মর্তুকাম

মর্তুকাম

দীপ্তটা মারা গেল। আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু দীপ্ত, আজকাল যাকে বলছে ভালো বন্ধু। কোনো অসুখে-বিসুখে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এমনকি দুর্ঘটনাও নয়। মার্ডার। কোনো মৃত্যুরই কোনো সান্ত্বনা নেই। কিন্তু মাত্র বছর দুয়েক আগেই দীপ্তর ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল। এমনও হয়েছে ছ-সাত রাত ওর জন্যে। নীলরতনে ঠায় বসে আছি। মশার কামড় খাচ্ছি আর চমকে চমকে উঠছি। এই বুঝি কোনো খারাপ খবর এল…এই বুঝি…। এক এক সময় এমন হয় না? বাড়িসুষ্ঠু আপনজন বন্ধুবান্ধব ভেতরে ভেতরে কাঁটা হতে হতে মড়াকান্না কাঁদতে তৈরি হয়ে যায়? তখন যদি দীপ্তটা সত্যি-সত্যি মারা যেত বোধহয় তৈরি ছিলাম। বলেই মেনে নিতাম। বুকের ভেতরটা কিছুদিন হা-হা করত, চায়ের দোকান, ধাবা, মাঠ-ময়দান যেসব জায়গায় দুজনে কত ঘুরেছি সেখানে স্মৃতি হাঁ করে থাকত। ওর বাড়িতে থেকে থেকে খোঁজখবর নিতাম, মাসিমা কেমন আছেন? কোনো দরকার হলে নিশ্চয়ই বলবেন…ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দীপ্ত দিব্যি ফিরে এল। সেই হালকা-পলকা দীপ্ত, কথার কথায় হঠাৎ চুপ করে যাওয়া, নীচু গলায় খিস্তি।

দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াও ওর অসম্ভব ছিল না। কেননা শ্যামবাজার শ্রীরামপুর বাসে ও বালি থেকে উঠত, একদিন জি, টি, রোডে সেটা একটা লজঝড়ে বাসের সঙ্গে লেগে যায়। ঘ্যাচাং। ডান সাইডে যারা ছিল তাদের মধ্যে দু-তিনজন স্পট ডেড, বেশ কয়েকজন মারাত্মক জখম। দীপ্তও বসেছিল ডান দিকেই, শেষ সিটে। তেমন কিছুই হয়নি। একটু ফার্স্ট এড দিয়ে ছেড়ে দিল। সবাই বলল, লগনচাঁদা ছেলে, মঙ্গল খুব স্ট্রং, তা নয়তো আগে জখম, পাশে জখম, ওইভাবে বেঁচে যায়। ভাবাই যায় না।

আজকাল লোকে বাসে-মিনিবাসে ওঠে প্রাণ হাতে করেই। ভালো করে চালাতে শিখেই লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে সব, হাত দরস্ত হতে না-হতেই বাস-ট্রাকের স্টিয়ারিং ধরছে। তা তখন যদি মারা যেত, বিরাট একটা কান্নাকাটি, দৌড়োদৌড়ি, বুক চাপড়ে ভাগ্যকে অভিসম্পাত, মর্গ…এইভাবে শেষ হয়ে যেত ব্যাপারটা। বাস কোম্পানি থেকে ফ্যামিলিকে ক্ষতিপূরণ দিত কিংবা দিত না। ফ্যাক্টরিতে ওর বোনকে একটা চাকরি পাওয়াবার জন্যে তদবির করতাম। মেয়েটা সবে সাবালক হয়েছে, কোনো ট্রেনিং নেই বলে ওরা গাঁইগুঁই করত। আমরা লড়ে যেতাম। কিন্তু মঙ্গল স্ট্রং। বেঁচে গেল। সবাই বলল, ছেলেটা দীর্ঘায়ু হবে। আমার মনে আছে, দীপ্ত বলেছিল, দীর্ঘায়ু না দ্রিঘাংচু? মাঝেমাঝেই মাসিমাকে বলত, অত হাঁকপাঁক করো কেন বলো তো? দেখলে, তো শালা ম্যালিগন্যান্ট আমার কি করতে পারল না। অ্যাকসিডেন্ট? সিনে নেই। কী রে জয়, কী বুঝছিস গুরু?

মুখে কিছু আটকায় না? মাসিমা রাগ করে বলতেন, ওভাবে বলতে নেই। গ্রহ কূপিত হন।

মাসিমার সামনে এই। আমাদের সামনে আবার দীপ্ত অন্য মানুষ। তখন বলত, কী করা যায় রে জয়, কিছু বল?

কীসের কী?

দেখছিস তো চারদিকে কী অবস্থা! একেবারে নো-হোয়্যার হয়ে আছি। এক মুহূর্ত ভাল্লাগছে না। শালারা বাবাটাকে ফুটিয়ে দিলে। মাথার ওপরে কেউ থাকার সোয়াস্তি কী জীবনে জানলাম না। মুখ শুকনো বিধবা মা, বোনটা কালো, কত দূর পড়াতে পারব, পারলেও কোনো হিল্লে হবে কি না…তুই কিছু ভাবিস? তোর অবশ্য বাপ আছে।

তেমনি দুটো বোন, একটা ভাই এখনও স্কুলে। তবে কী জানিস, আমরা যা হোক করে চালিয়ে নিচ্ছি। চারপাশে লোক দ্যাখ-ধুকছে। তাদের তুলনায়…

একটুকুই আমাদের সান্ত্বনা। ধরুন চৌরঙ্গি এলাকায় সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। জ্যাম জমাট একেবারে। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। সড়সড় সড়সড় করে কিছু ভিখিরি এঁকেবেঁকে গাড়িগুলোর মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। কার কোলে রিকেটি ছেলে, কার একটা হাত কাঠের মতো, কার গাল এমন ভাঙা, চোখ এমন গর্তে ঢোকা যে মনে হয় এই বুঝি শ্মশান থেকে উঠে এল। বাচ্চা ছেলে, করুণ মুখে পয়সা চাইছে, একটা গাড়ির কাচ নেমে গেল, কোনো মহিলা কিছু দিলেন। গাড়ি চলে যেতেই ছেলেটা ষাট-বছুরে বুড়োর মতো মুখ করে ভ্যাঙালে, ভিক্ষে পছন্দ হয়নি।

এই দৃশ্যগুলো আমরা লোলুপ চোখে দেখতাম, ঠিক যেমনভাবে কাঙালরা সুখাদ্য দেখে—শিককাবাব, গলদা চিংড়ির কালিয়া, মটন দো পিঁয়াজা। দীপ্ত বিড়বিড় করত—ঠিকই, এর চেয়ে বোধহয় ভালো। আমি বিড়বিড় করতাম— আমাদের চেয়েও খারাপ।

দীপ্ত বলত, টপ করে লাল আলোটা সবুজ হয়ে গেলে আর সব গাড়িগুলো এক সঙ্গে ছেড়ে দিলে, এইসব ভিখিরিগুলো তো পিষে যাবে রে জয়!

আমি বলতাম, রাস্তা ভরতি ধর থকথকে রক্ত…

রাস্তা ভরতি ধর থ্যাঁতলানো মড়া…

কেউ কি বাঁচবে?

অসম্ভব। কেউ না।

আর গাড়িগুলো?

কয়েকটা পড়িমরি করে পালিয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু বাকিগুলোতে জনগণ নির্ঘাত আগুন ধরিয়ে দেবে। টেনে নামাবে ড্রাইভারগুলোকে। মার মার বেদম মার।

পুলিশ আসার আগেই ফুটে যাবে।…হাসতাম আমি।

শুধু ড্রাইভার? মালিকগুলো!

ঘাবড়াচ্ছিস? বেশির ভাগই নিজেরা ড্রাইভ করে। আর পেছনে হেলান দেনেওয়ালারা? পার পাওয়া অত সোজা নয়! রেমন্ডের স্যুট, এক্সক্যালিবারের শার্ট, নাইকির শু…কি করতে পারবে না। গণপিটুনির পর কে বড়োসাহেব আর কে ছোটোসাহেব ধরতেই পারবি না। পেট্রোল ট্যাংকে কেউ ধর একটা বিড়ি ফেলে দিল। ব্যস সব কাঠকয়লা। ষ্টু মন্তর ঘু মন্তর ঘু মন্তর ছুঃ।

দুজনে খ্যাখ্যা করে হাসি।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ওরকম কিছু ঘটে না। ভিখিরিগুলো ম্যাজিক জানে, কিংবা ওদের বডিগুলো হাওয়া দিয়ে তৈরি। এ গাড়ির বনেট, ও গাড়ির বাম্পার, সে গাড়ির বডির পাশ দিয়ে দিয়ে ভানুমতীর খেল দেখাতে দেখাতে ঠিক বেরিয়ে আসে সব। গাড়িগুলোও এঁকেবেঁকে, কায়দা করে পাশ কাটিয়ে আবার অন্য কোনো মোড়ে সিগন্যাল খাবার জন্যে হুশ হয়ে যায়। ঠিক যেমন ম্যালিগন্যান্ট বা অ্যাকসিডেন্ট টপকে বেঁচে থাকে দীপ্ত, বেঁচে থাকি আমি।

দীপ্ত আসে শ্রীরামপুর থেকে, আমি শ্যাওড়াফুলি। নিজেদের মধ্যে আমরা বলি বিশ্রীফুলি, আর শ্যাওড়াপেতনিপুর। কারখানায় যাই, খোঁচা-দাড়ি খাড়া চুল হাজিরাবাবুর খেরোর খাতায় সই করি—দীপ্ত সমাদ্দার, রফিক আসলাম, বিহারীলাল পান্ডে, মহম্মদ বেণু, ইসমাইল খাদির শেখ…।

এক মাস মান্থলি আমার, পরের মাসে দীপ্তর। একজনই পকেট থেকে একটু বার করি, বলি, আমরা এক সঙ্গে দাদা, ডেলি।

এখন চিনে গেছে। কেউ আর ওসব দেখা টেখার ঝামেলায় যায় না। দীপ্ত বলে, পুরনো পাপী বুঝলি তো? দাগি হয়ে গেছি।

ট্রেনে কারও হাতে বাংলা কাগজ থাকলে তাক বুঝে ছোঁ মারি।–দাদা ওই মাঝের পাতাটা, পাঁচ নম্বর, পাঁচের পাতা।

বিরক্ত হয়, তো হোক, বয়ে গেল। কাগজ খুলে খুঁজে খুঁজে দেখি—জমজমাট খবরাখবর আছে কি না। যেমন ধরুন নস্কর লেনে দোতলা বাড়িতে গৃহিণীহত্যা, রক্তগঙ্গা, আলমারি খোলা, উদ্দেশ্য ডাকাতি। কিংবা বেহালা পর্ণশ্রীতে গৃহবধূর আত্মহত্যা, গলায় দড়ি। দড়ির দাগ বসেনি, জিভ ঝোলেনি, সন্দেহ—খুন। মহিলার স্বামী ও তাঁর বান্ধবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বোবা-কালা কিশোরী পুলিশব্যারাকে ধর্ষিত, ডাক্তারি পরীক্ষা হচ্ছে। অপরাধী বলে এখনও কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। নিরুদ্দিষ্ট ডাক্তারের মৃতদেহ পুকুরধারে, কাদার মধ্যে পোঁতা, আগের রাতে সহকর্মির বাড়ি নেমতন্ন ছিল। শালবনিতে ডাকিনী সন্দেহে বৃদ্ধাকে খুন। কালাহান্ডিতে অপহৃত বালকের ছিন্নমুন্ড দেহ রঘুনাথপুরে, সন্দেহ নরবলি। প্রকাশ্য রাজপথে গণধর্ষণ ও হত্যা। ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে যুবতির মৃতদেহ, সন্দেহ ধর্ষণ ও হত্যা, বালক-চাকরকে চোরের মার দিয়ে, ঘরে বন্ধ করে রেখে দম্পতি হাওয়া বদলাতে উধাও। প্রোমোটার খুনের চক্রান্তে জড়িত সন্দেহে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি ফেরার হবার চেষ্টায় ছিলেন।

দীপ্ত আমাকে কনুই দিয়ে ঠেলা মারে, কী রে জয়, খুনটুন করলেও তো বেশ আপনি আজ্ঞে পাওয়া যায় রে! খবরের কাগজওয়ালারা তো খুব খাতির করে!

যা বলেছিস। মহিলার স্বামী ও তাঁর বান্ধবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তিনি ফেরার হবার চেষ্টায় ছিলেন।…

আমাদের উল্লাস দেখে পাশের লোকে বিরক্ত হয়ে তাকায়। কাগজটা কি আপনাদের দেখা হয়ে গেছে? শুকনো গলায় বলে।

নিশ্চয়, নিশ্চয় সার। চুম্বুক মানে চুম্বকটুকু পড়ে নিয়েছি, নিন ধনিয়বাদ দাদা।

ঠিকাছে, ঠিকাছে।

সেই দীপ্তই খুন হয়ে গেল।

খবরটা কাগজেই পড়ি। লোক্যাল চায়ের দোকানে গিয়ে জম্পেশ করে একটা ডবল-হাফ আর একটা সর্ষের তেলে ভাজা ওমলেট আমার রোববারের মেনু। সঙ্গে কাগজ। কাগজটা হাতবদল হতে থাকে। এই কাগজের লোভেই যে অনেক খদ্দের তার ধরা দুধের চা খেতে আসে চা-ওয়ালা তারক তা বিলক্ষণ জানে। রোববারে কাগজে কাগজে ছয়লাপ। লোকে বলে পেপার। একখানা পেপার পেয়ে যাবার কোনো অসুবিধে নেই। প্রথম পাতার বাঁ দিকে লম্বা কলমটায় দেখি ব্যান্ডেল ল্যোকালে যুবা খুন। আবার যুবা! আমি শব্দ করে হাসি। যুবাই বটে, যুবা কি এখনও আছে না কি? এখন সব ছেলেছোকরা ছ্যামরা মদ্দ, আধবুড়ো, সিকিবুড়ো। যুববা  তা তিনি কেমন খুন হয়েছেন দেখি। যদি নতুন কিছু হয়।

লাস্ট ট্রেন সাইডিংয়ে নিয়ে যাবার সময়ে কিছু কিছু কর্মী লক্ষ করেন একটি কামরা থেকে লাল জল বেরিয়ে আসছে। বড়ই লাল, জমাট মতো, তখন কামরায় উঠে দেখা যায় এক যুবা, পরনে ছাই রঙের শার্ট এবং খাকি প্যান্ট, গলার নলি ও কবজির শির কেটে দেওয়া হয়েছে কোনো সূক্ষ্মধার অস্ত্র দিয়ে। অস্ত্রটি ঘটনাস্থলে পাওয়া গেলে এটি আত্মহত্যার কেস বলে সাবুত হত। কিন্তু অস্ত্রটি পাওয়া যায়নি। কবজি, গলা কেটে অস্ত্রটা জানলা গলিয়ে ফেলে দেবার সম্ভাবনা অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। বডি পোস্টমর্টেমে যাচ্ছে। আশ্চর্য যুবাটির পকেটে কিছুই পাওয়া যায়নি, টিকিট—দৈনিক বা মান্থলি, কোনো টাকাপয়সা বা মানিব্যাগ, হাতে ঘড়ি নেই। কোনো ভাবেই শনাক্তকরণের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। দেখে মনে হচ্ছে না, কিন্তু সে কি কোনো কারণে অনেক টাকা নিয়ে যাচ্ছিল?

চিহ্ন পাওয়া যায়নি তো ছবি দে! বিরক্ত হয়ে বলি। একটা কাজ যদি এরা সুষ্ঠুভাবে করতে পারে! যখন পচে-গলে যাবে তখন দিবি বোধহয়। আরও কতকগুলো খুন, সুইসাইড, ধর্ষণের ঘটনা পড়ি নিয়মমাফিক। তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ি চলে যাই। কেননা যাবার পথে বাজারটা করে নিয়ে যেতে হবে। বেশি সকাল সকাল গেলে মাছ আগুন, বেশি বেলা করে গেলে বেগুন। অর্থাৎ পচা-পাচকো।

দেখেশুনে গোটা দুই ফলুই মাছ কিনি। কড়া করে ভাজলে কাঁটা টের পাওয়া যায় না। রোজ রোজ মাছের তেল-কাঁটার চচ্চড়ি কিংবা তেলের বড়া খেতে খেতে মুখ পচে গেছে।

আপিসের দিনে কাক-চান, জলও থাকে না তেমন। আজ একেবারে গলির মোড়ে টিউবওয়েলের তলায় বসে পড়ি। লাল সাবান মেখে জববর চান। বাড়ি গিয়ে এখন একটু আয়েশ করব, গায়ে পাউডার ছড়িয়ে একটা ফতুয়া আর লুঙি, তেল-মাখা চুলে যত্ন করে টেরি কাটব। তারপর ফলুই মাছের কড়া করে ভাজা মাখো-মাখো ঝাল দিয়ে মুশুর ডাল আর আলুপোস্ত দিয়ে এক থালা ভাত, তারপর বাড়ির একমাত্র তক্তপোশটা দখল করে নিয়ে দিবানিদ্রা। তা সেই দিবানিদ্রারই আয়োজন করছি এমন সময়ে রুখু চুল, শুখো মুখ, লাট খাওয়া সালোয়ার-কামিজ আর হাওয়াই চপ্পল পায়ে শিপ্রা এসে হাজির।

ভাই খুলে দিয়েছিল। এসে বলল, দাদা, কে এসেছে, একজন মেয়ে, বাইরে এসে দেখে যাও!

মেয়ে? আমার কাছে? মেয়ে-টেয়ে আমার কাছে আসবার মতো তো কেউ নেই! আওয়াজ-ফাওয়াজ দিলে অনেক সময়ে মেয়েরা খুব পটে যায়। ওটা এক ধরনের খোশামোদ। ওরা জানে। আমার তোমাকে খাসা লাগছে, বুঝলে মেমসাব, তো সেই পুলকটাই এইভাবে ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে দেখাচ্ছি। এটা বোঝে বলেই রাগতে রাগতে ঠোঁটের কোণে একটু প্রশ্রয়, চলাফেরায় একটু ময়ূরী ময়ূরী ভাব ফুটে ওঠে। তো আওয়াজ-ফাওয়াজ দেওয়া তো অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি। এখন আবার রোববারের দুপুরটা মাটি করতে কোন মাধুরী এলেন!

উঠে দাঁড়িয়েছি, শিবানী, আমার বড়ো বোন, শিপ্রাকে নিয়ে ঢুকল।

আরে শিপ্রা? কী ব্যাপার? হঠাৎ? এখন?

শিপ্রা লালচে চোখ মেলে বলল, দাদা কাল বাড়ি ফেরেনি।

বাড়ি ফেরেনি? দীপ্ত? সে কী! কালকে ওর ওভারটাইম ছিল অবশ্য, তা কোনো খবরও দেয়নি?

আপনি…মানে আপারও তো ওভারটাইম…আমরা ভেবেছিলাম আপনার কাছ থেকে কোনো খবর পাব।

আমি কালকে ওভারটাইম করিনি শিপ্রা। ছুটি হতেই ডাক্তারখানা, এইসা ভিড়। মায়ের জ্বর হচ্ছিল…। দ্যাখো, আরও কিছুক্ষণ…হয়তো কোথাও আটকে গেছে। হয় এসে যাবে, নয় খবর দেবে।

কী করে খবর দেবে? পাশের বাড়ি থেকে আজকাল আর আমাদের মেসেজ দেয় না। আর আটকে কোথায় যেতে পারে! তেমন কোনো জায়গা আছে? বলুন না, তাহলে খোঁজ নিই।

কী করে আর বন্ধুর বোনকে বলি রাত্তিরে আটকে যাওয়ার একটাই জায়গা আছে আমাদের মতো আত্মীয়-বন্ধুহীন ছোকরাদের। হয়তো দীপ্তটা সেখানেই…

আমার বড্ড ভয় করছে জয়দা, আমার সঙ্গে একটু যাবেন?

ঘড়িতে দেখি দেড়টা। এখনও পর্যন্ত ফিরবে না? যে চুলোতেই যাক!

মা বড্ড কান্নাকাটি করছে, যদি একটু…যদি পুলিশে খবর দিতে হয়…

বিকেল অবধি অপেক্ষা করবে না?

কখনও এরকম হয় না জয়দা। কখনও…

এটা কিন্তু একদম শতকরা শতভাগ সত্যি। আমরা একশো ভাগ ভদ্রবাড়ির ছেলে, যেমন করেই হোক বি. এটা পাস করেছি। দীপ্তর বাবা ছিলেন লোক্যাল স্কুলের হেডমাস্টার। শুনেছি ওঁর বিরোধী গ্রুপ ওঁকে কায়দা করতে না পেরে ওঁর বিরুদ্ধে টাকা তছরুপের অভিযোগ আনে। জামিন পাবার আগে দু-দিন হাজতবাস করতে হয় ওঁকে, হাই ব্লাডপ্রেশার ছিলই, স্ট্রোক হয়, এক ঘায়েই শেষ। যখন এ ঘটনা ঘটে, দীপ্ত তখনও স্কুলে। কাজেই যেভাবে লেখাপড়ার কথা ছিল, সেটা হয়ে ওঠেনি, মা-ও খুব শোকগ্রস্ত ছিলেন বহুদিন। তাই বলে ভদ্র হোয়াইট-কলার ছাপটা যাবে কোথায়? আমার বাবা আবার সরকারি আপিসে কলম পেষেন। যতই হোক সরকারি চাকরি। একটা খাতির আছে। সন্তান সংখ্যা একটু কম রাখলে আর একটু স্বচ্ছন্দে থাকতে পারতেন। তবে আমার বোনেরা, ভাই সব—পড়াশোনা করে, বাজে সঙ্গে মেশে না, একটা নিয়ম-নীতি আছে চাল চলনের। যেমন আমরা মা-বাবাকে তুমি করে বললেও অন্যদের কাছে যখন উল্লেখ করি আপনি করে বলি। দীপ্ত বলে, আমার বাবা মারা গেছেন আমি বলি, মা ডাকছেন। খিস্তি ফিস্তি সব চৌকাঠের বাইরে রেখে বাড়ি ফিরি। বাজার করি, আত্মীয় কারও অসুখবিসুখ করলে মা খোঁজ নিতে পাঠান। মুখ মুছে ভিজে বেড়ালটির মতো যাই। বাড়ি ফেরার নির্দিষ্ট সময় আছে। বড়োদের সামনে ঝুঁকি না। কাজেই শিপ্রা বলতেই পারে, কখনও এ রকম হয় না জয়দা, কক্ষনও। এবং আমিও ওর উদবেগ চিন্তা বুঝতেই পারি।

মাকে বলে চটপট জিনসটা গলিয়ে নিই, আর সেই সময়ে হঠাৎ কেন যেন একটা কথা মনে আসে। শি-আ, ঘর থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, দীপ্ত কী পরে গিয়েছিল রে কাল?

কেন, আপনার মনে নেই?

আছে। কিন্তু রোজ রোজ নিজেদের খাড়া-বড়ি-থোড় জামাকাপড় কে-ই বা অত খেয়াল করে। তাই নিশ্চিত হবার জন্যে জিজ্ঞেস করি, বলই না।

খাকি প্যান্ট, আর ছাই-ছাই রঙের শার্ট।…

ঠিক, আমারও তাই মনে হচ্ছিল। খাকি প্যান্ট, আর ছাই রঙের শার্ট।

ভেতরটা গুড়গুড় করছে, হঠাৎ কেমন শীত করে কাঁপুনি এল। কাঁপা কাঁপা গলায় শিপ্রাকে বললাম, চল!

সেদিন সন্ধের খবরই দু-তিনটে চ্যানেলে ছবিটা দেখাল। চোখ বুজে শুয়ে আছে। দীপ্ত। গলার কাছটা জমাট রক্ত। মুখটা ইতিমধ্যেই একটু ফুলে গেছে। যেন মৃত্যুর মধ্যেই দীপ্তর স্বাস্থ্য ফিরে গেছে।

ছোট্ট সাদা-কালো টিভিতে ছবিটা দেখাতেই আঁক করে উঠলেন মাসিমা, আঁ ক দ্বিতীয়বার, তারপর একেবারে অজ্ঞান। শিপ্রা যেন পাথরের মূর্তি, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে আমি শিপ্রাকে নিয়ে লোক্যাল থানাতে ঘুরে এসেছি। ওসি, আশ্বাস দিয়েছেন—খোঁজখবর করছেন, কতকগুলো রুটিন প্রশ্ন করে নিয়েছিলেন।

কোনো পার্টি, মনে পলিটিক্যাল পার্টিতে…

স্যার, ফ্যাক্টরিতে থাকলে একটা ইউনিয়নে চাঁদা দিতেই হয়, ব্যস।

কোনো শত্রু?

আমার অত দুঃখেও হাসি পেয়ে যায়, দীপ্তর শত্রু? আমার শত্রু? তার চেয়ে যদি জিজ্ঞেস করতেন, কোনো বন্ধু আছে?—তাহলে সহজে উত্তরটা দেওয়া যেত।

শুনুন স্যার, আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের শত্রুও থাকে না মিত্রও থাকে না।

দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান খোঁচাচ্ছিলেন অফিসারটি, এমনিতেই মুখটা বিকৃত হয়েছিল, এখন একেবারে খিচিয়ে উঠলেন, যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দেবে ছোকরা।

হাসি পায়, এই তো পথে এসেছ, যুবা-টুবা তরুণ-ফরুন নয়। ছোকরা। স্রেফ ছোকরা। শিপ্রা থাকায় আমি যথেষ্ট সংযত থাকি।

রাগ করছেন কেন স্যার, আমরা বড্ড উদবিগ্ন।

উদবিগ্ন লোকেরাই এখানে আসে। খিচোতে হলে পাড়ার এম. এল. এ-কে খিচোও, কাউন্সিলরকে ঘিঁচোও। আমরা তোমাদের কাছে ভোট চাইতে যাব না, বুঝলে হে? ছ্যাঁচড়া একটা চাকরি করি। মাইনে পাই, ডিউটি করি, ডিউটি মাঝরাত্তিরে কলার ধরে টেনে আনে। বুঝলে?

বুঝেছি, স্যরি স্যার।

শিপ্রার দিকে তাকিয়ে বললেন, লভ অ্যাফেয়ার! পিরিত নাকি? ট্রায়াংগুলার?

শিপ্রা কেঁদে ফেলে। আমি বলি, ও নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির আপন বোন, বাড়ি ফেরেনি বলে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। আর কেউ তো নেই!

এমন করে বলি, যেন আমার অস্তিত্বের জবাবদিহি দিচ্ছি। তাতে লোকটি খুশি হয়।

যাই হোক, দীপ্তর মুখটা দেখব আশঙ্কা করেই টিভি-টা খুলেছিলাম। সন্দেহ ভঞ্জন হয়ে গেল। খাকি প্যান্ট আর ছেয়ে শার্ট হাজারও লোক পরতে পারে, কিন্তু এই খাকি-ছেয়ে নির্ভেজাল আমাদেরই।

জমাদারদের নগদ পাঁচশো টাকা দিয়ে লাশ ছাড়াতে হল। কী অদ্ভুত যুক্তি ওদের। জিনিসপত্তরের দাম হু হু করে বাড়ছে বাবু, দিতে বলছি ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিন।

আ রে। এটা তো তোদের পাওনা-ই নয়। জয়ন্তদা বলল, পাওনা? পাওনার কপালে ঢ্যাঁড়া।

খুশি হয়ে দ্যান সবাই। খু

শি হয়ে? ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-বন্ধু অপঘাতে মারা গেছে, খুশি হয়ে? বলছিস কী?

ওই হল। জেবন আজ আছে কাল নেই। জেবনদারদের তো পেটে খেতে হবে! চাঁদা তুলে কোনোক্রমে পাঁচশো জোগাড় হল। কিছুটা আমার পকেট থেকে। ওই গড়ের মাঠ থেকে যে কী করে এত মাল বেরোলো সে আমি জানি, আর আমার পকেট জানে।

কাজকর্ম হয়ে গেল। শিপ্রার জন্যে চেষ্টা করছি, তবে নেহাত শুকনো কারখানায় ও কী-ই বা চাকরি পেতে পারে। সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। এখনও কলেজ-টলেজ শুরুই হয়নি।

একটাই ভালো সব মন্দর মধ্যে। পুলিশ হাল ছাড়েনি। খুনিকে ওরা খুঁজে বার করবেই। আমাদেরও মধ্যে কথা হয়—শিপ্রা, আমি, শিবানী, পাড়ার শঙ্কর, জয়ন্তদা, দীপ্ত? দীপ্তকে কে মারবে? কেন মারবে? জয়ন্তদার উদ্যোগ উৎসাহ বেশি, বললে, পুলিশ করছে পুলিশের মতো। আমরা ইনভেস্টিগেশন চালাব আমাদের মতো। রাজি জয়?

রাজি।

তবে আমার এটাই আশ্চর্য লাগে, দীপ্তটা যখন জলজ্যান্ত ছিল, তখন ওর সেই জ্যান্ত শরীর-মনের খবরাখবর কেউ রাখত না। এখন, যে মুহূর্তে ছেলেটা মার্ডারের লাশ হয়ে গেল—দরদ, হাহাকার, বিস্ময়, ন্যায়বিচার পাবার লোখ সব যেন প্রতিযোগিতা করে করে বেড়ে যাচ্ছে এদের মধ্যে। লাশ ছাড়ানোর সময়ে বিশ পঁচিশ টাকা দ্যাখ না দ্যাখ বেরিয়ে এল এ-পকেটে ও-পকেট থেকে। যেন লাশটা দেখবার জন্যে সব হন্যে হয়ে আছে। ব্ল্যাকে টিকিট কাটছে। আমার মনে আছে, দগদগে হয়ে মনে আছে। এই মস্তানরা কখনও একটা চা কি সিগারেটের দাম চুকিয়ে দিয়ে, কিংবা পাঁচটা টাকা ধার দিয়েও আমাদের উপকার করেনি। বলতে কী আমাদের ছোট্ট এরিয়ায় দীপ্ত সমাদ্দার স্রেফ খুন হয়ে একটা সেলিব্রিটি হয়ে গেল। শিপ্রা, মাসিমার শোকে ফোলা মুখের ছবি বেরিয়েছে মেলাই কাগজে। কোনোটাতে কোনোটাতে আমিও এক কোণে আছি, মুখ দেখানোর কমম্পিটিশনে প্রায়ই গোহারান হেরে গেছি। পাশের বাড়ির জবা বউদি, ছায়া মাসিমা, পাড়া মস্তান মিঠুন, কয়লা, প্রতিবেশী শঙ্কর, জয়ন্তদা-সববাইকার মুখ দিব্যি ফোকাসে এসেছে। শোক থমথম ফটো সব। মহিলারা কেউ মাসিমাকে জড়িয়ে আছেন, কেউ শিপ্রাকে বুকে টেনে নিয়েছেন, ফলে শিপ্রার চুল আর হাত ছাড়া কিছুই আসেনি, এসেছে ছায়া না ফায়া-মাসিমার পুরো গোল মুখানা। ঠিক সিরিয়ালের মতো পোজ দিয়েছেন। কাঁধে শিপ্রা মুখ-লুকানো, ছায়া ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, ক্লোজ আপ।

হাসিও পায়। কান্নাও পায়। দীপ্তটা মার্ডার হবার আগে যদি জেনে যেত এত লোকে ওদের ফ্যামিলির বন্ধু, একটু নিশ্চিন্তে মার্ডার হতে পারত।

মাস তিনেক কেটে গেছে। হাঁফ ছাড়া গেছে একটু কেননা, রেল, ভারতীয় রেল স্বয়ং কী মনে করে শিপ্রা সমাদ্দারকে চাকরি দিয়েছে। মাইনে সামান্যই কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি তো! মাসিমা একটা রান্নার কাজ ধরেছেন। আর কী-ই বা একজন আটচল্লিশ-উনপঞ্চাশে গরিব বিধবা করতে পারেন। আমি একটু ক্ষীণ আপত্তি করেছিলাম। মাসিমা বললেন, তুমি বললে ভালো লাগল, কিন্তু ওঁর নামে মিথ্যে অপবাদ যখন রটল, যখন উনি দুম করে চলে গেলেন সেই অকূল পাথারে দুটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি একা। ওঁর পাওনা-গন্ডা পেতে পেতে পাঁচ বছর! তখন কী করেছি আর কী না করেছি জয়! দুঃখ-ধান্দা করেও যেমন করে তোক দিনগুলো চলে যাচ্ছিল। ছেলেমেয়ে বুকে আছে, মস্ত বড়ো বলভরসা। তা ভগবানের সইল না। কে যে এমন কাজ করল, কেন যে করল!

মাঝে অবশ্য একবার ফলো-আপ নিউজ বেরিয়েছিল পুলিশ নাকি কিছু সূত্র পেয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সেসব গোপন রাখা হচ্ছে। কিন্তু ভরসা রাখতে পারছি না। প্রতিদিন হুদো হুদো লোক মার্ডার হচ্ছে। কাগজ ছবি দিয়ে খবর দিয়ে স্টোরি করেই খালাস। মাঝেমাঝেই দেখি বেশ ভারিভুরি লোকদের হত্যারও এখনও কিনারা হয়নি, অপরাধী শনাক্ত হয়নি, তদন্ত চলছে। এবং অবধারিতভাবে তদন্তের স্বার্থে সূত্রগুলো গোপন রাখা হল।

ইদানীং মাসিমা বলতে শুরু করেছেন, ও তদন্ত হলেই বা কী! না হলেই বা কী! আমার যা যাবার তা তো গেলই। কে খুনে শাস্তি পেল কি না পেল তাতে কী-ই বা আসে যায়! ফিরে তো পাব না।

বলেন কি মাসিমা! একটা রাগ, নিদেনপক্ষে শোধ নেওয়ার প্রশ্নও তো রয়েছে।

শিপ্রা বলে, নেই জয়দা, নেই। আমাদের মতো নিরুপায় লোকের নিরাপদে বেঁচে থাকাটাই তো আশ্চর্য। ধরুন মশার ঝাঁক, মাছি, পিঁপড়ে, আরশোলা, হাজারে হাজারে জন্মাচ্ছে। একটা চাপড়, ব্যস থেতলে যাবে, কে তার তদন্ত করে বলুন! এক পিঁপড়েই কি আর এক পিঁপড়ের দিকে ফিরে তাকায়? পিঁপড়ে জীবন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে…চা খাবেন তো?

নাহ, একটু জল দিও বরং, ভেতরটা তেষ্টায় কাঠ হয়ে আছে।

মাসিমা বললেন, দুটো বাতাসাও দিস শিপ্রা।

আসল কথা রাগ, প্রতিশোধস্পৃহা এসবের জন্যে একটু জীবনীশক্তি লাগে। সেটুকুও এদের নেই। আমারই কি আছে? জ্বলে উঠতে পারছি কি? অফিস যাই, নাম সই করি, পরেই দীপ্তর নামটা কাটা রয়েছে একটা লাল কলম দিয়ে, হাজিরা খাতার পাতায় যেন মার্ডার। ফেরবার সময়ে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, ট্রেনে উঠে একটু ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেলেই মনে হয় এই কি সেই কামরা…যেখানে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছিল দীপ্ত? এই কামরাতেই কি আমার বন্ধুর রক্ত লেগে আছে! ও আগে নেমে যেত-শ্রীরামপুর, কাঁচের মুখে ফিরে তাকাত একবার—আবার কাল, জয়। আবার…।

আবার কাল দীপ্ত… আবার… আমি ফিরে জবাব দিতাম। কতটা জবাব দেবার ইচ্ছে থেকে আর কতটা শুধু অভ্যেস…বলা মুশকিল। ঝাঁকে ঝাঁকে লোক নামছে। ঝাঁকে ঝাঁকে লোক উঠছে, একভাবে, প্রতিদিন একভাবে—সেই যে দাদা…ঝাল মুড়ি, কড়াক কড়াক কড়াক ঝাল মুড়ি…ছুরি নিয়ে নিন সাত ফলা ছুরি… নখ কাটুন, পাঁউরুটি কাটুন, কোকাকোলার বোতল খুলুন চ্যাঁক করে, কাগজ ফাঁড়ুন, চিঠি খুলবেন তো দাদা… চিঠি খুলবেন না?… ইমপর্যান্ট চিঠি—চাকরির চিঠি, বাপের অসুখ, শুভবিবাহ, হোল খুলবেন দাদা, হোল, বাড়িতে ডাকাত এলে স্রেফ পেটটা ফাঁসিয়ে দিন—সাত ফলার মাল্টি পারপাস ছুরি দাদা… চা… চা… লেবু চা…, দুধ চা…, দুধ চা, লেবু চা…।

আমার ভেতরেও ইচ্ছেটা আস্তে আস্তে মরে আসছে। মাসিমার মতো বা শিপ্রার মতো করে ভাবছি। কী হবে? ফিরে তো পাব না। তবু রুটিন করে থানায় হাজিরা দিয়ে যাই। কী স্যার, হল কিছু?

ও. সি কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলেন, হলেই হল দীপ্তবাবু, স্যরি জয়বাবু?–এ যে কী ছ্যাঁচড়ার চাকরি! ডিউটি কর, বাড়ি যাও, একটু পেট আলগা করে খেতে বসেছি…বাস কল এখুনি যেতে হবে। এ-শালার চাকরি তো আর করেননি!

সেদিন ওই রকমই গেছি। ও. সি পাশের চেয়ারে বসে এক সাদা শার্ট আর কালো জিনস পরা ভদ্রলোককে বললেন, এই যে এঁর কথাই বলছিলাম স্যার। মা ছাড়ল, বোন ছাড়ল, ইনি কিন্তু লেগেই আছেন, এই দীপ্ত চম্পটি, মৃত জয় সমাদ্দারের প্রাণের বন্ধু। সরি জয় চম্পটি আর দীপ্ত সমাদ্দার।

বিবরণ শুনে আমি একটু হাসি। শুকনো, বিরস কঠিন হাসি।

আর জয়বাবু, ইনি আই, বি থেকে আসছেন। কেসটা হ্যান্ডল করছেন। কানাইলাল সামন্ত।

ভদ্রলোক ইয়াং ম্যানই বলা যেতে পারে। মেরেকেটে পঁয়ত্রিশের এদিক-ওদিক। আমাদের থেকে বড়ো হলেও তেমন কিছু নয়। মুখটা ভালোমানুষ-ভালোমানুষ।

মাফ করবেন, জয়বাবু—কেমন কাঁচুমাচু হয়ে বললেন কানাইলাল—আপনাদের মতো ঘনিষ্ঠ ক-জনের সহযোগিতা না পেলে…আই মিন…মুখ দেখাতে পারছি না ডি. আই. জি-র কাছে।

আমি অবাক হয়ে বলি, সহযোগিতা ছেড়ে, আমি তো জোঁকের মতো লেগে আছি দাদা, তা এনারা তো যে তিমিরে সে তিমিরেই। এক বছর পুরো পার হয়ে গেল।

মার্ডার জয়ন্তী—ও. সি বললেন।

ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাই। কোনো লাভ নেই। অবশ্য। যেমন অসাড় তেমন অসাড়ই থেকে যাবে এই লোকগুলো।

কানাই সামন্ত বললেন, কোথায় একটু বসা-টসা যায় বলুন তো?

ও. সি বলেন, ওই তো ওদিকের ঘরটা খুলে দিচ্ছি। জেরা ঘর। চলে যান। এখানেও বসতে পারেন, তবে এখানে নানান কিসিমের লোক তো অনবরত আসছেন, আপনাদের ব্যাঘাত হবে।

না, না। এখানে একেবারেই নয়।

আমি বললাম, এখানে ছোটোখাটো চায়ের দোকান আছে, কাছাকাছি দেখে। আমরাও বসতাম… আমি দীপ্ত…

না, না। ওখানে একেবারেই নয় জয়বাবু। আপনাকে সবাই চেনে, আমার আইডেনটিটি সম্পর্কে একটা কৌতূহল… না না, তাতে আমার অসুবিধে আছে।

দীপ্তর বাড়িতে যাবেন?

কে কে আছেন?

ওর বোন তো চাকরিতে বেরিয়ে গেছে। মা হয়তো ফিরে এসেছেন…

না, না।

সবেতেই যদি এত না-না তাহলে উনিই বলুন। আমি চুপ করে যাই। ভেবে চিন্তে উনি বললেন, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজে যাতায়াত আছে?

নাহ, এখন আর…

আইডিয়্যাল প্লেস বুঝলেন। আপনি কাল বিকেলে ধরুন সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ওখানেই চলে আসুন। অফিসের পর। কী, ঠিক আছে? আমি তিনতলাটাতে অপেক্ষা করব, ওখানে আমাকে বা আপনাকে কেউ চিনবে না।

চারটে-পাঁচটা নাগাদ ইদানীং, আমার শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। কেন জানি না। গরম প্রচণ্ড। ঘামে যেন গঙ্গাজল বয়, বড্ড ঘামছ—মদন শূর বলে, একটু নুন-চিনির শরবত খেয়ে নাও বুঝলে? শরীর থেকে নুনটা বেরিয়ে যায় তো! বিরাট গোল হাঁড়ি লাল ভিজে কাপড়ে জড়িয়ে শরবতঅলারা দাঁড়িয়ে থাকে।

আশেপাশে থাকে লেবু, চিনি, লবণ। সব মিলিয়ে বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা গা-জুড়োনো শরবত করে দেয়। খেয়ে সত্যিই একটু আরাম পাই। মদন শুর বলে, কে জানে আবার কলেরা খাচ্ছি, টাইফয়েড খাচ্ছি না হেপাটাইটিস বি খাচ্ছি।

কেন, ইনজেশন নেন না? আজকাল হেপাটাইটিস বি-র তো ভ্যাকসিন বেরিয়েছে।

তুমিও যেমন। আমি নেব ভ্যাকসিন? তুমি নিয়েছ? নাও? আমি না নিলেও কিছু হবে না। আমি হাসি—আমাদের কিছু হয় না। হবে …যতক্ষণ না খুন হচ্ছি, অনন্ত আয়ু শূরদা।

যা বলেছ, মদন শূর তার গেলাসে চুমুক দেয়।

তারপরেই মনে পড়ে যায়—আরে আজ কফি হাউজ যাবার কথা নয়?

গুচ্ছের পয়সা খরচা করে কে আবার বাসে যায়। আর একটু সময় থাকলে হেঁটে মেরে দিতাম। কিন্তু সময় নেই হাতে। হাওড়ার ট্রামগুমটি থেকে গুঁতোগুতি করে ট্রাম ধরি। রাস্তাময় থিকথিকে পিঁপড়ের মতো দলা পাকিয়ে আছে মানুষজন। কিংবা চিটেগুড়ে আটকে থাকা ভিনভিনে মাছি। কেমন ঘেন্না করে। ঘিনঘন মতন। এমন নয় যে আমি এর বাইরে, কোনো মহান বিশিষ্ট। নিজেকেও দেখতে পাই ওইসব মাছি-ভিনভিনে ঘিনঘিনে ভিড়ে। বাসে-ট্রামে একটু পা রাখার জন্যে গুতোগুতি, বাজারে আনাজ-তরকারি একটু কম পয়সায় পাবার জন্যে ঝুলোঝুলি, হাসপাতালে পেচ্ছাবখানার পাশে মেঝেতে একটু জায়গা করে দেওয়ার জন্য ওয়ার্ড মাস্টারকে ধরাধরি, আপিস-ফ্যাকটরিতে বাদুড়ঝোলা ঝুলতে ঝুলতে প্রাণ হাতে করে লেটে পৌঁছোনো, গালাগাল খাওয়া, ইউনিয়ন-সর্দারদের গা-জ্বালানি চালবাজি শুনতে শুনতে প্রাণপণ চেষ্টায় ভুরু সোজা করে রাখা…টিউবওয়েল থেকে জল আনতে ঠেলাঠেলি, রাত্রে মশারির মধ্যে চটাস-চটাস…ঘেন্না…খুব ঘেন্না…দীপ্তটা বেঁচে গেছে একরকম, মরে বেঁচে গেছে।

একটা পা ট্রামের পা-দানিতে। এইভাবেই হাওড়া ট্রামগুমটি থেকে মহাত্মা গাঁধি রোড হয়ে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছেই। মহান ইউনিভার্সিটি পাড়া, শতবার্ষিকী বিল্ডিং, মহান প্রেসিডেন্সি কলেজ, মহান হিন্দু স্কুল-হেয়ার স্কুল, সংস্কৃত কলেজ, আর মহান মহান সব দোকান, ফুটপাতে, বারান্দার রেলিং-এ, স্টল-এ। দোকানে শিক্ষার্থী, বিদ্বান। ইনটেলেকচুয়েলদের পাড়া। মাড়িয়ে চলে যাই। পাঠমন্দির, এঁরা আবার অধ্যাত্মচর্চা করে থাকেন। সমর্পণ করো, প্রশ্নহীন বিশ্বাস, ফেথ…কিছু আশা করো না, শুধু ডেকে যাও, কিছু চেয়ো না প্রে, প্রে, প্রে। কফি হাউজের সিঁড়ি দিয়ে উঠতি ইনটেলেকচুয়েলদের সঙ্গে প্রায় ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে হয়। ইনটেলেকচুয়েলও শালা একসেস হয়ে যাচ্ছে। ভাবিসনি সবাই ইনটেলেকচুয়েল হবি, যদ্দিন আসতে পারছিস এসে নে, হেসে নে, যেন পৃথিবীটা কিনে নিয়েছিস এমনি করে গলাবাজি কর। তারপর উট। আড়াই পোঁচ কাটা, বাকি গলা দিয়ে কালো রক্ত পড়ছে, পড়ছে, পড়ছে।

এই যে ভাই এদিকে।–খুব নিচু গলা কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলুম। কানাইলাল সামন্ত। লোকটাকে এমন সাধারণেরও সাধারণ দেখতে যে কালই দেখেছি, আজই ভুলে মেরে দিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মনে হচ্ছিল— লোকটাকে খুঁজে বার করব কী করে? চিনিই তো না। তা সে সমস্যাটা রইল না। কানাইলালই আমাকে খুঁজে নিয়েছে।

গুছিয়ে বসি।

একটু লেট হয়ে গেল,–রুমালে ঘাম মুছতে মুছতে কৈফিয়ত দিই-বড্ড ভিড়।

আমি বুঝতে পেরেছি জয়বাবু, টাইমিংটা…আমি দুঃখিত। এত ট্রাবল। খিদে পেয়েছে তো খুব?

ও তেমন কিছু না…।

আমি অলরেডি চিকেন স্যান্ডউইচ, চিজ-ওমলেট, আর পেঁয়াজ-পকোড়া অর্ডার দিয়েছি। আর কিছু?

আমি হেসে বলি, ইনাফ। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সাব এটা বলেন—ইনাফ।

খাবার আসে। লোকটি দুটো আলাদা প্লেটে খাবার সাজায়। আমার দিকে একটা এগিয়ে দেয়—এই যে ভাই-বেয়ারাকে ডাকে—পকোড়াটা কফির সঙ্গে দিও।

ঠিক আছে স্যার।

নিন শুরু করুন। নিজে একটা কাঁটা দিয়ে ওমলেট কেটে মুখে পোরে কানাই সামন্ত। আমি একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিই, একটু জল খেয়ে নিই। ভীষণ তেষ্টা। তেষ্টাটাই এতক্ষণ জ্বালাচ্ছিল প্রচণ্ড।

বেশ কিছুক্ষণ দু-জনেই নিজের নিজের খিদে মেটাতে থাকি। কানাইলাল একবার বোকা লাজুক চোখে আমার দিকে চেয়ে বলে, কিছু মনে করবেন না জয়বাবু, বড্ড খিদে পেয়েছিল।

ঠিকাছে। ঠিকাছে—আমি ওঁকে নিশ্চিন্ত করি।

আমি আসলে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি। গ্রোপিং ইন দা ডার্ক, বুঝলেন? নিহত মানুষটির চারপাশটা কেমন ছিল, কাদের সঙ্গে মিশত সেইসব…

আমি চেয়ে থাকি।

দেখুন সম্ভাবনা নাম্বার ওয়ান, আপিসে কারও সঙ্গে গণ্ডগোল। ছোটোখাটো হলেও বলবেন কিন্তু স্যার। তুচ্ছ বলে গোপন করে যাবেন না, কোনো ছোটোখাটো কাজিয়া? তুচ্ছ কারণে লোকে আজকাল খুনোখুনি করছে।

দেখুন, আমি ওমলেট ছিঁড়ে মুখে দিই, সেই যে বলে না তৃণাদপি তৃণ! আমরা সেই রকমই। তুচ্ছ একেবারে। একটা চাকরি পেয়েছি, সেটাই আমাদের যথেষ্ট। না পেলে, না পেতেই পারতাম, জানি না কী করতাম, হাত পেতে ভিক্ষে নিতেও পারতাম না, আবার গুন্ডা-হুলিগান হয়ে বোমাবাজি…তা-ও আমাদের দ্বারায় হত না।

আপনি আমরা-আমরা করছেন কেন? দীপ্তবাবুর তো আলাদা সার্কল, আলাদা মন থেকে থাকতে পারে। ধরুন কোনো ড্রাগ-পাচারকারীর শাগরেদ হয়ে গেছেন পাকেচক্রে।

এটা কিন্তু আমি একটু ভাবি, তারপর বলি, আপনি বললেন, তাই ভাবলাম, ভেবে দেখলাম খুব হচ্ছে।

নাহ। ছোটোবেলা থেকে বন্ধু, ইস্কুলে, কলেজে, দুজনেই পি ডিভিশন। দুজনের এক চাকরি, ঝগড়া-কাজিয়া এড়িয়ে চলতাম, বোথ অভ আস। এ নিয়ে আমাদের অনেক কথাও হয়েছে। ও আমার সঙ্গে একমত ছিল। উই ক্যানট অ্যাফোর্ড টু প্রোটেস্ট, টু কোয়ার্ল। উই ক্যানট অ্যাফোর্ড টু পাচার ড্রাগ।

ইউনিয়নের দিক থেকে কোনো প্রেশার?

আমার এবার হাসি পেয়ে যায়। তেতো হাসি।

আরে দাদা, ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের কী? ইউনিয়ন প্রেশার দেবে আমাদের মতো চুনোপুটিকে? আমরা প্রেশারের মধ্যেই বাস করতাম। বুঝলেন? জলে মাছ যেমন জলের প্রেশারে বাস করে!

আপনি জয়বাবু ভারি চমৎকার কথা বলেন। এত সুন্দর কথা বলতে আমি অনেকদিন কাউকে শুনিনি। অথচ…অথচ…

অথচ কী? আমার কিছু হল না?—আমি হো হো করে হাসি। দেখুন কানাইদা, আপনার কতটুকু অভিজ্ঞতা আমি জানি না, ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন—কিন্তু একটু লাগসই কথা বলার ক্ষমতা, লাগসই কাজ করার ক্ষমতা হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোকের আছে। তো কী?।

খুব অপ্রস্তুত হয়ে যায় ভদ্রলোকের মুখ।

ঠিক। ঠিকই বলেছেন জয়বাবু। একটা লাক-ফ্যাক্টর থেকে যায় না। না থাকলে…ক্যাঁচাল ভালো লাগে না সন্ধের ঝোঁকে। পাখাটা ওপরে বাঁই বাঁই করে ঘুরছে কিন্তু গরমে গ্যাদগেদে হয়ে যাচ্ছি।

বললাম, কী যেন বলছিলেন সম্ভাবনা নাম্বার ওয়ান…

হ্যাঁ হ্যাঁ, সরি। সম্ভাবনা নাম্বার টু—লাভ—মানে লভ-অ্যাফেয়ার। ধরুন কারও সঙ্গে লভ হয়েছে, কিন্তু তার একটি আগের লাভার আছে, ধরুন স্বামীই। এই এক্সট্রা ম্যারিটাল বা দাম্পত্য-বহিভূর্ত প্রেম বলুন, প্রেম, সম্পর্ক বলুন, সম্পর্ক…এটা এখন রাজনৈতিক খুনের পরেই প্রায়রিটি পাচ্ছে মোটিভে…বুঝলেন? স্ট্যাটিসটিক্স বলছে।

এতক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনছিলাম, এবার ঠান্ডা গলায় বলি, আপনার বন্ধু ও.সি বাবুও এই সন্দেহটির কথা বলছিলেন। যটুকু জানি বলছি সামন্তবাবু, সরি, মি. সামন্ত।

আরে না না, সামন্তবাবু ইজ অল রাইট। মিস্টার-টিস্টার নয়। বলুন, বলুন, কী বলবেন!

যদি বলি হ্যাঁ। বাস-স্ট্যান্ডের পাশে দোতলা বাড়িটার আড়তদার বরটার রসবতী বউটার সঙ্গে দীপ্তর আশনাই ছিল…বিশ্বাস করবেন?

কোন বাড়ি? কোন আড়তদার? কোন বউ? যদি কাইন্ডলি একটু ডিটেল বলেন।

কোন বাড়ি, কোন আড়তদার, কোন বউ জানি না। ওরকম হরদম আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আপনি যেমন সম্ভাবনার কথা বলছিলেন আমিও তাই বলছিলুম। কিন্তু আপনিই বলুন, এই আমার দিকে তাকিয়ে বলুন—গালে ব্রণর গর্ত, চোখে মাছ, বুকে পায়রা, গলায় বেড়াল আর পকেটে বিরাজ করছেন সাক্ষাৎ মা ভবানী। আপনার গোয়েন্দা মনটা কী বলে? এরকম ফেকলু পার্টি দিয়ে এক্সট্রা-দাম্পত্য হয়?

খুব লজ্জা পেয়ে সামন্ত বিড়বিড় করে বলতে লাগল, বড্ড বিনয়ী আপনি জয়বাবু। বড্ড বিনয়ী! ওসব ফেক টেকলু…নাঃ-দ্যাট ইজ টু মাচ। আফটার অল ইয়াং ম্যান! কারা এক্সট্রা-দাম্পত্য করে তাদের দেখেছেন? কেউই ময়ুরছাড়া কার্তিকটি নয়। কেউই একেবারে তাগড়াই ভীম পালোয়ান বীরসিংগিও নয়।

বেশ তো, তাহলে এই থিয়োরিটাই বসের কাছে পেশ করুন। উনি পিঠ চাপড়ে দেবেন।

আপনি জানেন না জয়বাবু, এভাবে কেস হাজির করলে… আমার চাকরিটা চলে যাবে। যতক্ষণ না আড়তদার বা রসবতী…কোনো সাবুত হাজির করতে না পারি…আমার নিস্তার নেই।

তাহলে আপনি খুঁজতে থাকুন। আমি উঠি।

আর একটু টাইম যদি দয়া করে দেন জয়বাবু, নইলে আবার একদিন বসতে হবে। কোথায় বাড়ি গিয়ে মাথায় দু-ঘটি জল ঢালবেন, তা না একটা টিকটিকির টিকটিকুনি শোনা।—খুব চিকচিকে চোখে চেয়ে মন্তব্যটি করে সামন্ত, ওর ধারণা একটা দারুণ মজার কথা বলেছে।

আমার যে সত্যিই বাড়ি গিয়ে মাথায় জল ঢালতে ইচ্ছে করছে সেটা ব্যাটা বুঝতে পেরেছে ঠিক।

বলল, ধরুন এ-ও তো হতে পারে জয়বাবু, দীপ্তবাবুর যে বোনটি আছে কোনো মস্তান তার পেছনে লেগেছে, দীপ্তবাবু তাকে ঠান্ডা করে দেবেন বলে শাসিয়েছেন…

আমি এবার হেসে ফেলি, শুনুন সামন্তবাবু এই মস্তান-টস্তানরা একটু রক্তমাংস চায় বুঝলেন? দীপ্তর বোন শিপ্রাকে একবার দেখে আসুন। তারপর এ বিষয়ে কথা হবে। দ্বিতীয় অধিবেশন।

প্লিজ প্লিজ দীপ্তবাবু, স্যরি জয়বাবু আর একটু। তাহলে কি আপনি বলছেন সেদিন দীপ্তবাবুর পকেটে বাই চানস অনেকগুলো টাকা ছিল? ট্রেন ডাকাতি?

শুনুন দাদা, পকেটে একটা মান্থলি আর দু-পাঁচ টাকা ছাড়া আমাদের পকেটে আর কিছু থাকত না। হাতঘড়িটা ডিজিটাল, ফুটপাত থেকে উনপঞ্চাশ টাকার কেনা।

সে ক্ষেত্রে এ-ও তো হতে পারে, দীপ্তবাবু ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে নিজেকে অযুগ্যি ভাবতে ভাবতে, একঘেয়েমির শিকার হতে হতে আত্মবিনাশ…মানে জিঘাংসা একটা—নিজেরই ওপর…?

এইবারে আমি বসে পড়ি। এতক্ষণ পাতি বকবকামির পর এটা তো লোকটা খারাপ বলেনি। সত্যিই তো! নিজেকে ঘেন্না করতে করতে, অযুগ্যি ভাবতে ভাবতে, আরও তিরিশ চল্লিশ কি পঞ্চাশ বছর এইভাবে বেঁচে থাকতে হলে…এ কথা মনে করে…এ তো আমারও কথা। আমারও। সামন্তর মতো একটা পাতি টিকটিকির মাথায় এটা আসতে পারে ভাবিনি তো!

কী হল?–সামন্ত ঝুঁকে বসেছে, চুপ করে রইলেন যে?

এটা ভাবা যেতে পারে—আমি অন্যমনস্কভাবে বলি

এটাই ভাবতাম জয়বাবু… যদি না দীপ্তবাবুর ভিসেরায় একটু স্ট্রং বার্বিচ্যুরেটের সন্ধান পাওয়া যেত। নিজেকে ঘুম পাড়িয়ে কি ব্লেড দিয়ে নিজের গলার নলি কাটা যায়? সেইজন্যে সব দিক ভেবে-চিন্তে আমরা এক দ্বিতীয় ব্যক্তির খোঁজ করছি, সে ঠিক দীপ্তবাবুর মতো, যার পরিস্থিতি ঠিক দীপ্তবাবুর মতো, দীপ্তবাবুর মতোই যার আত্মবিনাশ করতে প্রবল ইচ্ছে হয়, কিন্তু যে…আসলে আপনি নিজেকে মারতে চেয়েই দীপ্তবাবুকে মেরেছেন, তাই না জয়বাবু?

এগজ্যাক্টলি—আমি ক্লান্ত গলায় বলি এবং হা-ক্লান্ত চোখে কানাইলাল সামন্তর মুখের দিকে তাকাই। তাকিয়ে থাকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *