সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্ট প্রসঙ্গে

সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্ট প্রসঙ্গে

[বিশ্বের অধিকাংশ কমিউনিস্ট পার্টি যখন এই রিপোর্টকে ‘পথ আলোকিত করবে’ বলে অভিনন্দন জানিয়েছিল, তখন কমরেড ঘোষ বলেছিলেন, রিপোর্টের ত্রুটিগুলি যদি সময় থাকতে দূর না করা হয় তবে এটি ‘শোধনবাদের সিংহদ্বার উন্মুক্ত করে দেবে।’]

সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেস সম্পর্কে কেবল বুর্জোয়া দুনিয়ায় নয়, এমনকী কমিউনিস্ট মহলেও তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যত আলোড়নই হোক না কেন, যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যতটা গুরুত্ব দিয়ে একে বিচার করা উচিত ছিল, তা বাস্তবে করা হয়নি। একথার দ্বারা আমরা বলতে চাই যে, কোন তরফ থেকেই dispassionate (আবেগমুক্ত) হয়ে আলোচনা করা হয়নি। যারা বিরোধিতা বা সমর্থন করেছেন কোন পক্ষই তা আবেগমুক্ত পথে করেননি। অন্ধআবেগ বা বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে না পারলে কোন বিষয়েই সত্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও প্রকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই রিপোর্টকে বিশ্লেষণ করা দরকার। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার শুধু যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি করেনি তাই নয়, দুনিয়ার কোন কমিউনিস্ট পার্টিই এখনও পর্যন্ত করেনি। ভবিষ্যতে কেউ তা করবে কিনা, আমরা জানি না।

আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্ট খুঁটিয়ে বিচার করে কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। আমি এখানে ঐ রিপোর্টের উপরই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। এই রিপোর্ট সম্পর্কে অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্যের উপর আলোচনায় যাব না। কিন্তু আমাদের পার্টির সিদ্ধান্তগুলো আলোচনার সময়ও আমাদের কমরেডদের আবেগমুক্ত হওয়া দরকার।

সর্বপ্রথম দেখা যাক সোভিয়েট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে আলোচ্য বিষয় কী কী ছিল? সেগুলি হচ্ছে :

(১) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্মত কিনা।

(২) যুদ্ধের অনিবার্যতার নিয়ম (the law of inevitability of war) আজও বহাল আছে কিনা।

(৩) সমাজতন্ত্রে পৌঁছবার বিভিন্ন পদ্ধতি তথা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছান সম্ভব কি না।

(৪) পুঁজিবাদী দুনিয়ার বর্তমান অবস্থা।

(৫) স্ট্যালিনের রচনা ‘ইকনমিক প্রবলেমস্ অফ সোস্যালিজম ইন দি ইউ এস এস আর’ নামক পুস্তিকার উপর মিকোয়ান ও অন্যান্যদের কতিপয় প্রশ্ন।

(৬) ব্যক্তিপূজাবাদ।

এছাড়াও সোভিয়েট অর্থনীতি সম্পর্কে কিছু কিছু বক্তব্য রিপোর্টে রাখা হয়েছে। তবে সে বিষয়ে এখানে কোন আলোচনা আমরা নিষ্প্রয়োজন মনে করি।

মূল আলোচনা শুরু করার আগে আমি কয়েকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। আমাদের পার্টি গোড়া থেকে বারবার বলে এসেছে যে, গুরুবাদের সাথে মাকর্সবাদের কোন সম্পর্ক নেই। গুরুবাদের বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই কঠোর সমালোচনা করেছি। যদিও মাকর্সবাদ অথরিটির ধারণাকে (authority concept) বাদ দিয়ে চলে না, তথাপি গুরুবাদ যে অথরিটি মানসিকতা (authority sense) থেকেউদ্ভুত, তার সাথে মার্কসবাদের কোন সম্পর্ক নেই, বরং তা পুরোপুরি মার্কসবাদ বিরোধী। আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতি ও সংগঠনপদ্ধতি সম্পর্কে আমরা বহুকাল আগেই সাবধান করেছি। কিন্তু আমরা এমন সিদ্ধান্ত কখনও করিনি যে, এই নেতৃত্ব আর মার্কসবাদী নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটলেও মূলগত দিক থেকে কোন বিচ্যুতি (deviation) ঘটেনি। সেকথা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও প্রযোজ্য।(১) চিন্তাপদ্ধতির ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতা গড়ে উঠলে কি ক্ষতি হয়? যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতির বিশেষ দোষ কি? যান্ত্রিকভাবে অন্ধ সমর্থন জানিয়ে গেলে একজন বড় নেতাও ভুল করে বসতে পারেন। নেতাকে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে নেতা ঠিক করলে ঠিক হয়, নেতা ভুল করলে গোটা পার্টি ভুল করে। ইতিপূর্বের আলোচনায়(২) দেখানো হয়েছে যে, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমেই সবকিছুর বিকাশ ঘটে থাকে। তাই নেতার সাথে যদি কর্মীদের চিন্তার দ্বন্দ্বই না হয়, তাহলে নেতা ও কর্মীদের কারোর চিন্তারই সত্যিকারের বিকাশ হয় না। এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম না থাকলেই আমলাতন্ত্র জন্ম নেয়। ইচ্ছা না থাকলেও যদি কাজের (practice) ক্ষেত্রে চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতকে পরিহার করে চলা হয়, তবে যান্ত্রিকতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। যান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণ নেতৃত্বের মধ্যে অবশ্যম্ভাবীরূপে আমলাতন্ত্র গড়ে তোলে। যেমন আমরা জানি যে, বলবিদ্যার (mechanics) নিয়ম থেকেই ‘প্রাইম মুভার’-এর ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।

পার্টির ক্ষেত্রেও দেখা যায়, সাধারণ যুক্তিবাদী (ফর্মাল লজিক) বিচারপদ্ধতি নিয়ে চললে জ্ঞান সামগ্রিক বা সম্যক হয় না। যান্ত্রিকএবং সাধারণ যুক্তিবাদী পদ্ধতিতে বিচার করলে বড়জোর আংশিক সত্য জানা যায়। যে দল যেকোন পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করতে চায়, তার পক্ষে সাধারণ যুক্তিবাদেরসহজ, সরল ও একদেশদর্শী যুক্তি বিচারের পথ বর্জন করে দ্বন্দ্বমূলক বিচার পদ্ধতির পথ অনুসরণ করা অপরিহার্য। দল যদি আদর্শগত ও সংগঠনগত কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণের নীতি, মুখে না বললেও কাজে অনুসরণ করে চলে, তাহলে আদর্শগত একেন্দ্রীকরণ (ideological centralism) বাস্তবে দলের চিন্তাপদ্ধতির ক্ষেত্রে গুরুবাদের জন্ম দেবে; অপরদিকে সাংগঠনিক একেন্দ্রীকরণ (organisational centralism) দলের মধ্যে আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে তুলবে। প্রথম ক্ষেত্রে কর্মীদের মধ্যে উগ্র গোঁড়া মানসিক প্রবণতা এবং নেতা বা নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের মারাত্মক মনোভাব সৃষ্টি হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় দলের মধ্যে সমস্ত আলাপ-আলোচনার–অর্থাৎ আন্তঃপার্টি আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্য আর সত্য নির্ধারণ থাকে না, তা কার্যত নেতা যা বলেন তাকেই কোন প্রশ্ন না করে সত্য বলে গ্রহণ করার স্তরে, অর্থাৎ সত্য জানার সংগ্রামকে এড়িয়ে যাওয়ার স্তরেই নেমে যায়। এর ফলে দলের ভিতরে চিন্তার ক্ষমতার যথার্থ বিকাশ গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়।

আমরা যখন গণতান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণের কথা বলি, তখন আদর্শগত ও সাংগঠনিক–দুটোর একেন্দ্রীকরণই বুঝিয়ে থাকি; শুধুমাত্র দলের আভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কিছু গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করাকেই বোঝাই না। আমরা বহুদিন আগেই আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন সম্পর্কে বলেছিলাম যে, নেতৃত্বের চিন্তা ও কার্যাবলী মূলত মার্কসবাদ-লেনিনবাদসম্মত হলেও, তা গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত নয়। তাদের চিন্তাপদ্ধতি ও সংগঠনপদ্ধতির ক্ষেত্রে বহুদিন থেকেই যান্ত্রিকতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। আমাদের পুরানো পুস্তিকা থেকে একথার প্রমাণ মিলবে। আমরা বহুদিন আগেই বলেছিলাম যে, এই যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতি ও সংগঠনপদ্ধতির হাত থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সম্পূর্ণ মুক্ত না করতে পারলে টিটোর ঘটনাই শেষ ঘটনা নয়। আমাদের তখনকার এই আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, আজ তা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের শুধু ত্রুটির দিকটাই যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে ভুল করা হবে। এটাই একমাত্র দিক (feature) নয়। এইসব ত্রুটি সত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে এঁরা আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে যথার্থ ও যথাযথ নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। এখন, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতৃত্বের কিছু কিছু ভুলত্রুটির আমরা সমালোচনা করেছিলাম বলে আমাদের দেশের তথাকথিতকমিউনিস্ট বন্ধুরা আমাদের সাহস দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, আমরা আদৌ কমিউনিস্ট কি না! এধরনের প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। কারণ, একথা ক্ষণিকের জন্য ভুলবে চলবে না যে, আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের অভিজ্ঞতার প্রতি আমাদের যেমন যথাযথ মূল্য দিতে হবে, তেমন আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাকে আমরা বর্জন করতে পারি না। নেতৃত্বের সাথে কর্মীদের যদি আদান প্রদানের সম্পর্ক না থাকে, তাহলে অগ্রগতি একেবারেই অসম্ভব। নেতৃত্বকে বিচার করে নেওয়ার শুধু অধিকার থাকাটাই যথেষ্ট নয়, কাজে সেটা প্রয়োগ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসবাদী দলের ক্ষেত্রে দলের ভুলভ্রান্তি রোধ করে সঠিক পথে চলার জন্য এ জিনিস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রেও একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, দলের নেতৃত্বকে বিচার করার বা সমালোচনা করার সময়ও অন্ধ আবেগ থেকে মুক্ত হতে হবে–dispassionate হতে হবে। যাবতীয় বুর্জোয়া ভাবধারার প্রভাব, নিকৃষ্ট ব্যক্তিবাদী প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে এই বিচার করতে হবে। নেতৃত্ব সম্পর্কে এই মনোভাবের বিষয়ে শুধু যে কর্মীদের সজাগ থাকতে হবে, তাই নয়। নেতৃত্বের তরফেও, তার নিজের যথাযথ বিকাশ ও অগ্রগতির জন্য এর চর্চা অপরিহার্য। অর্থাৎ নেতৃত্ব ও কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক ও দায়িত্বের ধারণা হচ্ছে পারস্পরিক (reciprocal)। কিন্তু মার্কসবাদের এই শিক্ষাকে অহরহই ভুলতে দেখা যায়। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের দেখেছি এইভাবে অদ্ভুত যুক্তি করতে—’ও, আপনি কমিনফর্মকে সমালোচনা করছেন? তাহলে আপনি কমিউনিস্ট থাকেন কি করে?’ এধরনের যুক্তির সাথে দ্বান্দ্বিক যুক্তিবিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই–এটা ফর্মাল লজিক এরই একটা বিশেষ ধরনের নমুনা। নেতৃত্ব সম্পর্কে এই মনোভাব যেমন নেতাকে দেবতা বানাতে দ্বিধা করে না, তেমনই আবার পরমুহূর্তে তাকে মাটিতে মেশাতেও কসুর করে না। পরিণাম দু’রকমের হলেও বাস্তবে এই মানসিকতার মধ্যে কাজ করছে। অন্ধতাজনিত একই অ-দ্বান্দ্বিক ফর্মাল লজিক এর দৃষ্টিভঙ্গি! দলে নেতৃত্বের ভূমিকা ও সে বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই ত্রুটি আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা বহুদিন আগেই লক্ষ্য করেছি। আমাদের কর্মীরা জানেন যে, জার্মানি ও চীন সম্পর্কে সি পি এস ইউ’র ভ্রান্ত বিশ্লেষণের কথা আমরা একসময় বলেছিলাম। কিন্তু। সাম্যবাদী শিবিরের অন্তর্গত অন্য কোন পার্টিকেই আমরা সেসময় এবিষয়ে কিছু বলতে দেখিনি–কেউ বলেছে। বলে অন্তত আমরা জানি না। সেদিক থেকে সোভিয়েটপার্টির বিংশতি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত আমাদের হতচকিত করেনি।

তাই ব্যক্তিপূজাবাদের বিরুদ্ধে যে স্লোগান উঠেছে, তাতে আমাদের আনন্দিত হওয়ার বিশেষ কারণ রয়েছে। সেদিক থেকে আমরা বিংশতি কংগ্রেসের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কিন্তু এই অভিনন্দন জানাতে গিয়ে একই সাথে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, যে পদ্ধতিতে এই ব্যক্তিপূজাবাদকে দূর করার চেষ্টা হচ্ছে, তাকে আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমাদের আশঙ্কা যে, ব্যক্তিপূজাবাদকে দূর করার নামে তারা যেন বাস্তবে কোন ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধেই ‘ফাইট’ (লড়াই) করেছেন। নাহলে, যে ব্যক্তিপূজাবাদ দূর করা সম্পর্কে বিংশতি কংগ্রেসে এতখানি গুরুত্ব আরোপ করা হল, সেই ব্যক্তিপূজাবাদ গড়ে ওঠার মূল কারণ (root cause) সম্পর্কে রিপোর্টে কিছুই বলা হয়নি কেন? রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্ট্যালিন নাকি শেষজীবনে ‘প্রাউড’ (অহংকারী), ‘অ্যামবিশাস্’ (উচ্চাকাঙ্ক্ষী), ‘সেল কমপ্লাসেন্ট’ (আত্মসন্তুষ্ট), ইগোইস্টিক (অহংবাদী) ইত্যাদি হয়েছিলেন। কিন্তু কী করে স্ট্যালিনের মতো একজন নেতার মধ্যে এইসব দোষত্রুটি আসা সম্ভব হয়েছিল, কী তার কারণ, কারা এর জন্য প্রধানত দায়ী–সেসব কথা রিপোর্টে আদৌ আলোচনা করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ব্যক্তিপূজাবাদের চর্চা কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব–এই ধারণা ভুল। এমনকী কোন কমিটি বা বডির কার্যাবলীর দ্বারাও ব্যক্তিপূজাবাদ প্রশ্রয় পেতে পারে, যদি সেই কমিটি বা বডির প্রতি কর্মী বা জনসাধারণের অন্ধ আনুগত্যের মনোভাব দূর করার চেষ্টা না করে বরং তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। তাই মনে রাখতে হবে, একজন ব্যক্তিকে ‘ফাইট আউট’ (বিরুদ্ধ তা) করলেই ব্যক্তিপূজাবাদকে দূর করা হয় না।

কয়েকজন লোক একত্রে বসে কাজ করলেই যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। দলের চিন্তার ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, চিন্তার সংঘর্ষ ও আদান-প্রদান কাজ করলেই একমাত্র বলা যাবে যে, দলে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্ট্যালিনের আমলে দলের ভিতরে যৌথ নেতৃত্ব ছিল না বলে ক্রুশ্চেভ নেতৃত্ব যে অভিযোগ তুলেছেন, আমাদের মতে সেটা বড়জোর নিয়মিত মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার (operational aspect) অভাবকেই প্রতিভাত করে–শুধুমাত্র যে দিকটির উপর ভিত্তি করে বলা যায় না যে, স্ট্যালিনের সময়ে দলে যৌথ নেতৃত্ব কাজ করেনি। কার্ল মার্কস ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এক অর্থে এটা ব্যক্তি চিন্তার ফসল। কিন্তু তাই বলে কি ‘ক্যাপিটাল’কে ব্যক্তির মনগড়া পথে (subjective way) চিন্তার ফসল বলব? নাকি বলব যে, একজন ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সমাজ চেতনা (social consciousness) সর্বোত্তম রূপ পেয়েছে–যা বাস্তবে যৌথ নেতৃত্ব। ছাড়া কিছু নয়। তাই কতিপয় লোককে নিয়ে গঠিত কোন কমিটির চিন্তাতে যেমন ব্যক্তিবাদী চিন্তার প্রভাব থাকতে পারে এবং তা বাস্তবে ব্যক্তিবাদী চিন্তাপ্রবণতাকে প্রতিফলিত করতে পারে, তেমনই একজন ব্যক্তির মধ্য দিয়েও দলের সদস্য ও কর্মীদের যৌথ জ্ঞানের (collective knowledge) সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটতে পারে। সমাজচিন্তা যখন দলের সকল সদস্যের যৌথ জ্ঞানের রূপে একজন ব্যক্তির মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে তখন সেটাও যৌথ নেতৃত্ব। আসলে দেখা দরকার, দলের মধ্যে চিন্তার ক্ষেত্রে সত্যিকারের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ জারি আছে কি না। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে, একজন ব্যক্তির মধ্য দিয়ে যদি যৌথ চিন্তা (collective thinking) রূপ নিতে পারে, তাহলে আর যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজন কি? না, তাহলে ভুলভ্রান্তি রোধ করার ক্ষেত্রে গ্যারান্টি আসে না। সেই গ্যারান্টির জন্য আদর্শগত ও সাংগঠনিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে যৌথ কর্মপ্রক্রিয়া শুধু প্রয়োজনই নয়, তা অপরিহার্য। একজন ব্যক্তি, তা তিনি যতবড় বিপ্লবীই হোন না কেন, ভুল করতে পারেন। সে অবস্থায় সাংগঠনিক ক্ষেত্রে (operational side) যৌথ কর্মপ্রক্রিয়া না থাকলে নেতার সেই ভুলের পথ বেয়ে গোটা পার্টি একদিন এমনকী মূল নীতি থেকেও বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। তাই একটি সর্বহারা বিপ্লবী দলে যৌথ কর্মপ্রক্রিয়া ও যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রশ্ন এত গুরুত্বপূর্ণ।

দলের যৌথ নেতৃত্ব বলতে আমরা কি বুঝি? দলের সকল সদস্যের যৌথ জ্ঞানই হচ্ছে দলের যৌথ নেতৃত্ব। (collective knowledge of all the members is the collective leadership of the party)। এই যৌথ জ্ঞান গড়ে ওঠা প্রধানত দলের সভ্য ও কর্মীদের চেতনার মানের উপর নির্ভরশীল। বস্তুত উন্নততর চেতনার মানের উপর ভিত্তি করে যখন দলের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে চিন্তার সংঘর্ষ ও আদান-প্রদান ঘটবে, একমাত্র তখনই যৌথ জ্ঞান গড়ে উঠতে ও বিকাশলাভ করতে পারে। সুতরাং একথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, একটি খুব ভাল গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (constitution) গ্রহণ করলেই গণতান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণ গড়ে ওঠে না। গণতান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণের প্রকৃত ভিত্তি হচ্ছে কমরেডদের উচ্চতর আদর্শগত-সংস্কৃতিগত মান। তা না হলে, হয় কোন একজন ব্যক্তির প্রতি, না হয় অনুরূপভাবে একটি কমিটির প্রতি অন্ধ আনুগত্যের মনোভাব সৃষ্টি হতে বাধ্য। অন্ধভাবে কোন একজন বিশেষ নেতাকে অনুসরণ করা যেমন ব্যক্তিপূজাবাদ, তেমনই অন্ধের মতো কেন্দ্রীয় কমিটিকে অনুসরণ করা অথবা তার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের মনোভাবও ব্যক্তিপূজাবাদের আর এক ধরনের প্রকাশমাত্র। এই সমস্ত দিক বিচার করেই আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, সমস্যার এইসব গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিংশতি কংগ্রেসে আলোচনা করা উচিত ছিল–যা করা হয়নি। তাই ব্যক্তিপূজাবাদকে দূর করার ঘোষণা ও সদিচ্ছা প্রকাশ করা সত্ত্বেও বর্তমান নেতারা পুরানো যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোন ছেদ (break) ঘটাতে পারেননি বলেই মনে হচ্ছে। বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্টকে প্রায় সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টি যেভাবে কোন প্রশ্ন না তুলে নির্বিচারে মেনে নিচ্ছে, তাতে আমাদের এই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণ হচ্ছে।

সোভিয়েটকমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান নেতারা বলছেন যে, ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কমরেড স্ট্যালিনের কোনও বিচ্যুতি দেখা যায়নি। এঁদের বক্তব্য থেকেই পাওয়া যায় যে, লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন সাম্যবাদী আন্দোলনে সর্বপ্রকার বিচ্যুতির বিরুদ্ধে নিরলস আদর্শগত সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। অর্থাৎ, আজ কমরেড স্ট্যালিনের কর্মপ্রণালী সম্পর্কে যেসমস্ত প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, এদের বক্তব্য অনুযায়ীই ১৯৩৪ সালের আগে পার্টিজীবনে এই সমস্যার অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কমরেডস্ট্যালিনের জীবনে পরবর্তীকালে বিচ্যুতির যেসব অভিযোেগ বর্তমান নেতারা তুলেছেন, সেগুলি কেন ও কোন পথ বেয়ে গড়ে ওঠা সম্ভব হল? যেসব। বিচ্যুতির কথা বলা হয়েছে, তার মূল কারণ নির্দেশ করতে না পারলে ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা দূর হবে না। টিটোর ঘটনা সম্পর্কেও আমরা একই কথা বলেছিলাম। ব্যক্তিপূজাবাদ গড়ে ওঠার পিছনকার কারণ কী কী এবং কিভাবে তা দূর করা যায়, সে সম্পর্কে ক্রুশ্চেভের রিপোর্টে কোন কিছুর উল্লেখ নেই। এই দিক থেকে তাঁদের যুক্তি একদেশদর্শিতার দোষে দুষ্ট। ক্রুশ্চেভের অধিকাংশ যুক্তিধারার ক্ষেত্রেই এই একদেশদর্শিতার দোষ লক্ষ্য করা যায়। যেমন তিনি বলেছেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের জন্য স্ট্যালিনকে প্রশংসা করা ভুল, প্রকৃতপক্ষে রেড আর্মিই প্রশংসার পাত্র।” এই ধরনের যুক্তিকে উদ্ভট বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ, স্ট্যালিনের নেতৃত্বকারী ভূমিকাকে স্বীকার করার মানে কখনও রেড আর্মির ভূমিকাকে অস্বীকার করা বোঝায় না। জনসাধারণের ভূমিকা ও অবদান ব্যতিরেকে নেতার নেতৃত্বকারী ভূমিকার কোন প্রশ্নই আসে না। তাই ক্রুশ্চেভের এই বক্তব্যের দ্বারা পরিষ্কার যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই স্ট্যালিনের ভূমিকাকে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। একজন ব্যক্তির বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকাকে যদি স্বীকার না করি, তবে তা উগ্র গণতন্ত্রের (ultrademocracy) ধারণার জন্ম দেবে–যা আবার দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের বিশেষীকৃত ধারণার অবলুপ্তি ঘটাবে।।

প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে অপর ব্যক্তির পার্থক্য আছে যা অনুধাবন করা প্রয়োজন। সেইদিক থেকেই আমরা বলেছি যে, এঁদের যুক্তির ধারা একদেশদর্শিতার দ্বারা প্রভাবিত।

একইভাবে ব্যক্তিপূজাবাদের বিরুদ্ধে তারা যে অস্ত্র ধরেছেন, সেখানেও একটি প্রশ্ন দেখা দিতে বাধ্য। স্ট্যালিনের মধ্যে ব্যক্তিপূজাবাদের প্রবণতা জন্মেছিল একথা যদি আমরা ধরেও নিই, তাহলে এ ব্যাপারে স্ট্যালিনের নিজের দায়িত্বকে যেমন কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না, তেমনই বর্তমান নেতাদের দায়িত্বও কোন অংশে কম নয়। কোন নেতাকে যদি ক্রমাগত অন্ধ সমর্থন জানানো হয়, তাহলে তাঁর ব্যক্তিপূজাবাদের শিকার হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আজকে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আনা হচ্ছে। স্ট্যালিনের কিছু কিছু slip (ত্রুটি) আমাদের নজর এড়ায়নি। কিন্তু যেসমস্ত অভিযোগ স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। সেগুলো সত্য কি না, তা প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট (তথ্য) হাজির করা উচিত ছিল–যা করা হয়নি। যেন ব্যাপারগুলো শুধুমাত্র সি পি এস ইউ-এরই সমস্যা–এই মনোভাব বিরাজ করছে। সি পি এস ইউ ব্যাপারগুলো ‘মনোপোলাইজ’ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্ট্যালিন সংক্রান্ত যেকোন প্রশ্ন কেবল সোভিয়েট ইউনিয়নের নয়–গোটা দুনিয়ার মেহনতী জনগণ ও কমিউনিস্টদের জানার বিষয়। কাজেই এইরূপ একটি গুরুতর বিষয়ে দুনিয়ার কমিউনিস্টদের মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে নিজেরাই এককভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তাদের মোটেই উচিত হয়নি বলে আমরা মনে করি। তারা যদি প্রকৃতই ব্যক্তিপূজাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তরিক হতেন, তাহলে এই আচরণবিধি তাদের মেনে চলা উচিত ছিল।

এপ্রসঙ্গে আর একটি কথা মনে রাখা দরকার। কমিউনিস্টদের প্রতিটিকাজেরই একটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত। উদ্দেশ্যহীনভাবে কোন কাজ করা কমিউনিস্ট চরিত্রের পরিচায়ক নয়। যে ব্যক্তি আজ আর নেই, শুধুমাত্র যাঁর মতবাদ বর্তমান, ব্যক্তিগতভাবে তাকে শোধরাবার বা ফাইট আউট করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। অথচ দেখে মনে হচ্ছে, ব্যক্তিপূজাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নামে তাঁরা আজ যেন মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। করছেন। তা না হলে ব্যক্তিপূজাবাদ গড়ে ওঠার পিছনে তাদের নিজেদের ভূমিকা ও অবদান কী ছিল, সে সম্পর্কেপ্রধানত আলোচনা করাই, আমাদের মতে, তাদের উচিত ছিল। এই ব্যক্তিপূজাবাদ গড়ে ওঠার পিছনকার কারণকে যদি আজও পুরোপুরি উদঘাটিত না করা হয় তাহলে ব্যক্তিপূজাবাদ–যা চরম গুরুবাদেরই মতবাদ–তা এমনকী সিপিএসইউর কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকলাপের দ্বারাও প্রশ্রয় লাভ করতে পারে।

কিন্তু আমাদের এই সমালোচনা থেকে এমন সিদ্ধান্ত করা ঠিক নয় যে, বর্তমান নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল নীতি হতে বিচ্যুত হয়েছে। সে চিন্তা ভ্রান্ত।(৩) তাই যাঁরা প্রশ্ন করেছেন যে, সি পি এস ইউর বর্তমান ত্রুটিকে লক্ষ্য করলে সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার স্বার্থে সি পি এস ইউ-কে ভাঙার প্রয়োজন আছে কিনা, তারা ভুল করছেন। এ চিন্তা মাকর্সবাদ বিরোধী ট্রটস্কিবাদ দ্বারা প্রভাবিত।

প্রথমত, আগেই বলেছি যে, এঁদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূলনীতি হতে মৌলিক বিচ্যুতি ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টিকে মৌলিক বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সোভিয়েট জনগণের ভূমিকাকে অস্বীকার করতে পারি না। জনগণের ভূমিকার ধারণা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে অনেকটাই বস্তুনিষ্ঠ নয় (subjective), কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নে তা বাস্তব সত্য। আমাদের এই সমালোচনার উদ্দেশ্য বর্তমান। নেতৃত্বের ত্রুটি সংশোধন করে তাকে শক্তিশালী করা।

বিংশতি কংগ্রেস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে যদি শুধুমাত্র সোভিয়েট নেতাদের ভূল দেখাতেই সচেষ্ট হই, অথচ তাদের অবদানগুলি না দেখি তাহলে ভুল করা হবে। অপরদিকে যদি শুধু তাদের অবদান দেখি এবং বলি সমস্ত কিছুই সমর্থনযোগ্য, অথচ তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিসম্বন্ধে কিছু না বলি, তাহলেও ভুল হবে। এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গিই ঠিক নয়। যেহেতু পার্টিটা সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি, সুতরাং তাদের ভুল হতে পারে না–এ যুক্তি গুরুবাদের সমতুল্য। সেদিক থেকে সোভিয়েট নেতারাও আমাদের বক্তব্যকে ধীরভাবে বিবেচনা করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। এখন, অন্যান্য বিষয়ের উপর বিংশতি কংগ্রেস যে আলোচনা করেছে তা এক এক করে বিচার করা যাক।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান

পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা পুরোপুরি ঠিক না হলেও তার সঙ্গে আমাদের ব্যাখ্যার সাধারণ সহমত আছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি যে নিছক একটি কূটনৈতিক পাঁচ নয়, তা যে বাস্তব প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত এবং সম্পূর্ণভাবে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতিসম্মত–একথা আমরা বহুদিন আগেই বলেছি। মনে হচ্ছে বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্টে তারা যেন বিষয়টাকে অনেকটা সেভাবেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।(৪)

যুদ্ধের অনিবার্যতার নিয়ম

এই বিষয়ে এঁরা স্ট্যালিনের ব্যাখ্যারই কার্যত পুনরাবৃত্তি করেছেন, অথচ কোথাও স্ট্যালিনের নাম একবারও উচ্চারণ করেননি। তবে, আর একটি দিকও লক্ষ্য করা দরকার। রিপোর্টে সমস্ত বিষয়টিকে কয়েকটি বিভাগে ভাগ করে বিচার করা হয়েছে। এক বিভাগে আলোচনা করে দেখানো হয়েছে–যেহেতু সাম্রাজ্যবাদ আজও বর্তমান এবং যেহেতু সাম্রাজ্যবাদই যুদ্ধের কারণ, সেহেতু ‘পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধের অনিবার্যতার নিয়ম সম্পর্কে লেনিনের সিদ্ধান্ত আজও পূর্বের মতই বলবৎ আছে। কিন্তু আবার অন্য বিভাগে যুদ্ধ মৃত্যুর ন্যায় অবধারিত নয়’ দেখাতে গিয়ে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও শান্তি আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান শক্তিবৃদ্ধির দিকটার প্রতি একতরফা এত বেশি জোর দেওয়া হয়েছে যে, তার থেকেই এমন ভ্রান্ত ধারণা হতে পারে যে, সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যবস্থা রূপে বেঁচে থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ কে চিরকালের মত রোখা সম্ভব। এই ভাগ-ভাগ (compartmentalised) আলোচনার জন্য কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। যেমন রুমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে যে, যুদ্ধ আর একেবারেই হবে না। সেদিক থেকে স্ট্যলিনের অ্যাপ্রোচ (দৃষ্টিভঙ্গি) অনেক বেশি কমপ্রিহেনসিভ (সামগ্রিক) এবং ডায়ালেকটিক্যাল (দ্বান্দ্বিক) বলেই আমরা মনে করি।

স্ট্যালিনের পুস্তিকা ‘সোভিয়েট রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের কতিপয় অর্থনৈতিক সমস্যা’

বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্টে ক্রুশ্চেভ, বিশেষত মিকোয়ান স্ট্যালিনের এই পুস্তিকার কয়েকটি থিসিস্ সম্পর্কে নানারূপ মন্তব্য করেছেন। ক্রুশ্চেভ তার রিপোর্টে লেনিনের উক্তি উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদের চরম সঙ্কটের ফলে উৎপাদনে সম্পূর্ণ মন্দা দেখা দেবে বা উৎপাদন একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাবে–এমন ধারণা অমার্কসবাদী। ক্রুশ্চেভ যদিও কে বা কারা সম্পূর্ণ মন্দার ধারণা পোষণ করেন, তা খোলাখুলিভাবে বলেননি, তবু সমস্ত আলোচনার ধারা লক্ষ্য করলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, কমরেড স্ট্যালিনকেই তিনি বুঝিয়েছেন।(৫) আমাদের এ ধারণা যে অমূলক নয়, মিকোয়ানের রিপোর্টই তার প্রমাণ। মিকোয়ান বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্টকে সমর্থন জানাতে গিয়ে, আমাদের মতে, নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্ট্যালিনের উক্ত পুস্তিকার কতকগুলো থিসিস সম্পর্কে সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ক্রুশ্চেভের মতো পরোক্ষ রাস্তায় না গিয়ে মিকোয়ান সরাসরি স্ট্যালিনের সমালোচনা করেছেন–যেন পুঁজিবাদের চরম সঙ্কটের সময়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদনে সম্পূর্ণ মন্দা বা তা পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার (complete stagna tion or halt in the development of production) কথা স্ট্যালিন বলেছিলেন! কমরেড স্ট্যালিন ঐ পুস্তিকায়, চরম সংকটের সময়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে কারিগরি বিকাশের (technological development) ক্ষেত্রে মন্দা বা স্তব্ধতার কথা আলোচনা করেছেন। যার দ্বারা, আমরা মনে করি, উৎপাদনে সম্পূর্ণ মন্দা বা স্তব্ধতার ধারণা আদৌ সৃষ্টি হতে পারে না। আমরা বুঝি না, ক্রুশ্চেভ এবং মিকোয়ানের মত নেতাদের পক্ষে স্ট্যালিনের উক্ত ব্যাখ্যার এরূপ বিকৃত অর্থ করা কী করে সম্ভব হল! বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করে–যে ব্যাখ্যার সাথে ক্রুশ্চেভও একমত–স্ট্যালিন যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মন্দার প্রবণতা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠেছে। স্ট্যালিন যা বলেননি, সেকথা তার নামে চাপিয়ে দেওয়াকে আমরা গুরুতর অন্যায় মনে করি। এছাড়াও সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্টে পুঁজিবাদী দুনিয়ার সঙ্কটের মধ্যেও উৎপাদনবৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে স্ট্যালিনের একটি বক্তব্যকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করার চেষ্টা মিকোয়ান। করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্ট্যালিনের গোটা বক্তব্য থেকে শেষ লাইনটি বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে মিকোয়ান উপরোক্ত উৎপাদনবৃদ্ধির পরিসংখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে স্ট্যালিনের বক্তব্যের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। স্ট্যালিনের লেখার যে অংশটুকু মিকোয়ান নিয়েছেন, তাহচ্ছে, “since the volume of production in these coun tries will diminish” (যেহেতু এই সমস্ত দেশে উৎপাদনের আয়তন কমবে)। এখানে প্রথম যে অংশটি বাদ GTGTİ 6316, 019600, “However, expansion of production in these countries will proceed on a nar rower basis, since the volume of production in these countries will diminish” (যাই হোক, এইসমস্ত দেশে উৎপাদনের প্রসার সঙ্কুচিতভাবেই ঘটবে যেহেতু এই সমস্ত দেশে উৎপাদনের আয়তন কমবে।)।

তাহলে পরিষ্কার যে, বিশ্ব পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতেও পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক অবস্থায় বিশ্বপুঁজিবাদী বাজারের আরও সঙ্কোচনের ফলে ভবিষ্যতে এই সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে উৎপাদনের আয়তন (volume) কমে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাই স্ট্যালিন আলোচনা করেছেন এবং সেইদিক থেকেই ঐসব দেশে উৎপাদনের প্রসার সঙ্কুচিতভাবেই ঘটবে বলে ব্যাখ্যা করেছেন। শেষের ঐ লাইনে ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে, তারই ইঙ্গিত স্ট্যালিন দিয়েছেন, আজই কী ঘটছে তা বলেননি। কাজেই আজকের পুঁজিবাদী উৎপাদনের সামান্যতম অগ্রগতি লক্ষ্য করে স্ট্যালিনের উক্তিকে ভুল বলা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক। ১৯১৬ সালে বসন্তকালে লেনিনের একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে স্ট্যালিনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাকে ভুল প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে মিকোয়ান লেনিনের ঐ সময়েরই একটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মিকোয়ান বোধহয় ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে গিয়েছিলেন যে, স্ট্যালিন নিজেই আগেই বলেছেন যে, লেনিনের ঐ সিদ্ধান্ত আজকের পরিবর্তিত অবস্থায় আর প্রযোজ্য (valid) নয়। কাজেই লেনিন এপ্রসঙ্গে কী বলেছিলেন তার দ্বারা

স্ট্যালিনের ব্যাখ্যা ভুল বলে প্রমাণিত হয় না, যদি না পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার দ্বারা তাকে ভুল বলে প্রমাণ করা যায়। আর একটা আশ্চর্য দিক একটু সতর্ক হয়ে পড়লেই যেকোন মার্কসবাদীর দৃষ্টি এড়াতে পারে না। স্ট্যালিনের ভুল দেখানো মিকোয়ানকে এমন পেয়ে বসেছিল যে, সেই ভুল দেখাতে গিয়ে তিনি এমনকী ক্রুশ্চেভেরই মূল বক্তব্যের বিরোধিতা করে বসে আছেন। কথাটা একটু পরিষ্কার করেই বলা যাক। যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্কটজনিত অবস্থায় স্ট্যালিন তাঁর নিজের পুঁজিবাদী বাজারের আপেক্ষিক স্থায়িত্ব’ (relative stability of the capitalist market) এবং লেনিনের পুঁজিবাদ পূর্বের তুলনায় অতি দ্রুততালে এগিয়ে চলেছে’(capitalism is growing far more rapid ly than before) এই দুটো থিসিসই তার প্রয়োগক্ষমতা (validity) হারিয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। স্ট্যালিন এই সিদ্ধান্ত করেছেন পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাধারণ সঙ্কট এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার (growing instability) পরিপ্রেক্ষিতে।

সুতরাং বিশ্বপুঁজিবাদী বাজারের আপেক্ষিক স্থায়িত্বের পরিস্থিতিতে যে বক্তব্য সঠিক ছিল, আজ বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত অস্থিরতার দিনে তার মূল্য আর নেই। ক্রুশ্চেভও তাঁর রিপোর্টে বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত অস্থির (unstable) অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় আলোচনা করে দেখিয়েছেন। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার প্রশ্নের সাথেই স্ট্যালিনের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেদিক থেকে মিকোয়ান এমনকী ক্রুশ্চেভের বক্তব্যকেও বিরোধিতা করেছেন। এটা সত্যিই অদ্ভুত! এঁরা হয়। স্ট্যালিনের বক্তব্যকে বুঝতেই পারেননি, অথবা বুঝেও ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বিকৃত করেছেন।

‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ’

ক্রুশ্চেভ প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুন রাষ্ট্র কাঠামো দ্বারা ‘রিপ্লেস’ করার (পাল্টানোর) যে প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন সে সম্পর্কে কোন দ্বিমতথাকতে পারে না। কিন্তু কী উপায়ে তা করা সম্ভব–শান্তিপূর্ণ উপায়ে, নাকি সশস্ত্র গণঅভুত্থানের মারফৎ–এটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোনও কোনও দেশে সমাজতন্ত্র আনা সম্ভব–এই অভিমত এক সময়ে কার্ল মার্ক ব্যক্ত করেন। কিন্তু সেদিন বাস্তব অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। সেদিন পুঁজিবাদী দেশগুলিতেউদীয়মান গণতান্ত্রিক আবহাওয়া। দেখে তিনি অনেক আশা করেছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে যায়। তাই কমরেড লেনিন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান ছাড়া, বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধুলিসাৎ করা। ছাড়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটতে পারে না। একথা আজও প্রযোজ্য। বাস্তব পরিস্থিতিকে সামনে না রেখে কোনও বিষয়ে আলোচনা করা মার্কসীয় নীতি বিরোধী। লেনিনের সময়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের অবশ্যপ্রয়োজনীয়তাকে জনসাধারণের মনে দানা বাঁধাতে পরিস্থিতি সম্পর্কে লেনিনের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বিরাটভাবে কাজ করেছে। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আশপাশের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা লেনিন বলেছিলেন।

শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ক্রুশ্চেভ বলেছেন যে, “যদি পুঁজিবাদীরা রাস্তা ছেড়ে দেয়, কোন প্রকার বলপ্রয়োগ না করে তাহলে কমিউনিস্টরাও বলপ্রয়োগ করবে না। কিন্তু যেহেতু একথা নিশ্চিত যে, তারা বলপ্রয়োগ করবেই তাই আমাদেরও তৈরি থাকা দরকার।” কমিউনিস্টরা রক্তচোষা (blood thirsty) এই মিথ্যাচারের জবাবে তার এই যুক্তি খুবই উপযুক্ত সন্দেহ নেই। তিনি যদি একথা বলেই থামতেন তাহলে ভাল হত। কিন্তু তিনি আরো বলেছেন যে, বর্তমান পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক অবস্থায় অনেকগুলি পুঁজিবাদী এবং পূর্বেকার ঔপনিবেশিক দেশে নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে! আমরা এই চিন্তার সাথে একমত হতে পারিনি। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে একথা আদপেই গ্রহণ করা যায় না। কোন সন্দেহ নেই যে, ক্রুশ্চেভের এই চিন্তা বিভিন্ন দেশের সাম্যবাদী আন্দোলনে শোধনবাদী-সংস্কারবাদী প্রবণতার জন্ম দিতে সাহায্য করবে। প্রত্যেক দেশের কমিউনিস্টরাই এর দ্বারা ভাবতে সুরু করতে পারেন যে, তাদের দেশেই শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সংগঠিত হবে। ফলে বিপ্লবী প্রস্তুতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ হ’ল একটি দিক। অপর আর একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। এ ব্যাপারে ক্রুশ্চেভের নিজের বক্তব্য স্ব-বিরোধিতার দোষে দুষ্ট। একবার তিনি বলেছেন, যেসমস্ত পুঁজিবাদী দেশে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য আছে একমাত্র সেই সমস্ত অত্যন্ত উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতেই (the highly developed capitalist countries where democracy is traditional) শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র আসবে। পরক্ষণেই আবার বলেছেন, একমাত্র “দুর্বল পুঁজিবাদী দেশগুলোর” ক্ষেত্রেই এই পন্থা প্রযোজ্য। আবার আর এক জায়গায় তিনি বলছেন–উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বিপ্লব। অপরিহার্য। এই সমস্ত বক্তব্যের মধ্যে স্ব-বিরোধিতা অত্যন্ত প্রকট। আমরা এই বিষয়ে স্ট্যালিনের বক্তব্যকেই আজও সঠিক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। স্ট্যালিনের বক্তব্য হচ্ছে, “আজ সমাজতান্ত্রিক দেশকে যেভাবে পুঁজিবাদী দেশগুলো ঘিরে আছে, সেই অবস্থার বদলে যখন গুটিকয়েক পুঁজিবাদী দেশকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ঘিরে ফেলবে সেই সুদূর ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন আসতে পারে।” (“The question of establishment of socialism in a peaceful way can arise in that remote future when the present capitalist encirclement will be replaced by a socialist one.”)

কতিপয় অদ্ভুত যুক্তি

একথা বিশেষ করে মিকোয়ানের বক্তব্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ‘শান্তিপূর্ণ ও পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব’–ক্রুশ্চেভের এই মতের সমর্থনে মিকোয়ান ‘বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতি’ সম্পর্কে কতিপয় দেশের উদাহরণ দিয়েছেন। এই উদাহরণ একেবারে অপ্রাসঙ্গিক, অবান্তর ও অচল। কারণ আলোচ্য বিষয় যেখানে পুঁজিবাদ থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব কিনা, সেখানে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে বিপ্লবের অগ্রগত্মি সমর্থনে চীন, চেকোশ্লোভাকিয়া প্রভৃতি দেশের উদাহরণ একেবারেই অচল।। আশ্চর্যের কথা যে, সোভিয়েটকমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসেও এমন স্তরের আলোচনা করা ও উদাহরণ দেওয়া সম্ভব হয়!

পরিশেষে আমি বলব যে, বিংশতি কংগ্রেসে আলোচিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি, যুদ্ধের অনিবার্যতার নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনকে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে এদের ব্যাখ্যা প্রধানত সঠিক এবং তাই সমর্থনযোগ্য।(৬) এদিক থেকে বিচার করলে বর্তমান নেতৃত্বের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে কোন মৌলিক বিচ্যুতি ঘটেনি। তবুও আমরা বলতে বাধ্য যে, তাদের ব্যাখ্যার কিছু কিছু দিক অত্যন্ত গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ। সুতরাং সমস্ত বিষয়কে আবেগমুক্ত মনে ধীরভাবে খুঁটিয়ে বিচার করা দরকার। শুরুতেই বলেছি যে, আমাদের সমালোচনা যেন বন্ধুত্বপূর্ণ সমালোচনা হিসাবেই সকলে গ্রহণ করেন। বর্তমান নেতৃত্বের দুর্বলতাকে দূর করে তাকে শক্তিশালী করাই আমাদের এই আলোচনার একমাত্র উদ্দেশ্য।

প্রথম প্রকাশ :
২৪ জুলাই, ১৯৫৬, গণদাবীতে [সংক্ষিপ্তসার]
২০ মে, ১৯৫৬ ভাষণটি প্রদত্ত হয়।

————-

১। যদিও পরবর্তীকালে এই নেতৃত্ব পুরোপুরি শোধনবাদীতে পরিণত হয়।

২। এই বক্তৃতার আগেই মার্কসবাদ ও দ্বন্দ্বমূলকবস্তুবাদ সম্পর্কে রাজনৈতিক শিক্ষাশিবিরের আলোচনার কথা বলা হয়েছে।

৩। সি পি এস ইউর চরিত্র সম্পর্কে ১৯৫৬ সালে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের সামনে যে অভিজ্ঞতা মজুত ছিল তার ভিত্তিতে এটাই ছিল সেদিন আমাদের দলের মূল্যায়ন। কিন্তু চিন্তাগত ও সাংগঠনিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতাকে প্রতিহত করতে না পারায় ভুল সংশোধনের পরিবর্তে ক্রমাগত ভুল পদ্ধতি অনুসরণের পথ বেয়ে সি পি এস ইউ-এর নেতৃত্ব যে পুরোপুরি শোধনবাদী নেতৃত্বে পরিণত হয়েছে, পরবর্তীকালে কমরেড ঘোষের নেতৃত্বে আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটি তা তুলে ধরে। তবে নেতৃত্ব পুরোপুরি শোধনবাদী নেতৃত্বে পরিণত হল বলে গোটা পার্টিটা সঙ্গে সঙ্গে একটি অমার্কসবাদী পার্টিতে পরিণত হয়েছে–এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না। কারণ যথার্থ শ্রমিক শ্রেণীর দলের নেতৃত্ব শোধনবাদী নেতৃত্বে পরিণত হলেই শ্রমিক শ্রেণীর দলের মূল শ্রেণীগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সাথে সাথে নষ্ট হয়ে যায় না।।

৪। শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতিটি যে একটি কূটনৈতিক প্যাচ নয়, বিংশতি কংগ্রেসের এই বক্তব্যটির সঙ্গে আমরা একমত হলেও পরবর্তী কালের সমস্ত ঘটনা একথা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছে যে, সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান নেতৃত্ব শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতিটির বৈপ্লবিক তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয়–এই নীতিটির সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ায় এরা কার্যত এই নীতিটিকে peaceful capitulation বা শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পনের নীতিতে পরিণত করেছেন।

৫। এঁদের এই উদ্দেশ্য পরে আরও স্পষ্ট হয়ে যায় যখন ক্রুশ্চেভের পরিচালনায় সি পি এস ইউ’র শোধনবাদী নেতৃত্ব কমরেড স্ট্যালিনের সিদ্ধান্তগুলির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আক্রমণ শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ভেসি ইকনমিকির ১নং সংখ্যায় একদল সোভিয়েট অর্থনীতিবিদ দি বেসিক ইকনমিকল’ (মূল অর্থনৈতিক নিয়ম) নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেযখন কমরেড স্ট্যালিনের নানা আর্থিকনীতির বিরুদ্ধে সরাসরি প্রচার করতে থাকেন, তখন কমরেড শিবদাস ঘোষ ঐসব অর্থনীতিবিদদের ভ্রান্ত চিন্তা ও ধ্যানধারণাকে পুরোপুরি উদ্ঘাটিত করে এ ফিউ ইকনমিক প্রবলেমস’ (কিছু অর্থনৈতিক সমস্যা) নামে একটি রচনায় তাদের জবাব দেন। এই লেখাটি প্রথমে সোস্যালিস্ট ইউনিটিতে (ভলুম-৩, নিউ সিরিজ, সেপ্টেম্বর ‘৬২) ও পরে প্রটোরিয়ান এরা-তে (ভল্যুম-৮, সংখ্যা-২০, ১ আগস্ট ‘৭৫ এবং ভল্যুম-৯, সংখ্যা-১, ১৫ আগস্ট ‘৭৫) প্রকাশিত হয়। ৬। আগেই বলা হয়েছে, কমরেড শিবদাস ঘোষের নেতৃত্বে আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটি, পরবর্তীকালে সোভিয়েট পার্টি নেতৃত্বকে শোধনবাদী বলে বর্ণনা করে।

1 Comment
Collapse Comments
Susanta Kumar Patra June 26, 2020 at 12:32 am

Worth reading!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *