1 of 2

দেশসেবার ঝকমারি

দেশসেবার ঝকমারি

দেশসেবা কি কম ঝকমারির কাজ! এ তো কোর্টকাছারি, অফিস-আদালতে গিয়ে ঘণ্টা আষ্টেকের সময় কাটিয়ে আসা নয়। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় চা, মিনিটে-মিনিটে ফোন। কথায় কথায় খোশগল্প। দেশসেবা মানে ঘণ্টা বাজিয়ে সময় উৎসর্গ করা তো নয়! জীবনটাকে ঢেলে দেওয়া। অলওয়েজ সেবায় থাকা।

সেবা ব্যাপারটা কী?

সে একটা ভীষণ ব্যাপার। মানুষের ভালো করতে হবে। জানপ্রাণ লড়িয়ে দিতে হবে। আর্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। প্রচণ্ড সংগ্রাম করতে হবে। সে এক মহা ফাটাফাটি লাঠালাঠি ব্যাপার। সকলের জন্যে সমান অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, বাসস্থান। নির্য্যাতিত-তিতার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। প্রতিবাদে চিঙ্কার, পথ অবরোধ, বনধ। মানুষকে বোঝানো—একদিন না একদিন সব হবে। যবে হবে, তবে হবে। না হলে না হবে। সংগ্রাম চলছে। সংগ্রাম চলবে। সংগ্রামই জীবন, জীবনই সংগ্রাম।

কবে নাগাদ, মানে কত সালে এই সংগ্রাম শেষ হবে?

সেটা নির্ভর করছে লড়াইয়ের শক্তির ওপর। ফাটিয়ে লড়াই করতে পারলে তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি লড়াই শেষ হয়ে যাবে।

লড়াই শেষ হলে কী হবে? সুজলাং, সুফলাং, শস্যশ্যামলাং?

সে হলে হবে, না হলে না হবে। ওটা আলাদা ব্যাপার। ওদিকে সেবার কোনও সুযোগ নেই। লড়াই শেষ হলে আবার লড়াই শুরু হবে। চিরটাকাল আমাদের লড়াইয়ের মধ্যে থাকতে হবে। বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, বড় বড় দুর্ঘটনা। একবার এদিকে ছুটছি, একবার ওদিকে। ছুটছি। মিটিং করছি। বক্তৃতার তোড়ে পাড়া তোলপাড় করে দিচ্ছি। মনে রাখতে হবে, কিছু করার চেয়ে অনেক কিছু করতে পারি—এই মস্ত ধারণাটা মানুষের মনে ধরিয়ে দিতে হবে। কিছু করলে, মানুষ পরক্ষণেই ভুলে যাবে। আরও কেন করা হল না বলে গালাগাল দেবে। দলবাজি করছে, দল বদল করবে। এসব ভীষণ ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার। অতএব, কিছু করার চেয়ে কিছু না করা অনেক ভালো। অনেক নিরাপদ। একসময় এদেশে কিছু জমিদার ছিলেন, সবাই বলত, বদান্য জমিদার! কোথাও কিছু নেই বিশাল একটা পুকুর কাটিয়ে বললেন, তালপুকুর। তালগাছ দিয়ে ঘেরা। গ্রামবাসী ধন্য ধন্য করতে লাগল। এইবার কী হল, গ্রামে কলেরা, মহামারি শুরু হল। কেন হল? ওই পুকুর। জল দূষিত হয়ে গেছে। পুকুরটা না কাটালে জলকষ্ট হত বটে। কলেরা হত না।

এর পর জমিদার কী করলেন ইস্কুল। পাঠশালার পণ্ডিতরা না খেয়ে মরল। গ্রামের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে বিলেত চলে গেল। মদ খাওয়া শিখে, মেমবউ বগলে, ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরল। এদেশের মানুষ মামলা করে করে নিঃস্ব হল। সেই বদান্য জমিদারেরও একই পরিণতি হল। সাত ভাইয়ে মামলা করতে করতে, বিষয়-সম্পত্তি ঘেঁড়াছিড়ি করতে করতে একসময় অদৃশ্য হল। পড়ে রইল চোখের জলে টলটলে সেই তালপুকুর। তালতলায় ধান্যেশ্বরী-চোলাই। কারখানা। ফিজিক্যাল অ্যান্ড কেমিক্যাল—দুটি কারবারই সেখানে ফলাও। মানুষের শান্তিধাম। সাতভাই চম্পার মধ্যে ছোটটি দেশসেবার লাইনে গিয়ে ধনেপ্রাণেই শুধু বাঁচল না, এখন বেশ।

হৃষ্টপুষ্ট দেশনায়ক। কোথাও বসতে গেলে ভোঁস করে শব্দ হয়, আর উঠতে গেলে ফোঁস। ভুঁড়িটা যেন ওয়াটার বেলুন। পৃথিবীর যত সুস্বাদু খাদ্য সুখ্যাত হুইস্কি সমুদ্রে অবগাহনে নামে। আর। ওঠে না। মুক্তির সুরাধারে কত প্রাণ হল বলিদান। কত মুরগি, খাসি, ল্যাম্ব, টার্কি ওই মহামানবের উদরতীর্থে লীন হল। সেই লিকলিকে, Lanky-danky-dunky মানুষটা আজ এক Heavy weight দেশনেতা।

এখন দেশসেবা একটা প্রচণ্ড ভালো লাইন। যত ওপর দিকে উঠবে ততই আলো-বাতাস। কোম্পানি মাসোহারা দেবে। চতুর্দিক থেকে সিধা আসতে থাকবে। মোটা মোটা প্রণামীর প্যাকেট। নেতাদের সুবিধে, হাতেনাতে সেবা আর করতে হয় না। সেবার পলিসি তৈরি হয় যে গুমটিতে, সেইখানে হাজিরা দিতে হবে নিয়মিত। সেখানে পাখি পড়ানো হয়। পাখির দানার মতো গলায় ভরে আনতে হবে শব্দের দানা। স্বরক্ষেপণও শিখতে হবে। Audio-laboratory তে মাইল মিটার আছে। কোন বক্তৃতার কী স্পিড হবে অভ্যাস করতে হবে। স্পিড একটা একালের ফ্যাক্টর। টেনিস বলের স্পিড, ক্রিকেট বলের স্পিড।

গণতন্ত্র এক বিরক্তিকর সাক্ষীগোপাল। বিজ্ঞান দেশনেতাদের এক ভয়ঙ্কর শত্রু। লুকনো ক্যামেরার অবাধ গতিবিধি। দেশসেবার জন্যে কে কোথায় সামান্য পঞ্চাশকী পনেরো হাজার টাকা প্রণামী নিয়েছে, অমনি গণতন্ত্রের প্যাভেনিয়ানে নেত্য শুরু হয়ে গেল! সবাই যেন শালগ্রাম সিংহাসনে ধোয়া তুলসীপাতা! এমন করলে দেশসেবা কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সব বুঝবে ঠ্যালা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *