1 of 2

আহারের বাহার

আহারের বাহার

মারা যাওয়ার পর জনৈক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পীর আক্ষেপের মন্তব্য: খাওয়ার বারোটা বেজে গেল। মৃত্যু শোকাবহ নানা কারণেই। বিচ্ছেদ-বেদনার ঊর্ধে শিল্পীর মনে আর একটি শিল্পের মৃত্যুর ক্ষোভ দীর্ঘকাল জাগ্রত ছিল। সে শিল্পটি হল, রন্ধনশিল্প। প্রাচীনারা জাগতিক নিয়মেই বিদায় নিচ্ছেন। সেইসঙ্গে বিদায় নিচ্ছে রন্ধন নৈপুণ্য। কথায় বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। খাদ্যবস্তু দেখে জিভে জল না এলেও উদরপূর্তির জন্যে যে-কোনও আহার্যই গলাধঃকরণ করার উদারতায় আমরা অভ্যস্ত। আধুনিকারা হামেশাই বলেন, খোকা ডুডুও খাব টামাকুও খাব, তা তো আর হয় না। কথাটা ঠিকই। পি এইচ ডি মহিলা খোলা ছাতে পৌষের রোদে পিঠ কুঁজো করে সাদা কাপড়ে গুটি গুটি বড়ি দিচ্ছেন ভাবাই যায় না। ঝালের, ঝোলের, অম্বলের, হেঁচকির। সকালের সব কাজ ফেলে চিত্রতারকা শিফনের শাড়ি পরে বঁটিতে হোড় ডিসেক্ট করছেন আর ম্যানিকিওর করা চাঁপার কলির মতো আঙুলে কলাগাছের আঠার সুতো জড়িয়ে জড়িয়ে নিচ্ছেন। অত সময় কোথায়। সেই নাটকের ডায়ালগ, তবে আজ আসিবে খেদী, আমি বড় বিজি। প্রফেশনাল ম্যান। রন্ধনের সময় নেই, আহারেরও মেজাজ নেই। সকালে তরল কিছু কোঁত করে গলায় ঢেলে তড়াক করে লাফিয়ে রাস্তায়, রাস্তা থেকে গাড়িতে, গাড়ি থেকে লিফটে, তারপর চেয়ারে—এইরকম হলেই ভালো হয়।

শিল্পকর্মের উৎসই হল অফুরন্ত অবসর। রাঁধার যেমন তরিবাদি আছে, তেমনি সময়ও লাগে। থালার চারপাশে গোল করে বাটি সাজিয়ে খেতেও সময় লাগে, সাহসও চাই। খেয়ে মরব না তো

এই চিন্তায় খাবার ইচ্ছেও মরে যায়। চিংড়ির মালাইকারি? মন্দ না। বড়ই সুস্বাদু। কিন্তু অ্যালার্জি। কান চুলকে, ঠোঁট চুলকে, পিঠ চুলকে ফুলে ডবল সাইজ হয়ে, চেত্তা মেরে পড়ে। রইলুম তিনদিন! লাল বুলডগের মতো মুখ দেখে সকলেরই প্রশ্ন, আহা ছোকরার অমন মিঠে মুখ এরকম টেগার্ট মার্কা হয়ে গেল কী করে? আজ্ঞে, গলদা খেয়ে।

গঙ্গার ইলিশ বড়ই লোভনীয়। শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া ডে-ডেট, অটোমেটিক ঘড়িটি বাঁধা রেখে ভূতঘাট থেকে না হয় একটা কিনেই ফেলা গেল। তিনি কড়ায় চেপে পোয়াটাক তেল পোড়ালেন, তার ওপর পড়ল কচি সরষে বাটা, লয়া লয়া কাঁচালঙ্কা। খুবই মুখরোচক। ভাত উড়ে গেল সপাসপ। তারপর অফিসের চেয়ার তিনদিন খালি। পি এল-এর দরখাস্ত অফিসকর্তার টেবিলে। না আসার কারণ বাবুর তেলানি হয়েছে। নিজেই ইলিশ হয়ে ঘন ঘন বাথরুমের মাঝখানে খেলে খেলে বেড়াচ্ছেন। ইলিশের ইবলিশ এতকালের শুকনো পাকস্থলীতে ঢুকে ফাউন্ডেশন নাড়িয়ে দিয়েছে। এক্সপার্ট বললেন, তোমার কী করা উচিত ছিল জানো? প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর। ইঞ্চি ছয়েক ব্লটিং পেপার প্রথমে কোঁত করে গিলে নিয়ে ইলিশের কাঁচা ঝাল খাওয়া উচিত। আসলে আর্ট এখন বেঁচে আছে প্রোফেশনালদের হাতে। অ্যামেচারের যুগ শেষ। হালুইকর হেলে-দুলে হেলান মেরে রাঁধবেন কারণ সেইটাই তাঁর জীবিকা। ছতারা হোটেলের শেফ, মাথায় সাদা টুপি এঁটে ছত্রিশ পদ লাঞ্চ বানাবেন কারণ ওই আর্ট ভাঙিয়েই তাঁর রবরবা। চিনের রেস্তোরাঁয় হাফপ্যান্ট পরা রন্ধন-বিশারদ পাখির বাসার স্যুপ বানাবেন, কি চিনি স্যুপ তুলে ধরবেন রসিক মানুষের টেবিলে অথবা তৈরি করবেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামি আহার্যপদ—বুদ্ধ জামপিং ওভার দি ফেনস।

এখন ব্যাপার হল যে মহিলা সকালেই ছেলেকে রুটি, মাখন, জেলি, আন্ডা আর অর্ধপক্ক কার্বাইড-পাকা কদলি খাইয়ে টানতে টানতে স্কুলে নিয়ে যাবেন, ফেরার পথে দুধের বোতল বগলে বাড়িতে এসেই স্বামীকে ডবল হাফ চা খাইয়ে স্টিম তৈরি করে বাজারে পাঠাবেন আর কান খাড়া করে শুনবেন নটার ভোঁ বাজল কি না; তাঁর পক্ষে লাউ-চিংড়ি কি ঝিঙে-পোস্ত কি। নারকেল কোরা ছড়ানো মোচার ঘণ্ট এক দুঃস্বপ্ন। ওসব অফুরন্ত অবসরের মালিক বৃদ্ধাদেরই পোষায়। অফিস বেরোবার তাড়ায় প্যান্টের বোতাম লাগাবার হুশ থাকে না। চারাপোনা আস্ত গিলে সারস পাখির সন্ধান করেন টাগরার কাঁটা বের করে দেবার জন্যে, তাঁদের যদি বলা হয় বসে বসে এক ডজন সজনে ডাঁটা চিবোন, কি এক খাবলা কাটোয়ার ডেঙ্গো থেকে ভেজিটেবল ম্যারো বের করে তারিয়ে তারিয়ে খান তাহলে তাঁরা সবিনয়ে বললেন, মাপ করো রাজা চাকরিটা আর চিবিয়ে খেতে চাই না। কোনও সাকার স্ত্রী-র কি সে সময় আছে সকালে সজনে ফুল বেছে। ভাজবেন, কি কচুডাঁটার ঘণ্ট তৈরি করবেন? বড়জোর লো-প্রেসারের কত্তার টিফিন বাক্সে দুপিস রুটি আর একটি ছানার তাল ভরে দিয়ে শাঁখা-সিঁদুর অক্ষয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। মাথা ঘুরে পড়ে গেলে দেড় হাজার টাকা চোট।

তাছাড়া ওসব হাবিজাবির কী প্রয়োজন? এ হল প্ল্যানিং-এর যুগ, ফ্যামিলি প্ল্যানিং, প্রোটিন প্ল্যানিং, ক্যালোরি প্ল্যানিং ঝোল আর ভাত মেরে যাও সপাসপ। ফান্ড পারমিট করে তো সিঁথির সিঁদুর ঠেকানোর মতো এক চামচে মাখন গুঁজে আধখানা কাঁচালঙ্কা অ্যাপেটাইজার কাম অ্যান্টি অ্যাজমা। আর সব তোলা থাক রবিবারের জন্য।

উইক ডেজে তাই ঘরে ঘরে নটরাজের নৃত্য। চা, বাথরুম, বাজার, দাড়ি, লোডশেডিং, ছুটোছুটি, ধাক্কাধাক্কি—স্ত্রী ছুটলেন, স্বামী ছুটলেন, ছেলে ছুটছে, বেড়াল ন্যাজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। দুটো প্রেসার কুকার থেকে থেকে কৌসর করে উঠছে, কেউ কারওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। এ বলছে, কী বললে, ও বলছে, কী বললে, শেষে মেজাজ দু-তরফেরই ফাইভ ফর্টি ভোল্ট। কিচ্ছু বলিনি, আহা শুনতে পাইনি। বয়লেট ফাটে হেঁইও, থাক আর শুনে কাজ নেই, অন্য কেউ হলে ঠিকই। শুনতে পেত। অ্যাাঁ কে বললে? ব্যস মুখে কুলুপ পড়ে গেল। সম্পর্ক আপাতত জট পাকিয়ে থাক। রাতে দেখা যাবে। মেজাজের কোনও ভোল্টেজ স্টেবিলাইজার নেই। সকালের আহার সাধারণত চড়া ভোল্টেই হয়। বয়লার থেকে ভাত নেমেছে। ভাতের ভিসুভিয়াসের ওপর ডালের লাভাস্রোত গড়াচ্ছে। কর্তা একবার থাম্ব মারছেন আর ছ্যাঁকা খেয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন! ওদিকে ঘড়ি পেছন থেকে খোঁচা মারছে। শেষে রেগেমেগে বললেন, কাল থেকে সকালে আমার জন্য পান্তা। ড্রাগন না হলে এ আগুন গিলবে কে? শুকনো চুলে চিরুনি চালালে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়ে চুল ভূত দেখার মতো খাড়া খাড়া হয়ে ওঠে। আজকাল অধিকাংশ সময়ে মানুষের মনের রোঁয়াও ওইরকম শুয়াপোকার মতো, টুথব্রাশের মতো হয়ে থাকে। গতি আরও গতি। কেরিয়ারের ঘোড়সওয়ার। সেখানে রান্না ভালো হল কি খারাপ হল, পঞ্চপদ হল কি না, এ নিয়ে কেউ কখনও অনুযোগ করেন না। যা হয়েছে বেশ হয়েছে। কম মশলা, কম ঘি, তেল, একটু সেদ্ধ সেদ্ধ এইটাই তো যুগের চাহিদা। ওল খেও না ধরবে গলার মতো নুন খেয়োনা বাড়বে প্রেসার, তেলে কোলেস্টেরাল। ফলে আধুনিকারা বেঁচে গেছেন। নইলে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর সাতশো পাতার আমিষ ও নিরামিষ আহার বইটি নিয়ে বাড়িতে হাজির হওয়া যেত। আটশো আঠারো রকম শব্দর ফিরিস্তি সম্বলিত রন্ধনের মহাভারত।

আরও এক বন্ধুকে জানি যিনি স্ত্রীকে জব্দ করার জন্যে রাত দশটার সময় ইয়া এক মাছ হাতে বাড়ি ঢুকে হাসি হাসি মুখে বললেন, তোমার সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক। তোমার জননী বলেছিলেন, মেয়ে আমার মাছ খেতে বড় ভালোবাসে বাবা, রেখো তাকে মাছে-ভাতে। তা এই রোহিতটি তোমাকেই উৎসর্গ করলাম। ইওরস ফেথফুলি। ওই প্রজ্ঞাসুন্দরীকে দিয়ে অনেক সুন্দরীকেই কাত করা যায়। যেমন—তিনশো সাতাশি পাতা খুলে বললুম, আজ রবিবার মাসের প্রথম, আজ দেহেবু খাব। জানা থাকলে ভালো, না থাকে এই প্রজ্ঞাসুন্দরী নিয়ে বসলুম। মহিলামহলের কায়দায় আমি বলে যাই তুমি করে যাও। বেশ ঘি-ওলা বাগদা চিংড়ি বারোটি, দই এক পোয়া, পেঁয়াজ তিনটে, আদা আধ তোলা, আলু দুটো, ঘি আধছটাক, ছোট এলাচ দুটো, লবঙ্গ চার-পাঁচটা, দারুচিনি সিকি তোলা, জল প্রায় তিন ছটাক, নুন প্রায় আধ তোেলা, কাঁচালঙ্কা চারটি। কেষ্টদার দোকান থেকে নিক্তিটা নিয়ে আসি। ভোলা-ফোলা আছে।

এর পর আর একদিন বলতে পারি বার্মিজ ফলুয়া খাব। ওই প্রজ্ঞাসুন্দরী কালিয়া জগুরথ খাব। প্যাটে ভা পম ভেটে-র খাব। ফিরিঙ্গি মটন স্টু। পরিশিয়ান হেঁচকি, বাঁধাকপির চিমচিম, মুরগির কানিটর কাপ্তেন, ইলিশ মাছের ট্রামফ্রাড। এর পরেও তিনি যদি পিত্রালয়ে পলাতক না হন। তাহলে বলব লাগাও সেই মাল-কাঁকড়ার কলাপঠোচ, না ওটা থাক তার চেয়ে বরং বখরি পোলাও হোক—ছোট পাঁঠা একটি, চাল এক সের, ঘি তিন পোয়া, দই আধ সের। প্রথমে খানেওলার মৃত্যু। তারপর পাকানেওলার মৃত্যু। কারণ ছোট একটা পাঁঠা চাই তারপর অন্যান্য অনুষঙ্গ, ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি! তারপর যিনি পাকাবেন তাঁকে হতে হবে গুগুনোগুরের দেশের। লোক। প্রণালীটা এইরকম কচি পাঁঠা কাটিয়া মাথা ও হাঁটুর নীচের পা চারিটি এবং লেজটা কাটিয়া আলাদা রাখো। জানি না বখরি পোলাও কেমন খেতে হবে, তবে এ-মাল রাঁধতে। পারবেন কাঁপালিকের বউ। খাঁড়া চাই, হাঁড়িকাঠ চাই। ভাগ্য ভালো বইটি বাজারে আর মিলবে

। আমার এক প্রাচীন গ্রন্থকীট বন্ধু বইটিকে কয়েকদিন আগে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে। উদ্ধার করেছেন এবং তারপর থেকে ভীষণ গম্ভীর হয়ে আছেন। মনে হয় সুখের গৃহশ্মশান করি স্ত্রী নোটিশ দিয়ে সরে পড়েছেন। একই বাড়িতে প্রজ্ঞাসুন্দরী আর আমি, অসম্ভব। সেই রন্ধনপ্রণালী এখন আমার আর এক সুহৃদয়ের গৃহে। হোল ফ্যামিলিই ভোজনরসিক। ধীরে ধীরে বইটিকে হজম করেছেন।

দার্শনিকের মতো বলা ভালো কী হবে খেয়ে? কিংবা বলা যেতে পারে, এমন খাও যাতে দীর্ঘদিন খেতে পারো। রোলিংস্টোনদের জন্যে রোল কাউন্টারই ভালো। অর্ধাঙ্গ কাগজের খোলে অর্ধাঙ্গ বাতাসের মধ্যাহ্নে কিঞ্চিৎ আলুর ঘাঁটি, না হয় ভাজা মাংস। কামড়াতে কামড়াতে নীচে নামো। ওপরে একটু কফি বা চা লড়িয়ে দাও। তারপর ধীরে ধীরে অম্নরসের আধিক্যে পেটটি হয়ে উঠবে চোলাই ভরা ব্লাডারের মতো। গৃহে প্রত্যাগমন করেই বাবুর উইকেট ডিক্লেয়ার নাকিসুরে, আজ আমার নো মিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *