অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন

অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন

সতীশ ওঠেনি, শিবু ওঠেনি, মনুর মা ওঠেনি, এমনকী সূর্যও আকাশে দেখা দেয়নি, তার শুধু আলো পৌঁছেছে পৃথিবীতে।

কিন্তু শ্রীবিলাস উঠেছে।

বিছানা থেকে উঠেই প্রথমে খুঁজল লাঠি,—এটা ছাড়া সে চলতে পারে না, তার অন্ধত্বকে সে কতকটা উপহাস করে ওই লাঠির সাহায্য নিয়ে। ওই লাঠি তার মস্ত বড়ো সাথি। খুঁজতে খুঁজতে সাথিকে সে খুঁজে পেলোও, তার ডগাটি একবার ডানপাশে, একবার বাঁ-পাশে ফেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল এবং আন্দাজে দিক ঠিক করে করযোড়ে সূর্যকে প্রণাম করল।

ঘরের ভিতর তার স্ত্রী বিন্দু দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে, ভোরের বাতাসের ছোঁয়ায় বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।

লাঠিটা একপাশে রেখে শ্রীবিলাস দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসে পড়ল। একটু বসে থেকে ডাকতে লাগল, ও বউ, বউ? ওরে কেলো, ওরে হেবো, ওঠ বাবা ওঠ, আর কত ঘুমুবি বল, রোদুর উঠে গেছে যে, ও মা সদু–

অনেক ডাকাডাকিতে বিন্দুর ঘুম ভাঙল, বললে, রাত না পোয়াতে কী আরম্ভ করেছ শুনি?

শ্রীবিলাস বললে, এখনও কি তোমার রাত রয়েছে? কত লোক উঠে গেছে। আমি কতক্ষণ ধরে উঠে বসে আছি।

ছেলেপিলেগুলো ওঠেনি, বিন্দু বাইরে এসে ধপ করে মেঝের উপর বসে চোখ রগড়াল, গা মোড়ামুড়ি দিল, হাই তুলল, তারপর স্থির হয়ে বলল, এই তো এখন উঠলে, আমি বুঝি দেখিনি? কত লোক উঠেছে। একটিকেও তো দেখছিনে বাপু!

—তাতে কী হয়েছে, সকলে পাগল হলে কি তুমিও পাগল হবে বউ?

বিন্দু কি একটা কাজে ভেতরে গেল, যেতে যেতে বললে, আমি বলছি, কেন মিথ্যে কথা? সারারাত যে গরম গেছে, ঘুম একরকম হতেই চায় না, তার ওপর–

—মিথ্যে কথা? শ্রীবিলাস জোরে বললে, আমি মিথুক আর তুমি খুব সত্যবতী না? দেখবে, সকলে উঠেছে কি না? দেখবে দেখবে?

—দেখব, বিন্দু নিঃশব্দে হাসল।

–ওরে সতে, ওগগা শিবনাথ, ও মনুর মা,—কিছুক্ষণ এমনি নিষ্ফল ডেকে হতাশ হয়ে শ্রীবিলাস বললে, আর মেয়েমানুষের অত ঘুমই বা কেন!

-মেয়েমানুষের ঘুমেই চোখ টাটায়, না! বুঝি ঘুম শুধু পুরুষের? শ্রীবিলাস রেগে কী বলতে যাচ্ছিল এমন সময় ঘরের পাশে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল।

—ও দাদা, কি করছ?

–কে, বীরু?

-হ্যাঁ।

-এই তো দাদা বসে আছি একা, যাব একা, শ্রীবিলাস যেন এক মুহূর্তে বদলে গেল, বললে, কিছু সঙ্গে যাবে না, কেউ সঙ্গে যাবে না, স্ত্রী নয়, পুত্র নয়, ভাই নয়, বোন নয়, ধন-দৌলত নয়—শ্রীবিলাস গুনগুন করে পরলোকতত্ত্ব বিষয়ক একটা গান ধরলে, তারপর থেমে বীরুর দিকে তাকিয়ে বললে—বাঁশি বেজেছে। কারখানায় চললে এত সকালে?

বীরু বললে, ঠিক এসময়ই তো রোজ আমি যাই দাদা।

—রোজই এসময় যাও? তা হবে, শ্রীবিলাস বললে, ঘড়ি তো নেই যে সময় ঠিক রাখব, কি বল বীরু?

এই একটু আগেই এই নিয়েই স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছিল।

—কিন্তু আছে মন, আছে তাতে কাঁটা, মিনিটের নয় কিন্তু ঘণ্টার কাঁটা। তাই ঠিক করে বলতে পারিনে ছ-টা বেজে ক-মিনিট হয়েছে, কিন্তু এটা বলতে পারি যে ছ-টা বেজেছে, কি বল?

শ্রীবিলাস হাসল, বললে, ওই যে কথায় বলে মন না গতি–

বিন্দু আবার বাইরেই এসে দাঁড়িয়েছিল, বললে, আমাদের বীরু এখন একটা বিয়ে থা করুক, ঘরদোর কে দেখে বল? তা ছাড়া, অসুখ-বিসুখও তো আছে? করো ভাই করো, আমরা একটা নেমন্তন্ন খাই।

বীরু যেন লজ্জা পেল।

শ্রীবিলাস হেসে বললে, ওই তো মেয়েমানুষের দোষ, কেবল বিয়ে থা করো! আরে, বিয়ে তো করবে, খেতে দেবে কী? তারপর ছেলেপিলে হলে!

তার কথা শুনে বিন্দুর খিলখিল করে হাসতে বা ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কে কাকে বলে ? কিন্তু সে তা করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

শ্রীবিলাস বললে, তাই অল্প মাইনে, দুজনের পেট কী করে চলবে এতে? হ্যাঁ বীরু, তোমার না মাইনে বাড়বার কথা ছিল?

—ছিল, কিন্তু বাড়াচ্ছে না তো?

–বাড়াচ্ছে না? কথা দিয়েও!

–তাইতো দেখা যাচ্ছে।

—কি বলো, এত অন্যায়? কথা দিয়ে কথা-না-রাখার মতো পাপ আর আছে? বাইবেরটা দেখে মনে হয় শ্রীবিলাস ভয়ানক রেগে উঠেছে, পরক্ষণেই বেড়ালের মতো ঠাণ্ডা হয়ে বললে, ভগবান করুন, দিনে দিনে যেন তোমার উন্নতি হয়।

—আমি যাই?

—এসো ভাই।

কাছেই বিন্দুর নিঃশব্দ উপস্থিতি টের না পেয়ে শ্রীবিলাস জোরে ডাকতে লাগল, বউ, ও বউ–

-কী?

এখনও দাঁড়িয়ে আছ? কাল যে বললে, আজ তোমাকে খুব সকালে যেতে হবে, বাবুদের বাড়ির ছেলের ভাত! যাও তাড়াতাড়ি। আবার যদি রেগে-টেগে যায় তাহলে কি করবে বল? যাও শিগগির।

-যাই।

—আর দ্যাখো, ঘরে কোনো খাবার নেই, কিন্তু ছেলেপিলেগুলো খাবে একটা কিছু, দুটো পয়সা যদি থাকে রেখে যেয়ো না হয়, দু-পয়সার মুড়ি কি চিড়ে কিনে এনে খাবেখন।

-হুকুম করবার বেলায় তো খুবই মজা, আর পয়সা নেবার বেলায় কেবল গৌরী সেন! আঁচলে বাঁধা ছিল পয়সা, বিন্দু তা বার করে মেঝের ওপর ঝনাৎ করে ফেলে চলে গেল। শ্রীবিলাস হাত দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে আপন মনে বললে, আমার হাতের ওপর দিয়ে গেলে কি দোষটা হত শুনি? এখন পয়সা দুটো আমি কী করে পাই? কোথায় না কোথায় গড়িয়ে চলে গেছে কে জানে? লোকে বলে, টাকা-পয়সার হাত-পা আছে।

ছেলেপুলেদের মধ্যে কেলো সকলের বড়ো।

শ্রীবিলাস ডাকলো, ওরে কেলো—

কাছেই কোথায় সে খেলছিল, দৌড়ে এসে বললে, কী বাবা?

-তোদের খুব খিদে পেয়েছে না রে?

–পেয়েছে।

–খুব?

—হ্যাঁ বাবা, খুব।

—হেবো, সদু, ওরা কোথায়?

—ওই তো, আমি যেখানে খেলছিলাম সেখানেই তো খেলছে। সদুটা পিট পিট করে কাঁদছেই কেবল, বলে, খিদে পেয়েছে দাদা। কেলোটা অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলে ফেলল।

—আর হেবো, ওটাও কাঁদছে?

—হুঁ, কেলো বললে, ভয়ানক কাঁদছে।

–কই আমি তো শুনতে পাইনি?

–পাবে কি গো! কতক্ষণ আর কাঁদবে? দিলাম এক চড়, বললাম, মা এলে খাবি ছোঁড়া। তারপরই তো ফট করে চুপ করে গেল।

-চড় দিলি! শ্রীবিলাস তার লাঠিটা হাতে তুলে নিল, সেটা দিয়ে মেঝের ওপর এক শব্দ করে বললে, কেন চড় দিলি বল, নইলে আজ তোকে–

যে এত মিথ্যে কথা বলতে জানে, সে তার সাফাই গাইতেও জানে, বিশেষভাবে তার কাছে—যে ব্যক্তি চোখে কিছুই দেখতে পায় না।

কেলো বললে, খুব জোরে নয় বাবা। আমি কেন জোরে মারব ওকে বলো! এই এরকম আস্তে করে—সে শ্রীবিলাসের গায়ে আস্তে মৃদু একটা আঘাত করে বললে, হাতটা কেবল একটু লাগিয়েছিলাম, আর অমনি কেঁদে ফেলল ভ্যাঁ করে। এমন ছিচকাঁদুনে আর কখনও দেখিনি, বাপরে।

শ্রীবিলাস আবার শান্ত হল। মাটির ওপর একপাশে লাঠিটা রেখে, আঁচলের গিট খুলে পয়সা দুটো বার করল, বললে, শিরীষ দোকানির কাছে যা, মুড়ি নিয়ে আয়। দু-পয়সার, বুঝলি?

-আচ্ছা।

শ্রীবিলাস কেলোর হাতে পয়সা দিয়ে বললে, মুড়ির সাথে একটু তেল আর নুনও চেয়ে নিস বাবা, ভুলিসনি যেন, বুঝলি?

কেলো কি আর সেখানে রয়েছে, পয়সা পেয়ে তক্ষুনি দৌড়ে পালিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে–

আসতে দেরি দেখে শ্রীবিলাস ডাকল ছেলেটাকে, কেলো—

ঘরের পূর্বদিকের দরজার সামনেই একটা ভাঙা উঠোন ছিল, সেখানে বসে ওরা খাচ্ছিল। শ্রীবিলাস ছিল এপারের বারান্দায়, টের পায়নি।

—কেলো!

উত্তর এল, কী বাবা?

—খেলি?

–বাবা।

–হেবো আর সদু, ওরা?

—ওরাও তো খাচ্ছে, কিরে হেবো, খাচ্ছিস না তুই আমার সঙ্গে? কেলো ফিসফিস করে হেবোকে বললে, বলনা, চেঁচিয়ে বল।

হেবো চেঁচিয়ে বললে, হুঁ, আমি খাচ্ছি।

শ্রীবিলাস লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের দরজা পেরিয়ে বললে, সবই খেলি?

—সবই তো বাবা।

শ্রীবিলাস তাড়াতাড়ি তাদের কাছে যেতে যেতে বললে, একটুও রাখিসনি?

—হুঁ, সে তো আছেই বাবা, এই একেবারে তলায়, এই আধমুঠোও হবে না। শ্রীবিলাস দাঁত-মুখ খিচিয়ে বললে, পাজি ছেলে, সবই খেয়ে ফেললি? বয়েস আমাদের বেশি হয়েছে বলে বুঝি খিদে পেতে নেই মোটেই? শয়তান ছেলে, হতচ্ছাড়া, তোর হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলব আমি–

কেলো ভয়ে দৌড়ে পালাল।

-বউ এলে পর বলব, এরকম ছেলে পিঠমোড়া করে বেঁধে চাবুক লাগানো। দরকার, শুধু নিজের খাওয়া, সাতদিন না খাইয়ে রাখলে তবে ঠিক হয়—হবে না এমন, কেবল ছোটোলোকদের সঙ্গে মিশলে এরকম হয়ই। বউকে কত বলেছি, না ওর কেবল টাকা আর টাকা! আরে বাপু, ইদিকে যে ছেলেপিলেগুলো অমানুষ হয়ে গেল তা চোখে পড়ছে? আবার কোথায় গেল ওটা?

শ্রীবিলাস দরজায়, চৌকাঠে, দেওয়ালে কয়েকবার খুব করে লাঠির আঘাত করে বললে, ছেলেটা কোথায় গেল?

হেবো আর সদু কাছেই ছিল, বাপের রাগ দেখে ভয়ে এতক্ষণ কিছু বলেনি, এখন কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললে, দাদা পালিয়েছে বাবা।

—পালিয়েছে বাবা! ন্যাকামি! যা আমার সুমুখ থেকে, যা বলছি, নইলে মার খেয়ে মরবি বলে দিলাম।

হেবোটা সত্যিই ছিচকাঁদুনে, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললে।

শ্রীবিলাস বললে, আবার কাঁদছিস কেন?

—দুমুঠো করে আমাদের দিয়ে দাদা আর সবই নিজে খেয়েছে বাবা।

নিজে খেয়েছে! রাগে শ্রীবিলাসের চোখ ফেটে জল আসে আর কি! সবই নিজে খেয়েছে, আর আমরা বুঝি ভেসে এসেছি। দাঁড়া তো আসুক!

শ্রীবিলাস গুম হয়ে বসে রইল।

প্রায় এগারোটা অবধি বসে বসেই কেটে গেল। কাজই বা কী? অন্ধের আবার কী কাজ?

কিন্তু শ্রীবিলাসের কাজ আছে, সে দিনরাত কেবল বকে, বারান্দায় আর ঘরে আসা-যাওয়া করে, ছেলেপিলেগুলোকে নিষ্ফল শাসন করে, আরও কত কী করে?

বিন্দুর আসতে দেরি হচ্ছিল, আজকে বেশি কাজ, উৎসব-আয়োজনে রোজকার চেয়ে একটু দেরি হবেই তো।

বেলা বারোটা বাজল।

ছোটোছেলেদের এমনি একটা স্বভাব, যেমন ভুলে থাকতে পারে খুব, তেমনি অনেক সময় যার জন্যে একবার ঝোঁক চাপল তার জন্যে একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠে।

কেলো ওরাও ক্ষিদে ভুলে তখনও কোথায় খেলছিল।

শ্রীবিলাস নিজেই অস্থির হয়ে উঠল।

চারিদিক প্রায় নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে দু-একটা কাকের ডাক।

পাশের ঘরে থাকে সতীশ। এক বাদ্যযন্ত্রের দোকানে কাজ করে। বিয়ে করেছে। বেশিদিন হয়নি, এখনও সন্তান হয়নি।

শ্রীবিলাস বললে, ও সতীশ, গলার আওয়াজ যে পাচ্ছি, কাকে কী বলছ? কী হয়েছে?

ওপাশ থেকে জবাবা এল, এই তো দাদা, একটা কাচের গ্লাস গেল ভেঙে। গ্লাসটা ভালো দাম দিয়ে কিনেছিলাম এই ভেবে যে অতিথি মানুষ-টানুষ এলে পর জল দেওয়া যাবে—তাও আবার ভেঙে গেল। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের এমন হলে কি চলে, বলুন?

-কে ভাঙলে?

-ভাঙবে আবার কে? এই হল কি–

ওদিকে দেওয়ালের ওপাশে সতীশের বউ তাকে চুপিচুপি বলছে, বাইরে থেকে ভয়ানক তেষ্টা নিয়ে এসে আমায় বললে, বউ, দাও এক গ্লাস জল, সেই গ্লাসটি করে। দারুণ তেষ্টা পেয়েছে আমার। আনলুম জলের বদলে সরবৎ করে, এসে দেখি তুমি হাসছো, হাত থেকে সরবৎ তো নিলে না, নিলে আমাকে, গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল, আমি কী করব বল? আমার কী দোষ? আবার হাসছে, আরে, আরে, দ্যাখো, অত ফাজলামি কোরো না। দেবো মুখের ভিতর এই ভাঙা কাচ ফুটিয়ে–

এদিকে আবার শ্রীবিলাস সতীশের দিক থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে বললে, সতীশ, ও সতীশ–

—কী?

–ক-টা বাজল বলতে পার?

–একটা হবে আর কি! কেন জিজ্ঞেস করছেন?

শ্রী বিলাস বিনা আয়াসে বলে ফেলল, ওই দ্যাখো, আমিও কিন্তু ওইরকমই আন্দাজ করেছিলুম। ঠিক হল দেখছি। এখন আমি প্রায়ই পরীক্ষা করে দেখি, কি জানো, ঠিক হয়। কম আশ্চর্যের কথা নয়, কি বল?

-হ্যাঁ। আমি চান করতে চললুম দাদা।

—ওকি, এখনও খাওনি? হা ভগবান! এমন করলে কি শরীর থাকবে? এই অবেলায় খেয়ে জোয়ান বয়সেই না হয় কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে চলতে পারো, কিন্তু বুড়ো বয়সে এর জন্যে ভুগতে হবে বাপু। যাও তাড়াতাড়ি যাও–

অন্যের কাছে খুব ভালো মানুষ সেজে শ্রীবিলাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

একটু পরেই বিন্দু এল, সঙ্গে কেলো আর হেবো। সদু ঘরে ঘুমিয়েছিল।

হাত থেকে সব নামিয়ে বললে, ছেলেগুলো এমন দুষ্টু দ্যাখো, আবার বাবুদের বাসায় গেছে। কী সাহস! কতদিন মানা করলাম তবু—সেই ন্যাংটা দিগম্বর সেজে গিয়ে উপস্থিত।

শ্রীবিলাস বললে, কোনোদিন গাড়িঘোড়ার তলে পড়ে খুন হবে।

—হবেই তো।

শ্রীবিলাস বললে, আর যাসনে কিন্তু। তারপর, বউ, কেমন খাওয়া-দাওয়া হল?

–খুব ভালো। আমরা তিনজনেই পেট পুরে খেয়ে এসেছি।

–আর?

–আর এনিছিও তোমার জন্যে।

—তাহলে এবেলা আর রাঁধতে হবে না বল, শ্রীবিলাস কাছে এগিয়ে বললে, বসব?

–চান করেছ?

–সেই কখন।

–আচ্ছা দাঁড়াও, পিঁড়ি পেতে দিই।

শ্রীবিলাস তাড়াতাড়ি বললে, না থাক থাক, আমি মাটির ওপর বসতে পারব। বিন্দু তাকে খেতে দিতে দিতে বললে, আজ আর ভাত, ডাল, মাছ নয়, পুরনোয় মুখ বিষিয়ে উঠেছে। আজ পাকা লুচি, মাংস, দই, সন্দেশ।

শ্রীবিলাস হঠাৎ একমুখ হেসে উঠল।

–হাসছ যে?

–এমনি গো, এমনি।

–এমনি কেউ হাসে?

–বউ, আমি হাসি।

খেতে খেতে হঠাৎ একবার শ্রীবিলাসের গলায় ঠেকল।

বিন্দু তাড়াতাড়ি বললে, আহা, অত তাড়াতাড়ি খাচ্ছ কেন?

খাওয়া-দাওয়ার পর একটা পান চিবোতে চিবোতে শ্রীবিলাস বললে, সেই কড়িগুলো কোথায় গো বউ, সেই যে কিনেছিলে, না কোত্থেকে এনেছিলে?

—আছে বুঝি কোনোখানে, কেন?

–এসো না একটু খেলি?

বিন্দু বললে, না আমার ঘুম পেয়েছে। সারারাত একরকম ঘুমুইনি। আর তুমিই বা খেলবে কীগো, আমি যদি মিথ্যে চাল দিই?

-না, না, আমি খেলব, তুমি আনো।

বিন্দু একটা ছেড়া পাটি পেতে তার ওপর একটা বালিশ ফেলে শুয়ে পড়ল।

শ্রীবিলাস বললে, তাহলে আমি কী করব, ঠায় বসে থাকব?

—রোজ যা করো তাই করো। ঘুমোও, কিছু পেতে দেব?

–দাও।

শ্রীবিলাস যখন ঘুম থেকে উঠল, বিন্দু তখন অনেকক্ষণ কাজে চলে গেছে। সন্ধ্যার আর বেশি বাকি নেই।

শ্রীবিলাস সদুকে বললে তাকে কলতলায় নিয়ে যেতে।

সদু তিন বছরের মেয়ে, কিন্তু কথা বলে পাকা-পাকা। সে তার বাবার হাতের লাঠি ধরে তাকে কলের পারে দিয়ে এল।

অতগুলো গরিব পরিবারের জন্যে একটিমাত্র কল, তা-ও সারাদিন জল পড়ে যায়।

শ্রীবিলাস হাত-মুখ ধুতে এসেছিল। তাকে দেখে একজন কল ছেড়ে দিলে। সে হাত-মুখ ধুয়ে আবার ফিরে ঘরে এসে বসল।

সকলে যে যার কাজ থেকে ফিরছে।

আর শ্রীবিলাস তার ঘরের সামনেকার বারান্দায় বসে আছে চুপ করে। অনুভব করছে মানুষের পদচারণা, কথা বলা। এমনি সে রোজই বসে থাকে একা।

তার চোখের রং ধূসর, মাঝে মাঝে জল পড়ে, মাথার চুলগুলো খুব ছোটো করে ছাঁটা। পা-দুটো এক করে হাঁটুর ওপর এক হাত রেখে, তার ওপর মুখটি স্থাপন করে সে বসে থাকে। এই সময় কেউ সেধে কথা বললে উত্তর দেয় খুব। বিনীতভাবে কিন্তু অতি সংক্ষেপে।

রাত নটার সময় বিন্দু এল। আজ সে একটু সকালেই এসেছে। ছেলেরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু শ্ৰীবিলাস জেগে আছে। বিন্দু জিজ্ঞেস করলে, ওরা সব খেয়েছে?

হ্যাঁ। তুমি তো রেখে গেছলেই খাবার। কিন্তু বউ, আজ তুমি সকালে এসেছ বলে মনে হয়।

বিন্দু বললে, হুঁ। ছুটি দিয়ে দিলে। ওদের বাড়িতে আজ মেয়েরা নাচবে গাইবে। তারপর মেয়েপুরুষ মিলে থিয়েটার করবে গো—কিন্তু আমি তাতে কী কাজে লাগব বল? তাই চলে এলাম।

-তা নাচ-গান দেখে এলে না কেন?

বিন্দু মুচকি হেসে বললে, যাবে?

–কি বল? এখন? এত রাতে?

—এত রাতেই তো এলাম। তা ছাড়া আমার ওসব লোকের ভয় নেই।

খেয়ে-দেয়ে শ্রীবিলাস বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললে, নেই কেন?

বিন্দুর গরমটা সত্যি একটু বেশি, সে বাইরে গিয়ে বসেছিল।

একটু ঝিরঝিরে বাতাস বাইরে পাওয়া যায় বটে। কিছু দূরেই একটি মাধবীলতার গাছ আছে, তাতে অজস্র ফুল, সেই থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে, মাঝে মাঝে বাতাসের সঙ্গে ভেসে।

বিন্দু বললে, কারণ আমি জানি, আমি সত্যি, ওরা মিথ্যে। ওরা ভীতু।

–তবে কাকে ভয় করে শুনি?

বিন্দু বললে, তোমাকে।

শ্রীবিলাস শুয়েছিল, উঠে পড়ল, ধীরে ধীরে বাইরে এসে বললে, আমাকে কেন?

বিন্দু ফিক করে হেসে বললে, ভয় করব না তো কি? এই দ্যাখো, ছেঁড়া কাপড়, তালি দিয়ে সেলাই করে কোনোরকমে পরি। কিছুতেই আর সংসার চালাতে পারি না। এই তো আজ অর্ধেক মাস মাত্র গেছে, আমার কাছে মোটে একটা টাকা। ঘরে শুয়ে আছে তিন ছেলে-মেয়ে। ওরা বেঘোরে ঘুমুচ্চে। কিন্তু ওগো, তোমার চোখে কি ঘুম নেই? তোমার চোখের আগুন নেবাও, আমি তো আর পারিনে।

—আমি এখন শোবো না।

–শোবে না?

–না, আমার শুতে ইচ্ছে করছে না।

শ্রীবিলাস কাতরস্বরে বললে, দ্যাখো, আমি অন্ধ মানুষ, কত দুঃখ। তার ওপর আমাকে আরও কষ্ট দিয়ে লাভ কি? বিন্দু, ও বিন্দু–

-না, না, আমাকে আর ডেকো না। এই বয়সে আর অত সোহাগের ডাক ভালো লাগে না। একটা রাতও……।

-অত অহংকার ভালো নয়।

–আরে, এতে অহংকারের কী হল?

শ্রীবিলাস শক্ত গলায় বললে, তুই কি সারারাত ওখানেই দাঁড়িয়ে কাটাবি?

তুই সম্বোধন আরম্ভ হল।

বিন্দু চুপ করে রইল।

-আমি চোখে দেখতে পাই না বলে মজা পেয়েছিস বুঝি? খুব মজা না, খুব মজা?

কাছেই ছিল লাঠি, শ্রীবিলাস ভয়ানক রেগে সেটা ছুঁড়ে মারল আন্দাজে।

বিন্দু এবার হেসে উঠল। লাঠিটা গায়ে লাগেনি। সে তা উঠিয়ে রেখে দিলে ঘরের এক কোণে।

শ্রীবিলাস উঠে দাঁড়াল, কাঁপতে কাঁপতে বিন্দুকে ধরবার জন্যে রুখে এল, কিন্তু বিন্দু নিঃশব্দে সরে এসেছে আর একদিকে।

একটা পুরনো বাক্সের সঙ্গে শ্রীবিলাস খেলো ধাক্কা, আছাড় খেয়ে পড়ল, তারপর, আশ্চর্য—কেঁদে উঠল ডাক ছেড়ে, আমাকে মেরে ফেললে রে, ওই রাক্ষুসি আমাকে মেরে ফেললে রে!

আশেপাশে অনেক লোকজন, তারা শুনতে পেলে কী মনে করবে, হয়তো ভিড় জমাবে এসে এই রাতে, বিন্দু ভয় পেয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি শ্রীবিলাসের কাছে এল, হাঁটু গেড়ে বসল, তার হাত ধরে বললে, চুপ চুপ! কেন অমন করছ? এই দ্যাখো, আমি একটুও ভয় পাই না তোমাকে।

শ্রীবিলাসের চেঁচামেচি এক মুহূর্তে গেল থেমে, ব্যথা গেল উড়ে।

বিন্দু দরজা বন্ধ করল।

আবার ভোরও হল, কেউ না উঠতেই শ্রীবিলাসও উঠল, আকাশে না-দেখা সূর্যকে প্রণামও করল, পরলোক-বিষয়ক একটি গানও ধরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *