১৬. চলে যাচ্ছে বসন্তের দিন

আগোশ-এ গুল কুশাহ্ বরায়ে বিদা হৈ;
অয় অলীব চল্ কেহ চলে দিন বহার-কে।।
(গোলাপের কলিগুলি পাপড়ি মেলেছে বিদায় জানাবার জন্য;
হে বুলবুল, চলো এবার, চলে যাচ্ছে বসন্তের দিন।)

আচ্ছা মির্জাসাব, কখনও ভেবে দেখেছেন, কটা গালিব একসঙ্গে আপনার ভেতরে লুকিয়ে ছিল? আপনি তাদের কতজনকে চিনতেন? হয়তো কাউকে সারা জীবনে চিনতেও পারেননি, তাই না? আপনার মতো মানুষকে নিয়ে এই সমাজ বিপদে পড়ে যায়। সে বুঝে উঠতেই পারে না, কে আসল মির্জা গালিব। এই যেমন ধরুন, মির্জা হাতিম আলি সাব মিহ্রকে লেখা আপনার চিঠিটা। মনে পড়ে, ১৮৬০-এ লেখা সেই চিঠির কথা? মির্জা মিহ্র-এর প্রেমিকা মারা গেছেন, চিঠিতে আপনাকে বিচ্ছেদের দুঃখ জানিয়েছিলেন। আপনি তার উত্তরে লিখলেন, আমার বয়স এখন পঁয়ষট্টি, দুনিয়াটাকে আমি পঞ্চাশ বছর বেশ ভালই জরিপ করেছি। কম বয়েসে একজন দরবেশ আমাকে বলেছিলেন, নিজেকে কখনও কষ্ট দিও না। খাও,পিও,মজা করো, তবে একটা কথা মনে রেখো, তুমি চিনির বাটির চারপাশে উড়তে থাকে মাছি, কখনও মৌমাছির মতো একই ফুলে আটকে থেকো না। আর কী লিখেছিলেন মনে আছে, মির্জাসাব? লিখেছিলেন মৃতের জন্য সে-ই শোক করতে পারে, যে নিজে মরবে না। আপনি কাঁদবেন কেন? বরং আজাদি উপভোগ করুন,শোক ভুলে যান। আর সম্পর্কের বন্ধনকেই যদি ভালবাসেন, তা হলে মুন্নাজানও যা, চুন্নাজানও তা-ই। মাঝে মাঝে আমি কল্পনা করি, আমাকে বেহস্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে এক হুরিকেও আমার সঙ্গে দেওয়া হয়েছে, আর তার সঙ্গে অনন্তকাল আমাকে। থাকতে হবে। ভাবলেই আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। জীবন তো তা হলে এক বোঝা হয়ে উঠবে মিঞা। বেহস্তের সেই এক ঘর, এক গাছপালা, আর আমি অনন্তকাল ধরে একজনের মুখের। দিকের তাকিয়ে বসে আছি, তাঁকে প্রেমের কথা বলে যাচ্ছি। মনটাকে অন্য কোথাও জুতে দিন মিঞা। নতুন নতুন বাহার-এ আপনার জীবনে নতুন নতুন পরি আসুক। সারা জীবন একটা কিছুতে আটকে থাকার মতো বালখিল্য আর কিছু হয় না। একজনের বেদনা নিয়ে আপনি কেন মজা করতেন মির্জাসাব? না, না, এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না, কী ভেবেছিলেন নিজেকে, সবাই আপনার খেলার পুতুল? মির্জা মিহ্রকে লেখা আর একটা চিঠির কথাও আপনি বলতে চাইছেন তো? হ্যাঁ, সে-চিঠিও আমি পড়েছি। আপনি সেখানে স্বীকার করেছিলেন, পরোক্ষভাবে মুনিরাবাইয়ের মৃত্যুর কারণ আপনিই। আপনার সেই চিঠি থেকে একটা ছবি আমার সামনে ফুটে ওঠে, ভাঙাচোরা একটা মানুষ, আপনি, মির্জা মিত্বের হাত ধরে বলছেন :

