2 of 2

প্রেমের পুজো, পুজোর প্রেম

প্রেমের পুজো, পুজোর প্রেম

বর্ষা বিদায় নিলেন। শরৎ এসেছে নীল আকাশের আঁচল উড়িয়ে। তারার চুমকি বসানো রাত। পেঁজা তুলোর মতো পাহাড়ে ফর্মেশান। ভাঙা কলকাতার দক্ষিণের আকাশের দিকে ঘাড় তুলে তাকালে মনে হয় ডনভ্যালিতে লেংচে বেড়াচ্ছি, চোখের সামনে মেঘের মুসৌরী। মৃদুমন্দ বাতাস ঘাড়ের কাছে প্রেয়সীর নিশ্বাসের মতো বলতে চাইছে, আমার রাজা, শরৎ এল, মৃগয়ায় যাবে না! কোথা সে বন সখী? কোথা সে জল? রাজারা আর মৃগয়ায় যান না। এখন মৃগয়ার যুগ। কথায় কথায় লাশ পড়ে যায়।

আমি কৃষ্ণ নই, নবকার্তিক নই, মোগল বাদশাহনই, ওমর খৈয়ামও নই; তাতে কী এসে যায়। আমার কায়দায় আমি চলব। সেই নোনাধরা গলির গলি তস্য গলির বাড়িতে আমার কোনও প্রেমিকা থাকতে পারে। হতে পারে তার এলোচুল কোমরের কাছে লুটিয়ে থাকে না, হতে পারে তার চোখ দুটি তেমন পটলচেরা নয়। চশমার আড়ালে সে চোখ কিছু নিষ্প্রভ। হাসিতে তেমন ঝিলিক নেই। কোনও প্রাইমারি স্কুলে ছাত্র ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে মেজাজ ঈষৎ তিরিক্ষি। তা হোক। ঘুসঘুসে জ্বরের মতো এই প্রেম চলেছে সেই সেভেন্টি টু থেকে। দরখাস্তের ভাষায়, সিনস। নাইনটিন সেভেন্টি টু আই হ্যাভ সাফারিং ফ্রম। এই একাশিতেও ম্যাচিওর করল না। করবে কী। করে? সাকার হতে হতে তো নিরাকার হওয়ার দিন এসে গেল। তবু এই শরতে আকাশে-বাতাসে ঢাক আর মাইকের শব্দ যখন খইয়ের মতো ভাসছে তখন একটু লড়ে যেতে দোষ কী।

ঘ্যাম অফিসের ঘ্যাম এগজিকিউটিভ তাঁর আলট্রামডার্ন প্রেমিকাকে নিয়ে গোয়া চলেছেন। পুজোয় যাঁরা কলকাতা ছাড়েন না হয় তাঁরা অথর্ব, নয় তো হা-ঘরে। এ সময়টা হল, চলো রীণা ক্যাসুরিনার। হিলটপ হোটেলে ফায়ার প্লেসের বারে বোসো। জল নয়, লাল পানীয়, দামি সিগারেট ঠোঁটে। বাইরের আকাশ ঢালু হয়ে বহু নীচে গাছ গুড়ি-গুড়ি, দেশলাই-দেশলাই বাড়ি আর ফিতে ফিতে নদীর ওপর টাল খেয়ে পড়েছে। এদিকে চাঁপার কলির মতো আঙুলে আংটির পাথরে আলোর মুচকি হাসি। এনামেল করা ঠোঁটে রাজ্যের তৃষ্ণা। পুরু কার্পেটে পায়ে-পায়ে জড়াজাড়ি। যেন সিগারেটের বিজ্ঞাপন। বহু দূরের আকাশের তলায় সেইন্যাস্টি ম্যাটমেটে কলকাতা! ঢাক বাজছে ঢ্যাম-কুড়-কুড়। প্যান্ডেলের বাঁশের আড়ায় উঠে, সস্তা নীল প্যান্ট-পরা দস্যি ছেলের দল বাঁদরের মতো লাট খাচ্ছে। লাঠিসুদ্ধ কাঁপা-কাঁপা হাত জোড় করে কপালে। ঠেকিয়ে বৃদ্ধ মানুষ মা দুর্গাকে নমস্কার করতে করতে মনে মনে বলছেন, কী যুগে এনে ফেললে দেবী! হঠাৎ সন্দেহ হল, মঞ্চে মায়ের ফ্যামিলির সবাই ঠিকঠাক আছেন তো? না, লাস্ট মোমেন্টে দোলা ফেল করে, এক-আধজন কৈলাসেই পড়ে রইলেন! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চনমনে নাতনিকে জিগ্যেস করছেন, হ্যাঁ রে, আসল যে অসুর সেই অসুর কোথায়? নাতনির মন তখন অন্যদিকে। বারোয়ারির পটলদা অনেকক্ষণ চোখ দিয়ে বন্দুক দাগছে। দাদুর আবার সংশয়ের প্রশ্ন, হ্যাঁ রে, অসুর আছে তো? এতক্ষণে নাতনির কানে কথা ঢুকল। মনে মনে পটলদাকে বলল, অসভ্য। দাদুকে অসহিষ্ণু গলায় বললে, কী তখন থেকে অসুর অসুর করছ? এই তো পাম শু পরে, ঘাড় এলিয়ে বুক চিতিয়ে রয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না? ওদিকে পটলদার চেলা বলছে, গুরু, একটু। হ্যারাসমেন্ট হলেও, মায়ের খুব টান আছে, খাঁটিয়া থেকে সব খটমল বের করে আনে। কী সব। জিনিস আসছে মাইরি! চকু সাত্মক। এদিকে বৃদ্ধের আবার প্রশ্ন, হ্যাঁ রে, গণেশের ইঁদুর? পাশে আর এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছেন। জবাব তিনিই দিলেন, তুমি কিচ্ছু ভেবোনা মধুসূদন! সব আছে। তুমি আছ, আমি আছি, অসুর আছে, ইঁদুর আছে, মা-জননী আছেন। লাল, তামাটে চুল ফিতের প্রজাপতি মেলে খয়া খয়া চেহারার একটি মেয়ে বৃদ্ধের নাতনির জামাকাপড়ের বাহার দেখছে।

এক সময় শখের থিয়েটারে অভিনয় করতেন বিশুবাবু। এখন যৌবন চলে গেছে। হিরো হওয়ার মতো আর চেহারা নেই। এককালে পাড়ার রয়েল বেঙ্গল ছিলেন। মনে মনে ভাবছেন যুগ কিস্যু পালটায়নি। কেবল একটা দিক ছাড়া। হায় রে। যৌবনটা যদি থাকত! বিজয়ায় পর মিতালি সংঘের থিয়েটার হল পর পর দুদিন। প্রথম প্রথম ছেলেরাই মেয়ে সাজত। শেষের দু-বছর অমূল্যদার কলেজে পড়া ডাগরডুগুর মেয়ে সুক্তি স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয় করার জন্য এগিয়ে এল। উত্তরা। উঃ, আগুন জ্বলে গেল। অভিনয়ের পরের রাত থেকেই দুলালদাকে ফিটের ব্যামো ধরল। উত্তরা, উত্তরা ফিট। নাকের কাছে ব্লটিং পোড়ার ধোঁয়া দিয়ে, মাথায় জল ঢেলে, তুলে বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই, উত্তরা, উত্তরা, আবার ফিট। পরের বছরে আবার উত্তরা। সেই শেষবার। সারা এলাকার আলো ফিউজ করে দিয়ে মানিক হাজরার দলবল গ্রিনরুম থেকে উত্তরা হরণ করে নিয়ে গেল। লাঠি বেরোল। সড়কি বেরোল। রক্তগঙ্গা বইল। প্রভাত গাবগাছে গলায় দড়ি দিল। উত্তরা থেকে হেলেন অফ ট্রয়।

আর এখন? পরদা সরে গেছে। মা দুর্গার তেরপলের পেছনে পলটু দাঁড়িয়ে আছে। যেন ময়ুর থেকে এইমাত্র নেমে এল। হলদে বাড়ির মেয়েটি সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে। তুইতোকারিতে কথা চলেছে। এই তো সুযোগ গুরু। রথ দেখা কলা বেচা দুটো সুযোগই মা দশভুজা সামনে-পেছনে দু-দিকেই করে দিয়েছেন। মায়ের কী দয়া! এসব এখন অ্যালাউড। ছি ছি করার জিনিস নয়।

যুবক-যুবতির প্রেম নিকষিত হেম। প্রেমে না পড়লে ইয়ংম্যান হওয়া যায় না। এইবার বিজয়া সম্মেলন, বিচিত্রা অনুষ্ঠানের ঢেউ বইবে। ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরা, পাউডার ঘষা, উড়ু উড়ু চুল সেক্রেটারি। হাতে অনুষ্ঠানসূচি। ঘামে বগল ভিজে উঠেছে। সারা শরীর গুম মেরে আছে আতরের গন্ধে। ভীষণ ব্যস্ত। মধুছন্দা কই, মধুছন্দা? কুৎসিত উচ্চারণে মুখে সুপুরি পুরে, বেতালে। সবচেয়ে শক্ত রবীন্দ্রসংগীত শোনাবে। সেজেগুঁজে একপাশে বসে বিন বিন করে ঘামছে। সারা মুখে আলপিনের মতো ঘামের বিন্দু। তবলচি কালো পাঞ্জাবির ওপর সাদা সুতোর আলপনার বাহার নিয়ে মুখিয়ে আছে। হারমোনিয়াম প্যাঁ করলেই তেগেবেগে করে তবলা ধরবে। পাড়ার শের আফগান করবীর মাকে কথা দিয়েছে, মেয়েকে নাচিয়ে ছাড়বে। উদ্যোক্তা নিমরাজি। আর্টিস আমরা বাজিয়ে নেব। তোমার করবী তো আমাদের কী? রূপকুমার প্রথম সারির তিন নম্বর মেয়েটির দিকে চোখ রেখে হেলেদুলে গাইছে, নজররা কী তির মারে কশ, কশ, কশ, এক নেহি, দো নেহি, আট, নও, দশ। নাও অর নেভার। তবলার ঠেকা পড়ছে গাফু, গাফু, গাফা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *