মরূদ্যান

মরূদ্যান

হাজরাদের বাড়ি বীণা বেড়াইতে গিয়াছে। পাড়ার অন্য দুই একটা বাসা খুঁজিয়া সেখানে রণু গিয়া তাহাকে পাইল। বীণা আরও কয়েকজন মেয়ে ও বধূর সঙ্গে বসিয়া গল্প করিতেছিল।

রণু ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়া ডাক দিল, বীণা দি, শুনে যান তো।

বীণা বলিল, ওখান থেকেই বলো।

হাজরাদের বন্ধু কনক হাসিয়া বলিল, ও, রণজিতের বীণাদি বুঝি এসেছে এখানে? নইলে কোনোদিন যে ভুলেও এ বাড়িতে পা দেয় না, সে আজ এল! বীণাদির সাথে কী কথা আছে আমরা শুনতে পারব রণু?

একটা মৃদু হাস্যতরঙ্গ খেলিয়া গেল।

রণু লজ্জায় মাথাটা ঈষৎ কাৎ করিয়া বলিল আপনি কি যে বলেন বউদি। হ্যাঁ বীণাদি, শিগগির, গোটাকতক কথা রণুর সকলের সঙ্গেই থাকে।

কনক বলল, তুমি তো এবার আই-এ দিচ্ছ, টেষ্ট কবে? এসে পড়েছে নিশ্চয়ই–

রণু মাথা নাড়িল।

-তাই তো শেষ রাতে অত পড়ার শব্দ শুনতে পাই। আহা, অত পড়লে শরীর যে খারাপ হয়ে যাবে। তোমার বীণাদি তোমাকে মানা করে না এজন্যে?

বীণা আর রণুর দিকে সকলে চাহিয়া আবার হাসিল। রণুর অবস্থা দেখিয়া বীণা তাড়াতাড়ি খাট হইতে নামিয়া আসিল। সিঁড়ি বাহিয়া নামিতে নামিতে সে জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে?

রণু বলিল, ওই যে কারা দেখতে আসবে বলেছিল ওরাই তো এসে বসে রয়েছে। বড়দা তো রাগে সারা বাড়ি মাথায় করে তুলেছেন। সে ভীত দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিল।

বীণা হঠাৎ একটু উষ্ণ হইয়া বলিল, রাগ করেছে বড়ো বয়ে গেছে আমার। বলতে পারো, রোজ রোজ আমাকে এরকম সং সাজাবার মানেটা কী? রণু যেন নিজেকেই অপরাধী মনে করিল।

বাসায় আসিয়া বীণা সরাসরি তাহার মা কাদম্বিনীর ঘরে চলিয়া গেল। কাদম্বিনী বলিলেন, কোথায় গিয়েছিলি বলতো? তোকে তো আগে বলা-ই হয়েছিল, আজ ওরা দেখতে আসবে। নে, আর দেরি নয়, কাপড় বদলিয়ে আয়। ওরা আবার বসে রয়েছে।

বীণা জানালার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। কাদম্বিনী আবার কী বলিতে যাইবেন এমন সময় বড়দা আসিয়া ঘরে ঢুকিলেন। বীণাকে তেমনভাবে দেখিয়া রাগিয়া বলিলেন, এই যে, কোত্থেকে বেড়িয়ে আসা হল, শুনি? গুণবতী বোন আমার, সারাদিন কেবল মানুষের বাসায় ঘুরে বেড়ানো। আমি ভাবি যাদের বাসায় ও যায়, তারা কী মনে করে।

বীণা তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল।

বড়দা বলিলেন, যান এখন রুজ পাউডার কতগুলো ধ্বংস করে আসুন গে। আর এই যে—তিনি রণুকে সম্মুখে দেখিয়া আরও ক্ষেপিয়া গেলেন,—আর একজনকে পাঠিয়েছিডেকে আনতে, তারও কোনো খোঁজখবর নেই। বুঝলে মা, এমন মেয়ে-ঘেঁষা ছেলে আমি আর কখনো দেখিনি।

মাথা নত করিয়া রণু দাঁড়াইয়া রহিল। সে এ-বাড়ির ছেলে নয়, জ্ঞাতি সম্বন্ধে একটু আত্মীয়তা আছে। খুব গরিব, এখানে থাকিয়া পড়ে।

এ বাড়ির সকলেই বড়দাকে বাঘের মতো ভয় করে। তিনি যাহা একবার মুখ দিয়া বলেন তাহা করিয়া তবে ছাড়েন। তাহাতে যদি সংসারে কোনো ওলটপালট হইয়াও যায় কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।

বড়দা কাদম্বিনীকে বলিলেন, দ্যাখো মা, লেখাপড়া জানলে অন্য সব গুণও আপনি হয়ে যায়। এ এমনই জিনিস। ওই তো, সেবার শিলং-এ গিয়ে ওঁরই সম্পর্কে এক মাসতুতো বোনকে দেখলাম। কী সুন্দর, আর কত গুণ! নিজেদের কথা মনে হলে রীতিমতো লজ্জা করে।

বীণা এবার রাগিয়া গেল। কোনোদিন সে বড়দার মুখের উপর কথা বলে না। কিন্তু আজ বলিল, আচ্ছা আমি কি নিজে থেকেই পড়লাম না, না তোমরাই আমাকে পড়ালে না—কোনটা সত্যি? আমি বলে রাখছি আমাকে এরকম করে জ্বালালে আমি কিছুতেই এ বাড়িতে থাকব না। আজ বাবা থাকলে নিশ্চয়ই এরকম কথা তোমরা আমায় বলতে পারতে না। রূপ কি সকলের থাকে? তাই বলে— বীণা আর বলিতে পারিল না—কান্না চাপিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল।

ছেলের উপর কথা বলিবার শক্তি কাদম্বিনীর ছিল না। তিনি হতভম্বের মতো বসিয়া রহিলেন। বড়দার সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল রণুর উপরে। তিনি একরকম চেঁচাইয়া বলিলেন, এখানে হাঁ করে কী দেখছ? যে ভদ্রলোকগুলি আমাদের মতো লোকের বাড়িতে কৃতার্থ হয়ে এসেছেন তাদের বিদায় করগে যাও। যত সব— আমার এখানে কারোর জায়গা হবে না বলে দিলাম। আরে বাপু, গরিবের ছেলে লেখাপড়া ছাড়া অন্যদিকে মন গেলে যে বাপের রক্তজল করা পয়সার মর্যাদা থাকবে না।

সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। এইরকম ঝড়ঝঞা এ সংসারে প্রায়ই আসে, নতুন কিছু নয়।

রাত্রে বড়দা ঘুমাইলে পর কিছুটা শান্ত হইল। মোটা, ঘুমকাতুরে মানুষ, অল্প রাত্রেই গভীরভাবে ঘুমাইয়া পড়েন।

সেদিনের জন্য পড়া রাখিয়া রণু উপরে বড়দার নাক ডাকার বিকট শব্দ শুনিয়া নির্ভয়ে বীণাকে খুঁজিতে গেল। তাহার শুইবার ঘরে তাহাকে পাওয়া গেল না। রণু কাদম্বিনীর কাছে গিয়া দেখিল, সেখানেও বীণাদি নাই। সে চুপি চুপি সিঁড়ি বাহিয়া ছাদের উপর গেল।

চিলেকোঠার পূর্বদিকে আলিসায় ভয় দিয়া বীণা দাঁড়াইয়াছিল। জ্যোৎস্নাময় রাত্রি, চাঁদের আলো তাহার কাপড়ে পড়িয়া ফুটফুট করিতেছিল। পাশেই ছাদ আর আলিসায় তাহারই ছায়া দীর্ঘতর হইয়া লাগালাগি দাঁড়াইয়া আছে।

রণু আস্তে ডাক দিল, বীণাদি!

বীণা প্রথমে চমকিয়া উঠিল, মুখ ফিরাইয়া তাহার দিকে চাহিয়া আবার আগের মতো দাঁড়াইয়া বলিল, কেন?

কাছে আসিয়া রণু কহিল, খেয়েছেন? বীণা চুপ করিয়া রহিল।

চলুন তাহলে, বড়দা ঘুমিয়েছে, আমিও খাইনি। জ্যাঠাইমা তো আপনাকে খুঁজছে।

বীণা এবার একটু হাসিল, বলিল, তুমি যাও রণু। পড়া হয়েছে? পরীক্ষা কবে না বলেছিলে?

খুশি হইয়া রণু বলিল, এই কালকে এক সোমবার, তার পরের সোমবার আমাদের পরীক্ষা আরম্ভ হবে। আমার কিছু পড়া তৈরি হয় নি, কী যে করব ভেবে পাইনে। তার ওপর প্রিন্সিপাল নাকি এবার বলেছেন, খুব কষে ছাত্র পাস করাবেন।

কারণ, গতবার অনেকে ফাইন্যাল পরীক্ষায় ফেল করেছিল। বড়ো ভয় করছে তাই–

রণু মুখের এমন ভঙ্গি করিল, যেন এখনই সে ফেল করিয়াছে!

করুণ চোখে রণু বলিল, কী হবে? আর পড়া হবে না, বাবা কষ্ট পাবেন, আর বড়দার মনেও আঘাত লাগবে, তাঁর বাড়িতে থেকে পড়লুম, পাস করতে পারলুম না। তখন কী যে হবে আমার ভাবতে ভয় করে। বীণা হাসিয়া বলিল, ওরে বাবা, এতেই ভয় পেয়ে গেলে? সত্যিই কি তাই হয়ে গেল নাকি? তুমি কখনো ফেল করবে না; আমি বলছি। তা যাক। আচ্ছা রণু, তুমি পাস করে তারপর কী করবে, চাকরি? তা জানি না। তবে পাটনায় আমার এক কাকা থাকেন, ভালো অবস্থা, তার ওখানে যাব।

বীণা একটু অন্যমনস্কভাবে আকাশের জ্যোৎস্নাবর্ষী খন্ড চাঁদের দিকে চাহিল, তারপর রণুর পানে স্থিরভাবে তাকাইয়া বলিল, আমার টাকা থাকলে তোমাকে আমি পড়াতাম।

রণু চুপ করিয়া রহিল, কিছুক্ষণ পরে কহিল, আমার ভাই-বোন কেউ নেই বীণাদি। কাজেই তাদের স্নেহ থেকে আমি বঞ্চিত। কিন্তু আপনাকে আমার বড়ো মনে পড়বে, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন—

হাসিয়া বীণা বলিল, কি বললে শুনি!

হঠাৎ ভয়ানক লজ্জা পাইয়া কী বলব আবার—আমি কিছুই বলিনি তো, বলিয়া তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেল।

রণুর পাশের ঘরেই বীণা তাহার ছোটো বোন লীলা আর বড়দার ছোটো মেয়ে গীতার সঙ্গে শশায়। খুব সকালে ওঠা তাহার চিরকালের অভ্যাস।

তা ছাড়া শীতকালের রাত্রি দীর্ঘ বলিয়া অনেক আগেই ঘুম ভাঙিয়া যায়। একবার ঘুম ভাঙিয়া গেলে আর সহজে সে ঘুমাইতে পারে না। তাই কখনও লীলা বা গীতাকে জাগাইয়া গল্প করে, নয়তো পাশের ঘরে তাহার মামাকে ডাকিয়া পদ্মানদীর কাহিনি শোনে।

রণুর পরীক্ষার আগের দিন শেষ রাত্রেও বীণা জাগিয়া শুনিতে পাইল, দেয়ালের বড়ো ঘড়িতে চারটা বাজিয়াছে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়িয়া রণু টেবিলের ছোটো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়া রাখিয়াছিল সাড়ে তিনটায়, কিন্তু তখনও সে ওঠে নাই, বোধহয় গভীর ঘুমে অ্যালার্মের শব্দ শুনিতে পায় নাই।

বীণা আস্তে আস্তে তাহার ঘরে গেল। টেবিলের উপর বাতিটার আলো বাড়াইয়া রণুর বিছানার কাছে গিয়া ডাক দিল, রণু, অ রণু–

কয়েক ডাকের পর সে চোখ বুজিয়াই সাড়া দিল, কেন?

–চারটে যে বেজে গেছে, পড়বে বলেছিলে না?

—হুঁ! কিন্তু উঠিবার কোনো লক্ষণই তাহার দেখা গেল না। বেশি রাত্রে ঘুমাইয়া চোখ হইতে ঘুম ছুটিতে চায় না সহজে।

–আমি তো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি।

—হুঁ, দেখবে চলো, গম্ভীরভাবে বীণা রণুকে উঠাইয়া ঘড়ির সামনে আলো ধরিয়া দেখাইল। আশ্চর্য হইয়া রণু তাহার দিকে চাহিল।

বীণা বলিল, আশ্চর্য হবার কছু নেই। ওটা বেজে গেছে, কিন্তু আমাদের ঘুমকাতুরে রণুর কানে সেটা যায়নি। ভাগ্যিস আমি উঠে ডাক দিয়েছিলাম, নইলে যে কী হত!

চেয়ারে বসিয়া রণু বলিল, খুব খারাপ হত। বলিল, জুলিয়াস সীজারের কতখানি এখনও না-পড়া রয়ে গেছে। সেগুলি সারতে হবে। আবার সমস্ত পড়া রিভাইস করতে হবে, সময়ের দরকার অনেক। আমি কখন ঘুম থেকে উঠতাম কে জানে; শুতে যে রাত হয়ে গিয়েছিল!

—আমি যাই, তুমি পড়ো। বীণা চলিয়া গেল। পড়িতে পড়িতে রণুর ভোর। হইল, তারপর বেলা আটটাও বাজিয়া গেল।

বড়দা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, একটা কাজ করবে? এই যে চিঠিটা, নরেন মজুমদারের বাসা চেনো তো, সেই যে ফর্সা লম্বা লোকটা, আমার এখানে প্রায়ই আসে, ওঁকে এই চিঠিটা দেবে। তিনি তখনই এর উত্তর দিয়ে দেবেন। তুমি সঙ্গে করে তা নিয়ে আসবে। খুব জরুরি কিন্তু, বুঝলে! আর তাঁর বাসাটা কোথায়; দাঁড়াও, দাঁড়াও বলে দি তোমাকে, ইয়ে—

রণু করুণভাবে বড়দার দিকে চাহিল, এখন সে যায় কেমন করিয়া! সামনে দাঁড়াইয়া বীণা সব দেখিতেছিল। সে বলিল,-ওর কি না গেলে চলে বড়দা? পড়ার ক্ষতি হবে যে! কেন, ছোড়দা যাক না। ডেকে দেব?

ছোড়দা কিছু করে না, বসিয়া থাকে। ভোরবেলা এক কাপ চা খাইয়া সে কোথায় বাহির হইয়া গিয়াছে।

বড়দা কহিলেন, অজিত তো নেই বাসায়। কেন, ওই যাক না, এখন আর পড়ে কী হবে?

বীণা কহিল, না ওর যেয়ে কাজ নেই। অন্য কেউ যাক। বড়দা মনে মনে রাগিতেছিলেন। এই বোনটিকে আসলে তিনি কিছু ভয় করিতেন। কিন্তু বাহিরে সহজে প্রকাশ করিতেন না। ইহা তাঁহার স্বভাব নয়। নিজের কতৃত্বের অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না।

তবে এ ব্যাপারে এবার তিনি আর বেশি কিছু বলিলেন না। গম্ভীরভাবে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেলেন।

বীণা বলিল, তুমি কি রণু ! মুখ ফুটে কিছু বলতে পারো না? পরের বাড়িতে থাকো বলে কি সব কাজই করতে হবে নাকি? বড়দাকে দোষ দেওয়া যায় না। ওঁর ওটা স্বভাব। কিন্তু তাই বলে তোমার নিজস্ব কিছু নেই নাকি? ঘড়ির দিকে চাহিয়া সে বলিল, এখন আটটা বেজে পনেরো মিনিট হয়েছে। ঠিক সাড়ে নয়টার সময় স্নান করতে যেয়ো, বুঝলে? আমি মাকে গিয়ে বলছি।

বীণা চলিয়া গেল।

রণুর টেস্ট শেষ হইয়া গেল। নতুন উদ্যমে আবার সে ফাইন্যালের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল। পড়া আর পড়া—রণুর যেন ইহা ছাড়া আর কিছুই করিবার নাই।

একদিন ঘরে ঢুকিয়া বীণা বলিল, মা, রণুর জ্বর হয়েছে। আশ্চর্য হইয়া কাদম্বিনী কহিলেন, জ্বর হয়েছে? এই পরীক্ষার সময় আবার জ্বর হল? ও কী করছে এখন?

–দিলীপের সাথে ব্যাগাঠেলী খেলছে।

–ওকে শুয়ে থাকতে বলগে, আমি আসছি।

পরের দিন রণুর জ্বর কমিল না। না কমিলেও তত কাতর হইল না। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গল্প করিয়া খেলিয়া সেদিন তাহার কাটিল। কিন্তু তৃতীয় দিন বৈকালে জ্বর অত্যন্ত বাড়িয়া গেল। রণু মাথার বেদনায় কথা বলিতে না পারিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল।

বীণা আগে ইহা লক্ষ করে নাই। সন্ধ্যাবেলা তাহার কপালে হাত দিয়া দেখে যে, শরীরের উত্তাপ ভয়ানক বাড়িয়াছে। চোখ দুটি ঈষৎ লাল আর ফুলিয়া গিয়াছে। সে ভীতস্বরে ডাকিল, রণু?

—কী?

—মাথাটা ধুইয়ে দিই, কেমন?

রণু বীণার দিকে পাশ ফিরিয়া বলিল, বীণাদি, একটা কথা বলি। আমাকে হাসপাতালে যাবার ব্যবস্থা করে দিন। বাসায় এত লোকজন, একজনকে দেখতে হলে আর একজনের পাশে তাকানো চলে না। কেন মিছিমিছি আপনারা কষ্ট করবেন? এখনও আমি উঠে যেতে পারি, পরে হয়তো পারব না। আপনি ব্যবস্থা করুন।

বীণা তাহার কপালে, চোখের পাতায়, মুখে হাত বুলাইয়া বলিল, কি বাজে বকছো রণু! আমি জল নিয়ে আসি, দাঁড়াও।

ডাক্তার আনানো হইল, তিনি ওষুধের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন। অনেক রাত্রি অবধি তাহাকে বাতাস করিয়া বীণা গিয়া শুইল। পরের দিন একরকম রহিল। রণু ঠিকই বলিয়াছিল। এত লোকদের মধ্যে শুধু অসুবিধা সৃষ্টি করা।

কাদম্বিনী বীণাকে একান্তে কহিলেন, ওর বাবাকে খবর দেব? কী বলিস?

বীণা বলিল, না, না, দরকার নেই। অসুখ এমন বেশি কী হয়েছে যে কাকাকে খবর না দিলে চলবে না! আজ যদি আমাদের কারোর এরকম হত তবে কী করতে?

-না, তা বলছি না। এই পরীক্ষার সময়, যদি খারাপ কিছু হয়ে দাঁড়ায় দোষের ভাগী হব আমরা। খারাপ কিছুই হইল না। পরের দিনই জ্বর কমিয়া গেল। রণু হাসিয়া কথা কহিল। কাদম্বিনী যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। অসুখ সারিবার পরে একদিন রাত্রে বিছানায় শুইয়া হঠাৎ রণুর কী যেন মনে পড়িয়া গেল। সারা অসুখের সময় কাহার যেন স্নেহের পরশ, তাহার দুঃখ-কষ্টের জন্য সচেতন অভিব্যক্তি, কোনোদিন অনুভব করিয়াছিল, দেখিয়াছিল, নদীর পাশে শুষ্ক বালুচরে সপ্তমীর চাঁদের অস্পষ্ট জ্যোৎস্নার মতো কায়া লইয়া সে দাঁড়াইয়া। রণু হঠাৎ বসিয়া কি জানি কাহার উদ্দেশ্যে জোড় করিয়া নমস্কার করিল। সে লক্ষ করে নাই। ঘরে আছেন সেই মামা, দেখিয়া ফেলিলেন সব। রণু লজ্জা পাইল। মামা হাসিয়া বলিলেন—পরীক্ষা কাছে এলেই বুঝি অদৃশ্য দেবতার উপর দৃষ্টি পড়ে। কী বল রণু?

এ প্রসঙ্গ চাপা দিবার জন্য রণু বলিল, আপনাদের কয়টি বাড়ি পদ্মা নিয়েছে মামা? কেউ মরেনি তাতে? মুচকি হাসিয়া তিনি বলিলেন, কেউ মরেনি।

এক একটা কাজ রণু করিয়া বসে, পরে ভাবিলে হাসি পায়। একবার তাহার দুঃখ আর দারিদ্র্যের কথা বীণাদিকে বলিতে যাইয়া তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া কান্না আসে আর কি!

তবে সেদিনের কথা সত্যিই বড় মনে পড়ে। রাত্রির পৃথিবীতে সকলের অলক্ষ্যে এক অবহেলিত আত্মার কাছে দুহাত পাতিয়া সে আশীর্বাদ গ্রহণ করিয়াছে। সেদিন চারিদিকে নিস্তব্ধতায় আর দুঃখের কথায় চোখের জল আসিয়া পড়িয়াছিল, তাহা সত্যি।

রণুর পরীক্ষা হইয়া গেল অর্থাৎ এদিকের সব মিটিয়া গেল।

ফল বাহির হইতে তখনও অনেক বাকি। রণু বাড়ি যাওয়া ঠিক করিয়া ফেলিল। ফেলই হউক আর পাশই হউক এরপরে আর পড়া তাহার কোনো রকমেই হইতে পারে না। তা ছাড়া, বড়দাও তাহার খরচ বাড়তির জন্য তাহাকে এখানে রাখিতে চাহিবেন না।

কাদম্বিনী সৌজন্যের খাতিরে বলিলেন, ফলটা বেরুলে পর গেলে হত না!

—দরকার নেই জ্যাঠাইমা, রণু হাসিয়া বলিল, আমি পাস করবো।

কাদম্বিনী খুশি হইয়া বলিলেন, নিশ্চয়ই করবি। তুই কি আমাদের অজিত, বাবা, যে বছর বছর শুধু টাকা খরচ করতে হবে?

রণু বলিল, আচ্ছা জ্যাঠাইমা, জিতু বলে একটি ছেলে যে এসেছিল এখানে ও ই যে আপনার মাসতুতো না পিসতুতো ভাই-এর ছেলে, ও বুঝি বিলেত যাবে?

—যাবে না তো কি? মস্ত বড়োলোক ওরা, তার ওপর ছেলেটাকে দেখেছিস। তো, কেমন মুখের ওপর একটা বুদ্ধির দীপ্তি। অনেকটা তোর মতো …তোরও ওরকম হতো কেবল পয়সার জোর নেই বলে।

আশ্চর্য হইয়া রণু বলিল, কী বলেন জ্যাঠাইমা? আমার হতো না, কখনো হতো না, বড়দাই বলেছে যে…

হাসিয়া কাদম্বিনী বলিলেন, কী বলেছে?

নিজেকে নিজে বকব? রণু হাসিয়া ফেলিল। কাদম্বিনীও হাসিলেন।

আশ্চর্য বটে। যাইবার সময় বীণাকে বাড়িশুদ্ধ খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। বেলা তিনটায় ট্রেন। একবার দেখা হইয়াছিল, কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্য।

রণু কাদম্বিনীর কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বীণাদিকে খুঁজে পাচ্ছি না জ্যাঠাইমা। গাড়ির সময় হয়ে এসেছে যে!

দ্যাখ পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছেন বুঝি?

সেই হাজরাদের বাসায় বীণাকে পাওয়া গেল। সে কনকের সাথে বসিয়া গল্প করিতেছিল।

আগেই কনক হাসিয়া বলিলেন, রণু কেন আমাদের বাসায় এসেছে আমি তা জানি।

আপনার সব সময়ই ঠাট্টা বউদি, রণু বলিল।

আমার কী দোষ ভাই? বীণা তো এতক্ষণ তোমার কথাই বলছিল। তোমার পরীক্ষা হয়ে গেছে, ফল বেরোয়নি কিন্তু তার আগেই তুমি চলে যাবে, তোমার নাকি পড়বার ইচ্ছা ভয়ানক, তা হলে কী হবে? বীণা বলে যে চায় সে পায় না। তা ছাড়া আরও কত কী?…তোমার মতো ছেলে খুব কম দেখা যায় কনক হাসিয়া ভাঙিয়া পড়িলেন। আর চোখে জল ভরিয়া আসিল রণুর। কোনোদিন তাহার এ দুর্বলতা দেখা দেয় নাই, আজ কি জানি কেন দিল। সে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চাহিয়া বলিল, বীণাদি চলুন শীগগির।

বাসায় আসিয়া রণু কী যে বলিবে খুঁজিয়া পাইল না। বীণা প্রথমে কহিল,

যেখানেই থাকি না কেন তোমাকে আমি মনে করবো ভাই।

তা জানি বীণাদি। আমিও আপনাকে কোনোদিন ভুলবো না। রণু আর বলিতে পারিল না।

তারপর গলি শেষ হইবার আগে রণু একবার পিছনপানে তাকাইয়া দেখিল সকলেই তাহার দিকে চাহিয়া আছে, নাই কেবল বীণা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *