০২. ভূমিকা – এই দস্তান কে লিখছে

০২. ভূমিকা

এই দস্তান কে লিখছে? আমি, সাদাত হাসান মান্টো, না আমার ভূত? মান্টো সারা জীবন একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। মির্জা মহম্মদ আসদুল্লা খান গালিব। আব্দুল কাদির বেদিলের একটা গজল মির্জার খুবই প্রিয় ছিল, মাঝে মাঝেই দু’টো লাইন বলে উঠতেন। আমার গল্প সারা পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হয়, কিন্তু আমি তো একটা শূণ্যতা। বেদিল যেন মির্জার কথা ভেবেই লাইন দু’টো লিখেছিলেন। আমার কথাও কি ভেবেছিলেন?

আমার সবসময়েই মনে হয়েছে, মির্জা আর আমি যেন মুখোমুখি দু’টি আয়না। সেই আয়না দু’টোর ভিতরে শূণ্যতা। দুই শূণ্যতা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। শূন্যতারা কি কথা বলতে পারে নিজেদের মধ্যে?

আমি কতদিন মির্জার সঙ্গে একা একা কথা বলেছি। মির্জা চুপ করে থেকেছেন। কবরে শুয়ে থেকে কীভাবেই বা কথা বলবেন আমার সঙ্গে? কিন্তু এখন, এত বছর অপেক্ষা করার পর আমি জানি, মির্জা এবার আমার সঙ্গে কথা বলবেন। আমিও আমার কবরে গিয়ে ঢুকেছি। ১৯৪৮-এ পাকিস্থানে আসার পর থেকে বুঝতে পেরেছিলাম, এবার আমার কবর আমাকে খুঁড়তে হবে, যাতে তাড়াতাড়ি মাটির গভীরের অন্ধকারে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারি। আমার কবরের ফলকে লেখা থাকবেঃ ‘সাদাত হাসান মান্টো এখানে চিরনিদ্রায়। তার সঙ্গে সঙ্গে গল্প লেখার সব। রহস্যও কবরে চলে গেছে। টন টন মাটির নীচে শুয়ে সে ভাবছে, কে সবচেয়ে বড় গল্প লেখক, মান্টো না আল্লা’? ওরা তো জানে না, খোদার পাগলামি মাথায় নিয়ে মান্টো এসেছিল বলেই। সারা জীবন ধরে গল্পরা মান্টোকে খুঁজে ফিরেছে। মান্টো কখনও গল্পদের খুঁজতে যায়নি।

মির্জা এবার আমার সঙ্গে কথা বলবেন, আমরা কথা বলে যাব অনর্গল, মির্জা যা সারা জীবন। কাউকে বলতে পারেননি, আমি যে কথা কাউকে বলতে পারিনি, সব- সব কথাই এবার আমরা বলব, কবরের ভিতর শুয়ে শুয়ে। মির্জা শুয়ে আছেন, সেই দিল্লীতে, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগার কাছে সুলতানজির কবরে, আর আমি লাহোরের মিঞাসাহেতার কবরে। একসময় তো একটাই দেশ ছিল, ওপরে যতই কাঁটাতারের বেড়া থাকুক, মাটির গভীরে তো একটাই দেশ, একটাই পৃথিবী। মৃতের সঙ্গে মৃতের কথাবার্তা কেউ আটকাতে পেরেছে?

কাকে বলে হেমন্ত? ওরা কাকেই বা বলে বসন্তকাল? সারা বছর আমরা খাঁচার ভিতরে বেঁচে থাকি, এখনও বিলাপ করি, একসময় আমরা উড়তে পারতাম। একটা গজলে মির্জা এইসব কথা লিখেছিলেন। মির্জা কখনও উড়তে পারেননি, আমিও পারিনি। কিন্তু এবার কবরের অন্ধকারে আমরা ডানা লাগিয়ে নেব; বন্ধুরা, আমরা সেইসব কিস্সা বলে যাব, যা আপনারা কখনও শোনেননি; সেইসব পর্দা সরিয়ে সেব, যার ওপারে কী আছে, আপনারা দেখেন নি। মির্জাকে বাদ দিয়ে মান্টো নেই, হয়তো মান্টোকে বাদ দিয়েও মির্জা নেই।

কবরের ভিতরে তা হলে কথাবার্তা শুরু হোক। আদাব।

সাদাত হাসান মান্টো
১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫

ভূমিকা অনুবাদের পর আমি মান্টোর সাক্ষরের নীচের তারিখটির দিকে তাকিয়ে থাকি। তারিখটা যেন এক প্রহেলিকার মতো জেগে আছে। দীর্ঘ সময় নীরব নিশ্চলতায় আমি পাথর। গভীর শীত এসে ঘিরেছে কি আমাকে? বহু দূর থেকে তবসুমের গলা ভেসে আসে, ‘আজ আর লিখবেন না?’ আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে একখণ্ড কুয়াশা দেখতে পাই।

-কী হল?

-হুঁ–

-আজ লিখবেন না আর? আপনি বড় অলস, ফাঁকিবাজ।

-ঠিক বলেছেন।

-কী?

-অলস, ফাঁকিবাজ।

-কী হয়েছে আপনার? তবসুমের কণ্ঠস্বরে বেহালার দ্রুত ছড়।

-এই তারিখটা–

-হ্যাঁ, মান্টো ওইদিন ভূমিকাটা লিখেছিলেন।

-তা কী করে সম্ভব?

-কেন?

-মান্টো তো ওইদিন মারা যান।

-ওইদিন? তবসুম যেন কোনও গহ্বরের ভিতর থেকে কথা বলছে।

-হ্যাঁ। যেভাবে মারা যান, তাতে মান্টোর পক্ষে কলম ধরা সম্ভব ছিল না।

-তা হলে?

-এটা একটা নকল উপন্যাস।

-তার মানে?

-অন্য কেউ মান্টোর নাম নিয়ে লিখেছে। তবসুম এবার হেসে ওঠে।

-ভালই তো।

-কেন?

-একটা নকল উপন্যাস মান্টোর নামে ছাপা হয়ে যাবে।

-সে কী করে হয়?

-হোক না।

-কিন্তু তা কি ঠিক তবসুম?

-ঠিক ভুলের কথা বাদ দিন। আপনি মির্জা গালিবকে নিয়ে মান্টোর লেখা একটা উপন্যাস পড়তে চান তো?

-হ্যাঁ।

-তা হলে ধরে নিন, এটাই মান্টোর লেখা উপন্যাস।

-কেন?

-আপনি কি জানেন, মান্টো যা লিখেছেন, সবই তাঁর লেখা? কেউ হয়ত বলে গেছে, মান্টো লিখে গেছেন। যেমন আমি বলছি, আপনি লিখছেন। আপনি, আমি, মির্জা গালিব, মান্টো-কেউ হয়তো একদিন থাকবে না, তাদের নামটুকুও নয়, কিন্তু গল্পগুলো ঠিক ভেসে বেড়াবে। তাই বা কম কী? নিন, এবার লিখতে শুরু করুন তো।

তবসুমের মুখ পাণ্ডুলিপির অক্ষরের নৈঃশব্দে হারিয়ে যায়।

মিহারবাঁ হো কে বুলা লো মুঝে চাহো জিস ওয়ক্ত হো
মৈঁ গয়া ওয়ক্ত নহি হুঁ ফির আ না সকুঁ।
(দয়া করে যখন খুশি আমাকে ডেকে নাও।
আমি বিগত সময় নই যে আবার আসতে পারব না।)

অনেক দূর থেকে আপনাকে দেখতে পাই মির্জাসাব, এই চিত হয়ে শুয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছেন, কখনও কুণ্ডলী পাকিয়ে এমনভাবে শুয়ে থাকেন, মনে হয় যেন কবর আপনার মাতৃগর্ভ, হয়তো উঠে বসে দুলে দুলে নিজের মনে কী বলে যাচ্ছেন, কখনও মাথা নিচু করে আপনাকে পায়চারি করতে দেখতে পাই। তবে আমার এখন বেশীর ভাগ সময় শুয়ে থাকতেই ভালো লাগে, এই অন্ধকারে। সেই ১৮৬৯ থেকে আপনি শুয়ে আছেন, কবরটা ঘরবাড়িই হয়ে গেছে, তাই না? আমি তো সবেমাত্র এসেছি ওপরের জগৎ থেকে, বড় ঝড়ঝাপটা গেছে সারা জীবন, তাই শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আপনারও নিশ্চয়ই প্রথম প্রথম এইরকম অবস্থাই ছিল। আমি তো জানি, শেষ পর্যন্ত আর জীবনটাকে বইতে পারছিলেন না আপনি। ইউসুফ মির্জাকে লেখা একটা চিঠিতে ফুটে উঠেছিল সেই ক্ষত, আপনার জীবন; আপনি লিখেছিলেন, ‘আমি তো একটা মানুষ, দৈত্য নই, জিনও নই।’

আপনি আসলে কে, শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্ন আপনার কাছে অবান্তর হয়ে গেছিল। অথচ আপনার জীবনের মূল প্রশ্ন ছিল এটাই; কিন্তু শেষের বছরগুলোতে সবকিছু আপনার কাছে অর্থহীন মনে হত; শুধু মৃত্যু আর আল্লার কথাই বার বার বলেছেন। আপনি নামাজ পড়েননি, রোজা রাখেননি, ঠাট্টা করে নিজেকে অর্ধেক মুসলমান বলতেন, আর এজন্য উমরাও বেগমের থেকেও ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে হয়েছিল আপনাকে; অথচ, সেই আপনি, শেষের বছরগুলোতে শুধু খোদার দিকে তাকিয়ে আছেন। চিঠির চিঠির পর চিঠিতে আপনি লিখেছেন, খোদা যেন দয়া করে আপনাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেন। আমি জানি, আপনি আর লড়াই করতে। পারছিলেন না, গজল অনেকদিন আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে, মুনিরাবাইয়ের স্মৃতিও তখন কয়েকটা হাড়গোড় মাত্র, এমনকী আপনার প্রিয় সুরাও আর নিয়মিত জোটে না, এই অবস্থায়। একজন মানুষ খোদা ছাড়া আর কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? আপনার শেষ জীবনের কথা ভাবলে আমার সেই গজলের কথাই মনে পড়ে :

য়া রব, জমানা মুঝকো মিটাতা হৈ কিসলিয়ে
লওহ্-এ জহাঁ-পে হর-এ মুকরর নহি হু মৈ।
(হে ঈশ্বর, কাল আমাকে মুছে ফেলছে কেন?
পৃথিবীর পৃষ্ঠার ওপর আমি বাড়তি হরফ তো নই।)

কিন্তু এভাবে, প্রায় না-খেতে পেয়ে, রোগে ভুগতে ভুগতে, অন্ধ হয়ে মুছে যাওয়াই কি আপনার নিয়তি ছিল?

আপনার জীবনের কথা ভাবলে, আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা ধুলোর ঝড়। ঘোড়ার পিঠে চেপে তারা আসছে নদী পেরিয়ে আসছে সমরখন্দ থেকে। সূর্যের আলোয় ঝলসাচ্ছে তাদের হাতের ঘুরন্ত তরবারি। কত দূর দূর প্রান্তর পেরিয়ে, কত হত্যা ও রক্তপাতের কারবালা পেরিয়ে তারা আসছে ভারতবর্ষের দিকে। মনে হয় যেন স্বপ্নে দেখছি, নাকি সিনেমার পর্দায়? ওই আপনার পূর্বপুরুষেরা, তাদের সারাদিন কেটে যায় ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে, পথে কোনও জনপদ পড়লে চলে খুন, লুঠতরাজ, তারপর রাতে মরুভূমিতে তাঁবু খাঁটিয়ে বিশ্রাম। জ্বালানো হয়েছে আগুন, ঝলসাচ্ছে মাংস, বেজে উঠছে রবাব বা দিলরুবা। দূরে বসে কেউ একা একা মরুভূমির বেদুইনদের গান গাইছে, নিঃসীম আকাশের জন্য। কোনও কোনও তাঁবুতে লুঠ করে আনা মেয়েদের নিয়ে জমে উঠেছে শরীরের উৎসব। সৈনিক পূর্বপুরুষদের নিয়ে আপনার গর্ব কিছু কম ছিল না মির্জা সাহেব; নিজে হাতে অবশ্য কখনও তরবারি ধরেননি। গর্ব থাকলেও মনে মনে জানতেন, অন্যের প্রাণ নেওয়া আর নিজের প্রাণ দেওয়া ছাড়া তাদের জীবনে আর কিছু ছিল না। মাঝে কিছু নারীসঙ্গ, সুরা আর ক্ষমতার দম্ভ। আমি জানি, এই সৈনিক পূর্বপুরুষদের জীবন ছিল আপনার কাছে স্বপ্নের মতো। দু’জন গালিব আছে, আপনি একবার বলেছিলেন, একজন সেলজুক তুর্কি, সে বাদশাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, আর অন্যজন হা ঘরে, মাথায় ঋণের বোঝা, অপমানিত। বাদশাদের সঙ্গে মেলামেশা করা, তুর্কি সৈনিকদের উত্তরাধিকারী গালিব ছিল আপনার স্বপ্নের গালিব। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যে যখন সূর্য পাটে বসতে বসেছে, তখন সেই স্বপ্নের গালিবককে আপনি খুঁজে পাবেন কোথায়? আর নিয়তিও তত ছিল, আপনার নিজস্ব নিয়তি, যা আপনার জীবনে কবিতার বীজ বুনে দিয়েছিল। একজন ফরাসি কবি যাঁবো বলে ছিলেন, ‘I am the other’. আপনি তো সেই ‘other’ -কে সঙ্গে করে জন্মেছিলেন। তাকে তো ঘেয়ো কুকুরের মতোই মরতে হয়।

আপনার পরদাদা সমরখন্দের সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন শুনেছি। আপনার দাদা কুকান। বেগ খাঁ সেই অশ্বরোহীদের ঝড়ের সঙ্গে এসে পৌঁছলেন এ-দেশে। আমি কি ঠিকঠাক বলছি মির্জাসাব? ভুল হলে শুধরে দেবেন। আরে, আরে, আপনি উঠে বসে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! জানি, এসব কিস্সা শুনতে আপনার বেশ ভালই লাগবে। রক্ত কি টগবগ করে ফুটতে থাকে মির্জাসাব? আপনি সেই প্রথম গালিবকে দেখতে পান, তাই না? বাদশাদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তাঁর। আমি আপনাকে ব্যঙ্গ করছি না, মজাও করছি না আপনার সঙ্গে। কাশ্মীরি বলে আমারই বা কি কম গর্ব ছিল? জবাহরলালকে পর্যন্ত চিঠি লিখতে যে। সাহস পেয়েছিলাম, সে তো ওই কাশ্মীরি গর্বের জন্যই। মির্জাসাব, আমরা মাটির মানুষ, মাটির ভিতর তো কাঁকর থাকেই, তাও তো খোদারই দেওয়া। খোদা যেমন আপনাকে মেহেরবানি করেছিলেন, আমাকেও না করলে কি আমি এত তাড়াতাড়ি কবরে এসে শুতে পারতাম? আমিও তো আপনারই মত তাঁকে মানিনি, কিন্তু খোদার কাছে তাঁর সব সন্তানই সমান।

আপনাকে আবার আমি সব মনে করিয়ে দিচ্ছি নতুন করে মির্জাসাব। কবরের দীর্ঘ জীবনে হয়তো কত কিছুই ভুলে গেছেন আপনি। স্বাভাবিক। জীবনেই কতকিছু মনে রাখতে পারি না আমরা, আর মৃত্যু তো আসে একটা পর্দার মতো, যার ওপারে আর কিছুই দেখা যায় না। এক একটা মৃত্যুর পর্দা এসে কীভাবে সব মুছে দিয়ে গেছে, তা তো আমি ১৯৪৭ -এ দেখেছি। আল্লার দয়ায় আপনাকে তা দেখতে হয় নি। আপনি ১৮৫৭ দেখেছেন। কিন্তু ১৯৪৭ দেখলে আপনি আত্মহত্যা করতেন মির্জাসাব। বা হয়তো পূর্বপুরুষদের মতো আপনার হাতেও তরবারি ঝলসে উঠত। এত হত্যা, ধর্ষণ, নেমকহারামি পৃথিবী আর কখনও দেখেনি; ১৯৪৭ থেকে যা শুরু হয়েছিল, শুধু দু’টো দেশের নামে; এক দেশের কবরে আপনি শুয়ে আছেন, অন্য দেশের কবরে আমি।

মির্জাসাব, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, কোথা থেকে কোথায় চলে যাই, এই কবরের ঠাণ্ডাতে শুয়েও মনে হয়, ভিতরে কোথায় ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। আমি তাই অনেকক্ষণ এলোমলো কথা বলছি। কিন্তু আপনার দাদা কুকান বেগ খাঁর কথাই বলছিলাম, তাই না? ভুল হওয়ার কথা নয়। যদিও আমি অনেকদিন জনি ওয়াকার খাই না। পাকিস্থানে এসে তো দিশিই রপ্ত করতে হয়েছিল। আপনি তো ফ্রেঞ্চ ওয়াইন ভালোবাসতেন। শেষকালে রাম ছাড়া। উপায় ছিল না। কিন্তু আসল কথাটা তো বলতে হবে মির্জাসাব, ওই কুকান বেগ খাঁর কথা। ও বাবা, আপনি আবার নড়েচড়ে বসলেন দেখছি। পূর্বপুরুষদের কথা শুনতে খুব ইচ্ছে হয়, না? রক্তে ঘোড়ার খুরের ঝড় ওঠে বুঝি? ভুলতে পারেন না, আপনি একটা ভিখিরি জেলখাটা আদমি? আর কবি গালিবকে কী বলত লোকে? মুশকিল পসন্দ। মনে আছে? কেউ কেউ বলত, মুহমল-গো। কবিটা প্রলাপ বকে। সেই গজলটা আপনার মনে পড়ে?

য়া রব বহ ন সমঝে হৈঁ
ন সমঝেঙ্গে মেরি বাত।
দে উন দিল উনসে, জো ন দে
মুঝকে জবান ঔর।
(ঈশ্বর, তারা আমার ভাষা বোঝে না।
তুমি তাদের অন্য মন দিও।
তা যদি না দাও,
আমাকে অন্য ভাষা দিও।)।

কথার এই এক পাগলামি। আমি তো কথা বলতে শুরু করলে থামতেই পারতাম না। কেন জানেন? মনে হত, যা বলছি তা সবাই বুঝছে তো? আপনার খুতুত্ পড়লে বুঝতে পারি, কথা বলার কী নেশাই না ছিল আপনার। চিঠির পর চিঠিতে আপনি শুধু কথা বলে গেছেন, আপনার চিঠিগুলো পড়তে পড়তেই তো, মির্জাসাব একদিন আপনার গলা শুনতে পেয়েছিলাম আমি। আপনি কি বলেছিলেন, জানেন?

নহ্ গুল-এ নগ্মহ্ হুঁ, নহ্ পরদহ্-এ সাজ,
মৈঁ হুঁ আপনি শিক-কী আবাজ।
(রাগিণীর আলাপ নই, সেতারের তার নই;
আমি কেবল একটা আওয়াজ, পরাজয়ে ভেঙে পড়ার আওয়াজ।)

একজন দণ্ডিত, পরাজিত মানুষকে আমি সেই প্রথম দেখতে পেলাম। মির্জাসাব আপনি কখনও জানবেন না, আমার কত গল্পে তারা এসেছে, যারা নিজের পরাজয়ে ভেঙে পড়া আওয়াজ শুধু, কথা বলতে বলতে তাদের কিছু কিস্যাও আমি শোনাব আপনাকে। তাদের বাদ দিয়ে মান্টো কে? একটা ঝড়ো হাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু এবার কুকান বেগ খাঁর কথাটা বলে নিতেই হবে। আমি বুঝতে পারছি, গল্পটা শোনার জন্য আপনি অপেক্ষা করে আছেন। কবরের মাটি যেমন সব ধুয়ে মুছে দেয়, এইসব গল্পও হয়তো সেভাবে ফতুর হয়ে গেছে। কুকান বেগ খাঁ, আপনার দাদা, এই দেশে এসে লাহোরের নবাবের ফৌজে কাজ নিলেন। এই নবাব বেশিদিন বাঁচেননি। কুকান বেগ খাঁর মতো ভাড়াটে সৈনিক তা হলে কী করবেন? তাঁকে নতুন কোনও নবাব, বাদশা, নিদেনপক্ষে মহারাজা খুঁজে নিতে হবে। ভাড়াটে সেনারা তো এইভাবে রেণ্ডির মতোই বেঁচে থাকে, যতই তাঁর হাতে তলোয়ার ঝকমক করুক। মির্জাসাব ভাড়াটে সেনাদের এই জীবন আপনি জানতেন, তাই তলোয়ারকে পাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। ঠিক কি না, বলুন? মান্টোর মত হারামির চোখকে আপনি ফাঁকি দেবেন কী করে?

আপনার দাদা এবার দিল্লী এসে পৌঁছলেন। হায় আল্লা, কখন? দিল্লী যখন ফতুর হতে বসেছে। আওরঙ্গজেব সব লাটে তুলে দিয়েছিল, তারপর বাইরে থেকে আক্রমণের পর আক্রমণ, বাদশা শাহ আলমের দিল্লী তখন মুঘল সাম্রাজ্যের কঙ্কাল ছাড়া কিছু নয়। মুঘল দরবার তখন একটা বেতো ঘোড়ার মত ধুকছে। শাহ আলমের পঞ্চাশ অশ্বরোহী বাহিনীর সেনাপতি হয়ে জায়গির পেলেও কুকান বেগ খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন, এই দরবারে উন্নতির আশা নেই। তারপর তো জয়পুরের মহারাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পত্তি বেশী কিছু করতে পারেন নি। শুনেছি, আগ্রাতেই এন্তেকাল হয়েছিল তাঁর।

এবার আপনার ওয়ালিদ আবদুল্লা বেগ খান ছুটলেন লখনউতে, নবাব আসফ-উদ-দৌলার বাহিনীতে চাকরি নিতে হল তাঁকে। ভাড়াটে সেনার যা ভবিতব্য হয়; এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ছোটো; নবাব-বাদশাকে খুশি করো, যখনই দেখলে তাঁর সিংহাসন টলোমলো, তখন অন্য নবাব-বাদশার কাছে ছোটো। সেইসব মেয়েদের মতো, মির্জাসাব, যাদের আমি অমৃতসরের কাচ্চা ঘানিয়া, লাহোরের হিরামাণ্ডি, দিল্লীর জি টি রোদ, বম্বের ফরাস রোডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সারা রাতের লড়াই তাদের। মির্জাসাব, তাদের গল্প আমি আপনাদের একদিন বলব; তাদের মাংসের গল্প। তাদের হৃদয়ের গল্প, তাদের ঘাম-রক্ত-চোট-অশ্রুর গল্প। তাদের গল্পগুলো আমাকে দিনের পর দিন খুঁজে ফিরছিল, আর সেইসব গল্পের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি একদিন আল্লাকে বিশ্বাস করেছি; তাদের সারা জীবনের সঙ্গী তিনিই, রহিম- বিসমিল্লা। সেইসব গল্প কেউ বিশ্বাস করতে চায় নি; বলেছে, আমি বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি। তাদের কথা লেখার জন্য আমাকে বেশ্যাদের লেখক -পর্নোগ্রাফার বলা হয়েছে; কিন্তু আমি কী করে চুপ করে থাকব মির্জাসাহাব? এত – এতগুলো-এত হাজার হাজার মেয়ের হিরামাণ্ডি, ফরাস রোডে এসে। দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়েছিল? মির্জাসাব, আমাকে মাফ করবেন, শাফিয়া বেগম, আমার বিবিও বলত, সাদাতসাব আপনি এত এলোমেলো কথা বলেন কেন?

গোস্তাকি মাফ করুন হুজুর, পুরনো কথাগুলো তড়িঘড়ি বলে নিই। ওই যে, কথায় পেয়ে বসলে, আমি যে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাব নিজেই জানি না। লোকজনকে গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে মারতেও বেশ লাগে আমার। একবার রটিয়ে দিলাম, আমেরিকা আমাদের তাজমহল কিনতে আসছে। তার মানে? সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল, তাজমহল কিনবে কী করে? কিনলে নিয়ে যাবেই বা কী করে? আমি বললাম আমেরিকানরা সব পারে, ওরা একটা নতুন যন্ত্র বানিয়েছে, সেই যন্ত্র দিয়েই তাজমহলকে তুলে নিয়ে যাবে। কত লোকে যে কথাটা বিশ্বাস করেছিল, মির্জাসাহেব। বিশ্বাস করবে নাই বা কেন? সবাই তো বিশ্বাস করে, আমেরিকা যা খুশি তাই করতে পারে, আমেরিকা যেন একটা জাদুকর। কাকে বোঝাবেন বলুন, হাতে যন্ত্রপাতি থাকলেই সবকিছু করা যায় না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, এবার তা হলে বলেই ফেলি, লখনউতে আপনার ওয়ালিদ বেশিদিন চাকরি করতে পারেননি। তাঁকে চলে আসতে হল হায়দরাবাদে, নবাব নিজাম আলি খানের বাহিনীতে। তিনশো পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি হলেন। বেশ কয়েক বছর ছিলেন নিজামের বাহিনীতে। কী যে গণ্ডগোল হল- সব ইতিহাস তো লেখা নেই মির্জাসাব, লেখা থাকলেই বা আর কী-আবদুল্লা বেগ চলে এলেন আলোয়ারে। রাও রাজা বক্তওয়ার সিংয়ের সেনাবাহিনীতে। ইতিহাস লেখেনি, কোন যুদ্ধে, কীভাবে আপনার ওয়ালিদের মৃত্যু হয়েছিল। ভাড়াটে সৈন্যদের কথা তো ইতিহাস লেখে না; কিন্তু চমকদার সব ইতিহাস বানানোর জন্য ভাড়াটে সৈন্যদেরই কাজে লাগানো হয়। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, তখন আপনার পাঁচ বছর বয়স।

আপনি এতিম হলেন পাঁচ বছর বয়েসে। ওয়ালিদ নেই মানেই তো এতিম। শুধু আপনি নন, আপনার ভাই ইউসুফ, বোন ছোটি খানম। আপনার ওয়ালিদের কোনও বাড়ি ছিল না। আপনারও সারা জীবনে কোন বাড়ি হয়নি। আগ্রার কালে মহল – আপনার দাদুর বিরাট হাভেলি-আপনাদের তিন ভাই-বোনের শৈশব-কৈশোর কেটেছিল সেখানে, কিন্তু কবে বুঝেছিলেন। বলুন তো, আপনার আসলে কোন বাড়ি নেই? কালে মহলের ভিতরে কেমন দিন কাটত আপনার, জানতে খুব ইচ্ছে করে আমার। আপনার মা, শোকজর্জর মা, জেনানামহলের এককোণে নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকতেন। আমি দেখতে পাই, আপনারা তিন ভাই-বোন তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন, তিনি আপনাদের দু’হাতের ডানায় আঁকড়ে ধরতেন, আর হয়তো বিড়বিড় করে বলতেন, ‘ইয়া আল্লা, ইয়া আল্লা! ইস বাচ্চোকো ইনসাফ করো।

কবরের ভিতরে আপনি এক একদিন ছটফট করছেন দেখতে পাই, আর গোঙাতে থাকেন, আম্মা-মেরি আম্মাজান–’

আমি সেই বেগমের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, যাঁর নাম আমরা কেউ জানি না, আপনার আম্মা ডাকছেন, ‘আসাদ, মেরি জান—‘

-ঘর লে চলল আম্মা।

-কাঁহা?

-কাঁহি হো।

মির্জাসাব, আপনি আবার শুয়ে পড়লেন কেন? আমার কথা শুনতে আপনার ভাল লাগছে না? তা। হলে আপনি কিছু বলুন মির্জাসাব। আমার বখোয়াস ভুলে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *