গল্প - রেবন্ত গোস্বামী
ছড়া - রেবন্ত গোস্বামী
সাক্ষাৎকার

মৃত্যুবাণ

মৃত্যুবাণ

(পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দুর্দান্ত অফিসার জ্ঞান লাহিড়ীর নাম সাধারণের কাছে ততটা না হলেও, সারা ভারতের পুলিশ বিভাগে আর অপরাধী জগতেও অতি-পরিচিত ছিল। পুলিশ বিভাগে সংক্ষেপে জেল (জে-এ) আর সমাজে বিরোধীদের কাছে GUN নামে তাঁর যে পরিচিতি ছিল, সেটাই তাঁর গোয়েন্দাজীবনের সাফল্য ও দুর্ধর্ষতা জানিয়ে দেয়।

এহেন একজন ব্যক্তি জীবনের মাঝখানেই হঠাৎ যখন স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। জ্ঞানবাবুর মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁর একটা ব্যক্তিগত ডায়েরি পাওয়া যায়। তাতে অবসরগ্রহণের যে কারণ লেখা ছিল, সেটা পুলিশ বিভাগকে আরও হতভম্ব করেছিল। সেই ডায়েরি থেকে তাঁরই ভাষায় উদ্ধৃত করছি। শুধুমাত্র বিশেষ কারণে জ্ঞানবাবুর বন্ধুর নামটি এখানে বদলে দেওয়া হয়েছে।)

কাগজে খবরটা বেরিয়েছে বেশ ফলাও করে। কারণ লেখা হয়েছে, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় যান্ত্রিক বিস্ফোরণ এবং তাতে দুর্বল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু। এবার আমি একদিক থেকে নিশ্চিন্ত। কিন্তু অন্য এক পাপবোধ আমার বুকে যেন মৃত্যুবাণের চেয়েও তীব্রভাবে বিধে যাচ্ছে সবসময়ে। তাই এই গোয়েন্দাজীবনের কাজ থেকে অবসর নিয়ে অন্য কোনও শান্ত কর্মজীবন বেছে নেব।

স্বাস্থ্যের কারণ অজুহাতটা উঁচু মহল থেকে আরম্ভ করে কেউই বিশ্বাস করবে না হয়তো। কিন্তু আসল কারণটা–সেটা লেখা থাক আমার এই ব্যক্তিগত ডায়েরিতেই।

তা-ও লিখব না ভেবেছিলাম। এই ডায়েরিতে অনেক কথাই লেখা আছে। অনেক অভিযানের কথা। খুন, চুরি, ডাকাতির কথা। কিন্তু এর কাছে তাদের অপরাধ তো সাধারণ স্তরের, ধরাছোঁয়ার মধ্যে! তাই ভেবেছিলাম, এই লেখা একদিন প্রকাশ হয়ে পড়লে হয়তো আবার কোনও বিকৃতমস্তিষ্ক প্রতিভাধর সেই অস্ত্রের অধিকারী হয়ে সমাজে বিপর্যয় আনবে। কিন্তু পরে ভাবলাম, বৃথা দুশ্চিন্তা। প্রকৃতির নিয়মেই তো এইসব অপরাধীর পতন ঘটে, হোক-না সে যত শক্তিরই অধিকারী। রামায়ণ-মহাভারত থেকে ইতিহাসের পাতায় তো শুধু সেই দৃষ্টান্ত। নইলে কেনই বা দুলাল পাত্র এত লোক থাকতে আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিল?

ঘটনাটা প্রথম থেকেই লিখে রাখি।

.

১৫ মার্চ, শনিবার। সন্ধে প্রায় সাতটা।

একটা বিখ্যাত খুনের কেসের প্রায় সুরাহা করে এসে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছি। কিছুক্ষণ। এমন সময় বেহারা এসে একটা স্লিপ দিয়ে গেল। জনৈক দুলাল পাত্র আমার দর্শনপ্রার্থী। সাধারণত আমার সঙ্গে অপরিচিত লোকের দেখা করার ব্যাপারে একটু কড়াকড়ি রক্ষা করা হয়। কার্যোপলক্ষ্যে শত্রু আমার অনেক। তাই ঘরে ঢোকার আগে যন্ত্রের সাহায্যে দেখে নেওয়া হয় তাদের কাছে কোনও অস্ত্র আছে কি না। তা ছাড়া ডিপার্টমেন্টের লোক ছাড়া সাধারণত কেউ ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার কাছে আসেও না। কারণ আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই।

কিন্তু দুলাল পাত্র এসেছে এখানকার ধনী ব্যবসায়ী এবং এককালের খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক নির্মাল্য সিংহরায়ের কাছ থেকে। শুধু তা-ই নয়, নির্মাল্য আমার কৈশোরের বন্ধু ও সহপাঠী।

মনে পড়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার দিনগুলোর কথা। আধময়লা ইস্তিরিবিহীন জামাকাপড় পরে নির্মাল্য কলেজে আসত। একমাথা চুল প্রায়ই আঁচড়াতে ভুলে যেত। পরীক্ষায় অঙ্কে যে ছেলে প্রায়ই পুরো নম্বর পেত, সে-ই আবার পয়সার হিসেব রাখতে না পেরে দোকান-বাজারে ঠকে বেড়াত। সেই নির্মাল্যই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে বিলেতে পাড়ি দিল, তখন আমরা বলাবলি করতাম, ওখানে ভুল করে শুধু গেঞ্জি গায়ে কলেজে হাজির হলেই চিত্তির। আর্কিমিডিসের সময় ওসব চলত।

এত আত্মভোলা লোক হলে কী হবে, কেউ তাকে ঠকিয়েছে জানলে নির্মাল্য খেপে লাল হয়ে যেত। চোর-ডাকাত-পকেটমার সবাইকেই সে অহরহ ফাঁসি দিত। আমরা বলতাম, ভাগ্যিস তুই জজ হবি না।

একবার তাদের বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তায় একটা মোটা লোককে দেখিয়ে আমাকে বলেছিল, চিনির ব্ল্যাক করে লোকটা লাল হয়েছে। একদিন ছাদের ওপর থেকে দেব ওর মাথায় কনসেনট্রেটেড নাইট্রিক অ্যাসিড ঢেলে। আমি উত্তর দিলাম, দিয়েই দেখ-না। লোকে তোকেই ধরবে। লোকটার কালোবাজারি করার কোনও প্রমাণ দেখাতে পারবি? তোর প্রমাণ হাতেনাতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, সেই তো হয়েছে মুশকিল। আড়াল থেকে মৃত্যুবাণ যদি মারা যেত।

হেসে উত্তর দিলাম, ওসব বাচ্চাদের মনোভাব। গায়ের জোরে কারও সঙ্গে না পারলে তারা ভাবে, আহা, আমার যদি কোনও অলৌকিক শক্তি থাকত! ঠিক অরণ্যদেবের মতন।

কর্মজীবনে আমার আর নির্মাল্যর পথ দু-দিকে চলে গেল। বৈজ্ঞানিক নির্মাল্যর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকলেও ব্যবসায়ী নির্মাল্যর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ অনেক কমে গেল। তার মতো আত্মভোলা লোক ব্যাবসার ক্ষেত্রে নাম করেছে, এতে বেশ অবাক হলেও তার ওপর রাগও হয়েছিল। আমার বিশ্বাস ছিল, বিজ্ঞানে সে বিশ্বজোড়া নাম পেত। আমার দেশের সম্মান বাড়ত। আজ হঠাৎ নির্মাল্য আমার কাছে লোক পাঠিয়েছে শুনে তখনই তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলাম।

দুলাল পাত্র লোকটা–লোকটা না বলে ছেলেটা বললেই বোধহয় ঠিক হয়–তার নামের মতোই নিরীহ আর শান্ত। বয়স কুড়ির কমই হবে। ধুতির ওপর ফুলহাতা শার্ট। চুলের প্রচুর তেল কপালের কিছুটাও তৈলাক্ত করেছে। চোখের মধ্যে সারল্য আছে, একেবারে বুদ্ধিহীন সারল্যও নয়। তবে যাকে বলে স্মার্টনেস, সেটা স্বাভাবিকভাবেই অনুপস্থিত। দেখেই বোঝা যায়, শহরের জলে তার গ্রাম্যতা এখনও ধুয়ে যায়নি।

ঘরে ঢুকেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার, নির্মাল্যর খবর কী?

ছেলেটা যেন চমকে উঠল। তারপর ভীতভাবে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। আমি তার এই হাবভাবে একটু ঘাবড়ে গেলাম। তবে কি নির্মাল্যর কোনও বিপদ ঘটেছে?

দরজার পাশে দাঁড়ানো প্রহরীকে সরে যেতে দেখে দুলাল বলল, আমাকে সে গোপনে কিছু কথা বলতে চায়। কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবু বললাম, সে স্বচ্ছন্দে এখানেই সে কথা বলতে পারে। অভ্যাসবশত আমার আঙুলের চাপে টেবিলের তলায় ফিট-করা টেপরেকর্ডারটাও চলতে শুরু করল।

দুলাল যা বলল, তা অবিশ্বাস্য আর হাস্যকর মনে হলেও সুদূর অতীত ছাত্রজীবনের একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে সবই শুনে গেলাম।

দুলাল বলল, সে নির্মাল্যর ইউরেকা ল্যাবরেটরি ইন্সট্রুমেন্টস-এর একজন কর্মচারী। নির্মাল্যর বাড়ির তলাতেই অফিস। সে সব সময়ের জন্যে ওই বাড়িতেই থাকে। তারা ওসব যন্ত্রপাতি তৈরি করে না। দেশ-বিদেশ থেকে এনে সাপ্লাই দেয়। এই কাজে লাভ আছে ঠিকই, কিন্তু নির্মাল্যবাবুর আসল টাকা তাতে আসেনি। তিনি তন্ত্রসাধনা করে বাণ মারতে পারেন।

তাদের গ্রামে নাকি এরকম একজন লোক ছিল, ঠাকুমার কাছে শুনেছে। যার নামে মন্ত্র পড়ে বাণ মারবে, সে যেখানেই থাকুক-না কেন, রাত না পোয়াতেই মুখে রক্ত উঠে মরে যেত। দিল্লিতে এক বিখ্যাত নেতা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যায়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক নেতাকে তার আগে নির্মাল্যবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে দেখা গিয়েছিল। কিছু দিন আগেও একজন বিখ্যাত অভিনেতা মারা যাওয়ার আগে আর-একজন মাঝারি অভিনেতাকে নির্মাল্যবাবুর কাছে আসা-যাওয়া করতে দেখা যায়। এখন সেই মেজো অভিনেতাই সেই বিখ্যাত অভিনেতার জায়গা দখল করে নিয়েছে। এরকম কতকগুলো ঘটনার কথা দুলাল বলল।

দুলাল অনেকদিন ধরেই আঁচ করেছিল। কিন্তু তার বিশ্বাস হত না যে, তার মনিবের মতো অত অমায়িক সম্ভ্রান্ত লোক এ কাজ করতে পারেন। কিন্তু সে এবার নিশ্চিত। গতকালই একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, আরেকজন ব্যবসায়ীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। নির্মাল্যবাবু বেশি টাকা দাবি করাতে ব্যবসায়ীটি জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল। সেই সময় দুলাল কী কাজে ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন তার দিকে নির্মাল্যবাবু যেভাবে তাকিয়েছিলেন, তাতে তার ভেতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। ব্যবসায়ীটি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল। না হয়ে উপায় কী? নইলে তাকেই যে মরতে হবে।

বলতে বলতে সরল গ্রাম্য তরুণ দুলাল পাত্রর ভিতু-ভিতু চোখ দুটো যেন উত্তেজনায় চকচক করে উঠল। দুলালের দৃঢ় বিশ্বাস, এবার তাকে মরতে হবে। আমিও তাকে রক্ষা করতে পারব না। মরার আগে তাই সে এই ছদ্মবেশী খুনির কথা আমাকে জানিয়ে যেতে চায়। আমার নাম সে শুনেছে। সে আশা করে, আমি যদি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারি।

দুলালকে বাড়ি ফিরতে বলে আমি টেপটা আরেকবার শুনলাম। সত্যিই কি নির্মাল্য অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করেছে কোনও তন্ত্রসাধনা করে? কিন্তু সে তো এসব জিনিস একেবারে বিশ্বাস করত না। হয়তো সবই দুলালের গ্রাম্য কুসংস্কার।

হয়তো অন্য কাজের মধ্যে এই অলৌকিক ব্যাপারের কথা ভুলে যেতাম, যদি না পরদিনই কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাতেই বিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রভুদয়াল পোদ্দারের আকস্মিক মৃত্যুর খবরের সঙ্গে সঙ্গে সেই কাগজেরই শেষ পৃষ্ঠায় ঘটনা দুর্ঘটনা শিরোনামে ছোট্ট একটা খবর দেখতাম। দুলাল পাত্র নামে এক তরুণের ট্রাম-রাস্তায় হঠাৎ হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার খবরটাও অন্যান্য সংবাদের মধ্যে নগণ্য মনে হলেও আমার কাছে অসামান্য। একই নামের দু-জন লোক থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্থানটি আমার বাড়ির কাছাকাছি, সময়টাও আমার সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার কিছু পরেই।

অফিসে ফোন করে মৃতের পরিচয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলাম।

এবারে আমার কর্মপন্থা স্থির করে ফেললাম। কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম নানা জায়গায়। তথ্য যা সংগ্রহ হল তা মোটামুটি সন্তোষজনক। দিল্লি আইবি-র মি, ভাটিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজনৈতিক নেতার কাছে যে ব্যক্তির আসা-যাওয়া ছিল, তার একটা বর্ণনা গেলাম। তবে মি. ভাটিয়া জানালেন, আমার সন্দেহভাজন ব্যক্তির একটা ফোটো পাঠালে তিনি এ ব্যাপারে সঠিক খবর জানাতে পারবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই সাদা পোশাকে বন্ধুগৃহ অভিমুখে যাত্রা করলাম।

মস্ত বাড়ি। গেটে দারোয়ান থেকে অন্য কাজের লোকজনে বাড়ি ভরতি। নির্মাল্য বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে প্রথমে কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু সে ক্ষণিকের। পরমুহূর্তেই মুখের ভাব বদলে ফেলে কণ্ঠস্বরে উল্লাস এনে বলল, আরে, গ্যানা যে! চিনতেই পারিনি প্রথমে। আয় আয়। তুই তো এখন পুলিশের বিরাট মাথা। তোর নাম প্রায়ই দেখি কাগজেটাগজে।

আমাকে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকে বোতাম টিপে বেয়ারাকে ডেকে কফির অর্ডার দিল। নির্মাল্য যে বৈজ্ঞানিক, তার নিদর্শন এই বৈঠকখানাতে সে রেখেছে। দেয়ালে গ্যালিলিও, আইনস্টাইন, কুরি থেকে জগদীশচন্দ্র সকলের ফোটো টাঙানো। দরজার ওপরে ফ্রেমে বাঁধানো লেখা–Cogito crgo sum–এই তিনটে শব্দ। মানে জিজ্ঞেস করলে নির্মাল্য হেসে বলল, ওটা একজন বৈজ্ঞানিকের উক্তি। অর্থ–আমি চিন্তা করছি, সুতরাং আমি আছি।

সব দেখে-শুনে মনে হল, বৈজ্ঞানিক নির্মাল্যর চেয়ে ব্যবসায়ী নির্মাল্য অনেক স্মার্ট। টেবিলের ওপর একটা বড় অ্যালবাম। উলটিয়ে দেখতে লাগলাম। নির্মাল্যর জীবনের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনার ছবি। হঠাৎ একটা মতলব মাথার মধ্যে খেলে গেল। কথাবার্তার ফাঁকে ওর একটা সিঙ্গল ফোটো নির্মাল্যর অজ্ঞাতসারেই খুলে নিলাম। মি. ভাটিয়াকে একটা ফোটো পাঠানো নিতান্তই দরকার। হঠাৎ নির্মাল্যর ফোটো চেয়ে এখুনি তার মনে কোনও সন্দেহের সৃষ্টি করার ইচ্ছে আমার ছিল না।

নির্মাল্য বিয়ে-থা করেনি। দুলাল পাত্র বলেছিল, যারা বাণ মারে, সেইসব গুনিন বিয়ে থা করে না। করলে নিজের পরিবারে মৃত লোকদের অভিশাপ ফিরে আসে। এসব কথা ভাবছি, এমন সময় ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে উঠতেই নির্মাল্য উঠে গিয়ে ধরল। কোনও এক প্রমথর সঙ্গে কথা বলল। কথা বলতে বলতে আড়চোখে আমার দিকে একবার তাকাল, তারপর পরে হবে বলে রিসিভার রেখে দিল। আমার কাছে এসে বলল, কী খবর বল।

আমি কৌশলে কাজের দিকে এগোলাম। নির্মাল্যর মতো ব্যোমভোলা লোক রাতারাতি এরকম ব্যবসায়ী হয়ে উঠল কী করে, সে বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করতেই সে গম্ভীর হয়ে বলল, তুই কি ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করছিস?

আমার গোয়েন্দাগিরি আরও গভীর ব্যাপারে। সে কথা তাকে সোজাসুজি বুঝতে না দিয়ে বললাম, সেসব কথা মনে পড়ে তোর? চোর-ডাকাত-কালোবাজারিদের মৃত্যুবাণ মেরে শাস্তি দেবার কথা?

আমার কথায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল নির্মাল্য। তার মুখটা যেন ফ্যাক্যাশে দেখাল।

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে চললাম, প্রভুদয়াল পোদ্দারের মতো যদি চোরছ্যাঁচড়গুলো হার্টফেল করে মরত, তবে দেশে কত শান্তি হত, তা-ই না?

নির্মাল্য শক্ত হয়ে গেল। তারপর একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করে বলল, তুই কী বলতে চাস?

আমি পকেট থেকে ক্যাসেট বার করে বোতাম টিপতেই দুলালের কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল। নির্মাল্য হতভম্ব হয়ে শুনল। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, দুলাল তবে তোর কাছেই গিয়েছিল। আমি আন্দাজ করেছিলাম ওরকম। কিন্তু এসব একেবারে আজগুবি কথা। সকলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গিয়েছে, সে তো ডাক্তাররাই বলেছে। ওর কথা কোনও সভ্যজগতের আদালতেই টিকবে না।

আমি বললাম, এই টেপের কপি লালবাজারে আছে। তা ছাড়া এই ক-দিনে তোর বাড়িতে কয়েকটা টেলিফোন আসে, সেগুলোও ট্যাপ করে রেকর্ড করা হয়েছে। কোনও এক প্রমথ তোর জন্যে নানা অর্ডার নিয়ে আসে। যন্ত্রপাতির অর্ডার নয়, মানুষ মারার অর্ডার। নীলমাধব সেন নামে সম্পত্তির আরেক ভাগীদারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার জন্যে একজন তোকে প্রচুর টাকা দেবে বলেছে। তার নাম, টাকার পরিমাণ সবই রেকর্ড করা হয়েছে।

নির্মাল্য টলোমলোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাঃ, বেশ আটঘাট বেঁধে নেমেছিস তো বন্ধুর উপকারে। ঠিক আছে। আয়, তোকে দেখাচ্ছি আমার তন্ত্রসাধনা। এ ঘরে আয়।

পাশের ঘরে ঢোকার সময় দেয়ালে লাল আলো জ্বলে উঠতেই নির্মাল্য বলল, তোর পকেটে কিছু ধাতব জিনিস আছে। ওগুলো ওই ড্রয়ারে রেখে আয়। ভয় নেই। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সব তোকে ফেরত দেওয়া হবে। ঘাবড়াসনে।

মনে মনে হাসলাম। জ্ঞান লাহিড়ী ভয় কাকে বলে জানে না। তা ছাড়া আমি এক ঘণ্টার মধ্যে এ বাড়ি থেকে না বেরোলেই পুলিশে ঘিরে ফেলবে এ বাড়ি। নির্দ্বিধায় পকেট থেকে রিভলভার আর ছোট্ট টেপরেকর্ডার বার করে ড্রয়ারে রাখলাম। নির্মাল্যর পেছন পেছন একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকলাম। আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ক্লিক করে শব্দ হল। ঠিক যেন কেউ ক্যামেরায় ছবি তুলল।

টেবিলের ওপর একটা বাক্সের মতো যন্ত্র। সেটাকে দেখিয়ে নির্মাল্য বলল, এই আমার মৃত্যুবাণ। দুলাল ভুল বলেছিল। বৈজ্ঞানিক নির্মাল্য সিংহরায় ওসব তন্ত্রসাধনার তোয়াক্কা করে না, তার মাথার মধ্যে এই পদার্থ থাকতে। বলে সে নিজের মাথায় দু-বার টোকা দিল।

তারপর সুইচ টিপে বাক্সটার গায়ে একটা আলো জ্বেলে বলল, এ জগতে একটা আশ্চর্য জিনিস হচ্ছে, কোনও দুটো মানুষের চেহারা, তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের হাতের, পায়ের ছাপ কখনও হুবহু একরকম হয় না। অনেক সময় আশ্চর্যরকম মিল দেখা যায়– বিশেষ করে যমজ ভাই বা বোনের চেহারায়। কিন্তু অবিকল একরকম নয়। সে শুধু সিনেমার গল্পেই হয়। যে মানুষকে মৃত্যুবাণ মারব, তার একটা ফোটো জোগাড় করে খোপে ভরতে হবে। ফোটোতে মানুষের দেহের প্রতিফলিত আলো মুদ্রিত থাকে। পরপর ছ-টা ফোটো একসঙ্গে রাখা যায় অনেকটা রিভলভারের কার্তুজের মতন, তা-ই না?

এই বলে নির্মাল্য আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, যার ফোটো আগে পোরা হবে, সে আগে মরবে। এখন মাত্র একটা ফোটো ভরা আছে, সেটা নীলমাধব সেনের। আমার এজেন্ট প্রমথই এটা জোগাড় করে এনেছে শরিকের কাছ থেকে। এরপর কার ফোটো ভরব, সেটা… কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই নির্মাল্য স্থিরচোখে আমার দিকে চেয়ে থাকল।

হঠাৎ যেন সংবিৎ পেয়ে আবার বলতে লাগল, এটা আমার এক আশ্চর্য আবিষ্কার। অথচ, এটার কথা প্রকাশ করলে লোকের কাছে আমার পরিচয় হবে অপরাধী। আবার দেখ, অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমার মতো অস্ত্র–যা একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে মারে–সেগুলোর আবিষ্কর্তারা মহান বিজ্ঞানী।

যন্ত্রটার ওপর হাত বুলিয়ে নির্মাল্য আবার বলতে লাগল, এই যন্ত্রটার প্রোগ্রাম করা আছে আমার মস্তিষ্কের চিন্তাকোশের সঙ্গে। যখন ভেতরের ফোটোতে এই লাল আলো পড়বে, সেই সময় আমি এই ছোট্ট আয়নাটার ওপর তাকিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দিতে বলব। সঙ্গে সঙ্গে সেই চিন্তা, শক্তি লক্ষ্যস্থলে ছুটে গিয়ে সেই আদেশ পালন করবে। আর সেই অদৃশ্য মৃত্যুবাণে বিদ্ধ হয়ে গাছের পাকা ফলটির মতন শিকার যেখানে ছিল, সেখানেই টুপ করে লুটিয়ে পড়বে।

এই আদেশ কত দ্রুত লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাবে, জানতে চাস? টেলিপ্যাথির গতি জানিস? না জানলে মহাভারত পড়িস। ছদ্মবেশী যম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করলেন, জগতে সবচেয়ে দ্রুতগামী কী? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, মন। আমাদের জানা সবচেয়ে দ্রুতগতি হচ্ছে আলো বা বিদ্যুতের গতি। মনের গতি হয়তো তার চেয়েও বেশি। এই দেখ, নীলমাধব সেন কুপোকাত?

বলেই একটা সুইচ টিপে লাল আলোটা জ্বালিয়েই নিবিয়ে দিল। একটু পরে নিজের পোষা কুকুরের দিকে লোকে যেমন মমতার দৃষ্টিতে তাকায়, সেইভাবে যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কী জানিস? এই যন্ত্র অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ আগেই বলেছি, এটাকে প্রোগ্রাম বা টিউন করেছি আমার চিন্তাতরঙ্গের সঙ্গে। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এটার ভেতরে একটা স্পার্ক হয়ে কনট্রোল ইউনিট পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তাই আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় মাঝে মাঝে গন্ডগোল করতে পারে ভেবে গার্ড ইউনিটটা চালু রেখে তবে শুতে যাই।

কিছুক্ষণ পরে আমি হতবুদ্ধির মতো নির্মাল্যর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। আসার সময় ড্রয়ারে আমার রিভলভার আর টেপরেকর্ডার পেলাম না। নির্মাল্য বলল, ওগুলো তার চাকর বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়েছে। ওখানেই আমাকে ফেরত দেবে। সত্যিই, বাড়ির বাইরে আসতেই অটুট অবস্থায় সেগুলো ফেরত পেলাম।

নির্মাল্যর চোখের দৃষ্টির অর্থ আমার অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তার কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে লোভ বড় হয়ে উঠেছে। আমার কাছেও সেই ভুয়ো বন্ধুত্বের চেয়ে সমাজের মঙ্গল বড়।

আমি জেনেছিলাম, নির্মাল্যর পরের শিকার আমিই। আমার অজ্ঞাতসারে আমার ফোটো তোলা হয়ে গিয়েছিল। সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি বাড়ি ফেরার পরেই সেটাই যন্ত্রে ভরবে নির্মাল্য। কিন্তু তার আগেই আমি আমার কৌশল লাগিয়েছি। নির্মাল্য যত বড় বৈজ্ঞানিকই হোক, আমার নিখুঁত সাফাইয়ের কাজ সে-ও ধরতে পারবে না। আমার কাজের খাতিরেই এটা শিখতে হয়েছে আমাকে। তাই যন্ত্র দেখবার ছলে একসময়ে পকেট থেকে নির্মাল্যর ফোটোটা বার করে যন্ত্রে ভরে দিয়েছি। মি. ভাটিয়ার জন্যে যেটা সংগ্রহ করেছিলাম, সেটা যে এভাবে কাজে লেগে যাবে, সেটা আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবতে পারিনি। আমায় মৃত্যুবাণ মারবার অনেক আগেই যন্ত্রটা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতো নিজের সৃষ্টিকর্তাকে মেরে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

[সন্দেশ, পৌষ ১৩৮৮]

মৃত্যুবাণ

মৃত্যুবাণ

মৃত্যুবাণ

গুণিনের ওপর শীতলার ভর হল। গাঁয়ের বারোয়ারি অশথতলা। তার নীচে পুরানো বেদিটা প্রদীপের তেল আর মেটেসিঁদুরে একটা বিচিত্র রং ধরেছে। নীল শ্যাওলার ওপর দিয়ে কালো পোড়া তেল ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে। একপাশে থকথকে সিঁদুর জমেছে চাপবাঁধা রক্তের মতো। ধুনোর গন্ধে যেন নিশ্বাস আটকে আসে।

বেদির ওপরে একখানা কালো পাথর, তার সারা গায়ে ব্রণের চিহ্ন। মারীজননীর প্রতীক। মাঝখান দিয়ে একটা প্রকান্ড ফাটল, দেখলে মনে হয় কেউ যেন সেটাকে দু-টুকরো করে কেটে ফেলবার চেষ্টা করেছিল। পৌত্তলিকতাদ্বেষী রাঢ়জয়ী মুসলমানেরই তলোয়ারের কোপ পড়েছিল কি না কে জানে।

ফাল্গুনের রৌদ্রে উদ্ভাসিত এই ভরা দুপুরেও অশথের বিস্তীর্ণ শান্ত ছায়ার নীচে ঘনিয়েছে উগ্রগন্ধী অন্ধকার। ধুনো পুড়ছে, গুগগুল পুড়ছে। পট পট করে শব্দ হচ্ছে, কালো ধোঁয়া চক্রাকারে উঠছে সাপের কুন্ডলীর মতো। ঢাকের গগনভেদী বোল উঠছে, ক্যানক্যান করে তীক্ষ্ণ পেতনির কান্নার মতো স্বর তুলছে কাঁসর। আর তার ভেতরে বসে গুণিন একটানা স্বরে মন্ত্রপাঠ করে যাচ্ছে। তার কতকটা সংস্কৃত, কতকটা বাংলা, কতকটা দুর্বোধ্য ড আর ঢ়-এর সমারোহ। অশুদ্ধ উচ্চারণে জোর দিয়ে বলে যাচ্ছে, হাড় কট্টন, মাংস চর্বণ…

চারদিকে মেয়ে-পুরুষের ছোটো একটা দল জমেছে। গলায় আঁচল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ, কেউ-বা তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত বিহ্বল দৃষ্টিতে। ঢোল আর কাঁসরের বিরাম যতিতে সেই গম্ভীর মন্ত্রনাদটা যেন অলৌকিক হয়ে উঠছে। ধুনোর ধোঁয়ায় যাদের মাথা ঘুরছে, চোখে যারা দেখছে অন্ধকার, তাদের যেন মনে হচ্ছে এই কালো পাথরটা হঠাৎ একসারি ধারালো দাঁতসুদ্ধ কালো একখানা রক্তাক্ত মুখ মেলে দেবে, আর কড়মড় করে হাড়-মাংস চিবোতে শুরু করে দেবে

হেই গুণিন, ভালো করে মন্তর পড়ো বাবা। মা-র অনুগ্রহ একটু না কমলে যে আর বাঁচি না।

জনতার মধ্য থেকে কার যেন সকাতর অনুনয়। গুণিন এক বার পেছন ফিরে তাকাল। মদের নেশায় আর ধুলোর আগুনে চোখ দুটো রাক্ষসের মতো টকটক করছে। প্রকান্ড একটা গোলাকার মুখ, খাড়া খাড়া চোয়াল। মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলোয় কপালের আদ্ধেকটা ঢাকা পড়েছে।

যেমন করে ম্যালেরিয়ার ঝাঁকুনি আসে, তেমনি থরথর করে একটা কাঁপন এসে যেন গুণিনের আপাদমস্তক ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল। দু-হাতে দুটো ধুনুচি নিয়ে উঠে দাঁড়াল গুণিন, সমস্ত শরীর তার টলছে। তারপরে শুরু হল তান্ডবনাচ।

গুণিনের ওপরে শীতলার ভর হয়েছে। মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ করে বেরুচ্ছে একটা বীভৎস চাপা আওয়াজ। কখনো মাটিতে আছড়ে পড়ছে, পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে নেচে চলেছে রুদ্ৰতালে। ঝাঁকড়া চুলগুলো থেকে ধুলোর ঝড় উড়ছে। ফটাস করে একটা ধুনুচি মাটিতে পড়ে দুখান হয়ে গেল, চারদিকে ছিটকে গেল আগুন। সর সর করে তোক পালিয়ে যেতে পথ পেল না।

গুণিন আবার উঠেছে, আবার নাচ শুরু করেছে। কিন্তু নাচের তালে কেন যেন ভাটা পড়েছে এবার। পা আর তেমনভাবে চলছে না। মুখ থেকে চাপা গোঙানির শব্দটা কেমন বিকৃত আর অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছে। জ্বলন্ত চোখ দুটো যেন ঝিমিয়ে আসছে ক্রমশ।

এবারে গুণিন থেমে দাঁড়াল। টলমল করে কাঁপতে লাগল তার সর্বশরীর। তারপর ঠিক ইচ্ছে করে নয়—পেছন থেকে কে যেন মস্ত একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে ঘাড় মুচড়ে ফেলে দিলে মাটিতে। চারপাশের জনতা চঞ্চল হয়ে উঠল। কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। যা হওয়া উচিত এ তো তা নয়। বিস্ফারিত ভয়ার্তচোখে গুণিন কিছুক্ষণ গোঁ-গোঁ করতে লাগল, কষ দিয়ে ফেনার সঙ্গে বেরিয়ে এল একঝলক রক্ত। বলি-দেওয়া পশুর মতো বার কয়েক হাত-পা ছুড়েই সে সটান শক্ত হয়ে গেল। সমস্ত শরীরে ঢেউয়ের মতো দোলা দিয়ে বেরিয়ে এল অন্তিম একটা দীর্ঘশ্বাস, নাকের সামনে থেকে খানিকটা ধুলো উড়ে গেল হাওয়ায়।

হইহই করে ছুটে এল জনতা। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। মরে পাথর হয়ে গেছে গুণিন। ঢাকের বোল থেমে গেল, স্তব্ধ হয়ে গেল কাঁসরের আর্তনাদ। স্তম্ভিত জনতা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ, নিদারুণ ভয়ে একটি কথাও কেউ বলতে পারলে না।

একজন বললে, নিশ্চয় অশুচি হয়ে পুজোয় বসেছিল, তাই… ধুনোর অন্ধকারে ব্রণ-চিহ্নিত শীতলার পাথরটা গাঢ় রক্তের মতো খানিক সিঁদুর মেখে ক্ষুধার্ত হয়ে তাকিয়ে আছে। অশথের পাতায় সাঁ সাঁ একটা উদাস বাতাস বয়ে গেল। যেন একটা অশরীরী কণ্ঠ চাপা গর্জন করে বলে গেল—এবার তোদের পালা, গুণিনের মতো তোরাও…

মুহূর্তে বারোয়ারিতলা জনশূন্য। প্রাণ নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছে সকলে। শুধু অসমাপ্ত পুজোর উপকরণের সামনে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে রইল গুণিনের দেহটা। মুখের পাশে রক্তের চাপ ক্রমে ঘন হয়ে উঠতে লাগল, ধূপ আর গুগগুলের ধোঁয়া একটা কালো পর্দার মতো নিবিড় হয়ে নামতে লাগল তার চারপাশে।

গুণিনের আসল নাম অভিরাম দাস—জাতিতে চন্ডাল।

এই জাতিটা নাকি বর্ণসংকরের কঠিনতম শান্তির প্রতীক। প্রতিলোম বিবাহকে ক্ষমা করবে ব্রাহ্মণচালিত সমাজ, ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে অব্রাহ্মণকে পতিরূপে বরণ করলে তাদের সন্তান হবে অন্ত্যজ। সমাজের সমস্ত পথ তার কাছে বন্ধ হয়ে যাবে। তাকে শ্মশানে বাস করতে হবে, অখাদ্য আহার করতে হবে, মড়ার কাপড় নিয়ে লজ্জা নিবারণ করতে হবে। তাদের ছায়া মাড়ালে খন্ডে যাবে, ক্ষয়ে যাবে সতেরো বার বিশ্বনাথ দর্শনের পুণ্য।

আজকাল অবশ্য অন্ত্যজ মাত্রেই শ্মশানের বাসিন্দা নয়। কিছু কিছু পদোন্নতি যে হয়েছে তাতে আর সন্দেহ কী। এখন তারা ভদ্রপাড়ার কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে কিছুটা। শুয়োর চরায়, ডালা কুলো ধুনুচি তৈরি করে ভদ্রসমাজের দৈনন্দিনের পক্ষে সেগুলো অপরিহার্য। কেউ কেউ খেত করে, তরিতরকারি লাগায়, বিক্রি করে বাজারে। দু-একটা ভালো ফল ফুল উপহার দিলে ন্যায়রত্ন স্মৃতিরত্নেরা খুশিমনেই সেগুলো গ্রহণ করে থাকেন, অবশ্য নেবার সময় কিছু কিছু গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেওয়া হয় তাতে। কিন্তু এ ছাড়াও আর একটা দিক আছে এদের। সেজন্যে ইতর ভদ্র নির্বিচারে ভয় করে এদের, শ্রদ্ধা করে। এরা মন্ত্রসিদ্ধ।

অভিরামের বাপ নিধিরাম ছিল এ তল্লাটের সেরা গুণিন। না-জানত এমন মন্ত্র নেই, না পারত এমন ঝাড়ফুক নেই। কুকুরে কামড়েছে, একটুখানি জলপড়ায় সে তা ভালো করে দিত। সাপে ছোবল মেরেছে, পিঠের ওপর পেতলের থালা আটকে দিয়ে তার ওপর মন্ত্রপড়া মাটি ছড়িয়ে সে বিষ নামিয়ে নিত। ভূতে ধরলে তো আর কথাই নেই, নিধিরাম না গেলে কার সাধ্য সে-ভূত নামায়। বাণ মারতে পারত, বাটি চালান করতে পারত, জ্বলন্ত একটা প্রদীপ আকাশে উড়িয়ে দিয়ে অগ্নিকান্ড ঘটিয়ে দিতে পারত দূরের কোনো একটা নিশ্চিন্ত নিদ্রিত গ্রামে।

তা ছাড়া বংশানুক্রমিকভাবে তারা বারোয়ারি শীতলার পূজারি। শুধু পূজারি নয়, দেবীর প্রসাদপুষ্ট। কোনো এক অতীত অনার্য সংস্কৃতির ধারায় অন্তত এখানে ওদের অধিকার অব্যাহত। কোন অনাদিকাল থেকে এরা শীতলার পুজো করে আসছে কেউ বলতে পারে না। ব্রাহ্মণের প্রবেশ নিষেধ। শোনা যায় কিছুদিন আগে তন্ত্রসিদ্ধ এক ব্রাহ্মণ এসেছিলেন গাঁয়ে। চাঁড়ালে দেবী পুজো করে শুনে তিনি খেপে উঠলেন। বললেন, দেবী অশুচি, তাঁকে শোধন করে নিয়ে ব্রাহ্মণকে দিয়ে পুজো করাতে হবে।

গাঁয়ের লোকে নিযেধ করলে, কিন্তু দাম্ভিক তন্ত্রসিদ্ধ সেকথা শুনলেন না। দেবী শোধনের ব্যবস্থা করে পুজোয় বসলেন তিনি। আর পরমুহূর্তেই আশ্চর্যকান্ড। কোথা থেকে প্রকান্ড একটা চড় বাজের মতো শব্দ করে তাঁর গালে এসে পড়ল। অদৃশ্য হাতের সেই চড় খেয়ে ব্রাহ্মণ যে উলটে পড়ে গেলেন, আর উঠলেন না।

সেই থেকে চাঁড়ালেরাই এখানে পুজো করবার কায়েমি অধিকার পেয়েছে। খাতির বেড়েছে তাদের, খ্যাতি বেড়েছে আরও অনেক বেশি। গাঁয়ের উঁচু জাতেরা অসংকোচে অন্ত্যজের দেবীকে পুজো করেন, অন্ত্যজ পূজারির ছোঁয়া প্রসাদ পান। আর বসন্ত চিকিৎসার ব্যাপারে অধিকার তো তাদের একচেটিয়া।

কোথা থেকে একদিন পেতনি নামিয়ে এসে ভরা দুপুরের সময় নিধিরাম ঢক ঢক করে এক ঘটি জল খেল। আর মারাও গেল তার ঘণ্টা খানিক পরেই। দু-চার জন লোক মুখে বললে, সর্দিগর্মি; কিন্তু সকলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নিলে রোজার ঘাড় ভূতেই মটকেছে। শেষপর্যন্ত।

তার ছেলে অভিরাম। বাপের মতো তারও এমনি হঠাৎ মৃত্যু ঘটে গেল। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এ যেন ইতিহাসের সহজ এবং স্বাভাবিক ধারা। কিন্তু তারও আগে আরও একটু গল্প আছে।

বাংলা দেশের ওপর দিয়ে মহামন্বন্তর বয়ে গেল। যারা যাওয়ার তারা তো মরে বাঁচল, কিন্তু যারা রয়ে গেল তাদের দুর্গতির আর সীমা রইল না। শ্মশান বাংলার গ্রামে গ্রামে শ্মশানের প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল মানুষ। এক মুঠো কাঁকর-মেশানো ভাত সম্বল, এক ফালি ছেঁড়া ন্যাকড়া সম্বল। রাতারাতি যেন সবাই মায়াপ্রপঞ্চময় সংসারটাকে চিনে ফেলেছে দেহে মনে, বেশে বাসে অনাসক্ত বৈরাগ্য। চোখের দৃষ্টি অর্থহীন, যেন বাইরের অবান্তর পৃথিবীটার ফাঁকিটা ধরে ফেলে ব্ৰহ্মলাভের জন্যে একান্তভাবে অন্তর্মুখী হয়ে গেছে।

শাস্ত্রে বলেছে সবই যখন নলিনীদলগতজলমিব—তখন একটি মাত্র ভরসা আছে, সেটি হচ্ছে সাধুসঙ্গ এবং তার দ্বারাই ভবার্ণব পার হওয়া যায়। এবং ঈশ্বর করুণাময়, সাধুসঙ্গ তিনি পাঠালেন।

দুর্ভিক্ষ যখন শেষ হয়ে গেল তখন দেশের লোককে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে সরকারি ধানের গোলা বসতে লাগল এখানে-ওখানে। এল লাইসেন্সপ্রাপ্ত সরকারি এজেন্টের দল—মহাজনের করাল গ্রাস থেকে দেশকে বাঁচাবার মহৎ ব্রত নিয়েছে তারা। তার সঙ্গে এল সিভিল সাপ্লাই ইন্সপেক্টর, এল বোট অফিসার, এল এনফোর্সমেন্ট—কে এল এবং কে এল না।

এখান থেকে বারো মাইল দূরে ধান-চালের মস্তবড়ো একটা গঞ্জ। তার পাশ দিয়ে যে নদী, বর্ষার সময় ছাড়া তাতে নৌকো চলে না। হাঁটুজলের ওপর যে-পরিমাণে কচুরির স্কুপ জমে ওঠে, তাতে বরং মোটর চালিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু নৌকোর প্রশ্ন অবান্তর। অতএব…

অতএব রাস্তা তৈরি করতে হবে।

সে-কাজ নিলে কৃষ্ণপ্রসাদ। গৌরী সেনের টাকা—অফুরন্ত এবং অকৃপণ। এক বার টেণ্ডার নেওয়াতে পারলে আর ভাবনা নেই। পরবর্তী পথটুকু মসৃণ—তৈলাক্ত।

ধানের আল আর মজা দিঘির পাশ দিয়ে কৃষ্ণপ্রসাদ সাইকেল চালিয়ে এল। বারোয়ারি অশথতলায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। ভারি ভালো লাগছে ঠাণ্ডা ছায়া আর ঠাণ্ডা বাতাসটা।

আপনি, হুজুর? মস্ত একটা প্রণাম জানিয়ে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলে অভিরাম।

আমি? বাঁ-হাতটাকে হাফ প্যান্টের পকেটে পুরে কৃষ্ণপ্রসাদ সিগারেটের ধোঁয়া উড়তে লাগল। বললে, সরকারি লোক। রাস্তা করতে হবে এখানে, আঠারো মাইল দূরের রাস্তা। সরকারি লরি যাবে, গাড়ি যাবে—বুঝেছ?

আজ্ঞে রাস্তা?

নিশ্চয়। মুখস্থ করা লিবুর মতো কৃষ্ণপ্রসাদ বলে গেল, দেশের ভালোর জন্যেই। চালের ইজি সাপ্লাই হবে, গ্রামের উন্নতি হবে, ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের পথ বন্ধ হবে। একেবারে পাকাঁপাকি বন্দোবস্ত।

অভিরাম বিস্মিতমুখে তাকিয়ে রইল। কৃষ্ণপ্রসাদ যেন আকাশ থেকে কথা বলছে। দেশটাকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে নিস্তার দেবার জন্য স্বর্গ থেকে মর্ত্যভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছে হাফ প্যান্টপরা সাইকেলধারী একটি দেবতা। অশথতলায় পাথরের শীতলা নিদ্রিত হয়েই আছেন, কিন্তু ইনি যেমন জাগ্রত তেমনি মুখর।

ভাবতে পারা যায় রাস্তা তৈরি হবে এই গ্রামের মধ্য দিয়ে? যেখান দিয়ে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে রেলগাড়ি চলে যায়, তার চাকায় চাকায় সর্বদা মুখর সভ্যতার গর্জন, সে এখান থেকে অনেক দূরে। একটা মরা নদীর খেয়া, তিনখানা গ্রাম, ছ-খানা মাঠ, আরও এক ক্রোশ জেলাবোর্ডের পথ। এখানকার মানুষ যেন বাস্তু বেঁধেছে জীবনের তটতীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মধ্যে। একটা প্রাইমারি ইশকুল—সেও তিন মাইল দূরে। রাত্রির অন্ধকারে বহুদূর থেকে যেমন মহানগরীর মাথার ওপরে একটা অস্বচ্ছ জ্যোতির্মন্ডল দেখা যায়, এখান থেকেও তেমনি নাগরিক জীবনের একটা অলক্ষ্য জ্যোতি :সংকেত অনুভব করা চলে মাত্র। তবু চৌকিদারি ট্যাক্স আসে তামাকের ওপরে, দেশলাইয়ের ওপরে নতুন খাজনা আসে, শহরের তৈরি লোভের কারখানা থেকে মন্বন্তর আসে। এখানে আমদানি নেই, এ শুধু রপ্তানির দেশ।

এখানে রাস্তা হবে, গ্রামের উন্নতি হবে।

কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি! শুধু অভিরাম নয়, অভিরামের মতো দু-চার জন নয়, সমস্ত গ্রামটাই আনন্দিত বিস্ময়ে সজাগ হয়ে উঠল। আর সেই বিস্মিত আনন্দকে তটস্থ করে দিয়ে মাঠের পাশ দিয়ে একরাশ তাঁবু পড়ে গেল। যেন উড়ে এল হাওয়াতে।

পাঁচশো বছর আগে শীতলার থানে মুসলমানদের তলোয়ারের ঘা পড়েছিল, তারপরে আর কোনো জীবনচাঞ্চল্য জাগেনি এখানে। পাঁচশো বছরের মরা গাঙে নতুন করে জোয়ার এল। সেদিন এসেছিল রাষ্ট্রবিপ্লবে, আজ এল মন্বন্তরে।

অশথ গাছের ঠাণ্ডা ছায়ার নীচে দাঁড়িয়ে হিরালাল বাগদি। বললে, কারবারটি এক বার দেখছ গুণিন ভাই?

অভিরাম সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। বললে, হ্যাঁ।

উঃ, কী পেল্লায় কান্ড করছে রে বাবা! বনজঙ্গল গাছপালা সব লোপাট করে দিয়ে সড়ক বানাচ্ছে। মানুষের নাকি আর ভাতের দুঃখু থাকবে না। এই যদি মনে ছিল রে বাপু, তাহলে ক-টা দিন আগে এলিনে কেন? সব সাবাড় করে দিয়ে…

তখন তো ওদের সময় হয়নি।

 ওদের সময় হয় একটু দেরিতে, তাই না? হিরালাল রসিকতার চেষ্টা করলে, সিঁদেল চোরে সব লোপাট করে নিয়ে তিন মাইল ডাঙা পেরিয়ে গেলে চৌকিদারে এসে হাঁক পাড়ে।

অভিরাম জবাব দিলে না, কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। সামনে যা চলছে তা প্রলয়কান্ডই বটে। পাথরের মতো শক্ত টিলা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। সাফ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল, আদ্যিকালের পচা ডোবাগুলো দেখতে দেখতে ভরাট হয়ে গেল, আর নাকি ম্যালেরিয়া থাকবে না দেশে। শাবল, গাঁইতি, কোদাল। একশো কুলি খাটছে, শব্দ উঠছে ঝপ ঝপ ঝপাস, ঠন ঠন ঠনঠন। কোদালের মুখে মাটির তলা থেকে বাদামি রঙের মানুষের হাড় উঠে আসছে, পাঁচশো বছর আগেকার হাড় কি না কে জানে!

চোখ দুটোকে হঠাৎ সংকুচিত করে আনলে অভিরাম। মোটা মোটা ভ্র-দুটো একসঙ্গে এসে যোগ হয়ে গেল, তার ওপরে রেখা ফুটল একটা অর্ধবৃত্তের আকারে।

লক্ষণ আমার ভালো লাগছে না হিরু।

কেন গুণিন ভাই, কেন?

কী জানি কেন। অভিরাম নিজেও জানে না। হয়তো এই আকস্মিকতাকে ভয়, হয়তো এই নতুনকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। গাঁইতি আর কোদালের মুখে পুরোনো মাটি যেন যন্ত্রণায় কেঁদে উঠছে, যেন অভিশাপ দিচ্ছে। অথবা এ হয়তো ওর রক্তার্জিত সংস্কার। আকাশে-বাতাসে যেসব অশরীরী শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই সভ্যতা বর্জিত নগণ্য গ্রামে যাদের ছিল একাধিপত্য; রাতদুপুরে যারা অকারণে ঝপ ঝপ সরসর করে প্রকান্ড বট গাছের ডালপালাগুলোকে ঝাঁকিয়ে দিত, ভরা অমাবস্যায় মড়ার মাথা নিয়ে যারা শ্মশানে খটাখট করে গেন্ডুয়া খেলত আর খিলখিল করে হাসত, কিংবা পুরোনো দিঘির ধারে যাদের মুখে লকলক করে আগুন জ্বলে উঠত—তারাই কি প্রেতসিদ্ধ গুণিনের অনুভূতির ওপরে সঞ্চারিত করছে তাদের অলৌকিক প্রতিবাদ?

রহস্যময় মুখখানাকে আরও রহস্যময় করে গুণিন বললে, সে থাক।

ওদিকে রাস্তা তৈরি হয়ে চলেছে। চমৎকার রাস্তা, উঁচু-নীচু অসমতল মাটিকে দীৰ্ণবিদীর্ণ করে দিয়ে সরকারি লরির মসৃণ মনোরম চলবার পথ-রাজপথ। কিন্তু কাজ এগোতে পারছে না। কৃষ্ণপ্রসাদ হিসেব করে দেখলে এভাবে চললে বাঁধা সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে না। ওপরওয়ালা আর কর্তাদের কাছ থেকে তাগিদের পর তাগিদ আসছে। অতএব আরও লোক চাই। ঝড়ের গতিতে কাজ শেষ করো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পথ তৈরি করে দাও। যুদ্ধ খাদ্যসংকট—এমার্জেন্সি।

কুলির জন্য খবর গেল সদরে, কিন্তু কুলিরও বাজারদর বেড়েছে—বর্মা থেকে আসামফ্রন্ট পর্যন্ত তাদের চাহিদা। আর এই অজগর বিজেবনে লোক পাঠানোর বন্দোবস্ত করাও শক্ত। সুতরাং সদর থেকে পালটা খবর এল, লোকাল রিক্রুট করো।

কৃষ্ণপ্রসাদের স্বর্গীয় আভিজাত্য আর রইল না। খাকি হাফ প্যান্টের নীচে হাঁটু পর্যন্ত জমে উঠল ধুলো। ঘরে ঘরে তাগিদ পড়ল–এসো তোমরা কাজে লেগে যাও সবাই।

সকলের হয়ে এগিয়ে এল অভিরাম।

কুলির কাজ আমরা করব না হুজুর।

বিস্মিত এবং ক্রুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণপ্রসাদ বললে, কেন?

আমাদের বাপ পিতামো কখনো মাটিতে কোদাল মারেনি—ছোটো কাজ করেনি। সে পারে ছাতুরা, আমরা পারব না।

ছোটো কাজ! কৃষ্ণপ্রসাদ হেসে উঠল হা-হা করে। এক বেলা খেতে জোটে না, আভিজাত্যের জ্ঞানটা টনটন করছে একেবারে। ঢোঁড়া নয়, হেলে সাপ; কুলোপনা চক্কর নয়, বারকোশপানা। কিন্তু পরক্ষণেই বেদনায় কৃষ্ণপ্রসাদের গলার স্বর যেন ভারী হয়ে গেল।

ছি ছি, এ কী কুবুদ্ধি তোদের! গায়ে খাটবি, পয়সা পাবি, এতে অপমানের আছে কী? এই জন্যেই-না বাঙালির এমন দুর্দশা। তাই এই ঘরপোড়া দুর্বুদ্ধির জন্যেই তো এত লোক না খেয়ে শুকিয়ে মরল। অথচ পশ্চিম থেকে হিন্দুস্থানি কুলি এসে কীভাবে যে বাঙালির দেশকে লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে…

পাঁচ মিনিট একটা দীর্ঘ টানা বক্তৃতা, উদারা মুদারা এবং তারায়। ঘুরে ফিরে অতি কোমল নিখাদে এসে যখন যুক্তিপূর্ণ ভাষণটা সমাপ্ত হল, দেখা গেল আবেগে কৃষ্ণপ্রসাদের চোখের কোনায় কোনায় জলের বিন্দু দেখা দিয়েছে।

এখনও ভেবে দ্যাখ সবাই। এক বেলা তো পেট পুরে ভাত জুটছে না তোদের। আর কুলিগিরি করে যা মজুরি পাবি তাতে…

অর্ধভুক্ত ক্ষুধিত চোখগুলো লোভে জ্বলজ্বল করে উঠল। দৃষ্টির সামনে ঝলক দিয়ে গেল সোনালি মরীচিকা। সত্যিই তো অন্যায়টা তাদের কোনখানে। জমিতে যদি লাঙল ঠেলতে পারে তাহলে কোদাল মারলে মহাভারত সত্যিই কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

অভিরাম মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললে, কিন্তু বাবু…

কিন্তু লোকচরিত্র বোঝে কৃষ্ণপ্রসাদ। অভিরামের সর্বাঙ্গে বিদ্রোহ ঘনিয়েছে—গাঁয়ের লোকের ওপরে তার অপ্রতিহত প্রতিপত্তি, বিদ্বান নতুন লোক এসে সে-অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে এটা সে কল্পনাই করতে পারছে না। কিন্তু সে-আধিপত্যটা আধ্যাত্মিক। আধিভৌতিক প্রয়োজনের দাবিটা ঢের ঢের বেশি এবং বাস্তব—এই সহজ কথাটুকু বোঝবার বুদ্ধি কৃষ্ণপ্রসাদের আছে।

ঠোঁটের কোনা দুটো একটু বিস্তৃত করে কৃষ্ণপ্রসাদ তীক্ষ্ণ সর্পিল হাসি হাসলে। অভিরাম ছাড়া আর সমস্ত মানুষগুলির মুখই একাকার হয়ে গেছে। অলৌকিক ভীতি নয়—লৌকিক ক্ষুধা। লোভে এবং দ্বিধায় তারা বিচলিত হয়ে উঠেছে। মুহূর্তের জন্যে কৃষ্ণপ্রসাদ অনুভব করলে অভিরাম তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তার ক্ষমতালাভের পথে প্রতিপক্ষ। কিন্তু কৃষ্ণপ্রসাদের হাসিটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপে আরও খানিকটা বিস্মৃত হয়ে পড়ল। শেষপর্যন্ত জয় হবে তারই।

পকেট থেকে কালো চামড়ার নোটবই বেরোল। বলো, কে কে রাজি আছ।

এক বার কৃষ্ণপ্রসাদ আর এক বার অভিরামের মুখের দিকে তাকাল সকলে। অভিরামের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, শক্ত হয়ে উঠেছে খাড়া চোয়াল। যেন যে নাম লেখাবে, বাঘের মতো তারই ঘাড়ের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে সে।

কিন্তু জয় হল অপদেবতার নয়—সরকারি কন্ট্রাক্টরের। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল নিষ্কম্প স্তব্ধতায়। তারপর গলাটা সাফ করে নিয়ে হিরালাল বললে, লিখুন।

অভিরাম নড়ে উঠল। দুটো চোখ থেকে এক ঝলক আগুনবৃষ্টি করলে যেন। তারপর হনহন করে হেঁটে চলে গেল।

এবারে শব্দ করে হেসে উঠল কৃষ্ণপ্রসাদ, লোকটা পাগল নাকি?

গাঁয়ের লোক সে-হাসিতে যোগ দিল না।

গুণিনের চোখের সামনে দিয়েই সরকারি রাস্তা তৈরি হয়ে চলল। সবাই খাটে সেখানে, হিরালাল, মতিলাল, জনক। তিন-চার দিনের মধ্যেই হালচাল বদলে গেছে তাদের। রাতারাতি সব বড়োমানুষ। গাঁয়ের দুঃখ দূর হল এতদিনে। কৃষ্ণপ্রসাদের বক্তৃতায় ফাঁকি নেই। দেশের দুঃখে ঝরে-পড়া তার চোখের জল যে নিঃসন্দেহে আদি এবং অকৃত্রিম, এ সম্পর্কে মনে আর কেউ সন্দেহ পোষণ করেন না।

এক পয়সার বিড়ি জুটত না কোনোকালে, টুকরো বিড়ি কুড়িয়ে নিয়ে ধূমপানের তৃষ্ণাটা নিবারণ করত জনক। সেই এসে হাজির হল এক বাক্স সিগারেট নিয়ে। বললে, নাও গুণিন, একটা সিগারেট নাও। ভালো জিনিস, ঠিকাদারবাবু দিয়েছে।

অসীম বিরক্তিভরে অভিরাম বললে, নাঃ।

না? কেন, আপত্তিটা কীসের? সত্যি ভায়া তুমিই ঠকলে? খালি ভূত ঝাড়লেই কি পেটের ব্যবস্থা হয় আজকাল? চলে এসো আমাদের সঙ্গে, দু-কোপ মাটি তোলো, দিনমজুরি দুটো টাকা তোমার রোখে কে?

একটা চড় মেরে তোর মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।

আস্তে আস্তে জনক পিছু হটতে লাগল। ভীরু গলায় বললে, কেন, কেন অন্যায়টা কী বলেছি? সবাই যখন দু-পয়সা করে নিচ্ছে…

দু পয়সা! হঠাৎ রাক্ষসের মতো গলায় গুণিন গর্জে উঠল, নিজের মান-সম্মান বিসর্জন দিয়ে অমন পয়সার মুখে লাথি মারি আমি। ভাবিসনি এ সুখ তোদের সইবে। মা শীতলে জেগেই আছেন—জানলি, ধর্মের গাঁয়ে কখনো অধর্ম তিনি সইবেন না।

জনকের বুকের মধ্যটা কেঁপে গেল, শাপ দিচ্ছে নাকি গুণিন! মন্ত্রসিদ্ধ ভূতসিদ্ধ নোক সে, তার অসাধ্য কুকাজ নেই। একি শুধু কথার কথাই না এমনিভাবে দেশসুদ্ধ লোকের সর্বনাশ করবার মতলব আঁটছে সে! কিন্তু কেন? এমন কী অপরাধ করেছে তারা। ঘরের ভেতর ছটফটিয়ে মরলেও যখন একটি বার কেউ ডেকে জিজ্ঞেস করে না কিংবা এক ফোঁটা জল দেয় না খেতে, তখন গায়েগতরে খেটে দুটো পয়সা রোজগার করলে কার কী বলবার আছে। অথচ কেন এমন করছে গুণিন, কেন সে এমনভাবে হিংস্র হয়ে উঠেছে! জনক কিছু বুঝে উঠতে পারল না।

কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যে ভূতে ধরেছে সে-খবর অভিরামের জানা ছিল না।

সন্ধ্যার সময় গুণিনের বউ পদ্মা এসে সামনে দাঁড়াল। বললে, একটা কথা বলব?

কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে অভিরাম ডালা বুনছিল। বললে, কী বলবি?

গাঁয়ের মেয়েরা তো সবাই রাস্তায় কাজ করতে যাচ্ছে। দু-পয়সা পাচ্ছেও। তাই…

তাই? হাতের ডালাটা নামিয়ে রেখে সন্দিগ্ধ উগ্র চোখে তাকালে অভিরাম। চোয়ালের হাড় দুটো কঠিন হয়ে উঠেছে, মাথার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলগুলো নেমে এসেছে কপাল ছাড়িয়ে। অগ্নিগর্ভ স্বরে বললে, তাতে কী হয়েছে!

ডালা-কুলো বেচে আর ভূত ঝেড়ে তো সংসার চলে না। যা আকাল পড়েছে! আমিও যদি ওখানে গিয়ে কাজ করি, তাহলে অন্তত একটা করে টাকা…

অভিরাম তিরের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়াল।

খবরদার, খবরদার পদ্ম। ওকথা আর এক বার মুখে আনবি তো সোজা খুন হয়ে যাবি। গুণিনের বংশ আমরা। মা শীতলার দয়া আমাদের ওপরে। ঘরে না খেয়ে মরে থাকব সেও ভালো কিন্তু ওসবের মধ্যে আমরা নেই। গোলামি করি না আমরা, ছোটো কাজ করি না।

চাঁড়ালের ঘরের সুন্দরী বউ পদ্মা ঠোঁট ওলটাল। স্বাস্থ্যপুষ্ট কালো শরীরটা যেন নদীর জলের মতো ছলছলিয়ে উঠল চাঞ্চল্যে এবং অবিশ্বাসে।

তোমার মান নিয়েই তুমি গেলে। সবাই যখন কাজ গুছিয়ে নিলে, তখন…

পদ্মাকে মারবার জন্যে একটা ব্যাঘ্রমুষ্টি তুললে অভিরাম। আর সেই মুহূর্তেই বাইরে থেকে ডাক পড়ল, গুণিন–গুণিন?

কে?

 অপরাধী গলায় উত্তর এল, আমি হিরালাল।

একটা ঘোমটা টেনে ঘরের মধ্যে সরে গেল পদ্মা, আর কেরোসিনের অনুজ্জ্বল আলোর সামনে হিরালাল এসে দাঁড়াল। চোখে দুটো ভীতিতে বিস্ফারিত এবং বিহ্বল।

কী হয়েছে?

এক বার এসো ভাই। আমার বডোমেয়েটার যেন কী হয়েছে। জ্বর নেই জারি নেই, সন্ধে থেকে কেবল তড়পাচ্ছে আর থেকে থেকে চোখ উলটে আসছে, তুমি এক বার চলো। হিরালালের গলা কান্নায় কাঁপছে।

হুঁ, এবার গুণিনকে মনে পড়েছে তাহলে।

রাগ কোরো না ভাই, চলো। তুমি রাগ করলে আমরা কোথায় দাঁড়াই।

একটা বিরাট আত্মপ্রসাদে ভরে উঠল অভিরামের মন। খালি কৃষ্ণপ্রসাদ নয়, তারও দাম আছে, তারও প্রয়োজন আছে। এ তাদের বংশগত অধিকার, মা শীতলার অনুগ্রহে আধিব্যাধি সারাবার দায়িত্ব একমাত্র তাদেরই। পেটের খিদে মেটাবার লোভ দেখিয়ে কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রামের লোককে বশীভূত করতে পারে, কিন্তু যে-শত্রুকে চোখে দেখা যায় না তার বেলায়? মা ওলাইচন্ডী আর মা শীতলার যে-সমস্ত অনুচর দৃষ্টির অলক্ষ্যে মৃত্যুবাণ নিয়ে ঘুরছে, তাদের হাত থেকে বিপন্ন মানুষকে রক্ষা করতে পারে কে? অন্ধকার শ্যাওড়া গাছে যাদের আস্তানা কিংবা এলোচুলে ভর সন্ধেতে পুকুর ঘাটে গেলে যাদের নজর পড়বেই—কোনো সরকারি ঠিকাদারের সাধ্য নেই যে মুঠো মুঠো টাকা ছড়িয়ে দিয়ে তাদের বশীভূত করতে পারে।

ছোটো বেতের ঝাঁপিটা তুলে নিয়ে অভিরাম বললে, চলো।

হিরালালের দাওয়ায় তখন লোকারণ্য। ছোটো মেয়েটা পাগলের মতো ছটফট করছে, গড়াচ্ছে, কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা। অমানুষিক দুটো বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকাচ্ছে আর থেকে থেকে উঠছে প্রচন্ড এক-একটা হিক্কার ধমক। হিরালালের বউ মড়াকান্নার রোল তুলেছে তারস্বরে।

কটমট করে খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল অভিরাম। তারপর সংক্ষেপে বললে, হুঁ, পেতনিতে পেয়েছে।

বাড়িময় কোলাহল, কান্নার রোল আরও প্রবল হয়ে উঠল। গুণিন প্রকান্ড একটা ধমক দিয়ে বললে, চুপ। কিছু সরষের জোগাড় করো।

ভূতঝাড়া শুরু হল। সরষের পর সরষের প্রহার, সর্বাঙ্গে জলের ছিটে, কিন্তু পেতনির নামবার লক্ষণ নেই। মেয়েটা তেমনি করেই দাওয়াময় গড়িয়ে বেড়াচ্ছে। থেকে থেকে এমন এক-একটা হিক্কা উঠছে যে সন্দেহ হয় কখন তার দম আটকে যাবে। অভিরামের কপালে ঘাম জমে উঠতে লাগল। সংশয়ে ভরে যাচ্ছে মন। কিছুতেই কিছু হবার লক্ষণ নয়। সমস্ত বাড়িময় কালো অন্ধকার ঘনিয়েছে, ছোটো আলোকটা মিটমিট করছে, নিবে যাবে এক্ষুনি। আর সেই অস্পষ্ট আলোয় মেয়েটার দুটো ভয়াবহ চোখ দেখে তারই অন্তরাত্মা শিউরে উঠল। কামরূপ-কামিখ্যের ডাকিনীর আদেশ কোনো কাজে লাগছে না, বাঁচানো গেল না মেয়েটাকে।

টর্চের জোরদার আলো পড়ল প্রায়ান্ধকার প্রাঙ্গণে।

জুতোর মচ মচ শব্দ করে এসে ঢুকেছে কৃষ্ণপ্রসাদ। সঙ্গে আরও একটি ভদ্রলোক। কৃষ্ণপ্রসাদ হাসল, তোমার মেয়ের অসুখের খবর শুনে ডাক্তার নিয়ে এলাম হিরালাল। আমারই বন্ধু, এদিকে কাজে এসেছিলেন। সুবিধেই হল তোমার।

হিরালাল দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললে, গুণিন ওকে ঝাড়ছিল কিনা হুজুর, তাই…

ডাক্তার তাচ্ছিল্যভরে বললে, হ্যাং ইয়োর গুণিন। ওসব বুজরুকিতে কাজ চলে না, রোগও সারে না। তোমার ওই ঝুলি কাঁথা নিয়ে সরে দাঁড়াও তো বাপু, আমি এক বার দেখি।

বিদ্রোহী ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে অভিরাম বসে রইল। এক তিল নড়ল না।

কৃষ্ণপ্রসাদ টর্চের আলোটা অভিরামের মুখের ওপর ফেলল। একটু সরে বসো তুমি। অনেক তো করলে, কিছু পারলে না দেখতেই পাচ্ছি। এবার ডাক্তারবাবুকে দেখতে দাও।

অভিরাম তবুও নড়ে না। বললে, আমাকে ডেকে এনেছে হিরালাল। আমি ঝাড়ব একে, কোনো ডাক্তার-ফাক্তারের পরোয়া রাখি না আমি।

ননসেন্স! ইডিয়ট! নতুন ডাক্তারের ধৈর্যচ্যুতি হল। রোগীকে মেরে ফেলবে নাকি লোকটা? এদের নামে ক্রিমিনাল কেস করে দেওয়া উচিত।

অভিরামের মাথায় চড়ে গেল রক্ত, আর উদবেলিত সেই রক্তের উচ্ছাস যেন ফেটে বেরিয়ে পড়বার উপক্রম করলে দুটো চোখের মধ্য দিয়ে। একটা অশ্লীল গাল দিয়ে অভিরাম বললে, খবরদার!

মুহূর্তে কোথা থেকে কী হয়ে গেল! ডাক্তার সজোরে জুতোসুদ্ধ একটা প্রকান্ড লাথি বসিয়ে দিলে অভিরামের বুকের ওপরে। ভূত ঝাড়বার সরঞ্জামগুলোতে বিপ্লব ঘটিয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ল অভিরাম। ব্যাপারটা যেন ভোজবাজি, এমন একটা-কিছু যে ঘটতে পারে এ যেন কল্পনার অতীত।

জনতা নিঃশব্দ এবং নির্বাক। কৃষ্ণপ্রসাদ বললে, ছি ছি সেন, করলে কী!

সেন তখন রোগীর ওপরে ঝুঁকে পড়েছে নির্বিকার মুখে। শান্ত গলায় জবাব দিলে, যা করা উচিত, তাই করেছি। শুয়োরের বাচ্ছাটা পেশেন্টকে মেরে ফেলবার উপক্রম করেছিল, তার ওপরে আবার লম্বাই-চওড়াই! চৌধুরি, এক কাজ করো, কালই ওই স্কাউন্ট্রেলটাকে হ্যাণ্ড ওভার করবার বন্দোবস্ত করে দিয়ো। রেগুলার মার্ডারার! কত লোককে এইভাবে মেরে ফেলেছে কে জানে।

কিন্তু সেন ঠিক সময়মতোই এসে পড়েছিল। একটা ইঞ্জেকশনেই রোগী স্বাভাবিক হয়ে উঠল আস্তে আস্তে, হিক্কার প্রকোপটা কমে গেল ক্রমশ। উঠে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে ডাক্তার বললে, অল রাইট, ক্রাইসিস কেটে গেছে। বাই দি বাই, সে-জোচ্চোরটা গেল কোথায়?

ডাক্তারের লাথি খেয়ে অন্ধকার উঠানে ছিটকে পড়েছিল গুণিন। কিন্তু সেখানে সে নেই, কোন ফাঁকে সে উঠে গেছে কেউ টেরও পায়নি।

রাত ঝমঝম করছে। একফালি অনুজ্জ্বল চাঁদ উঠেছে আকাশে, তার আলোয় দেখা যাচ্ছে মাঠের ওপারে সাদা পাখির মতো তাঁবুগুলো ঘুমন্ত হয়ে আছে। একটু আগেই জোরালো আলো জ্বলছিল ওখানে, আসছিল কুলিদের দুর্বোধ্য গান আর ঢোলের কলরব। কিন্তু এখন নীরব হয়ে গেছে সমস্ত, ঝিমিয়ে পড়েছে যেন গভীর একটা অবসাদের মধ্যে। তার সামনে সাদা একটা সাপের মতো পড়ে রয়েছে নতুন পথ—রাজপথ। ওই পথ, ওই সাপটার বিষনিশ্বাস অনুভব করছে অভিরাম। তার সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে, যেন জ্বলে যাচ্ছে সমস্ত।

বুকের ভেতরে তখনও টনটন করে একটা ব্যথা চমক দিয়ে যাচ্ছে, জোর লাথি মেরেছে ডাক্তার। গুণিন বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। পাশে মড়ার মতো অঘোরে ঘুমুচ্ছে পদ্ম।

অভিরাম উঠে আলো জ্বালাল। ঘরের এক কোনা থেকে বার করলে লাল কাপড়ের একটা পুটুলি। অসহ্য উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে, তার চোখে তীক্ষ্ণআর শানিত হয়ে উঠেছে হত্যাকারীর দৃষ্টি। শুধু এক জন মানুষকে সে খুন করবে না—শুধু ওই ডাক্তারকেই নয় এই পাপকে, এই লাঞ্ছনা আর অপমানের হেতুকে ঝাড়ে-মূলে উচ্ছন্ন করবে সে।

একটা কালো বোতলের মধ্যে কতগুলো সাদা গুঁড়ো সে চোখের সামনে তুলে ধরল। কৃষ্ণপ্রসাদ কল্পনা করতে পারে না, ডাক্তারের ভাববারও ক্ষমতা নেই—ওই বোতলটার মধ্যে বন্দি হয়ে আছে দেশব্যাপী মহামারি। ওই বোতলের সাদা গুঁড়োগুলো আর কিছু নয়— বসন্তের বীজ, শুকনো গুটির মামড়ি। এগুলো ওরা সংগ্রহ করে ওষুধে লাগাবার জন্যে আর সময় বিশেষে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যে। অবিশ্বাসীকে কঠিন শাস্তি দেবার জন্য গুণিনেরা বহু বার ওই মৃত্যুবিষ বর্ষণ করেছে তার বাড়িতে, উড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায়, মিশিয়ে দিয়েছে কুয়োর জলে। ক-দিনের মধ্যে পাওয়া গেছে হাতেনাতে প্রত্যক্ষ ফল। বহুদিন পরে ওই মারণাস্ত্র প্রয়োগ করবার প্রয়োজন এল আবার। বোতলের কারাগারে যে মৃত্যুরাক্ষস বন্দি হয়ে আছে, এক বার ছাড়া পেলে সে আর ক্ষমা করবে না—নিশেষে গ্রাস করে নেবে সমস্ত। ওই ডাক্তার, ওই কৃষ্ণপ্রসাদ, ওই কুলিদের উপনিবেশ দু-দিনের মধ্যেই মৃত্যুর কলরবের মধ্যে তলিয়ে যাবে সমস্ত।

নিঃশব্দে ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে অভিরাম বাইরে বেরিয়ে এল। ম্লান জ্যোৎস্নায় পাড়ার কুকুরগুলো গুণিনের একটা ছায়ামূর্তি দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, পরমুহূর্তেই থেমে গেল আবার। সন্ধ্যা বেলা কারা যেন শুয়োর পুড়িয়েছিল, এখনও পোড়া মাংস আর পোড়া কাঠের গন্ধ বাতাসে সমাকুল হয়ে আছে। বড়ো একটা যজ্ঞডুমুরের ঝুপসি গাছ থেকে একটা কাক বোধ হয় স্বপ্ন দেখেই জড়িত কণ্ঠে ডেকে উঠল। রাত্রে কাকের ডাক অত্যন্ত দুর্লক্ষণ। কা— কা— কা—। গুণিনের মনে হল, যেন বলছে, খা—খা–খা—

অন্ধকার শীতলার থানের দিকে এগিয়ে চলল অভিরাম। ঝুরিনামা অশ্বথ গাছের পাতায় প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাস। বাইরের জ্যোৎস্নার আক্রমণে পলাতক তমিস্রা যেন এখানে এসে ঘনীভূত আশ্রয় নিয়েছে। শীতলার থানের ওপর গুচ্ছে গুচ্ছে জোনাকি জ্বলছে—যেন রাক্ষুসে দেবতা সহস্র সহস্র চোখের আগুন শানিত করছে সমস্ত পৃথিবীর ওপরে ছড়িয়ে দেবার জন্যে।

মাঠের ওপরে দেখা যাচ্ছে নতুন রাস্তা-জ্যোৎস্নায় রহস্যাতুর রাজপথ। দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশকে বাঁচাবার জন্যে রাজকীয় প্রতিশ্রুতি। সিভিল সাপ্লাইয়ের শুভ বুদ্ধিতে গৌরী সেনের টাকার সদাব্রত। তার ওপরে তাঁবুর সমারোহ, কৃষ্ণপ্রসাদের উপনিবেশ।

শীতলার থানে একটা প্রণাম করলে গুণিন। কল্পনা করে নিলে বিস্ফোটক-ভূষিতা দেবীর করালীমূর্তি। সারা গায়ের ক্ষতচিহ্ন থেকে রক্ত আর পুঁজ গড়িয়ে পড়ছে। এক হাতে মারণশূর্প—তার বাতাসে মহামারির বিষ উড়ে যাচ্ছে দেশে দেশে। গর্দভাসীনা দেবীর প্রসারিত জিহ্বা থেকে রক্ত পড়ছে গড়িয়ে।

গায়ের লোমগুলো রুদ্ধ উত্তেজনায় কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠেছে। ম্লান জ্যোৎস্নায় দীর্ঘ ছায়া ফেলে ফেলে অভিরাম অদৃশ্য হয়ে গেল।

তার পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত।

শহরের থেকে বন্দোবস্ত বা ডাক্তার আসবার আগেই কৃষ্ণপ্রসাদের কলোনিতে বসন্ত শুরু হল। কাকতালীয়ই হয়তো। অতএব…

ভীত কৃষ্ণপ্রসাদ বললে, স্ট্রাইক দি টেন্ট।

নতুন পথ অসমাপ্ত রেখেই কৃষ্ণপ্রসাদের দলবল পিছিয়ে গেল দশ মাইল দূরে। বিলীয়মান গোরুর গাড়ির সারির দিকে তাকিয়ে পিশাচের মতো হাসল অভিরাম। তার জয় হয়েছে। দেবী তার সহায়, জয় তার নিশ্চিত।

কিন্তু মহামারির রাক্ষসটা কৃষ্ণপ্রসাদের তাঁবুতেও আর সীমাবদ্ধ রইল না। নির্বিচারে তার ক্ষুধা বিস্তীর্ণ হয়ে এল গ্রামের দিকে। যারা বাইরে থেকে এসেছিল তারা পালিয়ে বাঁচল, কিন্তু যাদের বাইরে যাবার জায়গা নেই—বসন্তের আক্রমণ তাদের ওপরেই ভেঙে পড়ল অনিবার্যভাবে।

এবার কোথায় গেল কৃষ্ণপ্রসাদ, কোথায় গেল কে। অভিরাম ছাড়া আর উপায় নেই কারও। একটি ব্রহ্মাস্ত্রেই সম্রাট নিজের রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত।

বাঁচাও গুণিন, বাঁচাও।

অভিরামের ঠোঁটে ধারালো হাসি। কেন, সরকারিবাবু কোথায় গেল? তাকে ডেকে পাঠাও-না।

রাগ কোরো না ভাই, দয়া করো। তুমি ছাড়া আর কে আছে! এ সময়ে তুমি না এলে…

তারপর একদিন অভিরামের হাসিও বন্ধ হয়ে গেল। বসন্ত হল পদ্মার। লক্ষ্যভেদ করে ব্রহ্মাস্ত্র যে আবার তার বুকের দিকেই ফিরে আসবে একথা তো গুণিনও জানত না।

অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে মরে গেল পদ্মা। চাঁড়ালের সুন্দরী বউ পদ্মা। অমন অপূর্ব দেহটা তার পচে গেছে, এমন বীভৎস হয়ে গেছে যে সেদিকে তাকানো চলে না। সৌন্দর্যের আবরণের তলা থেকে বীভৎস নরককুন্ড।

এইবার মাটিতে আছড়ে আছড়ে কাঁদলে অভিরাম। কী করলাম, কী করলাম আমি!

কিন্তু সবচাইতে বড়ো আঘাত তখনও তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। পদ্মার মৃতদেহ সরাতে গিয়ে বিছানার তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা চমৎকার সোনার আংটি। ঠিক এই আংটিটাই কার হাতে দেখেছিল সে? ডাক্তারের না কৃষ্ণপ্রসাদের! তাহলে? তাহলে পদ্মা…

শোক মিলিয়ে গেল, মাথার মধ্যে জ্বলে যেতে লাগল দুঃসহ একটা অগ্নিকুন্ড। তাহলে শেষপর্যন্ত জয় হল কার? চরম অপমান আর চরম পরাজয়ের মধ্যে তাকে ফেলে গেল কে? গ্রামের ঘরে ঘরে মড়াকান্না উঠেছে। অভিরাম কি এই চেয়েছিল? আর পদ্ম? এই সোনার আংটি?

পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল গুণিন। লাল পুঁটলিটার মধ্যে নানা জাতের তীব্র প্রাণঘাতী বিষ সঞ্চিত আছে। অভিরাম হার মানবে না, না কিছুতেই না।

কিন্তু কৃষ্ণপ্রসাদ ভালো লোক।

সরকারি ডাক্তার, স্যানিটারি ইনস্পেকটর আর ভ্যাকসিনেটরের একটা ছোটো দল নিয়ে সে গ্রামের দিকে আসছিল। বারোয়ারিতলার কাছাকাছি আসতেই দলটা থমকে দাঁড়িয়ে গেল এক বার। দিনেদুপুরেই গুণিনের বিষজর্জরিত মৃতদেহটা শেয়ালে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল সেখানে।

অ্যানাদার ভিকটিম। ডাক্তার বললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *