২০. রূপমতীদের কিস্সা

সব-কহাঁ লাল্‌হ ও গুল-মেঁ নুমায়াঁ হো গয়ীঁ,
খাক-মেঁ কেয়া সূরতেঁ হোগী কেহ্ পিনহাঁ হো গয়ীঁ।।
(না, সব নয়, অতি অল্পই রূপ নিয়েছে লাল ও গোলাপের রূপে;
কী রূপসীই ছিলেন যাঁরা এই মাটির তলায় চাপা পড়ে আছেন।)

ভাইজানেরা, উঠে বসুন, এবার সেই রূপমতীদের কিস্সা আমি আপনাদের শোনাব, হীরামান্ডি, ফরাস রোড, জি বি রোডের কোঠিতে যাদের রূপযৌবন পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে গেছে। বোম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কত সুন্দরী নায়িকা আমি দেখেছি, তারা কেউ আমার দেলকিতাবে একটু দাগ রাখতে পারেনি; আর পটের বিবি সাজা ঘরের বউদের তো সহ্য করতেই পারতাম না, সব একরকম, মুখে সবসময় প্রেমের বুলি, ভেতরটা একেবারে ফাঁপা, সেখানে শুধু সোনা গয়না টাকাপয়সার হিসেব। আরে বাবা, প্রেম করার জন্য পাগলামি লাগে, হিসেব কষে প্রেম হয় না। কোঠির মেয়েরা, বিশ্বাস করুন, ওরা জানে, ইঙ্ক কাকে বলে। কেন জানেন? শরীর বেচে খাবার জোগাড় করতে হয় তো, তাই বুঝতে পারে, কোন্টা প্রেম আর কোন্টা নৌটঙ্কিবাজি। ওদের দেখতে দেখতেই আমি বুঝেছিলাম, মেয়েদের ভেতরে কীভাবে জন্নত লুকিয়ে থাকে; সংসার-সমাজ পর্দার ঘেরাটোপে এই মেয়েরাই ছারপোকার মতো হয়ে যায়। ভাববেন না, আমি ওদের খুব মহৎ বলতে চাইছি, মহত্ত্ব বলে কিছু নেই, ভাইজানেরা, আছে শুধু জীবনের টুকরো টুকরো সত্য, তাও একজনের সত্য অন্যের জীবনে কাজে আসে না, এটুকু মেনে নিতে পারলে আমাদের জীবন অনেক সহজ হত। ওরা সহজ হতে পেরেছিল। কেন জানেন? ওরা ভান। করেনি; ওরা যা, সেভাবেই নিজেকে দেখাতে চেয়েছে।

একটা কিস্সা বলি শুনুন। শোনার পর আমি বেশ কয়েকদিন বাল করে খেতে পারিনি। যেন কোনও সুড়ঙ্গে সরীসৃপদের সঙ্গে রয়েছি, মনে হয়েছিল। একদিন একটা লোক সন্ধেবেলা ক্যায়সার পার্কের বাইরের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। না, না, আমি নই, সব কিছুর সঙ্গে আমাকে মেলাতে যাবেন না। লোকটার নাম? ভুলে গেছি, তবে একটা নাম থাকলে সুবিধে হয়, তাই না? আচ্ছা, লোকটার নাম দেওয়া যাক সাজ্জাদ। তো সাজ্জাদ ওখানে অপেক্ষা করছিল এক বন্ধুর জন্য, আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিল, বন্ধু আসার সময় অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে। বন্ধুকে মনে মনে খিস্তি করতে করতে সে ভাবছিল, সামনের হোটেলে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নেওয়া যাক। তখন কেউ যেন তাঁকে ডাকল, সাব-সাব-।

সাজ্জাদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একটা দড়িপাকানো চেহারার লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার পরনে অনেকদিন না -কাচা, তেলচিটে দাগ ধরা পাজামা আর শার্ট। সাজ্জাদ বলল, আমাকে ডাকছিলে?

-জি।

-কী চাই?

-কিছু না হুজুর। বলতে বলতে লোকটা তার দিকে এগিয়ে এল, সেই সঙ্গে বোটকা গন্ধ, সাজ্জাদের বমি পেয়ে গেল। -আপনার কিছু লাগবে জনাব?

-কী?

-জেনানা, হুজুর।

সাজ্জাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কোথায় তোমার জেনানা?

বুঝতেই পারছেন, সাজ্জাদের তখন মেয়েছেলের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু সে নানা অঘটনের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে ভালবাসত। জীবনে তার একটাই রোগ ছিল, নতুন কিছু দেখে নাও, যে-পথ চেনো না, সেই পথেই পা বাড়াও।

-কাছেই হুজুর। ওই তো-রাস্তার ওপারে বাড়িটা দেখছেন -অত বড় বাড়িতে?

-জি হুজুর। লোকটা ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসল।আমি এগোচ্ছি। আপনি আমার পেছন পেছন আসুন।

সাজ্জাদ দালাল কে অনুসরণ করে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাড়ি না বলে খণ্ডহর বলাই ভালো। প্লাস্টার খসে গেছে, ইটের খাঁচা বেরিয়ে আছে, এখানে-ওখানে জংধরা লোহার পাইপ, আবর্জনা। বাড়ির ভেতরটা একেবারে অন্ধকার। দালালের পেছন পেছন সে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। কিছুটা ওঠার পর দালাল তার দিকে ফিরে বলল, সাব একটু দাঁড়ান। আমি এক মিনিটের মধ্যে আসছি।

সাজ্জাদ অপেক্ষা করতে লাগল। এদিকে দালালের দেখা নেই। সে মুখ তুলে দেখল, কিছুটা ওপরে আলো জ্বলছে। সাজ্জাদ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করল। আলোর কাছাকাছি পৌঁছে সে দালালের গলা শুনতে পেল, শালি, উঠবি, কি উঠবি না?

একটা মেয়ের গলা শোনা গেল।-বললাম তো না, আমাকে ঘুমোতে দাও।

-বলছি ওঠ, কথা না শুনলে কিন্তু—

-কী করবে? মেরে ফ্যালো। আমি উঠতে পারব না। আমাকে এবারের মত ছেড়ে দাও।

-ওঠ…উঠো মেরি জান। জেদ করিস না, এমন জেদ করলে, আমরা খাব কী বল তো?

-আমার খাবারের দরকার নেই। না খেয়ে মরে যাব। একটু ঘুমোতে দাও আমাকে।

-তুই তা হলে উঠবি না, কুত্তি?

-বলছি তো-না-না-না

-আস্তে কথা বল। কেউ শুনতে পাবে। শোন্,উঠে পড়। কতক্ষণ বা লাগবে? তিরিশ-চল্লিশ টাকা পেয়ে যাবি। মেয়েটা এবার কেঁদে ফেলে।

-তোমার পায়ে পড়ছি। কত দিন ঘুমোতে পারি না, আজকের দিনটা আমাকে একটু ঘুমোতে দাও।

-চোপ্। কতক্ষণ লাগবে বড়জোর ঘন্টাদুয়েক। তারপর এসে যত পারিস ঘুমাবি।

এরপর সব চুপচাপ। যে-ঘর থেকে কথা ভেসে আসছিল, সাজ্জাদ পা টিপে টিপে সেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেজানো দরজায় সামান্য ফাঁকে সে চোখ রাখল। ছোট্ট ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে একটা মেয়ে। কয়েকটা বাসনপত্র ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই। দালাল লোকটা। মেয়েটার পাশে বসে তার পা টিপে দিচ্ছে। হাসতে হাসতে দালাল বলল, উঠে পড়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে তো ফিরে আসবি। তারপর যত পারিস ঘুমোস। আমি আর জ্বালাব না, মেরি জান।

-মেরি জান? মেয়েটা হেসে উঠল।-শালা কুত্তা কাঁহি কা। বলেই এক ঝটকায় উঠে বসল।

সাজ্জাদ পা টিপে টিপে নীচে নেমে এল। তার ইচ্ছে করছিল, এই শহর, এই দুনিয়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে? কেনই বা যাবে? কে এই মেয়ে? কেন মেয়েটার ওপর এমন নিষ্ঠুরতা? দালালের সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক কী যে, ইচ্ছে না হলেও তার কথা মেনে নিতে হল? ঘরে উঁকি দিয়ে সে দেখেছে, ওইটুকু ছোট ঘরে কী তীব্র আলো। একশো ওয়াট তো। হবেই। অন্ধকারে এসে দাঁড়ানোর পরেও সেই আলো যেন ওর চোখ ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছিল। সাজ্জাদ ভাবছিল, অত আলোর ভেতরে কীভাবে ঘুমোতে পারে একজন মানুষ?

একটু পরেই সে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। দুটো ছায়া তার পাশে এসে দাঁড়াল। দালাল হেসে বলল, দেখে নিন, সাব।

-দেখেছি।

-ঠিক হ্যায়, না?

-ঠিক হ্যায়।

-চালিশ রুপিয়া দেবেন।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে সাজ্জাদ নোটগুলি বার করে দালালের হাতে গুঁজে দিল।-গুণে নাও কত আছে?

-পঁচাশ হুজুর।

-পঞ্চাশই রাখো।

-সালাম, সাব।

সাজ্জাদ তখন ভাবছিল, হাতের কাছে যদি একটা বড় পাথর পাওয়া যেত, সেই পাথর দিয়ে দালালটার মাথা গুঁড়িয়ে দিত সে।

দালাল মিনমিন করে বলল, নিয়ে যান সাব। তবে বেশী কষ্ট দেবেন না।

সাজ্জাদ কোনও উত্তর না দিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে বেড়িয়ে এল রাস্তায়। সামনে একটা টাঙ্গা দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটাকে নিয়ে সে টাঙ্গায় উঠে পড়ল। দালালের গলা আবার ভেসে এল, সালাম, সাব। সাজ্জাদ ভাবছিল, হাতের কাছে বড় একটা পাথর পাওয়া গেল না কেন?

মেয়েটাকে নিয়ে একটা হোটেলের ঘরে এসে উঠল সাজ্জাদ। এই প্রথম সে মেয়েটাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। চোখের পাতা ফোলা, সোজা তাকাতে পারছে না। মনে হচ্ছিল, মেয়টা যেন একটা পুরনো ঝুঁকে পড়া বাড়ি, সে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়বে।

সাজ্জাদ বলল, মুখ তুলে একটু তাকাও।

-কী চান?

-কিছু না। কয়েকটা কথা বলো।

মেয়েটার চোখ টকটকে লাল। ভাষাহীন চোখে সে তাকিয়ে থাকল সাজ্জাদের দিকে।

-তোমার নাম কী?

-কিছু না।

-কোথায় ঘর ছিল?

-আপনি কোথায় চান?

-এমনভাবে বলছ কেন?

মেয়েটা যেন এক ঝটকায় ঘুম থেকে উঠল।-আপনার যা করার করুন। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।

-কোথায়?

-যেখান থেকে নিয়ে এসেছেন।

-তুমি এখনই চলে যেতে পারো।

-যা চান করুন। এত কথা বলছেন কেন,সাব?

-আমি তোমাকে বুঝতে চাই।

মেয়েটা ফুঁসে ওঠে।- বোঝাবুঝির দরকার নেই, সাব। আপনার কাজ আপনি করুন, তা হলে আমি চলে যেতে পারি।

সাজ্জাদ মেয়েটার পাশে এসে বসে তার মাথায় হাত রেখেছিল। মেয়েটা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দেয়। -তঙ্গ মত কিজিয়ে, সাব। অনেকদিন আমি ঘুমোইনি। যেদিন থেকে এখানে এসেছি, আমি ঘুমোতে পারি নি।

-এখানে ঘুমিয়ে পড়ো।

তার চোখ আরও লাল হয়ে ওঠে।-আমি এখানে ঘুমোতে আসিনি। এ তো আমার ঘর নয়।

-ওই বাড়িটা-ওটা কি তোমার ঘর?

-বাখোয়শ বনধূ কিজিয়ে সাব। আমার কোনও ঘর নেই। আপনি আপনার সেরে নিন। না হলে আমাকে নিয়ে চলুন, ওই চুতিয়ার কাছ থেকে টাকা ফেরত নিয়ে নিন।

আর কোনও কথা হয় নি। সাজ্জাদ মেয়েটাকে সেই বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিল।

না, না, ভাইজানেরা, কিস্সা এখানেই শেষ নয়। কোনও কিস্সা কি এত সহজে শেষ হতে চায়? কিস্সারও তো একটা দাবি আছে, না কি? সে তো আর এতিম নয় যে, যেখানে সেখানে তাকে ফেলে দিয়ে আসবেন।

পরদিন সন্ধেবেলা কায়সার পার্কের কাছেই একটা হোটেলে বসে চা খেতে খেতে বন্ধুকে আগের দিনের ঘটনাটা বলছিল সাজ্জাদ। বন্ধুটি শুনে খুব আঘাত পেয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল কমবয়সী মেয়ে?

-জানি না। মেয়েটাকে ঠিকঠাক দেখিওনি আমি। একটা কথাই বারবার মনে হয়, রাস্তা থেকে ভারী পাথর তুলে কেন দালালটার মাথা ভেঙে দিইনি।

সেদিন বন্ধুর সঙ্গেও বেশীক্ষণ থাকতে ভাল লাগছিল না সাজ্জাদের। আগের দিনের ঘটনা থেকে সে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না। বন্ধু চলে যাওয়ার পর সে ফুটপাথে এসে দাঁড়াল; চারদিকে চোখ চালিয়ে সেই দালালকে খুঁজছিল সাজ্জাদ। রাস্তার ওপারেই ঝুঁকে পড়া বাড়িটা। সাজ্জাদ বাড়িটাতে ঢুকে পড়ল। পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। একসময় প্রখর আলো ছড়ানো সেই ঘরের সামনেও পৌঁছে গেল। কোথাও কোনও শব্দ নেই। ভেজানো দরজা। ফাঁক করে ভেতরে তাকাল সাজ্জাদ। তীব্র আলোয় তার চোখ যেন ঝলসে গেল, দেখতে পেল, মেঝেতে একটা মেয়ে শুয়ে আছে। দোপাট্টায় মুখ ঢাকা তার। মেয়েটা কি মরে গেছে? সাজ্জাদ ঘরে ঢুকে পড়ল, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বুঝল, সে ঘুমোচ্ছে। তারপরেই সে দেখতে পেল লোকটাকে, একটু দূরেই মেঝেতে পড়ে আছে, চাপ চাপ রক্তের ভেতরে। পাশেই পরে আছে রক্তমাখা ইট। ভাঙা মাথা থেকে তখনও রক্ত চুইয়ে পড়েছে।

এরপর আর কখনও সাজ্জাদকে ক্যায়সর পার্কের কাছে দেখা যায়নি। তারপর একদিন তাকে পাগলাগারদে ভর্তি করতে হয়েছিল। শেষমেশ তার কী হয়েছিল, আমি আর জানি না।

কোঠার মেয়েগুলো ভারি অদ্ভুত। সব কিছুর পরেও বেঁচে থাকাটা যেন ওদের কাছে নেশার মত। সৌগন্ধীর কী ছিল জীবনে? মাথধা দিনের পর দিন ওর সঙ্গে বেইমানি করে গেছে; যেদিন। বুঝতে পেরেছে, মাধোকে লাথি মেরে রাস্তায় বের করে দিয়েছে, কিন্তু নিজেকে খতম করতে যায়নি। কেনই বা করবে? কেউ তো তাকে একটা ফোঁটা ভালবাসা দেয়নি; নিজের জীবনকে সে নিজেই ভালবেসেছে। কী বলছেন, ভাইজানেরা? খুশিয়ার কথা শুনতে চান? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার কথা তো বলা হয়নি। আমি ভাবছিলাম, সৌগন্ধীর গল্পটাই আপনাদের বলি। তো, ঠিক হ্যায়, খুশিয়ার কথাই হোক। খুশিয়ার জন্য আমারও কি কম আগ্রহ ছিল? কেন সে ভুল বুঝেছিল কান্তাকে? সেই কথা জানতেই একদিন একা-একা কান্তার কোঠায় গিয়েছিলাম।

-আরে মান্টোসাব, আজ ইয়ারদোস্তরা সব কোথায়?

-তুমিই তো সেদিন আমাকে একা আসতে বলেছিলে।

কান্তা হেসে ওঠে।-একা আসতে বলেছিলাম? আমার কী আছে আর যে আপনাকে দিতে পারব?

-অনেক কিছু আছে কান্তা। কোমরের অমন ভাঁজ কজনের আছে?

কান্তা হা হা করে হাসে।-ভাঁজ দেখতে এলেন বুঝি?

আমি তার পেটে হাত বুলোতে বুলোতে বলি, এই গোস্তের স্বাদই আলাদা।

-বাখোয়শ বন্ধ করুন। কিছুই করতে পারেন না, শুধু মুখে কথার ফোয়ারা।

-কী করব কান্তা? ওই এক সেকেন্ডের কিস্সায় আমার মন ভরে না। আমি চাই অনেক বড় কিস্সা, অনেকদিন ধরে চলবে, আমার নাওয়া-খাওয়া-ঘুম কেড়ে নেবে।

-তা হলে এখানে আসেন কেন মান্টোসাব?

-কিস্সার খোঁজে। আজ তুমি আমাকে খুশিয়ার গল্পটা বলবে।

-খুশিয়া?

-সেজন্যই তো তুমি আমাকে একা আসতে বলেছিলে। মনে নেই? চলো,শরাব আনাও, খেতে খেতে খুশিয়ার গল্পটা শুনি।

আমরা কোঠার ছাদে গিয়ে বসলাম।

-খুশিয়া বড় ভালো ছিল। ও যে এমন পাগলামি করতে পারে, আমি ভাবতেই পারিনি, মান্টোসাব।

-কী করেছিল খুশিয়া?

-ওই তো আমার খদ্দর ধরে আনত। যা বলতাম, হাসিমুখে করত। আমি তখন সবে এ লাইনে এসেছি। একেক দিন আমার মুখের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকত। মনে হত, আমার জন্য ও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পায়। খুশিয়ার জন্য আমারও কষ্ট হত। এত সুন্দর ছেলে-কতই বা বয়স, সাতাশ-আঠাশ হবে- পেটের জন্য কোঠার দালালি করতে হয়। কী সুন্দর যে গল্প বলতে পারত খুশিয়া।

-কী গল্প বলত?

ইউসুফ আর জুলেখার গল্প ও-ই আমাকে প্রথম শুনিয়েছিল।

-হুঁ। তারপর?

-জি?

-আগে বাড়ো, ভাই।

-একদিন বিকেলে আমার ঘরের দরজায় টোকা। আমি তখন চান করছি। চেঁচিয়ে বললাম, কে? খুশিয়া, আমি খুশিয়া। ও খুশিয়া, তা এইসময়ে হঠাৎ কেন? এখন তো খদ্দের আসে না। আমি জল গায়েই একটা ছোট তোয়ালে জড়িয়ে এসে দরজা খুললাম। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে খুশিয়ার চোখ দুটো কেমন হয়ে গেছে। আমি বললাম, কী হয়েছে খুশিয়া? আমি চান করছিলাম। না, না, তুমি ভেতরে এসে বসো। এলেই যখন একটু চা নিয়ে আসতে পারতে। রামুটা আজ সকালেই পালিয়ে গেছে। খুশিয়া আমার দিকে তাকাতে পারছিল না। ও এমনই সরল ছিল মান্টোসাব। মাথা নীচু করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বলল, যাও, যাও, চান করো গিয়ে, এই অবস্থায় কেউ দরজা খোলে? আমি না হয় পরেই আসতাম।

-তুমিও বেশ লজ্জা পেয়েছিলে, তাই না কান্তা?

-না। লজ্জা পাব কেন? ও তো আমার খুশিয়া। ওর কাছে আবার লজ্জা কী?

-খুশিয়া তোমাকে এভাবে আগে কখনও দেখেছিল?

– না। কিন্তু খুশিয়া তো আমার ঘরের লোক। ও তো আর খদ্দের নয়।

-তারপর?

-খুশিয়া কি পাগল হয়ে গেছিল, মান্টোসাব?

-কেন?

-ও চলে গেল। সন্ধে পেরিয়ে গেল, খুশিয়া এল না। আমার ঘরেও সেদিন খদ্দের নেই। হঠাৎ একসময় দরজার কড়া নড়ে উঠল। দরজা খুলে দেখি, অচেনা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। বলল, যাবে? বাবু বাইরে গাড়িতে বসে আছেন?

-এখানে নিয়ে এসো।

-বাবু কোঠায় আসবেন না।

-কেন?

-বলছি না, বাবু কোঠায় আসেন না। যেতে হলে চলো। কত চাও? আগাম দিচ্ছি।

 -তুমি গেলে? আমি কান্তাকে জিজ্ঞেস করি।

-কি করব বলুন?

-খুশিয়া নেই, খদ্দের নেই, আমাকে তো দিনের রোজগারটা করতেই হবে। কোঠায় যারা আসে না, তারা টাকাও বেশী দেয়। না গিয়ে কী করব? বড় রাস্তার সামনেই ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়েছিল। দালালটা আমকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়েই হাত বাড়িয়ে নিজের হিস্যা নিয়ে নিল। টাক্সি ছুটতে শুরু করল।

ট্যাক্সির ভেতরের অন্ধকারে প্রথমে তাঁকে খেয়াল করিনি। চোখ সয়ে যেতে খুশিয়াটাকে দেখতে পেলাম।

-খুশিয়া তুম?

-টাকা পেয়েছ তো?

-খুশিয়া

-চোপ্। টাকা পেয়েছ, যা বলব তাই করবে।

-কী করেছিল খুশিয়া?

-কিছু না। অনেক দূর যাওয়ার পর, আমাকে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে দিল।

-আর তুমি?

-আমি তো রাস্তা চিনি না। একা একা দাঁড়িয়ে থাকলাম। রাস্তাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোর হলে ফিরে এসেছিলাম কোঠায়। মান্টোসাব, খুশিয়া আমার সঙ্গে কেন এমনটা করেছিল, বলতে পারেন?

আমি কান্তাকে সেদিন কিছু বলতে পারিনি। খুশিয়ার কথা আমি অনেকদিন ভেবেছি। প্রতিশোধ মানুষের এক আদিম প্রবৃত্তি। খুশিয়া প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। সে কোঠার দালাল হতে পারে, কিন্তু সে-ও তো একজন পুরুষ। খুশিয়াকে দালাল ভাবতে ভাবতে কান্তা এই সত্যটাই ভুলে গেছিল, তাই প্রায় নগ্ন হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিল, আরে তুমি তো আমাদের খুশিয়া। তোমার কাছে আবার শরম কীসের?

পৌরুষ এক ভয়ঙ্কর জিনিস, ভাইজানেরা, সে যখন জেগে ওঠে, এই দুনিয়াটাকেই ভেঙে-চুরে ফেলতে চায়। কেন জানেন? পৌরুষ একটা কাচের পুতুল, আছাড় মারলেই ভেঙে যায়। তাই সামান্য আঘাতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ভাববেন না, ওটা শুধু পুরুষের মধ্যেই থাকে; মেয়ারাও। তাঁকে বহন করে। পৌরুষ কী জানেন? আমিই শেষ কথা, এর পরে আর কোনও কথা নেই।

আরে ভাই, শেষ কথা বলার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? যে-দুনিয়ার কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, তাই আমরা বুঝতে পারি না-সেখানে তুমি শেষ কথা বলতে এসেছ? প্রগেসিভ রাইটারদের তাই আমি সহ্য করতে পারতাম না। এরা জীবনের কিছুই দেখেনি, বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখে, তারপর এসে বলবে এটাই শেষ কথা। কোন পয়গম্বর তুমি যে তোমার কথাই জীবনের শেষ কথা বলে মেনে নেব আমি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *