আসানসোলের লোকটা

আসানসোলের লোকটা

এককালে একটা নাম নিশ্চয় ছিল। সেটা তার বাপ জানত, মা-ও জানত নিশ্চয়। কিন্তু বাপ খতম হয়ে গেল জিটি রোডে মাঝরাতে নেশার ঘোরে লরি চালাতে গিয়ে, মা যে কোথায় উধাও হল কেউ জানে না।

তারপর এখানে-ওখানে। এর দোরে, তার দোরে।

একটা চোখ কানা, একটা পা ছোটো। সব দিক থেকে মার-খাওয়া। কী-আর কাজ জুটবে? হোটেলে কয়লা ভাঙা, বর্তন-উর্তন সাফ করা, উনুন-ধরানো, সবজি কাটা, ফাইফরমাস, চড় লাথি।

এ কানা, এ বদমাশ।

এক-পা ছোটো, এক চোখ কানা। বদমায়েশি করবার সুযোগ নেই কোনো। তবু এ কানা, এ বদমাশ এই নামই দাঁড়িয়ে গেল।

এখন চল্লিশ ধরো-ধরো। অনেক দেখেছে, অনেক ঘাটের জল খেয়েছে, ঘুরেছে নানা জায়গায়। কিন্তু হোটেলের কাজ ছাড়া আর কিছুই জুটল না কোথাও। আর কোনো কাজেরই যোগ্যতা নেই তার।

বিয়েও করেছিল বই কী—যদি তাকে বিয়ে বলা যায়। একটা ছোটো ঘরভাড়া করে সেই ধানবাদে থাকবার সময় হাজারিবাগ জেলার কালোকোলো একটি মেয়েকে নিয়ে সংসারও পেতেছিল একবার। কিন্তু কালো হলে কী হবে, সুরত ছিল মেয়েটার—অন্তত লোকে তাই বলত। তার মন টেকে কানা-ল্যাংড়ার ঘরে? কার সঙ্গে একদিন কোথায় চলে গেল একেবারে।

মা অন্তত বাপটা মরা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু ততটুকু দেরিও এর সইল না।

ঘেন্না ধরে গেছে তারপর থেকে। জাতটাই হারামি। নিজের মা-টাকেও তো দেখল।

এখন চল্লিশ ধরো-ধরো বয়েস। এ কানা, এ বদমাশ কেউ আর বলে না। এখন শুধুই কানা। তা চাকরিতে উন্নতি হয়েছে বই কী। আর কয়লা ভাঙতে হয় না, বর্তন সাফা করতে হয় না, চড়-লাথিও খেতে হয় না তাকে। কানা এখন রান্না করে হোটেলে। সব পথ শেষ করে আসানসোলে এসেই থিতু হয়েছে এখন। হোটেলের মালিক বুড়ো কানাইল সিং ফৌজে ছিল একসময়। মস্ত দাড়ি, মস্ত শরীর, মনটাও নেহাত ছোটো নয় তার। কানাইল সিং পছন্দ করে কানাকে।

কানা রাঁধে ভালো। তার হাতের তৈরি মাংস আর আলু-মটরের নাম আছে বাসওয়ালা আর কোলিয়ারি এলাকার সর্দারজিদের মহলে। হয়তো এইজন্যেই একটু খাতির আছে তার কার্নাইল সিংয়ের কাছে।

কিন্তু এ কানা। ওইটেই তার নাম।

তুমি তো শিখ। একজন জিজ্ঞেস করেছিল।

নিশ্চয়।

তাহলে তো শুধু কানা হতে পার না। সিং, কানা সিং।

তাই সই। একটু জাতে ওঠা গেল তাহলে। কানা সিং।

বেলা উঠতে থাকে, আসানসোলের রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ে। জিটি রোড পার হয়ে, রেলের লাইন ছাড়িয়ে, রেল কলোনির লাল লাল জীর্ণ বাড়িগুলোর মাথার উপর দিয়ে কানা আকাশটাকে দেখে। সাদা সাদা মেঘ ছিঁড়ে নীল দেখা দিয়েছে, লাল রোদ পড়েছে মেঘের গায়ে। ভোররাতের হাওয়ায় কালো ঠাণ্ডার যেন আলগা ছোঁয়া লাগল একটু। কানা জানে, জানে আর কদিন বাদেই বাঙালিদের পুজো আসবে। আসানসোল শহর, তার বাজার, সব কেঁপে উঠতে থাকবে ঢাকের শব্দে, মাইকের গানে। আকাশের ওই নীল তার খবর।

জিটি রোডে প্রাইভেট গাড়ির ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকবে এখন। কলকাতা থেকে পয়সাওয়ালা মাড়োয়ারি-পাঞ্জাবি-গুজরাতি-সিন্ধি-বাঙালি সব মোটর নিয়ে চলল হাওয়া বদল করতে। চলল নিয়ামতপুর থেকে ডাইনে ঘুরে চিত্তরঞ্জন হয়ে জামতাড়া-দেওঘর-জসিডির দিকে, চলল বরাকরের রাস্তা ধরে ধানবাদ-হাজারিবাগ হয়ে পাটনা-গয়া-কাশী-দিল্লির দিগবিদিকে। জিটি রোডে এখন ছুটির ডাক।

কানার আর কোথাও যাবার নেই, তার সব চলা শেষ। এখন কার্নাইল সিংয়ের হোটেল, আলুমটর, কড়াই ডাল, আলু-পালং, কুচো চিংড়ির তরকারি, মাংস, রুটি। ওই সব গাড়ি করে যারা যায় এ হোটেলে তারা থামে না, তাদের জন্যে একটু দূরে দোতলা হোটেল আছে, বিলাইতি দারুর ব্যবস্থা আছে। এখানকার খরিদ্দার আলাদা, তারা বাস-লরির ড্রাইভার কণ্ডাকটার ক্লিনার, তারা কোলিয়ারি এলাকার সর্দারজি।

কিন্তু দূরে ছুটে-যাওয়া ওই হাওয়া বদলের গাড়িগুলো কানাকে উদাস করে। হাতের ডাণ্ডাটা নিয়ে লম্বা পাত্রটার মধ্যে প্রাণপণে মাংস কষতে কষতে চোখ চলে যায় আকাশের নীলের দিকে। যে-বউটা পালিয়ে গেল, অন্য সময় যাকে স্রেফ হারামি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না তার, তারই জন্যে বুকের ভিতর কেমন একটা যন্ত্রণা হতে থাকে।

ম্যায় প্যার করনে ওয়ালে… কানার চমক ভাঙে, কার্নাইল সিং রেডিয়োটা খুলে দিয়েছে।

ওই স্বভাব কানাইল সিংয়ের। রেডিয়ো খুলে দেয় কিন্তু কখনো শোনে না, নিজের চৌকিতে বসে সামনের ছোটো বাক্সটার ওপর একটা পাঞ্জাবি খবরের কাগজ বিছিয়ে একমনে পড়ে। সকালের কাগজ রাতে-দিনেও পড়া শেষ হয় না কার্নাইল সিংয়ের। এখন হোটেলে খরিদ্দার নেই, কাজের চাপও নেই, হোটেলের বাচ্চা ছেলেটা গানটার সঙ্গে তালে তালে পা ঠোকে, গুনগুনিয়ে ধরতে চায় সুরটা।

বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক লাগায় কানা।

ভাগ বদমাশ কাঁহাকা।

হি-হি করে হেসে ওঠে ছেলেটা। বাইরে গিয়ে বিড়ি ধরায় একটা। যেন কানাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বিশ্রী বেসুরো গলা চড়িয়ে দেয়।

ম্যায় প্যার করনে ওয়ালে…

বদমাস কাঁহাকা! কথাটা নিজের কানে লাগে। এ কানা এ বদমাশ। ডাকটা সেও শুনত। সেও বোধ হয় এরই মতো বয়েসে, কিংবা আরও ছোটো ছিল তখন—হোটেলে কয়লা ভাঙতে আর বর্তন-উর্তন সাফা করতে এসেছিল।

তার কেউ ছিল না, এই ছেলেটার মা-বাপ আছে। বাপ কুলি, মা গৈঠা বিক্রি করে। সে রাত কাটাত হোটেলের মেজেতে, শীতের রাতে ঘন হয়ে বসত উনুনটার পাশে। অনেক রাত পর্যন্ত গরম থাকত সেটা। তখন মায়ের বুকে ঘুমুবার কথা ভেবে তার কান্না আসত।

কীসের মা? হারামি।

সামনে দিয়ে একটা বড়ো সাদা গাড়ি বেরিয়ে যায়, বহুত ভারী আদমির গাড়ি। কোনো পাঞ্জাবি বড়োলোক। সোনার চশমাপরা একজন, একজনের মাথার পাগড়ি। ফুটফুটে কয়েকটি মেয়ের মুখ। দু-তিনটে বাচ্চা। এখন চলল হাওয়া বদলে। ক্যারিয়ার পুরো বন্ধ হয়নি, মালপত্রে বোঝাই।

কত দূরে চলল? হয়তো আগ্রা-দিল্লি ছাড়িয়ে একেবারে নিজের দেশে পাঞ্জাবে। অত বড়ো গাড়ি রেলগাড়িকে টেক্কা দিয়ে কোথা থেকে কোথায় ছুটে যাবে।

রেল কলোনির পুরোনো বাড়িগুলোর মাথার ওপর দিয়ে নীল ফুটেছে, মেঘের গায়ে রাঙা রোদ। তারও দেশ ছিল পাঞ্জাবে। কিন্তু কানা কখনো দেশ দেখেনি। দেখেনি লাহোর থেকে কোথায় বিশ মাইল দূরে তার গাঁ। দেখেনি জলন্ধর, যেখানে তার চাচা নাকি বড়ো ব্যাবসাদার আর অনেক টাকার মালিক। দেখেনি অমরুতসর, তার সোনে কা মন্দির, রানিগঞ্জ আসানসোল-দুর্গাপুর-হাজারিবাগ-কলকাতা ব্যাস, ব্যাস।

ব্যাস সব ফুরিয়ে গেছে। এক-পা খোঁড়া, এক চোখ কানা, বয়েস চল্লিশ হতে চলল। বাকি জীবনটা কেটে যাবে এই কার্নাইল সিংয়ের হোটেলে। যদি বুড়ো কানাইল মরে যায় হঠাৎ, হোটেল উঠে যায় তার, এই আসানসোলেই অন্য হোটেলে কাজ জুটে যাবে। কানা সিংয়ের নাম আছে রান্নায়।

রেডিয়োতে আবার একটা ফিলমি গান শোনা যায়। বাচ্চাটা বাইরে থেকে ফিরে এসে চেয়ার-টেবিলগুলো অকারণে নাড়াচাড়া করে—যেন কাজ করছে। কানার হাসি পায়। ওর আসল কান ওই গানের দিকে।

অ্যাই–বদমাশ বলতে গিয়েও সামলে নেয় কানা, থোড়া আদরত লাও।

আদার দরকার নেই, তবু হুকুম করতে ভালো লাগে। না, এই ছেলেটার উপর তার মায়া হয় না, কেউ তাকেও মায়া করেনি। এই ছেলেটা রাত্রে তার গৈঠাওয়ালি মায়ের বুকের ভেতর আশ্রয় পায়। সে শুয়ে থাকত উনুনের ধারে। যখন উঠত, তখন সারা গা তার ছাইয়ে মাখামাখি।

এ কানা। এ বদমাশ।

এই ছেলেটারও একটা চোখ কানা হতে পারত, একটা পা খোঁড়া হতে পারত—হয়নি। শয়তানিতে দুটো চোখই ওর বিল্লির মতো জ্বলে। কানা যদি কখনো চটেমটে এক-আধটা চড়চাপড় বসাতে যায়, একেবারে রামছাগলের বাচ্চার মতো তিড়িং করে ছুটে পালায়। খোঁড়া পা নিয়ে কানা ধরতে পারে না তাকে। প্রাণখুলে গালাগালি করে কদর্য ভাষায়—দূরে দাঁড়িয়ে হি-হি করে হাসে ছেলেটা।

কানাইল সিং নজর দেয় না ওসবে। সকালের খবরের কাগজটা দিনমান ধরে পড়ে, কী পড়ে সে-ই জানে। পয়সাকড়ির হিসেব করে। আর তেমন তেমন খরিদ্দার এলে আদর আপ্যায়ন করে একটু। কানের কাছে রেডিয়োতে গানা চলে, অথচ কখনো শোনেও না। মেজাজ খুশি থাকলে, অর্থাৎ পয়সাকড়ির আমদানি একটু বেশি হলে তাকে গুনগুন করতে শোনা যায়।

ধন ধন পিতা দশমেশ গুরু, জিনহি চিড়িয়াসে বাজ তোড়ায়ে—

দশমেশ গুরু-গুরু গোবিন্দ। তারপর আর গুরু নেই। সব বান্দা।

এসব খবরও কি রাখত নাকি কানা? কানাইলই তাকে শুনিয়েছে।

গুরু গোবিন্দ। কী অসাধ্য ছিল তাঁর? ছোটো পাখি দিয়ে বাজ শিকার করিয়েছেন, তিনিই তো শিখিয়েছিলেন শিখদের পাঁচ ক ধারণ করতে হবে—কেশ, কাঁকই, কঙ্গন, কৃপাণ…

বলতে বলতে হাসে কানাইল সিং।

কানা, তুমিও শিখ।

জি।

কিন্তু তোমার চুল নেই, দাড়ি নেই, কৃপাণ নেই, কাঁকই নেই।

 থাকবার মধ্যে কেবল ডান হাতের কঙ্গন-লোহার বালাটা।

দেশে গেলে শিখেরা রাগ করবে তোমার ওপর। বঙ্গাল বলেই পার পেয়ে গেলে।

দেশ! পাঞ্জাব! সে রানিগঞ্জে জন্মেছে। কোনোদিন দেশে যায়নি, কখনো যাবে না। তার সামনে দিয়ে পাঞ্জাব যেন ছুটে যায়, ছুটে যায় কালকার গাড়ি। তার দেশের মানুষরা ছোটে ঘরমুখো। অমরুতসর, জলন্ধর, আম্বালা, লালান, চন্ডীগড়–কোথায়, কতদূরে! ভারী আদমিদের বড়ো বড়ো মোটরগাড়ি হাজারিবাগ-গয়া-বানারস পাড়ি জমায়, হয়তো অমরুতসর-চন্ডীগড়েও চলে যায় রেলগাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কানা রেলের লাইন দেখে, জিটি রোড দেখে, আর এমনি কোনো সময়—যখন শেষরাতের হাওয়ায় গায়ে একটা শিরশিরানি জাগে হঠাৎ, তখন আকাশের নীল দেখে।

রেডিয়োতে হিন্দি গান বাজে। বাচ্চাটা আবার পা ঠোকে তালে তালে। কানা এক চোখে তা দেখেও দেখতে পায় না। পাঞ্জাব—তার দেশ। অথচ সে দেশ কখনো দেখেনি। কে যেন তাকে বলেছিল হির-রনঝার গল্প, শুনিয়েছিল তার গান। রনঝাকে ভালোবেসে শেষে মহিষের রাখাল হতে হয়েছিল হিরকে, কী সে দুঃখ! কত কষ্ট!

হারামির জাত। বেকোয়াশ মহব্বত—বেফায়দা। সে তো নিজেই দুটোকে দেখল।

মাংসটা আরও জোরে কষতে কষতে কানা দাঁত কষকষ করে। কষা মাংসের গন্ধে আকুল হয়ে একটা কুকুর এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে, একটুকরো কয়লা ছুড়ে মারে তার দিকে।

ভাগ হারামি কাঁহাকা!

কিন্তু সামনের ওই নীলটা মন খারাপ করে। সেই কালোকোলো উজ্জ্বল চোখ মেয়েটার কথা ভেবে মোচড় দিতে থাকে বুকের ভেতরে। যে-পাঞ্জাব সে কখনো দেখেনি, তার মেঘবরণ আকাশছোঁয়া গমের খেত ভেসে ওঠে সামনে। দেখতে পায় তাদের, কতকাল পরে আজও মহিষ চরাতে চরাতে যারা হির-রনঝার গান গায়।

এই বদমাশ।

গালাগালটা দেবে না ভেবেও সামলাতে পারে না, যেন মুখফসকে বেরিয়ে আসে। যে কাজটা নিজেই করা চলত, তার দায় চাপিয়ে দেয় বাচ্চাটার ওপর।

ঢালো, পানি ঢালো ইসমে।

ছেলেটা গরম জল ঢালতে থাকে মাংসের পাত্রে। কানা প্রতিমুহূর্তে আশা করে খানিকটা গরম জল উছলে পড়বে ছেলেটার পায়ে, ফোসকা পড়ে যাবে, ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাতে থাকবে, যেমন তার হয়েছিল উনুনের পাশে শুতে গিয়ে একটুকরো গনগনে কয়লা পিঠের নীচে পড়বার পর। ছাই দিয়ে ঢাকা ছিল, বুঝতে পারেনি।

কিন্তু শেয়ালের মতো চালাক ছেলেটা। অসম্ভব হুঁশিয়ার, এক ফোঁটা জলও পড়ে না।

শালা হারামির বাচ্চা।

হঠাৎ ফুসে ওঠে ছেলেটা।

ঝুটমুট গাল দেতে কেঁও?

মারব এক থাপ্পর। ভাগ সামনে থেকে।

কানাইল সিং কিছুই শোনে না। এক হাতের মুঠোয় সাদা দাড়িটা চেপে ধরে খবরের কাগজ পড়ে যায়।

বেলা বাড়ে। মাংস নামে। ছেলেটা বেলে দেয়, কানা রুটি করতে থাকে। খদ্দেরদের আসবার সময় হয়ে এল। শব্দ করে একটা জিপ গাড়ি এসে থামে হোটেলের সামনে। টক টক করে লাফিয়ে পড়ে চার জন। ভারি জোয়ান চার জন শিখ। এক চোখে এক লহমা দেখেই কানা চিনতে পারে এদের। কোলিয়ারির লোক এরা—মালিকদের পোষা গুণ্ডা। মজদুরদের মধ্যে বেয়াড়াপনা দেখা দিলে এরাই দু-চার জনকে নিকাশ করে চালান করতে পারে কোনো পোড়ো খাদের অতলে, খুন করতে পারে দিনদুপুরে। এ ছাড়া ডাকাতি এদের বাঁধা ব্যাবসা। কখনো কখনো বিমা কোম্পানিকে ফাঁকি দেবার জন্যে এদের দিয়েই মালিক নিজের টাকা লুট করায়।

পুলিশে ধরে কখনো কখনো, আবার মালিকদের হাতের গুণে দু-দিনে ছটকে বেরিয়ে আসে। দরকার হলে দু-চারটে পুলিশকেও শেষ করে দেয়। একজন ফতে সিং, একজন ঠাকুর সিং, আর একজনের নাম জানে না; চতুর্থ জনও ঠিক তার মতো আসল নাম হারিয়ে ডালকুত্তা বলে বিখ্যাত।

ডালকুত্তাই বটে!

প্রকান্ড মাথা, প্রকান্ড মুখ। সারা মুখে কপালে চেচক-এর দাগ। অদ্ভুত চওড়া আর থ্যাবড়া নাক। জোড়া ভুরু দুটো এত মোটা যে প্রায় কপালের আধখানা জুড়ে গিয়েছে।

কথা কম বলে, কখনো হাসে না। আর আধবোজা মিটমিটে চোখে তাকায় ঠিক সাপের মতো। সে-চাউনিতে রক্ত হিম হয়ে যায়। এসব লোককে ভালো করে চিনিয়ে দিয়েছে কানাইল সিং নিজেই। নিজে ফৌজি হাবিলদার হয়েও সে ভয় পায় এদের। বলে, খুব হুঁশিয়ার, ডালকুত্তাকে কখনো ঘাঁটিয়ো না।

কার দায়, কে ঘাঁটাতে যাচ্ছে? বাচ্চাটা তো ওদের দেখলে ভয়েই সিঁটিয়ে যায়। আর কানা রান্না করে, খাবার সাজিয়ে দেয়। কানার হাতের মাংস খেলে খুশি হয় ওরা। যাবার সময় এক-আধটা থাবড়া আদর করে বসিয়ে যায় পিঠে। রোগা হাড়গুলো কনকন করে ওঠে তাতে।

ওদের ঢুকতে দেখে তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ায় কানাইল সিং, আপ্যায়ন করে একগাল হেসে। অন্যদিন লোকগুলো খুশি থাকে, কুশল জিজ্ঞেস করে কানারও।

আজ আর ভালো করে জবাবও দেয় না। মুখগুলো কালো।

কেমন করে থাকব? বিরস মুখে জবাব দেয় ঠাকুর সিং, খবর ভালো না। জমানা বদলে যাচ্ছে।

কার জমানা, কেমন করে বদলাল, এসব নিয়ে কিছু ভাববার নেই কানার। তার জমানা তো এই কানাইল সিংয়ের হোটেলের চৌহদ্দিতেই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু লোকগুলোর কথা শুনে কেমন ভয় পায় বুড়ো, চুপ করে ফিরে যায় নিজের জায়গায়।

এক কোনায় যেখানে একটা কালো পর্দা দিয়ে ঘেরার ব্যবস্থা আছে, সেখানে গিয়ে বসে চার জন। টেনে দেয় পর্দা। খাবারের হুকুম দেয় না। বাচ্চাটাকে বলে, দো সোডা মাঙ্গাও, আউর গিলাস।

বাচ্চা সোড়া আনতে ছোটে পাশের দোকানে। চাপা গলায় কী আলাপ করে ওরা, শোনা যায় না। রেডিয়োটার আওয়াজ কমিয়ে দিয়ে কানাইল সিং আবার ডুব দেয় খবরের কাগজে।

সোডা আসে, গেলাস যায়। বোতল খোলার শব্দ ওঠে।

হয়তো ডাকাতির মতবল ভাঁজছে, হয়তো খুনখারাপির। কিংবা পুলিশেই হুড়ো লাগিয়েছে হয়তো-বা। রুটি সেঁকতে সেঁকতে আবার কানার চোখ চলে যায় আকাশের দিকে। বাচ্চাটা বাইরে বেঞ্চিতে বসে থাকে চুপ করে। জিটি রোড দিয়ে গাড়ি ছোটে, ওধারে রেল আসা যাওয়া করে, সময় যায়।

আরও দুজন খদ্দের আসে। রুটি, আলু-মটর, জল খেয়ে পয়সা দিয়ে চলে যায় তারা। বাচ্চা টেবিল সাফ করে। বাইরে কাকের ডাক ওঠে। বেলা বাড়ে। সময় যায়।

কালো পর্দার ওপার থেকে মোটা গলায় হাঁক আসে। ফতে সিং কিংবা ডালকুত্তা আওয়াজে বোঝা যায় না।

রুটি-মাংস। চার জনের!

কানা সাজিয়ে দেয়। পরিবেশন করতে যায় ছেলেটা। আর তখনই ব্যাপারটা ঘটে যায়।

কী-একটা গেলাস-টেলাস উলটে পড়ল মনে হয়। তারপেরই শোনা যায় জঘন্য একটা গালাগাল। বাচ্চাটা ছিটকে সরে আসে, কালো পর্দার ভেতর থেকে জুতোপরা প্রকান্ড একটা লোক বেরিয়ে নিদারুণ লাথি বসায় ছেলেটার পেটে। হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে সে, তার হাত থেকে এক থালা রুটি-মাংস ছড়িয়ে যায় ঘরময়।

আতঙ্কে শক্ত হয়ে যায় কানা, হুড়মুড় করে লাফিয়ে ওঠে কানাইল সিং। গালাগালির ঢেউ উঠতে থাকে পর্দাটার ওপার থেকে।

টেবিলে থালা বসাতে গিয়ে একটা গেলাস উলটে দিয়েছিল ছেলেটা। খানিক মদ টলে পড়েছে ডালকুত্তার গায়ে।

মাংসের ঝোলে মাখামাখি হয়ে উঠে বসে ছেলেটা—ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। হাতজোড় করে কসুরের মাপ চায় কার্নাইল সিং, তটস্থ হয়ে ছোটে নিজের হাতে পরিবেশন করতে।

চোখের জল মুছতে মুছতে ছেলেটা মেঝে সাফ করতে বসে যায়।

কানা দেখে। মনে মনে খুশি হওয়া উচিত ছিল তার, কিন্তু খুশি হতে পারে না। স্মৃতিতে তার যন্ত্রণা চমকায়। তাকেও যেন কে অমনি করে লাথি মেরেছিল একবার, খাবার দিতে দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে। একটা চোখ মেলে বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, যেন নিজের সেদিনকার মুখটার ছায়া দেখতে পায় সেখানে।

খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে আসে লোকগুলো। পয়সা মিটিয়ে দেয় কার্নাইল সিংকে। কানাইল সিং হাসে। খাতির করে কিছু বলতে যায়, কিন্তু আলাপ জমে না। অন্ধকার চেহারা নিয়ে শুকনো গলায় কী বলে তারা আবার বেরিয়ে যেতে থাকে রাস্তার দিকে।

বাচ্চাটা পথ ছেড়ে ভয়ে সরে দাঁড়ায়। হঠাৎ কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে ডালকুত্তা। বাচ্চাটাকে

ডাকে, এই শুনো, ইধার আও।

বাচ্চাটা নড়ে না।

ইধার আও, ডবরা মত। পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে ডালকুত্তা, লো!

ছেলেটা তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে।

লো লো, বকশিশ লো।

একভাবে ছেলেটা ঘাড় গুঁজে থাকে, এক পাও নড়ে না।

আধবোজা চোখ দুটো খানিক খুলে যায় ডালকুত্তার। সাপের মতো চাউনি লিকলিক করে ওঠে। চেচক-এর চিহ্নে ভরা প্রকান্ড মুখটাকে ভয়ংকর দেখায়।

গোসসা হো গয়া শালে কো? আধুলিটা ছেলেটার মুখের ওপর সজোরে ছুড়ে দেয় ডালকুত্তা। ছেলেটা যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে। হা-হা করে হেসে চার জন লাফিয়ে বসে জিপে। স্টার্ট নেয় গাড়িটা, এগিয়ে যায় কলকাতার দিকে। এক বার চেয়ে দেখেই আবার কাগজটা পড়তে থাকে কানাইল সিং।

ছেলেটা দেখে না, আর কেউ দেখে না, কানা দেখে। আধুলিটা গড়িয়ে গিয়ে পড়ে নর্দমার ভিতরে।

সময় যায়, বেলা বাড়ে, খরিদ্দার আসে। একটু আগেকার সব দুঃখ ভুলে গিয়ে ছেলেটা পরিবেশন করে। গরিবের ছেলের ওসব মনে রাখলে চলে না।

কানাকে যে লাথি মেরেছিল সে বলেছিল, কাঁদছিস কেন শুয়োরের বাচ্চা। হাস, হাস বলছি, নেহি তো ফিন এক লাথসে তুমকো…

হাসতে হয়েছিল কানাকে। আর মজা দেখে মুচকে মুচকে হাসছিল হোটেলের মালিক। সেও চাবুক দিয়ে পিটতে ভালোবাসত কানাকে।

এক ফাঁকে দোকানের চাপ একটু কমে গেলে ছেলেটা এসে দাঁড়ায় কানার পাশে। ফিসফিস করে বলে, চাচা!

কেয়া?

উ তোক খুন কিয়া।

কেয়া?

হ্যাঁ, তাই। পর্দার বাইরে থেকে শুনেছে বাচ্চাটা। ওরা এবার পাঞ্জাবে পালিয়ে যাবে। জমানা খারাপ। মালিকের আর হাতযশ নেই আগেকার মতো।

কানার ঠোঁটের ওপর দাঁতের চাপ পড়ে। পাঞ্জাব! হঠাৎ কানার মনে পড়ে যায়, তার মা ও যেন কার সঙ্গে পাঞ্জাব পালিয়ে গিয়েছিল।

তীব্র গলায় কানা বলে, যাক, মরুক গে! ডাকু সব!

চাচা! বাচ্চাটা আবার ডাকে।

কেয়া?

উ লোগ মুঝে এক আধুলি দিয়া থা, কিধার গিয়া দেখা তুম?

কানা দেখেছে, ওই নালার ভেতর। জানে হাত দিলেই পাওয়া যাবে ওখানটায়।

একটু চুপ করে থাকে, তারপর জবাব দেয়, না, দেখিনি। যেতে দে বদমায়েশের পয়সা, আমি তোকে আধুলি দেব একটা।

ছেলেটা বিশ্বাস করতে পারে না। চাচার এমন দয়া এর আগে সে আর কখনো দেখেনি।

তুম?

হ্যাঁ আমিই দেব। বিশ্বাস করছিস না কেন?

ছেলেটার চোখ-মুখ খুশিতে ভরে যায়। বাচ্চা রামছাগলের মতো লাফাতে লাফাতে চলে যায় বাইরে। একটা ঘুড়ি কেটে পড়েছে কাছাকাছি, ছোটে তারই দিকে। ওরা কত সহজে ভুলে যায়।

সামনে আকাশটা নীল। গাড়ি ছুটছে একটার পর একটা। সব হাওয়া বদলে চলল। কিন্তু ওই নীলের দিকে তাকিয়ে আর মন খারাপ হয় না কানা সিংয়ের। হির-রনঝার গান ভেসে ওঠে না কোথাও। কেন যেন খুশি লাগে তার, বাচ্চা ছেলেটাকে একটা আধুলি দেবার কথা ভাবতে ভালো লাগে। কোথায় যেন একটা হাওয়া বদল হয়ে যাচ্ছে টের পায় সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *