রাতের কাহিনিকার

রাতের কাহিনিকার

যমুনার পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখছিলেন কাহিনিকার নুসরত রজা লাহোরি। তামাম দিল্লিতে সবাই তাঁকে ডাকে বাবা লাহোরি। ওঁর কাছেই নাকি দুনিয়ার সব কিসসা মজুত আছে। সাঁঝ নামলে যমুনার এই পাড়ে বসে চলে লাহোরির গল্প শোনানো। সমঝদারেরা বলে যে, সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের যেমন শেষ নেই, একটার শেষ হলে আরেকটার শুরু, তারপর সেটার শেষ

তো অন্যটার শুরু, তেমনি ধারা বাবা লাহোরির কিসসার…শুরু-শেষ শুরু-শেষ-শুরু…

বাবা নিজে অবশ্য মনে করেন গল্প হল জীবন আর মৃত্যুর মতো, একটা আছে বলেই অন্যটাও আছে। আগ্রায় বসে জাহাঙ্গির বাদশাহ একবার ওঁর গল্প শুনে বলেছিলেন, বাবা, এখানেই আপনার গল্প শেষ? ব্যাস?

বাবা লাহোরি মাথা ঝুঁকিয়ে তখন আদাব করে বলেছিলেন, শেষ? নেহি জাঁহাপনা! এই তো শুরু।

গল্পটা ছিল বাংলার শ্রীহট্টের নবীন যুবা চয়ন আর তার প্রেমিকা কুঞ্জরানির গল্প। দিল্লির হারেমে জমা পড়ে যাদের নাম হয়েছিল ফৈজু আর দিলারা। বাদশাহ এরপর জিজ্ঞেস করতেই পারতেন, বাবা, ইসকে বাদ কেয়া? তা না করে তিনি জোর কদমে হেঁটে গেলেন অন্দরমহলে বেগম নূরজাহানের কাছে আর কপালে হাত দিয়ে বসে বললেন, বেগম, কখনও ভেবে দেখেছ গল্প যদি সত্যি হয় তো তা কী ভয়ংকর ব্যাপারে দাঁড়াতে পারে?

নূরজাহান তাঁর কর্তার কথার কোনো মানে করতে না পেরে একটু উদবিগ্নই হলেন। তা হলে কি কাল বাদশার আফিম আর মদের মিশেল একটু গোলমেলে হয়ে গিয়েছিল? তিনি বাদশার মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে বললেন, মেরে সরতাজ, আপনার কেন এমনটা মনে হল হঠাৎ?

জাহাঙ্গির বললেন, আজ বাবা লাহোরির একটা গল্প শুনে মনটা একদম ভেঙে গেল, বেগমসাহেবান। বাংলার সিলহটের এক যুবকের গল্প। চাষির ছেলে, বাপ-দাদারা কর দিতে পারেনি তাই ওকেই পাঠিয়ে দিয়েছিল আমাদের আমির-ওমরাহদের হারেমে খোজা হবার জন্য।

বেগম নূরজাহানের রাগ বড়ো তাড়াতাড়ি চলকে ওঠে। তিনি দপ করে জ্বলে উঠে বললেন, পিয়ারে বাদশাহ, আমি তামাম হিন্দুস্তানের মালিক জাহাঙ্গির বাদশার হারেম খারিজ করতে পেরেছি। কিন্তু আপনার আমিরদের স্বভাব বদলাতে পারলাম কই? ওঁদের বেগমরা যেমন শরীরের হিরে-জহরত দেখিয়ে লোকের তারিফ কুড়োতে চায় তেমনই ওই আমিররা শুনেছি সাঁঝেরবেলা শরাব টানতে টানতে নিজেদের হারেমের গর্ব করে। মুঘল সাম্রাজ্যের রৌনক নাকি এখন এসে দাঁড়িয়েছে শরাবের মস্তি আর হারেমের বস্তিতে। এই ভাবলেই আমার রগের ব্যথাটা চড়চড় করে বাড়ে।

কপালে হাত রেখে, মাথা ঝুঁকিয়ে নূরজাহানের কথা শুনছিলেন জাহাঙ্গির। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে যেমন তুরন্ত এসেছিলেন, ঠিক তেমনি বেগে বেরিয়ে গেলেন বাইরের মহলের দিকে। ততক্ষণে তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন যে, করের বদলে খোজা করার জন্য চাষিবাড়ির যুবকদের নেওয়া বন্ধ করবেন।

বাবা লাহোরির এসব পরিষ্কার মনে আছে, আর জীবনের প্রান্তে এসে সওয়াল উমরের বাবার এও মাথায় আছে যে, বাদশাহ-জাহাঙ্গিরের সেদিনের সেই হুকুমের পরও সিলহট থেকে নওজোয়ানদের খোজা করার জন্য আমদানি রদ হয়নি। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, জিন্দেগি মওত, কাহিনির শুরু আর শেষের মতো হিন্দুস্তানের এলাকায় এলাকায় গরিবিরও কোনো শেষ নেই। আর যতদিন এই কমবক্ত গরিবি থাকবে ততদিন…

বাবা লাহোরির চিন্তায় ছেদ পড়ল এক নবীন যুবার সালামে। বাবা ওঁর বরফের মতো সাদা চুল-দাড়িতে ঢাকা মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, বেটা, চোখে ভালো করে দেখতে পাইনে। তুমি আরেকটু নজদিক হয়ে বলো তো, তুমি কে?

যুবক এবার নীচু হয়ে বাবার পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, বাবা, আমাদের গ্রামে একটা প্রবচন আছে যে, সাধু-সন্তদের কাছে উষালগ্নে আর সূর্যাস্তকালে দয়াভিক্ষা করলে তা বিফল হয় না…

যুবকের কথার মধ্যেই রে রে করে প্রতিবাদ শুরু করলেন বাবা লাহোরি, বল কী! বল কী! আমি সাধু-সন্ত-পিরফির নই বাপু, আর আমার কাছে ভিক্ষে করার মতো কিসসু নেই বাপ। আমি নিজেই রাতবিরেতে কিসসা গেয়ে ভিক্ষে করে দিন গুজরান করি। তুমি ছোকরা ভুল লোক পাকড়েছ।

যুবক এবার পাড়ের মাটিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে বলল, বাবা তিন মাস হিল্লিদিল্লি করেছি, এই আপনার খোঁজে। কেউ বলে কবেই মারা গেছেন, কেউ বলে শুধু রাতেই আপনার দর্শন মেলে রইসদের আখড়ায়। শেষে…

বাবা লাহোরি ওঁর মরে আসা চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে মেলে বললেন, শেষে?

—শেষে দিল্লির কোঠাওয়ালি সুরৈয়ার কাছে শুনলাম যে, দিনের এই সাঁঝবেলাতে আপনাকে যমুনার এই পাড়ে কিছুক্ষণ পাওয়া যায়।

ঠিক তখন সূর্য ডুবল, নদীতীর হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল, আর কালচে-নীল আকাশের গায়ে একটা মাটির ঢিবির মতো দেখাল প্রবৃদ্ধ বাবা লাহোরিকে। যুবকের কথায় কীরকম গুম মেরে আছেন বৃদ্ধ, আর এই পর্ব চলল বেশ কিছুক্ষণ। যুবকের মনে হল এই নীরবতা ওকে চলে যাওয়ার নির্দেশ। ও ফের বৃদ্ধকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গুস্তাকি মাফ করবেন হুজুর, আমি চললাম।

রোকো।–সহসা গম্ভীর স্বরে নির্দেশ এল বাবা লাহোরির। যুবক থমকে দাঁড়াতে ফের বললেন বৃদ্ধ, তুমি কিন্তু বলে গেলে না কী চাইতে এসেছিলে এখানে।

যুবক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শেষে নরম সুরে বলল, একটু দয়া।

বাবা লাহোরি বুঝে উঠতে পারলেন না ছোকরা দয়া, দয়া’ বলে কী বোঝাতে চাইছে। তার ওপর ওঁর হদিশ পেয়েছে কোঠাওয়ালি সুরৈয়ার কাছে, যার মতো একটা হারামি মেয়েছেলে দুনিয়ার কম আছে। কে জানে কী মতলবে একে পাঠাল সুরৈয়া। তবু ছোকরার মুখ দেখে দয়াই হল বাবার, জিজ্ঞেস করলেন, কীসের দয়া বেটা?

যুবক ফের বসে পড়ল বাবার পায়ের কাছে, বাবা, আমি রাতের কিসসা গাওয়াইয়া হব। আপনি আমায় তালিম দিন।

গোটা অন্ধকার আকাশটা তাঁর মাথায় টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়লেও বাবা লাহোরি এতখানি তাজ্জব হতেন না, যা হলেন যুবকের আর্জিতে। প্রায় গোঙিয়ে উঠলেন, বলিস কী বেটা! দম থাকতে আর দিমাক থাকতে কেউ কখনো এই কাজ নেয়! ওরে, এ তো সারাদুনিয়ার দর্দ আর দুখ বুকে আর মাথায় বয়ে বেড়ানো। আর রাত জেগে জেগে মহল্লায় মহল্লায় গেয়ে যাওয়া। রাতের কিসসাকার হল রেণ্ডির মতো, রাতই তার দিন। দুনিয়াকে ভুলতে মানুষ তার সঙ্গ নেয়, কিসসা শুনতে শুনতে এক সময় গাওয়াইয়াকে ভুলে গিয়েও মানুষ ঘুমে ঢলে পড়ে। তখন গাওয়াইয়ার মনে হয় সে-ও এক কাজ-ফুরোনো রেণ্ডি…তুই এই কাজ নিবি?

যুবক বলল, বাবা, আপনি রেণ্ডি কথাটা মুখেও আনবেন না মেহেরবানি করে। আপনি রাতের পরি। আমাদের প্রদেশে কাহিনিকারদের বলা হয় ঋষি। কারণ তাঁরা মানুষের দুঃখ বেদনার ইতিহাস জানেন। সুর করে সেই কাহিনি গাওয়াকে বলে কীর্তন। আমি কীর্তন গাইতে গাইতে বহু পথ পার হয়ে এখানে চলে এসেছি। আপনার কাছে।

আমার কাছে?—ফের একবার চমকে উঠলেন বাবা লাহোরি। তুই কি ভাবিস আমি দেব দেবী, হুর-পরির লীলাকীর্তন করি? আমি গল্প বলি আনসান আদমির উলটোপালটা কাজের, দোজখের কেচ্ছাকান্ডের, ছুরি চাকু হাতামারি বেলেল্লাপনার অজিব সিলসিলার। ব্যর্থ প্রেম, দুরন্ত শয়তানি, লোভীর জিভের জল আর দুঃখীর চোখের জল নিয়ে। এসব কাহিনি দিনে কেউ উচ্চারণ করবে না, রাতে শুনবে হাতে শরাব নিয়ে, আর আঁসু বহাবে। আমার উস্তাদ ছিলেন এক হিন্দু ব্রাহ্মণ মাধোদাস। আমার অর্ধেক কাহিনি তাঁর মুখ থেকে তোলা, আর অর্ধেক দিল্লির বাজার, ময়খানা, রেণ্ডিবাড়ি আর শানদার সব হারেম থেকে। ভাবিস না এইভাবে গল্প কুড়োনো খুব আসান কাম। আমার উস্তাদ মাধোদাস তাঁর শেষ কিসসা যেটা শুনিয়েছিলেন সেটা নিজের। যখন বললেন ‘এরপর মাধো চুপ করলেন, আর সেই মুহূর্ত থেকে কেউ আর তাঁর গলা শুনতে পেল না আমরা ভাবলাম পন্ডিতজি এটা কী বলছেন? এরপর আর তা হলে ওঁর আওয়াজ পাব না আমরা? আওয়াজ একটা পেলাম ঠিকই দম তোড়ার। আমরা হুড়মুড় করে ওঁর শোবার ঘরে ঢুকে দেখি পন্ডিতজি গলায় গামছা বেঁধে লটকে আছেন কড়িবরগা থেকে। তখন ওঁর উমর মাত্র চল্লিশ।

যুবক বলল, কিন্তু আপনি শওসাল বেঁচেছেন। উদাসভাবে বাবা লাহোরি বললেন, হু। তা হলে বোঝো আরও কত ব্যথা আর চোখের জল নিয়ে জীবন কাটালাম।

যুবক বলল, কিন্তু আমাদের অবতার শংকরদেবের তৈরি কীর্তন গাই যখন আমরা, তখনও তো কাঁদি।

বাবা লাহোরি অন্ধকারে ঢাকা যুবকের মুখ হাতড়ে হাতড়ে নিজের দুই তালুর মধ্যে এনে বললেন, তুমি শংকরদেবের কীর্তন গাও? আমায় একটু শোনাবে?

যুবক ওর কোঁচড় থেকে একটা বাঁশি বার করে তাতে একটু ঝিঝিট সুর তুলে তারপর গলায় গেয়ে গেল শংকরদেবের একটা কীর্তন। যমুনার তীরে অন্ধকারে বসে তাই শুনতে শুনতে তাঁর প্রায়ান্ধ চোখ দিয়ে অশ্রুবিসর্জন করতে করতে সেই গান শুনলেন বাবা লাহোরি।

যুবক কখন গান থামিয়েছে বাবার হুঁশ ছিল না, তিনি তখন স্বপ্নে স্বপ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লাহোরের বাল্যে, যখন আমিনাকে তিন তালাক দিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল আজমল খাঁ আর দূরে টিলার থেকে ঝাঁপ দিল নীচের পাথরে; সেই পাথরের জমির এক কোণে তখন

মাথা হেঁট করে বসে আজমলের ছেলেবেলার বান্ধবী নাজমুন, যে চোখে দেখতে পায় না, কিন্তু সব দৃশ্য অবিকল বর্ণনা করতে পারে আঁখদার মানুষের মতো। আজমল পড়ে থেতলে যেতেই ওর মরা মাথাটা কোলে তুলে এমন এক কান্না জুড়ল নাজমুন যে, সেই থেকে রাতের ঘুম থেকেও চমকে চমকে উঠত আমিনা। আর তখন ডাক পড়ত বালক নুসরত রজার— বাচ্চা, শুনেছি তোর বহুত কিসসা জানা আছে। আমায় কিসসা শুনিয়ে জাগিয়ে রাখ, না হলে ওই চুড়ৈল নাজমুনের কান্নার আওয়াজ আমার জান খেয়ে নেবে। বালক নুসরত বলল, কিন্তু নাজমুন তো সেইদিনই কাঁদতে কাঁদতে মরে গেছে। আমিনা বালককে কাছে টেনে নিয়ে বলল, মরে গেছে, কিন্তু কান্নাটা রেখে গেছে আমার জন্য।

বাবা লাহোরির মনের পরদায় ভাসছিল মিরাটের রইস ফজলে মিয়াঁর মুখটা, যিনি তাঁর প্রেমিকা খুবসুরত বাইয়ের গোপন প্রেমিকের ডান হাতের কড়ে আঙুলটা কেটে সোনায় বাঁধিয়ে গলায় মালা করে পরিয়েছিলেন খুবসুরতকে। বাবার চোখের সামনে ভাসল সেই ইটের দালান, যেখানে সেলিমকে ভালোবাসার জন্য জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছিল আনারকলিকে। তিনি দেখলেন বেনারসের ঘাটে বসা বিধবা দামিনীর মুখ, যিনি স্বামী মিছরিলালের কুষ্ঠ সারিয়েছিলেন বিশ্বনাথ মন্দিরের সামনে রোজ বারো ঘণ্টা কপাল ঠুকে। অথচ তাঁর কপালে কোনো চোট হল না, লোকে বলতে শুরু করল ‘এবার বোধ হয় সিঁড়ির পাথরটাই ভেঙে পড়বে। বাবা লাহোরি দেখলেন সিপাহসালার ওয়াকি খানের হারেমের সুন্দরী গুলবদনের দুই নীল চোখ, কালাজ্বরে ইন্তেকালের আগে যে-চোখ দুটো উপড়ে নিয়ে বোয়ামে ভরে দিলেন ওয়াকি। বললেন, আমি চলে গেলে এই চোখের ইজ্জত করার লোক থাকবে না। অন্ধ হওয়ার পর গুলবদনের কাজ হয়েছিল—তখন তো ওঁর দিন আর রাত সমান তরুণ নুসরত রজাকে ডেকে গল্প শোনা আর বিনিময়ে নিজের জীবনের সমস্ত প্রেম আর প্রেমিকের গল্প শোনানো। এরকম এক গল্পের বৈঠকের পর বলেছিলেন, নুসরত, এসো, উঠে এসো আমার বিছানায়।

ভয়ে আর লজ্জায় শিউরে উঠেছিল নুসরত, সে কী কথা, বেগমসাহেবান? আমি গরিবগুর্বো…

গর্জে উঠেছিলেন গুলবদন, চুপ! উঠে এসো।

-কিন্তু বেগমসাহেবান, চারিদিকে ভর দিন এখন…

–চুপ। উঠে এসো।

অগত্যা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেগমের বিছানায় জায়গা করে নিল নুসরত রজা। সেদিনের সেই প্রেমের স্মৃতিতে আজও গায়ে কাঁটা দেয় বাবা লাহোরির। জন্নত। বিলকুল জন্নতের ছোঁয়া সেদিনের সেই দুপুরের খেলায়।

কিন্তু তারপর? বাবা লাহোরি আজও ভোলেননি সেই মৃত্যুভয়ের মুহূর্ত। দোজখের শয়তানের মতো কোত্থেকে হঠাৎ উদয় হল হারেমের খোজা মুর্শেদ। টেনে হিঁচড়োতে হিচড়োতে নিয়ে গেল নুসরতকে হারেমের সহবত শেখাতে। ব্যথায়, যন্ত্রণায় ভুলেই গেল লোকগুলো সত্যি কী করল ওকে নিয়ে অন্ধকার ঘরে। তিন দিন, তিন রাত বেহুশ হয়ে থেকে ফের যখন দিনের আলো দেখল নুসরত, ও-ও তখন এক খোজা।

বাবা লাহোরির চোখের সামনে ভাসছিল চয়ন আর কুঞ্জরানির নিষ্পাপ মুখ দুটো, যখন কানে ভেসে এল যুবকের আওয়াজ, বাবা, আপনি আমায় শেখাবেন?

বাবা চোখ মেলে অন্ধকারের মধ্যে যুবকের আবছা মুখটা দেখলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোথাকার মানুষ রে ছোকরা?

—সিলহটের।

বাবা ফের চোখ মুছলেন। বললেন, তোর গান শুনেই আমি ধরেছি। তো তোর ওই গান ছেড়ে শেষে এইসব কাহিনি শোনাবি লোককে?

যুবক বলল, শ্রীহট্টে বড্ড খরা। ফসল কিছু হয় না। ফসলের বদলে আমরা ক-জন জমা পড়েছি হারেমে। খোজার গলায় কীর্তন কে শুনবে হুজুর?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাবা লাহোরি। যুবকের পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম?

যুবক বলল, নন্দন। হারেমে ডাকে লক্কা বলে।

বাবা বললেন, তোর বাপ-মা তোকে ছেড়ে দিল?

যুবক বলল, তাঁরা কেউই নেই, আমি তাঁদেরও খোঁজে আছি।

—তাঁদের মুখ মনে আছে? তাঁরা কোথায় জানিস?

—শুধু জানি দিল্লির কোনো হারেমে। কিন্তু তাঁদের মুখ আমি দেখিনি।

—তাঁদের নাম?

—চয়নদেব আর কুঞ্জরানি।

–তার মানে হারেমের দুনিয়া যাদের চেনে ফৈজু আর দিলারা বলে?

এই নাম দুটো সম্পূর্ণ অজানা নন্দনের কাছে, সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে।

২.

তখনই দিনের আলো ফুটতে দেরি আছে। বাবা লাহোরি নন্দনদেবকে নিয়ে দিল্লির সেরা হেকিম আবুতালেবের হারেম থেকে কাহিনি গেয়ে বেরোলেন। বেরোবার মুখে হারেমের খোজা ফরহত এসে বৃদ্ধের ঝোলায় কিছু রুপৈয়া আর চাল ঢেলে দিল। খোঁজ করল, বাবা, ফের কবে কাহানি শোনাবেন এই হাভেলিতে? আপনার কাহানি সচমুচ এই পরিদের নিদ কেড়ে নেয়।

বাবা লাহোরি ফরহতের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, দেখি, বেটা। উমর তো ফুরিয়ে এল। জানি না আর কতদিন টানতে পারব। ফরহত বিলকুল অবাক সুরে বলল, সে কী বাবা! আমার মালিক তো সামনের মহিনায় মীর সবজানির খেয়াল আর আপনার কহানিগানা দিয়ে মেহফিল বসাবেন ঠিক করেছেন। কত আঙুর খেজুর পিস্তা বরফি শরাবের ইন্তেজাম করেছেন।

বাবা লাহোরি নন্দনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন, দেখছিস বেটা, কী জিন্দেগি আমার? খানা পিনা গানা থেকে বেরোবার পথ নেই। আমি এই ছেড়ে যেতে চাইছি ফকিরের গানে, আর তুই দেবদেবীর কীর্তন ছেড়ে আসতে চাইছিস এইখানে?

নদীর পাড়ে বাবা লাহোরির পায়ের কাছে বসতে বসতে বহুক্ষণের নীরবতা ভেঙে নন্দন বলল, বাবা, দেবদেবীর কীর্তন গাওয়া কিছু কঠিন না, সবাই গায়। কিন্তু আপনার মতো মানুষের সুখ-দুঃখের কথা ক-জন বলে? কোঠাওয়ালি সুরৈয়া বলছিলেন যে, আপনি চলে গেলে মানুষের গল্প শোনা বন্ধ হয়ে যাবে শহরে। কারণ আপনার কোনো শাগিদ তৈরি হল না এতদিনে।

বুঝেছি, বুঝেছি বলে মাথা নাড়তে নাড়তে নন্দনকে তার কথার মধ্যে আটকে দিলেন বাবা। তারপর বললেন, তোর কি মনে হয় এই রাতওয়ালি কাহানি চিরদিন চলতে পারে? শুনেছি যুদ্ধের পর রাতের বেলা সেকান্দার কাহিনি শুনে কাটাতেন। তা হলে বোঝ, কত দিনকার রেওয়াজ এটা। ছোটো বয়সে বিশ-পঁচিশ রাতের কাহিনিকার দেখেছি শহরে। এক ছিলেন আমার উস্তাদ মাধোদাস, আর আরেক ছিলেন বড়ে আব্বাস, যিনি শুধু জঙ্গ, যুদ্ধের গল্প শোনাতেন।

বাবাকে এবার কথার মধ্যে রুখে দিল নন্দন—কিন্তু সুরৈয়া বলেন কেউ কিন্তু আপনার মতো ছিলেন না। কারণ কেউ কোনোদিন আপনার মতো প্রেমের গল্প শোনাতে পারেননি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বাবা লাহোরি বললেন, জানি। আর এইসব ইশকের কিসসা ফাঁদতে গিয়েই তো নিজের সর্বনাশ ডেকে আনলাম।

নন্দন প্রশ্ন করল, কীরকম?

বাবা বললেন, প্রেমের গাথা গাইতে গিয়ে বুঝলাম যে, যুদ্ধের গল্প, মারদাঙ্গা হাতমারির কেচ্ছা, মজার গল্প, রহস্য কাহিনির মতো এসব কথা শুধু মাথা দিয়ে, কল্পনা করে বলা যায় না। বড়ো দিল আর দর্দ দিয়ে বানাতে হয় এসব কাহানি। তখন বুকের ভেতর আনচান করে, মাথার মধ্যে মনে হয় খুন ঝরছে। কিন্তু থামাও যায় না, এমনই নেশা।

নন্দন বলল, এই কাহানি বানানোর তরিকাটা কী বাবা?

বাবা লাহোরি বললেন, মানুষ চেনা, মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়া।

-কীরকম?

তখন সূর্যোদয় হচ্ছে, দিনের প্রথম আলো এসে পড়ছে বাবা লাহোরির মুখের ওপর। নন্দন দেখল বাবা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে নদীর পাড়ের একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন, আর বলছেন—

বেটা, ওই দ্যাখ ওই ইমলি পেড়! যা গিয়ে সালাম করে আয়, তারপর এই কিসসা শোন।

নন্দন উঠে গিয়ে গাছটার গোড়ায় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে এসে বৃদ্ধের সামনে বসে বলল, বলুন হুজুর।

বাবা লাহোরি খুব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, আজ থেকে একুশ বছর আগে তোর বাপ আর মাকে নদী থেকে তুলে ওই গাছের নীচে শুইয়েছিলাম।

নন্দনের মনে হল ওর সারাশরীর দিয়ে একটা লম্বা বিদ্যুৎ খেলে গেল। ও কষ্ট করে গলার কান্নাটা চাপল। মনে পড়ল কোঠাওয়ালি সুরৈয়ার কথাগুলো, লড়কা, কেউ যদি তোর বাপ মায়ের হদিশ দিতে পারে তো ওই বাবা লাহোরি। ও দিল্লির হারেমগুলোকে আয়নার মতো দেখতে পায়। আর ও যা দেখে তা জিন্দেগিতে ভোলে না।

বাবা লাহোরি ফের ওঁর কাহিনি শুরু করলেন—অনেক কোশিস করে হুঁশ ফেরালাম ঠিকই ওই মাশুক-মাশুকার, কিন্তু ওরা সমানে বলতে লাগল, বাবা, আমাদের রেয়াত করুন, আমরা মরতেই চাই।

বললাম, খুব গেহরি ইশক না থাকলে কখনো কোনো নারী-পুরুষ এভাবে মরতে চায় না। আর এরকম ইশক থাকলে কোনো মেহবুব-মেহবুবার মরা উচিত নয়। দেখছ না, নদীও তোমাদের ফেরত দিয়েছে!

তিন দিন, তিন রাত ওরা আমার কুঠুরিতে ছিল, কিন্তু মুখে কোনো খাবার তুলল না। জলেরও কোনো পিয়াস দেখলাম না। পাশের ঘর থেকে শুনলাম কখনো চয়ন, কখনো কুঞ্জরানি নিজের নিজের দুঃখের কথা অন্যজনকে শুনিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন, সারারাত। তিন দিন, দিন রাত।

এই তিন দিন, তিন রাত আমিও কোনো কাজে বেরোইনি। না খেয়েছি, না নাহিয়েছি, না শুয়েছি। শুধু দেওয়ালে কান পেতে শুনে গেছি ওদের কাহিনি। তারপর চৌহা দিনের ভোরে যখন এসে ইজাজত চাইল চলে যাওয়ার, আমি ওদের রাস্তা রুখতে পারিনি। আর জিজ্ঞেসও করিনি কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কখনো ফিরবে কি না।

হায় আল্লা, তার পরের দিন ভোরে নদী ফের ফিরিয়ে দিল ওদের ধড় দুটো, বিলকুল নাঙ্গা, আর একের সঙ্গে অন্যটা এত গেহরাইসে ফঁসা, যে আমি দুটো শরীরকে একসঙ্গে কাঠের চিতায় তুলতে বাধ্য হলাম। আমার উস্তাদ মাধোদাসের কাছে সাত বছর যে-সংস্কৃত শিখেছিলাম তাও কাজে লাগালাম ওই সময়। সূর্যমন্ত্র বলে সূর্যাস্তের সময় আগুনে ভস্ম করে দিলাম আমার নায়ক-নায়িকাকে।

নন্দন বলল, বাবা, আমার সেই মাতৃপিতৃদেবের প্রেমের কথা বলুন এবার। ‘বলছি’ বলে বাবা লাহোরি চোখ বুজে গভীর শ্বাস টানলেন, লম্বা সময় ধরে সেই শ্বাস ধরে রাখলেন, আর শেষে যখন মুখ খুললেন মনে হল ওঁর বয়স ঝরে গেছে সত্তর বছর। এক তরতাজা নওজোয়ানের আওয়াজে বাবা গাইতে লাগলেন…তারপর কখনো যুবক, কখনো যুবতীর কণ্ঠে–

৩.

—জানো, কুঞ্জ পরপর তিন বছর যখন খরা চলল দেশে আমি ভয়ে বাবার চোখের দিকে চাইতে পারতাম না। বকেয়া কর দূরে থাক। আমাদের খাওয়া-পরাও বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়।

—আমি তোমার চোখের দিকে চাইলে তখন ঠিক বুঝতাম তোমার বুকের মধ্যে ঝড় বইছে। একবার তুমি বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলে, আর আমি তোমার বুকে কান পেতে বাজ পড়ার আওয়াজ পেলাম।

-সত্যি, কুঞ্জ?

–হ্যাঁ, চয়নদেব।

—তা হলে আমি কেন তোমার পেটে কান পেতে টের পাইনি তুমি মা হতে চলেছ?

—আমি তোমায় বুঝতে দিইনি, প্রিয়। দিতে চাইনি।

-কেন? কেন? কেন তুমি আমায় জানতে দাওনি, কুঞ্জ? তা হলে আমি তোমায় নিয়ে যে। দিকে দু-চোখ যায় পালিয়ে যেতাম।

—আমি কিন্তু পালাতে চাইনি, চয়ন।

—ধিক, কপাল আমার। শেষে তো সেটাই হল। এই সময় বাবা লাহোরি একবার পুরুষকণ্ঠে, একবার নারীকন্ঠে চোখের জল বইয়ে রব করে কাঁদলেন। নন্দনের মনে পড়ল সিলহটের সারারাতের কীর্তনযাত্রার কথা। বৃন্দাবন ছেড়ে কৃষ্ণ কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিচ্ছেন, আর সমস্ত গোপীকুল শোকে মুহ্যমান। রাধা গলায় ঘটি বেঁধে যমুনার ডোবার স্বপ্ন দেখছেন। নন্দন বাবা লাহোরির পিছনে যমুনার দিকে চাইল, একই মানুষের গলায় নারী-পুরুষের শোকের কী বিচিত্র প্রকাশ। নন্দনের তো কাহিনি শোনা নয়, বিশ্বদর্শন…আত্মদর্শন হচ্ছে।

হঠাৎ বাবা লাহোরি চোখ খুলে, চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, বুঝলি বেটা, এই ছিল তোর জন্মরহস্য।

নন্দন মুগ্ধ স্বরে বলল, হ্যাঁ, বাবা।

বাবা লাহোরি ফের শুরু করলেন—সিলহটে হুকুমনামা পৌঁছে গিয়েছিল সলতানাত বছর বছর এভাবে কর বাকি ফেলা পছন্দ করছে না। দিল্লির আমিররা চান সিলহট করের বদলে কিছু জোয়ান পুরুষ পাঠাক হারেমে কাজ করার জন্য। ভালো গাইয়ে জোয়ান হলে ভালো দর উঠবে। কিছু খুবসুরত লেড়কি হলেও বহুত রুপৈয়া মকুব হবে।

চয়নের বাবা চরণদাসের ভয় হল তার ছেলের গানের গলাই তার কাল হবে। তার ওপর অপূর্ব বাঁশি বাজায় ছেলে। তার আরও খবর আছে গ্রামের স্বর্ণকার পরীক্ষিৎচন্দ্রের মেয়ে কুঞ্জরানির সঙ্গে চয়নের ভাব-ভালোবাসা জমেছে। এই সুযোগে ওদের বিয়ে ডেকে দিতে পারলে ছেলের খোজা হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

চরণদাস পরীক্ষিৎকে গিয়ে তার শলা দিতেই আকাশ থেকে পড়ল বেনের ব্যাটা। পেঁয়ো চাষি খোয়াব দেখছে জহুরির বাড়িতে সম্বন্ধ করার। সেই রাতেই পরীক্ষিৎ খবর পাঠাল কাফি খাঁর কাছে চয়নের গানের কথা, বাঁশির কথা, চোখকাড়া চেহারার বর্ণনা দিয়ে। হপ্তা ঘুরতে না ঘুরতে চাষের মাঠ থেকে ঘুমন্ত চয়নকে তুলে পাচার করে দেওয়া হল দিল্লি। একমাত্র ছেলের শোকে চরণদাস ঝাঁপ দিল কুয়োয়।

—জানো, কুঞ্জ, ওরা হয়তো আমায় আফিম কি মদের নেশায় চুর করে রেখেছিল অতদিন। কীভাবে, কীভাবে যে দিল্লি এলাম কিছুই মনে পড়ে না আমার। যে-দিন সত্যি ঘোর কাটল দেখি চারধারে অচেনা মেয়েরা সব ঘোরাফেরা করছে, কিন্তু কাউকে আমার অ্যান্তোটুকু ভাল্লাগছে না।

—কিন্তু, চয়ন, দিল্লি আসার সব পথ, সব দিন, সব রাত আমার মনে আছে। মনে আছে সেই সব পুরুষকেও। যারা আমায় লুটেপুটে খেল শুধু তোমার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা দিয়ে। কোঠাওয়ালি সুরৈয়া তো আমায় ছ-মাস বেশ্যা করে রেখে দিল ওর ওখানে।

-কিন্তু কেন? কেন তুমি এই পথ ধরলে কুঞ্জ? আমাদের গ্রামের ধাইমা চঞ্চরীকে দিয়েই তো বাচ্চাটা নষ্ট করে দিতে পারতে।

-তোমার সন্তানকে আমি মারব, চয়ন? দেহে প্রাণ থাকতে? এই সময় উচ্চতরালে কখনো পুরুষ কষ্ঠে, কখনো নারীকন্ঠে কান্না জুড়লেন বাবা লাহোরি। চোখের জলে গোটা বুক ভেসে গেল নন্দনদেবের।

বাবা লাহোরি ফের কথায় ফিরে এলেন—চয়ন দেখে হারেমের শান, তার ঠাটবাট, প্রাচুর্য, রূপের হাট। কিন্তু মন পড়ে থাকে সিলেটের সেই সবুজ খেতে। সারারাত জেগে খিদমদগারি আর পাহারাদারি করে দিনেরবেলাটায় সে একটু ঘুমিয়ে নেয়। সুযোগ হলে ওর বাঁশিটাও একটু বাজিয়ে নেয়। সেজন্য মেয়েদের কাছে খুব কদর ওর; জেবউন্নিসা, নসরিন, রসিলাবাইরা তো সুযোগ পেলেই ওর গালে চুমো দিয়ে দিচ্ছে, গায়ে গা ঘষে দিচ্ছে, আর রাতেরবেলা গান শোনাতে ডাকছে। কিন্তু ওর পুরুষের কাজের অঙ্গটা নষ্ট করে দিয়েছে বলে নয়, ওর মন থেকেই কোনো সাড় নেই এইসব হিজিবিজি খেলাধুলোয়। ওর শুধু প্রাণে সাড়া দেয় যে-রাতে কাহিনিকার বুড়ো বাবা লাহোরি হারেমে আসেন গল্প শোনাতে। আহাহা! কী কথা! কী ব্যথা! কী চোখের জল বয় তখন হারেম জুড়ে! আর তখনই মেয়েদের সত্যিকারের চোখের জল দেখতে পায় চয়ন। কোনো কোনো মেয়ে তখন নিজেদের প্রেমের গল্প শোনানো শুরু করে বাবাকে। বাবা লাহোরি খাঁটি জহুরির মতো তখন সেইসব মণিমুক্তো কুড়োতে থাকেন তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে। আর চয়নেরও বড়ো প্রাণ উশখুশ করে নিজের জীবনের প্রেমের কাহিনি শুনিয়ে দেয় রাতের কাহিনিকারকে।

এইভাবে দিন কাটে চয়নের, হারেমের মেয়েরা ঠাট্টা করে ডাকে ওকে জিব্রিল বলে, যে ফরিশতার পাখনায় কখনো পাপের ছায়া পড়ে না। আর ওদিকে বাপ পরীক্ষিৎচন্দ্রের নিষেধ অমান্য করে কুঞ্জরানি জন্ম দেয় এক অপরূপ পুত্রের, যার মুখ হুবহু তার বাপের মতো। তুই জানিস নন্দন, তোকে দেখেই আমি তোর পেহচান পেয়ে গিয়েছিলাম। তোর চোখ মুখ কপাল চুল বিলকুল চয়নের আদলে, আর তোর নীল চোখ তোর মায়ের। তোকে জন্ম দেবে বলে তোর ঠাকুরমার বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিল কুঞ্জ, আর তোর জন্মের পর সমাজে বেইজ্জতির কথা ভেবে সেঁকো বিষ খেয়েছিল পরীক্ষিৎ।

—কুঞ্জ, যদি তুমি এলেই তা হলে এত দেরিতে কেন?

–তোমার ছেলেকে একটু বড়ো করে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম, চয়ন।

—হায় রে, দিল্লির পথকে তুমি রাস্তা বলছ? এ তো নরকের সড়ক।

—কিন্তু আমার মনে হল আমি স্বর্গের দিকে হাঁটছি…।

সিলহট থেকে দিল্লি সত্যিই বড়ো দূর। যত রাস্তা তত মানুষ আর তত শয়তান। যে-ই রাতে একটু শোওয়ার জায়গা দিয়েছে কুঞ্জকে সে-ই ওর শরীর লুটেছে। যে নৌকা, বয়েল গাড়ি কি এক্কায় চড়িয়ে এগিয়ে দিয়েছে সে-ও। যে পথ বাতলেছে সে-ও। শেষে যে ওকে ইলাহাবাদের রাস্তায় জ্বরে কাতরাতে দেখল সে-ও প্রথমে জ্বরের ইলাজ করল, তারপর নিজের পিয়াস মেটাল, তারপর এনে তুলে দিল দিল্লির কোঠাওয়ালি সুরৈয়ার আখড়ায়।

—কিন্তু জানো, চয়ন, আমার কোনো কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, লজ্জাও নেই, কারণ এই সবকিছুই আমি তোমাকে পাওয়ার মূল্য ভেবেছি। শংকরদেব শুনেছি বলেছিলেন, যাকে খুব চাওয়া যায় তার জন্য অনেক দিতে হয়।

—কিন্তু কী পেলে শেষে, কুঞ্জ? একটা ক্ষত হওয়া শরীর।

—কিন্তু একটা অক্ষত মন।

হারেমের জীবনে কত সুন্দরী দেখা হল চয়নের। কিন্তু ওই পর্যন্ত। অথচ হঠাৎ করে হারেমের নতুন এক আমদানির দিকে থেকে থেকেই চোখ সরে গেল। তাও মুখ বা শরীরের দিকে নয়, সারাশরীর বোরখায় মোড়া মেয়েটার ছোট্ট ছোট্ট, ফর্সা দুটি পায়ের পাতার দিকে। এরকম একজোড়া পায়ের পাতা ওর মগজে ভর করে আছে কতকাল। সিলহটের মেয়েদের এরকম নরম তুলতুলে পা হয়।

তারপর একদিন বোরখার জালের পিছনে একজোড়া নীল চোখও চোখে পড়ল চয়নের। বুকের মধ্যে ওর তখন পাহাড় ভাঙছে। হে কৃষ্ণ! হে শংকর! হে অবতার শংকরদেব! জীবনভর তোমাদের কীর্তন গেয়ে এই তার পুরস্কার। শেষে যে-হারেমের প্রহরী হলাম সেই হারেমে জব্দ করলে কুঞ্জকে!

চয়ন শীতের রোদে বহুক্ষণ চেয়ে ছিল বোরখাওয়ালির চোখের দিকে। সেই চাহনিতে কি পিপাসা ছিল? অন্তত কুঞ্জর তাই মনে হয়েছিল। কাজেই সেই রাতের বেলায় সারাহারেম যখন বহুদিন পর ফের বাবা লাহোরির কিসসা শুনছে কুঞ্জ পা টিপে টিপে চলে এল চয়নের ঘরে। মাঝখানে এক জায়গায় পাহারায় ছিল খোজা বিল্লা, সে হাঁক দিল, কৌন চলে রাতকো ওয়ক্ত! কুঞ্জ বোরখার অন্ধকার থেকে জবাব ছুঁড়ল হারেমের অন্ধকারে, ম্যাঁয় দিলারা। কহানি শুননে কো চলা। বিল্লা জিজ্ঞেস করল, তো উস তরফ কিউ? কুঞ্জ জবাব দিল, ফৈজুকো বুলানেকো। বিচারি নিদ পড়ি। বিল্লা বোঝার ভান করে বলল, হ্যাঁ।

বানানো কথা যে এভাবে সত্যি হয় তা জন্মেও ভাবতে পারত না কুঞ্জ। চয়নের ঘরে ঢুকে বোরখার পরদা তুলে ডাকল যখন ‘চয়ন। চয়ন। বলে, শুয়ে থাকা মানুষটা চোখও মেলল না। অন্ধকারে চয়নের ঠোঁটে একটু চুমু দিতেই চমকে উঠল কুঞ্জ। পাথরের মতো ঠাণ্ডা ঠোঁট লোকটার। অথচ গায়ে কোনো গরম চাদরও নেই।

কুঞ্জ পাথর ঘষে মোম জ্বালিয়ে দেখল উলঙ্গ হয়ে শুয়ে থাকা চয়নের শরীর থেকে প্রাণ যায়-যায়। কুঞ্জর চোখে পড়ল স্বামীর খোজা করা পুরুষাঙ্গের দিকে। একটা প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বামীর নিথর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুঞ্জ।

—কুঞ্জ, আমি তো মরেই ছিলাম। আমায় বাঁচাতে গেলে কেন?

–একসঙ্গে মরব বলে।

–তুমি পারলে আমার মরা শরীর বয়ে নিয়ে যমুনায় যেতে?

—বিল্লা সাহায্য করল।

—বিল্লা! ওই কুৎসিত, কদাকার জন্তুটা?

–ওকে কেউ কোনোদিন একটা মিষ্টি কথাও বলে না। আমি অন্ধকারে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিলাম, আদর দিলাম। তারপর গদগদ সুরে বললাম, বিল্লা, চয়নকে আমি আফিম খাইয়ে মেরে ফেলেছি। ভোর হলেই হইচই হবে। তুই, আমার পিয়ারে বিল্লা, ওর মড়াটা নিয়ে জলে ফেলে দে। তারপর তোকে আমি আরও অনেক আদর দেব।

-তারপর?

—বিল্লা তোমাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে যেই পাশে চাইল, দেখল আমিও তোমার সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি যমুনায়।

তোর বাপ আর মাকে পরদিন সকালে খুঁজে পেলাম এই পাড়ে। মরবে বলে বহুত আফিম খেয়েছিল চয়ন, কিন্তু ঢেউয়ের চোটে বেঁচে গেল। বেঁচে গেল কুঞ্জও। কিন্তু তার পরেও ওরা বাঁচতে চাইল না, একসঙ্গে মরবে বলে। তবে ওই তিনদিন আর তিন রাতে আমার ঝোলাতে রেখে গেল ওদেরই বুকের কিসসা। যা শুনে জাহাঙ্গির বাদশারও চোখে আঁসু এল।

নন্দন উঠে গিয়ে ফের প্রণাম করল বাবা লাহোরিকে। গল্পে গল্পে তখন শীতের সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে, দুজনের কারও খেয়াল নেই। বাবা লাহোরি বললেন, বেটা, চল আমার বস্তিতে। একটু নাহিয়ে নিয়ে কিছু পাক করে খেয়ে নিই।

নন্দন আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু, হুজুর, আমার হারেমে কিছু খাবার আছে। একবার ফিরে যেতেও তো হয়। সারারাত বাইরে বাইরে।

বাবা লাহোরি গম্ভীর গলায় হুকুম করলেন, তুই আর কখনো হারেমে ফিরবি না। আমারও কিছু জমা রুপৈয়া আছে। তোর মালিকের কাছ থেকে তোর আজাদি আমি কিনে নেব। আর তোকে আমার একমাত্র শাগির্দ করে রেখে যাব। তুই হবি দুনিয়ার সেরা রাতকে-কিসসা গাওয়াইয়া। আমার উমর একশো; তোর জন্য আমি আরও দশ সাল বাঁচব।

৪.

দশ বছর পর বাবা লাহোরি দেহত্যাগ করলে তাঁর একমাত্র শাগিদ ফকির রাজা গল্প শোনানো শুরু করেন। তিনি উর্দু, ফারসি, আরবি, হিন্দি, বাংলা ও সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন। সারাজীবনে তিন হাজার প্রেমের গল্প শুনিয়েছিলেন মানুষকে। তাদের একটি কাহিনি খুররম ও আর্জুমন্দ বানুর প্রেমকাহিনি। ইতিহাসে যাঁদের প্রখ্যাতি শাহজাহান ও মুমতাজ মহল নামে। বাদশাহ আলমগির ১৬৮০ সাল থেকে গানের চর্চা নিষেধ করলে ফকির রাজার রাতের কাহিনিগায়ন বন্ধ হয়। মনের দুঃখে তিনি যমুনায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

*In Bengal the peasants usually paid the revenue in cash, and cropsharing was but rarely practised. Jahangir declares, however, that in Silhat (Sylhet), the peasants used to offer their children as eunuchs in satisfaction of their revenue demand in view of the great market for them that the harems of the aristocrats provided they were doubtless as good as money for the revenue collectors.

**Jahangir says he prohibited this practice but it is unlikely to have been eradicated

–The Agarian System of Mughal India 1556-1707: Irfan Habib (p. 279).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *