1 of 2

পলাশ

পলাশ

ছেলেটা ভীষণ একগুঁয়ে। অঙ্কে প্রত্যেকবার যা পায় তার চেয়ে পাঁচ নম্বর কম পেয়েছিল বলে বাবা খুব বলেন, তোমার ওপর অনেক আশা ছিল। ভেবেছিলুম তোমাকে আমি বিদেশে পাঠাব। আমি নিজে একশোর মধ্যে একশো পেতুম। আমার ছেলে হয়ে অন্যের কাছে হেরে গেলে!

পলাশ মাথা নীচু করে শুনে গেল। সেদিন রাতে সাধ্যসাধনা করেও তাকে খাওয়ানো গেল না। পলাশের মা বললেন, নব্বই তো পেয়েছে। কেন তুমি ছেলেটাকে শুধু শুধু বকলে?

তোমার বোঝার ক্ষমতা নেই। এই সাংঘাতিক প্রতিযোগিতার যুগে একটা নম্বর এদিক-ওদিক হলে অন্যে মেরে চলে যায়। আমাদের ছেলে হেরে যাবে! আমার বাবা কখনও কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। স্কুলে ডবল প্রোমোশন পেতেন।

পলাশের মা চুপ করে রইলেন। ছেলে খায়নি, সে রাতে তিনিও খেলেন না। পলাশ সারা রাত ভালো করে ঘুমোতে পারল না। পাঁচটা নম্বরের জন্যে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী উন্মেষ এবার ফাস্ট হয়েছে, পলাশ সেকেন্ড। ভোরবেলা পলাশ যখন বিছানা ছেড়ে উঠল তখন সে অন্য ছেলে। ভীষণ গম্ভীর। বয়স যেন দু-বছর বেড়ে গেছে। নিজের মাথাটাকে সে কাল রাতে ভেতর থেকে দেখেছে। সবই সেখানে গোছানো আছে, শুধু সময়মতো টেনে বের করা। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা মানুষ জানতে পারে না, বুঝতে পারে না। আসলে ভয়। ভয়ই মানুষকে দুর্বল করে দেয়। মানুষের মাথা হল কম্পিউটার। এই কম্পিউটারের কাছে কোনও কিছুই কিছু নয়।

পলাশ পরের পরীক্ষায় শুধু প্রথম হল না, সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে রেকর্ড করল। সবেতেই ফার্স্ট। সবাই বললে, সবসময় বই মুখে করে বসে থাকলে ভালো রেজাল্ট কেন হবে না। ওর তো কোনও খেলাধুলো নেই, গল্পগুজব নেই। বন্ধুবান্ধব নেই।

পলাশ মনে মনে হাসল। পরের বছরই দেখা গেল, পলাশের মতো ভালো ক্রিকেট কেউ খেলতে পারে না। যেমন তার মার, তেমনি তার বল। দেখা গেল, কখন সে পড়ে তার কোনও ঠিক নেই, সারাদিন আড্ডা মারছে। গান শুনছে। আবার ছবি আঁকার নেশা ধরেছে। সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে একে-তাকে দিয়ে দিচ্ছে। পড়ার বইয়ের বাইরে গাদাগাদা বই এনে বাড়িটাকে প্রায় লাইব্রেরি করে ফেলেছে। সবাই ভাবলে, দেখা যাক, এইবার পরীক্ষায় কী হয়!

পলাশ কোনও পরীক্ষাতেই আর দ্বিতীয় হল না। স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা চলে গেল। ছবছর পরে পলাশ ফিরে এসেছে। ছবছরে সে আমেরিকা কাঁপিয়ে দিয়ে এসেছে। নতুন সব থিওরি বের করেছে। প্রমাণ করে এসেছে, মানুষের মাথার চেয়ে বড় কম্পিউটার এখনও তৈরি হয়নি। আমেরিকা তাকে ধরে রাখতে চায়। পলাশ চলে এসেছে ভারতে। এখানেই সে আরও গবেষণা করবে।

সবাই বললে, এখানে তোমার কেউ দাম দেবে না। ওখানে কত টাকা, কত ভালো জায়গা! কত সুখ!

পলাশ হাসল। বলল, এই আমার দেশ। ডাল, ভাত আর শাকপাতার অভাব হবে না। ওদেশে যেতে চাইলে এই মুহূর্তে যাওয়া যায়, তবে সায়েব হবার ইচ্ছে নেই।

পলাশের বাবা-মা বৃদ্ধা হয়েছেন। আত্মীয়রা বললেন, ছেলেটা এ কী করছে! আমরা ভেবেছিলুম একটা মোটর কিনবে, তার বদলে কিনেছে একটা সাইকেল! আগে যদিও বা প্যান্ট-শার্ট পরত, এখন ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া কিছুই পরে না। ভাবা গিয়েছিল, পুরোনো সাবেক বাড়িটা ভেঙে নতুন বিলিতি ধরনের বাড়ি করবে। কোথায় কী!

পলাশের বাবা-মা হাসেন। সব শুনে যান। সবাই জিগ্যেস করলেন, পলাশ তুমি কি সাধু হয়ে যাবে?

পলাশ বললে, না, মনে মনে আমি তো চিরকালই সাধু। আমি আমার বাবা-মায়ের সেবা করব।

সে আবার কী! সেটা একটা কাজ হল!

এ যুগের সেইটাই সবচেয়ে বড় কাজ।

সবাই বললে, ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

দুটো বড় কোম্পানি, তারা কম্পিউটার তৈরি করে, পলাশকে মোটা টাকার চাকরি নেবার জন্যে ঝোলাঝুলি করতে লাগল। পলাশের বাবা বললেন, চাকরিটা তুমি নিয়ে নাও। অত টাকা মাইনে!

চাকরি আমি করব না। চাকরি মানে দাসত্ব। আমার ঠাকুরদা চাকরি করেননি, তুমিও করোনি, আমিও করব না।

তাহলে কী করবে?

আমি আমার স্কুলে মাস্টারি করব।

তুমি জানোনা, সেই স্কুল আর আগের স্কুল নেই। সেখানে দু-বেলা শিক্ষকে শিক্ষকে হাতাহাতি হয়। ছাত্ররা ছাত্রদেরই বোমা মারে। লেখাপড়া হয়-ইনা। তুমি চাকরিটাই নাও।

তাহলে শুনুন, বড় বড় ফার্মেও এই একই অবস্থা। দলাদলি, কামড়াকামড়ি। ধর্মঘট। লকআউট। কী হবে ঢুকে! দিন দিন নিজেকে হারিয়ে ফেলা। চাকরি করতে হলে বিদেশে করাই ভালো। পলাশ বাড়িতে ছেলে পড়ানো শুরু করল। উঁচু ক্লাসের মেধাবী কিন্তু দুস্থ দু-চারটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে শুরু হয়ে গেল বিনা পয়সার স্কুল। সবাই বললে, না, ছেলেটার মাথা সত্যিই গেছে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

ছেলেবেলা থেকেই পলাশ ভীষণ একগুঁয়ে। সে কারুর কথা শোনে না। কারওর কথা শোনেনি কোনও দিন। পাড়ার সকলেই এই সিদ্ধান্তে এলেন, পলাশের মাথাটা গেছে। অনেকে তার পূর্বপুরুষদের ঠিকুজি, কোষ্ঠি ঘেঁটে এ-ও বের করে ফেললেন, পলাশের বাবার, বাবার, বাবার বাবা এইরকম এক পাগল ছিলেন। বাংলার নবাব আলিবর্দি তাঁর গুণ ও জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে জমিদারি দান করতে চেয়েছিলেন, তিনি নেননি। বলেছিলেন, বিষয়-সম্পত্তি মহাপাপ। আমি বেশ ভালোই। আছি। পলাশের মায়ের বাবার বাবা সংসার ত্যাগ করে হিমালয়ে চলে গিয়েছিলেন।

পলাশের খবর আমরা আর তেমন রাখিনি। যে যার সংসার আর চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। আমি পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে মোটামুটি একটা ভালো চাকরি পেয়ে সংসার সাজিয়ে ফেলেছি। বদলির চাকরি। কাজের গুণে প্রোমোশন পেতে পেতে পোস্টমাস্টার হয়েছি। নানা জেলায় পোস্টিং হয়। বেশ ভালোই আছি। খাতিরের চাকরি। সবাই মাস্টারমশাই, মাস্টারমশাই বলেন। জেলার বড় বড় মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়।

যখন আমি বাঁকুড়ার পোস্টমাস্টার, সেই সময় একটা নাম চোখে নড়ল, পলাশ চট্টোপাধ্যায়। প্রথমে তেমন কিছু মনে হয়নি। কত পলাশই তো আছে! কিন্তু নামটা মনে গেঁথে রইল। পলাশ আমার প্রাণের বন্ধু। কত রাত খোলা মাঠে, ঘাসের ওপর শুয়ে গল্প করেছি দুজনে। জীবনের গল্প। ছাত্রজীবনের সেই সব দিন কি ভোলা যায়!

পলাশ চট্টোপাধ্যায়। নামের তলায় আছে—অধ্যক্ষ, মানব বিকাশ কেন্দ্র। এই মানব বিকাশ কেন্দ্র কোথায়! কর্মীরা জানালেন, সে এক বিশাল ব্যাপার! কয়েক একর জমির ওপর সাত

আটটা স্কুল। একেবারে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুদের বড় করা হয়। মানুষের মতো মানুষ। বিদেশ থেকে সবাই আসেন দেখতে।

এর বেশি কিছু আমায় কর্মীরা বলতে পারলেন না।

বুদ্ধপূর্ণিমা। বিশাল গোল থালার মতো চাঁদ সবে উঠেছে। কী মনে হল, একটা গাড়ি ডেকে উঠে বসলুম। চলো মানব বিকাশ কেন্দ্র।

বাইরে থেকে দেখে অবাক হওয়ার তো কিছু খুঁজে পেলুম না। গেটটা খুব বড়। দু-পাশে বাগান। পথ চলে গেছে। এগোচ্ছি। চাঁদের আলোর জোর বেড়েছে। তার মানে রাত হচ্ছে।

অনেকটা যাওয়ার পর থমকে গেলুম। সবুজ ঘাসে-ঢাকা বড় একটা মাঠ। বাঁকুড়ার এই দিককার জমি কাঁকুরে। এখানে এমন ঘাস তৈরি করা খুব কঠিন কাজ। সেই সবুজ মাঠে সাদা পোশাক পরা নানা বয়েসের ছেলেরা বসে আছে স্থির হয়ে। মাঠ ভরে গেছে। দূরে একটা উঁচু বেদি। সেই বেদিতে কাচের ঘেরাটোপে একটি আলো জ্বলছে। এতটুকু শব্দ নেই। গাছে গাছে বাতাসে পাতা পড়ার শব্দ। মাঝে মাঝে কোকিলের ডাক। এইবার আমার চোখে পড়ছে, দূরে দূরে ছবির মতো সব বাড়ি। চাঁদের আলোয় দুধের মতো সাদা। মনে হচ্ছে স্বর্গে এসেছি।

এই পলাশ, আমাদেরই পলাশ। বুকে জড়িয়ে ধরে বললে, আমি খবর পেয়েছি, তুই আমাদের পি এম হয়ে এসেছিস। রবিবার একেবারে ভোরে চলে আয়। সবটা দেখতে পুরো একটা দিন লাগবে। এ বলার নয়, দেখার। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কী জানিস—এই গ্রামটাইনবাব আমার পূর্বপুরুষকে দিতে চেয়েছিলেন। আরও সব আশ্চর্য ব্যাপার আছে, সেদিন বলব।

ফিরে এলুম। রাতে স্বপ্ন দেখছি—একমাঠ সাদা সাদা রাজহাঁস। স্থির। দূরে বেদিতে বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেব নন, আমার বাল্যবন্ধু পলাশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *