শেষ লেখা

শেষ লেখা

গৃহপ্রাঙ্গণে ভবনশিখী পাখা মেলে নেচে বেড়াচ্ছে অতিমুক্তলতার পাশে পাশে। কাল রাত্রে প্রমোদগৃহে যে জাতিপুষ্পের সুগন্ধি মাল্য ব্যবহৃত হয়েছিল, সেটা বাতায়ন-বলভিতে প্রলম্বিত। বোধ হয় পরিত্যক্ত। আর সেটির কী দরকার!

অতিমুক্তলতার ফাঁকে ফাঁকে দূরের নীল শৈলশ্রেণির তুষার-মুকুট চোখে পড়ে। মাসটা চৈত্র, কিন্তু বেশ শীত।

সুন্দরী ভদ্রা প্রাঙ্গণ উত্তীর্ণ হয়ে বহির্ঘারের কাছে এসে তরুণ স্বামীর দিকে অপাঙ্গ দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, রও, তুমি কখন ফিরবে বলে যাও।

নন্দকে অত্যন্ত অনিচ্ছায় যেতে হচ্ছে গৃহ ছেড়ে। তিনি যেতে আদৌ ইচ্ছুক নন। নবপরিণীতা সুন্দরী বধূ প্রাসাদ-অলিন্দে আলুলায়িত-কুন্তল অবস্থায় দণ্ডায়মানা, শাক্যবংশের প্রাসাদ একাই যেন আলো করেছে এই প্রভাতকালে, নবোদিত সূর্যের আলো ম্লান হয়েছে না ওর মুখের সপ্রেম চাহনির আলোয়!

রাজকুমার নন্দ একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলেন। উপায় নেই, যেতেই হবে। কাল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভগবান জিন তথাগত ন্যগ্রোধারাম বিহার থেকে শাক্যদের প্রাসাদের কনিষ্ঠ নন্দের আলয়ে ভিক্ষা করতে এসেছিলেন।

দাদা কতকাল পরে আবার শাক্যদের প্রাসাদ আলো করেছেন ফিরে এসে। মহাপ্রজাপতি গৌতমী যদিও নন্দকে অঙ্কে পেয়েছিলেন প্রৌঢ় বয়সে, তবুও শাক্যকুলগৌরব ভগবান বুদ্ধকে তিনিই মানুষ করেছিলেন তাঁর মাতার মৃত্যুর পর থেকে। কুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে যাওয়ার পরে তাঁর দুঃখের সীমা ছিল না। নন্দকে কোলে পেয়েছিলেন, তাই—নয়তো বাঁচতেই পারতেন না। সুন্দর, সুঠাম, সুশীল নন্দ। তাঁর চোখের পুতুল, তাঁর কতদিনের স্বপ্ন।

মহাপ্রজাপতি গৌতমীর কৈশোরকালের নাম ছিল মায়া। যখন তিনি প্রথমে শাক্যরাজপ্রাসাদে আসেন নববধূরূপে, তার আগেই তাঁর কনিষ্ঠা ভগ্নী মহামায়ার বিবাহ হয়েছিল এখানে। যখন মহামায়ার কোনো পুত্রসন্তান হল না অনেকদিন পর্যন্ত, তখন প্রজারা রাজা শুদ্ধোধনকে পুনরায় বিবাহ দিলে মহামায়ার বড়োদিদি মায়ার সঙ্গে। তারপর মহামায়ার কোলে এলেন সিদ্ধার্থ। তার কতদিন পরে মায়া পেলেন আয়ুষ্মন নন্দকে নিজের ক্রোড়ে।

সেই নন্দ!

কপিলাবস্তু নগরীর সমাজস্থান, চতুষ্পথ, হট্ট, ক্রীড়াস্থান অন্ধকার করে যেদিন রাজকুমার সিদ্ধার্থ গভীর নিশীথে গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন, সেদিন এই নন্দই ছিলেন রাজা শুদ্ধোধনের ও মায়ার একমাত্র ভরসা। নন্দ তখন বালক, দাদা গৃহত্যাগ করাতে তিনি কেঁদে আকুল হয়েছিলেন। বড়ো ভালোবাসতেন তিনি দাদাকে। কপিলাবস্তুর রাজভবন, প্রাচীর, গোপুর ও চত্বর হাহাকারে ভরে গিয়েছিল সেদিন।

ইতিমধ্যে আয়ুষ্মন রাজকুমার নন্দ যৌবনাবস্থায় উপনীত হয়েছেন, জ্যেষ্ঠের গুণগান ও যশ সৌরভ সুদূর কাশী, রাজগৃহ ও পাটলিপুত্র থেকে বাতাসে বহন করে এনেছে কপিলাবস্তুর চতুষ্পথে। ভগবান জিন দেবতা, তিনি মহাবাণী প্রচার করেছেন দিকে দিকে। রাজগৃহের নৃপতি ও শ্ৰেষ্ঠীদের শিরোভূষণ তাঁর সেই দাদার পদপ্রান্তে আনমিত হয়েছে—এ কথাও কত লোকের মুখে মুখে এসে পৌঁছেচে এখানে।

কতকাল পরে সেই তাঁর দাদা প্রত্যাগমন করেছেন কপিলাবস্তুতে। আজ কত আনন্দের দিন শাক্যকুলের! অবশ্য তিনি প্রাসাদে আসেননি, ন্যগ্রোধারাম বিহারে শিষ্যপরিবৃত হয়ে বাস করছেন। কাল সন্ধ্যায় এসেছিলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা আয়ুষ্মন নন্দের আলয়ে ভিক্ষা করতে। ভ্রাতৃবধূ কল্যাণী ভদ্রা অত্যন্ত আদর করে তাকে অন্ন পরিবেশন করেছিলেন, অতিসুস্বাদু অন্ন। যাবার সময় অনেকগুলো সুপক্ক ফল দিয়েছিলেন সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে। ভগবান তথাগত কনিষ্ঠকে আদেশ করে গেলেন—এ ফলগুলো তুমি কাল সকালে নিশ্চয়ই আমার কাছে নিয়ে আসবে। তুমি নিজে এসো। অন্য কারও হাতে পাঠিয়ো না।

তাই আজ রাজকুমার নন্দ সেই ফলগুলি একটি বেতসলতায় প্রস্তুত আধারে রক্ষা করে আধারটি হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে চললেন।

সুন্দরী ভদ্রাকে ছেড়ে নন্দ একদণ্ডও থাকতে পারেন না কোথাও! মাত্র সম্বৎসর অতীত হয়েছে নন্দ বিবাহ করেছেন। নবপরিণীতা কিশোরী পত্নীকে চোখের আড়াল করার সাধ্য নেই নন্দের। দুজনে মিলে একসঙ্গে অঞ্জন, অভ্যঞ্জন, স্নান, গাত্রসংবাহন, আমিষ ও মধু সেবন, চিত্রকর্ম, মাল্যধারণ, ছন্দন-অনুলেপন এইসব চলছে। এই কয়দিনের প্রতিদিনই নন্দ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহাগুরু ভগবান তথাগত জিনকে দর্শন করতে গিয়েছেন—কিন্তু না, বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। সর্বদা ভদ্রার মুখ মনে পড়ে। সমস্ত জগতের মধ্যে ওই একখানি সুন্দর মুখ গড়েছিলেন বিধাতাপুরুষ। ওই একখানি রূপের মধ্যে সারা পৃথিবীর রূপের মঞ্জুষা। ওকে বলে বোঝাতে হয় না, ফুটন্ত ফুলের মতো ওর বাণী ওর রূপের মধ্যেই মুখর হয়ে উঠেছে দিনরাত।

ভগবান জিন বলতেন, নন্দ, এখুনি যাবে?

সলজ্জ শিরঃকম্পনের সঙ্গে নন্দ বলতেন, হ্যাঁ দাদা।

-বেশ, যাও।

ক-দিনই এই ব্যাপারটি লক্ষ করেন প্রশান্তবুদ্ধি, দূরদর্শী মহাপুরুষ, কিছু বলেন। কনিষ্ঠের গমনপথের দিকে স্নেহ ও অনুকম্পার দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখেন।

আজ এত সকালে এখনই যেতে হবে বধূকে ছেড়ে, মন সরছিল না রাজকুমারের। কিন্তু উপায় নেই, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশ লঙঘন করার সাধ্য নেই, যেতে হবেই।

ভদ্রা বললে, কখন আসবে?

—বেলা দু-দণ্ডের মধ্যে।

–ভগবান জিনকে আমার প্রণাম জানিও। আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্যে।

—একসঙ্গে অভ্যঞ্জন করব ফিরে এসে। স্নান ও কেলিও।

ভদ্রার বিশাল নয়ন দুটি কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাততালি দিতে দিতে বললে, খুব ভালো খুব ভালো, শিগগির এসো আয়ুষ্মন, অপেক্ষা করে থাকব তোমার জন্যে–

একটা পেচক কর্কশ রবে হর্মের উপর দিয়ে উড়ে গেল কি?

নন্দ বা ভদ্রা কেউ শুনতে পেলেন না সে রব। সুখী নন্দ, সুমনা ভদ্রা। কপিলাবস্তুর প্রাসাদ শিখরে দিবসের প্রথম প্রহর ঘোষণা করেছে সূর্যদেবের তরুণ কিরণ।

ন্যগ্রোধারাম বিহারে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের প্রভাত-পরিচর্যা সমাপ্ত হয়েছে। ভগবান জিন আজ যেন আগ্রহের দৃষ্টিতে বার বার চাইছেন পথের দিকে।

একজন ভিক্ষুকে বললেন, আবুস, রাত্রে ভালো নিদ্রা হয়নি।

—কেন?

—এ স্থানে কীটের উপদ্রব। এক পাত্র সুবচল রস আমাকে দিয়ে পানের জন্যে। নতুবা অনিদ্রাহেতু শির :পীড়া উপস্থিত হবে।

—আপনার যেমন আজ্ঞা। আপনার ইচ্ছাই তপস্যার আত্যন্তিকী সিদ্ধি।

এমন সময়ে বিনীত হাস্যমুখে রাজকুমার নন্দ জ্যেষ্ঠের পাদবন্দনা করে ফলপূর্ণ করকটি তাঁর সামনে স্থাপন করলেন। ভগবান জিন কনিষ্ঠের মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হে নন্দ, শরীর ভালো?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

—ফলপূর্ণ করকটি কি খুব ভারী?

—আজ্ঞে না।

–ওই ভারটি স্বচ্ছন্দে বহন করলে কেন, বলো তো? অন্য কারও জন্যে কী বহন করতে?

—ভন্তে, না।

—এ কথা সত্যি কিনা?

—হ্যাঁ ভন্তে, এ কথা সত্যি।

-তবে এখন কেন বহন করলে ওটি?

—ভগবান, আপনাকে ভালোবাসি। আপনার কর্মে আমার আনন্দ। কষ্ট হবে কেন?

রাজকুমার নন্দ আরও কিছুক্ষণ পূজনীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। বিহারের এদিকে-ওদিকে গেলেন। এদিকে মন ছটফট করছিল, বেশিক্ষণ আর থাকা চলে না। চক্ষুলজ্জার খাতিরে আরও অর্ধদণ্ড এদিক-ওদিক করতে হল। তারপর ভগবান জিনের পাদবন্দনা ও প্রদক্ষিণ করে বিদায় প্রার্থনা করলেন। হায়, তখন তিনি জানতেন না যে বাজপাখির কবলগত তিনি। বুদ্ধদেব কনিষ্ঠের দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, কোথায় যাবে নন্দ?

—গৃহে।

—গৃহ? গৃহে আসক্ত হয়ো না। কেননা গৃহ—তৃষ্ণা, রাগ, বিবাদ, মনু, মান, স্পৃহা, ভয়, দৈন্য, মন:পীড়া ইত্যাদির নিদান এবং জন্ম-মরণের আলবাল। গৃহ ছেড়ে বাইরে এসেছ আমারই ইচ্ছায়। আমি তোমাকে স্নেহ করি। তোমার মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্ভাবনা রয়েছে। বৃথা গৃহবাসী হয়ে সে সম্ভাবনা নষ্ট করো না। জাগতিক সুখ দু-দিনের, তার জন্যে চিরস্থায়ী সুখকে নষ্ট করবে কেন? আমার ইচ্ছা তুমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করো।

রাজকুমার নন্দের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এ কী সর্বনেশে কথা পূজনীয় জ্যেষ্ঠের মুখে! ভগবান জিন তাঁর সঙ্গে রহস্য করছেন না তো?

বুদ্ধদেব কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে নিরুত্তর দেখে আবার বললেন, কী নন্দ, কথা বললে না যে?

নন্দ অতীব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ভন্তে, আমি সম্প্রতি বিবাহ করেছি, আপনি জানেন। আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবার যোগ্য নই। মন যদি—মানে—সংসারের দিকেই থাকে, প্রব্রজ্যা গ্রহণ করা মিথ্যাচার হবে নাকি? মিথ্যাচারে অভিরুচি হয় না, দেব।

নন্দ জানতেন না মহামানবের বজ্রকঠোর নির্মম দৃষ্টি তাঁর ওপর নিপতিত। পাথরের দেবতার মতো তিনি নির্বিকার, শিষ্যের কোনও দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নন। তাকে তিনি সাধনোজ্জ্বল আত্মার সত্যদৃষ্টি ও নির্বাণ দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যাবে কোথায় বাবাজি?

ধীরে ধীরে বুদ্ধদেব বললেন, শোনো। প্রেম ক্ষণস্থায়ী, অনিত্য। যতদিন যৌবন, প্রেম ততদিন। রমণীর সৌন্দর্যও দু-দিনের। স্বপ্ন-দৃষ্ট ব্যাঘ্র বা অপ্সরী স্বপ্নদ্রষ্টার নিজেরই একটি অংশ। এক অখণ্ড আমিই মোহগ্রস্ত অবস্থায় নিজেকে বহুরূপে দেখছে। জগৎ কোথায়? জগৎ নেই!

রাজকুমার নন্দ আয়ত সুন্দর চক্ষু দুটি তুলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। চক্ষে ব্যাধপীড়িত মৃগের কাতর দৃষ্টি।

ভগবান জিন বললেন, শোনো নন্দ। তোমার কথা মিথ্যা নয়, তুমি ঠিকই বললে। কিন্তু কী জানো, পুরুষকার একটা খুব বড়ো জিনিস। চেষ্টা ছাড়া কিছু হয় না। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে জন্ম বৃথা যাবে, বার বার জন্মমৃত্যুর যূপকাষ্ঠে ব্রাহ্মণদের যজ্ঞীয় পশুর মতো বলি প্রদান করবে নিজেকে নিজে। এ থেকে কোনো দিন উদ্ধার পাবে না, মুক্তি পাবে না। সেটা ভালো, না-এই এক জন্মেই দেহ, কাল ও অহংকাররূপ বস্তুকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে শাশ্বত শান্তি ও আনন্দ লাভ করা ভালো? বলো শুনি।

রাজকুমার নন্দ বললেন, ভন্তে, জন্ম-মৃত্যু নিরোধ করাই ভালো।

—বেশ। তবে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করো। আর গৃহে ফিরে যেয়ো না। এই শুভ মুহূর্তটির প্রতীক্ষাতেই আমি ছিলাম। শুভ মুহূর্ত জীবনে একবার আসে, দু-বার আসে না। হেলায় হারিয়ো না সে মুহূর্ত। যখন সত্যে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন দেখবে। সংসার-সুখ তার কাছে অতিতুচ্ছ।

নন্দ শাক্যকুলজাত ক্ষাত্র বীর। আজ্ঞানুবর্তিকা তো কুলের ধর্ম।

বীরের মতোই তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশে তরুণী পত্নী প্রেমময়ী ভদ্রাকে মন থেকে মুছে ফেলে মাথা নীচু করে ঈষৎ হেসে বললেন, আপনি যা বলেন।

—প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবে?

—আপনি যা বলেন।

—আজই মস্তক মুণ্ডন করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করো। আর একটি কাজ করতে হবে। বড়ো কঠিন কাজ।

—আদেশ করুন।

—ভিক্ষাপাত্র হাতে ভিক্ষা করতে যেতে হবে তোমার জননী ও পত্নীর কাছে। আজই।

—আপনি যা বলেন।

 

এক বৎসর অতীত হয়েছে।

পুনরায় ফাল্গুন মাস। কিংশুক ও চম্পক ফুলের মেলা বসেছে বনে বনে, শৈলসানুতে, অধিত্যকার গর্ভদেশে। প্রকাণ্ড একটি ভেরীর মতো শিমুল বৃক্ষের কাণ্ড বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের নীচে। মাথায় তার ফুটন্ত ফুলের শোভা।

শ্রাবস্তিপুরের জেতবনবিহারে ভগবান তথাগত একটি নাগকেশর বৃক্ষের ছায়ায় বসে শত্রুর পিণ্ড ভোজন করছেন, পার্শ্বে একটি স্থালীতে শালিধানের সিদ্ধান্ন— পুষ্পভদ্রক-বিহারের ভিক্ষুণী উর্মিমাতার প্রেরিত, ভগবান তথাগতের সেবার জন্য।

এমন সময়ে জনৈক ভিক্ষু এসে কাছে দাঁড়াতেই বুদ্ধদেব বললেন, আবুস, কিছু বলবে?

—ভন্তে, নিবেদন আছে।

–বলো।

—ভন্তে, আজ আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভিক্ষু নন্দ আর একজন ভিক্ষুর কাছে বলছিলেন, তিনি গৃহস্থাশ্রমে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক। ব্রহ্মচর্যপালন আর তাঁর দ্বারা নাকি সম্ভব হচ্ছে না।

—কার কাছে বলছিল?

—ভিক্ষু ভেণ ও ভিক্ষু উন্মুকের কাছে।

—আবুস, তুমি আমার নাম করে আয়ুষ্মন নন্দকে বলো, আমি তাকে ডেকেছি। আর সামান্য লবণ পাঠিয়ে দিয়ে ওর হাতে।

—ভন্তে, আপনার যা আজ্ঞা।

আয়ুষ্মন নন্দ জ্যেষ্ঠের ডাক শুনে প্রমাদ গণলেন। সমবয়সি ভিক্ষু উন্মুকের কাছে আজই সকালে দু-একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছিলেন বটে মনের দুঃখে, কিন্তু–

ভগবান জিন কনিষ্ঠের মুখের দিকে স্নেহভরে চেয়ে বললেন, নন্দ, তুমি কারও

কাছে কিছু বলছিলে আজ?

—ভন্তে, বলেছি।

-বলেছ যে ব্রহ্মচর্য পালন করা আর তোমার দ্বারা সম্ভব নয়, তুমি গৃহস্থাশ্রমে প্রত্যাবর্তনে উৎসুক?

—ভন্তে, এ কথা সত্য।

—কারণ কি আমাকে বলবে?

রাজকুমার নন্দ মাথা হেঁট করে নীরব রইলেন। কোনও কথা বললেন না। ভগবান জিন বললেন, লবণ এনেছ?

—ভন্তে, এনেছি।

—স্থালীতে নিক্ষেপ করো।

—যথা আজ্ঞা। এখন বলো, ব্রহ্মচর্য পালন কেন তোমার দ্বারা অসম্ভব? গৃহত্যাগ করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছ, এখন আবার গৃহে ফিরতে চাও কী জন্যে খুলে বলো।

আয়ুষ্মন নন্দ অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে চোখ মাটির দিকে রেখে বলতে আরম্ভ করলেন, ভন্তে, আমার প্রগলভতার জন্যে ক্ষমা করবেন। আমার সংসার ভোগ করার স্পৃহা গেল না। আর একটি কথা, যখন সেদিন ফলপূর্ণ করক-হস্তে আপনার সমীপে ন্যগ্রোধারামে যাই, তখন আপনার ভ্রাতৃবধূ জনপদকল্যাণী গৃহদ্বারে দাঁড়িয়ে সপ্রেম দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বার বার ব্যাকুল স্বরে বলেছিল, ফিরে এসো তাড়াতাড়ি প্রিয়, বিলম্ব করো না যেন। তার সেই আলুলায়িতকুন্তলা মূর্তিতে আজও যেন সে সেই দ্বারে দাঁড়িয়ে আমায় ডাকছে। আমি তার সে মূর্তি ভুলতে পারছি না, দেব। আমায় গৃহস্থাশ্রমে ফিরে যেতে অনুমতি দিন।

বুদ্ধদেব প্রসন্ন হাস্যে বললেন, সাধু আয়ুষ্মন নন্দ, সাধু! তুমি সত্যবাদী, অকপট। এই জন্যেই তোমাকে গৃহের বাহিরে এনেছিলাম। তুমি কুলপুত্র, সত্যজ্ঞানের জন্যে গৃহত্যাগ করে এসে আবার গৃহে ফিরে গেলে অত্যন্ত নিন্দার কথা হবে সেটা। বংশ পতিত হবে। তপস্যা করো, নতুবা জ্ঞান লাভ হবে না। কর্মই কর্মকে জানিয়ে দেবে, ক্রমে আনন্দ ও বল পাবে মনে। আপাতমধুর অনিত্যবস্তুর প্রলোভনে শ্রেয় ত্যাগ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ? যাও, খুব মনোযোগের সঙ্গে চেষ্টা করো।

রাজপুত্র আয়ুষ্মন নন্দ নিজের কুটিরে ফিরলেন। আবার কিছুদিন ধরে একমনে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন চালান অধ্যবসায়ের সঙ্গে। বিনয়গুলি যথাযথ প্রতিপালন করবার চেষ্টায় সারাদিন বেশ কেটে যায়; কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকারে পদচিহ্নহীন প্রান্তরের দিকে চেয়ে মন কেমন করে ওঠে।

মনে হয় কতদূরে সে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাকুল প্রতীক্ষায় সেই গৃহদ্বারটিতে। এখনও সে আশা ছাড়েনি তার। ভদ্রার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। যেদিন ভিক্ষা করতে গিয়েছিলেন, সেদিন রাজাপ্রাসাদে মহাপ্রজাপতি মাতা গৌতমী তাঁকে ভিক্ষা দিয়েছিলেন; কিন্তু ভদ্রা মূৰ্ছিতা ও জ্ঞানহীনা ছিল প্রাসাদকক্ষে, ভিক্ষুর কায়বেশে তাঁর আগমন শ্রবণ করে। আয়ুস্মান নন্দের সঙ্গে ছিলেন ভিক্ষু স্থবির উপালী।

নন্দের ইচ্ছা ছিল পত্নীর মূৰ্ছাভঙ্গের জন্যে অপেক্ষা করেন।

জানবৃদ্ধ স্থবির উপালী অপেক্ষা করতে দেননি নন্দকে। বলেছিলেন, চলো চলো, আয়ুষ্মন। জননীর নিকট ভিক্ষা করলেই বিনয় প্রতিপালিত হল, যাই চলো।

নন্দ রাজপ্রাসাদে চিত্রশিক্ষকের নিকট চিত্রকর্ম শিখেছিলেন, ভালো চিত্র অঙ্কন করতে পারতেন।

কিছুকাল পরে তিনি এক উপায় বার করলেন।

ভদ্রাকে না-দেখে আর সত্যি থাকা যায় না। এক এক নির্জন সন্ধ্যায় মনে হয়, প্রাণ যেন আর দেহের পিঞ্জরে আবদ্ধ থাকতে চাইছে না। ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছে বিনয় প্রতিপালনের শৃঙ্খল থেকে, অষ্টাঙ্গিক মার্গের পাশবন্ধন থেকে, সেই বহুদূরে প্রাসাদ-অলিন্দে, যেখানে এই বসন্তে নাগকেশরবৃক্ষে কুঁড়ি নেমেছে, বকুল ফুল ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ছে শিলাবেদিকায়, অতিমুক্তলতায় কচি রাঙা পত্রের উদগম হচ্ছে ভদ্রা বাতায়ন-বলভিতে পুষ্পমাল্য রেখে একদৃষ্টে তাঁর আগমনপথের দিকে চেয়ে আছে। সেখানেই শান্তি, সেখানেই সুখ। নন্দ এক প্রস্তরফলকে ভদ্রার এক প্রতিমূর্তি আঁকলেন। সেই প্রতিমূর্তির সঙ্গে নির্জনে কথা বলেন, কত হাস্যপরিহাস করেন, কখনও অশ্রুপাত করেন।

অনেক সময় সারারাত্রি এমন ভাবে কাটে। নন্দ আকুলস্বরে স্ত্রীর ছবির দিকে চেয়ে কত প্রেম-সম্বোধন করেন, অনুচ্চস্বরে গান গেয়ে শোনান।

নন্দের কুটিরের কাছাকাছি যেসব ভিক্ষুরা থাকেন, তাঁরা ক্ৰমে ব্যাপারটা জানতে পারলেন।

দু-একজন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষু নন্দকে অনেক প্রবোধ দিলেন, অনেক সদ্ধর্মের উপদেশ দিলেন। দিলে কী হবে, মন মানে না, তিন-চার মাস ধরে ব্যাপারটা সমানে চলতে লাগল। প্রথমে কেউ বুদ্ধদেবের কানে কথাটা তুলতে সাহস করেননি। মঠে বাস করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে এ রকম ব্যবহার সদ্ধর্মের বিরোধী, বিনয়-আচরণের বিরোধী, সাধন-তপস্যার বিরোধী। সর্বাপেক্ষা লজ্জা ও সংকোচের ব্যাপার এই যে, ইনি ভগবান জিন তথাগতের মাতৃসারপুত্র।

কয়েকজন ভিক্ষুতে মিলে যুক্তি ও পরামর্শ করে একদিন একজন বিজ্ঞ ভিক্ষু পদ্মপাদ বুদ্ধদেবের নিকট গিয়ে ধীরে ধীরে নন্দের কাণ্ডকীর্তি সব নিবেদন করলেন।

ভগবান বুদ্ধদেব মনোযোগের সঙ্গে সবটুকু শুনে বললেন, আবুস, আয়ুষ্মন নন্দকে গিয়ে বলুন যে আমি তাকে ডেকেছি।

—ভন্তে, আপনার যা আজ্ঞা।

নন্দ কিছুক্ষণ পরে এসে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে কিছুদূরে বিনীত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

তথাগত বললেন, নন্দ শুনলাম, তুমি পুনরায় ব্রহ্মচর্যে অমনোযোগী হয়েছ, বিনয়গুলি রীতিমতো প্রতিপালন করো না?

—ভন্তে, এ কথা সত্য।

—তুমি পাথরের গায়ে তোমার পত্নীর চিত্র অঙ্কন করে তারই দিকে তাকিয়ে রাত্রিবেলা হাসো কাঁদো?

—ভন্তে, হ্যাঁ।

—কেন এমন আশ্রমবিরুদ্ধ আচরণ করো?

—ভন্তে, এ কথা আমি পূর্বেই আপনাকে নিবেদন করেছি। আপনার ভ্রাতৃবধূ শাক্যানী জনপদকল্যাণীর কথা বিস্মৃত হতে পারছি না, তিনি আমার সমস্ত মন বুদ্ধি অধিকার করে আছেন বলেই আমি ব্রহ্মচর্যে স্থিতিলাভ করতে পারছিনে। আপনি আদেশ করুন, আমি গৃহস্থাশ্রমে ফিরে যাই। আমার কিছুই হচ্ছে না—দু দিকই গেল।

ভগবান জিন স্নেহ ও অনুকম্পার দৃষ্টিতে এই তরুণবয়স্ক কনিষ্ঠ ভ্রাতার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর তাঁকে ইঙ্গিত করলেন নিকটে এসে উপবেশন করতে।

ধীরে ধীরে বললেন, নন্দ, একটা পুরোনো কথা বলি শোনো। যখন উরুবিন্দ্ব গ্রামের অরণ্যে আমি অভিসম্ভোধি লাভ করলাম, তখন আমি ভাবলাম এ ধর্ম সাধারণের কাছে প্রচার করব কিনা। ভোগাসক্ত বিচারশক্তিহীন ভাবপ্রবণ মানবসমূহের পক্ষে ধর্মের এ আদর্শ উপলব্ধি করা অত্যন্ত কঠিন হবে। আমি নিশ্চেষ্ট হয়ে সেই বনে কিছুকাল অবস্থান করি। একদিন সাহস্পতি ব্রহ্মা আমাকে এসে অনুরোধ করেন মানবসমাজের কল্যাণের জন্য এই ধর্ম প্রচার করতে। তাঁরই কথায় আমি পূর্বসিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করি। তারপর মনে ভাবলাম, সর্বাগ্রে কার কাছে এ ধর্ম প্রচার করব? কে বুঝবে?

অনেক চিন্তার পরে আমার দুই পূর্বতন গুরু আবাদ কালাম ও রুদ্রক রামপুত্রের কথা মনে পড়ল। তখনই ধ্যানে বসে দেখলাম, ওই দুই মহাত্মা মাত্র দশ দিন পূর্বে দেহত্যাগ করেছেন। তাহলে উপায়? মানুষ নেই, সবাই তোমার মতো নির্বোধ। তখন আমার পাঁচজন সাধন-সঙ্গীর কথা মনে পড়ল। তাঁরা ছিলেন ঋষিপত্তন মৃগদাবে সাধনারত। এঁদের গিয়ে উপসম্পদা দান করে ধর্মপ্রচারে নিযুক্ত করলাম। শীঘ্রই তাঁরা সত্যতত্বের ধ্যানে সম্পূর্ণ অধিকারী হলেন এবং জনসমাজে সদ্ধর্ম প্রচারের প্রকৃত যোগ্যতা লাভ করলেন। আমিও এই পঁয়ত্রিশ বছর সত্যের প্রচারে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছি। আমার নিজের উপলব্ধি এই যে, শিষ্য নিজের সংযম পবিত্রতা ও তপস্যার দ্বারাই মুক্তিলাভ করে, এ জন্যে চাই তার নিজের দৃঢ় ইচ্ছা ও অধ্যবসায়। আমি তোমাকে শুধু পথ দেখিয়ে দিতে পারি। বাকিটুকু করতে হবে তোমার নিজের উদ্যমে ও সত্যসংকল্পে। এখন কী তোমার অভিরুচি? জীবনের দুঃখের লবণ-জলধি পার হতে চাও, না পথভ্রান্ত নাবিকের মতো ঘুরে বেড়াবে জন্ম-জন্মান্তর ধরে?

নন্দ মাথা নীচু করে বললেন, ভন্তে, আমি অত্যন্ত দুর্বলচেতা। আমি বিনয় প্রতিপালন করতে পারছি না। আমাকে আদেশ করুন, আমি গৃহে ফিরে যাই। আমি আপনার স্নেহের ও কৃপার অযোগ্য।

ভগবান বুদ্ধদেব তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে স্নেহভাজন কনিষ্ঠ ভ্রাতার হস্তধারণ করে বললেন, চলো, এসো আমার সঙ্গে।

অবাক হয়ে গেলেন নন্দ। দাদা তাঁকে নিয়ে নক্ষত্রবেগে উড়ে চলেছেন নীল শূন্যপথ বেয়ে। পদতলে গোটা পৃথিবী লুপ্ত হয়ে গেল। উভয়ে এক অপূর্ব সুন্দর মহাদেশে উপস্থিত হলেন। দিকে দিকে সে দেশের সৌন্দর্যের মোহন লীলা; বিদ্যুতের, জ্যোৎস্নার, রমণীয় পুষ্পরাজির ও সংগীতের সমাবেশে যেন গোটা মহাদেশ স্বপ্নময়। বিদ্রুমবেদী ও হস্থলী স্থানে স্থানে যেন উপবন-মধ্যে বিরাজমান।

এমন সময়ে চারুহাসিনী লজ্জাবতী ঈষত্ৰাস্যময়ী বহু দিব্যনারীকে পরস্পর হাত-ধরাধরি করে অদূরে আবির্ভূতা হতে দেখে নন্দ মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলেন। রূপের জ্যোতিতে ভরিয়ে তুলেছে ওরা দশ দিক।

তারপর জ্যেষ্ঠের দিকে চেয়ে ভয়ে ও বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ভন্তে, এ কোন দেশ? এই দেবীরাই বা কারা?

বুদ্ধদেব বললেন, এ দেশ ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গ। এরা এ দেশের অপ্সরী। কামজয়ী পুরুষ ভিন্ন এরা অন্য কারও দৃষ্টিগোচর হয় না। আচ্ছা নন্দ, বলো দেখি এরা শাক্যানী জনপদকল্যাণী অপেক্ষা অধিক সুন্দরী, না শাক্যানী জনপদকল্যাণী এদের অপেক্ষা সুন্দরী?

মুগ্ধ নন্দ উত্তর দিলেন, ভন্তে, এদের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্যই নেই, তুলনা করা সম্ভবনয়।

—তবুও?

—ভন্তে, এদের তুলনায় শাক্যানী জনপদকল্যাণী নাসিকাকর্ণহীনা মর্কটীর ন্যায়।

—বেশ, শোনো নন্দ, যদি তুমি মনোযোগসহকারে ব্রহ্মচর্য পালন করো, তবে আমি এই সমস্ত অপ্সরী তোমাকে লাভ করিয়ে দেব—প্রতিশ্রুতি দিলাম। এখন চলো, জেতবনবিহারে ফিরে নিষ্ঠার সঙ্গে বিনয় ও ব্রহ্মচর্য অভ্যাস করবে। কেমন তো, রাজি?

নন্দ কেমন যেন হয়ে গিয়েছেন। অদূরে ওই কী কুলাচল পর্বত? এই কী স্বর্গ? আশ্চর্য দেশ! ওখানে কী হেমন্ত ও শিশির ঋতুর চার অষ্টকাতে ভগবান শত্ৰু এই অপরূপরূপসী দেবকন্যাদের সঙ্গে বিহার করেন? মরি মরি, এই পিঙ্গলবর্ণনীবীশোভিতা, চঞ্চলচরণা হাস্যময়ী দেবীগণের অপাঙ্গে যেন শাণিত তির। এদের চরণকমল নূপুরের রিনিঝিনিতে শব্দায়মান, কটিতটস্থ দু-কুরাজি কাঞ্চীকলাপে বিলাসান্বিত, এঁদের ক্ষীণ কটিদেশ কুচযুগের ভারে যেন পরিশ্রান্ত, কমলকোরকের সহিত স্পর্ধাধারী সকটাক্ষ নয়ন যেন সকল পুরুষার্থের সাধক।

বেচারি নন্দ! তাঁর মাথাটি ঘুরে গেল। তিনি সব বিস্মৃত হলেন। ভুললেন কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদ, ভুললেন কল্যাণী জনপদলক্ষ্মী ভদ্রার ব্যাকুল নয়ন দুটি। বললেন, ভন্তে, যদি এঁদের লাভ করতে পারি এমন প্রতিশ্রুতি দেন, তবে আমিও কথা দিলাম, আজ থেকে অতিনিষ্ঠা ও মনোযোগের সঙ্গে বিনয় প্রতিপালন করব।

ভিক্ষুগণ ক্রমে শুনলেন যে ভগবান তথাগতের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নন্দ একপাল দেবকন্যা লাভের আশায় পুনরায় ব্রহ্মচর্য পালনে মনোযোগী হয়েছেন।

এবার অধ্যবসায় আগেকার চেয়ে অনেক বেশি।

দু-চারজন সমবয়সি ভিক্ষু ঠাট্টা করে বলতে লাগলেন, বাহবা নন্দ, ভালো মজুরি বটে! একেবারে একটি দল দেবকন্যা লাভ!

কেউ কেউ বললেন, আরে বাবা, নন্দ বোকা নয়। দাদার কাছ থেকে পুরস্কারটি আগে আদায় করবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে তবে ব্রহ্মচর্য আরম্ভ করেছে। পাকা ঘুঘু নন্দ।

আয়ুষ্মন নন্দ কারও কোনো ঠাট্টা-বিদ্রূপ কর্ণপাত না-করে একাগ্র মনে প্রচণ্ড উৎসাহ ও অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে সাধনা করতে লাগলেন। তাঁর কঠোর আত্মসংযম ও বিনয় প্রতিপালনের দৃঢ়তা প্রৌঢ় ভিক্ষুগণকে পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিল।

 

পাঁচ বৎসর এইভাবে দিনরাত্রি কোথা দিয়ে কেটে গেল, নন্দ তার কোনো খবরইরাখেন না। অদূরবর্তী নির্বিন্ধ্যা নদীর বারিপতনে যেন সত্যতত্বের আভাস ভেসে আসে।সকল প্রকার গার্হস্থ্য সুখের চিন্তা তিনি ক্রমে পরিত্যাগ করলেন। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ-যশ, মুক্তি, বিলোপ ও নির্মললোক প্রভৃতির সমুদয় আশা আকাঙক্ষা ও ঋতুসমূহের পুষ্পস্তবক ফল ও নবীন কিশলয়রাজি বারংবার তাঁর উগ্র তপস্যার সম্মুখে নতমস্তকে অভিবাদন জানিয়ে গেল।

একদিন রজনীর শেষযামে ঊষার অরুণচ্ছটা দিগবলয়ে উঁকি দেবার উপক্রম করেছে, এমন সময় হঠাৎ জেতবন দিব্যজোতিতে পূর্ণ হয়ে গেল। এক দীপ্তিমান দেবতা ধ্যানাসনে উপবিষ্ট ভগবান তথাগতের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন এবং তাঁকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে বিনীতভাবে জানালেন, ভগবান, অদ্য ভগবানের মাতৃসাপুত্র আয়ুষ্মন নন্দ ক্ষীণাঙ্গ হয়ে চেতোবিমুক্তি লাভ করলেন। তাঁর জয় হোক।

ভগবান জিন ঘাড় নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ, এ আমি অবগত হয়েছি।

—আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।

দেবদূতের অন্তর্ধানের অল্প পরেই বনে বনে বিহঙ্গকুল কলরব করে উঠল। ভিক্ষুগণ শয্যা-ত্যাগ করলেন। সূর্যোদয়ের চিহ্ন প্রকাশ পেল পূর্ব আকাশে। ভিক্ষু উপালী প্রতিদিনের মতো নির্বিন্ধ্যা নদীর শীতলজলে অবগাহন স্নান করতে চললেন। ভিক্ষু তিষ্য ভগবান জিনের জন্য দন্তকাষ্ঠ রেখে গেলেন।

এমন সময় অহৎ-জীবনের প্রথম নবীন প্রভাতে আয়ুষ্মন নন্দ ধীর পদবিক্ষেপে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সমীপে উপস্থিত হলেন। নিম্নস্তরে নতমস্তকে নিবেদন করলেন, ভন্তে, আমাকে যে জন্য উপসম্পদা দান করেছিলেন, তা আজ সফল হয়েছে। আমায় আশীর্বাদ করুন।

ভগবান বুদ্ধ বললেন, আমি জানি, নন্দ। তোমার জন্মগ্রহণ অদ্য সার্থক। আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো।

নন্দ বললেন, ভন্তে, আর একটি কথা—

—বলো।

—পূর্বে আমাকে আপনি একটি প্রতিশ্রুতি দান করেছিলেন—

–করেছিলাম।

—ভন্তে, আমার আর তাতে কোনো আবশ্যক নেই।

—অপ্সরাদের তুমি হরণ করতে চাও না?

—ভন্তে, ক্ষমা করবেন। আপনিই আমায় সাংসারিক আসক্তি থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

—তোমার ভ্ৰম, নন্দ। মুক্তি কেউ কাউকে দিতে পারে না। তুমি নিজেই নিজেকে মুক্ত করেছ। আমি শুধু উপায় বলে দিয়েছি মাত্র। আর একটি কথা—

—ভন্তে, বলুন।

—আমি স্বর্গে তোমাকে নিয়ে যাইনি। এখানে এই বৃক্ষতলে বসেই ওই দৃশ্য তোমাকে দেখিয়েছি। যখন দেখলাম, তোমার তরুণ চিত্তবৃত্তি নারীতে আসক্ত, তখন সেই পথেইযাতে তুমি প্রজ্ঞা-বিমুক্তি লাভ করো, তার জন্যে ওই একটি অলীক কল্পনার আশ্রয় আমায় নিতে হয়। ওই সব অপ্সরা কোথাও ছিল না, স্বপ্নে দৃষ্ট গন্ধর্বনারীর মতোই ওই স্বর্গওঅলীক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *