১০. সন্ধ্যার অব্যবহিত পরে হেমাঙ্গিনী দেবী

সন্ধ্যার অব্যবহিত পরে হেমাঙ্গিনী দেবীর হাতিবাগানের বাড়ির দ্বিতলে একখানা বড় ঘরে গুটি দশ-বারো ভদ্রলোক ও মহিলা জড় হইয়াছিলেন। সকলে বিশিষ্ট পারিবারিক বন্ধু, বাহিরের লোক কেহ ছিল না। সুহাসকে লইয়া বিনয়বাবু উপস্থিত ছিলেন, দীনবন্ধুবাবুও আসিয়াছিলেন। ঘরের স্থানে স্থানে দুইজন বা তিনজন অতিথি একত্র হইয়া নিম্নকণ্ঠে বাক্যালাপ করিতেছিলেন, সকলের সম্মিলিত অনুচ্চ কণ্ঠস্বরে ঘরের মধ্যে একটি অস্ফুট গুঞ্জন উঠিতেছিল। গৃহকত্রী সোনার নাকটেপা। চশমা আঁটিয়া চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন এবং মাঝে মাঝে ইহাকে উহাকে সম্বোধন করিয়া আপ্যায়িত করিতেছিলেন। অনুপমচন্দ্র আকাশে চক্ৰায়মান চিলের মত সুহাসিনীকে কেন্দ্র করিয়া ঘরময় পরিভ্রমণ করিতেছিল।

ঘরের প্রায় মধ্যস্থলে একটা কৌচের উপর সুহাসিনী এবং আর একটি মেয়ে বসিয়া গল্প করিতেছিল। মেয়েটির নাম করবী, সে অনুপমের মামাত বোন। এতদিন দার্জিলিঙে মেয়েদের এক কনভেন্টে থাকিয়া পড়াশুনা করিতেছিল; এখন হঠাৎ কি খেয়াল হইয়াছে তাই লেখাপড়ায় ইতি করিয়া দিয়া বাপের কাছে চলিয়া আসিয়াছে। আজিকার এই অনুষ্ঠানের সে-ই প্রধান উপলক্ষ্য।

করবী মেয়েটি বয়সে সুহাসিনীর সমান কি এক-আধ বছরের ছোটই হইবে। ছোটখাটো গোলগাল গড়ন, চাঁপাফুলের মত রঙ, মুখে চোখে বেশ একটি শ্ৰী আছে,—এই মেয়েটি সহজে ছোট বড়। সকলের হৃদয় জয় করিয়া লইতে পারিত। বাপ-মা আত্মীয়স্বজনের অতিরিক্ত আদর ও বিলাতী স্কুলের শিক্ষার গুণে সে একটু ফাজিল ও স্বেচ্ছাপরায়ণ হইয়া পড়িয়াছিল বটে, কিন্তু সত্যকার মন্দ তাহার স্বভাবে কিছু ছিল না বলিয়া সকলেই তাহা ছেলেমানুষী মনে করিয়া উড়াইয়া দিতেন।

করবী সুহাসিনীর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিতেছিল, হাসিদি, তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে বড্ড ইচ্ছে করছে, ভাই।

সুহাসিনী বলিল, ছেলেমানুষী করিসনি, করবী! এত লোকের সামনে তোর কি একটু লজ্জাও নেই! তার চেয়ে স্কুলের গল্প বল শুনি।

করবী বলিল, সে হবে খন। কদ্দিন পরে দেখা বল তো, একটা চুমুও খাব না। আচ্ছা, এত লোকের সামনে যদি তোমার লজ্জা করে, ঐ পাশের ঘরটায় চলো। ও ঘরে কেউ নেই।

হাসিয়া ফেলিয়া সুহাসিনী বলিল, কি পাগল তুই বল দেখি! না না, চুমু খেতে হবে না। আমি এখন ঐ জন্যে উঠে যেতে পারব না। তারপর তাহার ডালিম-ফুলের রঙের টকটকে লাল সিল্কের শাড়িখানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, কি চমৎকার রঙ তোর শাড়িখানার! কবে কিনলি?

চুম্বনের কথা ভুলিয়া করবী আহ্লাদিত হইয়া বলিল, বেশ রঙ-না? কিনিনি, বাবা প্রেজেন্ট করেছেন। দাম বেশী নয় ভাই—পঁচাত্তর। তুমি যদি কেননা, বলে দিতে পারি কোন দোকানে পাওয়া যায়। আমি নিজে গিয়ে রঙ পছন্দ করে নিয়েছি কিনা।

সুহাসিনী বলিল, আমি এ রঙের কাপড় নিয়ে কি করব?

কেন পরবে।

সুহাসিনী হাসিল, দূর! আমাকে রক্ষেকালীর মত দেখাবে যে!

মাথা নাড়িয়া করবী বলিল, কখনো না, কখখনো না, চমক্কার দেখাবে। তুমি কি কালো? না, আমি গোরাচাঁদ বলিয়া সুহাস মুখে একটু হাসিল বটে, কিন্তু মনে তাহার সে হাসির ছায়া পড়িল না। এই আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত নিজের কালো রঙের জন্য কোনদিন তাহার মনে দুঃখ হয় নাই। কিন্তু ইদানীং কি জানি কেন, প্রায়ই নিজেকে কুরূপা মনে করিয়া সে ভারি বিষণ্ণ হইয়া পড়ে।

দরজার কাছে একটা শব্দ শুনিয়া দুজনে একসঙ্গে চোখ তুলিয়া দেখিল, টিলা আস্তিনের পাঞ্জাবি গায়ে গৌরবর্ণ দীর্ঘায়তন একটি যুবা দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

চশমার উপর দিয়া তাহাকে দেখিতে পাইয়া হেমাঙ্গিনী সাদরে আহ্বান করিলেন, এসো বাবা, এসো।

সুহাসিনীর গায়ে ঠেলা দিয়া চুপি চুপি করবী বলিল, কে ভাই, হাসিদি? তুমি চেনো?

সুহাস কিন্তু উত্তর দিল না, প্রশ্নটা বোধ করি শুনিতেই পাইল না। তাহার চোখের সম্মুখ হইতে একটা কালো পর্দা সরিয়া যাইতেছিল। আজিকার এই অনুষ্ঠানে যে কিশোর নিমন্ত্রিত হইতে পারে, ইহা তাহার অতিদূর কল্পনাতেও আসে নাই। অনুপমের সহিত কিশোরের যেরূপ আলাপ, তাহাকে আলাপ না বলিয়া বিরোধ বলিলেই ভাল হয়। হেমাঙ্গিনীর সঙ্গেও মাত্র একদিনের দেখাশুনা, ইহারই মধ্যে এমন কিছু অন্তরঙ্গতা জন্মিতে পারে না—যাহাতে এই পারিবারিক ক্রিয়ায় কিশোরকে নিমন্ত্রণ না করিলেই নহে। অথচ তাহাকে ঐ দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতে দেখিয়া কিছুই আর সুহাসিনীর কাছে গোপন রহিল না। বিদ্যুৎ-বিকাশের মত এই ব্যাপারের সমগ্ৰ নিগুঢ়তা তাহার অন্তরপটে প্রকট হইয়া পড়িল। সেদিন কিশোরের প্রতি হেমাঙ্গিনীর অযাচিত সহৃদয়তার আতিশয্য দেখিয়া সুহাসিনী কিছু বিস্মিত হইয়াছিল, আজ আর তাহার হেতু বুঝিতে তিলমাত্র বিলম্ব হইল না।

মর্মভেদ করিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস তাহার কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল, কিন্তু সে তাহা বাহির হইতে দিল না। করবীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি বলছিলে?

এবার করবীর নিকট হইতে কোন উত্তর আসিল না। সুহাস দেখিল, সে সম্মুখদিকে একটু ঝুঁকিয়া বিভক্ত ওষ্ঠাধরে উৎসুক দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে চাহিয়া আছে।

এই সময় হেমাঙ্গিনী করবীর দিকে ফিরিয়া ডাকিলেন, করবী, এ দিকে আয়। কিশোরের সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দিই।

কিশোরও সঙ্গে সঙ্গে এ দিকে ফিরিয়াছিল, সুহাসিনীকে দেখিয়া স্মিতমুখে হাত তুলিয়া নমস্কার করিল।

করবী সহাস্যমুখে চঞ্চলপদে উঠিয়া গেল; সুহাসিনী কিন্তু কিশোরের নমস্কার ফিরাইয়া দিতেও পারিল না, অব্যক্ত ব্যথার ভার বুকে লইয়া নতমুখে পাথরের মত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল।

হেমাঙ্গিনী বোধ হয় কিশোরের জন্যই অপেক্ষা করিতেছিলেন, এবার তাঁহার ইঙ্গিত পাইয়া তকমা-আঁটা দুজন বেয়ারা চায়ের পাত ও রূপার ট্রেতে করিয়া কেক্, প্যাটি ইত্যাদি নানাবিধ খাবার লইয়া অতিথিদের দিতে লাগিল।

কিশোর ও করবী তখন ঘরের এক কোণে গল্প আরম্ভ করিয়াছিল, বেয়ারা উপস্থিত হইলে করবী একটা পেয়ালা তুলিয়া লইয়া কিশোরের দিকে আগাইয়া দিয়া বলিল, এই নিন, কিশোরবাবু।

কিশোর লজ্জিতভাবে বলিল, ওটা আপনি নিন, আমি চা খাইনে।

চা খান না! চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া করবী তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল।

কিশোর হাসিয়া বলিল, ঘোর অসভ্যতার লক্ষণ সন্দেহ নেই, কিন্তু চা খেলেই আমার মাথা ধরে।

করবী আরও কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া থাকিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসি থামিলে বলিল, চা খান না, আপনি তো ভারি আশ্চর্য মানুষ। আমি দিনে অন্তত দশ পেয়ালা খাই। আচ্ছা, একটা কেক খান, নইলে পিসীমা দুঃখ করবেন।

তা বরং খাচ্ছি বলিয়া কিশোর সন্তর্পণে ট্রে হইতে একটা মিষ্টান্ন তুলিয়া লইল।

করবী নিজের পেয়ালার কানায় একবার ওষ্ঠ স্পর্শ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি আগে কোথায় থাকতেন?

মৃদু হাস্যে কিশোর বলিল, চা খাই না বলে নিশ্চয়ই আপনার সন্দেহ হচ্ছে আমি সম্প্রতি কোন জঙ্গল-টঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছি, কেমন? সত্যি কিনা বলুন?

করবী খুব হাসিতে হাসিতে বলিল, না সে জন্যে নয়, আপনাকে আগে কখনও দেখিনি কিনা, তাই জিজ্ঞাসা করছি।

কিশোর বলিল, দেখেননি, তার কারণ, ইতিপূর্বে আমি আপনাদের সমাজে মেশবার সুযোগ পাইনি, নইলে গত পাঁচ-সাত বছর থেকে আমি বরাবর কলকাতাতেই থাকি। মাত্র মাসখানেক হল। বিনয়বাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে, সেই সুত্রেই আপনাদের মত উন্নতিশীল লোকের সঙ্গে মেলামেশা; নচেৎ বস্তুত আমি একজন অতি সেকেলে পদানশীন নেটিব।

করবী যেন হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, কিন্তু কিন্তু আপনাকে দেখে—আপনার কথাবার্তায়—

কিশোর হাসিয়া উঠিয়া বলিল, আড়ষ্ট জড়সড় ভাব নেই—এই বলতে চান তো? ওটা আমার স্বভাব, কোন অবস্থাতেই আমি আড়ষ্ট বা জড়সড় হয়ে থাকতে পারি না।

ঘরের এক কোণে সুহাসের তখন চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছে, শরীর এত খারাপ বোধ হইতেছে। যে, ইচ্ছা হইতেছে কোথাও নিরিবিলি পাইলে বালিশে মুখ গুঁজিয়া শুইয়া পড়ে। এদিকে অনুপম কখন ঘেঁষিয়া ঘেঁষিয়া তাহার পাশে আসিয়া বসিয়াছে এবং কতকগুলা অর্থহীন কথা অবিশ্রাম তাহার কানের কাছে বকিয়া যাইতেছে; তাহাতে শারীরিক ক্লান্তি যেন আরও দুর্বহ হইয়া উঠিতেছে। ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিল, সাড়ে সাতটা; ভদ্রতা বাঁচাইয়া বিদায় লইতে হইলে অন্তত আরও একঘন্টা বসিয়া থাকিতে হয়। সে অধীরভাবে বিনয়বাবুর জন্য একবার চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল; দেখিল, তিনি একটা কোণে বসিয়া দীনবন্ধুবাবুর সহিত অত্যন্ত মনোযোগ দিয়া কি কথা কহিতেছেন।

অসুস্থতার অজুহাত দেখাইয়া সকাল-সকাল বাড়ি ফেরা সম্ভব হইবে কিনা ভাবিতেছে, এমন সময় অতি নিকটে কিশোরের কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে চমকিয়া উঠিল। ফিরিয়া দেখিল, কিশোর ও করবী তাহার পশ্চাতে আসিয়া পাশাপাশি দাঁড়াইয়াছে।

কিশোর বলিল, আমার এবং এঁর পক্ষ থেকে একটি সম্মিলিত আর্জি আপনার কাছে পেশ করতে চাই।

সুহাসিনী হাঁ-না কোন উত্তর না দিয়া ফিরিয়া বসিল, তাহার মনের মধ্যে এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিল। এতক্ষণ যে-শ্রান্তি তাহার দেহ-মনকে অবসন্ন করিয়া রাখিয়াছিল তাহাই যেন রূপান্তরিত হইয়া কিশোরের প্রতি দারুণ বিরক্তির আকার ধরিয়া দেখা দিল। কিশোরের এই সকৌতুক আবেদনের কোন উত্তর দিতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না।

কিশোর পুনশ্চ সহাস্যে আরম্ভ করিল, আমাদের বিনীত আর্জি হচ্ছে এই–

অনুপমবাবু, আমাকে এক গ্লাস জল এনে দিতে পারেন?

এই যে, এখনই দিচ্ছি বলিয়া অনুপম ব্যস্ত সমস্তভাবে আদেশ পালন করিতে ছুটিল।

 কিশোর আবার বলিতে যাইতেছিল, সুহাসিনী বলিল, করবী আয়, আমার কাছে এসে বোস! কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

আর আমার আবেদন বুঝি কানেই তুলছেন না? বলিয়া কিশোর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

বিরক্তিপূর্ণ অবজ্ঞায় সুহাসিনী চোখ তুলিয়া বলিল, কী বলতে চান, সোজা করে বলুন।

কিশোরের মুখের হাসি মিলাইয়া গেল, সে অপ্রস্তুতভাবে বলিল, একখানা গান গাইতে বলছিলুম।

তাহার অদ্ভুত স্পর্ধায় সুহাসিনী যেন অবাক হইয়া গেল, ভু তুলিয়া শুধু একবার বলিল, গান? তারপর গভীর বিরক্তিতে মুখ ফিরাইয়া লইয়া পাশে উপবিষ্টা করবীর সহিত কথা কহিবার উদ্যোগ করিল।

কিশোর সুহাসিনীর কথার ধরন কিছুই বুঝিতে না পারিয়া বলিল, হ্যাঁ, আমরা এতক্ষণ বলাবলি করছিলুম যে, আপনি যদি একখানা গান করেন–

তড়িদ্বেগে তাহার দিকে ফিরিয়া তীক্ষ অনুচ্চকণ্ঠে সুহাসিনী বলিল, আপনি কি মনে করেন, আমি পেশাদার গাইয়ে?

কিশোর ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত হইয়া গেল; সুহাসিনীর কণ্ঠের যে সুরটা সে এতক্ষণ ধরিতে পারিতেছিল না, তাহা তীক্ষ্ণ হইয়া তাহার কানে গিয়া বাজিতেই অপমানে তাহার মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিল। সে স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সুহাসিনীর দিকে চাহিয়া থাকিয়া সংযত স্বরে বলিল, আমায় মাপ করবেন। এ কথায় যে আপনি উত্ত্যক্ত হবেন তা আমি বুঝতে পারিনি। বলিয়া আস্তে আস্তে গিয়া একটা জানালার সম্মুখে দাঁড়াইল।

সুহাসিনীর মনে হইল, সে বুঝি এবার ভাঙিয়া পড়িবে। দুই হাতে কপাল টিপিয়া ধরিয়া সে হেঁটমুখে ভাবিতে লাগিল—আজ তাহার কি হইয়াছে? কেন সে এমন সৃষ্টিছাড়া ব্যবহার করিয়া বসিল?

এই নাও জল।

অনুপমের কথায় মুখ তুলিয়া সুহাসিনী বলিল, জল? জল কি হবে?

হতবুদ্ধি অনুপম বলিল, তুমি যে চাইলে?

ও–হ্যাঁ, আচ্ছা দিন বলিয়া গ্লাস লইয়া এক নিশ্বাসে সব জলটুকু পান করিয়া গ্লাস ফিরাইয়া দিল।

অনুপম প্রস্থান করিলে সহসা করবীর তীব্রকণ্ঠে সুহাসিনী চমকিয়া উঠিল। করবী সুন্দর মুখখানা রাঙা করিয়া বলিল, কিশোরবাবুকে অমন স্নাব করলে কেন বলো তো?

ক্ষীণকণ্ঠে সুহসিনী বলিল, কী করেছি?

ক্রুদ্ধকণ্ঠে করবী বলিল, অপমান করেছ। গান গাইতে বলে তোমার কী অসম্মানটা উনি করেছিলেন শুনি? আমার কথাতেই উনি তোমায় অনুরোধ করতে এসেছিলেন, নইলে আসতেন, না।

সুহাসিনীর ভয় হইল, সে এবার বিষম একটা কিছু করিয়া ফেলিবে। তাই ব্যগ্রভাবে করবীর হাত চাপিয়া ধরিয়া ভগ্নকণ্ঠে বলিল, করবী, বাবাকে একবার বল তো, আমি এখনই বাড়ি যেতে চাই।

সুহাসিনীর শুষ্ক শ্রীহীন মুখ দেখিয়া মুহূর্তে করবীর ক্রোধ গলিয়া জল হইয়া গেল, সে বিগলিত অনুশোচনার কণ্ঠে বলিল, আমি বুঝতে পারিনি, সুহাসদি, মাপ করো আমাকে। তোমার শরীর। খারাপ হয়েছে! যে গরম এই ঘরটা—যেন অগ্নিকুণ্ড। চলো পাশের ঘরে, এখনই ঠিক হয়ে যাবে। বলিয়া তাহার কোমর জড়াইয়া ধরিয়া একরকম টানিতে টানিতে পাশের ঘরে লইয়া গেল।

সেখানে ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া জোর করিয়া গায়ের জামা আগা করিয়া দিতে দিতে বলিল, হবে না? কি করে এটাকে বেঁধেছ বলো দেখি, একেবারে কেটে বসে গেছে যে! তারপর। তাহার মুখে-চোখে জল দিয়া হেলান-দেওয়া একখানা চেয়ারে বসাইয়া মাথার উপর পাখা খুলিয়া দিল।

মিনিট কুড়ি পরে সুহাস যখন করবীর হাত ধরিয়া বাহিরে আসিল, তখন সে অনেকটা সুস্থ হইয়াছে। সকলেই উল্কণ্ঠিত হইয়া প্রশ্ন করিতে লাগিলেন—কি হইয়াছিল? বিনয়বাবু বিহুলভাবে আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, সুহাস, কেমন আছিস মা?  

লজ্জিতমুখে সুহাসিনী বলিল, কিছুই তো হয়নি, বাবা। সামান্য একটু—

বিনয়বাবুর পশ্চাতে কিশোর ও দীনবন্ধুবাবু আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, করবী কিশোরের দিকে চাহিয়া বলিল, অনেকক্ষণ থেকে সুহাসদির শরীরটা খারাপ মনে হচ্ছিল, তাই কথা কইতে ভাল লাগছিল না।

তাহার কথার ইঙ্গিত বুঝিয়া কিশোর তৎক্ষণাৎ সুহাসিনীর পাশে গিয়া বলিল, এখন আর শরীর তেমন মনে হচ্ছে না? বেশ ভাল বোধ হচ্ছে?

সুহাসের মুখ সিঁদূরের মত আরক্ত হইয়া উঠিল। সে কোনমতে ঘাড় নাড়িয়া কিশোরের কথার উত্তর দিল, চোখ তুলিয়া তাহার দিকে তাকাইতে পারিল না।

দীনবন্ধু বলিলেন, তোমরা সবাই মিলে ঘিরে দাঁড়িয়ে ওকে আরও অসুস্থ করে তুলবে দেখছি। সুহাস-মায়ী, তুমি আমার কাছে এসো, ঐ জানলাটার সামনে দাঁড়াবে চলো, বেশ হাওয়া পাওয়া যাবে।

কিছুক্ষণ বাদে সাড়ে আটটা বাজিয়া যাইতেই অতিথিরা একে একে উঠিতে আরম্ভ করিলেন। কিশোর উঠিবার উপক্রম করিতেই বিনয়বাবু তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, কিশোরবাবু, একলা পালাবেন না যেন, আমরা এক পাড়ার লোক, একসঙ্গেই যাব। কিশোর সম্মতি জানাইয়া বসিয়া পড়িল। করবী কিশোরের পাশে আসিয়া বলিল, আবার কবে আসছেন বলুন! কিশোর ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া করবী বলিল, না, সে হবে না, আসতে হবে। আমাদের বাড়িতেও যাওয়া চাই। কবে যাবেন বলুন। শিগগির না গেলে আমি কিন্তু আপনাদের বাড়ি গিয়ে উৎপাত আরম্ভ করব।

কিশোর উৎসাহ দেখাইয়া বলিল, বেশ তো, বেশ তো। আমি ভারি খুশি হব আপনি এলে। বৌদিদিও খুশি হবেন।

করবী বলিল, আচ্ছা বেশ, কিন্তু আগে আপনার যাওয়া চাই।

কিশোর হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, তাই হবে।

ওদিকে হেমাঙ্গিনী সহানুভূতিপূর্ণ স্বরে সুহাসিনীকে বলিতেছিলেন, হঠাৎ শরীর খারাপ হল, ভেতরে ভেতরে কোনও রোগ না জন্মে থাকে। তোমার বাবাকে বলি, এই বেলা ডাক্তার দেখানো হোক বাপু। এলাকাড়ি দিয়ে শেষে কী থেকে কী হয়ে পড়বে।

মাথা নাড়িয়া সুহাস বলিল, এমন কিছুই তো হয়নি মাসীমা, আপনি কেন এত ব্যস্ত হচ্ছেন? ঘরটা গরম হয়ে উঠেছিল তাই নিজেকেও সে এই কথাটাই তখন হইতে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছিল।

অনুপম বুকে হাত বাঁধিয়া গম্ভীর-চিন্তিত মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিল, ও কোন কাজের কথা নয়। আমার বিশ্বাস ও পাড়াটা তোমার সুট করছে না, একটু চেঞ্জ দরকার। আমি বলি, এই সময় যদি কিছুদিনের জন্যে শিমুলতলা বা দেওঘরে—

সুহাসিনী হাসিয়া ফেলিল।

আর কেহ কিছু সন্দেহ না করিলেও হেমাঙ্গিনীর ন্যায় চতুরা নারী সুহাসিনীর আকস্মিক অসুস্থতার একটা হেতু বোধ হয় অনুমান করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি সেকথা আভাসে ইঙ্গিতেও প্রকাশ পাইতে দিলেন না। শুধু বলিলেন, ভাল হলেই ভাল মা। কিন্তু শরীরের ওপর একটু নজর রেখো। আজ তোমার মা নেই, তাই আমায় বলতে হচ্ছে, তিনি থাকলে আমায় একটা কথাও বলতে হত না। আমার মত দশটা মেয়েমানুষের বলা কওয়ার ভার তিনি একলাই নিতে পারতেন।

স্বর্গীয়া বান্ধবীর প্রতি এই শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করিয়া তিনি একটি গভীর নিশ্বাস মোচন করিলেন।

.

বিনয়বাবুর জন্য ট্যাক্সি ডাকা হইয়াছিল।

দীনবন্ধুর সঙ্গে গল্প করিতে করিতে তিনি নীচে নামিয়া গিয়াছিলেন। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াইয়া সুহাস ও করবী কথা কহিতেছিল, কিশোর হেমাঙ্গিনীর নিকট হইতে বিদায় লইয়া সেখানে আসিয়া দাঁড়াইল। ঘরে তখনও কয়েকজন অতিথি বসিয়া ছিলেন।

সুহাস বলিল, আচ্ছা, চললুম, ভাই। শিগগির একদিন যাস, নইলে ভারি রাগ করব বলিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিতে লাগিল।

কিশোরের দিকে ফিরিয়া করবী বলিল, আপনাকেও আমার ঐ কথা, শিগগির যাবেন, নইলে ভারি রাগ করব।

আচ্ছা-নমস্কার।

গুড নাইট বলিয়া করবী হাত বাড়াইয়া দিল। হাসিতে হাসিতে শেক-হ্যাণ্ড করিয়া কিশোরও বলিল, গুড নাইট।

দুধারে দেয়াল দেওয়া সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি। কিশোর সিঁড়ির মোড় পর্যন্ত নামিয়া গিয়া দেখিল, বাঁকের নীচেই দেয়ালে ভর দিয়া সুহাস চোখ বুজিয়া দাঁড়াইয়া আছে। একলাফে তাহার কাছে গিয়া কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে?

সুহাসের চোখের পাতা দুবার কাঁপিয়া খুলিয়া গেল, ঠোঁট দুটিও কাঁপিতে লাগিল, সে অতি অস্পষ্ট স্বরে বলিল, বুক বড় ধড়ফড় করছে আর পা কাঁপছে।

আমার হাত ধরুন বলিয়া কিশোর নিজেই তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে নামতে পারবেন?

নামিবে কি, কিশোরের হাত তাহার অঙ্গ স্পর্শ করিবামাত্র সে থরথর করিয়া কাঁপিয়া সিঁড়ির উপরেই বসিয়া পড়িল। আজ জীবনে এই প্রথম কিশোরের স্পর্শ অনুভব করিয়া তাহার বুকের মধ্যে যেন কত দিনের নিরুদ্ধ কান্নার বেগ গুমরিয়া উঠিল; এবং তাহার কুমারী-হৃদয়ের একান্ত অপরিচিত একটা দুর্দম বাসনা শরীরকে শিথিল অবশ করিয়া দিল। কিশোরের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিয়া তাহার বুক ভিজাইয়া দিবার বাসনা যে কতদূর নিন্দনীয়, তাহা অনুভব করিয়া সে যেন অর্ধেক চৈতন্য হারাইয়া ফেলিল।

তাহাকে কাঁপিয়া বসিয়া পড়িতে দেখিয়া কিশোর আর দ্বিধা করিল না, দুই বাহু দিয়া স্বচ্ছন্দে শিশুর মত তাহাকে তুলিয়া লইল। মুহূর্তকাল এইভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া সে সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়া নামিতে লাগিল। সুহাসের গলার আওয়াজ একেবারে বুজিয়া গিয়াছিল, তাই ওজর-আপত্তির একটা কথাও সে উচ্চারণ করিতে পারিল না; সুখে আতঙ্কে হর্ষে শঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া বেপমান বক্ষে কিশোরের বুকের উপর চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিল।

সিঁড়ির নীচে পৌঁছিয়া সুহাস চুপিচুপি বলিল, এবার নামিয়ে দিন।

সন্তর্পণে তাহাকে নামাইয়া দিয়া কিশোর বলিল, এখন অনেকটা ভাল বোধ হচ্ছে, কেমন? বারান্দা পেরিয়ে গাড়িতে উঠতে পারবেন কি?

পারব।

আচ্ছা, তবে আমার হাত ধরে আসুন।

কিশোরের হাত ধরিয়া স্বপ্নাবিষ্টার মত সুহাসিনী গাড়িতে গিয়া উঠিল। বিনয়বাবু গাড়িতে বসিয়া অপর দিকে দণ্ডায়মান দীনবন্ধুবাবুর সহিত তখনও বাক্যালাপ চালাইতেছিলেন; সুহাসিনী আসিয়া তাঁহার পাশে বসিতে তিনি বলিলেন, আচ্ছা দীনবন্ধু, তাহলে–

দীনবন্ধু বলিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, কাল-পরশুর মধ্যে আমি যাব, তখন আবার কথা হবে। দীনবন্ধুর গৃহ অন্যদিকে, তিনি আচ্ছা—চললুম বলিয়া প্রস্থান করিলেন।

বিনয়বাবু বলিলেন, কিশোরবাবু, সামনে বসতে হবে না, এইখানেই আসুন। তিনজনের যথেষ্ট জায়গা হবে।

সুহাসিনী সঙ্কুচিত হইয়া পিতার দিকে একটু সরিয়া বসিল, কিশোর তাহার পাশের খালি জায়গাটায় গিয়া উপবেশন করিল।

পথে যাইতে বেশী কথা হইল না, কিশোর একবার শুধু বলিল, এঁর স্বাস্থ্য বোধ হয় ডাক্তার দিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করানো দরকার। রোগ কিছু আছে আমি মনে করি না—তবু–

বিনয়বাবু বলিলেন, দীনবন্ধুর সঙ্গে এই কথাই হচ্ছিল। আমি তো আজ বড় ভয় পেয়ে গেছি। কখনও এমন হয় না—আজ হঠাৎ–না, কালই ডাক্তার ডাকব।

সিঁড়ির ঘটনাটা কিশোর ইচ্ছা করিয়াই উল্লেখ করিল না; বৃদ্ধ তাহাতে আরও ব্যাকুল হইয়া পড়িবেন কিন্তু লাভ কিছু হইবে না।

গাড়ি প্রায় বাড়ির কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে এমন সময় কিশোর অনুভব করিল, গাড়ির ভিতরকার অন্ধকারে নরম একখানি হাত নিঃশব্দে আসিয়া তাহার হাতের মধ্যে প্রবেশ করিল; কিন্তু তাহা মুহূর্তের জন্য। এই নীরব কৃতজ্ঞতা ও অনুতাপের নিদর্শন স্বীকার করিয়া হাতে একটু সস্নেহ চাপ দিতেই হাতখানি ত্রস্ত হইয়া ফিরিয়া গেল।

রাত্রে বিছানায় শুইয়া বুকের উপর দুই হাত রাখিয়া সুহাসিনী আজিকার এই নূতন উপলব্ধি সমস্ত ইন্দ্রিয় জাগ্রত করিয়া আস্বাদ করিতে করিতে ভাবিতে লাগিল। বিস্ময়েরও যেমন তাহার অবধি ছিল না, মনের এই জাজ্বল্যমান অবস্থা সে যে এত দিন দেখিতে পায় নাই, সে জন্য ক্ষোভেরও তেমনই। শেষ ছিল না। সুখ, বিস্ময়, কৌতুক, লজ্জা কত রসই তাহার বুকের উপর দিয়া ঢেউয়ের মত বহিয়া গেল তাহার অন্ত নাই। নিজের অন্ধকার শীতল শয্যায় একা শুইয়া সে নির্লজ্জভাবে মনের রাশ ছাড়িয়া দিল।

তারপর অনেক রাত্রে নিবিড়ভাবে বালিশটা জড়াইয়া লইয়া যখন সে ঘুমাইবার চেষ্টা করিল, তখন একজনের সুদৃঢ় বাহুবন্ধন ও করস্পর্শের স্মৃতি তাহার নিদ্রাকে আরও নিগুঢ় রসাপ্লুত করিয়া তুলিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *