০৫. অরূপের সমুদ্রে আমার তরী ভাসাল

গুল ও আঈনহ্ কেয়া খুরশীদ ও ম্যহ্ কেয়া
জির দেখা তিধর তেরা হী রূ থা।।
(ফুলের দিকে তাকাই, আয়নার দিকে তাকাই,
চন্দ্ৰসূর্যের দিকে তাকাই।
যেদিক তাকাই, তোমারই মুখ দেখতে পাই।)

অরূপের সমুদ্রে আমার তরী ভাসাল, মান্টোভাই। যাকে কখনও দেখা যায় না, তার পেছনে আমার সারা জীবনের দৌড় শুরু। তারপর থেকে কলমই আমার নিশান। আমার কলমগুলো কী দিয়ে তৈরি হয়েছিল জানেন? আমার যোদ্ধা পূর্বপুরুষদের ভাঙা তির দিয়ে। যেদিন প্রথম একটা শের লিখলুম, মনে হল, অনাদি-অনন্ত থেকে যেন আমি কবিতার বীজ বুকে নিয়েই এসেছি। কবিতা তো চেষ্টা করে লেখা যায় না; যায় বলুন? কবিতা যার কাছে আসে, সে-ই শুধু পারে। কিন্তু কেন সে আসে, কী ভাবে আসে, তা তো আমরা জানি না। আমার কী মনে হয় জানেন, হাজার হাজার দারুন গজল লিখলেও তাকে কবি বলা যায় না, কিন্তু এমন একটা। শেরও যদি সে লিখতে পারে, আর্তনাদের মতো, যাতে তার হৃদয়ের সব রক্ত লেগে আছে, তবেই তাকে কবি বলতে পারি আমরা। কবিতা তো মসজিদে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া নয়; খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ানো, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেষ কয়েকটা কথা বলা। মান্টোভাই, রক্তমাখা কাগজে আমি আমার ইস্কের কথা লিখে গেছি দিনের পর দিন, আমার হাত অবশ। হয়ে গেছে, তবু লিখে গেছি। আমি জানতুম, একদিন আমার গজল অনেক মানুষকে আশ্রয়। দেবে। গর্ব নয় মান্টোভাই, ক্ষত-আমার ক্ষতর পর ক্ষতের কথা লিখে গেছি-তা কাউকে ছোঁবে।

না, তা কি হতে পারে? কিভাবে হৃদয় থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে, আমি দিনের পর দিন দেখে গেছি। ছোটবেলার। কয়েকটা কথা তবে আজ আপনাকে বলি। তখন থেকেই তো রক্ত চুইয়ে পড়ছে, আর জমাট বেঁধে আমার বুকের ভেতরে এক একটা পাথর তৈরী হয়েছে। মীরসাব একটা শের-এ কী বলেছিলেন জানেন তো?

হুঁ শমা-এ আখির –এ শব, সুন সরগুজ মেরী,
ফির সুবহ্ হোনে এক তো কিস্সা হী মুখৎসর হ্যায়।।

সত্যিই তো আমি শেষ রাত্রির চিরাগ। ভেবে দেখুন, আমি যখন জন্মালুম, তখন একটা সাম্রাজ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। কতবার স্বপ্ন দেখেছি, যদি জাঁহাপনা আকবরের সময়ে জন্মাতুম; জাঁহাপনা। জাহাঙ্গীর, শাজাহানের সময়ে জন্মালেও আমাকে সারা জীবন এমন রাস্তার কুকুরের মতো কাটাতে হত না। খোদা আমাকে পাপের জন্য এমন নরকে এনে ফেললেন, যখন দরবার। বলতে আছে সামান্য খুদকুঁড়ো। আর ওই বাহাদুর শাহ, এক লাইনও গজল লিখতে পারতেন না, তাঁর খিদমতগারি করতে হল আমাকে।তবে কিনা আল্লা রহিম, তাঁর হয়তো আমার জন্য। এই ইচ্ছাই ছিল।

আমি আমার ওয়ালিদকে কখনও দেখিনি। আনেকে বলত, তাঁর সঙ্গে নাকি আমার অনেক মিল আছে। একটু বড় হওয়ার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মুখের প্রতিচ্ছবিতে আবদুল্লা বেগ খান বাহাদুরকে খুঁজতুম। কোথায়, কোন যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন তিনি, আম্মাজান তাঁর মরা মুখটাও দেখতে পাননি। একটা মানুষ হঠাৎই হারিয়ে গিয়েছিলেন, কোন চিহ্ন ছিল না তাঁর, কেউ তো তাঁর তসবিরও এঁকে রাখেনি যে তাঁকে মনে পড়বে। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেবের সময় থেকে তো তসবির আঁকাকে হারাম মনে করত সবাই। না হলে ভাবুন, মুঘল দরবারের মত তসবিরখানা দুনিয়ার আর কোথাও কেউ কখনও দেখেছে? পারস্যের মতো মুসাব্বিররা আর কোথায় জন্মেছে বলুন তো? আপনি বিঞ্জাদের নাম শুনেছেন? হাজার বছরেও অমন একজন। শিল্পী জন্মান কি না সন্দেহ হয়।

হায়, আমার আম্মাজান। তাঁর জন্য একটা তসবিরও রইল না। আম্মাজানের কথা জানলে আমার শৈশব-কৈশোরকে বুঝতে পারবেননা মান্টোভাই। অনেক পরে, আমি যখন বুড়ো হতে চলেছি, আম্মাজানের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হত, তাঁর জীবন আসলে একটা শব্দ : অপেক্ষা। অপেক্ষার রং নীল, জানেন তো? বিষাদ থেকে চুইয়ে পড়া নীল রং। অপেক্ষা ছাড়া তাঁর জীবনে আর কী ছিল বলুন? তাঁর নিজের কোনও সংসার ছিল না, মহল ছিল না। তিনি শুধু অপেক্ষা করে থাকতেন, কবে আমার ওয়ালিদ আসবেন। হয়তো কয়েকদিনের জন্য আসতেন তিনি। কয়েকটা রাত্রি কাটাতেন আম্মাজানের সঙ্গে। তাই আমি, ইউসুফ, ছোটি খানম পয়দা হয়েছিলুম। আমাদের মাঝে আর কেউ জন্মেছিল কি না জানি না। মাঝে মাঝে এ-ও মনে হয়, আবদুল্লা বেগ খান সত্যি সত্যিই আমাদের ওয়ালিদ তো? কালে মহলের দেওয়ালে কান পাতলে নাকি অনেক গোপন কিস্সা শোনা যেত। সে যাক গে। দিল্লি-আগ্রা মানেই তো কিস্সা।

আম্মাজানকে নিয়ে আমার একটা দস্তান লেখার ইচ্ছে ছিল, মান্টোভাই। কিন্তু দস্তান লেখা তো সহজ কাজ নয়। মুটে-মজুর যেমন কাজ করে, সেইভাবে লিখে যেতে হয়। আমার সে ক্ষমতা কোথায়? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, আমি দস্তষু লিখেছি, এত খতুত্ লিখেছি, তাহলে আম্মাজানকে নিয়ে দস্তানটা লিখতে পারতুম না? হয়তো পারতুম। মাঝে মাঝে কলম নিয়ে বসতুমও, কিন্তু কী এক ক্লান্তির অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরত, আমি একটা শব্দও লিখতে পারতুম না-আমার চোখ জলে ভরে যেত-মনে হত, এই দুনিয়ায় কোনও ঘর ছিল না আমাদের আম্মাজানের।

একদিনের কথা বলি আপনাকে। হটাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দেখলুম, ঘরের এককোণে চৌকিতে বসে আছেন আমার ওয়ালিদ আর আম্মাজান। তিনি আম্মাজানের দু’হাত ধরে আছেন; তাঁর পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা রক্তমাখা তলোয়ার। বাইরে থেকে ভেসে আসছিল হ্রেষাধ্বনি, ঝড়ের আওয়াজের মতো একটানা। আবদুল্লা বেগ খান বাহাদুরের বুকে মাথা রেখে আম্মাজান।

-এত ভয় পাও কেন? আব্বাজান জিজ্ঞেস করেছিলেন।

-জনাব, আপনি কোথায়, কখন থাকেন, জানতে পারি না। তাই—

-আমি অনেক দূরে থাকি বিবিজান।

-কোথায়?

-যেখানে শুধু রক্ত আর রক্তের স্রোত। আব্বাজানের গলায় ক্লান্তির কুয়াশা।

-আপনি আবার কবে আসবেন জনাব?

-জানি না। যদি কখনও মরে যাই, দুনিয়ায় আমার কবর খুঁজো না বিবিজান। তোমার দিল-এ গোর হবে আমার।

-জনাব–

-বিবিজান।

-আমাদের মহল হবে না কখনও?

-যদি শেষবার ফিরে আসি।

-কালে মহলে থাকতে আমার ভাল লাগে না, জনাব। এ তো আমার ঘর নয়। আপনার মহল হবে না? আব্বাজান হা-হা করে হেসে উঠলেন, ‘আমার মহল যুদ্ধক্ষেত্রে। তুমি কখনও সেখানে যেতে পারবে না।’

-আমি যাব।

-কোথায়?

-আপনার সঙ্গে জনাব। আপনি যেখানে যাবেন, সেখানেই আমার মহল। আমি দেখলুম, আবদুল্লা বেগ খান বাহাদুর আম্মাজানকে আরো কাছে টেনে নিলেন। আম্মাজানের প্রতি তিনি এমনভাবে তাকিয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল মরুভূমির আকাশে যেন মেঘ। ঘনিয়ে এসেছে। আপনি কখনও বারোমাসা তসবির দেখেছেন মান্টোভাই? কী সব তসবির যে এক কালে দেখেছি, কী সব কিতাব, সে-ও এক একটা তসবির। আমির হামজার দস্তানের কিতাব দিয়ে শুরু হয়েছিল-জাঁহাপনা আকবরের সময়ে-সেই কিতাবের ছবি এঁকেছিলেন মীর সৈয়দ আলি। জাঁহাপনা হুমায়ুন তাঁকে পারস্য থেকে নিয়ে এসেছিলেন। সম্রাটদের প্রাসাদের কারখানায় কত যে মুসাব্বির ছিলেন, তাঁরা সব পারস্য থেকে আসতেন। খাজা আবদুস সামাদকে বলা হত ‘শিরিন কলম’। কত কত ছবিওয়ালা কিতাবের জন্ম হয়েছিল। রামায়ণ, মহাভারত, নল-দয়মন্তীর কিতাবও ছিল; আর, হ্যাঁ, কেশবদাসের রসিকপ্রিয়া। সে এক আশ্চর্য কিতাব মান্টোভাই। রসিকপ্রিয়া’তে কতরকম নায়িকার কথাই না বলেছেন কেশব দাস, মুসাব্বিরা একের পর এক নায়িকাদের ছবি এঁকে গেছেন। কী যে সৌন্দর্য সেই নায়িকাদের, যেন পূর্ণ চাঁদের আলো। চকোর পাখি পূর্ণিমার আলো খেয়ে বেঁচে থাকে জানেন তো? পূর্ণিমায় এক নায়িকাকে দেখে তো চকোর পাখির বেভুল অবস্থা; কোন চাঁদের আলো দেখবে সে, বুঝতেই পারে না। জাঁহাপনা ঔরঙ্গজেব সব শেষ করে দিলেন। তসবির ছিল তাঁর কাছে হারাম। মুঘল কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। শাহজাহানাবাদ ছেড়ে মুসাব্বিররা পাহাড়ি দেশের রাজাদের দরবারে কাজ নিয়ে চলে গেলেন। দিল্লির তসবিরখানা শূণ্য হয়ে গেল; যেটুকু খুদকুঁড়ো পড়ে ছিল, তাও ধুয়েমুছে সাফ করে দিল নাদির শাহ আর মারাঠারা, তারপর গোরারা। নাদির শাহ দিল্লি লুঠ করে চলে যাওয়ার পর মীরসাব কি লিখেছিলেন জানেন?

দিল্লি যো এক শহর থা, আলম মে ইন্তিখাব
রহতে থে মুন্তাখাব হি, জাঁহা রোজগার কি
উসকে ফলক নে লুঠকে, বরবাদ কর দিয়া
হাম রহনেওয়ালা হ্যায়, উসি উজরে দিয়ার কে।

আপনি হাসছেন, মান্টোভাই? ঠিকই ধরেছেন, আপনারই মতো বদভ্যাস আমার, কথা বলতে শুরু করলে কোথায় যে চলে যাই, তাল থাকে না। আসলে কী জানেন, কথা বলতে গিয়ে মনে হয়, আরে এরা সব আসছে কোথা থেকে, তখন তো আমি দুনিয়াতেই আসিনি। আমার ভেতর থেকে তা হলে কে কথা বলছে? তাজ্জব বনে যাই মান্টোভাই, সত্যিই তাজ্জব, এক একজন। মানুষের ভেতরে ক’টা মানুষ লুকিয়ে থাকে? মানুষটার জন্মের আগের মানুষরাও তাঁর ভেতরে রয়ে যায়? কী মনে হয় জানেন? মাথার ভেতরে বহু দূর থেকে আসা কুয়াশা ছড়িয়ে যাচ্ছে।

বারোমাসা তসবিরের কথাই তো বলছিলুম, তাই না? এসব তসবিরের জন্ম পাহাড়ি দেশে। আমার ওয়ালিদ যেভাবে আম্মাজানের দিকে তাকিয়েছিলেন, তাতে সেই বারোমাসা তসবিরের কথা মনে পড়েছিল আমার। পাহাড় থেকে মুসাব্বিররা মাঝে মাঝে শাহজাহানাবাদে আসতেন তসবির বিক্রি করতে। তাঁদেরই কারো কাছে ভাদোঁর একটা তসবির দেখেছিলুম। ভাদোঁর রহস্যটা আগে আপনাকে বলতে হয় মান্টোভাই। এই প্রেমের মাসে আশিককে ছেড়ে কেউ থাকতে পারে না। বানিজ্য করতে যারা বাইরে যেত, তারাও ভাদোঁতে বিবির কাছে ফিরে আসত। আকাশ জুড়ে ঘন মেঘ, সারারাত গাছের পাতা থেকে জল ঝরছে, তারা হাওয়ায় কাঁপছে, তখন আশিককে ছেড়ে থাকা যায় বলুন? বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় হাওয়ায় জুইফুল আরা। চাঁপার গন্ধে এক শরীর তো অন্য শরীরকে চাইবেই। সেই তসবিরে ঘন কালো মেঘকে আদর করছিল সোনালি বিদ্যুতের রেখা, সারসের দল তৃষ্ণার্তের মতো মেঘের গভীরে উড়ে যাচ্ছে, হাওয়া সোহাগ করছে গাছেদের সঙ্গে, দোতলার বারান্দায় বসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকা, আপনি দেখলেই বুঝতেন, তারা আসলে রাধা ও কৃষ্ণ, বিদ্যুতের গর্জনে কপট ভয়ে রাধা জড়িয়ে ধরলেন কৃষ্ণকে, বারান্দায় নীচের আলসেয় বসে ময়ূর তাকিয়েছিল ঘনকৃষ্ণ আকাশের দিকে, আর নীচের তলায় খোলা বারান্দায় বসেছিলেন এক নারী, বেখোদ, যেন কারও অপেক্ষায়। সেই হয়ত আমার আম্মাজান। আম্মাজান যেন আকাশজোড়া ঘন কালো মেঘ, আবদুল্লা বেগ খান সোনালি বিদ্যুতের মত হটাৎই তাঁর কাছে এসেছেন। কত দীর্ঘ অপেক্ষার পর দু’জন। দু’জনকে এভাবে কাছে পেতে চায় মান্টোভাই, যেমন আজান আল্লার কাছে পৌঁছতে চায়। আবদুল্লা বেগ খান সেদিন তাঁর বিবিকে খুব আদর করলেন, বিবির সঙ্গে মিলিত হলেন। আমি বসে বসে সেই খোয়াব দেখলুম। সেজন্য আমার ভিতরে এতটুকু পাপবোধ নেই মান্টোভাই; কৃষ্ণ রাধার উপগত হয়েছেন দেখলে কি কোনও পাপ হতে পারে? খোয়াবের মধ্যে একবারই ওয়ালিদকে দেখেছিলুম আমি।

আম্মাজানের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারতুম না। সারাদিন জেনানামহলে কত কাজ তাঁর; আমরা তিন ভাই-বোন তাঁর আশপাশ ঘোরাফেরা করতুম, তিনিও চোখ তুলে তাকানোর ফুরসৎ পেতেন না। ছোটি খানম অবশ্য রাতে আম্মাজানের কাছে থাকতে পারত। আমি আর ইউসুফ থাকতুম দিবানখানায়। মান্টোভাই, খুব ছোটবেলাতেই আমি বুঝে গিয়েছিলুম, কালে মহল আমার ঘর নয়, এখানে আমরা থাকি ঠিকই, কিন্তু তিন ভাই-বোন সবার থেকে আলাদা হয়ে। ইউসুফ হয়তো এজন্যই পাগল হয়ে গিয়েছিল। ছোটি খানমও বেশীদিন বাঁচেনি। শুধু আমাকে আল্লা শাস্তি দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন, দোজখের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে কালো করে দিলেন। রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো মানুষ যেতে পারে না। কালে মহলের আসাদের জন্যই হয়ত মীর সাব লিখেছিলেন:

কেয়া মীর হ্যয় য়হী জো তেরে দরপে থা খাড়া
নমনাক চশ্ম ও খুশক্লব ও রংগজর্দ থা।।
 (সেই কি মীর যে তোমার দরজায় দাঁড়িয়েছিল,
ভেজা চোখ, শুকনো ঠোঁট, বর্ণ ফ্যাকাশে?)

আসাদকে শেষ পর্যন্ত দু’টো খেলাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল, মান্টোভাই। পতঙ্গবাজি আর সতরঞ্জ। দু’টো খেলায় একা একা লড়তে হয়, পাশে কেউ থাকে না। দু’টো খেলাতেই চোখ এক জায়গায় আটকে রাখতে হয়-আকাশে আর সাদা-কালো চৌখুপির মধ্যে। না হলেই আপনি হারবেন। খেলায় আমি জিতে গেছি মান্টোভাই; জীবনে শুধু পরাজয়ের পর পরাজয়।

পতঙ্গবাজি, কবুতরবাজির দিনগুলো এখনও বড় মনে পড়ে। সেই সময় আমার তুর্কি রক্তে যেন ঝড় উঠত, মান্টোভাই। কালে মহলে থাকতে আমার ভাল লাগত না; হয় আগ্রার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতুম, নয়তো কারো বাড়ির ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতুম; একেক দিন বংশীধরের মহলে অনেক রাত অবধি দাবা খেলে কেটে যেত। কালে মহলের পাশেই একটা বড় হাভেলির ছাদ থেকে আমরা ঘুড়ি ওড়াতুম। আমি, ইউসুফ, কানহাইয়ালাল, আরও অনেকে ছিল, সবার নাম মনে নেই। প্রায়ই রাজা বলবন সিংয়ের সঙ্গে ঘুড়ির প্যাঁচ খেলতুম। যেদিন হেরে যেতুম, মনে হত, আরে সামনেই তো কালকের দিন, কাল বলবন সিংকে হারাবই। মান্টোভাই, আমার শরীরে তুর্কি রক্ত বইছে, রোজ রোজ কি আমি হেরে যেতে পারি? অনেক বছর পর কানহাইয়ালাল দিল্লিতে এসে একটা মসনবি দেখিয়েছিল আমাকে; আমারই লেখা-আট-ন বছর বয়েসে লিখেছিলুম। পতঙ্গবাজির রহস্যের কথা। একদিন মসল্-ই-পতঙ্গ-ই-কাগজি, লে কে, দিল, সর রিস্তা-ই-আজাদগি…

সতরঞ্জ আমাকে পতঙ্গবাজির চেয়েও বেশী টানত। কেন জানেন? সতরঞ্জ আসলে একটা লড়াইয়ের ময়দান। এক একটা চালে যখন বংশীধরের খুঁটি খেতুম, রক্তের গন্ধ পেতুম আমি। এইভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল আমার। একদিন চৌসর খেলাও ধরলুম। চৌসরের জুয়া। ম্যায়খানা, মফিল, শরাব। তবায়েফদের কোঠিতেও যেতুম। কী করব বলুন? কালে মহলে থাকতে আমার ভাল লাগত না; আম্মাজানকে কতটুকুই বা কাছে পেতুম; তিনি ছাড়া তো আমার কাছের মানুষ কেউ ছিলেন না। তাঁর জায়গা তো ছিল জেনানামহলে। মীর আজম আলির মাদ্রাসায় পড়তে যেতুম; শেখ মুয়াজ্জামও পড়াতেন আমাকে, কিন্তু সেই সব পড়াশোনা আমার ভালো লাগত না মান্টোভাই। কত আশ্চর্য সব শব্দ আমার দিল-এর দরজায় এসে কড়া নাড়ত; রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে আমি শব্দগুলোকে সাজাতুম, কারা যেন আমার ভিতরে কথা বলে উঠত, আমি চমকে উঠতুম, আরে বা- ইয়ে তো শের হয়, হ্যাঁ মান্টোভাই। আমি, মির্জা গালিব গর্ব করে বলতে পারি ন’বছর বয়স থেকে আমি গজল লিখেছি। তারপর জনাব আবদুস সামাদ এলেন, দু’বছর কালে মহলে ছিলেন, ফারসির সৌন্দর্য ও রহস্য আমি তাঁর কাছেই শিখেছি। মান্টোভাই, উর্দুতে আমি গজল লিখেছি ঠিকই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, গজলের ভাষা একমাত্র ফারসি। আর তসবির মানে তো পারস্যের মুসাব্বিরদের আঁকা তসবির। আম্মাজান একদিন বললেন, মাদ্রাসায় যাস রোজ?’

-জি।

-লেখাপড়া কর আসাদ। এই মহলে তো সারা জীবন থাকতে পারবি ন।

-জি।

-তুই মহল বানাবি। আমি, ইউসুফ, ছোটি খানম তোর কাছে গিয়ে থাকব। মান্টোভাই, আপনি তো জানেন, আমার নিজের মহল কোনওদিন হয়নি। একদিন আম্মাজানকেও আগ্রায় ফেলে আমি শাহজাহানাবাদে চলে এলুম। তার মাঝে আমার নিকাহ্ হল উমরাও বেগমের সঙ্গে। আবার বন্দি হলুম, মান্টোভাই। কবরে শুয়ে বসে আমার কত বন্দিত্বের গন্ধই যে শুনতে হবে আপনাদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *