1 of 2

কালোয়াত কাল

কালোয়াত কাল

কোথায় গেল আমাদের সেই সময়। Good old days চতুর্দিকে এত বিভিন্ন রকমের ভয়ংকর ভয়ংকর অপরাধী মার্কেটে ছাড়া পায়নি। জমিদাররা লেঠেল, পাইক, বরকন্দাজ পুষতেন। জমি দখল, চর দখল এই সব নিয়ে মারদাঙ্গা, মাথা ফাটাফাটি হত। লাশও পড়ে যেত। পুলিশ কেস। হত। উকিলে-উকিলে মুখ শোঁকাকি। মামলা উঠল, মামলা নামল। বিধবার সংখ্যা বাড়ল।

ডাকাত ডাকাতি করত সম্পন্ন মানুষের বাড়িতে। গরিবগুর্বো মধ্যবিত্তদের এলাকায় চোর, হিঁচকে চোর আর সিঁদেল চোর। ঘটি, বাটি, ল্যাম্পো, গামছা, গাড়ু, লাউ, কুমড়ো, বেগুন, বরবটি, দু কুনকে চাল, শালগ্রামের সিংহাসন, সাইকেল, দা, কুড়ুল, খোন্তা, গাঁইতি ইত্যাদি হাবিজাবি জিনিস চুরি করত।

গোলাগুলি, বন্দুক, চপার এসব ধারে কাছে যেত না। এদের একটাই কোয়ালিফিকেশন ছিল জলের পাইপ বেয়ে ওঠা, গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়া। কার্নিশ বেয়ে হাঁটা। চালের বাতা সরিয়ে ঘরের ভেতর ধুপ করে নয়, থুপ করে নেমে পড়া। এদের কাছে থাকত গুরুদত্ত ঘুমপাড়ানি মন্ত্র।

তখন সস্তাগণ্ডার বাজার। গোটাকতক শাড়ি, ধুতি, কাঠকুটো, তেল, মশলা, চুরি করলে দু একদিনের জন্যে সংসারের সুরাহা হত। ব্যাঙ্কডাকাতি, রেলডাকাতি এসব বড় বড় ব্যাপার। অবশ্যই রিস্কি। আমাদের কালে ছিচকে চোরদের ওপর মানুষের সিমপ্যাথিও ছিল। রাতে যে চোর, দিনের বেলা সে তো আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। কলেজে পড়ি, আমাদের সকলের ভীষণ প্রিয় ভোলাদার চায়ের দোকানে চা খাই। সেই সময় মাঝেমধ্যেই লিকলিকে রোগা আমাদেরই বয়সি একটি ছেলে চা খেতে আসত। সবাই জানত সে চোর। তার কোনও লজ্জা, দ্বিধা, সংকোচ ছিল না। হাসছে, কথা বলছে, মজার মজার কথা। সেইসব কথা শুনে আমরা সবাই হো হো করে হাসতুম। সে যে চোর, একথা জানাতে তার কোনও লজ্জাই ছিল না।

অনেকের অনেক কিছু বাঁধা থাকে। বাঁধা শব্দটা এইভাবে ব্যবহার হয়, বাঁধা দরজি, বাঁধা মুদিখানা, বাঁধা চায়ের দোকান, সেলুন, স্বর্ণকার ইত্যাদি। চুরি করার জন্যে বাঁধা বাড়ি, আমরা তার মুখেই শুনেছিলুম। এলাকায় একসময় বড় বড় জমিদারদের বাগানবাড়ি ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই তাঁদের বোলবোলা আশ্চর্যভাবে কমতে লাগল। সেই ছেলেটি এইরকমই একটি জমিদারবাড়িতে নিয়মিত চুরি করতে যেত। এক অথর্ববৃদ্ধ মানুষ ভেতর দিকের দোতলার একটি ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটাতেন। মোটাসোটা ধবধবে শিবের মতো চেহারা। জমিদার। মানদাশঙ্কর। ছেলে বিলেতে ব্যারিস্টার হচ্ছেন। বিলেতে গিয়ে এক বছরের মধ্যেই মেম বিয়ে করে ফেলেছেন। মেয়ে সন্ন্যাসিনী। পুনার আশ্রমে। দ্বিতীয় মীরাবাঈ। জমিদারবাবুর স্ত্রী মেয়ের কাছে চলে গেছেন। ছত্রাকার সংসার। পুরোনো আমলের অথর্ব একটি কাজের লোক। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ।

সেই বৃদ্ধের সঙ্গে এই চোরটির অদ্ভুত এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। গভীর রাতে গল্পগুজবও হত। তারপর ওঠার সময় চোর বললে, তা হলে দেয়ালঘড়িটা নিয়ে যাই?

বৃদ্ধ বললেন, টেবিলের ওপর আমার চশমা আর জলের গেলাসটা আছে। সরিয়ে রেখে টেবিলে উঠে সাবধানে পেড়ে নে। পড়ে গেলে ভেঙে যাবে। দামি ঘড়ি। কিউরিও। বেচবি কোথায়?

চোর বললে, চোর বাজার।

দাম পাবি না। অনেক নতুন নতুন শিল্পপতি বড়লোক গজাচ্ছে, তাদের কাছে নিয়ে যা। কত দাম চাইবি? বলে দিচ্ছি, দশে শুরু করবি, সাতে নামবি। সাত হাজারের কমে ছাড়বি না। এ ঘড়ি ইন্ডিয়ায় বেশি নেই।

সেকালের ক্রিমিন্যালদের মধ্যে দারুণ একটা হিউমার ছিল। দরদও ছিল। বৃদ্ধ মানুষটির এইসব কথা শুনে সেই চোর ঘড়িটা নিল না। জিগ্যেস করল, আপনি ঘুমোন না কেন?

ঘুম আসে না। পুরোনো দিনের অজস্র কথা মনে পড়ে যায়। কত কথা! বাবার কথা, মায়ের কথা। আমার দাদার কথা। বাংলাদেশে আমাদের জমিদারির কথা। সেই তালপুকুরটার কথা। সেই সাদা ঘোড়াটার কথা। সেই ময়ূরপঙ্খী নাওটার কথা। আমার বিয়ের রাতের কথা।

চোর তখন বললে, শুনুন বাবু, ভদ্দরলোকদের এই এক মুশকিল, তারা শুধু ভেবে ভেবেই ঘাটে চলে যায়। অত ভাবেন কেন? মাথার ওপর ছাদ আছে, পেটে দুটো ভাত আছে, পিঠের তলায়। বিছানা আছে। যেটা নেই, সেটা হল নাক ডাকিয়ে ঘুম। টান টান হয়ে শুয়ে পড়ুন, আমি আপনার পা টিপি। গল্পের গরু নয়, সত্য ঘটনা। পরেশ চোর হয়ে গেল পরেশ সাধু। যে এদিকেও। যেতে পারে, সে ওদিকেও যেতে পারে। পরেশ ভালোর দিকে এমন পালটাল, যে বই লেখা যায়। সেই বৃদ্ধ মানুষটি তাকে সন্তানের চেয়েও ভালোবেসে ফেললেন। পরেশ তাঁকে চাঙ্গা করে তুলল। নতুন করে বাঁচতে শেখাল। একটা কারখানা খুলে বসল। পাওয়ারলুম। দিন-রাত কাজ হয়।

অঞ্চলের বহু দুস্থ মহিলার জীবিকার সন্ধান।

আমরা এখন চলেছি ভাঙনের মধ্য দিয়ে। সুনামি, আর্থকোয়েক, টেররিজম, এক্সটর্শান, কিডন্যাপিং সব ভালো ভালো শব্দ। মানুষ কী করতে চাইছে মানুষই জানে না। অজস্র বক্তৃতা, অজস্র প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কোনও লক্ষ্য নেই, আদর্শ নেই। মন্দিরে মাধব নেই, ভোঁ ভোঁ শাঁখের শব্দ। বিগ্রহশূন্য মানব-মন্দিরে উন্মাদের পূজা।

এই ভালো, খুব ভালো। ধেই ধেই ভালো। পারমিসিভ সোসাইটি। যে-কোনও আদর্শই ব্যাকডেটেড। ছাত্রদের ভয়ে অধ্যাপক জড়সড়ো। ছেলের ভয়ে বাপ পলাতক। স্ত্রী-র ভয়ে স্বামী দার্শনিক। শিষ্যের দাপটে গুরু কেঁচো। কাজের মহিলার দাপটে গৃহ তটস্থ। শ্রমিকের দাপটে শিল্পপতি নিরুদ্দেশ। গাড়ির দাপটে পথচারী যমালয়ে। সর্বত্র মারমুখী জনতা। ভাষা হল খুন। খুন কা বদলা খুন।

সূর্য্যাস্তের পর জলখাওয়া নিষিদ্ধ। আরকের রাত। বউ পেটানো মধ্যরাতে। টেলি সিরিয়ালের জীবন। কসমেটিক সমস্যা। গান হল, ব্যান্ড।

তোমার মরণ, তোমার মরণ

আমার মরণ নয়।

মরব যখন ঘাটে যাব

কী করবি কর।

সবাই এখন কালোয়াত। কী ছেলে, কী মেয়ে! একটা হাত কানে। সেলফোন। চার্চে গেছি। একটি মেয়ে থামে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জুতো জোড়া তার পায়ের কাছে। নিতে পারছি না। শুনছি উপগ্রহ ছুঁয়ে প্রেম আসছে—প্রেমের দেবতার মন্দিরে। ফোন করেছেন যিশু নয়, কাঁচরাপাড়ার বিশু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *