সাম্যবাদী শিবিরের আত্মসমালোচনা

সাম্যবাদী শিবিরের আত্মসমালোচনা

[কমিউনিস্ট লিগ অফ যুগোশ্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটোকে কমিনফর্ম থেকে বহিষ্কারের পটভূমিতে লেখা এই প্রবন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের যান্ত্রিক চিন্তা ও সংগঠনপদ্ধতির প্রতি। সেই ১৯৪৮ সালেই কমরেড ঘোষ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, এই অ-মার্কসবাদী যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যার যদি সময়ে সমাধান না করা হয়, তাহলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে প্রকাশ্য বিবাদ অথবা যুদ্ধের। মতো নতুন ঘটনা একদিন বিশ্বের জনগণকে দেখতে হতে পারে। এই হুঁশিয়ারি ভবিষ্যৎবাণীর মতোই পরবর্তীকালে সত্য প্রমাণ হয়।]

বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ও দেশে দেশে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে স্থায়ী শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে সোভিয়েট রাশিয়া ও ইউরোপের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে যে অভূতপূর্ব গণসংগ্রাম ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা নিঃসন্দেহে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে ত্রাসের সঞ্চার করেছে। কিন্তু আপাতবিরোধী মনে হলেও একথা সত্য যে উপরোক্ত উদ্দেশ্যে সংগ্রামরত জনগণের ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী ফ্রন্টের মধ্যে আদর্শ ও চিন্তার ঐক্যের ভিত্তিতে দৃঢ় সংহতির এখনও ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে যে বিপদের সম্ভাবনা আছে তাকে চোখ বুজে থেকে কিংবা ভাসাভাসাভাবে নজর দিয়ে অথবা অস্বীকার করে এড়ানো যাবে না। এসত্যটা যদিও সমস্ত কমিউনিস্টরাই শব্দগত অর্থে (tautologically) মেনে নেন, অর্থাৎ মুখে স্বীকার করেন, কিন্তু বাস্তবে বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বের দিক থেকে বিভিন্ন ভ্রাতৃপ্রতিম সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির প্রতি সম্প্রতি যে মনোভাব প্রতিফলিত হচ্ছে তা শুধু কর্তৃত্বকারী (bossism) মনোভাবই নয়, লৌহশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে কোথাও কোথাও তা অর্থহীন রূঢ়তায় রূপ নিয়েছে। এসব থেকে মনে হচ্ছে, নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ সাম্যবাদী শিবিরের এই সঙ্কট কাটিয়ে তোলার পরিবর্তে বর্তমান অবস্থাকে অদূর ভবিষ্যতে আরো গভীরতর সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দেবে।

বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের বহু সফলতা ও গৌরবময় আত্মত্যাগকে যথাযথ গর্ব ও শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করেও আমরা এর গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাইনি। সমস্ত সত্যিকারের কমিউনিস্টরা যাঁরা আত্মসমালোচনার নাম করে আত্মপ্রতারণায় বিভ্রান্ত হতে না চান বা কোনরকম অন্ধ আবেগ বা বিদ্বেষের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাহায্যে এই সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হবার বিপ্লবী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে চান, তারা এই গুরুতর ত্রুটিগুলিকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। বরং তাঁদের দায়িত্ব একে বিজ্ঞানসম্মতভাবে গভীরে খতিয়ে দেখা।

এই গুরুতর ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি দেখা দেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, বিশ্বসাম্যবাদী শিবিরের বর্তমান নেতৃত্ব বহুলাংশে যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতির দ্বারা প্রভাবিত। এটা আমরা বেশ কিছুদিন যাবৎ অত্যন্ত বেদনা ও উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে আসছি। ঠিক এই কারণের জন্যই বিভিন্ন দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে সম-অধিকার ও শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে পারস্পরিক নির্ভরশীল ও সহায়ক সম্পর্ক গড়ে তোলার মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিটি ক্রমাগত লঙ্ঘিত হয়ে এসেছে; যার ফলে চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী সাম্যবাদী নেতৃত্ব গড়ে ওঠার যে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি মার্কসীয় বিজ্ঞানে ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে স্বীকৃত হয়েছে তা কার্যত পরিত্যক্ত হয়েছে।

লেনিনবাদী নীতিতে একথা যদিও স্বীকৃত যে বিশেষ সময়ে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমিতে বিভিন্ন দেশের বিশেষ বাস্তব রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভিত্তি করে দেশে দেশে যেসব। কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতের পথেই বিপ্লবের সাধারণ আন্তর্জাতিক লাইন গড়ে উঠবে, কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্য করছি যে, বিপ্লবের সাধারণ আন্তর্জাতিক লাইন গড়ে তোলার এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অনুসরণ করার পরিবর্তে কেবলমাত্র একটি-দুটি নেতৃত্বকারী কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির যা বিশ্লেষণ করছে তাকেই, খুঁটিয়ে বিচার বিশ্লেষণ না করেই, আন্তর্জাতিক লাইন হিসাবে গ্রহণ করাটা অভ্যাস ও প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর ফলে, ‘আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব’ সংক্রান্ত কনসেপ্ট বা ধারণা গড়ে তোলার জন্য চিন্তার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের প্রয়োজনকেই কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে। এর ফল স্পষ্টতই বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিয়ে এবং পার্টির সকল সদস্যের মধ্যে এবং নেতা ও কর্মীদের মধ্যে চিন্তার দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পথেই কমিউনিস্ট পার্টিগুলির নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার ছিল, সেখানে বেশিরভাগ পার্টিই যান্ত্রিক একেন্দ্রীকরণের সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছে, যা ফলস্বরূপ পার্টির শীর্ষে আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে।

এই ঘটনা বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের আদর্শগত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে গুরুতর ত্রুটিরই স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। যার প্রমাণ পাওয়া যাবে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ভুল স্বীকারের মধ্যে; যেখানে তারা বলেছে যে, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বিরাট সাফল্য সত্ত্বেও দৈনন্দিন সংগ্রাম। পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলছিল, তা ভুল ছিল ও তা সর্বহারার শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না (এখানে ফ্রান্স, ইটালি, ভারত প্রভৃতি দেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুপরিচিত ‘জনযুদ্ধ তত্ত্ব’-এর প্রয়োগ সম্পর্কে কমিনফর্মের একটি সভায় ঐসব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির বক্তব্য দ্রষ্টব্য)।

আদর্শগত ক্ষেত্রে এই ধরনের ভুলের জন্যই দেখা যাচ্ছে যে, বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছানোর পরে যেসব পার্টির চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা, সেই সন্ধিক্ষণেও সেই সমস্ত পার্টিগুলিকে নতুন করে আবার আদর্শগত সংগ্রাম শুরু করার কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হচ্ছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কিসের জন্য এই সংগ্রাম? পার্টির অভ্যন্তরে কার বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম? আমাদের মতে, আজকের দিনের আদর্শগত সংগ্রামের মূল প্রশ্নটা এখানেই। এতকাল বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টরা সংগঠনের একপেশে রুটিন কাজের উপরই প্রধানত জোর দিয়ে এসেছেন, আদর্শগত চর্চার সাথে যুক্ত করে সংগঠন করার কাজকে একদম গুরুত্ব দেননি। অন্যদিকে নেতারা কর্মীদের শুধু দলের প্রতি দায়িত্ব ও শৃঙ্খলার কথা (যা যান্ত্রিক শৃঙ্খলা ছাড়া কিছু নয়) এবং যেকোন উপায়ে হোক সংগঠন বাড়াবার কথাই বলেছেন।

কিন্তু আজ হিসাব-নিকাশের সময় উপস্থিত। আজ উত্তরোত্তর এই উপলব্ধি ঘটছে যে, এখন পার্টিগুলির মধ্যে ছাঁটাই বাছাই না করলে ভবিষ্যৎ আন্দোলন পরিচালনায় সুষ্ঠু নেতৃত্ব দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হবে। কারণ, এতদিনে বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের বর্তমান নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছেন যে, উদ্দেশ্যের স্বচ্ছ উপলব্ধি ছাড়া অনেকটা অন্ধের মতোই কর্মীরা অশেষ নির্যাতন ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে বিরাট সংগঠন গড়ে তুলেছেন, সেটা বহুলাংশেই শক্ত ভিত্তির উপর গড়ে ওঠেনি; যার ফলে তাদের পরিশ্রমের ফসলকে বিরুদ্ধ শক্তিগুলি (গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের অংশীদার লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা) আত্মসাৎ করতে সক্ষম হচ্ছে। এটা ধরতে পারলেই বোঝা যাবে কেন আজ মার্কসীয় বিজ্ঞানের জ্ঞানকে পার্টির যৌথজ্ঞানে পরিণত করার জন্য আবার নতুন করে আদর্শগত সংগ্রাম শুরু করা হচ্ছে। কিন্তু এসত্ত্বেও এখনও যে পদ্ধতিতে সমালোচনা-আত্মসমালোচনা পরিচালিত হচ্ছে, যেভাবে সমস্যা সম্পর্কে নিতান্তই একপেশে ও যান্ত্রিক বিশ্লেষণপদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, সাম্যবাদী আন্দোলনের অতীত ও বর্তমানের শিক্ষাকে কোনরকম বিরুদ্ধ। চিন্তা ও মতামতের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের সম্মুখীন হওয়ার সুযোগ না দিয়ে বা ইচ্ছে করে তা এড়িয়ে গিয়ে

একতরফা বিচার-বিশ্লেষণের নীতি গৃহীত হচ্ছে এবং তাকেই নির্বিচারে অন্ধের মতো মেনে নেওয়াকে শৃঙ্খলাবোধ। ও গতিশীল মনের পরিচয় বলে প্রশংসা করা হচ্ছে, তাতে আমাদের আশঙ্কা যে, শেষপর্যন্ত এই কমিনফর্ম নেতৃত্বের পক্ষে বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা আদৌ সম্ভব হবে কি না!

এখানে একটি কথা স্পষ্ট বলে যাওয়া দরকার। বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও বর্তমান মূল রাজনৈতিক কর্মসূচির সাথে আমাদের কোন পার্থক্য না থাকলেও, আদর্শগত সংগ্রাম ও সংগঠন পরিচালনার ব্যাপারে নেতাদের কোনরকম ভুল হতে পারে না বা যদি কোন ভুল হয় তবে তাকে আত্মসমালোচনার মনোভাবের ভিত্তিতে দেখাবার চেষ্টা করলেই সাম্যবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করা হয়–এরূপ মনোভাব নিতান্তই অন্ধতার পরিচায়ক এবং তা মার্কসবাদবিরোধী বুর্জোয়া পলায়নী মনোভাবের (escapism) দ্বারা প্রভাবান্বিত বলেই আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি।।

একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, সাম্যবাদী শিবিরের সাথে দীর্ঘ সাহচর্য ও বহু ঐতিহাসিক সংগ্রামের ঐতিহ্য বহন করা সত্ত্বেও মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে যুগোশ্লাভিয়ার পার্টি মার্কসবাদের মূল নীতির সঠিক অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই অতীতে কষ্টস্বীকার ও আত্মত্যাগের রেকর্ড বা ইতিহাসই বর্তমানে সাম্যবাদী আন্দোলন পরিচালনায় নির্ভুলতার একমাত্র গ্যারান্টি নয়; প্রতিনিয়তই এবং সম্ভব হলে প্রতিটি ব্যবহারিক ক্ষেত্রেই পার্টির বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থাকে মার্কসবাদের মূল নীতিগুলির মাপকাঠিতে বিচার করে নিতে হবে। একথা কমরেড স্ট্যালিনের নিম্নোক্ত উক্তি থেকেই স্পষ্ট : ‘without practice theory is sterile and without theory practice is blind.’ অর্থাৎ প্রয়োগবিহীন তত্ত্ব হল বন্ধ্যা, আর তত্ত্ববিহীন প্রয়োগ হল অন্ধ প্রয়োগ। সাংগঠনিক সংহতিকে সুদৃঢ় করার জন্য বর্তমান কমিনফর্ম নেতৃত্বের আহ্বান একদিকে যদিও কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি আবার বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দৃঢ় সংহতিতে নতুন নতুন ফাটল ও চিড় ধরার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে ইটালির কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে বামপন্থী (leftwing) কমিউনিস্ট কর্মীদের সাথে তোগলিয়েত্তির মতপার্থক্যের কথা এবং টিটোর মতবাদের সাথে অভিন্নতার দরুণ গোমুলকাকে পোলিশ ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়ে লেনিন-স্ট্যালিনের শিক্ষা বুলগেরিয়া মানছে না বলে ম্যাসিডােনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির অভিযোগের কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। উপরন্তু, একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতবর্ষে সাম্যবাদী বলে পরিচিত বিভিন্ন পার্টিগুলি, যারা অন্তত মুখে হলেও আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে, তাদের আচার-আচরণ নিয়েও ইতিমধ্যেই গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বর্তমান নানা গুরুতর বিভ্রান্তির মূলে যেসব কারণের কথা বলা হল, তার উপরেও আর একটি দিকের প্রতি এখন থেকেই বিশেষ লক্ষ্য দেওয়া দরকার। তা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে সোভিয়েট পররাষ্ট্রনীতির নির্দেশের সাথে বিশ্বসর্বহারা বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব কর্তব্যের সম্পর্ক কী হবে? তারা কি পরস্পর পরিপূরক, নাকি একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন?

এই প্রশ্নে কমিউনিস্টদের মধ্যে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে। কারও মতে, সোভিয়েট পররাষ্ট্রনীতি ও সোভিয়েটের আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবের নীতি একেবারে আলাদা এবং এই দুইয়ের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। আবার কারও কারও মতে, এই দু’টি শুধু অবিচ্ছিন্নই নয়–এক ও অভিন্ন।

প্রথমোক্ত মতটি ট্রটস্কিবাদ দ্বারা প্রভাবিত এবং দ্বিতীয়টি সাম্যবাদী মহলে অত্যন্ত পরিচিত একটি তত্ত্ব। কিন্তু বাস্তবে সোভিয়েট পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য সোভিয়েটকমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি আবার এই দু’টিকে একেবারে এক ও অভিন্ন করে দেখাও ভুল হবে। কারণ তাহলে সোভিয়েটইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি ও ভূমিকার বৈপ্লবিক তাৎপর্য সঠিকভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে গুরুতর বাধার সৃষ্টি হবে। আসলে এই দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল এবং একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে। সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকে প্রধানত দুটি বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। প্রথমত, সর্বত্র সর্বহারা আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনকে কী করে পরোক্ষভাবে, আবার কোথাও সম্ভব হলে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য ও শক্তিশালী করা যায় তার সুযোগ বা সম্ভাবনাকে খুঁজে দেখা ও কাজে লাগানো।

দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের তথা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল শত্তিগুলির ষড়যন্ত্র, হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের হাত থেকে সোভিয়েটসমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে রক্ষা করা এবং সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখা। কাজেই বিভিন্ন সময়ে সোভিয়েট পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনবোধ থেকে গৃহীত সোভিয়েট রাষ্ট্রের যেকোন। রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক পদক্ষেপকেই আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবের নীতি বলে সিদ্ধান্ত করাটা হবে বিপজ্জনক। অথচ, এই ধরনের ভুল ধারণা ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই আজ সাম্যবাদী শিবিরে নতুন নতুন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।

তাই আমরা যে বিষয়টির উপর আবার জোর দিতে চাই, তা হচ্ছে, সোভিয়েট পররাষ্ট্রনীতির সহজ-সরল গতানুগতিক ব্যাখ্যার পথে, বা নিছক তার বাহ্যিক রূপটি বিচার করে সোভিয়েট ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক বিপ্লবী নীতির তাৎপর্যকে সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। বস্তুত, লেনিন-স্ট্যালিন তাদের শিক্ষাগুলির মধ্যে বহু সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে সংগ্রামকৌশলের যে দিকগুলি রেখে গেছেন এবং যা অক্টোবর বিপ্লবের শিক্ষার মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে, তাকে যথাযথ উপলব্ধি করা ছাড়া সোভিয়েট ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক বিপ্লবী নীতির তাৎপর্যকে আজকের জটিল রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যে সঠিকভাবে বোঝা একান্তই অসম্ভব।

একদিকে ট্রটস্কিবাদীরা যেমন সোভিয়েট পররাষ্ট্রনীতির তাৎপর্যকে ও আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সোভিয়েট ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে বিকৃত করে দেখাচ্ছে, তেমনই আবার বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি, যারা অতীতের তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সাথে যুক্ত ছিল ও বর্তমানে কমিনফর্ম-এর সাথে যুক্ত, তারাও সোভিয়েট ইউনিয়ন অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি, যা লেনিনবাদের সাথে মূলত (basically) সঙ্গতিপূর্ণ, সে সম্পর্কে একটি গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলার দ্বারা গুরুতর ধরনের ভুল করে চলেছে। আর এজন্যই তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে, সোভিয়েটপররাষ্ট্রনীতি ও দেশে দেশে বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে বাস্তবে একটি দ্বন্দ্বও বিরাজ করে। এই পার্টিগুলি সোভিয়েট পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নকে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের প্রশ্নের সাথে গুলিয়ে ফেলছে এবং তার ফলে নতুন নতুন সমস্যা ও জটিলতার সামনে পড়ে তারা ক্রমাগত একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে।

সারা বিশ্বের কমিউনিস্টদের কাছে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে যাঁরা কমিউনিস্ট নামে পরিচিত, তাদের কাছে। আমরা আবেদন করছি যে, আমাদের এই সমালোচনাকে বিরুদ্ধবাদীদের সমালোচনা না মনে করে তারা যেন। একটি আত্মসমালোচনা রূপে গ্রহণ করেন। আমরা যে বিষয়টির প্রতি সমস্ত কমিউনিস্টদের বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি, তাহচ্ছে, সোভিয়েটবা কমিনফর্ম নেতৃত্বের প্রতি অন্ধবিশ্বাস ঐ নেতৃত্বকে দুর্বল করতেই। সাহায্য করবে। আমাদের হাতে রয়েছে বিশ্বসর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, আমাদের সম্পদ হচ্ছে দ্বন্দ্বতত্ত্বের মার্কসীয় বিজ্ঞান যার মানদণ্ডে আমাদের অবশ্যই নেতৃত্বকেও বিচার করে নিতে হবে–তা

সে সোভিয়েট নেতৃত্বই হোক বা কমিনফর্ম নেতৃত্বই হোক একথা ক্ষণিকের জন্য ভুললে চলবে না যে, প্রতিটি কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব উদ্যোগই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনের সক্রিয়তা ও কার্যকারিতার সুদৃঢ় ভিত্তি। চোখ বুজে নেতৃত্বকে শুধু অন্ধ সমর্থন জানিয়ে গেলে কোন নেতৃত্বের পক্ষেই বিশ্ব পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করা ও সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব নয়। টিটো ও অন্যান্য বিভেদপন্থীদের ইতিহাস প্রমাণ করছে যে, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনে চিন্তাপদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি মোটেই ত্রুটিমুক্ত নয় বলে আমরা যে বিশ্লেষণ রেখেছি, তা পুরোপুরি সঠিক। সত্য চাপা দেওয়ার যেকোন প্রচেষ্টাই আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছু নয় এবং বর্তমানের বিভ্রান্তি ও সঙ্কটের দায় সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বকেই বহুলাংশে বহন করতে হবে। সুতরাং প্রতিটি কমিউনিস্ট কর্মীর অবশ্যকর্তব্য হবে, আবেগমুক্ত মন নিয়ে পরিস্থিতিকে বিচার করা এবং সাম্যবাদী আন্দোলনের অতীত ইতিহাস, বর্তমান ধারা ও প্রবণতাগুলি এবং ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া। মনে রাখতে হবে, ট্রটস্কিবাদের সমাধির সাথে সাথে কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা শেষ হয়ে যায়নি। যথেষ্ট সতর্ক না থাকলে বর্তমানে অত্যন্ত জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট শিবিরে নতুন করে বিভেদ সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শুধু তাই নয়, মতাদর্শগত ক্ষেত্রে বর্তমানে যে অমার্কসীয় যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা রয়েছে, তা যদি সময়মত ঠিকভাবে সমাধান না করা হয়, তাহলে বিশ্ব ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না যখন মানুষ দেখবে যে, বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরও কমিউনিস্টরা নিজেদের মধ্যে ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করা এবং বিশ্বসাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি দ্বন্দ্ব কলহে ও এমনকী যুদ্ধ বিগ্রহেও লিপ্ত হয়ে পড়েছে।

মার্কসবাদী হিসাবে আমাদের সর্বদা ও সর্বাগ্রে মনে রাখা দরকার যে, সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতৃত্বে পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে শক্তিশালী করার অত্যুৎসাহে আমাদের এমন কোন কিছুই করা ঠিক নয়, যার দ্বারা বাস্তবে তার ক্ষতি হয়ে যায়।

প্রথম প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ গণদাবীতে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *