০৬. দিন আট-দশ পরের কথা

দিন আট-দশ পরের কথা। হঠাৎ গুমট গরম শেষ হইয়া বর্ষা নামিয়াছে। কদিন ধরিয়া মেঘগুলা আকাশের চারিপাশে ঘুরিয়া জটলা পাকাইয়া ষড়যন্ত্র করিতেছিল, আজ দ্বিপ্রহরে সকলে একজোট হইয়া প্রবলবেগে বর্ষণ শুরু করিয়া দিল। সেইসঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস দিয়া শহরের তাপক্লিষ্ট অর্ধসিদ্ধ মানুষগুলার অঙ্গে যেন অমৃত সিঞ্চন করিয়া দিতে লাগিল।

কিশোর ভিজিতে ভিজিতে কলেজ হইতে বাড়ি ফিরিল। বিমলা জানিত, সে ছাতা লইয়া যায় নাই, তাই আগে হইতেই জামাকাপড়, তোয়ালে ইত্যাদি ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল। সে বলিল, খুব ভিজেছ তো? নাও, এখন তাড়াতাড়ি ওগুলো ছেড়ে ভোয়ালে দিয়ে গা মোছছ। ছাতা নিয়ে। বেরুলে বুঝি কোট-প্যান্টুলুনের অপমান হয়?

ভিজা জুতা-মোজা খুলিতে খুলিতে অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সহিত কিশোর বলিল, আজ খুব ভিজেছি। কিন্তু আশা মেটেনি, খালি গায়ে বিষ্টিতে ভিজতে না পারলে আরাম হয় না। বলিয়া

কোট ও কামিজ খুলিয়া মাটিতে ফেলিল।

বিমলা বলিল, আচ্ছা, আর একদিন ভিজো। এখন আগে শুকনো তোয়ালে নিয়ে গা-মাথা মুছে। ফেলো তো। আমি এইখানেই তোমার খাবার নিয়ে আসছি।

খালি গায়ে প্যান্টুলুন পরিয়া কিশোর হঠাৎ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, বৌদি, চলো, দুজনে তেতলার ছাদে উঠে খানিক ভিজি গে।

বিমলা বলিল, অ্যা। আবার ভিজবে। এই না সারাটা পথ ভিজে এসেছ? না না, আর ভিজলে অসুখ করবে।

কিশোর আবদার করিয়া বলিল, লক্ষ্মীটি বৌদি, একবার চলল। বেশী নয়—পাঁচ মিনিট। প্রথম বর্ষা নেমেছে, আজ ভিজলে কি অসুখ করে? অন্তত আমার করবে না। ভিজতে ভারি ইচ্ছে করছে বৌদি, চলো!

বিমলার চক্ষু দিয়া সস্নেহ কৌতুক ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, সে বলিল, কী ছেলেমানুষী বলো তো! তুমি কি স্কুলের ছেলে যে, ক্লাস পালিয়ে জলে ভিজতে যাবে?

গলায় প্যান্টুলুন দিয়ে বলছি বৌদি, চলো।

কিন্তু আমার যদি ভিজে চুলে থেকে অসুখ করে—

না করবে না বলিয়া মহানন্দে হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বিমলাকে উপরের খোলা ছাদে সে ইয়া চলিল।

খালি গা, খালি পা, কেবল প্যান্টুলুন-পরা কিশোর বিমলাকে টানিয়া মুক্ত ছাদের বৃষ্টিধারার মধ্যে ৰ্পণ করিয়াই সোল্লাসে উচ্চকণ্ঠে আরম্ভ করিল—

ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
ঘন গৌরবে নবযৌবনা—

হঠাৎ কিশোর থামিয়া গেল।

থামলে যে— বলিয়া কিশোরের ত্রস্ত দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া বিমলা দেখিল, গলির অপর পারের হর একটি বাড়ির ছাদের উপর দাঁড়াইয়া শ্যামশ্রীমতী বর্ষার মতই আর-একটি নবযৌবনা তরুণী চুল খুলিয়া দিয়া উর্ধ্বমুখী হইয়া যেন এই নববারিধারা সর্বাঙ্গ দিয়া গ্রহণ করিতেছে।

কিশোরের কাব্যোম্ফস কানে যাইতেই সুহাসিনী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। ক্ষণেকের জন্য কিশোর হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু পরক্ষণেই একবার নিজের অর্ধনগ্ন মূর্তির দিকে সত্রাস দৃষ্টিপাত করিয়া বিমলাকে ছাড়িয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি দিয়া পলায়ন করিল।

বিমলা নিজের ঘরে গিয়া ভিজা থান ও শেমিজ বদলাইয়া আসিয়া দেখিল, কিশোর শুষ্ক জমা কাপড় পরিয়া আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া চুল আঁচড়াইতেছে।

সে মুখ টিপিয়া হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী? পালিয়ে এলে যে?

কিশোর বলিল, দেখ বৌদি, আজ রাত্তিরে কিন্তু খিচুড়ি রাঁধতে হবে। মুসুর ডালের খিচুড়ি আর হাঁসের ডিম, আর কিছু নয়।

বিমলা বলিল, আচ্ছা খিচুড়ি না হয় হবে, কিন্তু অমন উঠিকী পড়ি করে পালিয়ে এলে কেন, সেটা তো আগে বলো।

পালিয়ে আবার কখন এলম? তোমার যেমন কথা। আমি তো আস্তে আস্তে নেমে এলুম।

তাই বুঝি? ওর নাম আস্তে আস্তে নেমে আসা? আমি ভাই সেটা বুঝতে পারিনি, মনে করেছিলুম, বুঝি পালিয়ে এলে।

কিশোর লজ্জিত মুখে বলিল, আচ্ছা, তুমিই বলো বৌদি, লজ্জা হয় না? কী বেশে আমি ছিলুম। বলো তো? শুধু একটা প্যান্টুলুন। ঐ বেশে ভদ্রমহিলার কাছে ধরা পড়লে সঙ্কোচ হয় না?

কিন্তু আমিও তো একজন ভদ্রমহিলা, আমাকে দেখে তো একটুও লজ্জা হল না। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলে!

হ্যাঁ, তুমি আবার ভদ্রমহিলা হতে গেলে কোন দুঃখে? তুমি তো বৌদি।

বৌদির বুঝি ভদ্রমহিলা হতে নেই?

না। বৌদি স্রেফ বৌদি।

কিশোর নিজ মনে কিছুক্ষণ যেন গবেষণা করিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, কী আশ্চর্য, বৌদি! তুমি হাজ বললে বলে খেয়াল হল কিন্তু তোমার কাছে যে সঙ্কোচ করে সম্ভ্রম করে চলা দরকার, এ কখনও আমার মনেই হয়নি। এক দিনের জন্যও ভাবিনি যে, তুমি আমার পর, তোমার কাছ থেকে সন্তর্পণে নিজেকে ঢেকে রাখা উচিত। আচ্ছা, কেন এমন হল? আমি তো ভেবেচিন্তে কিছুই করিনি।

বিমলা কথা কহিতে পারিল না, তাহার দুই চক্ষু সহসা জলে ভরিয়া উঠিল।

কিশোর কতক নিজমনেই বলিতে লাগিল, আর তাই বা আশ্চর্য কেন? আপনার লোকের কাছে। আবার লজ্জা সঙ্কোচ কে করে থাকে! যারা পর, যাদের সঙ্গে শুধু মুখের আলাপ, তাদের জন্যেই না ঐ সব! তোমাকে তো প্রথম দিন থেকেই পর বলে মনে করতে পারিনি। কী জানি কী করে মনে বসে গিয়েছিল যে, তুমি আমার নিতান্ত আপনার। আমার নিজের বড় দিদি বা ছোট বোন নেই, মাকেও ভাল করে মনে পড়ে না, কিন্তু তাঁরা যদি থাকতেন, তা হলেও বোধ হয়, তাঁদের তোমার চেয়ে বেশী আপনার বলে মনে করতে পারতুম না। এই বলিয়াই একটা গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

বিমলার গণ্ড বহিয়া ঝরঝর করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। সে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, ঠাকুরপো, লোক-দেখানো কথা নয়, সত্যিই আমি তোমার দিদি—আমি তোমার ছোট বোন। তুমি আমার আপনার মার পেটের ভাই। উঃ তোমাকে না পেলে আমি যে কী করতুম! বলিয়া নিজেকে আর সংবরণ করিতে না পারিয়া বিমলা অঞ্চলে চক্ষু আবৃত করিয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

বিমলার অন্তরের নিগুঢ় আবেগকে এমন করিয়া নাড়া দিয়া জাগাইয়া তুলিবার ইচ্ছা কিশোরের ছিল না এবং কেন যে তাহার মত স্বভাবত চাপা লোক এতগুলা মনের অন্তরতম কথা ঝোঁকের মাথায় বলিয়া ফেলিল, তাহাও সে বুঝিতে পারিল না। কিন্তু আজ এই আকস্মিক বর্ষার্গমে তাহার মনের মধ্যে কী এক বিপর্যয় ঘটিয়াছিল, তাই বিমলার স্নেহোগত চোখের জল তাহাকে দুঃখ না দিয়া যেন কানায় কানায় ভরিয়া দিয়া গেল। সে জানালা খুলিয়া দিয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া পরিপূর্ণ হৃদয়ে ভাবিতে লাগিল, কী অদ্ভুত বস্তু এই নারীর হৃদয়। ইহার ভালবাসার পরিধির মধ্যে আত্মপর বিচারের এতটুকু স্থান নাই। ভগিনীরূপে-মাতৃরূপে-পত্নীরূপে যখনই সে ভালবাসিয়াছে, তখনই সম্ভব-অসম্ভবের গণ্ডী ছাড়াইয়া, শত বাধাবিঘ্ন মাড়াইয়া স্বচ্ছন্দে অবহেলে চলিয়া গিয়াছে, দেহ দিয়াছে, প্রাণ দিয়াছে, ইহকাল-পরকাল দিয়াছে, তবু ভালবাসার এক বিন্দু লাঘব করে নাই। শৈশব হইতেই নারীর স্নেহ-ভালবাসা পাইবার সুযোগ কিশোরের হয় নাই, কিন্তু এতকাল এ অভাব সে ভাল করিয়া অনুভব করিতে পারিত না। আজ তাহার পূর্ণ-যৌবনের ভরা আকাঙক্ষার দিনে কোথা হইতে এই একান্ত নিঃসম্পর্কীয়া রমণী আসিয়া ভাই বলিয়া তাহার পাশে দাঁড়াইল এবং ভগিনীর অপরাজেয় দাবি জানাইয়া দুটি অর্ধস্ফুট অবরুদ্ধ কথায় নিজের বুভুক্ষিত অন্তর উদঘাটিত করিয়া দেখাইয়া দিল! নিজের দিক হইতে কিশোর যে বিমলাকে পরমাত্মীয়ের দৃষ্টিতে দেখিয়াছে, তাহাকেও ছাপাইয়া ভাসাইয়া তাহার প্রতি বিমলার এই বিপুল স্নেহের পরিচয় কিশোরের হৃদয়কে একেবারে প্লাবিত করিয়া দিল। পুলকিত রসাপ্লুত অন্তরে সে ভাবিতে লাগিল বৌদিদি তাহাকে এত ভালবাসেন। —ঠিক নিজের ভাইয়ের মত! সে-ও তো তাঁহাকে আপনার ভগিনীর মতই দেখে কিন্তু ওঁর তুল্য ভালবাসা তাহার দ্বারা সম্ভব নহে। সমস্ত মন প্রাণ ঢালিয়া এমন করিয়া ভালবাসা, পুরুষ তো দূরের কথা কয়জন স্ত্রীলোকই বা পারে? কি রূপে, কি গুণে, তাহার এই বৌদিদি একেবারে অদ্বিতীয়, কোথাও তাঁহার দোসর নাই। একটা নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল, কী স্ত্রী-ই তীর্থদা হারাইয়াছে!

কিশোরবাবু, আজ আর কোথাও বেরুবেন নাকি? তার চেয়ে আসুন না, এইখানে বসেই গল্পসল্প করা যাক।

কিশোরের চিন্তার জাল ছিন্ন হইয়া গেল, সে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, বিনয়কৃষ্ণবাবু নিজের বাড়ির জানালায় দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছেন।

এই কয়দিনের মধ্যে তাঁহাদের সহিত কিশোরের বেশ ঘনিষ্ঠতা হইয়া গিয়াছিল। বালকের মত সরল বৃদ্ধটিকে সে মনে মনে বড় শ্রদ্ধা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এতখানি পাণ্ডিত্যের সহিত এতটা ছেলেমানুষী যেমন তাহার কৌতুকপ্রদ বোধ হইত, তেমনই তাঁহার নিরহঙ্কার সহজ শিষ্টতা এবং ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের সহিত সমান ব্যবহার তাহার প্রীতিও আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল।

সে হাসিয়া বলিল, যেতে পারি, কিন্তু আজকের দিনে গরম গরম মুড়ি চালভাজা খাওয়ানো চাই।

বিনয়বাবু মুখখানা নিরাশ করিয়া বলিলেন, এত বড় আশ্বাস কি আমি আপনাকে দিতে পারব? আর দিলেও যদি কথা না রাখতে পারি। সংসারের ঐ বিভাগটি আমার এলাকায় নয়। একটু হাসিয়া বলিলেন, আর বাকি সব বিভাগই যেন আমার এলাকায়। তা যাক, সুহাসকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। শেষে রোখের মাথায় কথা দিয়ে ফেলে অপদস্থ হব।

সুহাসিনী বোধ হয় ঘরের মধ্যেই ছিল, তাহার কণ্ঠস্বর শুনা গেল, উনি আসুন তো। তারপর দেখা যাবে।

বিনয়বাবু বলিলেন, শুনতে পেলেন তো? এরকম ভাসা-ভাসা অনিশ্চিতের উপর নির্ভর করে যদি আসতে রাজী থাকেন তো বলুন।

আচ্ছা, ওতেই হবে বলিয়া কিশোর নামিয়া গেল। কিশোরের জুতার শব্দ শুনিয়া বিমলা রান্নাঘর হইতে ডাকিয়া বলিল, ঠাকুরপো, খাবার খেয়ে বেরোও।

বিনয়বাবুর কাছ থেকে এইমাত্র নিমন্ত্রণ পেলুম। এখন আর কিছু খাব না, বৌদি! বলিয়া কল বাহির হইল।

বিনয়বাবুর ড্রয়িংরুমে বসিয়া তাঁহার সহিত একথা-সেকথা আলাপ করিতে করিতে মিনিট পনেরো কাটিবার পর, থালার উপর একরাশ চিড়াভাজা, মাড়োয়ারীর দোকানের ডালমুট ও পাঁপরভাজা লইয়া সুহাসিনী প্রবেশ করিল। টেবিলের উপর রাখিয়া বলিল, আপনার ফরমাশ-মত হল না, কিন্তু ঘরে আর কিছু ছিল না।

কিশোর খাদ্যদ্রব্যগুলির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, একেই বলে, পিপাসিত হয়ে চাহিলাম বারি, এনে দিল মকরন্দ! কোথায় চেয়েছিলুম মুড়ি চালভাজা, এল কিনা পাঁপরভাজা ডালমুট!–কিন্তু একটা পাত্রেই কি সকলের চলবে।

সুহাসিনী বলিল, বাবা তো খাবেন না, ওঁর সহ্য হয় না।

কিশোর চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, তবে কি আমি একাই এতগুলো খাব? আমার শরীরের আয়তন আর একটু বড় হলে কি আপনি আমাকে রাক্ষস মনে করলেন? আমি কি ফাঁপা?

না না, আপনি আরম্ভ করুন না। খেতে না পারেন পড়ে থাকবে।

বেশ, কিন্তু নষ্ট হলে দোষ দেবেন না।

আপনি বোধ হয় চা খান, কিন্তু ঐ জিনিসটা দিতে পারলুম না। আমরা কেউ চা খাইনে।

মাথা নাড়িয়া কিশোর বলিল, আমিও না। ওটা কোন কালেই বরদাস্ত হয় না।

খাওয়া এবং গল্প চলিতে লাগিল।

বিনয়বাবু বাহিরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, জল থেমেছে দেখছি। পুরো চার ঘণ্টা একদমে বৃষ্টি হল।

কিশোর চকিতের ন্যায় একবার সুহাসিনীর দিকে চোখ তুলিয়া আবার চিড়াভাজায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বলিল, হ্যাঁ, এ বৃষ্টিটার দরকার হয়ে পড়েছিল, গরম যেন আর সহ্য হচ্ছিল না।

বিনয়বাবু বলিলেন, দেখো, আমাদের দেশে এই বর্ষার আগমন একটা অদ্ভুত জিনিস, অন্য কোথাও এমনটি পাবে না। সেই প্রাচীনকাল থেকে কত কবিই না এর কথা লিখে গেছেন, কিন্তু আজও তার শেষ হয়নি। অসহ্য গরমে মানুষ পুড়ে যাচ্ছিল, গাছপালা শুকিয়ে উঠেছিল, নদী কেবল বালুসার হয়ে পড়েছিল, এমন সময় কোথা থেকে মেঘ এসে আকাশ অন্ধকার করে দিল, প্রবল জলধারায় পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এই দ্রুত পট পরিবর্তনে মানুষের মনে এমন একটি খুশির ভাব জেগে উঠে যে, তার আত্মার উল্লাস শত শত কাব্যে গানে প্রকাশ হয়ে পড়ে। আরও কত বাবে যে এই সহসা-মুক্ত মানব-মন আত্মপ্রকাশ করে তার ইয়ত্তা নেই।

ঠিক কথা বলিয়া কিশোর এবার আর সুহাসিনীর দিকে তাকাইল না। তাহার নিজের সহসা-মুক্ত মানব-মন সম্প্রতি যে কিভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল তাহা যদি সুহাসিনী ছাদের উপর হইতে দেখিয়া ফেলিয়া থাকে তবে আপাতত তাহার সহিত চোখাচোখি হওয়া বাঞ্ছনীয় নহে।

বিনয়বাবু বলিতে লাগিলেন, সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে আমার ভাল পরিচয় নেই, কিন্তু যেটুকু আছে তা থেকে বুঝতে পারি যে, তার ঋতুবর্ণনার মধ্যে বর্ষা ঋতুই চৌদ্দ আনা স্থান জুড়ে আছে। সেকালের কবিরা যেন সব ঋতুকে ছেড়ে বর্ষাকেই বেশী করে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আর শুধু সেকালে কবিই বা বলি কেন? একালের রবীন্দ্রনাথের কথাই ধরো—তাঁর গানে কি বর্ষার সুর বেশী করে বাজেনি?

কিশোর বলিল, রবীন্দ্রনাথকে একেলে কবি বলবেন না, আমাদের দেশের তরুণরা তাহলে ভয়ঙ্কর চটে যাবে।

বিস্মিত হইয়া বিনয়বাবু বলিলেন, চটে যাবেন কেন?

ওর মধ্যে কেন নেই। চটে যাওয়াই তাঁদের স্বভাব।

বিনয়বাবু বুঝিতে পারিলেন না। তখন কিশোর তরুণদের মনোভাব তাঁহাকে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া বলিল। বৃদ্ধের মনে সত্যকার কাব্যরসবোধ ছিল, তিনি ব্যথিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, না না, ও হতেই পারে না, কিশোরবাবু। আমাদের দেশের নূতন সাহিত্যিকরা রবীন্দ্রনাথের কাব্য উপভোগ করতে পারেন না এ কথা আমি ভাবতেই পারি না। রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্কিমবাবুকে বাদ দিলে আমাদের ভাষায় কি থাকে বলুন দেখি?

কিছু না—বলিয়া কিশোর সহসা নিজের সম্মুখস্থ থালার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, কিন্তু এ দিকেও যে কিছু নেই দেখছি! এ কী রকম হল? সত্যিই কি সব খেয়ে ফেললুম নাকি?

মৃদু হাসিয়া সুহাসিনী বলিল, হ্যাঁ, অন্যমনস্ক হয়ে খেয়ে ফেলেছেন। কিশোর দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, ভেবেছিলুম কম খেয়ে আপনাদের কাছে প্রশংসা অর্জন করব! কিন্তু আমার ভাগ্যই খারাপ, নিজের প্রকৃত স্বরূপ আমি চেপে রাখতে পারি না, অসাবধানে প্রকাশ হয়ে পড়ে।

চাকর আসিয়া শূন্য থালা-গেলাস লইয়া যাইবার পর কিশোর রুমালে মুখ-হাত মুছিতে মুছিতে বলিল, এবার তাহলে মধুরেণ সমাপয়েৎ করুন—একটা গান হোক। সেদিন অধপথে আপনার গানে বাধা দিয়ে অবধি মনের গ্লানি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছি নে।

সুহাসিনী বলিল, তাই গান শুনে বুঝি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান?

কিশোর উত্তর করিল, এমনও তো হতে পারে গঙ্গাস্নান করে পাপ ধুয়ে ফেলতে চাই।

বিনয়বাবু বলিলেন, বেশ তো, বেশ তো, একটা গাও না, সুহাস।

সুহাস অগানের কাছে গিয়া বসিল। কিছুক্ষণ লঘুস্পর্শে পদাগুলির উপর আঙ্গুল চালাইতে চালাইতে হঠাৎ পূর্ণকণ্ঠে গাহিয়া উঠিল—

আমার নিশীথরাতের বাদলধারা
এসো হে–গোপনে—

কিশোরের মন আজ পূর্ব হইতেই নানা কারণে ছায়ানিবিড় ও রসঘন হইয়া ছিল, সুহাসিনীর কণ্ঠস্বর তাহার মধ্যে যেন তড়িবিকাশের মত চমকিয়া চমকিয়া উঠিতে লাগিল। সে মুখ নীচু করিয়া একাগ্র তন্ময় হইয়া শুনিতে লাগিল—

একলা ঘরে চুপে চুপে
এসো কেবল সুরের রূপে–
দিয়ো গো, দিয়ো গো,
আমার চোখের জলের দিয়ে সাড়া ॥

গান থামিলে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কিশোর যেন কোন স্বপ্নলোক হইতে ফিরিয়া আসিল। তন্দ্রাবিষ্ট কণ্ঠে বলিল, কি সুন্দর আপনার গলা! আমি ড়ুবে গিয়েছিলুম।

ইহা যে মামুলি চাটুবাক্য নহে, মুগ্ধ হৃদয়ের স্বতরুৎসারিত স্তুতি, তাহা বুঝিতে পারিয়া সুহাসিনীর মুখখানি রাঙা হইয়া উঠিল। কোনমতে লজ্জা দমন করিয়া সে বলিল, এবার আপনি একটা গান। করুন।

চমক ভাঙ্গিয়া কিশোর বলিল, আমি গান করব? আমি তো গাইতে জানি না।

ছদ্ম গাম্ভীর্যের সহিত সুহাসিনী বলিল, জানেন বৈকি। তখন যে ছাদের উপরে গাইছিলেন।

এবার কিশোরের লাল হইবার পালা, সেকার্য সে ভাল করিয়াই করিল। কর্ণমূল পর্যন্ত রক্তবর্ণ হইয়া কোন রকমে বলিল, অ্যাঁ–ও—আপনি শুনেছিলেন বুঝি? তা সে তো গান নয়। কী মনে হল তাই একটা কবিতা আওড়াচ্ছিলুম—আজ এই হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে—আপনিও তো ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজছিলেন–বাদলার ছোঁয়াচ তো আপনারও–

তাহাকে এই বিপন্ন অবস্থা হইতে মুক্তি দিবার জন্যই যেন এই সময় সাহেববেশী অনুপমচন্দ্র ঘরে প্রবেশ করিল।

ওয়াটারপ্রুফ ও টুপি বাহিরে টাঙ্গাইয়া ঘরে ঢুকিতেই সম্মুখে কিশোরকে দেখিয়া অনুপম মুখখানা অন্ধকার করিয়া বিনয়বাবুর পাশে গিয়া বসিল। চেষ্টা করিয়া মুখে একটু শুষ্ক হাসি আনিয়া বলিল, একটা কাজে এদিকে এসেছিলুম, তাই ভাবলুম দেখা করে যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *