১৯. এক ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখে

সজ হোতী হী নহীঁ য়হ্, সরজমীঁ
তুখ্‌ম-এ খ্বাহিশ দিলমে তু বোতা হ্যয় কেয়া।।
(এ বক্ষভূমি শস্যশ্যামলা হবে না কোনও দিন,
কেনই বা তাতে বাসনার বীজ বুনে যাচ্ছ?)

এক ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখে আতঙ্কে ধড়মড় করে উঠে বসলুম। গলা শুকিয়ে কাঠ, হাত-পা থরথর করে কাঁপছে, কাল্লুকে ডাকার চেষ্টা করলুম, কিন্তু আওয়াজ বেরুল না। স্বপ্নটা আমি সারা জীবনেও ভুলতে পারিনি। মরুভূমির মধ্য দিয়ে এক কাফেলা চলেছে। নীল আল ছড়িয়ে আছে মরুভূমিতে। উট আর মানুষগুলি সত্যিকারের নয়, যেন ছায়ায় মিলিয়ে চলেছে। কেউ কারোর সাথে কথা বলছে না। শুধু মাঝে মাঝে বহু দূর থেকে ভেসে আসছে সমবেত আর্ত চিৎকার, যেন কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে, আর ওই চিক্কার যে মৃত্যুর সঙ্গে মোলাকাতের আর্তনাদ তা আমি বুঝতে পারছিলুম। আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল সাবার সঙ্গে। বুঝতে পারছিলুম না তো, কাফেলার সঙ্গে আমি কোথায় চলেছি? কেনই বা জুড়ে গেছি এই দলের সঙ্গে? পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, কোথায় যাচ্ছি, জনাব?

লোকটা উত্তর দিল না।

কিছুক্ষণ পর আবার একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, আর কতদূর যেতে হবে আমাদের?

সে-ও কোন কথা বলল না।

এরা কী কথা বলতে পারে না? না, আমার সঙ্গে কথা বলবে না? তা হলে আমাকে তাদের দলে নিয়েছে কেন?

একটা কালো ছায়া যেন আমার বুকের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলুম, তারা শুধু আমার মুখের দিকে তাকাল, কথা বলল না, জলও দিল না। ঠিক করলুম, এই দল ছেড়ে আমাকে পালিয়ে যেতেই হবে। উটের মুখ উল্টোপথে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলুম, কিন্তু সে কিছুতেই কাফেলা থেকে আলাদা হবে না। শেষমেশ এক ঝটকায় সে আমাকে পিঠ থেকে ফেলে দিল। আমি বালির ওপর পরে গিয়ে দেখলুম কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাইজানেরা, কী বলব, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আমার ছিল না, মনে হচ্ছিল, মরুভূমি যেন আমাকে গ্রাস করে নিতে চাইছে। একসময় দেখলুম, একটা চাপ বাঁধা অন্ধকার আমার ওপর। নেমে আসছে। হ্যাঁ, বিরাট ডানার এক পাখি, লম্বা গলায় শুধু কাঁটা আর কাঁটা, এমন পাখি তো আগে কখনও দেখনি, কোথা থেকে এল এই পাখি, আমার দিকে সে ধেয়ে আসছে কেন? পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলুম, শরীর নাড়ানোর কোনও ক্ষমতাই আমার নেই। পাখিটা আমার বুকের ওপর এসে বসল, দুই ডানা ছড়ানো, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল,। দেখলুম, তার চোখ নেই, শুধু দুটি কোটর, আর তারপর তার লম্বা ঠোঁট নেমে এল আমার বুকের ওপর, পাখিটা ঠোকরাতে শুরু করল, বুক ফুটো করে সে আমার শাঁস-রক্ত খেতে চায়, সে ঠুকরে যেতে লাগল, মাংস ছিড়তে থাকল…. তখনই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। সত্যি বলতে কী মান্টোভাই, জীবনে প্রথম আমি ভয় পেলুম। কী মানে এই স্বপ্নের? আমার কেয়ামতের দিন তা হলে এসে গেছে! এত যে খেতে ভালবাসি, সারাদিন কিছু খেতে পারলুম না, যতবারই খাবারের দিকে তাকাই খতরনাক পাখিটার লম্বা ঠোঁট দেখতে পাই। কাল্লু গিয়ে হয় তো জেনানামহলে জানিয়েছিল, তাই সন্ধেবেলা বেগম আমার কাছে এল।

-সারাদিন কিছু খাননি শুনলাম। তবিয়ৎ খারাপ?

-না, বেগম।

-তা হলে?

জানেনই, উমরাও বেগমের সঙ্গে আমার কথাবার্তা প্রায় বন্ধ হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নটা আমি তাঁকে বলতে চাইছিলুম। বেগম হয়তো আমাকে সামান্য হলেও আশ্রয় দিতে পারবে। পুরুষরা এক-একসময় কেমন অসহায় হয়ে যায়, মান্টোভাই, আল্লার হাত ধরার চেয়ে সে তখন নারীর কাছে মুখোমুখি বসিবার সামান্য একটু জায়গা খুঁজতে চায়।

-একটা বদখোয়াব দেখে সারাদিন ধরে শুধু উল্টি আসছে।

-কী দেখেছেন, আমাকে বলুন।

আমি বেগমকে স্বপ্নটা বললুম। শুনে তাঁর ঠোঁটে বাঁকা হাসি খেলল।-এ খোয়াব তো আপনারই দেখার কথা মির্জাসাব।

-জি-

-উল্টি আসছিল বলে কিছু খাননি, শরাব তো পিয়া, না?

আমি কোনও কথা বললুম না।

-শরাব আর জুয়ার মধ্যে ডুবে আছেন, আর কোন খোয়াব দেখবেন আপনি? ভাল খোয়াব তো আপনার জন্য নয়, আপনি দেখতেও চান না।

আমি মনে নিজের গালে চড় মারলুম। কেন বেগমকে খোয়াবের কথা বলতে গেলুম? এবার তো আমাকে শুনতে হবে, আমি কতটা বেশরিয়তি, আর শরিয়ত যে মানে না, তার জীবনটাই তো একটা বদখেয়াল। এই রকম সময়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমি তো একটা কাজই করতে পারি, ঠাট্টামশকরা করা, ওইটুকুই তো আমার সম্বল। বেগমকে বললুম, হজরত মুসাকি বহ্ন, আমার জন্য তা হলে দোয়া করুন।

-আপনার জন্য দোয়া? আপনি শরিয়ত মানেন না, রোজা রাখা তো দূর, নমাজও পড়েন না, আপনার জন্য কী দোয়া করব বলুন। আল্লাই জানেন, আপনার কী হবে—

আমি হেসে বললুম, আমার হশর তোমার চেয়ে খারাপ হবে না বেগম। ভালই হবে।

-কী করে বুঝলেন?

-আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

-কী দেখছেন?

-হশরে তোমার সঙ্গে থাকবে মাথা মুড়োনো ধার্মিক লোকেরা, তাদের নীল পোশাক, কোমরে দাঁতন, হাতে বদনা, সব গোমড়ামুখো মানুষ।

-তাই? বেগমও হেসে ফেলে। -আর আপনার সঙ্গে কারা থাকবেন?

-তারা সব দুধর্ষ, অত্যাচারী বাদশা। ফরাউন, নিমরোদ। তাদের কোমরে তলোয়ার ঝুলছে। আমি গোঁফে তা দিতে দিতে বুক ফুলিয়ে তাদের সঙ্গে হেঁটে যাব। আর আমার দুপাশে ফরিস্তারা আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবেন।

-বেশ তো, সেভাবেই যাবেন। বেগম উঠে দাঁড়ায়।-আমি যাই। রাতে একটু খেয়ে নেবেন। খালি পেটে শরাব ঠিক না।

-বেগম-

-বলুন।

শরিয়ত কি এতই কঠোর, যে তা মানে না, তার কথা শোনাও হারাম? একটা কিস্সা শোনার সময় আছে তোমার হাতে?

-কার কিস্যা?

-শেখ আবু সয়ীদের। খোরাসানের সুফি সাধক। তো শেখকে একদিন তাঁর শিষ্যরা জিজ্ঞেস করল, এ-শহরে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন মানুষ কে? শেখ বললেন, কেন, লোকমান, ওর মতো সাফ মানুষ আর আছে নাকি? শাগির্দরা তো অবাক। লোকমান তো একটা পাগল, চুলে জটা, ছেড়া ননাংরা আলখাল্লা পরে থাকে, আর কথায়-কথায় মুখে খিস্তি। শেখ তখন বোঝালেন, পরিচ্ছন্ন মানুষ কাকে বলে জানো? যে কোনও কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে নেই। তাই লোকমানের মত পরিচ্ছন্ন আর কে আছে?

-আপনি নিজেকে এমনই সাফসুরতি মনে করেন?

-না বেগম। তোমার শরিয়ত মানায় যে সাফসুরতি নেই, সেটুকুই আমি বুঝি। সত্যি কথা যদি পাথরের মত আঘাত করে, আমার কাছে তার কোনও মূল্য নেই। তার চেয়ে মিথ্যা নিয়ে বেঁচে থাকা ভাল।আমরা তো কেউই জানি না, কেয়ামতের দিন কে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব।

বেগম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মহলসরায় চলে গেল।

.

তখন আমার উনত্রিশ বছর বয়স, মান্টোভাই। কত তাড়াতাড়ি খোয়বের ভেতরে আমি কেয়ামতের দিনের ছবিটা দেখতে পেলুম। সে-বছরই আমার ভাই ইউসুফ মির্জা পুরো পাগল হয়ে গেল। আগের বছর আমার শ্বশুর মারুফসাব মারা গেছেন।জীবনটা তো খুল্লমখুল্লাই কেটে যাচ্ছিল, পেনশনের সামান্য কটা টাকা, এরপর দানখয়রাতে, আর ধারদেনা করে। কিন্তু এবার একটা অন্ধগলির ভেতরে এসে দাঁড়ালুম আমি। মারুফসাব মারা যাওয়ায় আমার ভিতটাই টলে গেল। পাওনাদাররা টাকা শোধ দেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। যে-জীবনযাপনে আমি অভ্যস্ত তা তো আর বদলাতে পারব না, তা হলে একটা কাজই করার, কীভাবে কোথা থেকে। টাকা পাওয়া যায়? একটা কথাই নিজেকে বলতুম, রোজগার বাড়াতে হবে মির্জা গালিব, না হলে তুমি বাঁচবে কীভাবে, আর নিজের মতো করে বাঁচতে না পারলে, কী করে গজল লিখবে? উপোস করে কে কবে সৌন্দর্যের জন্ম দিতে পেরেছে দুনিয়ায়, মান্টোভাই?

গোরাদের কাছ থেকে যে-পেনশন পেতুম, এবার তার হিসেব-নিকেশ নিয়ে বসতেই হল আমাকে। ভাববেন না, শুধু নিজের জন্য। ইউসুফ মির্জার পরিবার, চাকর-বাকর-দাসী, তাদের ছেলেমেয়েদেরও দেখতে হবে আমাকে। হ্যাঁ, নিজের মৌতাতে থাকতাম ঠিকই, কিন্তু কাউকে তো জীবন থেকে ফেলে দেওয়ার কথা ভাবিনি। কী করে ভাবব, বলুন? ওরা চারপাশে আছে। বলেই তো আমি আছি। একা একা আমার কী ক্ষমতা? দুটো লাইন লেখার জন্যও অনেক। মানুষের সঙ্গে থাকতে হয়, সে তো আপনি জানেন, মান্টোভাই।

কোনওদিন তো ভাবিনি টাকাপয়সার হিসেবের মধ্যে মাথা গুঁজতে হবে আমাকে। ভোগ করার জন্য টাকা তো লাগেই, টাকা কোত্থেকে আসবে, কীভাবে জোগাড় করব, এ সব ধান্দার কথার ভাবলেই আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ত। কিন্তু মানুষ কী না পারে বলুন? মেঘের সঙ্গে মেঘ হয়ে ভাসতে পারে, আবার একটা কেন্নোর মতো মাটিতে সেঁধিয়ে যেতেও পারে। ফলে ব্রিটিশের দেওয়া পেনশনের ব্যাপারটা এবার আমাকে খতিয়ে দেখতেই হল।

একটু খোলসা করেই বলতে হয় আপনাদের, নইলে বুঝবেন না। ব্রিটিশের দেওয়া পেনশনটা আমরা পেতুম লোহরু-ফিরোজপুরের নবাব আহমদ বক্স খানের কাছ থেকে। ইনি আবার আমার শ্বশুর মারুফসাবের বড় ভাই। আমার চাচা নসরুল্লা বেগ খান তো মারাঠা বাহিনীতে কাজ করতেন। ১৮০৩- ব্রিটিশের কাছে মারাঠারা হেরে যাওয়ার পর চাচার হালও খারাপ হল। এদিকে আহমদসাবের বোন ছিলেন চাচার বেগম। চোস্ত মানুষ ছিলেন আহমদসাব। অলওয়ারের রাজার হয়ে লর্ড লেক আর ব্রিটিশের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতেন তিনিই। একইসঙ্গে রাজা ও ব্রিটিশকে খুশি করে লোহারু আর ফিরোজপুরের নবাবি পেয়েছিলেন। তো তিনি আমার চাচাকে ব্রিটিশের বাহিনীতে ঢুকিয়ে দিলেন। ১৮০৬-এ চাচা মারা যাওয়ার পর, আহমদসাব ব্রিটিশেদের বোঝালেন, নসরুল্লা বেগ খানের পরিবারের ভরণপোষণ দেখা তাঁদের দায়িত্ব। তবে কিনা ব্রিটিশের হয়ে দায়িত্বটা পালন করবেন তিনিই, শুধু নবাবীর জন্য বছরে ২৫ হাজার টাকার পাওনাটা তাঁরা মুকুব করে দিন। বদলে তিনি নসরুল্লা বেগ খানের। পরিবারের খাওয়াপরা তো দেখবেনই, ব্রিটিশের জন্য পঞ্চাশ অশ্বরোহী বাহিনীও মজুত রাখবেন। পেনশনের ব্যাপার নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখলুম, চাচার পরিবারের ভরণপোষণের। জন্য ধার্য হয়েছিল বছরে ১০ হাজার টাকা, কিন্তু আসলে দেওয়া হত পাঁচ হাজার টাকা। আমি পেতুম ৭৫০ টাকা। আমার ভাইয়ের জন্য কোনও বরাদ্দ ছিল না। এদিকে খাজা হাজি নামে। একজন টাকা পেয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে আমার চাচার কোন সম্পর্ক ছিল না। এ এক বিরাট জট, মান্টোভাই, আপনি তো জানেনই টাকাপয়সার জট সহজে ছাড়ানো যায় না।

এ তো গেল একদিক, কিন্তু আরও সমস্যা তৈরি হয়েছিল। আহমদ বক্স খানের ছিল দুই বিবি। এক বিবির ছেলে শামসউদ্দিন, অন্য বিবির ছেলে আমিনউদ্দিন আর জিয়াউদ্দিন। আমিনউদ্দিনের সঙ্গে আমার খুবই দোস্তি ছিল। ১৮২২ সনে অলওয়ারের রাজা ও ব্রিটিশের মত নিয়ে আহমদসাব শামসউদ্দিনকে তাঁর নবাবির উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন। এতে তো ছোট দুই ভাই খেপে গেল। তাদের মা খানদানি মুসলমান আর শামসউদ্দিনের মা সাধারণ। মেওয়াতি, শামসউদ্দিন হবে কিনা উত্তরাধিকারী? আমিনভাই আমার বন্ধু, তাই আমিও পড়লাম মুসবিতে। শামসউদ্দিন আমাকে নিয়ে খেলতে শুরু করল। কখনও আমার বরাদ্দের টাকা কম পাঠায়, কখনও মাসের পর মাস পাঠায়ই না। মারুফসাব মারা যাওয়ার পর আমি তো একেবারে খাদে পড়ে গেলুম। এতগুলো লোকের দেখভাল করা, তার ওপর পাওনাদারের চাপ। আহমদসাবকে কতবার চিঠি লিখেছি, ভেবেছি তিনি নিশ্চয় কোন ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু তাঁর দিক থেকে কোনও উত্তর নেই। একদিন ফিরোজপুরে গিয়ে হাজির হলুম। তাঁর তখন খুবই খারাপ অবস্থা। সারা শরীরে ঘা, কোনও মতে বিছানায় উঠে বসলেন। আমি সোজাসুজি তাঁকে বললুম, জনাব, হয় আপনি আপনার কথা রাখুন, আমরা যাতে ঠিকঠাক টাকা পয়সা পাই দেখুন, না হলে বলুন, আমি সরকারের দরবারে গিয়ে আর্জি পেশ করব। তিনি আমার হাত চেপে ধরে কাঁদতে লাগলেন। বুঝতে পারলুম,আহমদসাবের আর কিছু করার নেই, শামসউদ্দিনের কথা মেনেই চলতে হবে তাঁকে। ঠিক করলুম, শামসউদ্দিনের সঙ্গেই দেখা করব, বোঝাপড়াটা এবার শেষ করে নিতে হবে। আমার পথ এবার আমাকেই দেখতে হবে। ১৮০৬-এর মে মাসে আহমদসাব আর ব্রিটিশের সঙ্গে চুক্তিতে বলা হয়েছে, নসরুল্লা বেগ খানের উত্তরাধিকারীদের বছরে ১০ হাজার টাকা ভাতা দিতে হবে। আর ওই বছরেই জুন মাসের চুক্তিতে ভাতা নামিয়ে আনা হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকায়। তা কী করে হতে পারে? এটা নকল চুক্তি বই আর কিছু নয়। আমি শামসউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করলুম। কথায়-ব্যবহারে সে বেশ খাতিরই করল আমাকে। আসল কথাটা পাড়তেই বলল, ওসব চুক্তির কথা আমি কিছু জানি না, মির্জা।

-তাহলে আমি কী করব?

-সে তুমি যা ভালো বোঝো, করো।

-কিন্তু টাকাও তো তুমি ঠিক সময়ে পাঠাচ্ছ না।

-টাকা কি আসমান থেকে পড়ে?

-মতলব?

-টাকা হাতে এলে তবেই না পাঠাব।

-কিন্তু আমি কী করে সংসার চালাই, বলো?

-আরে ইয়ার, তোমার আবার সংসার কী? শরাব, রেন্ডি, গজল-এই তো? তুমি বড় শায়র, আমরা তোমাকে সম্মান করি, এত টাকা-টাকা করো কেন? আরে এখানে থাকো কদিন মস্তি করো।

ইউসুফ মিঞার শরীর ভালো না। মাঝে মাঝেই ধুম জ্বর আসে, আবোল-তাবোল বকে।

-বদর বার করে দাও শরীর থেকে। ঠিক হয়ে যাবে।

-তুমি ঠিক সময়ে টাকা পাঠালেই আমরা একটু ভাল থাকতে পারি শামসভাই।

-দেখি। খোদা যা করেন।

ওই যে কথাটা, খোদা যা করেন, ওটা হচ্ছে আমার বুকে শামসউদ্দিনের শেষ লাথি। তখনই ঠিক করলুম, রাজধানী কলকাতায় যেতে হবে আমাকে, রাজার দরবারে নকল চুক্তিটাকে ফাঁসিয়ে দিতে হবে। নিজেকে বললুম, মির্জা তুমি আকাশে-আকাশে ঘুরে বেড়াও, বেড়াতে বেড়াতে গজল লেখো, কিন্তু একবার এই জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াও তো, নিজের পাওনাগণ্ডাটা বুঝে নাও, দেখি কত হিম্মৎ আছে তোমার, একইসঙ্গে আশমানে ওড়ো, আবার মাটিপৃথিবীর হিসেবটাও বুঝে নাও। তবে না তুমি কবি। মেহর নিগারকে ভালবাসার জন্য মীরসাব যদি এত অপমান, পাগল হওয়ার শাস্তি বহন করতে পারেন, তুমি এটুকু পারবে না? কতগুলো মানুষ শুধু দিনরাতের খাওয়ার জন্য তোমার দিকে তাকিয়ে আছে; গজলের সৌন্দর্য আর ভালভাবে বাঁচার খুবসুরতি তো আলাদা নয় মির্জা। দরবার করতে তাই আমাকে কলকাতায় যেতেই হবে।

কিন্তু কী করে যাই বলুন, তো? হাতে কোনও টাকাপয়সা নেই; যাতায়েতের খরচা ছাড়াও, পরিবারের দিন গুজরানের কথাও ভাবতে হবে। শামসউদ্দিন কখন টাকা পাঠাবে, তার তো। ঠিকঠিকানা নেই। তার ওপর ইউসুফ মিঞা বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। তার দিকে তাকানো যায় না। একা একা বসে কী যে বিড়বিড় করে বলে। বেশ কয়েকদিনের জন্য সে উধাও হয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। এক একসময় মনে হত, ওকে পাগলাগারদে ভরে দিয়ে আসি। কিন্তু সেখানে তো শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে। ইউসুফ বড় কোমল প্রাণের মানুষ ছিল, মান্টোভাই। তাঁকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবে, তার ওপর চাবুক চালাবে, এ আমি ভাবতেও পারতুম না। পাগলদের মত অসহায় আর কেউ নেই দুনিয়ায়, তাদের নি যে যা খুশি করতে পারে; কিন্তু। মানুষের কি তা করার অধিকার আছে? যে মানুষটা যুক্তি দিয়ে সবসময় দুনিয়াকে বিচার করে, সে পাগল নয়? শুধু যুক্তি নিয়ে যে বাঁচে, সে নিজেই তো একটা পাগলাগারদ। মানুষকে কে বোঝাবে বলুন, পাগল আর স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে ব্যবধানটা একটা সুতোর মাত্র। কেউ তার আকাক্ষা পিষে মারতে পারে, কেউ পারে না; যে পারে না, সে পাগল হয়ে যায় আর অন্যজন স্বাভাবিককের মতোই হাঁটে-চলে-কথা বলে, কিন্তু যা সে গোপন করেছে, তা একদিন ফুটেও বেরুতে পারে, এতে তার কোনও হাত নেই; তাই আমি মনে করতুম, সব মানুষই পাগল হওয়ার পথে এগিয়েই রয়েছে, তবু কবে সেই জিন ভর করবে, এটুকু কেউই বলতে পারে না।

ইউসুফকে একদিন ধরেবেঁধে বসালুম আমার সামনে। তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললুম, তোর কী কষ্ট, আমাকে বল।

সে শুধু হাসল, এমনভাবে যেন আমার কথাই বোঝেনি।

-ইউসুফ—

-জি।

-কী ভাবিস তুই?

সে কোনও কথা বলল না। আমি কত প্রশ্ন করলুম, সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। মান্টোভাই, আমি বুঝতে পারলুম, আমাদের যুক্তিতে যত জোরই থাক, পাগলের মনের ভেতরে আমরা ঢুকতে পারব না, তার ভাষা আর আমার ভাষা আলাদা; ও আমাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল।

তখন অন্য কিছু ভাবার সময় নেই আমার, কলকাতায় আমাকে যেতেই হবে। পেনশনের ব্যাপারটা নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। জুনের চুক্তিটা যে জাল, তা আমাকে প্রমাণ করতেই হবে। বেগমকে তাই সব বলতে গেলুম।

-আপনি কলকাতা যাবেন? সে তো বহু দূর শুনেছি।

-কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। নয়তো একদিন না খেয়ে মরব আমরা।

-আপনি পারবেন, মির্জাসাব?

-পারতেই হবে বেগম।

উমরাও আমার হাতে হাত রেখে বলে, টাকাপয়সা নিয়ে কাজিয়া তো আপনার কাজ নয়, মির্জাসাব।

-এখন তা-ই করতে হবে।

-আর আপনার গজল?

-গজল! সে কথা তুমি ভাবো নাকি, বেগম?

-না। গজলের ভেতরে আপনি ভাল থাকেন, এটুকু তো বুঝি।

সেদিন এক অন্য রুপ দেখলুম বেগমের, ভাইজানেরা। প্রথম সে আমার গজল নিয়ে কথা বলল।

আমি বললুম, কয়েকটা বছর তোমাকে সব দেখেশুনে রাখতে হবে, বেগম।

-আপনি ভাববেন না। এত দূরের পথ যাবেন, টাকাপয়সা তো লাগবে, কোথায় পাবেন?

-ধার করব।

-আবার ধার?

-আমি জিতে ফিরব বেগম। সবার সব টাকা শোধ করে দেব।

-কেউ আর ধার দেবে আপনাকে?

-আলবৎ দেবে। কলকাতায় যাচ্ছি তো সব পাওনাগণ্ডা বুঝে নিতে, বেগম। অনেক দিন ধরে অনেক ঠকেছি। এবার আমাকে আর ঠকাতে পারবে না।

-আপনি তো ঠকতেই ভালবাসেন, মির্জাসাব। বেগম হেসে বলল।

-না, বেগম না, আর কেউ আমাকে ঠকাতে পারবে না। গজল লিখি বলে কি আমার পেট নেই?

কলকাতায় যাব শুনে মথুরা দাস, দরবারি মলরা আমার ওপর বাজি ধরল। আমিও তাদের বোঝাতে পারলুম যে এ মামলায় আমি জিতে ফিরবই। তখন সুদে-আসলে সব টাকা ফেরত পাবে তারা। বেশ মজাই পেলুম। খেলাটা তা হলে জমে উঠেছে। জিতে ফিরতেই হবে আমাকে। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মনে হত, আমি যেন একটা শেয়ালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। চলো মিঞা, কলকাত্তা চলো, দেখো নসিব বদলায় কি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *