2 of 2

শেষ কথা

শেষ কথা

জমিদার বাড়ির গঙ্গার ঘাট। তেমন তো কেউ সরে না। সাবেক কালের বাঁধন আলগা হয়ে এসেছে। পইঠের কিছু কিছু হেলে গেছে। এইবার যে-কোনও দিন জোয়ারের গাঙ্গে গা ভাসিয়ে দেবে। সরকারি বাঁধন আইন মোতাবেক দুপাশ দিয়ে চলে গেছে। সে আরও বিপজ্জনক। ঘাটের সীমানা ছাড়িয়ে জলের তলায় কোথায় কী হয়ে আছে ওপরের কল্লোলিনী স্রোতধারা দেখে বোঝার উপায় নেই।

যতটা সম্ভব সাবধানে অমল ডান পা জলে বাড়াল। পানীচের দিকে নামছে তো নামছেই। নতুন বছর আজ শুরু হল। সাল দু-হাজার একের কোল ছেড়ে দুইতে পা রাখল। উত্তর থেকে। হাড়কাঁপানো হি হি বাতাস বয়ে আসছে। সোজা এসে হৃদয়ে ধাক্কা মারছে। ঠান্ডার অনুভূতি অমল ভুলে গেছে। দেহের সঙ্গে মনের আর যোগ নেই। কী শীত, কী গ্রীষ্ম। কোথায় হাত, কোথায় পা! একবারই কেবল মনে হল পাকি মাটি স্পর্শ করবে না। বাঁ-পা ঘাটের পইঠেতে, ডান-পা নেমে চলেছে, অতলে, এর পর দেহের ভারসাম্য রাখাই মুশকিল হবে। ভাঁটার টানে। তরতর করে বয়ে চলেছে গঙ্গা। কাঠ, কুটো, ফুল, পাতা, আবর্জনা সবই ভেসে চলেছে সাগরের দিকে। সময়ের ভাঁটিতে ভেসে চলা জীবনের মতো। আজ চলেছে কালের দিকে।

হঠাৎ পা ঠেকে গেল ভাঙা ইটের স্তূপে। শহরের সভ্য মানুষ। খালি পায়ে চলার অভ্যাস নেই। বড় সুখী পা। এবড়ো-খেবড়ো ইটের খোঁচায় মনে মনে উঃ করে উঠল। এই প্রথম বুঝল, মন দেহেই আছে। দেহবোধ অত সহজে যায় না। ক্ষণিকের তরে হয়তো যায়। ফিরে আসে আবার, বাসায় ফেরা পাখির মতো।

অমল টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো হচ্ছিল। ঘাটের একেবারে উঁচু ধাপে উবু হয়ে বসেছিল প্রবীণ কুলপুরোহিত চন্দ্রকান্ত সরস্বতী। কুশের অঙ্গুরীয় পাকাতে পাকাতে তিনি অমলের দিকে নজর রেখেছিলেন। চিৎকার করে বললেন, সাবধান, সাবধান, তাড়াহুড়ো কোরো না। ধরে ধরে নামো, ধরে ধরে নামো। এখন কেটেকুটে যাবার খুব সম্ভাবনা।

অমল বুঝতে পারল না, কী ধরবে, কাকে ধরবে। পেছনে ভাঙা ঘাট, সামনে খরস্রোতা নদী। ডানপাশে সরকারি বাঁধন ছেড়ে বেরিয়ে আসা তারের খাঁচা। বাঁ-পাশে জমিদার বাড়ির ভেঙে পড়া পোস্তার শতটুকরো থাম। অমল এখন পুরোপুরি সচেতন। মানুষ সহজে কি মরতে চায়! একটু আগে সে অসীম শূন্যতায় কাটা ঘুড়ির মতো ভাসছিল, এখন আবার সুতো এসে গেছে হাতে। গোটাতে শুরু করেছে। জলের এই গভীরতায় উলটে পড়া মানে ভেসে চলে যাওয়া। অতি কষ্টে হেলেদুলে শরীরের ভারসাম্য কোনওক্রমে ফিরিয়ে এনে ভাবতে লাগল, কী করবে। কীভাবে নামবে জলে!

মাঝ নদী দিয়ে একটা লঞ্চ চলেছে উত্তর দিকে। হিন্দি সিনেমার গানের সুর খান খান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, ভাঙা খোলামের কুচির মতো। লঞ্চের ছাদে একদল উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে হই হই করছে। অমল অবাক হয়ে গেল, পৃথিবী তাহলে ফুরিয়ে যায়নি। এখনও গান আছে, জীবন আছে, আনন্দ আছে। আছে নিউ ইয়ারসের পিকনিক।

জমিদার বাড়ির দারোয়ান ঘাটে এসেছিল। অমলের টালমাটাল সঙ্গিন অবস্থা দেখে উঁচু গলায় বললে, আরও ডান দিকে সরে গিয়ে নামার চেষ্টা করুন। ওখান দিয়ে পারবেন না।

অমল এখন মরিয়া। এই কসরত আর ভালো লাগছে না। বহুক্ষণ হয়ে গেল। কত জল বয়ে গেল। সাগরের দিকে। অমল ডান দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ঘাটের ওই দিকটা নাকি সহজ। জীবনের কোন দিকটা সহজ? পা না দিলে কি বোঝা যায়! জীবনের এতগুলো বছর পেঁজা তুলোর মতো উড়ে গেল ফুরফুর করে, কই বোঝা তো গেল না সহজ কোনটা!

অমল পা বাড়াচ্ছে, পেছন থেকে অমলের মেয়ে বললে, বাবা দাঁড়াও, আমি এসে গেছি। একা নামতে যেও না। আমি তোমার হাত ধরছি।

তির তির করে হরিণীর মতো নেমে আসছে শাড়ি পরা টুকটুকে ফরসা একটি মেয়ে। বাতাসে উড়ছে রুক্ষ ফুরফুরে চুল। অমলকে ধরার জন্যে ছুটে আসছে স্নেহের বন্ধনে। একটু আগে তার মনে হচ্ছিল, বছরের এই এমন একটা দিনে নিজের জীবনে ইতি টেনে দিলে ক্ষতি কী! সারাটা বছরের উথালপাথালে তাহলে পাড়ি দিতে হয় না। মুক্তি! মৃত্যুর চেয়ে সহজ মুক্তি আর কীসে। আসে? এই তো মাত্র দশ দিন আগে সেই সত্যের সন্ধান সে পেয়েছে। পেলে কী হবে! বন্ধন যে মুক্তির চেয়ে প্রবল। সব নৌকোই কি আর নোঙর তুলে তটের মায়া কাটিয়ে সহসা চলে যেতে পারে! তীরে তীরে বয়ে যায়। ঘাট থেকে ঘাটে। হাট থেকে হাটে। যতক্ষণ না ঝঞ্চা এসে। একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

অমলের মেয়ে সোমা বললে, বাবা, আমি আগে নামি, তারপর তুমি আমাকে ধরে নামো।

বাবা ডাক শুনে অমল নিমেষে পেছিয়ে গেল তিরিশটা বছর। হরিদ্বারের মনসা পাহাড়ের খাড়া একটা অংশে সে উঠে গিয়ে নীচের দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, বাবা, আপনি আমার হাত ধরে উঠে আসুন। বেশ সাহসের সঙ্গে নিজের ওপর আস্থা রেখেই বলেছিল।

তিনি হেসেছিলেন। হেসে বলেছিলেন, তুই পারবি না রে আমার ভার রাখতে। দেখনা আমি নিজেই উঠছি। তুই বরং নেমে এসে আমায় ঠেলে তুলতে পারিস। টেনে তোলার চেয়ে ঠেলে তোলা সহজ।

তখন অমল ছিল ছেলে, আজ সে বাবা। অমল মনে মনে বললে, সেদিন সন্দেহ করেছিলেন, ভার রাখতে পারব না, কিন্তু এগারো দিন আগে আপনাকে কাঁধে করে নিয়ে গেছি। আপনি কি বুঝতে পেরেছিলেন!

কী হল নেমে এসো। এই ঠান্ডায় তুমি দেখছি একটা শক্ত ব্যামো না ধরিয়ে ছাড়বে না।

মেয়ের কথায় অমল তিরিশ বছর পেছন থেকে আবার সামনে ফিরে এল। এক হাত দূরে গঙ্গার শীত-স্বচ্ছ জল তর তর করে বয়ে চলেছে। সোমা কায়দা করে কখন নেমে পড়েছে জলে। হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেছে। একটা হাত সামনে বাড়িয়ে ধরে বলছে, ঝপ করে নেমে এসো বাবা, আর দেরি কোরো না। ভীষণ ঠান্ডা জল।

নামার আগে অমল একবার পেছন ফিরে তাকাল। অমলের স্ত্রী নীপা এসে দাঁড়িয়েছে কখন। খেয়াল করেনি। পরনে সাদা লালপাড় শাড়ি। টকটকে গৌরবর্ণ শরীর অশৌচের কৃচ্ছসাধনে বেশ সাত্বিক দেখাচ্ছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ। টানা তিন মাস দিবারাত্র রুগির পরিচয্যার পর শরীর এখনও বিশ্রাম পায়নি। দু-একবার বলেছে, কাজকর্ম চুকে যাক, তারপর একটানা তিনদিন পড়ে। ঘুমোবে। অমল জানে না সংসার তাকে সে-সুযোগ দেবে কি না! সংসার এমন এক জায়গা, যা সুখ, দুঃখ, কর্ম, অকর্ম সব গ্রাস করে নেয়। মৃত্যুর মতো অমন শান্তির মহানিদ্রা আর নেই। তিনটি মাত্র খাবির মামলা। এই তো দেখল। চোখের সামনে ভাসছে সে দৃশ্য। প্রথম খাবিতে কবজির। কাছ থেকে নাড়ি চলে গেল। দ্বিতীয় খাবিতে চলে গেল কনুইয়ের কাছ থেকে। তৃতীয় খাবিতে চোখ বিস্ফারিত স্থির। দেহ শান্ত। নিমেষে সব যন্ত্রণার অবসান। দীর্ঘ পঁচাশি বছরের কর্মকাণ্ড। তিন টুসকিতে কোথায় চলে গেল! কত কষ্টে একটা জীবন ছড়ায় আর কত সহজেই না গুটিয়ে যায়। ছাদের আলসেতে মেয়েরা যখন ভিজে কাপড় ঝোলায়, তখন কত ধীরে ধীরে, ঝেড়ে ঝেড়ে, টেনে টেনে ঝোলায়। আর শুকনো কাপড় তোলার সময় সড়াক করে একটানে তুলে নেয়। মৃত্যু হল শুকনো কাপড় তোলা।

নীপা হাত তুলে ইশারা করে জানাল, দাঁড়াও। নেমে এল ধীরে ধীরে। সোমা হাত পেছিয়ে নিল। বাবার জীবনসঙ্গিনী এসে গেছে। আর ভয় নেই। সহধর্মিণী।

নীপা বললে, তোকেই কে ধরে ঠিক নেই, তুই ধরবি এই বুড়ো মানুষটাকে?

অন্য সময় হলে অমল প্রতিবাদ করত। সে এমন কী বুড়ো। সবে কানের পাশের দু-চারটে চুলে পাক ধরেছে। আজ শুধু ফ্যালফ্যালে দুটো চোখ মেলে শুনে গেল।

নীপা অমলকে বললে, খালি পায়ে না চলে চলে পাদুটোকে এত নরম করে ফেলেছ। তা ছাড়া তুমি একটু ভীতুও আছো বাবা।

অমল এবারেও প্রতিবাদ করল না। শুনে গেল। কেমন করে বোঝাবে এদের নিজের মনের অবস্থা সাহারা মরুভূমির মতো হয়ে গেছে। যেদিকে তাকাও শুধু বালি আর বালিয়াড়ি।

নীপা খুব সাবধানে, ধরে ধরে অমলকে এক পা, এক পা করে জলে নামাল। ঠান্ডা জলের স্পর্শে গা যেন জ্বলে গেল। ভেতরটা পাঁকে একেবারে গ্যাদ গ্যাদ করছে। পায়ের হাঁটু পর্যন্ত ভড়-ভড় করে ঢুকে গেল। অন্য সময় হলে গা ঘিনঘিন করত। এখন আর সে বোধ নেই। ঘটনা তাকে ঠেলতে ঠেলতে সময় থেকে সময়ে, দিন থেকে দিনে নিয়ে চলেছে। জীবনের কী দাম! থাকলেই বাকী, গেলেই বা কী! থাকার চেয়ে যাওয়াটাই নিশ্চিন্ত। কবে কোথায় যেন পড়েছিল, তুমি জন্মেছ। মরার জন্যে।

বর্ধমান থেকে দিদি আসত তার ছেলেবেলায়, অমল জানত, এটা আসা নয়, যাওয়া। যাওয়ার জন্যেই দিদি এসেছে। হাসছে, কথা বলছে, গান গাইছে। কলকাতায় থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে, অমল খুব একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করত না। জানত ধরে রাখা যাবে না। যাওয়ার দিন দিদি অমলের হাতে একটি টাকা দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। তখন অমলও কাঁদত দিদিও কাঁদতেন হাউ হাউ করে। সে এক মজার ব্যাপার। দুজনেই জানত যেতে হবে, চিরবিদায় নয়, তবু বুকটা কেমন যেন খালি হয়ে যেত।

নীপা বললে, এবার দেখছি তোমাকে নিয়ে এক বিপদ হবে। তুমি যা করছ। ঝপ করে একটা ডুব মেরে নাও, তোমাকে আমি ওপরে তুলে দিয়ে আসি। আরে বাবা কোনও মানুষই কি চিরকাল বাঁচে! বয়েস হলেই যেতে হবে। মনটাকে শক্ত করো, শক্ত করো। তোমার এখনও কত কাজ বাকি, ছেলেমেয়ের এডুকেশান, বিয়ে।

অমল আর শীর্ণ স্বার্থের কথা শুনতে চায় না। শুনে শুনে কান পচে গেছে। তাছাড়া এইবার যেন কাঁপুনি আসছে। চড়া রোদ; কিন্তু দমকা বাতাসে মনে হচ্ছে কাশীর চিনির মতো লালচে নরম। সে ঝপ ঝপ করে গোটা দুই ডুব মেরে নিল। বরফের মতো শীতল জল। দুটো কান কটকট। করতে শুরু করেছে।

নীপা বললে, আর না, আর না, এবার উঠে চলো।

অমলের হঠাৎ মনে হল, এ ভালোবাসা না স্বার্থ! সে-ই তো এখন সংসারের মাথা হল, তাকে ঘিরেই গ্রহরা ঘুরপাক খাবে। আকর্ষণ-বিকর্ষণে হাসি ফুটবে। মুখ ভার হবে। তার শরীর-স্বাস্থ্য, মন-মেজাজের জন্যে তাই কি এত উদবেগ!

ঘাটের মাথা থেকে চন্দ্রকান্ত সরস্বতী তাড়া লাগালেন, উঠে এসো, উঠে এসো। আর দেরি কোরো না। উত্তরীয়টা পরে কাপড়টা শুকিয়ে নাও। তারপর কাজে বসা যাবে।

ঘাট আর তেমন নির্জন নেই। আত্মীয়স্বজনেরা একে একে সব এসে গেছেন। এক-একজনের এক-একরকম সাজ-পোশাক। চোস্ত পাজামা, সার্জের পাঞ্জাবি, দামি শাল গায়ে দিয়েও কেউ কেউ এসেছেন। একজনের মুখে সিগারেট জ্বলছে। মেয়েরা কেউ কেউ বেশদামি শাড়ি পরেছে। বিলিতি গন্ধ ঢেলেছে গায়ে। জমিদারবাড়ির এই একান্ত, নির্জন ঘাটটির প্রশংসা করছে কেউ। কেউ বলছে পৃথিবীতে পয়সাই সব। পয়সা থাকলে মানুষ কত ভালোভাবে বাঁচতে পারে। গঙ্গার ধারে বিশাল বাগানবাড়ি। পোস্তা। ঘাট। মন্দির। মুক্ত বাতাসে ভোরে দু-চার পাক মারা মানেই। একশো বছরের পরমায়ুর গ্যারান্টি। এইসব নানা কথা অমলের কানে আসছে। খিল খিল হাসি। দু-চার কলি রবীন্দ্রসংগীত। একজনের দুঃখ আর-একজনকে স্পর্শ করে না। দুঃখ আর মেয়েদের অলঙ্কার যে এক বস্তু। সহজে অন্যের কাছে যায় না। নিভৃতে ভেলভেটের বাক্সে থাকে। গোপনে খুলে খুলে দেখতে হয়, পরতে হয়।

নীপা বললে, এ কী, গা-টা মুছলে না! নিউমোনিয়া হলে কে দেখবে! ওনার তবু তুমি ছিলে, তোমার কে আছে? কে দেখবে তোমাকে?

নীপার এই কথাটা অমলের ভীষণ ভালো লাগল। দুটো জায়গা স্পর্শ করেছে। এক, তার অহঙ্কার। সে যে খুব করেছে, বাঁচুন না বাঁচুন, সেবার ত্রুটি হয়নি, এরা বুঝেছে, জেনেছে সবাই। দ্বিতীয় তার শূন্যতা। একালের ছেলেমেয়েরা বাপকে দেখবে না, দেখে না; নীপা বুঝেছে। অমলকে তাহলে নীপাই দেখবে, যদি না সে আগে চলে যায়। বেঁচে থাকার পরিধি আজ এই মুহূর্তে সুচিহ্নিত হল। স্বামী আর স্ত্রী আর এদিকে-ওদিকে কিছু কর্তব্য, যা মানুষকে করে যেতেই হয়।

নীপা উঁচু গলায় বললে, এই চন্দ্রকান্তদা, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না!

পাটকাটির ফেঁসে পরিষ্কার করতে করতে তিনি বললেন, কেন মা?

এই ঠান্ডায় পুরো জলটা গায়ে বসে গেল।

যাক, বসে যাক। কিছু হবে না। এখন ও তাঁরই রক্ষণাবেক্ষণে আছে। তিনিই দেখবেন। তুমি কিছু ভেবো না।

নীপা আর সোমা দুজনে দুদিক থেকে ধরে অমলের ভিজে থান রোদ আর বাতাসে শুকোতে লাগল। বাতাস লেগে কাপড়টা মাঝে মাঝে ফুলে উঠছে নৌকোর পালের মতো। সোমার হাত থেকে একবার একটা খুট ফসকে বেরিয়ে যেতেই, মা আর মেয়ে দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ার দাখিল।

আত্মীয়দের মধ্যে উঠতি বয়সের চপলা নামে একটি মেয়ে বলছে, শীত থাকতে থাকতে এখানে একটা পিকনিক করলে বেশ হয়।

সকালে অমল একবার লক্ষ করেছে, এখনও করল, প্রতিবেশী একটি ছেলে মেয়েটির কাছাকাছি আসার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নানাভাবে তোয়াজ করে চলেছে মেয়েটিকে। পিকনিকের কথায় ছেলেটি মহা উৎসাহে বললে, তাহলে কালই হয়ে যাক। মেয়েটি স্মরণ করিয়ে দিলে, কাল যে শ্রাদ্ধ।

ছেলেটি চুপসে গেল। আর সেই মুহূর্তে পুরোহিত চন্দ্রকান্ত ছেলেটিকে বললেন, বাবু, এই বালতিটা করে এক বালতি গঙ্গাজল নিয়ে এসো তো।

পরনে দামি প্যান্ট। গায়ে কলার দেওয়া সুন্দর সোয়েটার। হাতে জাপানি ঘড়ি। ছেলেটির মুখটা ভারি করুণ দেখাল। এসেছিল প্রেম করতে। বড় আশায় আশায়। এখন আনতে হবে ভড়ভড়ে পাঁকে পা ডুবিয়ে গঙ্গার ঘোলা জল! আর বালতিটাও নেহাত ছোট নয়।

ছেলেটি প্যান্টের পা গুটোতে লাগল। মেয়েটি চলে গেল ভাঙা শিবমন্দিরের দিকে। বালতিটা হাতে নিয়ে ছেলেটি এপাশে-ওপাশে তাকাচ্ছে অসহায়ের মতো। বিশ-পঁচিশটা বড় বড় ধাপ ভেঙে তাকে নামতে হবে জলে।

অমল বসেছিল, উঠে দাঁড়াল, বালতিটা আমাকে দাও, আমি নিয়ে আসছি জল।

চন্দ্রকান্ত সরস্বতী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, না না, তুমি না, তুমি চুপচাপ বোসো। ও ছোকরা আছে, ও-ই নিয়ে আসবে।

অমলের বড় অদ্ভুত লাগছে, হঠাৎ তার খাতির কেমন বেড়ে গেছে। সকলেরই নজর এখন তার দিকে। সংসারের এত নজর তো তার ওপর ছিল না। তাকে বসতে দেখলেই তো একটা না।

একটা কাজ চাপিয়ে দেওয়া হত ঘাড়ে। ভারি কাজের তো অভাব ছিল না। বালতি বালতি জলও টেনে তুলতে হয়েছে একতলা থেকে দোতলায়।

চন্দ্রকান্ত বললে, কী কাপড় শুকোলো?

নীপা বললে, প্রায় শুকিয়ে এসেছে।

একটু দোলাও, একটু দোলাও। বারোটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই।

নীপা আর সোমা কাপড়টাকে দোলাতে লাগল মজা করে, এপাশ থেকে ওপাশ, সাদা থান ফুলে ফুলে উঠছে। সোমা বলছে, দেখো মা, আবার না ফসকে যায়।

অমল অবাক হচ্ছে। দশ দিনেই এরা একটা মানুষকে ভুলে গেল। কী আশ্চর্য! এই তাহলে সংসারের পাওনা! সারাজীবন খেটে, তিল তিল সঞ্চয় করে, হয়তো একটা বাড়ি, আশি-নব্বই হাজার খরচ করে মেয়েকে বিয়ে, নিজেকে মেরে ছেলেকে ডাক্তার কি ইঞ্জিনিয়ার করা, তারপর যেন স্লেটের লেখা। দু-ফোঁটা চোখের জল, সব মুছে গেল। জগৎ হাসতে লাগল হ্যা হ্যা করে। কে যেন ভেতর থেকে বললে, অমল ভাবছ কী! তুমিও এই ভাবে চলে যাবে স্মৃতি থেকে। সংসার। সংসার করে আর অত বেশি উতলা হয়ো না। তোমাকে যারা ঘিরে আছে, সবাই কাবুলিওয়ালা। হয় আসল দাও, না হয় দাও সুদ। একটা ছাদ, একটা বিছানা, একটা বউ আর বাবা ডাকের। জন্যে বড় চড়া সুদ দিতে হয়। গোটাও, গোটাও, নিজেকে গুটিয়ে নাও।

নীপা এগিয়ে এসে বলল, এই নাও তোমার কাপড়। আমি এবার নখ কেটে চান সেরে নিই।

অমল হঠাৎ জিগ্যেস করলে, তোমাদের মন খারাপ হচ্ছে না?

না, আমাদের মন বলে কোনও বস্তু নেই। আমরা পাষাণ।

চলে গেল নীপা। মহামায়া সেলুনের ছেলেটা এসেছে। প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট চড়িয়ে। একপাশে দাঁড়িয়ে প্যান্ট পালটে লুঙ্গি পরছে। এদের নখ কাটবে, সব শেষে অমলকে ন্যাড়া করবে। নীপা ওইদিকেই গেল।

পুরোহিত চন্দ্রকান্ত বললেন, খান চারেক ইট চাই যে।

ইট?

সকলের মাথায় যেন ইট ভেঙে পড়ল। পরস্পর পরস্পরকে বলতে লাগল, ইট চাই? ইট। কেউ

কিন্তু নড়ল না। কে যেন বললেন, ইয়াং জেনারেশন সব গেল কোথায়? ইটফিট তো তারাই আনবে।

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, ইয়াং একালের ইয়াং, তারা ন দেবায়, ন হবিষগায়।

অমল এতক্ষণ নিজের ভাবে ছিল, লক্ষ করেনি, দুই প্রবীণ প্রতিবেশী বেশ ধোপদুরস্ত হয়ে, শালটাল গায়ে দিয়ে এসেছেন। একজনের নাম কমলবাবু আর একজনের নাম শ্যামলবাবু। দুজনেই রিটায়ার্ড। একজন রেলে আর একজন ইনকাম ট্যাক্সে কাজ করতেন। একজন খুব ঘুরতেন, আর একজন মানুষকে খুব ঘোরাতেন। দুজনেই কৃতী, করিতকর্মা। বাড়ি করেছেন। ছেলেদের ভালো ভালো জায়গায় বসিয়েছেন। দেখেশুনে খেলিয়ে মেয়েদের সব পাত্রস্থ করেছেন।

কথা হচ্ছে কমলে আর শ্যামলে। শ্যামলবাবুর হাতে আবার সেদিনের ভাঁজ করা কাগজ।

শ্যামলবাবু বললেন, যা হবার তা এই অমলদের জেনারেশন পর্যন্ত হয়ে গেল, এরপর আর পিতৃপুরুষকে জল পেতে হচ্ছে না। ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে ফেলে দিয়ে আসবে ভাগাড়ে।

না, না, না ভুল হল, ভুল হল কমলবাবু সংশোধন করলেন, জল পাবে অন্য ফর্মে, চোলাইয়ের বোতলের তলানি দু-চার ফোঁটা ঢেলে দেবে ঠোঁটে। আমরা হয়তো এক চামচে গঙ্গোদক পাব, অমলদের বরাতে কী আছে কে জানে! তখন হয়তো শ্রাদ্ধেও রাজনীতি ঢুকবে।

তুমি বলছ রাজনৈতিক শ্রাদ্ধ। আরে সে তো সারা দেশ জুড়েই হচ্ছে।

অমল তোমার ছেলেটিকে দেখছিনা?

শ্যামলবাবুর প্রশ্নে অমলের খেয়াল হল। সত্যিই তো শেখর গেল কোথায়! তারও তো ঘাটে কাজ আছে। এই সময় থাকলে, জল কি ইট এনে দিতে পারত, অন্যের খোশামোদ করতে হত না।

কমলবাবু বললেন, আরে সে তো এই জেনারেশনেরই ছেলে। দ্যাখো হয়তো টিভিতে ক্রিকেট দেখছে। লাঞ্চের পর আসবে।

একালের ছেলেরা দেশ থেকে ধর্মটর্ম সব উঠিয়ে দেবে দেখছি।

না না, ধর্ম উঠবে কেন? দেখছ না, বারোয়ারির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে কীরকম। বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে।

বারোয়ারিকে তুমি যদি বলো পুজো, তাহলে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে বাপু।

শোনো শোনো, ধর্ম যায় যাক, মানবধর্ম যেন থাকে। সেটি হল শিশ্নোদরপরায়ণ হওয়া। তা সেদিকে আমরা বাপু হু-হু করে এগিয়ে চলেছি। বিয়ের ঘটা দেখছ? এক এক লগ্নে হাজারে হাজারে জোড় বাঁধছে। আর প্রেম? প্রেমের বন্যা বইছে। সবাই লাভার।

অমলের কাপড় পরা হয়ে গেছে। পুরোহিত বললেন, আর দাঁড়িয়ে থেকো না অমন উদাস মুখ করে। জানি মন ভীষণ খারাপ। তবু করণীয় কাজ তো করতেই হবে।

কমলবাবু বললেন, আহা বেচারা একেবারে ভেঙে পড়েছে। এ তো যে সে ছেলে নয়, একেবারে বাবা অন্ত প্রাণ। হবেই তো। ভেতরটা একেবারে হু-হু করবে। যত দিন যাবে জ্বলে-পুড়ে খাক। হবে। আমার পিতৃবিয়োগের পর কী হয়েছিল জানো? একটা বছর একেবারে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলুম। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার সব যেন বিষ। পানসে, পয়জন।

আমার সেই বাল্যে হয়েছিল, বেঁচে গেছি, কিছুই তেমন মনে নেই। এখন নিজেই পিতা।

তোমার বড় ছেলেটি এখন কোথায়?

হারামজাদাকে দূর করে দিয়েছি। আমি বড় স্ট্রিক্ট প্রিনসিপলের ফাদার। তুমি বড় চাকরি করতে পারো, কিন্তু বাপের অমতে বিয়ে করলে ক্ষমা নেই। নো প্লেস ইন দি ফ্যামিলি। শুনেছি সল্টলেকে নাকি দেখার মতো বাড়ি ফেঁদেছে।

শ্বশুর নাকি বিশাল বড়লোক।

শুনেছি, শুনেছি। খানচারেক গাড়ি আছে। তা থাক, কালচারে ভেরি পুওর। একেবারে পোর। শেক্সপীয়ারের নাম শোনেনি। কেবল ঠনঠনিয়া ঢনঢনিয়া।

কীসের কারবার?

লোহার। আয়রন মার্চেন্ট। ওড়িশার দিকে একটা মিনি স্টিলপ্ল্যান্ট করেছে।

ছেলেকে তুমি তাড়ালে, না তোমাকে লাথি মেরে সরে গেল?

আরে বাবা, ওই একই হল। নিজে না সরলে, আমিই তাড়াতুম। বুঝলে না, বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে, একেবারে ভেড়া বানিয়ে ছেড়ে দিলে। গেট আপ। উঠে দাঁড়াল। সিট ডাইন। বসে পড়ল। লাই ডাউন। শুয়ে পড়ল।

কী করা যায় বলো তো?

কীসের কী করা যায়?

মেয়েরা যদি এইভাবে ছেলেদের ভাঙিয়ে নিয়ে যায়, আমাদের ভবিষ্যৎটা কী হবে?

সময় থাকতে সাবধান হবে আমার মতো। সঞ্চয় বাড়াবে। সেভিংস। আমার সলিড এক লাখ ফিক্সড করা আছে। ইন্টারেস্টেই মাস চলে যাবে, ডিপোজিটে হাত পড়বে না।

তোমার যে ভাই মেয়ে নেই। বেঁচে গেছ। জোর বাঁচা বেঁচ্ছে। কান্তিটাকে দেখলে আমার ভয় হয়।

কে কান্তি?

আরে আমাদের কান্তি ঘোষ।

অ কান্তি। পি এম জি অফিসে ছিল তো? ও একটা রামছাগল। ওকে প্রথমে মেরে গেছে ওর বউ। চির রুগ্ন। শেষ সাতটা বছর পড়ে রইল বিছানায়। তারপর শেষ মার মারলে ওর ছেলে। ওস্তাদের মার। বাপের পয়সায় ব্যবসা করতে গেল। আরে বাবা বাঙালির রক্তে ব্যবসা আছে নাকি! বাঙালির রক্তে তিনটি মাত্র জিনিস আছে, রাজনীতি, দলাদলি আর বোমাবাজি। কান্তির মতো গাধারা শেষ জীবনে মরবেই। ফ্যা-ফ্যা করে মরবে। দুবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। জানোই তো, একে চন্দর, দুয়ে পক্ষ। মানে কী? একবার স্ট্রোকে চাঁদি উড়বে। টাকার শ্রাদ্ধ হবে। দ্বিতীয় বারে তুমি পাখা মেলবে। এই উড়ি, কখন উড়ি ভাব। আর তিনে নেত্র। চোখটি উলটে গেল। চিচিং ফাঁক।

চন্দ্রকান্ত সরস্বতী চারখানা ইট ঘিরে বেশ একটা উনুন মতো বানিয়ে ফেলেছেন। পাশে উবু হয়ে বসে আছে অমল। নিজের মনেই বললে, এই ছাতারে পাখির কিচিরমিচির বন্ধ হবে কখন? ধরা করা করে ঘাটটা জোগাড় করলুম, শান্তিতে নির্জনে কাজ করব বলে, হয়ে গেল। সে গুড়ে বালি।

পুরোহিত বললেন, ছিঃ ছিঃ। ওঁরা তোমার গুরুজন। পিতার বন্ধু।

আমার পিতার কোনও বন্ধু ছিল না।

তোমার পিতার পরিচিত। একটা বছর তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে বাবু। মহাগুরু নিপাত যোগ। কারওর সঙ্গে বিবাদ বিসম্বাদ নয়, সাবধানে চলাফেরা। ট্রামে বাসে ওঠা নামা। বয়স্ক মানুষদের বকবক করাই স্বভাব। নাও, মালসা চাপাও। চাল আমি ধুয়ে রেখেছি।

শ্যামলবাবু হেঁকে উঠলেন, অমল তোমার শীত করছে না?

অমলের সংক্ষিপ্ত উত্তর, না।

কমল বললেন, ওর আর এখন শীত-গ্রীষ্ম বোধ নেই।

গীতা একেই বলেছেন মনসা কর্মনা বাচা। শ্যামল যোগ করলেন।

কী পাগলের মতো বলছ! গীতায় আবার অমন শ্লোক পেলে কোথায়?

আরে ওই হল। ভাগবত ভেঙেই তো গীতা হয়েছে।

চুপ করো, তুমি চুপ করো। তোমার জ্ঞানের ভাণ্ডার আর খুলো না। সামনেই পণ্ডিত বসে আছেন। শুনতে পেলে হাসবেন তিনি।

হাসার কী আছে। সব ধর্মই এক। সর্বধর্ম সমন্বয়। গীতাও যা, ভাগবতও তাই। রামায়ণও যা, মহাভারতও তাই। যেই রাম, সেই কৃষ্ণ—দুয়ে মিলে রামকৃষ্ণ।

পুরোহিত বললেন, নাও, এক গোছা প্যাঁকাঠি নিয়ে আগুনে ধরাও। উত্তরীয় সামলে। একটু সরে বোসো, আগুনের ফুলকি উড়ছে বাতাসে।

ওপাশে মেয়েরা হইহই করছে। নখ কাটা চলেছে। অমলের ছেলে এসে গেছে। সে আর কাজের দিকে ভেড়েনি। মাথায় আধুনিক কায়দায় লম্বা ফুরফুরে চুল। পরনে জিনসের বহু পকেটওয়ালা কায়দার প্যান্ট, টি শার্টের মতো সোয়েটার। সিনেমার কচি নায়কের মতো হাত-পা নেড়ে কত কথাই যে বলছে। অমলের কানে আসছে আবার আসছে না।

হঠাৎ অমলের কানে এল শ্যামলবাবু বলছেন, মনই তো আত্মা, সেই আত্মাকে জয় করতে পারলেই মার দিয়া কেল্লা। তখন শীতও নেই, গ্রীষ্ম নেই, বাতও নেই, অম্বলও নেই।

কমলবাবুর তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ, কে বলেছে মনই আত্মা? মন আত্মা নয়।

তাহলে মনটা কী?

মন ইজ মন। আত্ম ইজ আত্মা। আত্মাকে জয় করা যায় না। আত্মায় গিয়ে ঢুকে পড়তে হয়, যেমন শীতকালে তোক হি-হি করে ঢুকে পড়ে লেপের তলায়। যেমন ছানা আর রসগোল্লা। রসগোল্লা খেয়ে কেউ বলবে না ছানা খেয়েছি। অথচ ছানাই খেয়েছে। সন্দেশ খেয়ে কেউ বলবে না, ছানা খেয়েছি, কিন্তু ছানাই খেয়েছে। আত্ম হল ছানা। সেই ছানা থেকে ছেনে মানুষ, বেড়াল, কুকুর, গাধা।

কুকুর, বেড়াল, গাধার আত্মা নেই। যা প্রাণ চায় তাই বলে যাচ্ছ।

কুকুরের আত্মা নেই? বেড়ালের আত্মা নেই? এভরি হোয়্যার দেয়ার ইজ আত্মা। কোথাও অল্প ডোজে, কোথাও বিগ ডোজে। সব আত্মা। আত্মারই জগৎ।

চেয়ারের আত্মা আছে?

একেবারে ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন। আরে গাছের আত্মা আছে তো? স্যার জে সি বোস প্রমাণ করে গেছেন।

সে তো প্রাণ!

আরে প্রাণ মানেই তো আত্মা। আত্মার লক্ষণই তো প্রাণ।

প্রাণ তো মরে যায়। মরে ভূত হয়। তাহলে আত্ম মানে কি ভূত!

জানি না।

গাছ মরে চেয়ার। চেয়ার কি তাহলে গাছের ভূত?

তুমি এই সাবজেক্টটা বেঁচে থাকতে থাকতে আর বোঝার চেষ্টা কোরো না। মরলেই জানতে পারবে।

তোমাকে তো আর জানাতে পারব না।

আমিও মরে জেনে নেব।

ওপার থেকে যদি চিঠি লেখা যেত বেশ হত! ভগবানের কেন পোস্টাপিস নেই বলতে পারো?

না, পারি না। ভগবান বলে কিছু আছে? নেই। আছে ব্ৰহ্মৈব। ব্রহ্মেব তেন গন্তব্যং ব্ৰহ্মকর্মসমাধিনা। বুঝলে কিছু? ব্রহ্মের কাজ শেষ করে ব্রহ্মেই ফিরে যেতে হবে। বেশি বোঝার চেষ্টা কোরো না, তোমার মাথায় এইসব ঢুকবে না।

পুরোহিত অমলকে বললেন, নাও, ভাত হয়ে এসেছে। এই মোটা কাঠিটা দিয়ে ঘুটে নামিয়ে নাও।

অমল বললে, এখন যে একটু চাল চাল রয়েছে। এতটা শক্ত কি উনি খেতে পারবেন?

পুরোহিত অমলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি কি উনি খাবেন, মৃত্যুর পর মানুষের কিছু থাকে না। ধর্ম একটা প্রথা, একটা মনস্তত্ব, মনে রাখার জন্যেই এত সব। তা না হলে তো বিস্মৃতিতে সব হারিয়ে যাবে। নাও নামিয়ে দাও। দই, মধু, তিল আর কলা দিয়ে চটকালেই দেখবে নরম হয়ে গেছে!

অমল গরমেই হাত দিতে যাচ্ছিল, পুরোহিত বললেন, হাতটা পোড়াবে না কী? আগে ঠান্ডা জলে হাত ডুবিয়ে নাও। তুমি কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেছ। আরে মৃত্যু তো মানুষের জীবনের একটা স্বাভাবিক ঘটনা। মানুষ আসবে, মানুষ চলে যাবে। আমি যাব, তুমি যাবে। ওই দেখো ওরা কেমন স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। হাসছে, গাইছে, হইহই করছে।

অমল পুরোহিত মশাইয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাল। চোখদুটো জলে ভরে আসছে। কেমন করে বোঝাবে সে হঠাৎ কত নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। আপনার বলতে কেউ কি আর রইল। একই আধারে, পিতা-মাতা-বন্ধু-গুরু। যারা ওপাশে হইহই করছে, নাতি আছে, নাতনি আছে, পুত্রবধূ আছে, আত্মীয়স্বজন আছে; তারা তো সব ভিন্ন জগতের। একজন নতুন শাড়ি পরে কুঁচি ঠিক করছে। একজন অভিযোগ করছে, এইবার চুলে তেল দিতে না পারলে পাগল হয়ে যাব। একজন খোঁজ নিচ্ছে টিভিতে এই শনিবার কী বাংলা বই দিয়েছে। একজনও বলছে না, মানুষটা ছিল চলে গেছে। জীবনের শেষ তিনটে মাস কিছুই খেতে পারেননি। নাকে পরানো নল দিয়ে শুধু তরল আহার ঢালা হয়েছে খেয়ালখুশি মতো।

চোখের জল দেখে পুরোহিত বললেন, ভেঙে পোড়ো না। দীর্ঘ পথ তোমাকে একাই টানতে হবে বাবু। জগতের এই নিয়ম। নিজের জোয়াল আমরা নিজেরাই টানব। জেনে রাখো, সময়। সময়ই সব ক্ষত সারায়। নাও মালসার ভাত কলাপাতায় ঢালো।

নীপা এগিয়ে এল। হাতে দু-খানা ধুতি। অমলের সামনে মেলে ধরে বললে, কোন পাড়টা তোমার পছন্দ? একটা তোমার একটা তোমার ছেলের।

অমল শুধু একবার তাকাল। দু-চোখে ঝাপসা দেখছে। বললে, যেটা হোক।

নীপা বললে, তুমি এখনও মেয়েছেলেদের মতো কাঁদছ। আশ্চর্য!

অমল মনে মনে ভাবলে, মেয়েরা আজকাল কাঁদে! কই তুমি তো কাঁদছ না!

নীপা চলে গেল। অমল ভাত মাখছে। ভাবছে, এই হল প্রেতের আহার। কোথায় কাঁসার ঝকঝকে থালা, গেলাস, পরিপাটি আসন, লাল মেঝে, জল তরতরা!

চন্দ্রকান্ত সরস্বতী বললেন, নাও গোল গোল করে দশটা পিণ্ড করো সমান মাপের। হাতে নিয়ে নাচাও, দেখবে সুন্দর গোল হয়েছে।

কমলবাবু বন্ধু শ্যামলকে ছেড়ে দু-ধাপ ওপরে উঠে এসে অমলের কাছাকাছি উবু হয়ে বসলেন। চন্দ্রকান্ত সরস্বতী তাকাতেই মুচকি হেসে বললেন, বড় আদর্শবান, ধার্মিক মানুষ ছিলেন। কখনও কারওর কাছে মাথা হেট করেননি। আরে এই তো মাসখানেক আগেও দেখি বাজার থেকে ফিরছেন। ধোপদুরস্ত ধবধবে সাদা জামা আর কাপড় পরতেন। পায়ে পালিশ করা চকচকে ডার্বি। মেরুদণ্ড একবারে সোজা। আহা অমন মানুষ আর হবে না। আমরা দেখলেই বলতুম, আপনার ছেলের চেয়েও আপনি এখনও যুবক আছেন।

চন্দ্রকান্ত সরস্বতী বললেন, এক মাস আগে নয়, তিন মাস আগে।

আমার স্পষ্ট মনে আছে এক মাস আগে।

কমলবাবু শ্যামলকে জিগ্যেস করলেন, শ্যাম এক মাস আগে না?

শ্যামলবাবু বললেন, তোমার আজকাল সময়ের হিসেব থাকছে না। দু-মাস তো তুমি এলাহাবাদে মেয়ের বাড়িতে ছিলে।

কমলবাবু হতাশ হলেন। তবে বেশিক্ষণ নয়।

প্রশ্ন করলেন, পণ্ডিতমশাই, এই পিণ্ডি সাহস করে মানুষ খেতে পারবে?

খারাপ কী? ফাইন আলোচাল, দই, কলা, তিল সবই—অতি উপাদেয়।

না মশাই, আমার মনে হয় পেট ছেড়ে দেবে। এ একমাত্র ওই ভূতেদের চলে। ভূতের তো আর পেট নেই।

শ্যামলবাবু উঠে এলেন। কমলের পাশে বসে গম্ভীর মুখে বললেন, পাঁজিটা দেখেছিলেন?

চন্দ্রকান্ত বললেন, কেন বলুন তো?

মৃত্যুর সময়ে কোনও দোষটোষ পাননি তো?

হ্যাঁ পেয়েছেন, ত্রিপাদ দোষ।

সর্বনাশ! একপাদ, দ্বিপাদ নয় একেবারে ত্রিপাদ। সমূহ বিপদ। দোষ খণ্ডনের কিছু করেছেন?

কিছু মাত্র না।

সে কী? বংশ যে নির্বংশ হয়ে যাবে।

দেখাই যাক না কী হয়।

পুরোহিত কুশের আংটিটি অমলের হাতে দিতে দিতে বললেন, নাও পরে নাও অনামিকায়। দক্ষিণাস্য হয়ে বোসো। পইতেটা বাঁ কাঁধ থেকে ডান কাঁধে ঘুরিয়ে নাও। একে বলে প্রাচীন। রীতি। তার আগে গায়ত্রী পড়ো দশবার।

দমকা বাতাসে হঁটের ঘেরাটোপ থেকে প্যাঁকাটির ছাই ঘুরতে ঘুরতে ওপর দিকে উঠে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। মাঝ গঙ্গা দিয়ে আবার একটা পিকনিক লঞ্চ চলেছে, হিন্দি গান ছড়াতে ছড়াতে। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কী এক রসিকতায় খিলখিল হাসছে।

পুরোহিত বললেন, নাও এবার বাম জানু মাটিতে রেখে ডান জানু তুলে বোসো। বেদির ওপর এই কুশ পাঁচটা পাঁচটা করে সাজাও।

অমলের চোখ বেয়ে তখনও জল ঝরছে। দুটো হাতই জোড়া। মুছে নেবে সে উপায় নেই।

চন্দ্রকান্ত সরস্বতী বললেন, নাও, হাতে একটি কুশ, তুলসীপাতাসহ প্রথম পিণ্ডটি তোলো। মন্ত্র পড়ো, কাস্যপগোত্র প্রেত….

পিণ্ডটি মন্ত্রপাঠ শেষে হাতের ডান দিক দিয়ে গড়িয়ে বেদির ওপর পেতে রাখা কুশাসনে ফেলে দিল অমল। বড় বিচিত্র কায়দা। ঠিকমতো ফেলা হল না। গড়িয়ে গেল একপাশে।

পুরোহিত বললেন, পরেরটি ঠিকমতো ফেলার চেষ্টা করো। আর একটু এগিয়ে এসোনা সামনে।

কমলবাবু বললেন, এসবের জন্যে ট্রেনিং দরকার। পাকা হাত চাই। সহজ ব্যাপার। অত বড় একটা তাল তাগ করে ফেলা। তার ওপর দু-কনুই দিয়ে জল নিপেক্ষ। চেষ্টা করো চেষ্টা করো।

চেষ্টায় কী না হয়! আগুনের রিং-এর ভেতর দিয়ে বাঘ গলে যায়।

প্রতিবেশীর একটি শিশু এসে বারে বারে একই প্রশ্ন করে চলেছে পিসেমশাই তুমি নেড়া হবে না?

চন্দ্রকান্ত বললেন, হবে বাবা, হবে। ঠিক সময়ে হবে।

আমি দেখব।

হ্যাঁ হ্যাঁ দেখবে দেখবে। এখন তুমি ওদিকে মায়ের কাছে যাও।

ছেলেটি চলে গেল। সূর্য মধ্যগগন ছেড়ে ক্রমশই পশ্চিমে হেলেছে। সোজা রোদ এসে পড়ছে অমলের মুখে। আবার শুরু হল মন্ত্রপাঠ …দেবশর্মন্ননেনিক্ষব। যতবার প্রেতপুরুষের নাম। আসছে ততবারই অমল চমকে উঠছে। পঁচাশি বছরের একটি জীবনসংগ্রাম আজ পারিবারিক ইতিহাস মাত্র। খরা, বন্যা, আশ্বিনের ঝড়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, অভাব, অভিযোগ, অবাধ্যতা, কলহ, রোগ, শোক, ব্যাধি; অবশেষে শ্রীঅমুকচন্দ্র এখন প্রেত দেবশর্মন্ন।

পিণ্ডদান শেষ হল। এবার মস্তক মুণ্ডন।

নতুন একটা ক্ষুর কিনে আনিয়েছিলেন অমল। তেমন ধার নেই। সেলুনের ছেলেটি বললে, সিলিপ করে যাচ্ছে স্যার। এ দিয়ে কামাতে গেলে ঘণ্টা তিনেক লেগে যাবে। তার মানে সন্ধে।

শ্যামলবাবু বললেন, আরে বোকা দিশি ক্ষুরে বার দশেক শান না পড়লে ধার ওঠে না। তোমার ক্ষুর নেই?

আছে স্যার

আছে স্যার তো লাগাও। চড়চড় করে টেনে সাফ করে দাও। বারে বারে ওইভাবে চুল ভেজালে সাইনোসাইটিস হয়ে যাবে যে।

ছেলেটি অমলকে জিগ্যেস করল, কি স্যার লাগাবো?

অমল ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে গেছে। বললে, লাগাও।

ওদিকে দুই বিশেষজ্ঞে ধুম তর্ক লেগেছে, কোথাকার ছানার ভালো পান্তুয়া হয়। দত্তপুকুর না। বর্ধমান। হাতাহাতি হয় আর কি! একটু পরেই সব ছানা কিনতে বেরোবে। ভিয়েন হবে রাতে।

দেখতে দেখতে অমলের মাথা সম্পূর্ণ সাফা হয়ে গেল। এত বছরের চুল। মনে হচ্ছে মাথায় কেউ যেন পিপারমেন্ট মাখিয়ে দিয়েছে।

কমলবাবু বললেন, কি বাবা খুব মন খারাপ হচ্ছে? মন খারাপের কী আছে? মানুষ মরে না রে ভাই।

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্ৰানি, উঃ কী হাড়কাঁপানো বাতাস ছেড়েছে আজ, গঙ্গাসাগর আসছে বুঝি। নৈনং দহতি পাবকঃ কাল মাঝ রাত থেকে কষের একটা দাঁত যা ট্রাবল দিচ্ছে। নচৈনং ক্লেদয়্যাপোন শোষয়তি মারুতঃ। বুঝলে বাপি কোনও অস্ত্রের ক্ষমতা নেই আত্মাকে ছেদন করে। অগ্নির ক্ষমতা নেই যে দগ্ধ করে। জল এই আত্মাকে ডাইলিউট করতে পারে না, টোট্যালি হেল্পলেস, বায়ুর ক্ষমতা নেই শুষ্ক করে। নাঃ, ঘাটে আর বসা যায় না। যত বেলা বাড়ছে, তত শীত বাড়ছে। সার কথা হল, ন জায়তে মিয়তে বা কদাচিং নায়ং ভুত্বাভবিত ক ন ভূয়ঃ। জন্মাইনি, মরিনি, মরব না, জন্মাব না। এই হল গিয়ে তোমার শেষ কথা। নাঃ, আজ ডেন্টিস্টের কাছে যেতেই হবে। না হলে আজ রাতটাও ঠায় জেগে কাটাতে হবে।

অমল হঠাৎ প্রশ্ন করলে, আত্মার দাঁত আছে?

কেন বলো তো। হঠাৎ তোমার এই প্রশ্ন?

উত্তর দেওয়ার আগেই চন্দ্রকান্ত সরস্বতী তাড়া দিলেন, নাও, নাও স্নান সেরে নাও, আর বেলা বাড়িও না। বাড়ি গিয়ে একটা মালসা পোড়াতে হবে।

শ্যামলবাবু বললেন, আমিও চলি। সুন্দর কাজ হয়েছে বাবা। বড় সুন্দর কাজ। এ যেন মরেও সুখ। তোমাকে আমার কিছু একান্ত প্রশ্ন আছে, পরে হবে, কী বলল, এই যেমন শেষটা কী হল, কীভাবে গেলেন, শেষ কথা কী বললেন। সন্ধেবেলা তো দেখে গেলুম। হেসে হেসে কথা। বললেন!

কমলবাবু বললেন, সত্যিই তোমার ভীমরতি হয়েছে শ্যাম, তুমি সময় পেলে না? এখন ওই সব প্রশ্ন চলে!

পরনে নতুন ধুতি, গায়ে একটা খাদি চাদর, হাতে গঙ্গার জলের ঘটি, অমল বাড়ি ফিরে এল। পেছন পেছন আসছে মেয়ে সোমা। দেখা গেল বাপের প্রতি তারই দরদ বেশি; সেই থেকে এক মুহূর্তও সঙ্গ ছাড়েনি।

বাড়িতে তখন দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। ছাদে প্যান্ডেল বাঁধার কাজ শেষ। ডেকরেটারের লোক ফিনিশিং টাচ মারছে। বাঁশ ফেলার ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। এখানে ওখানে সাদা চাদর ঝোলানো হচ্ছে। যে ভদ্রলোক ফুল সাপ্লাই করবেন, তিনি এসে বসে আছেন একপাশে। টাকা নিয়েই ছুটবেন হাওড়ার ফুলবাজারে। অমল এক নজরে দেখে দিল বাড়ির চিত্র। থইথই আত্মীয়স্বজন চারপাশে। সার দিয়ে বসে আছেন কর্মীরা। কেউ এখুনি বেরোবেন ছানা আনতে, কেউ ছুটবেন কাঁচা বাজারে। কেউ বসে আছেন ছোট্ট একটি প্রশ্নের জবাবের জন্যে। খাবার টেবিল কী সানমাইকা লাগানো নেবেন না প্লেন।

মেজোমামার এক পাটি চটি কুকুরে চিবিয়ে শেষ করে দিয়েছে। দেখছেন আর বলছেন, বিঅন্ড রিপেয়ার। তিনি ছানা কিনতে যাবেন। কী পরে যাবেন? পায়ের মাপ নয়। এ বাড়িতে ননম্বর মাপের পা নেই। খালি পায়ে তো আর যাওয়া যায় না। এ বাড়ির পোষা কুকুর নয়, হিন্দি সিনেমার গেস্ট আর্টিস্টের মতো গেস্ট কুকুর। কে কবে দয়া করে খেতে দিয়েছিল, সেই থেকে আর নড়ে না। জুতোর রসে নেশা হয়ে গেছে। পড়ে আছে একপাশে। কে একজন বেধড়ক পিটিয়ে দিলে। কুকুরটা কেঁদে মরছে।

ইলেকট্রিক মিস্ত্রি অনবরত প্রশ্ন করে চলেছে, কটা পয়েন্ট হবে বলে দিন, আমি কাজটা ফিনিস করে ফেলি।

ওদিকে তুমুল গবেষণা, জেনারেটারের ব্যবস্থা করা হবে কি হবে না। গত এক মাস পাওয়ার পজিশান ভেরি গুড। অমল ভেবেছিল, নির্জনে শূন্য ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে কিছুক্ষণ। বসে। বসে ভাববে অতীতের কথা। পছন্দমতো এক-একটি ঘটনা তুলে এনে জীবন্ত করে সাজাবে! উপায় নেই। কাছাকাছি গোটা দুই নিমন্ত্রণ এখনও বাকি। নীপা চিৎকার করছে, কে গ্যাস জ্বেলে নেভাবার পর গ্যাসের মুণ্ডি বন্ধ করেনি। সোমা চিৎকার করছে, বিছানার চাদরে চিনি ফেলেছে কে। লাইন দিয়ে লাল পিপড়ে এসেছে।

দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে গেল। শীতের ধোঁয়ায় চারপাশ ঝাপসা। আলো জ্বলছে সব পিত্তি রঙের। পৃথিবীর যেন ন্যাবা হয়েছে। একে একে হালুইকরের লোক আসছে। বড় বড় কড়া উঠছে ছাদে। শেষ মুহূর্তে ধরা পড়েছে নকুলদানা আনা হয়নি। নীপা হেড হালুইকরকে বলছে, তিনি পান্তুয়া ভীষণ ভালোবাসতেন। ইয়া বড় বড় সাইজের করবেন, বেশ কড়া করে ভাজা, লাল লাল।

কোনও কিছুতেই তাঁর তেমন আসক্তি ছিল না। আসলে পান্তুয়া ভালোবাসে নীপা। আর যা নিজস্ব ভালোবাসার বস্তু, সবই এখন তাঁর নামে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। মেনু ক্রমশই লম্বা হচ্ছে। ছেলের ভালোবাসা কড়াইশুটির কচুরি, মেয়ের আঁচড়ের কোফতা, নিজের ঘুগনি আর আলু বোখরার চাটনি।

অধ্যাপক প্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন। ভীষণ গম্ভীর মুখ। অমলকে একপাশে নিয়ে গিয়ে মৃদু গলায় বললেন, পাঁজি দেখলাম। রাত নটা পনেরো মিনিট গতে যে কোনও মৃত্যুই সাংঘাতিক দোষযুক্ত।

অমল বললে, জানি, ত্রিপাদ দোষ।

অধ্যাপক শিউরে উঠলেন।

অমল জিগ্যেস করলে, ত্রিপাদ দোষে কী হয়?

কী না হয়? একটা জনপদ সম্পূর্ণ বৃক্ষশূন্য হয়ে যেতে পারে। শোনো, খুব সাবধান। যত। তাড়াতাড়ি পারো দোষ খণ্ডন করিয়ে নাও। তোমাকে ভালোবাসি তাই ছুটে এসেছি। তোমাদের পুরোহিত কে?

চন্দ্রকান্ত সরস্বতী।

পণ্ডিত মানুষ। তুমি কালই কথা বোলো তাঁর সঙ্গে।

অধ্যাপক বসলেন না। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। তেজস্বী ব্রাহ্মণ। উঠে চলে গেলেন।

নানা বর্ণের, নানা গন্ধের এক ঝাঁক ফুল আর মালা নিয়ে ঢুকলেন যুগলবাবু। আজ রাতেই ফুলের কাজ মোটামুটি শেষ করে যাবেন। প্রথমে সাজাবেন ঘর আর খাট। যে খাটে পরলোকগত মানুষটি জীবনের শেষ তিনটি মাস আসন করে বসেছিলেন মহাযোগীর মতো। মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলেছিলেন বসে বসে। মৃত্যুর চাল আটকে রেখেছিলেন তিন মাস। গ্র্যান্ড মাস্টারের খেলা।

কিস্তিমাতের চালটি পড়ল সোমবার রাত নটা আটান্ন মিনিটে। দীর্ঘ দাবার লড়াই এক চালে শেষ হয়ে গেল। দর্শকরা নীরব, হতবাক। অপরাজেয় খেতাব নিয়ে উঠে গেল মৃত্যু। পড়ে রইল শূন্য ছক। এ ছক বন্ধ হবে না। জীবনের সাদা-কালো খুঁটি সাজানোই রইল। যে কোনও দিন আবার শুরু হবে খেলা। চলবে দিনের পর দিন। নির্ভর করছে প্রতিদ্বন্দ্বীর খেলার ওপর। ওপাশের ঘরে কে টিভি খুলে বসে আছে। নাচের অনুষ্ঠান চলছে। বোল আর ঘুঙুরের শব্দ ভেসে আসছে।

যার যৌবন আছে, সে তো নাচবেই। যার তৃষ্ণা আছে, সে তো দেখবেই। নীপা ঘরে এসে ঢুকল। মুখে কী একটা পুরে এসেছে। ভুর ভুর গন্ধ বেরোচ্ছে।

ভারি মুখে বললে, বুঝলে পাক্কা দশদিন পরে পান-জর্দা খেলুম।

তুমি ওঁর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে পান-জর্দা খাবে না। পারলে না রাখতে!

দাঁড়াও দাঁড়াও, নেশা তো একবারে ছাড়া যায় না। ধীরে ধীরে একটু একটু করে হবে।

অমল উঠে পড়ল। বসতে, শুতে, পড়তে, ঘুমোতে, কথা বলতে কোনওকিছুই ভালো লাগছে না। হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, হয়তো সবই আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে, আবার সিনেমা। দেখবে, তারিয়ে তারিয়ে রসের বই পড়বে, রসের কথা বলবে। জীবনের পেছনে ছুটবে প্রেতের মতো ফ্যা ফ্যা করে। তবু যে সত্য লাভ হয়েছে, সেইটাকে যতদিন ধরে রাখা যায়। সব ফেলে। চলে যাওয়াটাই সত্য, সব ধরে বাঁচাটা বড় সাময়িক। কাঁদতে কাঁদতে আসা, খুঁতখুঁত করতে করতে বাঁচা আর অতৃপ্তি নিয়ে মরা। মাত্র তিনটে খাবি খাওয়া, সব শেষ। শ্মশান চিতায় বরফ শীতল দেহ। এক টুকরো কাপড় নিম্নাঙ্গে। মাথার তলায় কাঠের বালিশ। সেই বরফ শীতল শরীরে ভেজাল গব্যঘৃত মাখাবে। দূষিত গঙ্গাজল ঢালবে খাঁটি সংস্কৃত মন্ত্র পড়তে পড়তে। তারপর এক পাঁজা প্যাঁকাঠিতে আগুন ধরিয়ে গোল হয়ে প্রদক্ষিণ করবে। শেষে মাথায় ঠেকিয়েই গুঁজে দেবে হাঁটুর তলায়। বিশুদ্ধ সংস্কৃতে বলবে, জানা অজানা অনেক দুষ্কর কর্মের নায়ক তুমি। তোমার সর্বাঙ্গে আগুন দিলাম; পুড়ে ছাই হও। আর পারো তো চলে যাও দিব্যলোকে। ব্যস, মিটে গেল ঝামেলা। তারপর, বাস চলছে, পরচর্চা-পরনিন্দা হচ্ছে, মাংস কষা হচ্ছে, চিনের। দোকানে ফ্রায়েড রাইস উড়ছে। কোথায় কী! এ তো আর গয়না রাখার ভেলভেট বাক্স নয়, যে লকেটটি তুলে নিলেও খোপটি থেকে যাবে চিরকাল। জীবনের বাক্সে ফুটকড়াই গড়াচ্ছে। কে গেল আর কে রইল। গড়াগড়ির শেষ নেই।

প্যান্ডেলের ঘেরাটোপের একপাশে গনগনে আগুনে ভিয়েন হচ্ছে। বিশাল কড়ায় চিনির রস। মিঠে গন্ধ বেরোচ্ছে। শৈশবের সুখের দিনের গন্ধ। বেঁচে থাকার গন্ধ। টুকটুকে লাল, অভাবনীয় অজস্র পান্তুয়া হাবুডুবু খাচ্ছে। হেড হালুইকর বিচিত্র বললে, একটা টেস্ট করে দেখুন না বাবু!

অমল বললে, আমি কোনও কিছুই খেতে পারব না ভাই, যতদিন না নিয়মভঙ্গ হচ্ছে।

ও হ্যাঁ, তাই তো। আমি ভুলেই গিয়েছিলুম, শেষ আপনার ছেলের পইতেতে কাজ করে গিয়েছিলুম। বড়বাবু ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, দেখো বিচিত্র, তোমার আর আমার প্রেসটিজ যেন থাকে। কী মানুষ ছিলেন।

অমল বললে, আমার কাজের সময় হয়তো এইখানে এসে দাঁড়াবে আমার ছেলে!

আপনার কী কাজ বাবু?

শ্রাদ্ধ।

আপনার শ্রাদ্ধ! তার আগে আমার শ্রাদ্ধ হয়ে যাবে। ষাট পেরিয়ে গেছি। আপনার বিয়েতে বেঁধে গেছি। সে খুব বড় কাজ হয়েছিল। দশ-বারোরকম আইটেম হয়েছিল। ঠিক এই শীতকাল।

আর কথা বলার সময় নেই। বিচিত্র দরবেশ ভাজতে বসল। দূরে কুকুর ডাকছে। একটা বোমা ফাটার শব্দ হল। কেউ হারল, কেউ জিতল।

নীপা এসে হাত ধরে অমলকে নীচে নিয়ে গেল। কেউ তাকে একলা থাকতে দিচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে। এত যার শোক সে হয়তো কিছু একটা করেই ফেলবে বোকার মতো।

সিঁড়ির মুখে নির্জনে দাঁড়িয়ে নীপা বললে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছেনা! তোমার কাজ, তুমি একটু ঘুরে-ফিরে দেখবে না! দেখবে চলো, দানের জিনিস কেমন সাজানো হয়েছে। ঘর কেমন সাজানো হয়েছে। বাইরের গেটটা কেমন হল!

অমল বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে গেট কেমন হয়েছে দেখছে, হঠাৎ পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে খুটখুট করে কে যেন আসছে। প্রবীণ মানুষ। চলনে অতি মাত্রায় সতর্ক। ভদ্রলোক অমলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। অমল চিনতে পারল, শ্যামলবাবু।

কাকাবাবু এত রাতে এই ঠান্ডায়?

শ্যামলবাবু ধরা ধরা গলায় বললেন, সব ঠিক মতো হচ্ছে তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমি ওই হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানায় ওষুধ নেবার জন্যে বসেছিলুম। ফেরার পথে ভাবলুম, তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। একটা প্রশ্ন করব বাবা?

ভেতরে চলুন না।

না না, অনেক রাত হয়েছে বাবা। ছোট প্রশ্ন। তুমি তো ধাপে ধাপে একটা মৃত্যু দেখলে। শেষটা কি খুব কষ্টের?

কী করে বলি, আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না কাকাবাবু।

শেষটা কীভাবে হল?

স্বর সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বলে আগের দিন থেকে অক্সিজেন চলছিল।

সব চিনতে পারছিলেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, পরিপূর্ণ জ্ঞান ছিল। কাশির সঙ্গে রক্ত আসছিল বলে, সাকশান মেশিন দিয়ে সাফ করে নেওয়া হচ্ছিল থেকে থেকে। মাঝে মাঝে টিউবটা দাঁতে চেপে ধরছিলেন। মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি।

তাই নাকি?

মৃত্যুর সঙ্গে খেলাই বলা চলে। আধশোয়া হয়েছিলেন। হঠাৎ সাড়ে নটার সময় উঠে বসলেন। পরিষ্কার ঝরঝরে গলায় প্রশ্ন করলেন, কটা বাজল, কী বার, কী তিথি? আমরা ক্যালেন্ডার দেখে বললুম। এদিক-ওদিক তাকালেন। সকলকে দেখে নিলেন একবার ভালো করে। তারপর বললেন, নাঃ, আর ভালো লাগছে না, এইবার চলে যাই। ঠিক মিনিট পনেরো কুড়ি পরে একবার কাশলেন। প্রচুর রক্ত। ঠাকুরের ছবির দিকে দুহাত তুলে বললেন, মা নাও। সঙ্গে সঙ্গে কাশি। ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লেন। তিনবার হেঁচকি। সব শেষ।

বাঃ-বাঃ, এত সহজ। না আতঙ্ক, না কান্না, না চোখের জল। নৌকোর দড়ির তিনটি গেঁট খুলে গেল। বাঃ চমৎকার। শেষ কথা তাহলে কী?

ওই যে অঞ্জলি, মা নাও।

আহা, যার জীবন তাকেই উৎসর্গ। লহোলহ। আচ্ছা, আমি আসি বাবা।

শ্যামলবাবু টুকটুক করে চলে গেলেন। সেই দিনের মানুষ নন, রাতে একেবারে অন্যরকম। সামান্য সামনে ঝুঁকে চলেছেন। আপনমনে। দিন শেষের বলদের মতো।

মাঝ রাতে অমলের ঘুম ভেঙে গেল। পাশেই কে যেন ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে। নিস্তব্ধ বাড়ি। শূন্য ঘর। মেঝেতে কম্বলের বিছানা। শুয়েছিল সে আর নীপা। ঘরে নীল আলো। শোবার আগে ধূপ জ্বেলেছিল। গন্ধে ভরাট। পাশেই ফুলে সাজানো খাট। তার ওপর একটি পূর্ণ আকৃতির ছবি। বসে আছেন তিনি, যিনি আর নেই। মুখে অদ্ভুত হাসি। অদ্ভুত দুটি বৈরাগী চোখ। নীপা ছবির দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কখন উঠে পড়েছে। আপন মনে কেঁদে চলেছে। গঙ্গাধারার চেয়ে পবিত্র। অমল হাত রাখল পিঠে। প্রশ্ন নেই।

কী বলেছিলেন তিনি?

বলেছিলেন, আর কয়েকটা বছর সময় পেলে, তোমাকে ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ পার করে দিতুম। বলেছিলেন, সোমার বিয়েটা নিজে হাতে দেখে-শুনে দিতুম।

আর বলেছিলেন, তোমাদের মনের ভেলভেট খোপে মুক্তোর দানার মতো একটু সুখ রেখো। ভালোবাসার নামই সুখ। নীল আলোর সমুদ্রে ফুলে ঢাকা জীবননৌকো ভাসছে। পারে বসে দুই যাত্রী। একজন স্বামী, একজন স্ত্রী। পুত্র আর পুত্রবধূ।

যাই ওঘর থেকে মায়ের ছবিটা এনে পাশে বসিয়ে দিই। বড় একলা পড়ে গেছেন। তাই না! নীপা উঠে গেল পাশ থেকে। কম্বলের বিছানায় অমল একা। সামনে ছবির চোখে উদাস হাসি। স্পষ্ট শুনতে পেল, তিনি যেন বলছেন, জীবনের শেষ পরিণতি, ওঁ আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুভূত নিরাশ্রয়। জেগে থাকো, জেগে থাকো, একা জাগো। তোমাকে এই আমার শেষ কথা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *