১৫. চোখ বুজে শুয়েছিলুম

মুহব্বৎনে জুলুমৎসে কাঢ়া হ্যায় নূর
মুহব্বৎ নহ্ হোতী নহ্ হোতা জুহুর।
(প্রেমই তমসার মধ্যে রচনা করেছে জ্যোতি,
প্রেম না থাকলে প্রকাশ সম্ভব হত না।)

মান্টোভাই, আপনি ঠিকই ধরেছিলেন, আমি ঘুমাইনি, চোখ বুজে শুয়েছিলুম, আসলে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ১৮৫৭-র পর থেকে আমার আর জেগে থাকতে ইচ্ছে করত না, সত্যি বলতে কী, খোদার কাছে তখন আমার শুধু একটাই প্রার্থনা ছিল, আর-রশিদ, আমাকে এবার। কবরের পথটা দেখিয়ে দিন। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু বান্ধব হারিয়ে আমাকে তবু আরও বারোটা বছর বেঁচে থাকতে হল। তা তো হবেই। আমার জীবনে কীই বা আর ঠিকমতো হয়েছে! তাই আস্তে আস্তে নিজেকে আমি বাইরে থেকে দেখতে শিখেছি, নিজের দুর্দশা দেখেই আনন্দ পেয়েছি। হয়তো হাসবেন, তবু বলি, আমি একসময় নিজেকে শত্রুর চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করেছিলুম। কিসমতের এক-একটা চাবুকের ঘা আমার গায়ে এসে পড়েছে, আর আমি চিৎকার করে নিজেকেই বলেছি, দ্যাখ, দ্যাখ, কুত্তা গালিবটা আবার মার খেয়েছে। কত গর্ব ছিল না তোমার। গালিব? তোমার মতো শায়র আর নেই, ফারসিতে তোমার সমকক্ষ কে আছে? এখন দ্যাখো, তোমার নামের পাশে কী লেখা আছে! কী? তুমি শালা দোজখের বাসিন্দা। নিজেকে গালাগালি করতে করতে কেঁদে ফেলতুম। তারপর একসময় চোখ থেকে আর জলও বেরোত না, চোখের ভেতরটা মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করত। আমি তার কাছে প্রার্থনা জানাতুম, আল্লা, আর পানি নয়, এবার আমার দুচোখ থেকে রক্ত ঝরে পড়ুক, আমি দুহাতে রক্ত মেখে, সারা মুখে রক্ত লেপে এতিমের মতো মরে যেতে চাই। কিন্তু আল্লা আমাকে পৃথিবীতেই দোজখ দেখিয়ে কবরে পাঠাবেন। কেন জানেন? আমার একটাই গুনাহ্। এই নশ্বর জীবনটাকে তো খোদা একেবারে মুছে দিতে চান, আমি সেই জীবনের কয়েকটা মুহূর্তকে অনন্তের স্বাদ দিতে চেয়েছিলুম-আমার গজলে। খোদা তার জন্য শাস্তি দেবেন না? দেবেনই তো। কে হে তুমি মির্জা গালিব, খোদার দুনিয়ার পাশে শধু শব্দ দিয়ে আরেকটা দুনিয়া তৈরি করতে চাও? বেওকুফ! তুমি কবিতা লেখো, কিস্সা বানাও, তসবির আঁকো, সুর বাঁধো-তুমি বেওকুফ ছাড়া কী! কিন্তু আপনি কী করবেন, মান্টোভাই? শব্দকে যে আমি ভালবাসি, শব্দ ছেনে ছেনে রং বার করি, শব্দের গভীরে ঢুকে সুর শুনতে পাই, অন্ধকারকেও দেখতে পাই-এসব যে আমি পারি, তা তো আল্লারই দান। তবু তিনি আমাকে শাস্তি দেবেন? আমি অনেক পরে এই শাস্তির অর্থ বুঝেছিলুম। যাকে দেখা। যায় না, তাকে তুমি দেখেছ; যা শোনা যায় না, তা তুমি শুনেছ; যাকে অনুভব করা যায় না, তাকে তুমি অনুভব করেছ; এজন্য তো তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। অনন্তের স্বাদ পাওয়ার জন্যই নরক-জীবন দেখতে হবে তোমাকে। আল হাল্লাজকে যেমন শাস্তি পেতে হয়েছিল। একটা নতুন দুনিয়া গড়তে চাও তুমি, আর তার ভার বহন করবে না, তা কখনও হয়?

কিন্তু দিল্লিতে আসার পর প্রথম দশ-বারো বছর এসব কিছুই ভাবিনি, একটু আগে আপনি বলেছিলেন না যে দিবানখানায় বসে আমি কাঁদতুম, ওটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। না, মান্টোভাই, আমি তখনও কাঁদতে শিখিনি। হতাশ হয়েছি বিরক্ত হতুম, একাও লাগত খুব মাঝে মাঝে, কিন্তু তখনও আমার চোখে মেঘ দেখা দেয়নি। মাটি ভিজবে, বাস্প তৈরী হবে, আকাশে উঠবে, তারপর তো মেঘের দেখা; সেজন্য তো সময় লাগে। আর তখন তো আমি তরতাজা যুবক। আমার দিকে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকত। কেন জানেন? আমার গায়ের রং ছিল জুইফুলের মতো সাদা। এই যে ঝুঁকে পড়া, চামড়া কুঁকড়ে যাওয়া গালিবকে দেখছেন, একে দেখে সেই গালিবের আন্দাজ পাবেন না আপনারা। লম্বা, পেটানো চেহারা, মাথাভর্তি কোঁকড়া কালো চুল, নিজেই চুলে আঙুল চালিয়ে মখমলের স্পর্শ টের পেতুম। পর্দার আড়াল থেকে কত যে বেগম আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, তা আমি বুঝতে পারতুম, মান্টোভাই। আর তাকাবেই না কেন? দিল্লিতে কটা লোক ছিল আমার মতো? সবাই তো একইরকম। পোশাক পরত, তাদের বড় বড় চুল আর মুখ ভরা দাড়ি। সব ভেড়ার পাল, বুঝলেন তো! তাই মির্জা গালিব যখন রাস্তা দিয়ে পালকি চেপে যেত, তার দিকে লোকজন তাকিয়ে থাকবে না, তা কি হতে পারে? পাজামার ওপর মিহি কাপড়ের কুর্তা, আর সেই কুর্তার বুকের ওপর জামদানি কাজ, কত ফুলের বাহার, কত নকশা, মাথায় লম্বা কলাহ্ পপাখ টুপি। আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা, সব কিছুতেই তা ফুটিয়ে তুলতুম। এসব শিখেছিলুম মির্জানামা থেকে। সে এক কিতাব ছিল ভাইজানেরা, ঠিকঠাক মির্জা হওয়ার আদব-কায়দা সেখানে লেখা ছিল। মির্জা কি যে কেউ হতে পারে? তার তরিকা আছে না? পোশাকে-ব্যবহারেই বোঝা যাবে, কে মির্জা, আর কে নয়। নিজের সমান মানুষ ছাড়া মির্জা কখনও যার-তার সঙ্গে কথাই বলবে না। আম। আদমির চেয়ে সে আলাদা, তা বোঝানোর জন্য মির্জা হেঁটে কোথাও যাবে না, সবসময় যেতে হবে পালকিতে চড়ে। বাজারে গিয়ে কিছু পছন্দ হলে, দাম যা-ই হোক মির্জা কিনে নেবে; অন্যদের মতো দরাদরি করবে না। আর কী করতে হবে? হাভেলিতে রইস আদমিদের ডেকে মেহফিল বসাতে হবে। একটা কথা শুনে রাখুন। সবাই যে তামাক খাবে, তা হতে হবে সুগন্ধি আর হাশিস মেশানো। শরাবে মেশাতে হবে মুক্তাচূর্ণ। মির্জা হতে হলে আপনাকে সাদির গুলিস্থান আর বুস্থান স্মৃতি থেকে বলে জানতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, আপনি যখন। কথা বলবেন, তাতে যেন ব্যাকরণের ভুল না থাকে। মাঝে মাঝে গজলের বয়েৎ বলতে হবে। ফুলের মধ্যে তার প্রিয় হবে নার্সিসাস। আর ফলের মধ্যে নারঙ্গ। তার কাছে আগ্রার কেল্লাই দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা; আর পারস্যের সবচেয়ে ভাল শহর ইস্পাহান। মাথায় যারা বড় পাগড়ি বাঁধে, মির্জা তাদের সবসময় ঘৃণা করবে।

বুড়ো হবার পর সেই মির্জা গালিবের দিকে তাকিয়ে আমার হাসি পেত খুব। আসলে কী। জানেন, মানুষ যখন কোনও স্বপ্নে বুদ হয়ে থাকে, তখন সে এভাবেই সবার থেকে নিজেকে অন্যরকম মনে করে, তারপর স্বপনভঙ্গের সময় শুরু হলে সে আস্তে আস্তে মাটিতে পা রাখতে শেখে, বুঝতে পারে, অন্যরকম হতে চাওয়াটা আসলে যৌবনের ঔদ্ধত্য; সত্যি তো এই যে, প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা আলাদা, কেউ কারোর সঙ্গে মেলে না, সবাই অন্যরকম। এই সত্য বোঝবার জন্য, জীবনের পথে অনেক কারবালা পেরিয়ে আসতে হয়, মান্টোভাই।

না, না, বিরক্ত হবেন না ভাইজানেরা, উঁইফুলের মত সাদা যে-গালিবের কিস্সা আপনারা শুনতে চাইছেন, তা আমি আপনাদের শোনাব। কিন্তু মনে রাখবেন, জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে যখন নিজের জীবনটাকে দেখা হয়, তখন সেই গল্পটা তো সোজা পথে চলে না, নানা কথার ডালপালা এসে তাকে ঘিরে ধরে; একটা শেষ হওয়া জীবনকে আমি ফিরে দেখছি, সেই জীবনের সামনে। নতুন আর কোনও পথ খুলে যাবে না, তাই আমার অনেক কথা মনে হবে, যদি এমনটা না হয়ে অমন হত, তা হলে কেমন হত, আমি কোনও কথাকেই এখন আর ফেলে দিতে পারব না।

মান্টোভাই, আপনি ঠিকই বলেছেন, মারুফসাবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমি ডানা মেলার সুযোগ পেলুম। ওখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একটা লোক গজল লিখতে চায়, আবার জ্ঞানও দিতে চায়, এসব মানুষকে বেশীক্ষণ সহ্য করা যায় না। এদের জীবনটা ফিতের মতো, আর সেই ফিতের মাপে অন্যের জীবনকেও হেঁটেকেটে নিতে চায় তারা। কিন্তু আমি। একটা এতিম, ওয়ালিদকে কখনও দেখিনি, আমার কাছে তো জীবনের কোনও মাপজোক ছিল না। সব্বান খানের হাভেলি ভাড়া নিয়ে আমি নিজের মত করে বাঁচার স্বাদ পেলুম। মদ। খাওয়া, জুয়া খেলা, কোঠায় যাওয়া থেকে এখানে কে বাধা দেবে আমায়? এক একদিন রাতে বেগমের সঙ্গে শুয়েছি, যন্ত্রের মত যা করার করে গেছি, তার বেশী বেগমও কিছু চাইত না, তার কাছে দুটো শরীরের মিলনের অর্থ, বাচ্চা পয়দা হোক। তো পয়দা হয়েছে তারপর এক-দেড় বছরের মধ্যে তারা মরেও গেছে। কী করে বাচবে বলুন? এসব তো ভালবাসার পয়দা নয়। তবে এও ঠিক, আমিও তো ওদের বাঁচা-মরার দিকে নজর দিইনি। ওরা কেউ কেউ বেঁচে থাকলে বেগমের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হয়তো এমন ঠাণ্ডা হয়ে যেত না। আর আমি তো তখন অন্যরকম হওয়ার নেশায় বুদ হয়ে আছি। এ এমন এক নেশা মান্টোভাই, যখন আপনি মানুষকে মানুষ বলেই মনে করবেন না, হাসিঠাট্টায় সব কথা বরবাদ করে দিতে চাইবেন। আমার সে ক্ষমতাও ছিল। তা হলে একটা গপ্পো বলি শুনুন। এক মোল্লা একদিন আমার সামনে শরাব খাওয়া নিয়ে যাচ্ছেতাই সব কথা বলে যাচ্ছিল। মদ হারাম, তাই তোমাকে দোজখে যেতেই হবে। অনেকক্ষণ শোনার পর আমি আর চুপ করে থাকতে পারলুম না, বললুম, শরাবে এত কী খারাপ আছে মিঞা?

শরাবি তা বোঝে না।

-কে বোঝে!

-খোদা এসবের হিসাব রাখেন।

-কী হিসাব রাখেন?

-শরাবির প্রার্থনা কখনও কবুল হয় না।

আমার ভিতর জমা হওয়া হাসি এবার ফেটে পড়ল। বললুম, মিঞা, আমার কাছে শরাব আছে, সে সব ভুলিয়ে দিতে পারে, কীসের জন্য আর প্রার্থনা করব তা হলে?

শরাবির প্রার্থনা সত্যিই কবুল হয় না, আজ আমি বুঝি, মান্টোভাই। শরাবির মাথাটা এমন একটা জায়গায় আটকে থাকে, সে অন্য কিছু আর দেখতে পায় না, তবু আমি মদ ছাড়তে পারিনি; নেশা এমন একটা বদ্ধ জায়গা তৈরি করে দেয়, যা ছেড়ে আর বেরিয়ে আসা যায় না, সেখানেই শুধু ঘুরপাক খেতে হয়, আর ওই ঘূর্ণির মধ্যে আপনি দিনের পর দিন আরও একা হয়ে যেতে থাকেন।

সত্যি বলতে কী, শাহজাহানাবাদে তো আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছিলুম, শায়ের হিসাবে আমার নামও ছড়াচ্ছিল, তবু মুশায়েরা পর মুশায়েরায় আমাকে অপমান করার লোকের কমতি ছিল না। জওক, মোমিনদের মতো ধরাবাঁধা বুলির গজল আমি লিখতে চাইনি। এক একটা শব্দ ছিল আমার কাছে স্ফটিকের মতো, হৃদয়ের আলো পড়লে শব্দ থেকে রামধনুর জন্ম হয়। কালে মহলের ভেতরে ঘুড়তে… আকবরাবাদের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি শব্দদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অঞনিৰ্বর শুনতে পেতাম, মান্টোভাই। শব্দদের ভেতরে কারা কাঁদত জানেন? আকাশ-বাতাস-অন্তরীক্ষে হারিয়ে যাওয়া আত্মারা। গজল লিখতে লিখতে আমি তাদের হতাশ্বাস শুনতে পেতুম। রোজ যারা মুশায়েরা মাতায়, তারা কেন বুঝতে চাইবে আমাকে? তাদের কাজ তো একটাই, ওই শালা গালিবকে হঠাও, ওকে অপমান করো, ও যেন কিছুতেই দরবারে জায়গা না পায়। শালা, কাউকে মানে না, কাউকে বুজুর্গ মনে করে না। হ্যাঁ, করি না তো, আমি জানি, আমির খসরুর পর একমাত্র আমিই, আমিই ফারসিতে গজল মান রাখতে পারি। ফারসিতে যার গজল লেখার দম নেই, তাকে আমি কবি বলি না, মান্টোভাই। এসব কথা বলার মতো কোন মানুষ ছিল না আমার জীবনে। আমি একা একা, নিজেকে শুনিয়ে বলে যেতুম আমার কথাগুলো।

এইরকম সময়েই সে এসেছিল আমার জীবনে, ভাইজানেরা। প্রথমে আমি শুধু তার চোখ দুটো দেখেছিলুম। আর দেখামাত্রই মীরসাবের সেই শেরটা মাথার ভেতর গুনগুন করে উঠেছিলঃ

জীমেঁ কেয়া কেয়া হ্যায় অপনে অয় হম্‌দম।
পর সুখন তা বলব নহীঁ আতা।
(মনের মধ্যে কত কী আছে, হে দরদী বন্ধু,
কিন্তু কোন কথা ঠোঁট পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না।)

সেদিন প্রচুর শরাব খেয়েছিলুম। কোঠা থেকে বেরিয়ে আর হাভেলিতে ফিরতে পারিনি। কোঠার বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কে যেন একসময় আমাকে ঘুমের অন্ধকার থেকে টেনে তুলেছিল। আমি দেখেছিলাম শুধু দুটো চোখ, সুরমার রেখা আর চিকন জাল।

 -মির্জাসাব।

শীতের রাতের হাওয়ার মতো এক কণ্ঠস্বর আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি শুধু চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিলুম আর সেই চোখের ভেতরে কত যে পাখিরা উড়ছিল, যেন ভোর হয়ে গেছে, আমার জীবনে দেখা প্রথম ভোর, দুটো চোখের ভেতরে। যেন শিল্পী বিজাদের তুলি হাওয়ার

শরীরে চোখ দুটো এঁকে দিয়ে গেছে।

-মির্জাসাব

-কওন হো তুম?

-ঘর কিউ নেহি লওটা?

-ঘর? আমি হেসে ফেললুম।

-কাহাঁ হ্যায়?

-হাবাস খান ফটক মে।

-ওখানে তো আমার ঘর নেই।

সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, চলুন, আপনাকে হাভেলিতে পৌঁছে দিয়ে আসি।

-কিউঁ

-আপনি এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকবেন না, মির্জাসাব।

-কেন মিঞা?

-আপ বেনজির শায়র হ্যায় জি।

-বেনজির?

-সচ্‌।

-বেনজির?

-জি মির্জাসাব।

-ফির বোলো–

-বেনজির হ্যায় আপ।

আমি তার হাত চেপে ধরলুম। কী উত্তাপ, কী উত্তাপ। আমি তার হাতে মুখ রাখলাম। তার হাতের মাংস চুষতে লাগলুম। গভীর কৃষ্ণবর্ণ সে। আর এত কালো বলেই অন্ধকারে এমন উজ্জ্বল।

-ছোড় দিজিয়ে জনাব।

কিন্তু আমি তার অন্ধকারের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলাম। তাকে বুকে আঁকড়ে ধরতে না পারলে স্বস্তি হচ্ছিল না। সে-ও ধরা দিয়েছিল, কোনোরকম বাধা না দিয়ে। মান্টোভাই, এই প্রথম একজন মেয়ের শরীরে আমি ভেজা মাটির গন্ধ পেলুম। বৃষ্টি হওয়ার পর গাছের গোড়া থেকে যেমন গন্ধ বেরোয়, ঠিক সেইরকম গন্ধ। এ তো কোঠার তবায়েফের শরীরের আতরের খুশবু নয়, এ সেই ভেজা আদিম পৃথিবীর অন্ধকার গন্ধ। মান্টোভাই, আমি ওই গন্ধেই মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলুম। সে কোনও কোঠার মশহুর বায়েফ ছিল না। সামান্য এক ডোেমনি। ডোমনি কাকে বলে জানেন তো? ডোমনিরা লোকের বাড়িতে শাদিতে-উৎসবে নাচা-গানা করে টাকা রোজগার করে, তা বাদে, পুরুষদের সাথে বিছানাতেও যায়; তবে কোন রইস মির্জা ডোমনিকে ছুঁয়েও দেখবে না। ডোমনিদের ভাবসাব, কথাবার্তাও ছিল একেবারে নর্দমার মতো। কিন্তু মুনিরা-মুনিরাবাই সবার চেয়ে আলাদা ছিল।

সেইদিনের পর থেকে মুনিরাবাইয়ের ঘরেই আমার আশ্রয় মিলল। সে আমারই গজল শুধু গাইত। গাইতে গাইতে কৃষ্ণবর্ণ মুনিরাবাইয়ের মুখে লাল মেঘের আলো ছড়িয়ে পড়ত। -মুনিরা -জি। -আমার গজল তুমি কোথায় শুনলে? মুনিরাবাই হেসে বলত, জি আশমানসে আয়া।

-আশমানসে?

-জি।

-কোথায় সেই আকাশ, তারা?

-জি, ইধর। মুনিরা হাসত, নিজের বুকে হাত রেখে বলত, সিনা মে হ্যায় জনাব।

বুকের ভেতর আকাশ আর সেই আকাশ থেকে ভেসে আসছে আমার গজল, এভাবে কখনও তো কেউ বলেনি আমাকে। শুধু মুনিরাবাই বলতে পারত। আমার গজলের সঙ্গে তার দেনাপাওনার সম্পর্ক ছিল না। আমিও তাঁকে বুকের ভেতর টেনে নিয়েছি। সে আমার শরীরের আড়ালে নগ্ন হয়েছে। সজল, কালো একখণ্ড মেঘকে যেন আমি জড়িয়ে আছি। মান্টোভাই। বেগম ফলক আরা ছিলেন আমার জীবনের একটা রৌদ্রালোকিত দিন, আর মুনিরা যেন ঘনঘোর বর্ষা, একটানা বৃষ্টি পড়েই চলেছে, কত যে নতুন পাতা গজাচ্ছে আমার শরীরে; বিশ্বাস করুন, মুনিরার সামনে বসে থাকতে থাকতে একসময় শুধু তার চোখ দুটোই দেখতে পেতুম আমি, হরিণের মত দুরন্ত, আবার মাঝে মাঝেই কেমন স্থির হয়ে যেত। সেই স্থির দৃষ্টিতে আমি দেখতে পেতুম ভয়, হরিণ যেমন দৌড়তে দৌড়তে ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

চারপাশে টিটি পড়ে গিয়েছিল, মান্টোভাই। তুমি মির্জা গালিব, ঠিক হ্যায়, কোঠায় তুমি যেতে পারো, তবায়েফের সঙ্গেও রাত কাটাতে পারো, কিন্তু একটা ডোমনির ঘরে গিয়ে তুমি থাকবে? নিজের জমিন ভুলে যাচ্ছো তুমি? মান্টোভাই কাকে বলে নিজের জমিন? একের পর এক মুশায়েরায় অপমানিত হয়ে আমি তো তার কাছে গিয়েই দাঁড়াতে পারতুম। সে কিছু বলত না, শুধু আমার গজল গাইত :

দিল-এ নাদাঁ তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়?
আখির ইস দর্দ কী দাওয়া কেয়া হ্যায়?

যেখানে আশ্রয়, সেখানেই তো মুক্তি। তাই আমাকে নিয়ে যতই নোংরা কথার ফোয়ারা উঠুক, আমি পাত্তা দিই নি। আম আদমি আমার দিকে ঢিল ছুঁড়বে বলে আমি লেজ গুটিয়ে পালাব? তেমন বান্দা আমি কোনওদিনই ছিলাম না। পূর্বপুরুষদের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে যাইনি ঠিকই, কিন্তু আমার জীবনটা তো একটা যুদ্ধক্ষেত্রই হয়ে উঠেছিল আর সেই লড়াইটা আমাকে একা একা লড়তে হয়েছে। গুলি মারো লোকের কথায়। বিছানায় মুনিরাকে পেলে তো আমি সব অপমান ভুলে যেতে পারতুম, মুনিরা ভুলিয়ে দিতে পারত, আর আমিও ওকে দিনে দিনে আঁকড়ে ধরেছি, ওর গলায় আমার একটার পর একটা গজল শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, মুশায়েরায় আমাকে যতই অপমান করা হোক, একজন মানুষ তো তার কণ্ঠস্বরে আমার গজলকে বাচিয়ে রেখেছে। মুনিরাকে আমি একবার একার মতো করে পেতে চেয়েছি, ওকে বাইরে গান গাইতে যেতে দিতুম না, ওর ঘরে কাউকে আসতেও দিতুম না। ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলুম। সঙ্গতি তো আমার তেমন ছিল না। মাসে ৬২ টাকা ৫০ পয়সা ব্রিটীশের দেওয়া পেনশন। এই টাকাতেই সংসার চালাও, তারপর মদ-জুয়া আছে, তার ওপর ওর দায়িত্ব। তবে কিনা আমার মাসি মাঝে মাঝে কিছু টাকা দিতেন, লোহারু থেকে আহমদ খান বক্স খানও টাকা পাঠাতেন অবরেসবরে, আম্মিজানও কখনও কখনও টাকা পাঠাতেন আগ্রা থেকে। কিন্তু নবাবি মেজাজ আমার, ওই টাকাতে কুলিয়ে উঠতে পারতুম না। তাই ধার করো। তখন অবশ্য মথুরা দাস, দরবারি মল, খুবচাঁদের মতো মানুষরা ছিল, ধার চাইলে কখনও না বলেনি। সব মিলিয়ে দিনগুলি মৌজ-মস্তিতেই কেটে যাচ্ছিল, আর মুনিরাকে ঘিরে জন্ম নিচ্ছিল কত যে গজল।

জান তুম পর নিসার করতা হুঁ
ম্যায় নহীঁ জানতা দুয়া কেয়া হ্যায়।

কিন্তু একদিন মুনিরার বাড়িতে কিছু লোক হামলা চালাল, ওকে মারধোর করল, জিনিসপত্র ভাঙচুর করল। কেন জানেন? আমাকে যেন ওর ঘরে ঢুকতে না দেয়। তবু আমি গেলুম, আমার রোখ চেপে গিয়েছিল। মুনিরা আমার দুহাত চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলেছিল, মির্জাসাব আপ চলে যাইয়ে। উও লোগ দেখেঙ্গে তো-

-কী করবে? আমাকে মারবে?

-আপনার বদনাম হোক, আমি চাই না, জি।

-তুমিও চাও না, আমি আর আসি?

সে আমার মুখ তার বুকের নিরালায় টেনে নিয়ে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে, আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, আপ মেরি জান, মির্জাসাব। ফির ভি-

মান্টোভাই, ওকে ছাড়া আমিও তো বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারতুম না। পতঙ্গ যেমন আগুনের দিকে উড়ে যায়,আমিও সেভাবেই মুনিরার কাছে গিয়েছিলুম। ওই সৌন্দর্যকে বাদ দিয়ে তো আমার জীবন অসম্পূর্ণ। আমার মনের ভাবটা কেমন ছিল জানেন? এই বুঝি ওকে কেউ আমার কাছ থেকে চুরি করে নেবে। ওকে নিয়ে বাগানেও বেড়াতে যেতুম না আমি, মনে হত, নার্সিসাসও ওকে দেখলে নিজের রুপ ভুলে ওর কাছেই ছুটে আসবে। মুনিরাবাইয়ের যত গভীরে আমি ঢুকেছি, ততই মনে হয়েছে, ওকে সম্পূর্ণ করে পাইনি।

ইয়ে না থি হামারি কিসমত কে বিশাল-ই-ইয়ার হোতা
অগর আউর জিতে রহতে য়েহি ইন্তেজার হোতা।

এরকমই মনে হত আমার। ওর সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলন আমার কিসমতে নেই। যদি আরও বাঁচি, তা হলে ওকে পাব না, অপেক্ষাতেই কেটে যাবে সারা জীবন। মান্টোভাই, জীবনে একবারই, এমনভাবে ভালবাসতে পেরেছিলুম আমি। কবিদের মধ্যে ফিরদৌসি, পীরদের মধ্যে হাসান বাসরি আর প্রেমিকদের মধ্যে মজনু-জগতের তিন নূর। মজনুর মতো ভালবাসতে না পারলে তাঁকে আমি মহব্বত বলি না। আমি ভেবেছি, কিন্তু মজনুর মতো ভালবাসতে পারিনি, মান্টোভাই। সে বড় কঠিন পথ। নিজেকে ভুলে যাওয়ার সাধনা কজন করতে পারে? আমিও পারিনি।

প্রথমে খুবই অভিমান হয়েছিল, তাই মুনিরাবাইয়ের কাছে যাওয়া-আসা কমিয়ে দিলুম। আস্তে আস্তে একদিন অভিমান মুছে গেল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেও মুছে যেতে থাকল। মোঘল রক্ত বড় নিষ্ঠুর, মান্টোভাই, আমার শরীরেও তো সেই রক্ত ছিল। এই রক্ত কী করে জানেন? যাকে ভালবাসে, তাকেই হত্যা করে। মুনিরাকে আমিই হত্যা করেছিলাম। ওকে ভুলে আমি তো আবার জীবনের নতুন পথে মেতে গিয়েছিলুম। কিন্তু মুনিরা তো নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল আমার ভেতরে, তার সামনে তো নতুন কোনও পথ খুলে যায় নি। আওরত এরকমই, একবার যাকে ভালবাসে, সেই ভালবাসার পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, শুকিয়ে মরে গেলেও খাঁচাতেই নিজেকে আটকে রাখে। একসময় ভাবতুম, ওদের জগৎটা বড় ছোট, কিন্তু কাউকে ভালবেসে সে মরে যেতেও পারে, সে তো আসলে এক সাধনার পথে চলেছে, নিজেকে পেরিয়ে গিয়ে অন্যের ভেতরে হারিয়ে যাওয়ার সাধনা। মান্টোভাই, পুরুষকে এই সাধনার জীবন আল্লা দেননি। আমরা পতঙ্গের মতো, আর ওরা দীপশিখা, নিজেকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে আলোর জন্ম দেয়। মীরাবাইয়ের পদে আপনি এই মহব্বতকেই দেখতে পাবেন মান্টোভাই। গিরিধারী বিনা মীরার জগৎ অন্ধকার। ক্যায়সে জিউ রে মা, হরি বিন ক্যায়সে জিজঁ রে।

একদিন খবর পেলুম, মুনিরাবাই মরে গেছে। ওর মৃত্যুর সঙ্গে বেখুদি মহব্বতও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু ওর চোখ দুটো তো আমাকে ছেড়ে গেল না। ময়ূরের পেখমে আঁকা সেই চোখ বার বার আমার কাছে ফিরে এসেছে, মৃত্যুশয্যায় শুয়েও দেখেছি, ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মওত যখন এসে আমার হাত ধরেছে, সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মুনিরাকে আমি মজনুর মতোই ভালবাসতে চেয়েছি, নইলে এন্তেকালের সময় সে এসে আমাকে দেখা দিত না।

মুদ্দত হুই হ্যায় ইয়ার কো মেহমান কিয়ে হুয়ে
জোশ-এ-কাদা সে বজম্ চিরাঘন কিয়ে হুয়ে

করতা হুঁ জমা ফির জিগর-এ লখ লখত্ কো
আরসা হুয়ে হ্যায় দাওয়াত-এ-মিজগান কিয়ে হুয়ে

ফির ভাজ-এ ইহতিয়াৎ সে রুকনে লগা হ্যায় দম্
বরষে হুয়ে হ্যাঁয় ঢাক গরেবন কিয়ে হুয়ে

মাঙ্গে হ্যায় ফির কিসি কো লব -এ-বাম পর হাবাস
জুলফ-এ-শিয়ারুখ পে পড়েশন কিয়ে হুয়ে

এক নওবাহার-এ-নাজ কো তাকে হ্যায় ফির নিগাহ্
চেরা ফারোগ-এ ম্যায় সে গিলিস্থান কিয়ে হুয়ে

জী ঢুণ্ডতা হ্যায়ফির ওহি ফুরসৎ কে রাত দিন
বয়েঠে রহেঁ তসভুর-এ জানা কিয়ে হুয়ে

মুনিরাবাই চলে গেল। মলিন দিনগুলি, আরও মলিনতর হল, মান্টোভাই। বেগম ফলক আরা ছিলেন আমার জীবনের আশমানে একটা বিদ্যুৎরেখা, আর মুনিরাবাই সেই নক্ষত্র, যে-নক্ষত্রের মৃত্যুর পরেও কোটি বছর ধরে তার আলো আমাদের আঙিনাকে ছুঁয়ে যায়।

রাতের পর রাত আমি তার মৃত্যুর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মীরসাবের শেষ বলে গেছি :

সরসরী তুম জহানসে গুজরে
বরনহ্ হর জা জহন-এ দীগর থা।

মুনিরাভাই, মেরি জান, হেলাফেলা করে তুমি জগৎ থেকে চলে গেছে, তুমি দেখলে না, এখানে। প্রত্যেক জায়গায় নতুন এক জগৎ ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *