০৩. এত দূর থেকে কি আমার কথা

বুদকদহ্মে মানীকা কিস্মে করে সওয়াল
আদম নহী হ্যয়, সুরৎ-এ আদম বহুৎ হয় য়াঁ
(এই মাটির পুতুলের রাজ্যে কার কাছে বিশ্বরহস্যের অর্থ শুধাব?
এখানে মানুষ নেই, মনুষ্যাকৃতি অবশ্য অনেকেই আছে।)

এত দূর থেকে কি আমার কথা শুনতে পাবেন মান্টোভাই? আপনি বড় নাছোড়বান্দা, তাই এতদিন বাদে আবার আমাকে কথা বলতে হচ্ছে। ১৮৫৭-র পর বারো বছর আমি বেচেছিলুম ঠিকই, কিন্তু কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হত না। তবুও কথা বলতে হত, কথা বেচেই তো রোজগার করতে হত আমাকে। রুজি-রোজগারের জন্য যতটুকু, তা বাদে কথা আমার কাছে হারাম হয়ে গেছিল। ভাঙাচোরা দিবানখানায় আমি শুধু শুয়ে থাকতুম। কাল্লু এসে ওখানেই আমার দু’বেলার খাবার, ওই একটু পরোটা, কাবাব বা ভুনা গোস্ত আর দারু দিয়ে যেত। শুধু ঘুম আর ঘুম। একটা গজলও মাথায় আসত না। কী করে আসবে বলুন? আমি তো তখন। পচে যাচ্ছি, সারা শরীরে বন্ধু, কেউ না পেলেও আমি সেই গন্ধ পেতুম, পচে যাওয়ার গন্ধ। একদিন ওই গন্ধ সহ্য করতে না পেরে সন্ধেবেলা মহলসরায় গেলুম। আমি ওখানে পারতপক্ষে যেতুম না। উমরাও বেগম সারাদিন নামাজ-তসবিমালা নিয়ে পড়ে থাকত; তার কাছে আমি থাকা-না-থাকা তো সমান। আমারও তো তার সঙ্গে কোনও কথা ছিল না। ভাবুন মান্টোভাই, দু’টো মানুষ পঞ্চাশ বছরের ওপর পাশাপাশি রয়ে গেল, তাদের মধ্যে কোনও কথা হল না, কেউ কাউকে জানতেই পারল না। এরই নাম নিকাহ্; এখানে মহব্বত-এর কী দরকার? ভাববেন না, আমি উমরাও বেগমের ওপর দোষ চাপাচ্ছি, আমিই তো একটা কাফের। মীরসাব একটা শের এ বলেছিলেন না, তাকে কীভাবে নিজের কাছে নিয়ে আসব আমি জানতুম না; সে কখনও আসেনি, কিন্তু সে তো তার দোষ নয়।

মহলসরায় গিয়ে দেখি বেগম তখন কালুর মা, মাদারির বিবিকে খুব গম্ভীর হয়ে কী সব যেন বলে যাচ্ছে। মাই বাইরে দাঁড়িয়ে শোনবার চেষ্টা করলুম। বেগম ওদের বলছিল, ‘হজরতের কত বিবিই না ছিলেন। কারুর প্রতি কম নজর ছিল না নবির। পালা করে সব বিবির কাছে থাকতেন তিনি। শুধু বিবি সুদা নিজের পালা বিবি আয়েশাকে দিয়েছিলেন। সুদা, সফিয়া, জ্ববিরা, ওম্মহবিবা, ময়মুনা-এই পাঁচ বিবিকে দূরে রাখলেও, তাদের বঞ্চিত করেননি। তাঁর কাছে ছিলেন আয়েশা, হা, ওম্মসলম, জয়নব। হজরতের মতো সমান নজর ক’জনের থাকে?’ বেগম থামতেই আমি গলা খাঁখরি দিয়ে ঘরে ঢুকলুম। কাল্লুর মা, মাদারির বিবি সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে। উমরাও বেগম আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘বসুন মির্জাসাব।‘

-সবাইকে সমান দেওয়া যায় বেগম? আমি তাকে হেসে জিজ্ঞেস করলুম।

-নবি ছাড়া আর কে পারবেন জি? কিন্তু আপনি হঠাৎ জেনানামহলে? কোনও ফরমায়েস থাকলে কাল্লুকে বলতে পারতেন।

-ফরমায়েস? আমি কি তোমার কাছে কখনও ফরমায়েস পাঠিয়েছি বেগম?

-তা হলে, আমার মহলে এলেন? আমি তাঁর হাত চেপে ধরে বললুম, ‘আমার গায়ের গন্ধ একবার শুকবে বেগম?’

-ইয়া আল্লা! আপনি কী বলছেন মির্জাসাব?

উমরাও বেগম অনেক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, সে সব তো অনেক আগের কথা। আপনার কী হয়েছে মির্জাসাব?’

-বেগম তুমি কি বদু পাও?

-বদু?

-এই যে আমি তোমার সামনে-বদু পাও না?

-কেন মির্জাসাব?

-আমার শরীর থেকে সবসময় বন্ধু পাই। পচা মাংসের।

ইয়া আল্লা! সে আর্তনাদ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে। দুই হাতে আমার পিঠ ডলতে ডলতে বলে, কী হয়েছে আপনার মির্জাসাব? কী হয়েছে? জাদা পি লিয়া আজ? বদ খোয়াব দেখেছেন?

আমি হেসে ফেলেছিলাম-বদ খোয়াব? আমিই তো তো একটা বদ খোয়াব। আল্লা বোধহয় সারা জীবনেও আমার মতো বদখোয়াব আর দেখেননি।

-মির্জাসাব

-বলো।

-আল্লার কাছে দোয়া মাঙুন।

-আল্লার কাছে তো আমি দোয়া করি বেগম।

-কী মাঙ্গেন?

-হম্ হৈঁ মুস্তাক অওর বোহ্ বেজার, য়া ইলাহী য়ে মাদ্রা কেয়া হৈ?

-কে সে? কে আপনার ওপর বেজার?

-খোদা। বলতে বলতে আমি তাঁর কাঁধের ওপর মাথা রেখেছিলুম।

-চলুন। মির্জাসাব, আপনাকে দিবানখানায় দিয়ে আসি।

-কেন?

আমরা দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলুম। আমি বুঝতে পারছিলুম, এই বরফ ভাঙার সাধ্য আমাদের নেই। বেগমও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিল। তার দুই গাল ভিজে যাচ্ছিল। এই বয়েসে এসব কার সহ্য হয় মান্টোভাই? কী হবে কান্না দিয়ে? কান্না আর আমার ভাল লাগে না। কান্না শুনলেই আমি কারবালা দেখতে পাই। কাসেমের মৃত্যুর পর সখিনার সারা শরীর যেমন কান্নার সমুদ্র হয়ে উঠেছিল।

বেগম আমাকে সেদিন দিবানখানায় পৌঁছে দিয়েছিল, আমাকে বিছানায় শুইয়ে অনেক সময় আমার মাথায় হাত রেখে পাশে বসেছিল। বেশ কয়েকবার ডেকেছিল, ‘মির্জাসাব-মির্জাসাব-’। আমি কোনও উত্তর দিইনি। কী হবে উত্তর দিয়ে? সব তো শেষ হয়ে গেছে, কারোর কথা আর কারোর কাছে পৌঁছবে না। চোখ বুজে আমি বিড় বিড় করে সেই গজলটা বলে যাচ্ছিলুম!

বোহ ফিরাক অওর বোহ্ বিসাল কহাঁ,
বোহ্‌ শব ও রোজ ও মাহ্ ও সাল কহাঁ।।

প্রদীপ নিভিয়ে বেগম একসময় চলে গেল। অন্ধকারে, রোজকার মতো, আমার কয়েদখানায়। শুয়ে রইলুম, আর খুব শীত লাগছিল, মাঝে মাঝে মনে হয় শীত ছাড়া আমার জীবনে যেন আর কোনও ঋতুই নেই। ঘুমের ঘোর এসেছিল, একসময় কাল্লুর গলা শুনতে পেলুম, হুজুর মেহরবান-হজুর-মির্জাসাব-’।

কাল্লু কখনও সময় ভোলে না, রোজ ঠিক সময়ে আমার দাওয়াই নিয়ে আসে। বাক্সের চাবি ওর কাছেই থাকে। ও ঠিক মাপমতন আমাকে এনে দেয়। একফোঁটা দারুও কালু বেশী দেবে না। খেতে খেতে আমি রোজ কালুর কাসে কিস্সা শুনি। কিস্সা বলতে পারলে কাল্লু আর কিছু। চায় না। আমি সেদিন বললুম, ‘কাল্লু, আজ আমি তোকে কিস্সা বলি শোন।

-জি জনাব।

-ক’টা দুনিয়া আছে তুই জানিস?

কালু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

-দো দুনিয়া। একটা আল্লার, সেখানে তিনি থাকেন। জিব্রাইল আর ফেরেস্তাদের নিয়ে। আর একটা আমাদের, এই পৃথিবী, মাটি-জলের পৃথিবী। দুই দুনিয়ার মালিক একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেয়ামতের দিন এই দুনিয়া কার হবে?’ উত্তর কে দিলেন? সেই মালিক। তিনি ছাড়া কে উত্তর দেবেন? মালিক বললেন, ‘সব, সবই আল্লার। কালু, কী মজা দেখ, আল্লা শুধু আল্লার সাথে কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারে কে? আল্লা খুব একা কাল্লু।

-ইয়া আল্লা। আর্তনাদ করে ওঠে কাল্লু।

-কী হল?

-আল্লা

-ধুত্তোরি আল্লা। তুই আগে আমার কিস্সাটা শোন। এই পৃথিবীতে যারা গুনাহ্ করে, আল্লার দরবারে তো তাদের শাস্তি পেতেই হবে। আল্লার দুনিয়াতেও কারও কারও গুনাহ থাকে। তাদের আল্লা কী করে জানিস? এই দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেন শাস্তি পাওয়ার জন্য। আমি আল্লার দুনিয়ায় গুনাহ্ করেছিলুম কাল্লু।

-জনাব

-তাই আল্লা আমাকে এই দুনিয়ায় পাঠালেন। কালু, তেরো বছর কয়েদখানায় কাটানোর পর আমাকে যাবজ্জীবন দেওয়া হল। কবে জানিস? বেগমের সঙ্গে যেদিন আমার নিকাহ্ হল। তারপর দিল্লী। এ এক ভয়ঙ্কর কয়েদখানা কাল্লু। কে আমার বেড়ি খুলে দেবে বল তো? কে কে খুলে দেবে? সারা জীবন ধরে লিখে চলা কী যে শাস্তি কাল্লু, তুই বুঝবি না।

কাল্লু খুব ভাল কিস্সা বলতে পারত, মান্টোভাই। সময় পেলেই দৌড় লাগাত জামা মসজিদে। মসজিদের চাতালে দস্তানগোদের পাশে বসে বসে কিস্সা শুনত। দাস্তানগোরা ভারী আশ্চর্য মানুষ। সারা দিন জামা মসজিদের চাতালে বসে বসে তারা কিস্সা বলত, মানুষকে কিস্সা শুনিয়েই তাদের রোজগার। ঝোলা ভরা কিস্স, কখনও ফুরাত না, যেন সারা পৃথিবী ঘুরে তারা সেইসব কিস্সা খুঁজে নিয়ে এসেছে। পয়সা না দিতে পারলেও শোনাত; শুধু তো। রোজগারের ধান্দা নয়, কিস্সা বলতে বলতে তারা নিজেরাই খোয়বে ডুবে যেত। মান্টোভাই, আমাদের সময়টাই ছিল কিস্সর সুতোয় বোনা একটা চাদর। কোনটা যে জীবনের, আর কোনটা কিস্যার সুতো বোঝাই যেত না। সিপাই বিদ্রোহের পর গোরারা দিল্লির দখল নিল, সে এক দিন গেছে মান্টোভাই, গোটা দিল্লি যেন কারবালা হয়ে গেল, তারপর থেকে দস্তানগোরাও হারিয়ে গেল দিল্লি থেকে। গোরাদের দিল্লিতে কিস্সার আর কোনও জায়গাই রইল না; আপনি তো জানেন,গোরারা কিস্সা চায় না, ওরা চায় ইতিহাস। আমাকেও তো একবার ইতিহাস লেখার কলে জুতে দিয়েছিলেন জাঁহাপনা, সে যে কী বিরক্তিকর কাজ! গোরাদের ইতিহাসের কথা দু’একজনের মুখে শুনেছি; সে এক দমবন্ধ-করা অন্ধকূপ মনে হয় আমার।

আপনি তো কিস্সা লিখতেন, তাই বুঝতে পারবেন, কিস্সা ক’টা লোক বলতে পারে, ক’জনের লেখার ক্ষমতা আছে? ইতিহাস সবাই লিখতে পারে। সেজন্য দরকার শুধু দানেশমন্দি! কিন্তু কিস্সা লেখার জন্য চাই খোয়াব দেখার ক্ষমতা। তাই কি না বলুন? খোয়াব ছাড়া লায়লা মজনুনের কিস্সা জন্ম নিতে পারত? খোয়াব না দেখলে কেউ ইউসুফ-জুলেখার কিস্স বিশ্বাস করবে? কিস্সা বলেই কি তা মিথ্যে? কত যুগ যুগ ধরে এই কিস্সা বেঁচে আছে। আর সিকন্দর? তাঁর নামই লোকে জানে; তাঁর সাম্রাজ্য আজ কোথায়? ইতিহাস একদিন ধুলো হয়ে যায় মান্টোভাই; কিস্সা বেঁচে থাকে।

দিল্লি কারবালা হয়ে যাওয়ার পর, কাল্লুকে মাঝে মাঝেই দেখতাম দিবানখানার কোনও কোণে বসে কাঁদছে। কী হয়েছে কাল্লু? কাল্লুর ফোপানি বেড়ে যেত; সেই সময় ওকে মনে হত গুলি খাওয়া একটা জন্তু, মৃত্যু ওকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কী হয়েছে কালু? কাল্পর ভেতর থেকে যেন মরণ-চিৎকার ভেসে আসত।

-জনাব, দস্তানগোরা আর দিল্লিতে ফিরবে না?

-না রে কাল্প।

-কিঁউ হুজুর?

-বাদশাকেই ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে। দাস্তানগোরা কী করে ফিরবে বল? একদিন আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। আমি সকালবেলা বাড়ির সামনের বারান্দায় বসেছিলুম। হঠাৎ কোথা থেকে একটা লোক এসে হাজির হল, ছেড়াফাটা আলখাল্লা পরা, চুলে জট ধরে গেছে, চোখ টকটকে লাল। সে এসে সরাসরি আমার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসল।

-মিঞাসাব, ক’দিন কিছু খাইনি।

-তা আমি কী করব? রাস্তার কুকুরের মত আমি খেঁকিয়ে উঠলুম।

-কিছু দানাপানি যদি দেন হুজুর

-আমারই বলে জোটে না।

-দু’টি খেতে দ্যান হুজুর। আমি দস্তান শোনাই আপনাকে।

হঠাৎ কাল্লু এসে হাজির। সে চোখ বড় বড় করে বলে, ‘দাস্তান?’

লোকটা তার সবক’টা হলুদ দাঁত বার করে বলল, ‘দস্তান বলাই আমার কাজ জি।’ কাল্লু সঙ্গে সঙ্গে তার পাশে বসে পড়ে বলে, ‘শোনাও, তবে, শোনাও।

-আগে কিছু খেতে দাও।

কাল্লু সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে দৌড়ল, একটু পরেই কোথা থেকে যে ও কয়েকটা কাবাব আর ছেড়া পরোটা নিয়ে এল, কে জানে! লোকটা নিমেষের মধ্যেই কাবাব-পরোটা শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল।

-বলো, বলো। কাল্লু লোকটাকে তাড়া দেয়। -কিস্সাটা কাকে নিয়ে মিঞা?

-মির্জা আসাদুল্লা খান গালিব।

কালু একবার আমার মুখের দিকে, তারপর লোকটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

-মির্জা আসাদুল্লা খান গালিবকে তুমি চেনো মিঞা? আমি জিজ্ঞেস করলুম।

-না, হুজুর।

-তার কিস্সা তবে জানলে কোথায়?

-আগ্রাতে।

-তুমি আকবরাবাদে থাকো?

-জি হুজুর?

-কিন্তু মির্জা তো কবেই আকবরাবাদ ছেড়ে দিল্লি চলে গেছেন, মিঞা।

-জানি হুজুর। আগ্রাতে আমরা মির্জার দস্তান বলি। বহুত লোক ভিড় করে শুনতে আসে।

-তা হলে, বলো শুনি। আমি কালুর দিকে তাকিয়ে হাসলুম; কাল্লুর মুখেও দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল।

লোকটা প্রথমে পতঙ্গবাজি নিয়ে একটা মসনবি আবৃত্তি করল। মান্টোভাই, নয় বছর বয়েসে পতঙ্গবাজি নিয়ে মসনবিটা লিখেছিলুম। তখন আমার তখল্লশ অসদ্‌।

আপনি জানেন তো, নবাব হুসাম-উদ-দৌলা লখনউ গিয়ে মীরসাবকে আমার গজল দেখিয়েছিলেন? মীরসাব বলেছিলেন, ‘অগর ইস লড়কে কো কোই কামিল উস্তাদ মিল গয়া অওর ইসে সিধে রাস্তে পর ডাল দিয়া তো লা-জওয়াব শায়র বনেগা-বরনা মোহমল বকনে লাগে গা।’ মীরসাব আমার সম্পর্কে এই কথা বলেছিলেন, ভেবে দেখুন।

ইরতেদা-এ ইশকমেঁ রোতা হ্যয় কেয়া।
আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যয় কেয়া।
(সবে তো প্রেমের শুরু, এখনই কাঁদছ?
দেখো ক্রমে ক্রমে আরো কত কী ঘটে।)।

ইশক্‌। ভালবাসার জন্য মীরসাবকে পাগল হয়ে যেতে হয়েছিল, পাগল বানানো হয়েছিল তাঁকে। তাঁর খানদানেরই একজন বেগমের জন্য ইশক -এ দেওয়ানা হয়েছিলেন মীরসাব। সেজন্যই তাঁর ওপর চলেছিল লাগাতার নির্যাতন। আগ্রা থেকে দিল্লি পালিয়ে গিয়েও রেহাই পাননি। শেষে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন, ছোট একটা কুঠুরিতে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। দূর থেকে খাবার ছুঁড়ে দেওয়া হত। চিকিৎসার নামে কী যন্ত্রণাই না দেওয়া হয়েছিল মীরসাবকে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে পড়তে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। এতসবের পরেও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন মীরসাব। দিল্লিতে আর থাকতে পারেননি, চলে গিয়েছিলেন লখনউ। ১৮১০-এ লখনউতে মারা গেলেন মীরসাব। তখন আমার বয়স তেরো। সেই বছরেই উমরাও বেগমের শেকলে আটকে গেলাম।

-আরে, আসল দস্তান তো বলো। কাল্লু লোকটাকে কাঁধ ধরে ঝাঁকায়।

-সে এক বিরাট মহল। কালে মহল। খাজা গুলাম হুসেন খানের মহল। ইয়া ফটক, মহলের ভিতরে বিরাট চবুতরা, সেই চবুতরায় কত রকমের খাঁচা, মোর দ্যাখো, হিরণ দ্যাখো, কত রকমের পাখি, একটা খাঁচায় নাকি তোদহোদও ছিল।

আমি হা হা করে হেসে উঠলুম।-হোদহোদ? আরে সে পাখীর কথা তো কোরানে লেখা আছে, সোলয়মানের কাছে ছিল। সেই হোদহোদ তুমি খাজা গুলাম হুসেন খানের মহলে দেখেছ মিঞা?

-আমি দেখিনি। তবে অনেকে বলে দেখেছে।

-বেশ, তারপর?

-খাজা গুলাম হোসেন খানের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আবদুল্লা বেগ খানের। তিনি কখনও লখনউতে, কখনও হায়দারাবাদে, কখনও আলোয়ারে-নবাব-রাজাদের সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন তো। তাঁর নিজের ঘরবাড়ি ছিল না। মির্জা আসাদুল্লার জন্ম হয়েছিল কালে মহলেই।

-মির্জার পাঁচ বছর বয়েসে তার ওয়ালিদ যুদ্ধে মরেছিল, তাই না?

-হুজুর, জানেন?

-কিছু কিছু শুনেছি। মির্জা গালিব বলে কথা, তার কিস্সা তো হাওয়াতেই উড়ে বেড়ায়। তারপর?

-মির্জার চাচা ছিলেন নসরুল্লা বেগ খান। তিনি-–

বখোয়াস বন্ধ করো। আমি চেঁচিয়ে উঠলুম।–তোমার কাজ কী? বলো, কী কাজ?

-জি, আমি তো দস্তান বলি।

-ইয়ে দস্তান হ্যায়? কে জানতে চায় নসরুল্লা বেগের কথা? যারা ইতিহাস লেখে, তাদের ওসব বলো গিয়ে। ওসব জেনে আমার লাভ কী? হঠো, হঠো, ইধর সে।

-হুজুর। কাল্লু এবং লোকটা আর্তনাদ করে ওঠে।

-আমি জানি। হাসতে হাসতে তাঁকে বললুম।

-জি হুজুর। লোকটা আমার পা জড়িয়ে ধরে।

-আমি জানি, সেই পাঁচবছর বয়স থেকে নিকাহ্ হওয়া পর্যন্ত আসাদুল্লা কীভাবে কালে মহলে থাকত।

-বলুন হুজুর। কাল্লু এবার আমার হাত চেপে ধরে।

-মির্জা একটা গজল লিখেছিল অনেক পরে। শুনে রাখ, কালে মহলের সেই দিনগুলো–

নওম্মীদী-এ মা গার্দির্শ-এ আয়াম নহ দারদ্‌;
রোজ কেহ্ সিয়হ্ শুদ সহর ও শাম নহ্ দারদ্‌।।
(আমার ঘন নৈরাশ্যের মধ্যে কালের গতি রুদ্ধ;
যে-দিন মিশকালো তার প্রভাতই বা কী, সন্ধ্যাই বা কী।।)

মান্টোভাই, আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে এবার একটু শুয়ে থাকতে দিন। তারপর না হয় আপনার কথাগুলো শোনা যাবে। কবরে শুয়ে এইসব খোয়াব কতদিন দেখতে হবে, কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *