1 of 2

গরুর রেজাল্ট

গরুর রেজাল্ট

বড়মামা প্রায় কুঁকতে ধুকতে নীচে থেকে ওপরে উঠে এলেন। এমন চেহারা এর আগে আর কখনও দেখিনি। কপালের ডানপাশটা ফুলে ট্যাঁপা লালা। দু-হাতের কনুইয়ের কাছ পর্যন্ত লাল টকটকে। গাঢ় নীল রঙের সিল্কের লুঙ্গি একটু উঁচু করে পরা। পায়ে কারও ওয়াটার প্রুফ জুতো।

ধীরে-ধীরে সিঁড়ি ভেঙে বড়মামা দোতলার ঢাকা বারান্দায় উঠে এলেন। ঝলমলে রোদ জাফরির নকশা পেতে রেখেছে ঝকঝকে লাল মেঝের ওপর। দূরে কোণে মেজোমামা বসে বসে ক্যামেরার লেনস পরিষ্কার করছিলেন। আমি তাঁর ফাইফরমাস খাটছিলুম। ‘এটা দে, ওটা দে।’

মেজোমামার কোলের ওপর ক্যামেরা। হাতে হলদে রঙের ফ্ল্যানেলের টুকরো। চোখ আর ক্যামেরার দিকে নেই, বড়মামার দিকে। মেজোমামা হঠাৎ বললেন, ‘স্টপ। ঠিক ওই জায়গাতেই এক সেকেন্ড। আমি চট করে তোমার একটা স্ন্যাপ নিয়ে নি! তোমাকে ঠিক দিশি কাউবয়ের মতো দেখাচ্ছে। বেড়ে দেখতে হয়েছ তো! কী করে হল?’

বড়মামা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘শাট আপ। শা-আট আ আপ!’

মেজোমামা ফিশফিশ করে আমাকে বললেন, ‘সাবজেকটটা ভালো ছিল তবে একটু খেপে আছে।’

বড়মামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে ডাকলেন, ‘কাম হিয়ার। কুইক।’

‘শুনে আসি মেজোমামা।’

‘হ্যাঁ শুনে আয়। কেসটা কী আমাকে জানিয়ে যাবি।’

‘আচ্ছা।’

ঘরে ঢুকতেই বড়মামা বললেন, ‘কী হবে?’

‘কীসের কী হবে?’

‘জুতো পরে ঢুকে পড়েছি যে!’

‘ও কিছু হবে না।’

‘এটা যে রাস্তার জুতো। কুসি দেখলে খ্যাঁক-খ্যাঁক করবে।’

‘মাসিমা তো এখন ধারে কাছে নেই।’

‘মেঝেতে যে দাগ পড়ে গেল!

‘আমি পা দিয়ে পালিশ করে দিচ্ছি।’

‘আমি যে দাঁড়িয়ে পড়েছি!’

‘চলতে চান তো চলে ফিরে বেড়ান না। অসুবিধে কীসের!’

‘যেদিকে যাব সেই দিকেই তো দাগ পড়ে যাবে!’

‘জুতো খুলে ফেলুন।

‘ইয়েস, দ্যাটস রাইট।’

বড়মামা জুতো খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বারকতক নেচে নিলেন। লাল চকচকে মেঝেতে নাচের জুতোর নকশা তৈরি হল।

‘দেখলি, দেখলি! সাধে কুসি আমার ওপর রেগে যায়! রেগে যাবার অনেক কারণ আছে! পৃথিবীতে কোনও কিছুই কি সহজ নয় রে!’

‘জুতোটা না খুলে অমন করে নাচছেন কেন?’

বড়মামা রেগে উঠলেন, ‘আমি কি ইচ্ছে করে নাচছি। আমাকে নাচাচ্ছে যে! রবারের জুতো পরে একবার দেখ না। পরা সহজ, তারপর পা থেকে আর খুলতে চায় না। ক্রীতদাসের জাত। পায়ে ধরে বসে থাকতে চায়।’

‘এখন তা হলে কী হবে! সারাদিন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

‘আমি বরং দাগে দাগ মিলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। তুই ওই মারকিউরোক্রোমের শিশি আর খানিকটা তুলে নিয়ে আয়। ও, না।’

‘কী হল আবার?’

‘বাইরে তো উনি ক্যামেরা তাক করে বসে আছেন। এখুনি ফট করে একটা ছবি তুলে এত বড় করে বাঁধিয়ে রাখবেন।’

‘তাহলে আপনি ওই চেয়ারটায় বসুন, আমি পা থেকে জুতো দু-পাটি খুলে দি।’

‘না, দেখে ফেলবে।’

‘দেখলে কী হয়েছে? আর কে-ই বা দেখবে?

‘ও বাবা, দেখলে কী হয়েছে! হোল বাড়িতে হইচই পড়ে যাবে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ভাগনেকে দিয়ে জুতো খোলাচ্ছে! মনে নেই সেদিনের কথা? তোকে বলেছিলুম পিঠে একটু তেল ঘষে দিবি, সেই নিয়ে কতরকমের কথা!’

‘তাহলে আমি চেয়ারটাকে টেনে আনি, আপনি বসে বসে খুলে ফেলুন।’

‘অগত্যা তাই করতে হবে। আমার আবার জুতোয় হাত দিলে কীরকম গা ঘিনঘিন করে। পায়ের জিনিস পায়ে-পায়েই খোলা উচিত। আমারই সাবধান হওয়া উচিত ছিল, এটা হল সন্ধের জুতো, সকালের নয়।’

‘সে আবার কী, জুতোর আবার সকাল-সন্ধে আছে নাকি?

‘জুতোর নেই। শরীরের আছে। সারারাত ঘুমের পর সকালের শরীর হল ফুলো ফুলো, তাজা! মুখ ফুলো, চোখ ফুলো, হাত ফুলো, পা ফুলো। শরীর যত সন্ধের দিকে এগোচ্ছে তত শুকোচ্ছে, চুপসে যাচ্ছে। এসব হল অ্যানাটমি, ফিজিওলজির ব্যাপার। ডাক্তার হলে বুঝতে পারতিস।’

বড়মামা ডাক্তার। চেয়ারটাকে প্রথমে দু-হাতে তুলে আনার চেষ্টা করলুম। বেজায় ভারী। এখন। টেনে আনার চেষ্টা করলুম। ঘষটাতে ঘষটাতে আসছি তেলা মেঝের উপর দিয়ে। চেয়ার ঠেলতে বেশ মজা লাগে। ইচ্ছে করেই বেশ একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আনছি। সোজা রাস্তায় আসছি না। পথ ফুরিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি!

‘এ কী, এ কী, অ্যাাঁ ঘরের এ কী অবস্থা, তুই সারা ঘরে চেয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন! বসার

জায়গা পাচ্ছিস না! ও মাগো, মেঝেটার কী অবস্থা! দরজার সামনে মাসিমা। আমি যেখানে যেভাবে ছিলুম সেইভাবে, বড়মামাও সেই একই ভাবে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে।

বড়মামা চোখ দুটো কেবল বুজিয়ে ফেলেছেন। এটাবড়মামার নিজস্ব টেকনিক। ভয় পেলেই চোখ বুজিয়ে ফেলা।

সেই চোখ বোজানো অবস্থাতেই বড়মামা বললেন, ‘কুসি, আমি আহত।’

‘তোমাকে কিছু বললেই তো তুমি আহত!’

‘আমি সেভাবে আহত নই, এই দেখ আমার কপাল।’ বড়মামা মাসিমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। কপালটা এর মধ্যেও আরও ফুলেছে। ঘেঁতো হয়ে গেছে।

‘তোমার কপালে এই সবই লেখা আছে আমরা জানতুম!’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।’ মাসিমার পাশে মেজোমামা এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে ক্যামেরা।

মেজোমামাকে দেখেই বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘ও, নো নোনো ফোটোগ্রাফ।’

‘ছোট্ট করে একটা। ফ্যামিলি অ্যালবামে মানাবে ভালো।’

মাসিমা মেজোমামাকে থামিয়ে দিলেন, ‘রাখো তো তোমার ক্যামেরা। আগে ছবি তোলা শেখো। ঠ্যার ঠ্যার করে হাত কাঁপে, ফোকাস করতে পারো না! কেবল পয়সা নষ্ট।’

‘হাত কাঁপে! আমার হাত কাঁপে?’

‘হ্যাঁ, কাঁপে। ছবি না তুলে তোমার কম্পাউন্ডার হওয়া উচিত ছিল। জল দিয়ে পেনিসিলিন গোলবার জন্য কসরত করার দরকার হত না, তোমার কাঁপা হাতে শিশিটা ধরিয়ে দিলেই আপনি গুলে যেত!’

মেজোমামা একটু মুষড়ে গেলেও হেরে যেতে প্রস্তুত নন। আমার মামারা সহজে হারতে চান না। মেজোমামা বললেন, ‘আমি যখন রেগে যাই তখনই আমার হাত কাঁপে, তা না হলে আমার হাত ল্যাম্পপোস্টের মতোই স্টেডি।’

‘তোমার সবসময়েই হাত কাঁপে, তা হলে বুঝতে হবে সবসময়েই রেগে আছ। কথা বাড়িয়ো না, যা করছিলে তাই করোগে যাও।’

মাসিমাকে সুবিধে করতে না পেরে মেজোমামা বড়মামার ওপর সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলেন।

‘আহা, তোমার কপালটা বেশ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে বড়দা। কীসে ঠুকলে অমন করে?’

বড়মামা যেন হালে পানি পেলেন। মাসিমা যেভাবে তাকিয়ে আছেন, একমাত্র কপালের জোরেই বড়মামা বাঁচতে পারেন।

‘ঠোকা? ঠোকাঠুকির মধ্যে আমি নেই। ওই লক্ষ্মীছাড়া। যার নাম রাখা হয়েছিল লক্ষ্মী, সেই লক্ষ্মী পেছনের পায়ে ঝেড়েছে এক লাথি।’

আমি চেয়ারটা যেখানে ছিল সেইখানেই চতুষ্পদ করে রেখে, ওষুধ আর তুলো নিয়ে মাসিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকেও তো একটা বাঁচার রাস্তা বের করতে হবে। সারা মেঝেতে চেয়ার টানার লম্বা লম্বা দাগ।

‘এই নিন মাসিমা, ওষুধ।’

মাসিমা ওষুধ আর তুলোটা হাতে নিয়ে বড়মামাকে ধমকের সুরে বললেন, ‘তুমি সাতসকালে। গরুর কাছে কী করতে গিয়েছিলে? তোমার অন্য কোনও কাজ ছিল না!’

মেজোমামা বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিকই তো, তোমার অন্য কোনও কাজ ছিল না? তুমি কি পশু চিকিৎসক? তুমি তো মনুষ্য চিকিৎসক!’

বড়মামা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নাও, কথা শোনো দুজনের। যা হয় একটা কিছু বলে দিলেই হল! তোরা জানিস না?

‘কী জানতে হবে?’ মাসিমা তুলোয় লাল ওষুধ লাগালেন।

‘তোরা জানিস না, আমার সবক’টা কাজের লোক পালিয়ে গেছে। মালি গন। কুকুরগুলোকে যে দেখত সেই বিশে ব্যাটা হাওয়া। গরুটাকে যে দেখত সেই রামখেলোয়ান সরে পড়েছে। দেন হু উইল বেল দ্য ক্যাট? তোমরাই বলো?

‘ইংরেজিটা ঠিক হল না বড়দা।’ অধ্যাপক মেজোমামা আবার বানান ভুল, ভাষার ব্যবহারের ভুল একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।

‘তোমার অবশ্য দোষ নেই। তুমি তো লিটারেচারের লোক নও। সারা জীবন প্রেসক্রিপশানই লিখে গেলে, টিডি, বিডি। তোমার বলা উচিত ছিল…।’

মাসিমা কটমট করে মেজোমামার দিকে তাকাতেই মেজোমামা আমতা-আমতা করে চুপ হয়ে। গেলেন, যেন গান শেষ হল, ‘না, মানে ভুল, মানে বেল মানে, ক্যাট দি বেল মানে, না না বেল দি ক্যাট মানে…’

মাসিমা আবার তাকাতেই মেজোমামার রেকর্ড একেবারেই থেমে গেল।

‘দেখি কপালটা নীচু করো। ওঃ লম্বা বটে! তালগাছ।’

বড়মামা অভ্যর্থনা সভার সভাপতির মতো কপালে যেন তিলক নিচ্ছেন।

মাসিমা একহাতে বড়মামার মাথার পেছন দিকটা ধরে সামনে ঝুঁকিয়ে আর এক হাতে। অ্যান্টিসেপটিকে ভেজানো তুললো থ্যাঁতলানো কপালে চেপে ধরেছেন। বড়মামার যেন চুল কাটা হচ্ছে সেলুনে। তুলোটা কপালে চেপে ধরতেই বড়মামা বিশাল একটা চিঙ্কার ছাড়লেন। মানুষ উঁচু ছাদ থেকে পড়ে যাবার সময়েই অমন চিৎকার করে। চিৎকার শুনেই কোথা থেকে ছুটে এল বড়মামার কুকুরদের অন্যতম, সবচেয়ে দুর্দান্ত স্প্যানিয়েল—’ঝড়’। সবক’টা কুকুরেরই বাংলা নাম। ঝড়ু, সুকু, ডাকু।

ঝড় বড়মামাকে বাঁচাতে এসেছে। সামনের থাবার ওপর মুখ নামিয়ে, ঝিকি মেরে মেরে, বার কতক ঘেউ ঘেউ করে খুব খানিকটা বকাঝকা করল। যখন দেখল মাসিমা তবু তার প্রভুকে ছাড়ছে না, তখন শাড়ির আঁচল ধরে হিড়হিড় করে টানতে শুরু করল। ফাইন লাগছিল। ব্যাপারটা। ঝড়ুর মুখটা ভারী সুন্দর। সেই মুখে আঁচলের আধখানা, পেছনের দু-পায়ে ভর রেখে, মুখটা সামান্য ওপরে তুলে, টান টান, টানাটানি, টাগ অফ ওয়ার।

বড়মামার কপাল ততক্ষণে মেরামত হয়ে গেছে। মাসিমার দু-হাত এখন মুক্ত। দু-হাতে আঁচল ধরে টানছেন। নতুন শাড়ি। সহজে ছিড়ছে না, কুকুরেও ছাড়ছে না। মেজোমামা তারিফ করে বললেন—

‘ডগ ইজ এ ফেতফুল অ্যানিম্যাল। প্রভুভক্ত জীব।’

‘প্রভুভক্তি আমি ঘুচিয়ে দিচ্ছি। এই, লাঠিটা নিয়ে আয় তো।’ লাঠির নাম শুনে ঝড়ু একটু থমকে দাঁড়াল, তারপর চোখ দুটো আধ-বোজা করে যেমন টানছিল তেমনি টানতে লাগল, ঝটকা মারতে লাগল, খোঁটায় বাঁধা প্রাণীর মতো অর্ধবৃত্ত আকারে ঘুরতে লাগল। বড়মামা একটু সামলেছেন। মুখ দেখে মনে হল ঝড়ুর বীরত্ব ও প্রভুভক্তিতে বেশ গর্বিত। তবে লাঠি থেকে বাঁচাতে হবে। ভক্তেরই তো ভগবান! বড়মামা শাসনের সুরে বললেন, ‘ঝডু, ঝডু, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, নো অসভ্যতা।’

উত্তরে ঝড়ু আরও মরিয়া হয়ে মাসিমার আঁচলে হ্যাঁচকা টান মারতে লাগল। মেজোমামা বললেন, ‘ঝড়ু ছাড়া ঝড়ুর কিছু করতে পারবে না। কুকুরের সঙ্গে কুকুরের ল্যাঙ্গোয়েজেই কথা বলতে হবে।’ বড়মামা কুকুরের পক্ষেই গেলেন, ‘আসলে কী হয়েছে জানিস, কুকুরের তো বাঁকা বাঁকা দাঁত, কুসির শাড়িটা তাঁতের জ্যালজেলে, দাঁতে আটকে গ্যাছে। ও টানছে না, ও দাঁত থেকে খুলে ফেলার জন্যে ছটফট করছে। দেখি, কাঁচিটা দেখি, এ কেসটা হল সার্জারির কেস।’

মাসিমা বললেন, ‘শাড়িটার দাম জানো? সেভেনটি সিকস। সার্জারি নয়, লাথি।’

মাসিমা সত্যি সত্যিই একটা লাথি চালালেন। ঝড়ুর গায়ে লাগল না, কিন্তু ভয়ে ছেড়ে দিল। শাড়ির আঁচলটা ফুটো ফুটো, চিবোনো চিবোনো। মাসিমার চোখে জল এসে গেছে।

‘আজই নতুন শাড়িটা সবে ভেঙে পরলুম, হতচ্ছাড়া, জানোয়ার কুকুর। শাড়িটার কী সুন্দর রং ছিল!’ মাসিমার কাঁদো কাঁদো গলা শুনে মেজোমামা বললেন—

‘ছিল বলছিস কেন, এখনও তো সুন্দর রংই রয়েছে! জলে পড়লে রং ওঠে, কুকুর ধরলে রং উঠবে কেন?’

বড়মামা বললেন, ‘বারো হাত শাড়ির হাতখানেক কেটে ফেলে দিলেও এগারো হাত থাকে। যে কোনও মহিলার পক্ষে এগারো হাত যথেষ্ট। কী বল?

মেজোমামা বললেন, ‘ইয়েস ইয়েস। ইলেভেন ইয়ার্ডস’— ‘তোমার ইংরেজিটা শুদ্ধ করো, ইয়ার্ড মানে গজ, হাত নয়।’ বড়মামা হঠাৎ সুযোগ পেয়ে গেছেন।

নীচে ‘হাম্বা’ করে একটা শব্দ শোনা গেল, ‘গরু খুলে গেছে, ওমা গরু খুলে গেছে, গরু যাঃ যাঃ, হায় গো, ডাঁটার ঝাড়টা নিয়ে পালাল গো!’

‘কী হল মানুর মা?’ মাসিমা শাড়ির শোক ভুলে সিঁড়ির দিকে দৌড়োলেন।

মেজোমামা বললেন, ‘দাদা, তোমার ভিটামিন বি কমপ্লেক্স গবায় নমঃ হয়ে গেল। আসল কাটোয়ার ডেঙ্গো ছিল।’

বড়মামা বললেন, ‘নো ক্ষমা, আর ক্ষমা করা চলে না, সেই লাইনটা, অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে—’

আমরা সদলে নীচের উঠোনে নেমে এলাম। মাসিমার পেছনে ঝুলছে কুকুরে চিবোনো আঁচল। পেছনে আমি। আমার পেছনে বড়মামা। বড়মামার পেছনে মেজোমামা।।

লক্ষ্মীছাড়া লক্ষ্মী উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ বুজিয়ে ডেঙ্গোর ঝাড় চিবোচ্ছে। এত চিৎকার, চেঁচামেচি কোনওদিকে কোনও দৃকপাত নেই। নিজের কাজ করে যাচ্ছে আপন মনে। ডাঁটা ঝাড়ের আধখানা চলে গেছে গলায়, বাকি অংশটা ইঞ্চি ইঞ্চি করে ঢুকছে। মাসিমা সেই বাড়তি অংশটা ধরে টানাটানি শুরু করলেন। যতটুকু পারা যায় উদ্ধারের চেষ্টা।

মেজোমামা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ছেড়ে দে কুসি। পারবি না। বোভাইন-টিথের স্ট্রাকচার জানা থাকলে তুই আর চেষ্টা করতিস না। গরুর ওপর আর নীচের পাটিতে ক’টা করে দাঁত, কী ভাবে সাজানো থাকে জানিস?’

মাসিমা বললেন, ‘তোমরা জানো, আমার জেনে দরকার নেই।’ মাসিমা পাতা ধরে টানতে লাগলেন। লক্ষ্মী চিবিয়েই চলেছে। এক ঝটকায় মাসিমাকে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে টলমল করে দিয়ে লক্ষ্মী পেছন ফিরে দাঁড়াল। ন্যাজটা মাঝে মাঝে দুলছে। বিরক্তি ভালো লাগছেনা। তার। শান্তিতে কাটোয়ার ডাঁটা চিবোতে চায়। গরুটাকে দেখতে ছবির গরুর মতো। সাদা ধবধবে গায়ের রং। ন্যাজের দিকটা চামরের মতো। ডগাটা কালো। শিং দুটো তেলা। চোখ দুটো বড় বড়, ভাসা ভাসা।

‘বড়মামা, আপনার গরুটাকে ভারী সুন্দর দেখতে।’

‘অতি অসভ্য গরু। একগুয়ে, অবুঝ। গরুর সম্পর্কে আমার ধারণা পালটে দিয়েছে। মানুষের চেয়েও অসভ্য!’ মাসিমা কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। সামলে নিলেও ভীষণ রেগে গেছেন।

‘অনেকদিন তোমাকে বলেছি দাদা, তোমার এই গরু-কুকুর এসব হাটাও। বাড়িতে টেকা যায় না। এ আমাদের কম সর্বনাশ করেছে! আদরে আদরে বাঁদর তৈরি হয়েছে।’

বড়মামা বললেন, ‘আর মায়া নয়, আজই একে বিদায় করতে হবে। মানুর মা, আজই, এখনই তুমি এটাকে নিয়ে যাও।’

‘আমি গরু নিয়ে কী করব দাদাবাবু। আমার নিজেরই থাকার জায়গা নেই। চাল নেই। চুলো নেই।’

‘কেন, তোমার বাড়ির পাশের মাঠে বেঁধে রেখে দেবে। যখন দুধ হবে দুধ খাবে, দই খাবে, ক্ষীর খাবে, চেহারা ফিরে যাবে।’

মেজোমামা বললেন, ‘মাঝে মাঝে লাথিও খাবে। সভ্যতা এতবছর এগিয়ে গেল, গরু কিন্তু সেই গরুই রয়ে গেল। প্যালিওলিথিক গরু, নিওলিথিক গরু আর এই স্পেস এজ গরু বিবর্তনের ধারাটা কত স্লো দেখছ দাদা! আমরা কত অসম্ভবকে সম্ভব করলুম! গরু কোনওদিন ভাবতে। পেরেছিল, তার তরল দুধকে আমরা গুড়ো করে টিনে ভরে ফেলব?’

উঠোনে একটা বাঁধানো বসার জায়গা ছিল, বড়মামা তার ওপর বসে পড়লেন। চুল উড়ছে। কপালের একটা পাশ গোলাপি। ফরসা চেহারায় বেশ মানিয়েছে। মাসিমা ডাঁটা উদ্ধারের আশা। ছেড়ে দিয়ে ভীষণ যেন রেগে গেলেন। সকালে বাজার এসেছে। মানুর মা সব ধুয়ে ধুয়ে রেখেছে। আলু, পটল, উচ্ছে, কুমড়ো, কাঁচালঙ্কা, পাতিলেবু।

‘এই নে সব খা, সৃষ্টি খা, তুই-ই খা’। ঝুড়িসুদ্ধ সব টান মেরে মাসিমা লক্ষ্মীর মুখের সামনে ছড়িয়ে দিলেন।

লক্ষ্মী খুব চালাক গরু, ভেবেছিলুম পটলের সঙ্গে লঙ্কা চিবিয়ে আর একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসবে। লক্ষ্মী জানে কোনটার পর কী খেতে হয়। সে কুমড়োটা মুখে পুরেছে। ডেঙ্গো শাক কুমড়ো দিয়েই রাঁধে। এরপরই হয়তো আলু আর পটল খাবে, সঙ্গে একটা কাঁচালঙ্কা। পেটে গিয়ে হয়ে যাবে আলু-পটলের ডালনা।

মেজোমামা বললেন, ‘শিশু আর গরু বুদ্ধিবৃত্তিতে সমান স্তরের প্রাণী। যা পাবে তাই মুখে পুরবে। যত রকমের অপকর্ম আছে নির্বিবাদে করে যাবে। হ্যাঁ, শিশু আর গরু এক জিনিস, সেম থিঙ্কস, চেহারা ছাড়া সব এক।’

বড়মামা বললেন, ‘তা হলে দেখো, সেই শিশু স্নেহ পায় বলেই মানুষ হয়। গরুর বেলায় উলটো। গরু স্নেহ পায় না, তাই বড় হয়েও গরুর গরুমি যায় না। হ্যাঁরে বাংলাটা ঠিক হল তো?’

‘কী বললে, গরুমি!’ বাঁদর-বাঁদরামি, পাগল-পাগলামি, ছাগল-ছাগলামি, গরু থেকে বোধহয় গবরামি হবে। সংস্কৃত গো শব্দ থেকে উৎপত্তি। গো আর রামি।’

‘আমরা কত স্বার্থপর দেখো? গরু মানেই আমাদের কাছে দুধ, মাখন, ছানা, দই, রসগোল্লা, গব্যঘৃত, ফুলকো লুচি।’

হঠাৎ লক্ষ্মী একটা লাফ মারল। বালতি, ঝুড়ি সব উলটে-পালটে, সেই ছোট্ট উঠোনে টাটু ঘোড়ার মতো গোল হয়ে ছুটতে লাগল। মাসিমা রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন। মেজোমামা দোতলায় ওঠার। সিঁড়ির ধাপে, বড়মামা যে বেদিটায় বসেছিল সেইটার ওপর উঠে দাঁড়ালেন।

দোতলার বারান্দা থেকে আমি বললুম, ‘ওর ঝাল লেগেছে বড়মামা, কাঁচালঙ্কা খেয়েছে।’

‘একটু পরেই রতন আসবে।’

রতনের খাটাল আছে। মাসিমাই রতনের কথাটা বললেন। বড়মামা যেন ধড়ে প্রাণ পেলেন। বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, কুসি! রতনের ওখানে থাকলে লক্ষ্মীটি মানুষ হবে, সঙ্গী পাবে। একটা প্রতিযোগিতার ভাব আসবে। আর পাঁচটা গরুকে দুধ দিতে দেখলে নিজের দুধ দেবার ইচ্ছে হবে।’

মেজোমামা বললেন, ‘ইয়েস, কম্পিটিশন। প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকলে গরু ভালো রেজাল্ট দেখাতে পারবে।’

লক্ষ্মী সেজেগুঁজে রেডি হল। নীল নাইলনের দড়ি। গোয়াল থেকে উঠোনে এসেছে, একটু পরেই সদর দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

‘বাবু আছেন, ডাক্তার বাবু?’ ওই যে রতন এসে গেছে। গায়ে হলদেটে ফতুয়া। নীচের দিকে দুটো পকেট, নানারকম জিনিসে ফুলে আছে। লুঙ্গিটা একটু উঁচু করে পরা। কালো তেল চুকচুকে রং, কদমছাঁট কাঁচা-পাকা চুল।

‘এসো, রতন এসো।’ ধরাধরা গলায় রতনকে ডাকলেন।

‘বাঃ, লক্ষ্মী তোলক্ষ্মীই, বেশ চেহারাটি! গরু হলে এই রকম গরু হওয়াই উচিত।’

‘একটা রিকোয়েস্ট রতন, তুমি নজর দিও না।’

‘হাসালেন ডাক্তারবাবু, ও তো এখন থেকে আমার নজরেই থাকবে। আমি চেহারা-ফেয়ারা বুঝি না, আমি বুঝি দুদ। দুদ দিলে খাতির, না দিলে জুতো।’

‘জুতো মানে, গরুকে জুতো পেটা’? ‘না না, হিন্দুর ছেলে গরুকে জুতো মারতে পারি? মহাপাপ! গরু মেরে জুতো তৈরি হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *