• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

অনুভব

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » অনুভব

অনুভব

সামনের বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তেই হৃদয়ের সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি কাজ করল। কাগজটা মুখ থেকে সরিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে নীচের মাঝারি চওড়া রাস্তার দিকে চেয়ে সে দেখল তার ছেলে মনীশ, নাতি অঞ্জন আর পুত্রবধূ শিমুল আসছে। দৃশ্যটি এই শরতের মেঘভাঙা উজ্জ্বল সোনালি রোদে ভারী চমৎকার দেখাচ্ছে। মনীশের পরনে গাঢ় বাদামি রঙের চৌখুপিওলা ঝকঝকে পাতলুম, গায়ে হালকা গোলাপি জলছাপওলা হাওয়াই শার্ট। লম্বাটে গড়নের, ফরসা ও মোটামুটি স্বাস্থ্যবান মনীশকে বেশ তাজা ও খুশি দেখাচ্ছে। রাতে নিশ্চয়ই খুব ভালো ঘুমিয়েছে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়নি এবং হাতে কিছু বাড়তি টাকা আছে। নাতির পরনে নীল চৌখুপি এবং ডোনাল্ড ডাকওলা বাবা সুট, শিমুলের শ্যামলা ছিপছিপে শরীরে আঁট হয়ে পেঁচিয়ে উঠেছে একটা বিশুদ্ধ দক্ষিণী রেশমের কাঁচা হলুদ রঙের চওড়া কালোপেড়ে শাড়ি।

দৃশ্যটা চমক্কার। মনীশের হাতে সন্দেশের বাক্স। শিমুলের কাঁধ থেকে ব্যাগ ঝুলছে। আজ রবিবার, ওরা সারাদিন থাকবে, সন্ধের পর বন্ডেল রোডের ফ্ল্যাটে ফিরে যাবে। মনীশ বাবাকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে চেনা দিল। হৃদয়ও হাত তোলে। তারপর নিস্পৃহ হয়ে আবার ইজিচেয়ারে পিছনে হেলে বসে খবরের কাগজের দিকে তাকায়।

কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে না হৃদয়। সে বসে তার সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি বা ইনস্টিংকট-এর কথা ভাবতে থাকে। এই যে খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে হঠাৎ মনের মধ্যে একটা ইশারা জেগে উঠল আর হৃদয় দোতলার বারান্দা থেকে রাস্তায় তাকিয়ে দেখল সপরিবারে তার ছেলে আসছে, এ ব্যাপারটা তাকে বেশ খুশি করে। এমন নয় যে ছেলেকে দেখে তার আনন্দ হয়েছে। বরং এই এ রবিবারের আগন্তুক মনীশকে সে খুব একটা পছন্দ করে না। ওর বউ শিমুলকে আরও নয়। মনীশের বয়স এখন বছর-পঁচিশেক হবে, হৃদয়ের ধারণা শিমুলের বয়স মনীশের চেয়ে অন্তত বছর দুই-তিন বেশি। নাতি অঞ্জনকে এমনিতে খারাপ লাগে না হৃদয়ের, তবে তার বাপ-মা তাকে নিয়ে এত ব্যস্ত এবং সতর্ক যে হৃদয় তার সম্পর্কে খুব আগ্রহ বোধ করে না আজকাল। একটু ক্যাডবেরি কি সন্দেশ হাতে দিলেও অঞ্জনের বাপ-মা সমস্বরে ‘ওয়ার্মস ওয়ার্মর্স’ বলে আঁতকে ওঠে। আরে বাবা, কৃমি কোন বাচ্চার নেই? তা বলে কি বাচ্চারা মিষ্টি খাচ্ছে না? অন্য কেউ স্নান করালে নাকি ছেলের ঠান্ডা লাগে বলে শিমুলের ধারণা। এ বাড়িতে এসেই ছেলের জন্য শিমুল ফি রবিবার হাফ বয়েল্ড ডিম আর সবজির স্টু বানানোর বায়না। ধরবে। অত যত্নের ছেলেকে ছুঁতে একটু ভয় করে হৃদয়ের। আর ভয় করলে ভালোবাসা বা। স্নেহটা কিছুতেই আসতে চায় না।

কিন্তু হৃদয় তার ছেলে এবং ছেলের পরিবারকে দেখে খুশি হোক বা না হোক, এই প্রায় পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি বয়সে নিজের সূক্ষ্ম বোধশক্তি দেখে কিছু তৃপ্তি পেয়েছে। বলতে কী, এই ইনস্টিংকট যে তার আছে এ বিষয়ে বরাবর সে নিঃসন্দেহ ছিল। সেবার জামসেদপুর যাওয়ার সময় তার কামরায় টিটি একটা বিনা টিকিটের ছোকরাকে ধরেছিল। ছোকরা বারবার তার এ পকেট ও পকেট খুঁজে রাজ্যের কাগজপত্র, নোটবই রুমাল খুঁজে-খুঁজে হয়রান। বলছে—টিকিটটা ছিল তো! পকেটেই রেখেছিলুম! কেউ বিশ্বাস করছিল না অবশ্য। টিটি তাকে বাগনানে নামিয়ে জি আর পি-তে দিয়ে দেবে বলে শাসাচ্ছে। ছোকরা তখন হৃদয়ের দিকে চেয়ে সাদা মুখে বলেছিল—দাদা, ঝাড়গ্রাম স্টেশনের কাছেই আমার দোকান, আমার ভাড়াটা দিয়ে দিন, আমি ঝাড়গ্রামে নেমে ছুটে গিয়ে টাকা এনে দিয়ে দেবে আপনাকে। হৃদয়ের ইনস্টিংকট তখনই বলেছিল যে, এ-ছোকরা মিথ্যে বলছে না। চোখে মুখে সরল সত্যবাদিতার ছাপ ছিল তার। টিকিটও হয়তো কেটেছিল। কিন্তু ইনস্টিংকটকে উপেক্ষা করেছিল হৃদয়। ভেবেছিল, যদি আহাম্মকের মতো ঠকে যাই? পরে অবশ্য ছোকরা সে-কামরাতেই খুঁজে পেতে তার ঝাড়গ্রামের চেনা লোক বের করে ভাড়া মিটিয়ে দেয় এবং হৃদয়ের কাছে এসে এক গাল সরল হাসি হেসে বলে—দাদা, পেয়ে গেছি। শুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল হৃদয়ের। সে তো জানত, মুখ দেখেই তার সূক্ষ্ম অনুভূতিবলে টের পেয়েছিল, ছোকরা মিছে কথা বলছিল না। তার সেটুকু উপকার সেদিন করতে পারলে আজ এই সুন্দর সকালের সোনালি রোদটুকুকে আর একটু বেশি উজ্জ্বল লাগত না কি তার কাছে।

ওরা দোতলায় উঠে এসেছে টের পাচ্ছিল হৃদয়। তার বউ কাজল দরজা খুলে নানারকম অভ্যর্থনা ও আনন্দের শব্দ করছে। করবেই। ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই মনীশই যা একটু-আধটু আসে। আর সবাই দূরে। মেজো ছেলে অনীশ আমেরিকায়, ছোট ক্ষৌণীশ তার মেজদার পাঠানো টাকায় দেরাদুনে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে পড়ছে। একমাত্র মেয়ে অর্পিতা বোম্বাইয়ে স্বামীর ঘর করে। এ- বাসায় কাজল আর হৃদয়, হৃদয় আর কাজল। শুনতে বেশ। কিন্তু আসলে যৌবনের সেই প্রথমকাল থেকেই কোনওদিন কাজলের সঙ্গে বনল না হৃদয়ের। ফুলশয্যার রাতেই কাজল প্রথম আলাপের সময় বলেছিল—আমি কিন্তু গানের ক্ষতি করতে পারব না তাতে সংসার ভেসে যায় যাক। তখনই হৃদয়ের ইনস্টিংকট বলেছিল—একথাটা এই রাতে না বললেও পারত কাজল। বিয়েটা হয়তো সুখের হবে না।

হয়ওনি। কাজল গান ছাড়েনি। এখনও রেডিওতে মাঝে-মাঝে গায়, দু-একটা গানের স্কুলে মাস্টারি করে। প্রাইভেটে শেখানো তো আছেই। কিন্তু ফুলশয্যার রাতে তার কথা শুনে যেমন মনে হয়েছিল এ মেয়ে বোধহয় লতা মঙ্গেশর হবে তেমনটা কিছুই হয়নি। বরং অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশে জীবনে কিছু জটও পাকিয়েছে কাজল। তাকে বিভিন্ন ফাংশানে চান্স দিতে পারে বলে কিছু প্রভাবশালী লোকের খপ্পরে পড়ে নিজেকে নষ্ট করেছে। হৃদয় কানাঘুষো শুনেছে, কাজল নিজের পবিত্রতা বজায় রাখে না। এখানেও সেই ইনস্টিংকট। ছোট ছেলে ক্ষৌণীশকে কোনওদিনই নিজের ছেলে বলে ভাবতে পারে না হৃদয়।

মনীশ বারান্দায় এসে পাশের টুলের ওপর হৃদয়ের অভ্যস্ত ব্রান্ডের এক প্যাকেট সিগারেট আর এক বাক্স ভোটা দেশলাই রেখে বলে—কেমন আছ বাবা?

হৃদয় আজকাল কথা বলতে ভালোবাসে। কিন্তু কথায় ভেসে যেতে ভারী ভয় হয় তার। সূক্ষ্ম অনুভূতি তাকে সাবধান করে দেয়, কথা বোলোনা, বেশি কথা বললেই ওরা বিরক্ত হবে। ভাববে তুমি বুড়ো হয়েছ। তোমার ব্যক্তিত্ব নেই।

হৃদয় সতর্ক হয়। এত বেশি সতর্ক হয় যে মুখই খোলে না। ঘাড় নেড়ে জানায় ভালো।

অনীশ আমেরিকা থেকে তার ডাক্তার দাদার জন্য খুবই আধুনিক ধরনের একটা ব্লাড প্রেশারের যন্ত্র পাঠিয়েছে। সেটা প্রতিবারই সঙ্গে আনে মনীশ। আজও এনেছে। টুলের ওপর রেখে হাত বাড়িয়ে বলল—হাতটা দাও, প্রেশারটা দেখি।

হৃদয় মাথা নাড়ে, না। খামোখা দেখো। হৃদয়ের প্রেশারের কোনও গণ্ডগোল নেই। তেমন। কিছু বয়সও তো হয়নি তার। মোটে সাতচল্লিশ। একুশ বছর বয়সে সে বিয়ে করেছিল মায়ের বায়নায়। বাইশ বছর বয়সে মনীশ হয়। এখনও হৃদয়ের চেহারা ছিপছিপে, পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের বেশি দেখায় না। চুল এখনও বেশ কুচকুচে কালো, চলাফেরা যুবকের মতো চটপটে। বয়সের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। তবে যে মনীশ প্রায়ই তার প্রেশার দেখে সেটা একরকম তোষামোদ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাপকে সে কোনওদিনই রোজগারের পয়সা দেয় না।

মনীশ চাপাচাপি করল না, তবে কৌতূহলভরে মুখের দিকে চেয়ে বলল—তোমার মেজাজটা আজ খারাপ নাকি?

বারান্দার ওদিকটায় নাতি-কোলে করে কাজল এসে দাঁড়াল। ওই দেখ, ওই দেখ বলে রাস্তায় আঙুল দিয়ে কী একটু দেখিয়ে ফিরে চাইল হৃদয়ের দিকে। বেশ কোমল গলায় বলল—দেখাও না প্রেশারটা। দেখাতে দোষ কী?

হৃদয় তার প্লাস পাওয়ারের চশমাটা খুলে কোলের ওপর রেখে বিতর্কের জন্য প্রস্তুত হয়ে ঠান্ডা গলায় বলে—কেন দেখাব?

এই স্বর চেনে কাজল। ভ্রূ কুঁচকে স্বামীর দিকে চায়। তার মুখের রেখা কঠিন হয়ে ওঠে। বলে–থাক থাক, দেখাতে হবে না।

মনীশ খুব চালাকের মতো বলে—বাবা, ডোন্ট মাইন্ড। জাস্ট চেক আপ করতে চেয়েছিলাম। জাস্ট চেক আপ, তা ছাড়া কিছু নয়।

কাজল ধমকে দেয়—থাক, তোকে দেখতে হবে না। যে চায় না তারটা দেখবি কেন?

হৃদয়ের ইনস্টিংকট বলল, আজকের দিনটা ভালো যাবে না। হয় দুপুরে, নয়তো রাত্রে একটা তুমুল ঝগড়া লাগবে কাজলের সঙ্গে। লাগবেই।

কাজল নাতিকে নিয়ে এবং মনীশ তার যন্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। হৃদয় বসে থেকে খবরের কাগজে চোখ বোলায়। জনতা গভর্নমেন্ট হয়তো বেশি দিন টিকবে না। ইন্দিরাও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ক্ষমতা ফিরে পাবে বলে মনে হয় না। তাহলে নাইনটিন এইট্টিতে ভারতবর্ষ শাসন করবে কে? ভূতে?

যে যুবতী মেয়েটি তাদের রান্না করে সে এসে টুলের ওপর এক কাপ চা রাখল। মেয়েটির দিকে কোনওদিনই খুব ভালো করে তাকায় না হৃদয়। তাকাতে ভরসা হয় না। মেয়েটির বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ হবে। স্বামী নেয় না বলে কসবায় বাপের বাড়িতে থেকে কাজ করে খায়। এ বাড়িতে দুবেলা রাঁধে, সারাদিন নানা কাজ করে, সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে যায়। মাইনে পঁচাত্তর টাকা। রাঁধে অবশ্য খুবই ভালো। ইংলিশ ডিনার থেকে মাদ্রাজি ইডলি দোসা সবরকম খাবার করতে পারে। কিন্তু সেটা কোনও যোগ্যতা নয়। আসল যোগ্যতা হল, ওর বয়স। চমৎকার বয়স। চেহারাখানা রোগাটে হলেও খাঁজকাটা শরীরের একটা লাবণ্য আছে। মুখখানা মোটামুটি। আগে উলোলো ঝি-র মতো আসত। এখন সাজে। পরিপাটি করে বাঁধা চুল, চুলে লাল নীল ফিতে, কপালে টিপ। হৃদয়ের সামনে আসবার আগে মুখখানা যে আঁচল দিয়ে ভালো করে মুছে আসে তা হৃদয় ইনস্টিংকট দিয়ে টের পায়।

আজও পেল। খবরের কাগজের ডানদিকের পাতায় কোণাচে একটা খুনের খবরে চোখ রেখেও হৃদয় বুঝতে পারে ললিতা তার দিকে খুব নিবিড় চোখে চেয়ে আছে। একটু চাপা গলায়, যেন গোপন কথা বলার মতো করে বলল—আপনার চা।

গভীর শ্বাস ছেড়ে হৃদয় বলে।–হুঁ

লক্ষ করেছে হৃদয়, বয়সে যথেষ্ট ঘোট হলেও ললিতা তার বউকে বউদি আর তাকে দাদা। বলেই ডাকে। আবার মনীশ আর তার বউকে বলে বড়দা আর বড়বউদি! কাজল বলে-বলেও তাকে আর হৃদয়কে মাসি-মেশোর গোছের কিছু ডাকাতে পারেনি ললিতাকে দিয়ে। এসবই একরকম ভালো লাগে হৃদয়ের। একটা গোপন অবৈধ তীব্র অনুভূতি। ললিতা তাকে মেসো বলে ডাকলে হয়তো এই অনুভূতিটা হত না তার।

কাজল গানের স্কুল বা টিউশনিতে যায়। ছুটির দিনে ফাঁকা বাড়িতে কত দিন একাই থাকে হৃদয় আর ললিতা। কোনওদিন হৃদয় সচেষ্ট হয়নি। ললিতাও না। তবে দুজনকে ঘিরে একটা তীব্র অনুভূতির বৃত্ত যে বরাবর তৈরি হয়েছে এটা ইনস্টিংকট দিয়ে কতবার টের পেয়েছে হৃদয়। কিন্তু বাইরে ভালোমানুষ এবং ভিতরে এক শয়তান হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া সে আর কীই বা করতে পারে?

হৃদয়ের আর কিছুই বলার ছিল না। ললিতা চলে গেল। কিন্তু হৃদয়ের কেমন যেন মনে হয়, ললিতা আজ তার কাছ থেকে কিছু শুনতে চায়। কিন্তু হৃদয়ের যে বলার মতো কথা নেই। জীবনে অন্তত একবার খারাপ হওয়ার বড় ইচ্ছে তার। কিন্তু কিছুতেই একটা মানসিক ব্যারিকেড ডিঙিয়ে যেতে পারে না।

এই ব্যারিকেড অনায়াসে ভেঙেছে কাজল। যতই বুঝতে পেরেছে যে, স্বাভাবিক পথে গানের জগতে সে ওপরে উঠতে পারবে না, ততই সে অলি গলি রন্ধ্রপথের সন্ধানে নিজেকে সস্তা করেছে। হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই বিষিয়ে যায়। তাই হৃদয় একসঙ্গে থেকেও কাজলকে বিশেষ নজরে রাখেনি। কিন্তু টের পেয়েছে ঠিকই। তার ইনস্টিংকট কম্পাসের কাঁটার মতো নির্দেশ করে দিয়েছে। অনেক বছর আগে সন্ধেয় হৃদয় এমনি বারান্দায় বসে ঝুঁকে রাস্তা দেখছিল। তার দুপাশে কিশোর মনীশ আর কিশোরী অর্পিতা। হঠাৎ রাস্তার ভিড়ের মধ্যে সে কাজলকে ফিরতে দেখল। দৃশ্যটা নতুন কিছু নয়। প্রায়ই সন্ধে পার করে কাজল বাসায় ফেরে। তবু সেদিন নতমুখী, অন্যমনা কাজলের হেঁটে আসার ভঙ্গির মধ্যে কী দেখে তার ইনস্টিংকট নিঃশব্দে চেঁচিয়ে উঠল—অস্পৃশ্য! অস্পৃশ্য! তখন মনীশ আর অর্পিতা ভারী খুশির গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিল—মা! কাজল ওপরের দিকে তাকায়নি। খুব অন্যমনস্ক ছিল।

সেই রাত্রেই শোওয়ার ঘরে হৃদয়ের জেরার কাছে প্রায় ধরা পড়ে কাজল। কিন্তু স্বীকার করল কিছু, উলটে কত ঝগড়া করল। কিন্তু তাতে হৃদয়ের অনুভূতি বদলে গেল না।

এতদিন বাদে এই সুন্দর শরতের ভোরে সেই সব পুরোনো কথা মনটা ভারী এলোমলো করে দিল। বাতাসে কোল থেকে উড়ে গড়িয়ে পড়ল খবরের কাগজের আলগা পাতা। গত তিন চার বছর ধরে একটানা কাজলের সঙ্গে তার সম্পর্কহীনতা চলছে।

হৃদয় উঠল। কারও সঙ্গে কথা বলল না, পায়জামার ওপর একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে, মানিব্যাগটা পকেটে পুরে বেরিয়ে এল। বেরোবার মুখে শুনতে পেল তিনটে শোওয়ার ঘরের মধ্যে যেটা সবচেয়ে ভালো সেই পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ঘরে মনীশ আর কাজল কথা বলছে। অঞ্জনকে ভিতরের ডাইনিং স্পেসে খাওয়াতে বসিয়েছে শিমুল। শিমুলকে ভালো করে চেনেও না। সে। একদিন মনীশ ওকে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল প্রণাম করাতে। সেই প্রথম দেখা। সামাজিক মতে একটু বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল পরে। তারপর থেকে ওরা আলাদা। শিমুল শ্বশুরকে দেখে নড়ল না, একটু ভদ্রতার হাসি হেসে বলল—ভালো তো?

হৃদয় কোঁচকায়। এরা কারা, কোত্থেকে এল তা যেন ঠাহর পায় না। এত অনাত্মীয় এরা যে কথার জবাব পর্যন্ত দিতে ইচ্ছে করে না তার। দিলও না হৃদয়। ভিতরের বারান্দায় এসে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ানোর সময় একবার অভ্যাসবশে রান্নাঘরের দিকে এক ঝলক তাকাল সে। ললিতা প্রেশার কুকারের স্টিম ছাড়ছে। ধোঁয়াটে বাষ্পের মধ্যে আবছা দেখায় তাকে। তবু দুখানা চোখের কৌতূহল ভরা দৃষ্টি স্পর্শ করে হৃদয়কে। কাউকে কিছু বলে আসেনি হৃদয়। কিন্তু কে জানে কেন ললিতার দিকে চেয়ে বলল—আমি একটু বেরোচ্ছি।

ললিতা তাড়াতাড়ি প্রেশার কুকার রেখে উঠে আসে। মুখে ঘেমো ভাব, চুল কিছু এলোমেলো, অকপটে চেয়ে থেকে বলল—ফিরতে কি দেরি হবে?

–হতে পারে।

ললিতা কিছু বলল না। কিন্তু সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল, যতক্ষণ হৃদয় না চোখের আড়ালে গেল।

পুরোনো আড্ডা সবই ভেঙে গেছে। বাইরের পৃথিবীটা এখন আর আগেকার মতো নেই। বড় পর হয়ে গেছে সব। এখন হৃদয়ের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল তার দোতলার ফ্ল্যাটের সামনের বারান্দাটুকু। এ গ্রেড ফার্মে সবচেয়ে উঁচু থাকের কেরানি হিসেবে তাকে অফিসে অনেকক্ষণ কাজ করতে হয়। সেটুকু সময় বাদ দিয়ে বাকি দিনটুকু সে বসে থাকে বারান্দায়। বেশ লাগে। অনেক মাইনে পায় হৃদয়! ওভারটাইম নিয়ে হাজার দুই-আড়াই কি কখনও তারও বেশি। পুজোর মাসে দেদার বোনাস পেয়েছে। সবটা তার খরচ হয় না। কাজলেরও আয় খারাপ নয়। দুজনের বনিবনা নেই বলে কাজল তার কাছে বড় একটা বায়না বা আবদার করে না। তাই হাতে বেশ টাকা থাকে হৃদয়ের, কিন্তু সেই টাকা খরচ করার পথ পায় না সে। কী করবে? মদ খেতে রুচি হয় না। জামা কাপড়ের শখ নেই। জিনিস কেনার নেশা নেই। কী করবে তবে?

বুক পকেটে মানিব্যাগটা টাকার চাপে ফুলে হৃৎপিণ্ডটা চেপে ধরেছে। ভারী লাগছে। ব্যাগে কত টাকা আছে তার হিসেব নেই হৃদয়ের। কয়েক শো হবে। হাজারখানেকের কাছাকাছিও হতে পারে।

চওড়া গলি পার হয়ে কালীঘাটের উলটোদিকের রসা রোডে এসে দাঁড়ায় হৃদয়। লক্ষ-লক্ষ লোক ছুটি আর রোদে বেরিয়ে পড়েছে। কোথায় যাচ্ছে তা ভেবে পাওয়া শক্ত। মোটামুটি সকলেরই কোনও-না-কোনও গন্তব্য রয়েছে যা হৃদয়ের নেই। চারদিকে এত অচেনা মানুষের মধ্যে আজকাল বেশ একটু অস্বস্তি বোধ করে সে। কেন যেন তার ইনস্টিংকট তাকে সবসময়ে সাবধান করে দেয়, চারদিক সম্পর্কে সজাগ থেকো। এরা বেশিরভাগই খুনে, বদমাশ, চোর পকেটমার দাঙ্গাবাজ ঝগড়ুটে। তোমাকে একটু বেচাল দেখলেই পকেট ফাঁক করবে, ঝগড়া বাধাবে, অপমান করবে, মেরে বসবে বা মেরেই ফেলবে।

ফাঁকা অলস গতির ট্যাকসি ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে কিছু না ভেবেই হাত তোলে হৃদয় এবং উঠে পড়ে। আজকাল তার বাইরে সম্পর্কে ভীতি জন্মেছে আগে যা ছিল না। সে সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করে নিজের সামনের বারান্দায়। যদি তার কোনও গন্তব্য থাকে তবে তা ওই ভাড়াটে বাড়ির বারান্দাটুকুই। বাদবাকি শহর, দেশ বা রাষ্ট্র তার কাছে এক দূরের অচেনা রাজ্য। ট্যাকসি চৌরঙ্গির দিকে যাচ্ছে, পিছু হেলে বসে হৃদয় নিস্তেজ চোখে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। তার সুখদুঃখের বোধ ডুবে গেছে একেবারে। কী সুখ কী দুঃখ বলতে পারে না। এত অনাত্মীয় হয়ে গেছে তার আত্মীয়স্বজন যে তার ভয় হয়, এদের মধ্যে কেউ মরে গেলে সে তেমন কোনও শোক করবে না। ভেবে মাঝে-মাঝে সে একটু অবাক হয়। নিজের মনকেই জিগ্যেস করে, যদি এখন মনীশ বা অনীশের কিছু হয় তবে তোমার রিঅ্যাকশন কেমন হবে? যদি কাজলের কিছু হয়, তাহলে? ইনস্টিংকট তাকে বলে, কিছু হলে তোমাকে বাপু জোর করে থিয়েটারি কান্না কাঁদতে হবে।

কামুর আউটসাইডার বইখানা পড়েছে হৃদয়, অ্যালিয়েশনের কথাও তার অজানা নয়। সে কি ওইসবেরই শিকার? হৃদয়ের ইনস্টিংকট সঙ্গে-সঙ্গে বলে ওঠে—না হে, তা নয়। আসলে তোমার সন্নিসী হওয়ারই কথা ছিল যে! তা হতে পারোনি বলে তোমার মনটা তোমাকে ফেলে জঙ্গলে চলে গেল। এখন তুমি আর তোমার মন ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁই।

মানিব্যাগটা বুকে বড্ড চাপ দিচ্ছে। দম চেপে ধরছে। অস্ফুট একটু শব্দ করে হৃদয়। ট্যাকসিওলা বাঙালি ছোকরাটি একবার ফিরে চায়। বলে–কিছু বলছেন?

হৃদয় মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, সে কিছু বলছে, বহুদিন আমাকে বড় অনাদর করেছে তোমরা। ঠিকমতো লক্ষ করোনি আমার রক্তচাপ, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুস ঠিকঠাক কাজ করেছে কি না। জানতে চাওনি কতখানি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে আমার হৃদয়।

হৃদয় মানিব্যাগটাকে পকেটসুদ্ধ খামচে ধরে বুক থেকে আলগা করে রাখে। তারপর ট্যাকসির মুখ ঘোরাতে বলে। কোথাও যাওয়ার নেই শুধু ওই নিয়তি বারান্দাটা ছাড়া।

বাড়ি ফিরে আসতে-আসতে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল হৃদয়ের। কেন এই বাড়ি ছাড়া তার আর কোনও গন্তব্য থাকবে না? কেন আর কোথাও তার যাওয়ার নেই। কেন এত কম মানুষকে চেনে সে?

মানিব্যাগটা আলগা করে ধরে রেখেও বুকের বাঁ-ধারের অস্বস্তিটা গেল না। দমচাপা একটা ভাব। রসা রোডে নিজের গলির মোড়ে ট্যাকসিটা ঠিক যেখানে ধরে ছিল সেখানেই আবার ছেড়ে দিল সে। কী অর্থহীন এই যাওয়া আর ফিরে আসা!

বেলার রোদ খাড়া হয়ে পড়েছে। জ্বলে যাচ্ছে শরীর, ঝলসে যাচ্ছে চোখ। হৃদয় ধীর পায়ে হেঁটে গলিতে ঢুকল। আস্তে দোতলায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। ওপরে খুব হইচই শোনা যাচ্ছে। এবার পুজোয় কাজলের একটা আধুনিক গানের একসটেন্ডেডপ্লে রেকর্ড বেরিয়েছে। স্টিরিওতে সেই রেকর্ডটা বাজছে এখন। বহুবার শোনা হৃদয়ের। কেউ বাড়িতে এলেই বাজানো হয়। জঘন্য গান। প্রায় অশ্লীল দেহ ইঙ্গিতে ভরা ভালোবাসার কথা আর তার সঙ্গে ঝিনচাক মিউজিক।

দোতলার বারান্দায় উঠতে খুবই কষ্ট হল হৃদয়ের। মানিব্যাগটা বের করে ঝুল পকেটে রেখেছে, তাও বাঁ-দিকের বুকে চাপটা যায়নি। এখন সেই চাপ-ভাবের সঙ্গে সামান্য পিন ফোঁটানোর ব্যথাও। সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দম নিচ্ছিল হৃদয়। বুঝতে পারছে তার মুখ সাদা, গায়ে কলকল করে ঘাম নামছে।

ললিতা ডাইনিং হলের পরদা সরিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দেখে থমকে দাঁড়ায়। দু-পা এগিয়ে এসে বলে–কী হয়েছে?

হৃদয় কখনও এ মেয়েটার চোখে চোখ রাখতে পারে না। মনে পাপ। চোখ সরিয়ে নিয়ে খুব অভিমানের গলায় বলে–কিছু না!

এ অভিমানের দাম দেয় কে? হৃদয় হাঁফ ধরা বুক হাতে চেপে ঘরের দিকে এগোয়। বুঝতে পারে, শব্দগুলো আবছা হয়ে আসছে চোখে, বুকে ফুরিয়ে আসছে বাতাস। স্ট্রোক কি?

ভাবতেই মনটা অদ্ভুত ফুরফুরে হয়ে গেল আনন্দে। দীর্ঘকাল সামনের বারান্দায় বসে সে কি এই স্ট্রোকেরই অপেক্ষা করেনি? ইনস্টিংকট বলত—আসবে হে আসবে একদিন। সে এসে সব যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে।

কার কথা বলত তার ইনস্টিংকট তা তখন বুঝতে পারত না সে। আজ মনে হল, এই অদ্ভুত অসুখের কথাই বলত।

হৃদয় ভেবেছিল, খুব নাটকীয়ভাবে সে ঘরের দরজায় লাট খেয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু পড়ল না। হাত পা কাঁপছিল থরথর করে, বুকে অসম্ভব ধড়ধড়ানি আর হুলের ব্যথা, গায়ে ফোয়ারার মতো ঘাম। তবু পড়ল না। চেতনা রয়েছে এখনও, খাড়া থাকতে পারছে। পরদাটা সরিয়ে ড্রইং কাম ডাইনিং স্পেসে ঢুকল সে।

দরজার মুখে ললিতা এসে পিছন থেকে দুটো কাঁধ ধরে বলে—শরীরটা তো আপনার ভালো নেই। বউদিকে ডাকব?

বিরক্তি গলায় হৃদয় বলে—না, কাউকে ডাকতে হবে না।

ললিতা বোকা নয়। সব জানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। তাই মৃদু স্বরে বলে—আচ্ছা চলুন আমি বারান্দায় পৌঁছে দিই আপনাকে!

খুব যত্নে ইজিচেয়ারে তাকে স্থাপন করে ললিতা। টুল থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে সেটা সামনে রেখে পা দুটো টান করে মেলে দেয় টুলের ওপর। মৃদুস্বরে বলে—চোখ বুঝে একটু বিশ্রাম করুন।

মুখে বড় ঘাম জমেছিল হৃদয়ের। ললিতা কিছু খুঁজে না পেয়ে তাড়াতাড়িতে নিজের শাড়ির আঁচলে যত্নে ঘামটুকু মুছে দিল। বলল—পাখা আনছি। চোখ বুজে ঘুমোন তো।

আলো মুছে যাচ্ছিল, ক্লান্তিতে এক অতল খাদে গড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। তবু চোখ খুলে চেয়ে থাকে হৃদয়। হাঁ করে চেয়ে থাকে ললিতার দিকে। একটুও কাম বোধ করে না সে। সব ভুলে হঠাৎ ‘মা’ বলে ডেকে উঠতে ইচ্ছে করে।

ঝিনচাক মিউজিকের সঙ্গে কটু সুরের গান বেজে যাচ্ছে স্টিরিওতে, সঙ্গে বাচ্চা-বুড়োর গলায় হাঃহাঃ হোঃ-হোঃ। কিন্তু এই সামনের বারান্দায় এই শরৎকালের উজ্জ্বল দুপুরে ভারী পুরোনো দিনের এক আলো এসে পড়ল। হৃদয়ের ইনস্টিংকট বলল, মরবে না এ যাত্রায়।

Category: গল্প (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়), শীর্ষেন্দুর সেরা ১০১
পরবর্তী:
অপেক্ষা »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