-মিঞা আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাদের আল্লা মুক্তি দিন। আর আমরা যারা বিচ্ছেদ সহ্য করেছি, আমাদের যেন করুণা করেন। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে মুনিরাবাই আমার জীবনে এসেছিল। তারপর আমি আর ও-পথে যাইনি, কিন্তু তার চাউনি, তার লাবণ্য আমি আজও ভুলতে পারি না। সেই শোক আমি সারা জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারব না। মিঞা, যৌবনের ভালবাসার আগুন যদি এখনও আপনার মধ্যে বেঁচে থাকে, সেই ভালবাসা এখন আল্লার পায়ে। রাখুন। খোদাই শেষ কথা, আর সবই মরীচিকা।

এই যে দুটো চিঠি, যা একই সময়ে আপনি লিখেছিলেন, এর মধ্যে কে আসল মির্জা গালিব? কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ, মির্জাসাব? আপনাকে আমি ভালবাসি, আপনার ছন্নছাড়া জীবনের দিকে তাকিয়ে আমার দুচোখে জলের পর্দা দুলে ওঠে, কিন্তু মুখ আর মুখোশের এই দ্বন্দ্বকে আমি মানতে পারি না। আমি সত্যিই খুব সোজাসাপটা মানুষ, আপনার গোলকধাঁধায় আমি হারিয়ে যাই। আপনাকে শয়তান বলেও খারিজ করতে পারি না, অথচ এক এক সময় আপনি শয়তানেরও অধম। আপনি এই মুহূর্তে যাকে ভালবাসেন, পরের মুহূর্তেই তাকে নিয়ে মজা করতে পারেন। একেই বোধহয় বাদশাহি চাল বলে। এ কী, এ কী, আপনি শুয়ে পড়ছেন কেন আবার? আমার কথাগুলো সহ্য হচ্ছে না, তাই না? আমি জানি মির্জাসাব, নিজের বিরুদ্ধে একটা কথাও আপনি সহ্য করতে পারতেন না, আমির খসরুর পরেই আপনি, মাঝখানে আর কেউ নেই, এ কথাটা কখনও ভুলতে পারেন না, না? আমিও বিশ্বাস করি মির্জাসাব, আমির খসরুর পরে একমাত্র আপনিই লিখতে পারেন এমন শের :

বেতলব দে তো মজা উস-মে সিবা মিলতা হৈ;
বোহ্ গদা জিস-কো নহ্। হো খু-এ সবাল, আচ্ছা হৈ।।
(না-চাইতেই যদি দেন তিনি তো তার স্বাদই আলাদা;
সেই ভিখারি -শ্ৰেষ্ট, হাত পাতার অভ্যেস হয় নি যার।)

কিন্তু বার বার কেন এত নানারকম মুখোশ পরেন আপনি? কার ভয়ে? কার আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে?

-মান্টোভাই

-জি, মির্জাসাব।

-আপনি আমাকে নিয়ে কিস্সা লিখছেন বলে আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফর্দাফাই করতে পারেন না।

-কিন্তু আমি আপনাকে বুঝতে চাই।

-সে চেষ্টা করবেন না। মারুফসাবের বাড়ি থেকে আমি কেন বেরিয়ে এসেছিলুম জানেন। সেখানে তো সুখেই ছিলুম। কিন্তু প্রতি পদে তিনি আমাকে বুঝতে চাইতেন, মাপতে চাইতেন। কী অধিকার আছে আপনার আমাকে পুরোপুরি বুঝতে চাওয়ার?

-মানুষ তো মানুষকেই বুঝতে চেয়েছে, মির্জাসাব।

-বাখোয়াস বন্ধ করুন। মানুষ, মানুষ করে আপনাদের এত বড় বড় বুলি আমার সহ্য হয় না। বোঝার নাম করে আপনারা আসলে একজনকে সতরঞ্জের একটা-খোপে আটকে রাখতে চান। কী বুঝবেন আমাকে? আপনি কোনওদিন আমার স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ভেতরে ঢুকতে পারবেন? আপনি বুঝতে পারবেন, কেন আমি সারা রাত ঘুমের ভেতরে নিজের সঙ্গে কথা বলে যেতুম? আমি আমার কষ্টের কথা বলছি না। অপমানিত হতে হতে আমি আর অপমান গায়ে মাখতুম। না। মানুষ সবচেয়ে আনন্দ পায় তার পাশের মানুষকে অপমান করতে পারলে। কী ঢং-এ করে জানেন? তোমাকে আমি খুব ভালবাসি, এই কথা বলতে বলতে। লিখে নিন, আমি কাউকে ভালবাসতুম না। তাই অপমান করে গেছি, ঠাট্টা মশকরা করেছি। কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি বলে কাউকে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলিনি। এই দুনিয়াদারিটা আপনার চেয়ে অনেক বেশীদিন আমি দেখেছি। শুনুন মান্টোভাই, একজন মানুষ নিজেই বলি, নিজেই জহ্লাদ ভাবতে পারেন? সে আমি-মির্জা গালিব। লিখতে গিয়ে কালি যেমন কাগজ ছেপে ছলকে যেতে পারে, তেমনি আমার নিয়তি পুঁথি, নির্বাসিতের রাতের চিত্রলিপি।

-মির্জাসাব

-বলুন।

-আপনাকে আমি কাটাছেঁড়া করছি না।

-মান্টোভাই, কেউ বেশীক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেই অস্বস্তি হত। কেন জানেন? সবাই একটা আসল মির্জা গালিবকে খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু আমই তো একটা ছায়া ছাড়া আর কিছুই ছিলুম না।

-কার ছায়া মির্জাসাব?

-আমি তাঁকে সারা জীবনেও দেখতে পাইনি। ভোরের আজান শুনতে শুনতে মনে হত, তিনি আছেন, কোথাও আছেন, শুধু তাঁর ছায়া হয়ে আমি এই দুনিয়াতে পড়ে আছি।

-আমিও তারই ছায়া মির্জাসাব।

-বহুৎ খুব। এবার তা হলে আপনার ইকের কিস্সা শোনান। তেমন কিছু ঝুলিতে আছে তো? কোন এক ইসমতের কথা বারবার বলেন। আমি একটু শুয়ে শুয়ে শুনি।

.

কুয়াশার পর্দা দুলছে, তার ওপারে যেন আমার একটা জীবন।

ইসমতের কথা পরে বলা যাবে, ভাইজানেরা। আজ যদি কবরে শুয়ে আমি স্বীকার করি করি, ইসমতকে আমি ভালবাসতাম, সেও কি বাসত না আমাকে, ওপরের দুনিয়ার ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গিয়েছিলাম, চাপা দিতে চেয়েছিলাম, নইলে বন্ধুত্বটুকু বেঁচে থাকত না। ভালবাসা নিয়ে অনেক কথা বলেছি আমরা, কিন্তু আমি সবসময়েই এমন একটা ভাব করেছি যে মহব্বৎ আসলে একটা কথার কথা, ও শব্দটার কোনও মানেই নেই। একবার আমি ওকে বললাম, কী মহব্বৎ বলতে তুমি কী বোঝ বলো তো?

-আমি তো তোমার কাছে শুনতে চাই মান্টোভাই।

-আমি-আমি কেন-আর আমি তো কতবার বলেছি, ওসব ভালবাসা-টাসা আমি বুঝি না।

-সবসময় একগুঁয়েমি করো না।

ইসমতের ধমকে আমি হেসে ফেলি।-তা হলে বলি শোন। আমি আমার সোনালি জরির এমব্রয়ডারি করা জুতো ভালবাসি, রফিক ওর পাঁচ নম্বর বিবিকে ভালবাসে। এই হচ্ছে মহব্বৎ

-মান্টোভাই তুমি নিজেকে কী মনে করো?

-কিছু না বহিনজি। আমি তো কতবার বলেছি, আমি একটা ফ্রড।

-আবার সেই কথা।

-এবার তুমি বলো, প্রেম কী?

-একজন যুবক আর যুবতীর মধ্যে যা জন্মায়।

-ওঃ তাই বলো। তা হলে আমিও প্রেমে পড়েছিলাম, বলা যায়।

-কীরকম? ইসমত বড় বড় চোখে তাকায়, যেন আমার কথা সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

সেই কিস্সাটা আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি, মির্জাসাব। আমার জীবনে প্রথম রামধনু দেখা। তখন আমার বয়স হবে বাইশ-তেইশ। তিনবারের চেষ্টায় ম্যাট্রিক পাশ করার পর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি-তে। আমার ফেল মারা দোস্ত সয়ীদ কুরেশীও সঙ্গে ছিল। কিন্তু ইউনিভার্সিটির কঠোর নিয়মকানুনের সঙ্গে আমি মানিয়ে চলতে পারতাম না। তবে ওখানকার শিক্ষক-ছাত্ররা অনেকেই আমাকে ভালবেসে ফেলেছিল। মানিয়ে নিতে না পারার জন্য শরীরটাও খারাপ হতে লাগল। বেশ কয়েক বছর ধরেই বুকে ব্যাথা হত, তার সঙ্গে জ্বর। অসুখটা এত বেড়ে গেল, এত ব্যথা হত যে দুহাটু বুকের কাছে এনে আমি বসে থাকতাম। এইভাবে বসে থাকার অভ্যেস আমার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল। ব্যাথা ভুলতে দেশী মদ খেতে শুরু করলাম। কিন্তু নেশার সময়টুকু ছাড়া তো ব্যথা থেকে নিস্তার নেই। দিল্লিতে এলাম চিকিৎসা করাতে। এক্স-রে করে ধরে পড়ল, আমার টিবি মানে রুহ্ আফ হয়েছে। ইউনিভার্সিটি ছাড়তে হল। চিকিৎসা চালানোর মতো টাকাও নেই। দিদি ইকবাল বেগম এসে বাঁচাল। সব খরচ দিয়ে দিদি আমাকে পাঠাল বাতোত-এর এক হাসপাতালে। বানিয়ালের দিকে জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়েতে পাহাড়ের ওপর বাতোত এক আশ্চর্য দ্বীপ যেন। জীবনে সেই প্রথম ও শেষবার আমি দুনিয়ার সেরা সৌন্দর্য দেখেছি, ভাইজানেরা। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, পাইন চিনার-মজনুর অরণ্য কিছু দূরেই যেন হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায়, হিমালয়ের তুষারঢাকা কত যে শৃঙ্গ। সারা জীবন ওইরকম একটা জায়গায় যদি থেকে যেতে পারতাম আমি।

ওর নাম সত্যি সত্যিই কী ছিল, আমি ভুলে গেছি। হ্যাঁ, বেগু বলেই ডাকতাম মনে হয়, কখনও। ওয়াজির, কখনও বা বেগম বলেও ডেকেছি। পাহাড়দেশের মেয়ে সে, গায়ের রং ছিল। একেবারে গোলাপের মতো, আর লজ্জা পেলে তার মুখ হয়ে যেত ভোরের সূর্যের মতো। সারাদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ছাগল চড়িয়ে বেড়াত বেগু। মাঝে মাঝেই কোনও ছাগল হারিয়ে গেলে মুখের কাছে দুহাত এনে তাকে ডাকত বেগু আর তার ডাকের প্রতিধ্বনিতে পাহাড় যেন। প্রাণ পেয়ে জেগে উঠত।

এমন মেয়েকে এ-দুনিয়া সত্যিই একেবারই পায়। সরু, লম্বা নাক। আর চোখ? অমন চোখ আমি খুব কম দেখেছি। বেগুর দুচোখ যেন ধরে রেখেছিল পাহাড়ের গভীরতা। লম্বা, পুরু। আমার সামনে দিয়ে যখন হেঁটে যেত, মনে হত, সূর্যের একটা রশ্মি এসে ওর চোখের পাতায় আটকে আছে। চওড়া কাঁধ, গোল গোল হাত। আর বুক দুটোকে মনে হত পাহাড়ি মুরগির মতো। একটুও বানিয়ে বলছি না, ভাইজানেরা, এই সৌন্দর্য একমাত্র দেখা যায় পাহাড়ি মিনিয়েচার ছবিতে। তার রূপের কথা বলতে হলে ওইসব ছবিতে দেখা অভিসারিকা রাধার কথাই বলতে হবে। পাহাড়ি পথে তাঁর হাটা, মাঝে মাঝে গান গেয়ে ওঠা, নিজের মনে মুচকি হাসা, যেন কারোর সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খায় সে পাকদণ্ডি পথ বেয়ে চলেছে। সে এক অভিসারযাত্রাই।

আমি যখন বেগমকে প্রথম দেখি, মনে হল, আমার ভেতরে এত দিন ধরে জমে থাকা অন্ধকারে বিদ্যুৎরেখা ঝলসে উঠল। বেশ কয়েকদিন গাছের আড়াল থেকে আমি ওকে দেখতাম। বেগম তার ছাগল-ভেড়াদের সুর করে ডাকত, যেন সে কোনও গানের কলি হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, আর সেই ডাকের প্রতিধ্বনি আমার ভেতরে একটা সম্পূর্ণ গানের ঝরনার মতোই এসে ফেটে পড়ত। একদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলাম, আর সে ভয় পাওয়া হরিণীর মতো আমাকেই আঁকড়ে ধরল। আমার খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল, ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেও গিয়েছিলাম, কিন্তু এক ঝটকায় আমাকে ঠেলে দিয়ে বেগু পালাল। আর ওই চেষ্টা করিনি। কিন্তু ও একদিন নিজে থেকে এসেই আমার সঙ্গে কথা বলল। তারপর দিনের পর দিন বসে বসে আমরা যে কত গল্প করেছি। ভাইজানেরা, সেসব আমার পুরো মনে নেই। জানেন তো, মদ প্রথমে মাথাটাকে খায়, সব স্মৃতি আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে, জীবনে যা ঘটেনি, তাকেও সত্যি বলে মনে হয়।

বেগমকে আমি আমার ভালবাসার কথা জানিয়েছিলাম। ও খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।

তারপর ওড়নার খুঁট দাঁতে চিবোতে চিবোতে বলল, তুমি তো এই সরাইখানা থেকে চলে যাবে। তখনও ভালবাসবে আমাকে?

-কোথায় সরাইখানা?

-এই সরাইখানা।

-এই পাহাড় সরাইখানা! আমি তার কথায় হেসে ফেলি।

-দাদি বলে–

-কী বলে?

বেগু আর কিছু বলেনি। আমি বুঝতাম, সব কথা বলার মতো ভাষা নেই। কিন্তু ও অনুভব করতে পারে। মির্জাসাব, অনেকদিন পর একটা গল্প শুনে বেগুর কথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

মাফ করবেন ভাইজানেরা, কিস্যাটা এখানে আমাকে বলে নিতেই হবে। না হলে, কী করে আপ্নারা বুঝবেন, একটা সরাইখানাতেই আমাদের দুজনের বেগমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল?

ইব্রাহিম ইবন আদম একদিন দেওয়ান-ই-আম-এ বসে আছেন। রয়েছে তাঁর উজিরেরা, অন্য প্রজারা। এমন সময় লম্বা দাড়িওলা, ছেঁড়া আলখাল্লা পরা এক ফকির সোজা এসে সম্রাটের সিংহাসনের সামনে দাঁড়ালেন।

-কী চান আপনি? ইব্রাহিম জিজ্ঞেস করলেন।

-একটু দাঁড়াতে দিন। সবে তো এই সরাইখানায় এসে পৌঁছলাম।

-আপনি পাগল নাকি! ইব্রাহিম চড়া গলায় বলে উঠলেন, এটা সরাইখানা নয়, আমার প্রাসাদ।

-আপনার আগে এই প্রাসাদ কার ছিল? ফকির জিজ্ঞেস করলেন।

-আমার ওয়ালিদের।

-তাঁর ওয়ালিদের।

-তার আগে?

-সে অনেক পুরুষের কথা।

-তাঁরা এখন কোথায়?

-এত দিন বেঁচে থাকবেন নাকি? সকলেই গোরে গেছেন।

-যেখানে মানুষ আসে আর যায়, সেটা সরাইখানা ছাড়া কি? কথাটা বলেই ফকির অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

বেগুর দাদি ঠিকই বলেছিল, একের পর এক সরাইখানা পেরিয়েই তো আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই।

বেগু একদিন বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করে থাকবে না তো?

-কেন?

-ওই যে সেদিন-

-কী?

-তোমাকে চুমু খেতে দিইনি।

-আমি ভুলে গেছি বেগম।

-জানো, সবাই যে কেমন করে আমার সঙ্গে। এসে বলবে, তোর চোখ দুটো কী সুন্দর, তোর ঠোঁট দেখলে চুমু না খেয়ে থাকা যায় না। আমি কী বলি বলো তো? আমার এসব শুনতে বাল লাগে না। তোমাকেও আমি ওদের মতো ভেবেছিলাম।

-তা হলে আমি কী করব?

বেগু গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল। হেসে বলেছিল, তুমি ওদের মতো না, তুমি শরিফ।

একদিন দেখি বেগুর কুর্তার পকেট ভর্তি কী সব জিনিস। আমি বললুম, পকেট ভরে কী এত নিয়ে চলেছ?

-বলব না। বেগু বেণী দুলিয়ে হাসল।

-বলবে না? দাঁড়াও। আমি ওর হাত চেপে ধরলাম।-দেখাও, কী আছে। দেখাতেই হবে।

-ছোড় দিজিয়ে না-

-না, দেখাতেই হবে।

বেগু অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে একের পর এক আশ্চর্য সব জিনিস বার করতে লাগল। চিনারের শুকনো পাতা, খালি দেশলাই বাক্স, কয়েকটা নুড়ি পাথর, খবরের কাগজ থেকে কাটা হলুদ হয়ে যাওয়া একটা ছবি, চুলের ফিতে। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই দেখাবে না। হাতের মুঠোয় চেপে দাঁড়িয়ে রইল।

-ওটা কী?

-না দেখাব না।

-ঠিক আছে। আমি হেসে ফেললাম।-এবার যাও।

বেগু অনেকটা চলে যাওয়ার পর ফিরে এল। আমি একটা গাছের নীচে বসেছিলাম। দূর থেকে হাতের জিনিসটা সে আমার কোলে ছুঁড়ে দিয়ে দৌড় লাগাল। কী হল জানেন? একটা লজেন্স। আমি অবাক হয়ে গেলাম, কেন সে অমন লজ্জা পেয়েছিল লজেন্সটা দেখাতে, কেনই বা ফিরে এসে আমাকে দিয়ে চলে গিয়েছিল। মির্জাসাব, সেদিনই বেগমের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আর তাঁকে দেখিনি। দুয়েকদিনের মধ্যে আমিও বাতোতকে বিদায় জানিয়েছিলাম। লজেন্সটা আমার জামার পকেটেই রয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। বেগমের একমাত্র স্মৃতি। কিন্তু স্মৃতি আর কতদিন বাঁচে বলুন, একদিন ড্রয়ার খুলে দেখলাম, লজেন্সটাকে ঘিরে বেশ ভোজ জমে গেছে পিঁপড়েদের।

ইসমতকে একদিন বেগমের কথা বলেছিলাম। সব শুনে সে বলল উঠল, এটা একটা প্রেম হল, মান্টোভাই? তোমার কাছ থেকে আমি একটা দুর্দান্ত লাভ স্টোরি আশা করেছিলাম। হাস্যকর।

-কেন হাস্যকর কেন?

-একটা পচা, থার্ড ক্লাশ লাভ স্টোরি। একটা চিনির ড্যালা পকেটে নিয়ে ফিরে এসে ভাবলে, কী নায়কের মতো কাজই না করেছ। ছ্যাঃ ছ্যাঃ।

আমি চুপ করে গিয়েছিলাম।

-কী হল? কিছু তো বলো। ইসমত আমাকে খোঁচাতে লাগল।

-কী করতাম ইসমত? কী করলে তুমি খুশি হতে?বেগমের সঙ্গে শুয়ে ওর পেটে একটা অবৈধ বাচ্চা রেখে আসতাম, তাই তো? তা হলে লাভ স্টোরিটা জমত, না? হাতের পেশী ফুলিয়ে বলা যেত, আমার মতো পুরুষ দুনিয়ায় নেই। হাঃ হাঃ, আমাকে কি তুমি এইরকম দেখতে চেয়েছ ইসমত?

ইসমত আমার হাত চেপে ধরেছিল, তার দুচোখে কুয়াশা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *