১৩. আমার মতই এই শহরটা

দিলকী বিরানীকা কেয়া মজকুর হ্যয়
অহ নগর সও মর্তবা লুট গয়া।।
(আমার উজাড় হৃদয়ের কথা কী আর বলব,
এই নগরীটি বার বার লুন্ঠিত হয়েছে।)

মান্টোভাই, আমার মতই এই শহরটা, দিল্লি, কতবার ভেঙে পড়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ও দিল্লির নিয়তি যেন একটা একই কলম দিয়ে লিখেছিলেন খোদা। তবে আমি যখন এসে দিল্লি পৌঁছলুম, তখন কিছুটা শান্তি ফিরে এসেছে, কিন্তু তা সে শ্মশানের শান্তি, দিল্লির রওনক তো কবেই হারিয়ে গেছে। সেসব কথা আপনারা ইতিহাস বইতে পড়েছেন, কীভাবে ফারসি, আফগান, মারাঠাদের একের পর এক আক্রমণ আর দরবারের ভেতরকার খেয়াখেয়িতেই দিল্লি একটা খণ্ডহর হয়ে গেছে। মীর, সওদার মতো কবিরা এক সময় দিল্লি ছেড়ে লখনউ চলে গিয়েছিলেন জানেনই তো। কেন চলে যেতে হয়েছিল তাঁদের? তবে মীরসাবের একটা শের বলি:

অব খরাবহ হুয়া জহান্-এ আবাদ
বরনহ্ হরেক কদমপে যাঁ ঘর-থা।।
(আজ উজাড় হয়ে গেল যেখানে জমজমাট নগর ছিল,
নইলে এখানে তো প্রতি পদেই বাড়ি ছিল।)।

আমার সামনেও দিল্লি আবার এভাবে উজাড় হয়ে গেছে, মনে হত যেন কারবালায় দাঁড়িয়ে আছি, তবু এই শহরটা ছেড়ে যেতে পারিনি আমি; কিন্তু অনেকবার তো ভেবেছি, কে পৌঁছে আমাকে এই শহরে, এ তো এক কারাগারের মতোই এসেছে আমার জীবনে, তবু আলবিদা বলতে পারিনি। কেন জানেন? ওই যে বলেছি, খোদা আমার আর দিল্লির নিয়তি একই কলমে লিখেছিলেন। তাকে ফেলে যাব কোথায়? জীবনে যা পেয়েছি আর পাইনি, তার হিসেবনিকেশ তো শহরটার আত্মায় খোদাই হয়ে গিয়েছিল। লোকে বলবে, পাগলামি, কিন্তু ওই জুনুন ছাড়া আমি বাঁচতাম কী করে বলুন তো? দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গিয়েছিল, তো কী? আমি মনে। মনে বলেছি, চালাও, আরও গোলি চালাও, দেখি কত রক্ত তোমরা দেখতে চাও, কতখানি ঘিলু বের করে আনতে চাও, কত অপমানিত করতে চাও করো, কিন্তু তোমরা তো আমার ভেতরের খুশবুটাকে ছুঁতে পারবে না, সেই ভাষাকে তো ছুঁতে পারবে না, যা সাজিয়ে সাজিয়ে আমি গজল লিখি। একদিন আমার পাপের কথাও থাকবে না, তোমাদের গোলি চালানোর কথাও একদিন ভুলে যাবে সবাই, বেঁচে থাকবে কিছু শব্দ আর ছন্দ, যার নাম মির্জা গালিব। যাকগে, এ সব বাদ দিন, লোকে হাসবে, বলবে, নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে কবিদের জুড়ি নেই। যখন কলকাতায় গিয়েছিলুম, তখন কার মুখে যেন শুনেছিলুম একই সঙ্গে সরস্বতী আর লক্ষীর সঙ্গে ঘর করা যায় না। আমিও লক্ষীর সঙ্গে ঘর করতে পারিনি। সরস্বতীর প্রেমে পড়েছিলাম যে। ইয়া আল্লা! কী যে বলি আমি! গোস্তাকি মাফ করবেন, আসলে হিন্দুদের আর কোনও দেবীর। হাতে তো বীণা দেখিনি আমি। মুনিরাবাইয়ের প্রেমে পড়েছিলুম গানের জন্যই। উমরাও বেগম তো আমার কানের কাছে সবসময় কোরান আর হাদিসের বাণী শুনিয়ে যেত। পবিত্র ফুল। আপনি কল্পনা করতে পারেন মান্টোভাই, যার ওপর একটাও মৌমাছি এসে বসেনি? ফুল যে সুধা তার ভেতর জমিয়ে রেখেছে, মৌমাছি এসে সেই সুধা যদি না পান করে, তবে সেই সুধার সার্থকতা কোথায়? আমার শ্বশুর, নবাব ইলাহি বখশ খানও এ সব কথা শুনলে রেগে যেতেন। তিনিও শের লিখতেন, তার তখঙ্কুশ ছিল মারুফ, জানেনই তো। হাসি পায় কি জন্য জানেন? মারুফের একটা শের আপনি এখন খুঁজে দেখুন তো, পান নাকি কোথাও? কিন্তু ইতিহাসে লেখা আছে, তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। কুর্নিশ জানাই এমন ধর্মপ্রাণকে। কবি মারুফের কথা আল্লা তাঁর কোনও কিতাবেই লেখেননি। কেন জানেন? আল্লা তো কবিতা বোঝেন। তাঁর পয়গম্বর হজরতের কটা বিবি? আর কোরান?সে তো কবিতার ছন্দেই আল্লার কাছ থেকে। পেয়েছিলেন হজরত মান্টোভাই, কোরান আমার কাছে এক আশ্চর্য কবিতা,সেই কবিতায় জন্ম মৃত্যু-প্রেম-নিয়তি, গোটা বিশ্বসংসার এক খেলায় মেতে উঠেছে, যেমন আপনি বেদ উপনিষদ,গীতা, জেন্দ আবেস্তায় পাবেন; আমার গজলে সেই খেলার ভেতরে ঢুকতে গিয়েই তো ফৌত হয়ে গেলুম। জওকসাব,মোমিনসাবের মততা কি লিখতে পারতুম না আমি? কিন্তু আমি জীবনটাকে বাজি ধরেছিলুম; আমার শাগির্দ হরগোপাল তাকে একবার লিখেওছিলুম,শোনো, গজল মানে সুন্দর সুন্দর শব্দ নয়,ছন্দ নয়, হৃদয় থেকে রক্ত না ঝরলে গজল লেখা যায় না। এক একটা শব্দ কত রক্তে ভেজা,আমি একা একা বসে অনুভব করেছি,মান্টোভাই।

কথায় কথায় অনেক দূর চলে এসেছি। কবরের বন্ধুরা,যাঁরা আমার কথা শুনছেন, মাফ করবেন। আসলে কী জানেন, আমার জীবনের ব্যর্থতা খেই হারানো এইসব কথার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।আমাকে যারা অভিযুক্ত করেছে, তাদেরও ঠিকঠাক উত্তর আমি দিতে পারিনি;আসলে আমি তো সব ভুলে যেতুম। আমার কাছে প্রত্যেকটা দিন ছিল নতুন একটাই দিনের জীবন-পরের দিনের কথা আমি তো জানি না। আমি আপনাদের কাছে সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করছি, আমি অনেক পাপ করেছি-শরিয়তে যেহেতু তাঁকে পাপ বলা হয়, তবে কি না পাপ-পুণ্যের বিচার তো এই দুনিয়ায় হওয়ার নয়, সে হবে কেয়ামতের দিনে, আল্লার দরবারে-কিন্তু কারুর জন্য আমার মনে প্রতিহিংসা আসেনি। কেন জানেন? আপনারা হাসবেন হয়তো,তবু বলি,ভাগ্যিস কবিতার সঙ্গে বিছানায় শুয়েছিলুম আমি, ভাগ্যিস আমি দিল্লিতে আমার নিজের হাভেলি বানানোর কথা ভাবিনি,ভাগ্যিস আমাকে একের পর এক মুশায়েরায় অপমান করা হয়েছে,ভাগ্যিস আমি পেনশনের টাকা আদায়ের জন্য ছুটে ছুটেও তা পাইনি, ভাগ্যিস আমাকে নির্ভর করতে হয়েছে নবাব-মহারাজাদের দান-খয়রাতের ওপর,ভাগ্যিস আমাকে মনে করানো হয়েছে, গালিব, তোর বাবার কোনও বাড়ি ছিল না, তোরও কোনও বাড়ি নেই,ভাগ্যিস আমি এতিমের মতো জন্মেছি, এতিমের মতো জীবন কাটিয়েছি,এতিমের মতো মরেছি, ভাগ্যিস আমি জুয়াখেলার জন্য জেলখানায় জীবন কাটিয়েছি-আর ততই চিনেছি মানুষদের-আসলে তো তারা সব ছায়াপুতুল জানেই না জীবন তাদের কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও জানতুম না। কিন্তু তারা অজ্ঞানের মতোই বিশ্বাস করেছে, তারা মক্কার পথে চলেছে। আমি সে-পথে কোনওদিন যেতে চাইনি, মান্টোভাই। সেই শেরটা আপনার মনে আছে?

হু মৈ-ভী তমাশাই-এ নৈর-এ-তমান্না,
মৎলব নহীঁ কুছ ইস-সে কেহ্ মলব-হী বর আয়ে।।
(বাসনার নিত্য নব রঙের দর্শক আমি,
আমার বাসনা কোনওদিন পূর্ণ হবে কিনা,অবান্তর সে-কথা।)

মনে করবেন, সেই একই নিজের ভেতরের অন্ধকারের কথা বলে চলেছি আমি। না, এবার একটু রংদার কথায় আসা যাক। গভীর নির্জন পথের কথা বেশিক্ষণ কেউই শুনতে পারে না। আমিও পারতুম না; মশকরা না করলে এই এক জন্মেরই হাল্কা জীবনটাকে কেউ বইতে পারে? এত হাল্কা-দুদিন পর কেউ কারুর থাকবে না-তাই বইতে পারা যায় না। কেউ কি বিশ্বাস করবে মান্টোভাই, মৃত গোলাপের সামান্য একটি পাপড়ির ভার আমি বইতে পারতুম না। এসব শুনে কী বলবে লোকে? ওই বজ্জাতটা সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলতে পারত খুব, কী দিয়েছে নিজের বিবিকে,এতগুলো বাচ্চা পয়দা হওয়ার পরেও পনেরো মাসের বেশি বাঁচেনি কেন তারা, কী করেছে ওই বুরবাকটা তার বাচ্চাদের জন্য? আমি তাদের জন্য একটা গল্প বলি। আপনারা রাবেয়ার নাম জানেন?বার সুফি সাধিকা রাবেয়ার কথাই বলছি,একেবারে ভিখারির ঘরে জন্ম হয়েছিল তাঁর বাপ-মায়ের মৃত্যুর পর ক্রীতদাসী হিসাবে তাঁকে বাঁচতে হয়েছিল অনেকটা জীবন। তাঁর একটা কিস্সা লিখেছিলেন আতরসাব তখিরাৎ-আল-আওলিয়া-তে। সে এক মজার কিস্সা।

রাবেয়াকে একজন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?

-অন্য দুনিয়া থেকে রাবেয়া হেসে বললেন।

-আর কোথায় যাচ্ছেন?

-আর এক দুনিয়ায়।

-তা হলে এই দুনিয়ায় কী করছিলেন?

-একটু খেলতে এসেছিলাম, ভাইজান।

এই কিস্পটা বললুম বলে ভাববেন না যে আমিও একজন সুফি সাধক ছিলুম। সে ক্ষমতা। আমার ছিল না। আমি তো সারা জীবন আয়নার সামনে বসে থাকা এক মানুষ, সে শুধু প্রতিবিম্বই দেখে চলেছে। আমি কী করে সাধক হব বলুন? আমি তা দাবীও করিনি কখনও। কিন্তু যারা জীবনে সব কিছু ঠিক ঠিক ভাবে করে গেছে, যাতে এতটুকুও দাগ না লাগে, তারা যখন বলেছে, আমরাই তো দীনের পথে চলেছি,তখন আমাকে একটু মুচকি হাসতে হয়েছে। তাহলে আল্লা কেন ধুলো দিয়ে আদমকে বানালেন? কেন তাকে পাপের পথে ঠেলে দিলেন?আল্লা যদি নিজের ভেতরেই থাকতেন তা হলে নিজেকে দেখতেন কীভাবে? আদমের মধ্য নিজেকে দেখলেন তিনি।পাপের পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেখলেন কোথায় তার পুণ্য। না,না, আমি আমার সাফাই গাইছি না। মহাভারতের অনেক কিস্সা তো আমি শুনেছি। সেখানে সবচেয়ে পুণ্যের অধিকার কার? একমাত্র যুধিষ্ঠিরের। তাঁর সারা জীবন তো শুধু নানা পাপেরই গল্প। পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে আর কেউ এত পাপ করেননি, তবু ধর্মরাজ কুকুর হয়ে তাঁরই সঙ্গী হলেন। কেন? এর উত্তর আমিও জানি না, মান্টোভাই। আরেকজনের কথা বলি। বেশ্যা পিঙ্গলার নাম শুনেছেন?  উদ্ভব গীতা-য় পিঙ্গলার কথা আছে। আমি জামা মসজিদের এক দস্তানগোরের কাছেই কিস্যাটা শুনেছিলুম।উদ্ভব গীতা-য় দত্তাত্রেয় অবধূত রাজর্ষী যদুকে তাঁর চব্বিশজন গুরুর কথা বলেছেন। পিঙ্গলা তাদেরই একজন। অবধূত এক সন্ধ্যায় পিঙ্গলাকে দেখেছিলেন,নিজের বাড়ির সামনে প্রেমিকের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকতে। সন্ধ্যা থেকে রাত গড়িয়ে গেল,কেউ এল না। পিঙ্গলা ভাবছিল,আজ কেউই এল না? ভগবানকে না ডেকেই আমার এই অবস্থা। নিরাশ হতে হতে সে নিরুদ্বেগ হয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল। পিঙ্গলা অবধূতকে কী শেখাল? আশা ত্যাগ করলেই শান্তি। ভেবে দেখুন, একজন বেশ্যাও গুরু হতে পারে।

কিন্তু আমার শ্বশুড় মারুফসাব দুনিয়ার সব কিছুর উত্তর জানতেন। দিল্লিতে এসে আমি আর উমরাও বেগম তো তাঁর হাভেলিতেই উঠেছিলুম,ছিলুমও বেশ কিছুদিন,কিন্তু লোকটাকে সহ্য করা যেত না। সব কিছু নিক্তি দিয়ে, পাই পাই করে মাপতেন। ওভাবে মানুষকে মাপা যায় নাকি? আমিও তাই তাঁর সঙ্গে মজা করতুম। এইসব মানুষ, যারা নিজেদের পবিত্র মনে করে, যারা কথায় কথায় বলে দেবে, কোন্ পথ আপনার জীবনের জন্য ঠিক, তাদের নিয়ে মজা করা ছাড়া আর কী করা যায়? যত মজা করবেন,দেখবেন, ততই তাদের তসবির ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। এইসব পবিত্র মানুষরা, আমি দেখেছি, একটা জিনিসই জানে, কীভাবে,কতভাবে অন্যদের অপমান করা যায়। আমার ওয়ালিদের ঘরবাড়ি না থাকতে পারে, তুর্কি রক্ত তো আমার শরীরে,আমি সেই অপমান সহ্য করব? তাই আমার হাতের তাস ছিল মজা, ওই শালা মারুফসাবকে নিয়ে এমন মজা করো যাতে তাঁর মূর্তিটা ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়।

আমি ছোটবেলা থেকে রাস্তার কুত্তাদের খুব ভালবাসতুম,মান্টোভাই। আকবরাবাদের পথের কুকুররা আমার পায়ে পায়ে ঘুরত,আমি ওদের আদর করতুম,তাদের সঙ্গে কথা বলতুম রাস্তার কুকুররা যেমন বন্ধু হয়, তেমন আর কেউ হতে পারে না,এ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তারাও আমার গা ঘেঁষে বসত, আমার শরীরের গন্ধ শুকত, আর এমনভাবে তাকিয়ে থাকত,ওরা সত্যিই অনেক কথা বলতে চাইত,আমি বুঝতে পারতুম। কিন্তু কুকুরদের ভাষা তো আমি জানি, আল্লা দয়া করে যদি সেই ক্ষমতাটুকু দিতেন তা হলে জীবনটা দিনে দিনে পাথর হয়ে উঠত না। আর মারুফসাব কুকুরদের একেবারে পছন্দ করতেন না। একদিন বললেন, মিঞা হাভেলিতে থাকো, রাস্তার কুকুরের সঙ্গে তোমার এত ভাব-ভালবাসা কেন? আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, শালা কুত্তা কাহিকা। বলতে তো পারিনি। যাঁর বাড়িতে থাকি–খাই তাঁকে তো এ-কথা বলা যায় না। কিন্তু সেজন্য তো আমি তাঁর ক্রীতদাসও হয়ে যাইনি। আমি তাই মজা করতে শুরু করলুম।

-ওরা আপনার তো কোনও ক্ষতি করেনি।

-এত নোংরা জানোয়ার আর আছে নাকি! ছায়া মারালেও গোসল করতে হয়। তুমি তা করো?

-না।

-তওবা,তওবা,কোরানের একটা কথাও তুমি মানো না?

-মানি তো।

-তা হলে কুকুরদের সঙ্গে এত মাখামাখি কিসের?

আমি হেসে ফেললুম-আমিও তো এক কুকুর, মারুফসাব।

-মানে?

-আমার ওয়ালিদের কোনও হাভেলি নেই। দাদার বাড়িতে আমি বড় হয়েছি, তারপর আপনার মেয়েকে নিকে করে আপনার বাড়িতে এসেই উঠেছি। তা হলে আমাকে কুকুর বলবেন না কেন? আমার তো পথেই থাকার কথা ছিল।

-মিঞা, তোমার জুবান বড় বেশি। যার খাও তারই মাথায় হাগতে চাও। মারুফসাব রাগে গরগর করতে লাগলেন।

-কুত্তার জুবানের মতোই জি।

-মিঞা, মুখ সামলাও।

-ভাঁদোর কুকুর দেখেছেন মারুফসাব? রাস্তায় কী করে? এইরকম ভাঁদোর কুকুর মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। যার ভেতরে লুকিয়ে থাকে, হাজারবার গোসল করলেও সে সাফসুরত হয় না।

-কী বলতে চাও তুমি?

-আগে তো নিজেকে সাফসুরত করুন।

কোরান হাদিশের এত এত বয়াৎ যার মুখে মুখে ফেরে,সে তা হলে ঘরে বিবি থাকতেও কোঠায় যায় কেন, মান্টোভাই? তার কী কোনও অধিকার আছে অন্যের সাফসুরতি নিয়ে কথা বলার?

আমি খুব সাচ্চা আদমি,এই দাবি কখনও করিনি। সত্যি বলতে কী, আমি দিল্লি এসেছিলুম লোভে পড়েই। মারুফসাবের খানদান পরিবার, দরবারের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে, ভেবেছিলুম শায়র হিসেবে দরবারে জায়গা পেয়ে যাব আমি, নিজের মর্জিমাফিক জীবন চলবে, সুরা আর নারীর প্রতি তখনও তো আমার খুব টান ছিল। বেগমের সঙ্গে তো কোনও সম্পর্ক ছিল না আমার। সে থাকে জায়নামাজ-কোরান-হাদিশ নিয়ে; দিনে দিনে তা আরও বেড়েছে আর এক সময় তো নিজের খাওয়ার বাসনকোসনও আলাদা করে নিয়েছিল। কেন? আমি দারু খাই, গজল লিখি;তার কোরানে তো এ সব হারাম ছিল। দায়িত্ব তার খুবই ছিল, আমার কোথায় সুবিধে অসুবিধে সব দিকে নজর রাখত, কিন্তু তাঁকে তো আর মহব্বত বলে না। জানি না, হয়তো সেটাই ছিল উমরাও বেগমের ভালবাসা। তবে কী জানেন,বয়স যত বেড়েছে ভালবাসা শব্দটাকে আমি ততই অবিশ্বাস করেছি। সত্যি কী অবিশ্বাস করেছি? কিন্তু এটুকু জানি দিনে দিনে আমার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কেন? হয়তো আমার ভেতরেই ভালবাসা ছিল না, আমি কাউকে ভালবাসতে পারিনি। আজ কবরে শুয়ে মনে হয়, আমি ভালবাসার কাঙাল ছিলুম, নিজে কাউকে ভালবাসিনি। আমি তো মীরসাব নই, শুধু ভালবাসার জন্য কী অত্যাচারই না সহ্য করেছিলেন তিনি। লায়লা-মজনুর গল্প তো আপনারা সবাই জানেন, কিন্তু মীরসাবের সেই দিনগুলোর কথা কজনই বা জানে? ইস্কে দিবানা কাকে বলে, মীরসাব তা জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মীরসাবের কথাই বলছি; জানি, একজনের জীবনের ঘ্যানঘ্যানানি বেশিক্ষণ শোনা যায় না। নিজের কথা এত যে ফলাও করে বলে চলেছি, আমি জানি, এক কথায় আমার জীবনের। গল্পটা যদি বলতে হয়,তবে শুধু একটা জিজ্ঞাসা চিহ্নই কাগজের ওপর বসিয়ে দিতে হবে। তার চেয়ে মীরসাবের সেই দিনগুলোতে ফিরে যাই চলুন।

ক্ষত বিক্ষত এক শহর, তাঁর হৃদয়, মীরসাবের। সেই শহরের কথা তিনি মুআমলাত-এ ই মসনবিতে লিখে গেছেন। আমার তো মনে হয়, ভালবাসা নিয়ে যে-সব মসনবি মীরসাব লিখে গেছেন, মুআমলাত -ই সেরা; এ যেন শিষমহলে একটা আর্তনাদ পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ কীসের আর্তনাদ জানেন? চাঁদ দেখার জন্য। সেই যে ছোটবেলায় নানি সন্ধেবেলা তার মুখ ধুইয়ে দেওয়ার সময় বলতেন, উপর মে তাকাও বেটা, দেখো, চাঁদকো দেখো, তখন থেকেই চাঁদ তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল,আর তারপর তো চন্দ্রাহতই হতে হয়েছিল। চাঁদের শরীরে তিনি তা আশিক্কে দেখতে পেতেন, এভাবে দেখতে দেখতেই একদিন পাগল হয়ে গেলেন। কে তার আশিক্‌?

 তাঁর নাম আমি জানি না, মান্টোভাই। আমরা যে সমাজে বেঁচেছিলুম, সেখানে তো মসনবি দস্তান ছাড়া মেয়েদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। কী দরকার তাদের নামের? মোল্লারা তো তাদের বোরখা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে, সে যে একা একজন মানুষ। সেই পরিচয়টাই মুছে দিয়েছে। কিন্তু আজ আমরা তাঁর একটা নাম দিতেই পারি। কী নাম দিই বলুন তো? মেহর নিগার, কেমন হয়? ভারি সুন্দর নয় নামটা? তো এই মেহর নিগারের প্রেমে পড়েছিলেন মীরসাব, তখন তাঁর আঠারোর মতো বয়স। বিবাহিত মেহর বেগম মীরসাবের চেয়ে বয়েসে কিছুটা বড়ই ছিলেন, তবে পারিবারিক সম্পর্ক থাকার দরুণ পর্দা প্রথা মেনে চলতে হত না, মীরসাবের সঙ্গে তিনি সহজভাবেই মেলামেশা করতেন। এই বেগমের চলাফেলা, আদবকায়দা নিয়ে পরিবারের সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। মীরসাব সেই সব কথা শুনতে শুনতেই একদিন প্রেমে পড়ে গেলেন মেহর বেগমের। মীরসাব তাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন, কিন্তু কথা বলতে পারতেন না। কী বলবেন? যখন অনেক কথা নিজের ভেতরে জমে যায়, তখন আর কথা বলা যায়, মান্টোভাই? ধীরে ধীরে একদিন আড়াল ভেঙে গেল, মীরসাব তাঁকে স্পর্শও করলেন।মুআমলাত-এ মীরসাব নিজেই লিখে গেছেন, আমি তার সৌন্দর্যের কথা বলতে পারব না, যেন আমার কামনার ছাঁচেই তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁ হাঁটাচলায়, চোখ তুলে। তাকানোয়, গ্রীবার ভঙ্গিতে গজলের ছন্দকে আবীস্কার করতেন মীরসাব। একদিন কী হল জানেন? মেহর বেগম তখন পান খাচ্ছিলেন, ঠোঁট দুটি সূর্যোদয়ের আকাশের মত রাঙা, আর সেই ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে মীরসাব নিজেকে সামলাতে পারলেন না, বেগমের অধরের সুরা চাইলেন তিনি। প্রথমে হেসে নারাজ ভাব দেখালেও, বেগমও শেষ পর্যন্ত মীরসাবার অধরের সুরা পান করলেন। তার পরে কী হতে পারে, ভাবুন। বেগমের সঙ্গে নিভৃতে দেখা করার ইচ্ছে, আর বেগমও তা চাইছিলেন। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর মেহর বেগম একদিন বললেন, এই ভালবাসার কোন পরিণতি নেই মীর। এভাবে বেশীদিন চলা যায় না।

মেহর বেগম নিজেকে সরিয়ে নিলেন। আর মীরসাব যেন এক স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। প্রতিটি রাত কল্পনায় মেহর বেগমের সঙ্গে কেটে যায়, কিন্তু দিনের বেলা অসহ্য হয়ে উঠল তাঁর কাছে। বছরের পর বছর আর কেউ কাউকে দেখেননি। এই অবস্থায় কী হয় মানুষের? চারপাশের জগৎটাই তো মিথ্যে হয়ে যায়, তার কোনও অস্তিত্বই থাকে না। ব্যাপারটা জানাজানিও হয়ে গেছিল। আত্মীয়-বন্ধুরা মীরসাবের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, তাঁকে পাগল বলতে শুরু করেছে। আপনি তো জানেনই, মান্টোভাই, হাতি গর্তে পড়লে পিঁপড়েও লাথি মারে, মীরসাবের দশা তখন সেইরকম। তারপর মেহর বেগম একদিন তাঁর কাছে এলেন গোপনে। বললেন, আমাদের দূরে সরে যেতেই হবে মীর। এমন ভালবাসায় সবাইকে। একদিন এই বিচ্ছেদের মুখোমুখি হতে হয়। আমি যতদিন বাঁচব, তুমিও আমার হৃদয়ে থেকে যাবে। বিচ্ছেদ এবার সম্পূর্ণ হল। রইল শুধু স্মৃতি, স্মৃতির ভার। মীরসাব পাগল হয়ে গেলেন। খোয়াব-এ -খেয়াল-এ মীর সেই পাগলামোর দিনগুলোর কথাই লিখে গেছেন। মীরসাব। চাঁদের দিকে তাকাতে তিনি ভয় পেতেন, তবু চোখ চলে যেত, আর চাঁদের শরীরে মেহর বেগমকেই দেখতে পেতেন। বিশ্বাস করুন, তাঁর চোখ থেকে ঘুম চলে গিয়েছিল, নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়েছিলেন, যেদিকেই তাকান, শুধু মেহর নিগার। ছবির পর ছবির চক্রের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া।

তাঁকে সারানোর জন্য কত হাকিম এলেন, কত ঝাড়ফুক চলল, কিন্তু কে বুঝবে বলুন মীরসাবের যখন চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে অবস্থা, সেই চাঁদই তখন হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। অনেক চেষ্টা করেও যখন সারানো গেল না, তখন কী করা হল জানেন? মীরসাবকে একটা ছোট কুঠুরিতে আটকে রাখা হল, হ্যাঁ শুনুন বলছি, কবরের চেয়েও ছোট সেই কুঠুরি। দিনে একবার খেতে দেওয়া হত তাঁকে। সুস্থতা বলতে কী বোঝে আসলে মানুষ? খাও, হাগো, খাও, হাগো, আর তুমি যা বিশ্বাস করো না, সেই কথাগুলো বলে যাও। তারপর কী হল জানেন? সবাই ঠিক করল, লোকটার শরীর থেকে বদ রক্ত বের করে দিতে হবে। রক্ত বেরোতে বেরোতে মীরসাব অচৈতন্য হয়ে গেলেন। তাতে কী? বদ রক্ত তো বার করতে হবে। মীরসাব পরে একটা শের এ লিখেছিলেন, ক্রীতদাশ হও, জেলে পচে মরো, কিন্তু ভালবাসার খপ্পরে পড়ো না। প্রেমে একদিন আগুন জ্বলে উঠেছিল, তারপর তো পড়ে আছে শুধু ছাই।

মীরসাব সেই আগুনের ছোঁয়া পেয়েছিলেন, আর আমি শুধু সেই ছাইটুকু গায়ে মাখতে পেরেছিলুম। মীরসাবের মতো করে কাউকে ভালবাসতে পারিনি আমি। কেন জানেন? হয় খোদা আমার ভেতরে ভালবাসা দেননি, নইলে এতিমের মতো জীবন কাটাতে কাটাতে আমি ভালবাসার মানেই ভুলে গেছি; শুধু শব্দদের ভালবেসেছি, শব্দ কীভাবে মানুষকে ছোঁয় আমি বুঝতে পারিনি।

জীবন শুরুর দিনগুলোতে উমরাও বেগম একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কথা বলেন না কেন, মির্জাসাব?

-কী কথা?

-আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না আপনার?

-করে তো, কিন্তু

-কী?

-তুমি আমার থেকে অনেক দূরে বেগম।

-কত দূরে?

আমি আঙুল তুলে আকাশের একটা নক্ষত্রকে দেখিয়েছিলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *