তিটাও এতই সুস্পষ্ট যে কাহারও কর্ণকে ফাঁকি দিতে পারিল না। ঘরের কোণে করবী ও সুহাসিনীর বাক্যালাপ বন্ধ হইয়া গেল। দীনবন্ধুবাবু চোখ খুলিয়া সোজা হইয়া বসিলেন, বিনয়বাবু ফ্যালফ্যাল করিয়া অনুপমের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলেন। কেবল হেমাঙ্গিনী ক্ষণেকের জন্য নীরব হইয়া, যেন কিছুই হয় নাই এমনই ভাবে দীনবন্ধুর উদ্দেশ্যে আবার কথা কহিতে শুরু করিলেন।

কিশোর স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনুপমকে নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিল, আপনি কী ইঙ্গিত করছেন, পরিষ্কার করে বলবেন কি?

ভ্রূ তুলিয়া অনুপম বলিল, ইঙ্গিত? ইঙ্গিত তো কিছু করিনি। যাকে আপনি বৌদিদি বলে থাকেন–

শান্তস্বরে কিশোর বলিল, অনুপমবাবু, সোজা কথাকে এত ঘুরিয়ে বলবার প্রয়োজন কী তা তো বুঝছি না। আমি স্পষ্ট কথা শুনতে ভালবাসি।

অনুপম বিদ্রূপ করিয়া বলিল, আমিও স্পষ্ট কথা বলতে ভালবাসি এবং সেইজন্যেই বলছি যে স্ত্রীলোকটিকে আপনি বৌদি বলে প্রচার করে নিজের

কিশোরের অনুচ্চ অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ছুরির মত অনুপমের মুখের কথাকে কাটিয়া দ্বিখণ্ডিত করিয়া দিল, ব্যস! আর না। আপনি কি বলতে যাচ্ছেন আমি অনুমান করতেও চাই না। কিন্তু আপনার ভালর জন্যেই বলছি—ভবিষ্যতে যখন ওঁর উল্লেখ করবেন তখন আমার বৌদিদি বলেই করবেন।

কিশোরের কণ্ঠস্বর ও চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যাহা অনুপম পূর্বে কখনও দেখে নাই। অনুপম আজ কিশোরকে নূতন করিয়া চিনিল। ইহাকে এমন অবহেলাভরে ঘাঁটানো যে নিরাপদ নহে, এই কথা হৃদয়ঙ্গম হইবামাত্র সে চট করিয়া কথার ভঙ্গি বদলাইয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, কিন্তু আমি তো অন্যায় কথা কিছুই বলিনি। ধনপতির চিঠি পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে উনি আপনার নিজের বৌদিদি নন, সেই কথাই বলছিলুম। কিন্তুধনপতি এমন কথা লিখলে কেন? সে আপনাদের বিষয় অনেক কথাই লিখেছে। এ কথাও লিখেছে যে তীর্থনাথ হালদার বলে কোন এক মাস্টার–

কিশোর শুস্বরে বলিল, আপনাদের বন্ধুটি সত্যি কথাই লিখেছেন। এবার তাঁকে মনে পড়েছে, ডাক্তারের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন করে যাবার চেষ্টা করেছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে আমার একটু মনোমালিন্য হয়েছিল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু কথাটা ঠিক, উনি আমার নিজের বৌদিদি নন, এমন কি মাসতুত-পিসতুতও না। উনি আমার এক বন্ধুর স্ত্রী। কিন্তু থাক, নিজের পারিবারিক কথা অন্যের সঙ্গে আলোচনা করতে আমি ভালবাসি না। আপনাদের পক্ষে এইটুকুই যথেষ্ট যে, উনি আমার বৌদিদি। বলিয়া কিশোর উঠিয়া দাঁড়াইল।

সুহাসিনী এতক্ষণ ঘাড় হেঁট করিয়া শুনিতেছিল, কিশোর উঠিয়া দাঁড়াইতেই সে চোখ তুলিয়া তাহার মুখ দেখিতে পাইল। সঙ্গে সঙ্গে আর একদিনের একটা দৃশ্য তাহার চোখের উপর দিয়া কালো মেঘের মত ছায়া ফেলিয়া গেল—সেই যেদিন ছাদের উপর ভিজিতে ভিজিতে কিশোর ও বিমলাকে হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিল। তাহাকে দেখিতে পাইয়া কিশোরের সন্ত্রাস পলায়ন—ক্ষণকালের জন্য সেই ছবিটা অন্য এক রূপ ধরিয়া তাহার বুকের মধ্যে সব আলো মুছিয়া নিল।

কিন্তু তাহা ক্ষণকালের জন্য। মুহূর্তমধ্যে সে এই অতি গর্হিত সন্দেহটাকে মন হইতে দূরে ঠেলিয়া দিল, এবং নিজের ক্ষুদ্রতাকে ধিক্কার দিয়া দৃঢ়পদে উঠিয়া কিশোরের সম্মুখীন হইয়া বলিল, আজ আপনি আমাদের সঙ্গে বায়োস্কোপে যেতে পারলে আমি খুব খুশি হতুম। কিন্তু যখন যাওয়া হল না, তখন আর একদিন আমি, আপনি, বাবা আর কাকাবাবু একসঙ্গে যাব—এই কথা রইল। আর আপনার বৌদিদি যদি আসেন–

নিমেষমধ্যে কিশোরের মুখের মেঘ কাটিয়া গেল, সে প্রফুল্ল হইয়া বলিল, আচ্ছা বেশ, বৌদিদিকেও যে-করে পারি ধরে নিয়ে যাব।

করবী সুহাসিনীর পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে বলিল, বা রে! আর আমি বুঝি বাদ? সে হবে না, আমিও যাব। কিশোরবাবু, মনে আছে তো আপনার সঙ্গে কী কন্ট্রাক্ট হয়েছে?

দীনবন্ধু অতিশয় সরল মনে বলিলেন, বেশ কথা। সেদিন করবীর সমস্ত কথা শোনবার এবং তার উত্তর দেবার ভার আমি নিলুম। বলিয়া নিরীহভাবে সপুত্র হেমাঙ্গিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।

দীনবন্ধুর কথায় সুহাসিনীর চমক ভাঙিল। আজই সকালে, যাহাকে সে ভালবাসে বলিয়া প্রকারান্তরে স্বীকার করিয়াছে, তাহাকে পিতা এবং অন্যান্য গুরুজনের সম্মুখে এমনভাবে সম্বোধন করার বিসদৃশ নির্লজ্জতা চোখে পড়িবামাত্র সঙ্কোচে সে মাটির সহিত মিশিয়া গেল এবং কেন যে অকারণে এতগুলা কথা কিশোরকে বলিতে গেল, তাহাও বুঝিতে না পারিয়া নিজের প্রগতার জন্য নিজেই বিরক্ত হইয়া উঠিল।

এই সময় হেমাঙ্গিনী উঠিয়া দাঁড়াইয়া নীরসকণ্ঠে বলিলেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সুহাস, তোমার শ্লিপার জোড়া বদলে নাও। এর পর গেলে গোড়াটা দেখতে পাবে না।–অনুপম, একটা ট্যাক্সি।

সুহাসিনী নিজের পায়ের দিকে একবার দৃষ্টি নামাইয়া দ্রুতপদে নিজের ঘরের উদ্দেশে প্রস্থান করিল।

মিনিট পাঁচেক পরে বায়োস্কোপ-যাত্রীদের গাড়ি রওনা হইয়া গেলে অবশিষ্ট তিনজন আবার ঘরে আসিয়া বসিলেন।

কিন্তু অনুপমের সঙ্গে ঐ অপ্রীতিকর চচার্টা তিনজনকেই ভিতরে ভিতরে পীড়া দিয়া তাঁহাদের মনের সহজ শান্ত ভাব নষ্ট করিয়া দিয়াছিল। তাই, যে কথা বলিবার জন্য কিশোরকে আটকাইয়া রাখা হইল, দুইজনের কেহই তাহা সহসা উত্থাপন করিতে পারিলেন না। অসংলগ্ন অন্যমনস্কভাবে কথাবার্তা চলিতে লাগিল। প্রয়োজনীয় কথাটা কী, তাহা জানিবার জন্য কিশোরেরও কম কৌতূহল ছিল না, কিন্তু সে কোন প্রশ্ন করিল না। সময় উপস্থিত হইলে দীনবন্ধু আপনা হইতেই বলিবেন বুঝিয়া সে প্রতীক্ষা করিয়া রহিল।

তারপর কখন অজানিতভাবে তিনজনের মধ্যে একটি প্রগাঢ় আলোচনা শুরু হইয়া তাঁহাদের এমনই অখণ্ড মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া লইল যে, সময়ের দিকে কাহারও লক্ষ্য রহিল না। আধুনিক ও প্রাচীন ইংরাজী, ফরাসী, ইটালীয় ও জার্মান সাহিত্যের কাব্যের দিকটাতে বিনয়বাবুর অসামান্য পাণ্ডিত্য ছিল। দীনবন্ধুবাবুরও সকল বিষয়ে এমন একটি স্বাভাবিক সত্যদৃষ্টি ছিল যে, কাব্য-বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের অভাব সত্ত্বেও বোধ ও অনুভূতির ব্যাপকতা দ্বারা তাহা পূর্ণ করিয়া লইতে পারিতেন। কিশোরের শিক্ষার ধারা যদিও রসায়নের দিকেই গিয়াছিল, তথাপি তাহার উৎসুক মন রসশাস্ত্রকেও কোন দিন অবহেলা করে নাই, বাংলা ও ইংরাজী কাব্যে তাহার ভাল রকম দখল ছিল। সুতরাং বিনয়বাবুর জ্ঞানপূর্ণ অথচ সরল কাব্যালোচনা সকলের হৃদয়ের মধ্যেই একটি সরস তন্ময়তার সৃষ্টি করিয়াছিল। বিনয়বাবু পাশ্চাত্ত্য মহাকাব্যের আদি পিতা হোমার হইতে আরম্ভ করিয়া ভার্জিল, দান্তে, টাসো, চসার, ফ্রাঁসোয়া, ভিল, গেটে, ভিক্টর হুগো, কীটস এবং সর্বশেষ রুপার্ট ব্রুক—সকলকে রসের একসূত্রে গ্রথিত করিয়া কাব্যের বংশানুক্রম দেখাইয়া যাইতেছিলেন, কিশোর ও দীনবন্ধু মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিলেন ও মাঝে মাঝে দু একটা কথার দ্বারা নিজ নিজ উপলব্ধির আনন্দ প্রকাশ করিতেছিলেন, এবং দুজন শ্রোতারই মনে থাকিয়া থাকিয়া এই বিস্ময়টি খেলিয়া যাইতেছিল যে, সংসারী বিনয়বাবু ও অধ্যাপক বিনয়বাবুতে কী আকাশ-পাতাল প্রভেদ!

ঠং করিয়া ঘড়ি বাজিতেই সকলে একসঙ্গে চোখ তুলিয়া দেখিলেন সাড়ে আটটা। বিনয়বাবু লজ্জিত হইয়া বলিলেন, তাই তো হে, দু ঘণ্টা ধরে বকে চলেছি। আর তোমরা চুপ করে বসে শুনছ? তোমাদের ধৈর্য তো কম নয়।

দীনবন্ধু একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আরও দুঘণ্টা হলেও আমার ধৈর্যচ্যুতি হত না। কিন্তু সে যাক। এখন আপনি কিশোরকে কী বলতে চান তাই বলুন।

বিনয়বাবু চেয়ার হইতে উঠিয়া একবার ঘরময় পায়চারি করিলেন, চুলের মধ্য দিয়া আঙুল চালাইয়া চুলগুলাকে অত্যন্ত এলোমেলো করিয়া তুলিলেন, তারপর বিস্মিত কিশোরের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া প্রায় ভগ্নস্বরে বলিলেন, বাবা কিশোর, আমার সুহাসকে আমি তোমার হাতে দিতে চাই—তাকে— বলিয়া আরও কিছু বলিতে চাহিলেন কিন্তু আবেগের পূর্ণতা হেতু বলিতে পারিলেন না।

কিশোর উঠিয়া দাঁড়াইল। এত অপ্রত্যাশিত, এমনই অচিন্তনীয় এই প্রস্তাব যে, কিশোরের মাথা ঘুরিয়া গেল। হৃৎপিণ্ড গলার কাছে আসিয়া সবেগে স্পন্দিত হইতে লাগিল এবং মুহূর্তের জন্য ঘূর্ণমান পৃথিবীটা তাহার চক্ষুর সম্মুখ হইতে লুপ্ত হইয়া গেল। কেবল সেই শূন্যতার কেন্দ্রস্থলে একখানি স্মিতসলজ্জ সুকুমার-সুন্দর মুখ তাহার দিকে চাহিয়া হাসিতে লাগিল। তারপর আনন্দের বন্যার মত এই অনুভূতি তাহার হৃদয়ের উপর দিয়া প্রবাহিত হইয়া গেল যে, তাহার নিভৃত অন্তর্যামী এই বস্তুটিকেই এত দিন একান্তভাবে কায়মনোবাক্যে কামনা করিতেছিল। কিন্তু এত নিগুঢ় সে কামনা যে, কোনদিন তাহাকে নিজের মনেও স্পষ্ট করিয়া রূপ দিবার সাহস তাহার হয় নাই। সে। নিজের কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য সংযত করিয়া বলিল, কিন্তু তিনি কি–?

দীনবন্ধুবাবু হাত বাড়াইয়া তাহার হাতে একটু চাপ দিয়া বলিলেন, হ্যাঁ। তাঁর মত না নিয়ে কিছু করা হয়নি। বলিয়া কিশোরের হাত আর একবার চাপিয়া দিলেন।

.

এইবার কিশোরের সমস্ত স্নায়ু শিরা পূর্ণ করিয়া অনির্বচনীয় সুখের একটা শিহরণ বহিয়া গেল। সুহাস নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছে। সে তাহাকে চায়! হয়তো মনে মনে অনেক দিন হইতেই। প্রেয়সী নারীর হৃদয় জয় করিবার যে গর্ব, তাহা কিশোরের মুখখানাকে উদ্ভাসিত করিয়া দিল। সে সহাস্যে মুখ তুলিয়া বলিল, তবে আর আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আমি আর কী বলব, আপনাদের ইচ্ছাই আমার কাছে আদেশ।

বিনয়বাবু কম্পিতস্বরে বলিলেন, বেঁচে থাকো বাবা, দীর্ঘজীবী হও।

কিশোর নত হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। দীনবন্ধুর পায়ের কাছে মাথা নোয়াইতে তিনি সবলে তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া বলিলেন, কিশোর, এত দিন তুমি আমার ছাত্র সহকর্মী ছিলে, এবার তোমার পদবী বদলে গেল। জান তো, সুহাস-মায়ী আমার মা।

কিছুক্ষণ পরে দীনবন্ধু বলিলেন, তাড়াতাড়ি কিছু নেই, শ্রাবণ মাস তো শেষ হয়ে এল। মাঝে অঘ্রান মাসও বাদ যাবে—সেই মাঘ-ফাল্গনের আগে কিছু হচ্ছে না। কিন্তু এ দিকে কাজকর্ম সব। এগিয়ে রাখা ভাল। তোমার বাবাকে চিঠি লিখে, তারপর তাঁর কাছে গিয়ে সব ঠিক-ঠাক করতে হবে। সাহেবমেমের ব্যাপার তো নয় যে, শেষ বরাবর বাপকে একখানা নিমন্ত্রণপত্র দিলেই চলবে। বলা যায় না, তোমার বাবা হয়তো বরপণ দাবি করতে পারেন। তোমরা কুলীন বটে তো হে? বলিয়া হাসিতে লাগিলেন।

কিশোরের নিকট হইতে কিন্তু এ হাসির জবাব আসিল না। সহসা তাহার মুখখানা অত্যন্ত শুষ্কভাব ধারণ করিল। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া সে ধীরে ধীরে বলিল, বাবাকে জানানো কি আবশ্যক?

দীনবন্ধু বিস্মিত হইলেন, কিশোরের মনের ভাবটা ঠিক বুঝিতে পারিলেন না। তিনি জানিতেন। যে, কিশোরের পিতা দ্বিতীয়বার বিবাহ করিয়াছেন ও প্রথম পক্ষের ছেলের প্রতি তাঁহার স্নেহ কিছু আলগা হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু তাই বলিয়া বিবাহের সময় তাঁহাকে সংবাদ পর্যন্ত দেওয়া হইবে না, ইহাই বা কী করিয়া সম্ভব? তিনি বলিলেন, আবশ্যক নয়? বল কি হে? তিনি যে বরকতা, তিনি। যত দিন আছেন তত দিন তুমি যে কেউ নও। কথায় বলে বর না চোর। তাঁর অনুমতি যে সর্বাগ্রে চাই। অবশ্য তুমি সাবালক স্বাধীন, বাপের গলগ্রহ নও, সে সব আমি জানি। কিন্তু আমাদের সমাজে এ প্রথাটা অনাদিকাল থেকে চলে আসছেনা করলে তাঁকে অসম্মান করা হবে যে।

কিন্তু তিনি হয়তো কথা শেষ না করিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস চাপিয়া কিশোর উঠিয়া দাঁড়াইল, দীনবন্ধুর দিকে ফিরিয়া আস্তে আস্তে বলিল, এ বিষয়ে আমার কিছু বলা উচিত নয়, আপনারা যা ভাল বুঝবেন, করবেন।

একবার ঘড়ির দিকে চাহিয়া সে নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। তাহার ছায়াচ্ছন্ন আশঙ্কাচিহ্নিত মুখ লক্ষ্য করিয়া দীনবন্ধু ভাবিলেন, কিশোরের বাপ বোধ হয় সেকেলে গোঁড়া হিন্দু, এত বড় মেয়ের সঙ্গে এরূপ ম্লেচ্ছভাবাপন্ন ঘরে বিবাহ দিতে রাজী না হইতে পারেন, এই চিন্তা কিশোরকে উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছে।

অন্ধকার করিডর পার হইয়া বাহিরের বারান্দায় পা দিতেই কিশোর দেখিল সুহাসিনী মোটর হইতে নামিয়া গাড়ির অন্যান্য আরোহীদের নিকট বিদায় লইয়া বহিদ্বারের সম্মুখীন হইল। মোটর চলিয়া গেল। বাড়ির দ্বার খোলাই ছিল, অস্ফুটস্বরে একটা গানের কলি গুঞ্জন করিতে করিতে। বারান্দায় প্রবেশ করিয়া সুহাসিনী থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। যদিও বারান্দায় আলো ছিল না, তবু রাস্তার একটা গ্যাসের আলো জানালা দিয়া প্রবেশ করিয়া বন্ধ বারান্দাটিকে ঈষৎ আলোকিত করিয়াছিল। অস্পষ্ট আলোতে সুহাস চিনিল, কিশোর দাঁড়াইয়া আছে।

দুজনেই ক্ষণকাল পরস্পরের মুখের দিকে তাকাইয়া নীরব হইয়া রহিল, কাহারও মুখে সহসা কোন কথাই আসিল না। তারপর সুহাস মুখ নীচু করিয়া জড়িতস্বরে কী একটা বলিয়া পাশ কাটাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিল। কিশোরও তাড়াতাড়ি সরিয়া দাঁড়াইয়া পথ ছাড়িয়া দিল।

দরজা পার হইয়া সুহাস করিডরে প্রবেশ করিয়াছে—

সুহাস!

সুহাসিনী চমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। গ্যাসের আলো সোজা আসিয়া তাহার মুখের উপর পড়িয়াছিল, কিশোর তাহার কাছে গিয়া বলিয়া উঠিল, সুহাস, আজ তোমার বাবা তোমাকে আমার হাতে দান করতে চেয়েছেন। এ দান নেবার যোগ্যতা আমার আছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি নিয়েছি। দীনবন্ধুবাবু বললেন, তোমার অমত নেই। কিন্তু এই কথাটি আমি তোমার নিজের মুখে একবার শুনতে চাই।

সুহাসিনীর বুকের ভিতর যে ঝড় বহিয়া গেল, বাহিরে তাহা কিছুই প্রকাশ পাইল না, এমন কি তাহার সর্বশরীর যে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, তাহাও ক্ষীণালোকে ধরা পড়িল না। সে নতমুখে দাঁড়াইয়া রুমালের খুট আঙুলে জড়াইতে লাগিল।

কিশোর বলিল, এই কদিনের জানাশোনায় তুমি যে আমাকে ভালবাসবে এ আমি কল্পনাও করতে পারি না—তবু–কিশোর থামিল।

ঘরে আলো থাকিলে আজ সুহাস একটা কথাও মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিত না, কিন্তু এই আবছায়া আধ-অন্ধকার তাহার লজ্জাকে আবৃত করিয়া দিল। সে মুখ তুলিয়া মৃদুকম্পিত কণ্ঠে বলিল, কেন, কল্পনা করতে পারেন না?

কিশোর তাহার একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া আগ্ৰহস্পন্দিত স্বরে কহিল, সুহাস, সত্যিই কি–

সুহাসের মনে হইল, তাহার দেহের অস্থিমজ্জা পর্যন্ত দ্রব হইয়া তরল হইয়া গিয়াছে, আর বুঝি সে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিবে না। হাতখানা সে সম্পূর্ণ কিশোরের হাতে ছাড়িয়া দিয়া আর এক হাতে নিজের বুক চাপিয়া ধরিয়া রহিল।

সুহাস, সত্যিই কি তুমি আমাকে–? না, তুমি নিজের মুখে বলল। স্বপ্নের মত কিশোর শুনিতে পাইল, সুহাসিনী যেন বলিতেছে, হ্যাঁ! তুমি জানতে পারনি? আমিও আগে জানতে পারিনি। কাল রাত্রে যখন তুমি–সুহাসের মুখের কথা মুখে মিলাইয়া গেল।

কিছুক্ষণ দুইজনে এমনিভাবে হাত ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর অতি দীর্ঘনিশ্বাস পতনের শব্দে দুজনেই মুখ তুলিয়া দেখিল তাহাদের মুখের চেহারা কেমন বদলাইয়া গিয়াছে। কিশোর বুভুক্ষুর মত সুহাসিনীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিল, সুহাস, আমাকে বিশ্বাস করতে পারবে, আমার উপর মনপ্রাণ সব ছেড়ে দিয়ে নির্ভর করতে পারবে?

কথাগুলার মধ্যে এমন একটা ব্যগ্র মিনতি ছিল যে, সুহাসের চোখে জল আসিয়া পড়িল। যাহার হাতে সর্বস্ব তুলিয়া দিতে পারিয়াছে, তাহাকে বিশ্বাস করিতে পারিবে না? সে ঘাড় নাড়িয়া শুধু বলিল, পারব।

দুই হাতে সুহাসের নরম হাতখানা একবার ধরিয়া কিশোর ছাড়িয়া দিল। তারপর আর কোন কথা না বলিয়া দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। প্রাপ্তির এই প্রথম উচ্ছল উন্মাদনায় পাছে অধিকারের অতিরিক্ত কোন অসংযম প্রকাশ করিয়া ফেলে, এই ভয়ে জোর করিয়া সে নিজেকে ছিনাইয়া লইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *