মেঘ-মল্লার
মৌরীফুল
যাত্রাবদল
জন্ম ও মৃত্যু
কিন্নর দল
বেনীগীর ফুলবাড়ি
নবাগত
তালনবমী
উপলখন্ড
বিধুমাস্টার
ক্ষণভঙ্গুর
অসাধারণ
মুখোশ ও মুখশ্রী
নীলগঞ্জের ফালমন্ সাহেব
1 of 2

মুক্তি

মুক্তি

ওর ভালো নাম বোধ হয় ছিল নিস্তারিণী। ওর যৌবন বয়সে গ্রামের মধ্যে অমন সুন্দরী বউ ব্রাহ্মণপাড়ার মধ্যেও ছিল না। ওরা জাতে যুগী, হরিনাথ ছিল স্বামীর নাম। ভদ্রলোকের পাড়ায় ডাকনাম ছিল ‘হরে যুগী’।

নিস্তারিণীর স্বামী হরি যুগীর গ্রামের উত্তর মাঠে কলাবাগান ছিল বড়ো। কাঁচকলা ও পাকাকলা হাটে বিক্রি করে কিছু জমিয়ে নিয়ে ছোটো একটা মনিহারি জিনিসের ব্যাবসা করে। রেশমি চুড়ি ছ-গাছা এক পয়সা, দু-হাত কার এক পয়সা—ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রমে মনে হল, ‘কার’ মানে ফিতে বটে, কিন্তু ‘কার’ কী ভাষা? ইংরেজিতে এমন কোনো শব্দ নেই, হিন্দি বা উর্দুতে নেই, অথচ ‘কার’ কথাটা ইংরেজি শব্দ বলে আমরা সকলেই ধরে নিয়ে থাকি! যাক সে। হরি যুগীর বাড়িতে দু-খানা বড়ো বড়ো মেটে ঘর, একখানা রান্নাঘর, মাটির পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি। অনেক পুষ্যি বাড়িতে, দু-বেলা পনেরো-ষোলোখানা পাত পড়ে। হরি যুগীর মা, হরি যুগীর দুটি ছোটো ভাই, এক বিধবা ভাগনি, তার দুই ছেলে-মেয়ে। সংসার ভালোই চলে, মোটা ভাত, কলাইয়ের ডাল ও ঝিঙে ও লাল ডাঁটাচচ্চড়ির কোনোদিন অভাব হয়নি, গোরুর দুধও ছিল চার-পাঁচ সের। অবিশ্যি দুধের অর্ধেকটা ব্রাহ্মণপাড়ায় জোগান দিয়ে তার বদলে টাকা আসত।

গ্রামের মধ্যে সুন্দরী বউ-ঝির কথা উঠলে সকলেই বলত—’হরে যুগীর বউয়ের মতো প্রায় দেখতে’। গ্রামের নারী-সৌন্দর্যের মাপকাঠি ছিল নিস্তারিণী। গেরস্তঘরের বউ, স্নান করে ভিজে কাপড়ে ঘড়া কাঁকে নিয়ে যখন সে গাঙের ঘাট থেকে ফিরত, তখন তার উদ্দাম যৌবনের সৌন্দর্য অনেক প্রবীণের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিত।

এ গ্রামে একটা প্রবাদ আছে অনেকদিনের।

তুলসী দারোগা নদীর ঘাটের পথ ধরে নীলকুঠির ওদিকে থেকে ঘোড়া করে ফিরবার সময়ে উঁতবটের ছায়ায় প্রস্ফুট উঁত ফুলের মাদকতাময় সুবাসের মধ্যে এই সিক্তবসনা গৌরাঙ্গী বধূকে ঘড়া কাঁকে যেতে দেখল। বসন্তের শেষ, ঈষৎ গরম পড়েছে—নতুবা উঁত ফুলের সুবাস ছড়াবে কেন?

তুলসী দারোগা ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ জাঁহাবাজ দারোগা—’হয়’কে ‘নয়’ করবার অমন ওস্তাদ আর ছিল না। চরিত্র হিসেবেও নিষ্কলঙ্ক ছিল, এমন মনে করবার কোনো কারণ নেই। তুলসী দারোগার নামে এ অঞ্চলে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খেত। তার সুনজরে একবার যিনি পড়বেন, তাঁর হঠাৎ উদ্ধারের উপায় ছিল না এ হেন তুলসী দারোগা হঠাৎ উন্মনা হয়ে পড়ল সুন্দরী গ্রাম্যবধূকে নির্জন নদীতীরের পথে দেখে। বধূটিকে সন্ধান করবার লোকও লাগালে। হরি যুগীকে দু তিনবার থানায় যেতে হল দারোগার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু নিস্তারিণী ছিল অন্য চরিত্রের মেয়ে, শোনা যায় তুলসী দারোগার পাঠানো বৃন্দাবনী শাড়ি সে পা দিয়ে ছুড়ে ফেলে বলেছিল, তাদের কলাবাগানের কল্যাণে অমন শাড়ি সে অনেক পরতে পারবে; জাতমান খুইয়ে বৃন্দাবনী কেন, বেনারসি পরবার শখও তার নেই।

এই ঘটনার কিছুদিন পরে তুলসী দারোগা এখান থেকে বদলি হয়ে চলে যায়।

আর একজন লোক কিন্তু কথঞ্চিৎ সাফল্যলাভ করেছিল অন্যভাবে। গ্রামের প্রান্তে গোসাঁইপাড়া, গ্রামের মধ্যে তারা খুব অবস্থাপন্ন গৃহস্থ—প্রায় জমিদার। বড়ো গোসাঁইয়ের ছেলে রতিকান্ত নদীর ধারে বন্দুক নিয়ে শিকার করতে গিয়েছিল সন্ধ্যার প্রাক্কালে—শীতকাল। হঠাৎ সে দেখলে কাদের একটি বউ ঘড়াসুদ্ধ পা পিছলে পড়ে গেল—খুব সম্ভব তাকে দেখে। রতিকান্ত কলকাতায় থাকত, দেশের ঝি-বউ সে চেনে না। সে ছুটে গিয়ে ঘড়াটা আগে হাঁটুর ওপর থেকে সরিয়ে নিলে, কিন্তু অপরিচিতা বধূর অঙ্গ স্পর্শ করলে না। একটু পরেই সে দেখলে বধূটি মাটি থেকে উঠতে পারছে না, বোধহয় হাঁটু মচকে গিয়ে থাকবে। নির্জন বনপথ, কেউ কোনোদিকে নেই, সে একটু বিব্রত হয় পড়ল। কাছে দাঁড়িয়ে বললে—মা, উঠতে পারবে না হাত ধরে তুলব?

তারপর সে অপরিচিতার অনুমতির অপেক্ষা না-করেই তার কোমল হাতখানি ধরে বললে—ওঠো মা আমার ওপর ভর দিয়ে, কোনো লজ্জা নেই—উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করো তো—

কুণ্ঠিতা সংকুচিতা বধূ ছিল না নিস্তারিণী। সে ছিল যুগীপাড়ার বউ—তাকে একা ঘাট থেকে জল আনতে হয়, ধান ভানতে হয়, ক্ষার কাচতে হয়—সংসারের কাজকর্মে সে অনলস, অক্লান্ত। যেমনি পরিশ্রম করতে পারে, তেমনি মুখরা, আর তেমনি সাহসিকাও বটে। স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের গৌরবে তখন তার নবীন বয়সের নবীন চোখ দুটি জগৎকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে।

সে উঠে দাঁড়াল, রতিকান্তের সঙ্গে কিন্তু কোনো কথা বললে না। বুঝতে পারলে গোঁসাইপাড়ার বাবুদের ছেলে তার সাহায্যকারী। বাড়ি গিয়ে দু-তিন দিন পরে সে স্বামীকে দিয়ে একছড়া সুপক্ক চাঁপাকলা ও নিজের হাতের তৈরি বাঁশশলা ধানের খইয়ের মুড়কি পাঠিয়ে দিলে গোঁসাইপাড়া। বললে—আমার ছেলেকে দিয়ে এসো গে—

নিস্তারিণী সেই থেকে সেই একদিনের দেখা সুদর্শন যুবকটিকে কত কী উপহার পাঠিয়ে দিত। রতিকান্তের সঙ্গে আর কিন্তু কোনোদিন তার সাক্ষাৎ হয়নি, গোঁসাইবাড়ির ছেলে যুগী-বাড়িতে কোনো প্রয়োজনে কোনোদিন আসেনি।

রতিকান্ত কলকাতাতেই মারা গিয়েছিল অনেকদিন পরে। নিস্তারিণীর দু-তিন দিন ধরে চোখের জল থামেনি, এ সংবাদ যখন সে প্রথম শুনলে।

গ্রামের অবস্থা তখন ছিল অন্যরকম। সকলের বাড়িতে গোলাভরা ধান, গোয়ালে দু-তিনটি গোরু থাকত। সবজিনিস ছিল সস্তা। নিস্তারিণীদের বাড়ির পশ্চিম উঠানে ছোটো একটা ধানের গোলা। কোনো কিছুর অভাব ছিল না ঘরে। বরং ব্রাহ্মণপাড়ার অনেককে সে সাহায্য করেছে।

একবার বড্ড বর্ষার দিনে সে বাড়ির পিছনের আমতলায় ওল তুলচে—এমন সময় বাঁড় য্যেবাড়ির মেয়ে ক্ষান্তমণি এসে বললে—ও যুগী-বউ!

নিস্তারিণী অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইলে। বাঁড় য্যেবাড়ির মেয়েরা কখনো তাদের বাড়ির বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলে না। সে বললে—কী দিদিমণি?

—একটা কথা বলব?

—কী, বলো দিদিমণি—

—আমাদের আজ একদম চাল নেই ঘরে। বাদলায় শুকুচ্চে না, কাল ধান ভেজে দুটো চিড়ে হয়েছিল। তোমাদের ঘরে চাল আছে, কাঠাখানেক দেবে?

নিস্তারিণী এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলে, তার খাণ্ডার শাশুড়ি কোনোদিকে আছে কিনা। পরে বললে—দাঁড়াও দিদিমণি—দেবানি, চাল ঘরে আছে। শাশুড়িকে লুকিয়ে দিতি হবে— দেখতি পেলে বড্ড বকবে আমারে। তা বকুক গে, তা বলে বামুনের মেয়েকে বাড়ি থেকে ফিরিয়ে দেব?

আর একবার বাঁড়য্যেবাড়ির বউ তার বৃদ্ধা শাশুড়িকে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল; সে বউ ছিল গ্রামের মধ্যে নামডাকওয়ালা খাণ্ডার বউ শাশুড়ির সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া বাধাত, কেরোসিনের টেমি ধরিয়ে শাশুড়ির মুখ পুড়িয়ে দিয়েছিল। পাড়ার কেউ ভয়ে বৃদ্ধাকে স্থান দিতে পারেনি, যে আশ্রয় দেবে তাকেই বড়ো বউ-এর গালাগালি খেতে হবে। যুগী-বউ দেখলে বাঁড়য্যেবাড়ির বেড়ার কাছে বড়ো সেগুনতলার ছায়ায় ন-ঠাকরুন চুপ করে দাঁড়িয়ে হাপুসনয়নে কাঁদছেন। ওগিয়ে বললেন-ঠাকরুন, আসুন আমাদের বাড়ির দাওয়াতে বসবেন–বড়ো বউ বকেছে বুঝি?

ন-ঠাকরুন শুচিবেয়ে মানুষ, তা ছাড়া বাঁড় য্যেবাড়ির গিন্নি হয়ে যুগী-বাড়ি আশ্রয় নিলে মান থাকে না। সুতরাং প্রথমে তিনি বললেন—না বউ, তুমি যাও, আমার কপালে এ যখন চিরদিনের, তখন তুমি একদিন বাড়িতে ঠাঁই দিয়ে আমার কী করবে! নগের বউ যেদিন চটকতলায় চিতেয় শোবে, সেদিনটি ছাড়া আমার শান্তি হবে না মা। ওই ‘কালনাগিনী’ যেদিন আমার নগের ঘাড়ে চেপেচে–

নিস্তারিণী ভয়ে ভয়ে বললে—চুপ করুন ন-গিন্নি, বউ শুনতি পেলি আমার ইস্তক রক্ষে রাখবে না। আসুন আপনি আমার বাড়িতে, এইখানে দাঁড়িয়ে কষ্ট পাবেন কেন মিথ্যে—

ন-গিন্নিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে সে নিজের হাতে তাঁর পা ধুয়ে দিয়ে সিঁড়ি পেতে দাওয়ায় বসালে। কিছু খেতে দেওয়ার খুব ইচ্ছে থাকলেও সে বুঝলে, বড়ো ঘরের গিন্নি ন-ঠাকরুন এ বাড়িতে কোনো কিছু খাবে না, খেতে বলাও ঠিক হবে না, সে ভাগ্য সে করেনি।

অনেক রাত্রে গিন্নির বড়ো ছেলে নগেন খুঁজতে খুঁজতে এসে যখন মায়ের হাত ধরে নিয়ে গেল, তখন নিস্তারিণী অনেক অনুনয়-বিনয় করে বড়ো একছড়া মর্তমান কলা তাঁকে দিয়ে বল্লে—নিয়ে যান দয়া করে। আর তো কিছুই নেই, কলাবাগান আছে, কলা ছাড়া মানুষকে হাতে করে আর কিছু দিতে পারিনে—

তার স্বামী সে-বার রামসাগরের চড়কের মেলায় মনিহারি জিনিস বিক্রি করতে গেল। যাবার সময় নিস্তারিণী বললে—ওগো, আমার জন্যি কী আনবা?

—কী নেবা বলো? ফুলন শাড়ি আনব?

-না, শোনো, ওসব না। একরকম আলতা উঠেচে আজ মজুমদার-বাড়ি দেখে এলাম। কলকেতা থেকে এনেচে মজুমদারমশায়ের ছেলে—শিশিনিতে থাকে। কী একটা নাম বললে, ভুলে গিইচি।

—শিশিনিতে থাকে?

—হ্যাঁ গো। সে বড়ো মজা, কাটির আগায় তুলে দেওয়া, তাতে করে মাখাতে হয়। ভালো কথা, তরল আলতা—তরল আলতা—

—কত দাম?

—দশ পয়সা। হ্যাঁগা, আনবে এক শিশিনি আমার জন্যি?

—দ্যাখব এখন। গোটা পাঁচেক টাকা যদি খেয়েদেয়ে মুনাফা রাখতি পারি, তবে এক শিশিনি ওই যে কী আলতা—তোর জন্যি ঠিক এনে দেব।

এইভাবে গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ার সাথে টেক্কা দিয়ে নিস্তারিণী প্রসাধনদ্রব্য ক্রয় করেছে। তাদের পাড়ার মধ্যে সে-ই তরল আলতা পায়ে দেয়। শূদ্রপাড়ার মধ্যে ও জিনিস একেবারে নতুন—কখনো কেউ দেখেনি। আলতা পরবার সময়ে যে দেখত সে-ই অবাক হয়ে থাকত। হাজরি বুড়ি মাছ বেচতে এসেচে একদিন—সে অবাক হয়ে বললে—হ্যাঁ বড়োবউ, ও শিশিনিতে কী? কী মাখাচ্চ পায়ে?

নিস্তারিণী সুন্দর রাঙা পা দু-খানি ছড়িয়ে আলতা পরতে বসেছিল, একগাল হেসে বললে—এ আলতা দিদিমা। এরে বলে তরল আলতা।

—ওমা, পাতা আলতাই তো দেখে এসেচি চিরকাল। শিশিনিতে আলতা থাকে, কখনো শুনিনি। কালে কালে কতই দ্যাখলাম। কিন্তু বড়ো চমৎকার মানিয়েছে তোমার পায়ে বউ—এমনি টুকটুকে রং, যেন জগদ্ধাত্রী পিরতিমের মতো দেখাচ্চে–

এসব ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা।

 

শীতের সকালবেলা। ওদের বড়ো ঘরের দাওয়ায় হেঁড়া মাদুরে হেঁড়া কাঁথা গায়ে নিস্তারিণী শুয়ে আছে। সংসারের সাবেক অবস্থা আর নেই, হরি যুগী বহুদিন মারা গিয়েছে—হরি যুগীর একমাত্র ছেলে সাধনও আজ তিন-চার বছর একদিনের জ্বরে হঠাৎ মারা গিয়েছে। সুতরাং নিস্তারিণী এখন স্বামীপুত্রহীনা বিধবা। তার শাশুড়ি এখনও বেঁচে আছে, আর আছে এক বিধবা জা, জায়ের এক মেয়ে, এক ছেলে।

পঁয়ত্রিশ বছর আগের সে উচ্ছলযৌবনা সুন্দরী গ্রাম্য বধূটিকে আজ আর রোগগ্রস্তা, শীর্ণকায়া, মলিনবসনা প্রৌঢ়ার মধ্যে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। হরি যুগীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সে গোয়ালভরা গোরু ও গোলাভরা ধান অন্তর্হিত হয়েছে —ঘরের চালে খড় নেই, তিন-চার জায়গায় খুঁচি দেওয়া খসে-পড়া চালে বর্ষার জল আটকায় না। গত বর্ষায় চালের ওপর উচ্ছেলতা গজিয়ে একদিকে ঢেকে রেখেচে, মাটির দাওয়ার খানিকটা ভেঙে পড়েছে, পয়সার অভাবে সারানো হয়নি। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলে। সংসারের কর্তা, যার আয়ে সংসারের শ্রী, সে চলে যাওয়ায় নিস্তরিণীর আদর এ বাড়িতে আর নেই। আগে ছিল সে-ই সংসারের কী, এখন তাকে পরের হাত-তোলা খেয়ে থাকতে হয়—তার ছেলে সাধন বাপের মনিহারি দোকান আর কলাবাগান কোনোরকমে বজায় রেখেছিল।

তিন বছর আগের এক ভাদ্র মাসে খুব বৃষ্টির পরে সাধন নদীর ধারে কলাবাগানে কাজ করতে গিয়ে সেখানে মারা যায়। কেন মারা যায় তার কারণ কিছু জানা যায়নি। সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধন ফিরল না দেখে তার ঠাকুরমা নাতিকে খুঁজতে বার হচ্ছে, এমন সময় বেলেডাঙার দুজন মুসলমান পথিক এসে খবর দিলে— সাধন মুখ খুঁজড়ে কলাবাগানের ধারের পথে কাদার ওপরে পড়ে আছে—দেহে বোধ হয় প্রাণ নেই।

সকলে ছুটতে ছুটতে গেল। গ্রামের লোক ভেঙে পড়ল। সকলে গিয়ে দেখলে সাধন সত্যিই উপুড় হয়ে কাদার ওপর পড়ে, সর্বাঙ্গে কাদা মাখা, তার ওপর দিয়ে এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে। যেখানে শুয়ে আছে সেখানটা রক্ত পড়ে অনেকখানি জায়গা রাঙা, খানিকটা বৃষ্টির জলে ধুয়েও গিয়েছে। রক্তটা পড়েছে সাধনের মুখ থেকে।

গরিবের ঘরের ব্যাপার, দু-দিনেই মিটে গেল। সংসারের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ল; ক্রমে বাড়িতে উপার্জনক্ষম পুরুষমানুষের মধ্যে বাকি কেবল হরি যুগীর ভাই যুগলের ছেলে বলাই। যুগলও বহুদিন পরলোকগত দাদার মৃত্যুর পর বৎসরেই সে বিধবা স্ত্রী ও দু-বছরের শিশুপুত্রকে রেখে মারা যায়। বলাই এখন ষোলো বছরের, বেশ কর্মঠ, স্বাস্থ্যবান বালক।

নিস্তারিণীকে এখন আদর করে ‘নিস্তার’ বা ‘বড়োবউ’ বলে কেউ ডাকে না—যে ডাকত সে নেই। এখন তার নাম ‘সাধনের মা’। কেউ ডাকে পিন্টুর ঠাকুমা। পিন্টু সাধনের শিশুপুত্র—এখন তার তিন বছর বয়েস। সাধনের বিধবা বউ-এর বয়স এই সবে সতেরো।

নিস্তারিণী ডাক দিল ও পিন্টু, পিন্টু—

পিন্টু উঠানের আমতলায় খেলা করছিল, কাছে এসে বললে—কী ঠাকুমা?

—তোর মাকে একবার ডেকে দে—

পিন্টুর ডাকে তার মা এসে দাওয়ার ধারে দাঁড়িয়ে বললে—কী হয়েছে, ডাকচ কেন?

—আমি আজ দুটো ভাত খাব, বল তোর ঠাকুরমাকে—

পুত্রবধূ ঝংকার দিয়ে বললে—ভাত বললিই অমনি ভাত! খাবা কোথা থেকে? সে আমি বলতে পারব না ঠাকুরমাকে।

—তবে একগাল খই কী চিড়েভাজা যা হয় দে এখন—খিদেয় মলাম—

—হ্যাঁ, আমি তোমার জন্যি বামুনপাড়ায় বেরুই লোকের দোরদোর। অসুখ হয়েচে চুপ করে শুয়ে থাকো বাপু।

ওরা ওইরকম। সাধনের বউ মুখঝংকার দেয়, তাকে একেবারেই মানে না। সেকালের আর একালের মেয়েতে কী তফাত, তাই সে ভাবে এক-এক সময়ে। তারও একদিন সতেরো বছর বয়স ছিল, কখনো শাশুড়ির একটা কথার অবাধ্য হতে সাহস হত তার? আশ্চর্যি!

একটু পরে নিস্তারিণীর শাশুড়ি এসে দূরে দাঁড়িয়ে বললে—বলি হ্যাঁ বউ, তোমার আক্কেলখানা কী? আজ নাকি ভাত খেতে চেয়েচ? জ্বর রয়েচে চব্বিশ পহরের জন্যি, ভাত খেলেই হল অমনি?…বলি সোয়ামি খেয়েচ পুঙুর খেয়েচ, দেওর খেয়েচ—এখনো খাওয়ার সাধ মেটেনি তোমার?

নিস্তারিণী বড়ো দুর্বল হয়ে পড়েছে অসুখে—তবু সে বললে, সোয়ামি পুত্তুর তো তুমিও খেয়েছিলে, তবুও তিন পাথর করে ভাত মারো তো তিনটি বেলা! লজ্জা করে না বলতি!

নিস্তারিণীর শাশুড়ি একথার উত্তরে চীৎকার করে গালাগালি দিয়ে এক কাণ্ডই বাধালে। সাধনের বউকে ডেকে বলে দিলে—ওকে কিছু খেতে দিবিনে আজ বলে দিচ্চি। এ সংসারে যে খাটবে সে খাবে। আমরা সবাই মায়ে-ঝিয়ে খাটি, ও শুধু শুয়ে থাকে। রোগ নিয়ে শুয়ে থাকলি এ সংসারে চলে না। তার ওপর আবার যে সে রোগ নয় ওকে বলে পাণ্ডুর রোগ। মুখ হলদে, চোখ হলদে, হাত-পা ফুলেচে, ও কী সহজ রোগ! ও আর উঠবেও না, খাটবেও না, কেবল শুয়ে শুয়ে পাথর পাথর খাবে!

নিস্তারিণী বললে—খাব—খাব, বেশ করব। আমার খোকা কলাবাগান সামলে রাখত, তারই আয়ে বাড়িসুদ্ধ খাওনি? সেই কলাবাগান তদবির করতে গিয়েই বাছা আমার চলে গেল। তোমরা ওদের বাপ-ছেলের রক্ত-জল-করা কলাবাগান, মনিহারি ব্যাবসা ঘোচালে, এখন আমায় বসিয়ে খেতে দেবে না তো কী করবে? নিশ্চয়ই দিতে হবে।

—বাসি আখার ছাই খেতে দেব। ডাইনি রাক্ষুসি—আমার সংসার তোর দিষ্টিতে জ্বলে পুড়ে গেল! নইলে কী না ছেল, গোলাভরা ধান ছেল না? হাঁড়ি ভর্তি ডালডুল, গোয়াল–ভর্তি গোরুছাগল—ছেল না কী?

উভয় পক্ষের চেঁচামেচি শুনে ওর জা নির্মলা সেখানে এসে পড়ল। এটি হরি যুগীর ছোটো ভাই যুগলের বিধবা স্ত্রী। এর একমাত্র পুত্র বলাই এই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষমানুষ। বলাইয়ের বয়েস এই উনিশ বছর।

বলাই বাঁশ কিনে গাড়ি বোঝাই দিয়ে রেলস্টেশনে নিয়ে যায়, সেখান থেকে মালগাড়িতে উঠিয়ে কলকাতায় পাঠায়। গত বছরখানেক এ ব্যাবসা করে সে গোটা পঞ্চাশ টাকা হাতে জমিয়েছে—মা-র হাতেই এনে দিয়েছে সে টাকা। নির্মলা আবার সে টাকাটা থেকে কুড়িটা টাকা শাশুড়িকে দিয়েছে। বুড়ি সেই টাকায় পাশের গ্রাম থেকে দুধ কিনে এ গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়ায় জোগান দেয়, তাতেও সামান্য কিছু লাভ থাকে। বুড়ির বয়স সত্তর ছাড়িয়ে গেলেও সে এখনও দুপুররোদে সারা পাড়া সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়—দূর-দূরান্তরের চাষাগাঁয়ে হাঁসের ডিম, মুরগির ডিম সংগ্রহ করতে যায় ব্রাহ্মণপাড়ায় বিক্রির জন্যে।

নির্মলা নিজেও বসে থাকে না, তিনু গাঙ্গুলীর বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে মাসে দু টাকা মাইনে পায়।

সুতরাং এ সংসারে এখন নির্মলার প্রতিপত্তিই বেশি। নিস্তারিণীর দিন সকল রকমেই চলে গিয়েছে। এখন নির্মলার ছেলে বলাই পয়সা আনে, নির্মলা নিজে পয়সা আনে, বলাইয়ের পয়সায় ওর ঠাকুরমা দুধের জোগান দিয়ে কিছু আয় করে। নিস্তারিণী শীর্ণ পাণ্ডুর দেহে উত্থানশক্তিরহিত শয্যাগত অবস্থায় শুধু ‘খাই খাই’ করে রোগের দুষ্টক্ষুধায় অবোধ বালিকার মতো। হরি যুগী বেঁচে থাকলে তার সে অন্যায় আবদার খাটত, সাধন বেঁচে থাকলেও খাটত—আজ তার আবদার কান পেতে শোনবার লোক কে আছে এ সংসারে?

নির্মলার বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ—বেশ ধপধপে ফর্সা, মুখচোখ ভালোই, মাথায় এখনও একঢাল চুল, একটি চুলেও পাক ধরেনি। যুগীদের মেয়েরা সাধারণত সুন্দরী হয়ে থাকে। নির্মলার মেয়ে তারাও বেশ সুন্দরী। তারা বলাইয়ের ছোটো, এই মাত্র চোদ্দো বছর বয়েস। আজ বছর দুই হল এই গ্রামেই তার বিয়ে হয়েছে।

নির্মলা এসে বললে—দিদি, চেঁচিও না। ঝগড়া করে মরচ কেন?

নিস্তারিণী কাঁদতে কাঁদতে বললে—দ্যাক দিকি ছোটো বউ, আমায় কিনা রাক্ষুসি, ডাইনি বলে! আমি নাকি এসে ওনার সংসারে আগুন লাগিয়ে দিইচি! আমার সোয়ামি পুতুরের অন্ন উনি কোনো দিন বুঝি দাঁতে কাটেননি—

নির্মলা বললে—সে তো তুমিও ওনাকে বলেচ। যাক, এখন চুপটি করে শুয়ে থাকো।

—ও ছোটো বউ, আমি দু-টো ভাত–

—না, আজ না। তোমার গা ফুলেচে, মুখ ফুলেচে”তুমি ভাত খাবে কী বলে আজ?

—তা হোক, তোর পায়ে পড়ি—

—আচ্ছা এখন চুপ করো, বেলা হোক। ভাত রান্না হোক, আমি বলব তখন। নিস্তারিণীর হাত, পা মুখ ফুলেচে একথা ঠিকই। কী বিশ্রী চেহারা হয়ে গিয়েছে তার, ওর দিকে যেন আর তাকানো যায় না—এমন খারাপ দেখতে হয়েছে ও। যত্ন করবার কেউ-না থাকাতে আরও দিন দিন ওর অবস্থা খারাপতর হয়ে উঠেছে। খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আগ্রহ করে খেতে দেবার কেউ নেই। রোগীর পথ্য তো দূরের কথা, দুটি ভাত তাই কেউ দেয় না।

ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না-পেরে বেলা দশটা আন্দাজ সময়ে সে নাতিকে ডেকে চুপি চুপি বললে—পিন্টু, দুটো পেয়ারা আনতে পারিস?

পিন্টুর মা ছেলেকে বলে—খবরদার, যাবি না বুড়ির কাছে! ওর পাণ্ডুর রোগ হয়েচে, ছোঁয়াচে রোগ। ছেলে খেয়ে বসে আছে ডাইনি, আবার নাতিকে খাবার জোগাড় করচে–ঠ্যাঙ ভেঙে দেব যদি ওর কাছে যাবি–

বেলা দুপুরের পরে সে ভীষণ জ্বরে বিকেল পর্যন্ত অঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইল— কখন যে এ বাড়ির লোক খাওয়া-দাওয়া করেছে তা সে কিছুই জানে না। যখন তার খানিকটা জ্ঞান হল, তখন ভাদ্র মাসের রোদ প্রায় রাঙা হয়ে উঠানের আমগাছটা, বাঁশঝাড়গুলোর আগায় উঠে গিয়েচে। মুখের কাঁথাটা খুলে দিয়েই ও চি-চি করে প্রথমেই ডাকলেও পিন্টু, পিন্টু—

পিন্টু কোথা থেকে ছুটে এসে বললে—কী ঠামা?

—আমার জন্যি সেই পেয়ারা আনলি?

—না, ঠামা।

—আনিসনি? ছেলেমানুষ ভুলে গিয়েচিস? বোস এখানে।

কিন্তু পিন্টু বসতে ভরসা পায় না, মা দেখতে পেলে মার খেতে হবে। সে আনমনে খেলা করতে করতে অন্যদিকে চলে গেল। একটু পরে নিস্তারিণী আবার ডাকলেও ছোটো বউ-ছোটো বউ–

কেউ উত্তর দিল না, কারণ এ সময়ে বাড়িতে কেউ থাকে না।

আরও দু-বার ডাক দিয়ে নিস্তারিণী অবসন্ন হয়ে পড়ল, তার বেশি চেঁচামেচি করবার ক্ষমতা নেই।

বেশ খানিকক্ষণ পরে নির্মলার মেয়ে তারা এসে বললে—হ্যাঁ জ্যাঠাইমা, ডাকছিলে?

নিস্তারিণী চি-চিঁ করতে করতে বললে—কাতরে কাতরে মরে গেলাম, তা যদি তোমাদের একজনও উত্তর দেবে! একজন এমন রুগি বাড়িতে রয়েছে—বোস এখানে একটু–

তারা ওর মায়ের মতো ছিপছিপে গড়নের সুন্দরী বালিকা। নতুন বিয়ের কনে, পাশেই শ্বশুরবাড়ি। নবীন যুগীর ছেলে অভিলাষ তার স্বামী। এইমাত্র শ্বশুরবাড়ি থেকেই আসছে। আসবার কারণ অন্য কিছু নয়, অভিলাষ এখুনি গরম মুড়কি মেখেচে, বালিকা স্ত্রীকে আদর করে বলেছে, তোদের বাড়ি থেকে ধামি নিয়ে আয়, মুড়কি খেতে দেব। এইজন্যেই তার আগমন। রোগগ্রস্ত জ্যাঠাইমা বুড়ির বকুনি শোনবার জন্যে সে এখন এখানে বসতে আসেনি। সুতরাং সে বিব্রত মুখে বললে–ও জ্যাঠাইমা, আমি এখন বসতে পারব না, তোমার জামাই মুড়কি মেখেচে, নিয়ে বেলেডাঙায় ফিরি করতে বেরুবে—

—তোর মা কোথায়?

—বাড়িতে কেউ নেই। মা গাঙ্গুলী-বাড়ি কাজ করতে গিয়েছে, ঠাকুমা নরহরিপুরে হাঁসের ডিম আনতে গিয়েছে—

—পিন্টুর মা কোথায়?

—ওই যে শিউলিতলায় বসে বাসন মাজছে—

—একটু ডেকে দিয়ে যা দিকি মা—

পরে সুর খুবই নীচু করে বললে—মা দু-টো মুড়কি অভিলাষের কাছ থেকে নিয়ে আয় না, আমার নাম যেন করিসনে—

তারা বললে—সে আমি পারব না। অসুখ-গায়ে মুড়কি খাবে কী? তারপর শেষকালে ঠাকুমা টের পেলে আমায় বকে ভূত ঝাড়াবে। চললাম আমিও বউদিদি, শুনে যাও জ্যাঠাইমা ডাকচে—

পুত্রবধূ বিরক্ত মুখে এসে দূরে উঠোনে দাঁড়িয়ে বললে—বলি ডাকের ওপর ডাক কেন অত? আমার সংসারে কাজকর্ম নেই, না তোমার কাছে বসে থাকলে চলবে? কী বলছো বলো—

নিস্তারিণী কাতর সুরে বললে—তা রাগ করিসনে আমার ওপর বউমা, আমায় দুটো ভাত দে—

—দিই! জ্বরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছ, ভাত না-খেলে কী চলে!

–তবে আমি কী খাব, খিদে পায় না?

—আমি জানিনে। আদিখ্যেতার কথা শোনো! খিদে পায় তা আমি কী করব? ঠাকুমা এলে বলো, ঠাকুমা না-বললি আমি ভাত দিতি পারব না।

—পিন্টু কোথায়? একটু ডেকে দে আমার কাছে—বড্ড ইচ্ছে করে দেখতি—

পুত্রবধূ ঝংকার দিয়ে বলে উঠল—অত সোহাগে আর কাজ নেই। ছেলের মাথা। খেয়ে বসে আছে, এখন নাতিটি বাকি?

নিস্তারিণী মিনতির সুরে বললে—অমন করে বলতি নেই, বউমা। তা দে ডেকে, কিছু হবে না, দে একবার ডেকে—

পুত্রবধূ হাত-পা নেড়ে বললে–না–না–হবে না। তোমার পাণ্ডুর রোগ হয়েচে, বিশ্রী ছোঁয়াচে রোগ—আমি ছেলে পাঠাতি পারব না তোমার কাছে। গেলি আমারি যাবে তোমার কী?

কথা শেষ করেই মুখ ঘুরিয়ে পুত্রবধূ চলে গেল। নিস্তারিণীর দুই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ে হেঁড়া, ময়লা, তেলচিটে বালিশটা ভিজিয়ে দিলে। এমন কথাও লোককে লোকে বলে—তাও নিজের পুত্রবধু! সাধনের নাম রেখেচে ওই ধুলোগুঁড়োটুকু—ওই অবোধ শিশু। মা সাতভেয়ে কালী তার মঙ্গল করুন, মঙ্গল করুন।—সে না তার ঠাকুরমা, বউমা বলে কিনা, গেলে তারই যাবে।

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে নির্মলা বামুনবাড়ির কাজকর্ম সেরে ফিরে এল। বড়ো জায়ের কাছে গিয়ে বললে—কেমন আছ দিদি? দেখি, গা দেখি—

নিস্তারিণী না-ঘুম না-জ্বরে আচ্ছন্নমতো হয়ে পড়েছিল, কপালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠে বললে—কে ছোটো বউ? তুই আবার আমায় ছুঁলি কেন? তোর পাছে পাণ্ডুর রোগ হয়—আজ আমায় বউমা বলেছে—হ্যাঁ ছোটো বউ, সাধনের ছেলে আমার কেউ নয়? বলো তুমি—

নিস্তারিণী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। নির্মলা বললে—চুপ করো চুপ করো দিদি, সবই তোমার কপাল। পিরতিমের মতো বউ ছিলে, সব তো দেখেচি। স্বভাব চরিত্তির সম্বন্ধে কেউ একটা কথা বলতি পারেনি কোনোদিন।

—কেন, দেওরদের কোলেপিঠে করে মানুষ করিনি? আমি যখন ঘর করতি এলাম, তোর সোয়ামি তখন ন বছরের ছেলে। আমার পাত থেকে বেগুনপোড়া ভাত মেখে খেত, আর আজ আমি হইচি নাকি ডাইনি—

—চুপ করো দিদি। এসব কথা আমি সব জানি। এখন কী খাবে তাই বলো— নিস্তারিণী মিনতির সুরে বললে—দুটো ভাত—

—না, আমায় বকিও না। সারাদিন কাজ করে দুঃখধান্দা করে এলাম। দুটো মুড়ি নিয়ে এসেছি—

–শোন ছোটোবউ, অভিলাষ আজ গরম মুড়কি মেখেছে, তারা বলে গেল—

-না, সে-সব হবে না। গুড়ের মুড়কি জ্বর হলে খায় না। দুটো তেলনুন দিয়ে মুড়ি মেখে দিগে, খেয়ে এক ঘটি জল খেয়ে আজ রাত্তিরটুকু পড়ে থাকো। শুনেচ কাণ্ড, বাজারে নাকি চালের পালি দেড় টাকা! ভাত আর খাতি হবে না। বলাই আর কত রোজগার করবে, কী করে এই বিধবার পুরী চালাবে? ধান ফুরিয়ে এসেচে, এবার আমাদের মতো গরিবদের না-খেয়ে মরণ।

নিস্তারিণী স্তব্ধ হয়ে শুনলে। অসুস্থতার দরুন সে বহুদিন অবধি বৈষয়িক ব্যাপারে নিস্পৃহ, তবুও দেড় টাকা এক পালি চাল শুনে সে যেন অত জ্বরের ঘোরের মধ্যেও চমকে গেল। সেকালে যে তাদের গোলার ধান বিক্রি হয়েছে,–আঠারো আনা করে সরু বাঁশসলা কী চামরমণি ধানের মণ। মনে আছে, একবার তার প্রথম পুত্রের অন্নপ্রাশনের জন্য গোলা থেকে পঁচিশ টাকার ধান বিক্রি হয়— পাঁচ সিকা ছিল এক মণ ধানের দাম।

নিজের হাতে সে কত ধান বিলিয়ে দিয়েছে…একবার গাঁয়ে আকাল হয়েছিল, টাকায় সাড়ে তিন সের হয়ে উঠল চালের দাম। বামুনপাড়ার মেজো গিন্নি একদিন তাকে বাড়িতে ডেকে বল্লেন, ”বউ, তোমায় একটা কথা বলি—খাওয়া-দাওয়ার বড্ড কষ্ট, দু-মণ ধান আমাকে ধার দিতে হবে। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় তোমার কোনো অভাব নেই। গোলা আরও উথলে উঠুক তোমার।” সে শাশুড়িকে লুকিয়ে দু-মণ ধান বার করে দিয়েছিল গোলা থেকে। শাশুড়ি চিরকালের খাণ্ডার, কাউকে কিছু জিনিস দেওয়া পছন্দ করত না কখনো। কিন্তু তখনকার দিনে এ সংসারে তার প্রতিপত্তি ছিল অন্যরকম। সে যা করবে তাই হবে। তার ওপর কথা বলবার কেউ ছিল না। কোথায় গেল সে-সব দিন!

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। নির্মলা এক বাটি দুধ নিয়ে এসে বললেও দিদি, খেয়ে নাও একটু দুধ।

নিস্তারিণী বললে—আমার এখানে একটু বোস ছোটোবউ-কেউ বসে না।

নির্মলার বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসবার জো নেই। এক্ষুনি সব খেতে চাইবে, শেষরাত্রে উঠে চার কাঠা ধানের চিঁড়ে কুটতে হবে বাঁড়য্যেদের।

তারপর আবার যে একা সেই একা। সারা দিনরাত আজ একটি মাস ধরে একাই শুয়ে থাকতে হচ্ছে। নির্মলা তাকে ধরাধরি করে ঘরের মধ্যে শুইয়ে দিয়ে গেল।

একদিন দু-দিন করে কতদিন যে কাটল, নিস্তারিণীর কোনো খেয়াল নেই। কেবল আবছা আবছা দিনগুলো আসে, সে-সব দিনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন নিঃসঙ্গ, কেবল ছোট্ট খোকা পিন্টুকে দেখতে ইচ্ছে করে…কিন্তু তার মা তাকে পাঠায় না, একটুও বসতে দেয় না কাছে। পুত্রবধূ হয়ে শাশুড়িকে দেখতে পারে না…তার নাকি ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে বলে। আর কেবল সবাই বকে, সবাই বকে।

একদিন সে শুয়ে শুয়ে লক্ষ করলে আর আকাশে বৃষ্টি হয় না। হলদে রঙের রোদ বাঁশঝাড়ে, আমগাছের মাথায়। তেলাকুচো লতায় সাদা সাদা ফুল ধরেছে, বলাইয়ের হাতে পোঁতা উঠানের রাঙা ডাঁটা শাক ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। বর্ষাকাল তা হলে চলে গিয়েছে!

পুত্রবধূ আমতলায় কাঠ কাটছে, জিগ্যেস করলেও বউমা, এটা কী মাস?

—সে খোঁজে কী দরকার তোমার?

–বলো না বউমা?

—শেষ ভাদ্দর। তোমার কী হুশ-পোড়েন আছে? সেদিন চাপড়া ষষ্ঠী গেল, খোকাকে তোমার আশীর্বাদ করা দরকার, তোমার কাছে গিয়ে ডাকলে, তা যদি একটা কথা বললে–

বিকেলে ও-পাড়ার বুধো গোয়ালার মা দেখা করতে এসে বললে—ওমা, এ কী চেহারা হয়ে গিয়েছে! আহা, কতদিন হয়েছে আসিনি—বলি শুনচি বড্ড অসুখ, একবার দেখে আসি। উদুরী হয়েছে বুঝি, পেট যে ফুলেচে বড্ড। সোনার পিরতিমে চেহারা ছিল বউমার। আমি তো আজকের লোক নই, যখন হরি প্রথম বিয়ে করে এল—ওই আমতলায় দুধে আলতার পিঁড়িতে দাঁড়াল, বেশ মনে আছে, রূপে একেবারে ঝলকা দিয়ে গেল যেন। সে চেহারার আর কিছু নেই। এমন নক্ষি বউ—আহা, তার এত কষ্টও ছেল অদেষ্টে।

নিস্তারিণী যেন সব বিষয়ে নিস্পৃহ, উদাসী হয়ে পড়েছে। এসব কথা শুনে যায় বটে, কিন্তু কার বিষয়ে কে যেন কথা বলছে! সেকালের সে বড়োবউ তো কোনকালে মরেহেজে গিয়েছে! সে রূপসী, লক্ষ্মীর মতো সংসারজোড়া বড়োবউ কোথায় আজ?…কেবল খেতে ইচ্ছে হয়। পান্তাভাত কতকাল খায়নি। কেউ দেয়

—দেখাই করে না এসে। সন্ধ্যার পরে নির্মলা এসে একটু কাছে বসে, বলে— ও দিদি, তোমার জন্যি একটা জিনিস এনেছি মনিববাড়ি থেকে। নিস্তারিণী ব্যগ্রভাবে বলে—কী কী?

-চুপ করো। দুটো তালের বড়া। গিন্নি ভাজছে, তা আমাকে খেতে দেলে—

—কতকাল খাইনি! দে—

নির্মলা বেশিক্ষণ বসতে পারে না, রান্নাঘরে খই ভেজে দিতে হবে জামাই অভিলাষকে। তারা বলে দিয়েছে—কাল মুড়কি মাখবে সকালবেলা। সে মুড়কির ব্যাবসা করে, কিন্তু খই ভাজা কাজটা মেয়েমানুষের, পুরুষের নয়—ওটা শাশুড়ির বিনা সাহায্যে সম্পূর্ণ হয় না।

রান্নাঘরে যেতে সাধনের বউ বললে—কাকিমার বুড়ির কাছে রোজ বসা চাই ই। অমন ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে—পাপের দেহ তাই কষ্ট পাচ্ছে—নইলে মরে যেত কোনকালে!

নির্মলা ধমক দিয়ে বললে—অমন বলিসনে বউমা, মুখে পোকা পড়বে। সতী নক্ষ্মী মেয়ের নামে কিছু বোলো না। তোর আপন শাশুড়ি না? তুই ওসব কথা মুখে বের করিস কী করে? আজই না-হয় ও অমন হয়ে গিয়েচেও যে কী ছিল, আমি সব দেখেচি। এই সংসারের যা কিছু ঝক্কি চিরকাল ও পুইয়েছে। দেওরদের মানুষ করা, বিয়ে-থাওয়া দেওয়া—ও না-থাকলে সংসার টিকত না। আজ না-হয় ওর

সাধনের বউ ঠোঁট উলটে বললে—হোক গে যাক বাপু, ও নিজের ছেলে খেয়েছে—ওর ওপর আমার এতটুকু ছেদ্দা নেই, যতই বলো।

—ও খেয়েছে, কী বলিস বউমা! ও ছেলে খেয়েছে! যাবার অদেষ্টে যায় চলে। কার দোষ দেব! তাহলে তো তোকেও বলতে পারি—তুই সোয়ামি খেয়েছিস।

এই কথার উত্তরে খুড়শাশুড়ি ও বউয়ে তুমুল ঝগড়া বেধে উঠল।

 

আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। পুজো প্রায় এসে পড়েছে। নিস্তারিণী একেবারে উত্থানশক্তিহীন হয়ে পড়েছে। দিনের অর্ধেক সময় তার জ্ঞান থাকে না। এক একবার চেতনা সজাগ হয়ে ওঠে, তখন কেবল এদিক-ওদিক চেয়ে নাতিকে খোঁজে। নির্মলাকে খোঁজে। ওর মলিন বিছানা ও সারা দেহে কেমন একটা দুর্গন্ধ বলে আজকাল কেউই কাছে আসতে চায় না। কেবল খাওয়ার সময় কোনোদিন নির্মলা, কোনোদিন বা সাধনের বউ দুটি ভাত দিয়ে যায়। সেদিন ও চোখ মেলে ভাত খাবার চেষ্টা করলে—কিন্তু পারলে না। অনেকক্ষণ পরে পুত্রবধূ বললে— ভাত খাওনি যে, খাইয়ে দেব?

নিস্তারিণী অবাক হয়ে গেল অসুখের ঘোরের মধ্যেও। বললে—তাই দে বউমা।

সাধানের বউ ভাত দুটি খাইয়ে এঁটো থালা নিয়ে চলে গেল। একটু পরে নির্মলা বাড়ি এল। রোগীকে দেখতে গিয়ে ওর মনে হল অবস্থা ভালো নয়। আপনমনে বললে—ঠাকুর, ওকে মুক্তি দাও, বড় কষ্ট পাচ্ছে—

প্রতিদিন সন্ধ্যায় যেমন নিস্তারিণীর জ্ঞান হয়, আজও তেমনি হল। জা-কে অবোধ বালিকার মতো আবদারের সুরে বললে—দুটো পান্তভাত আর ইলিশমাছ। ভাজা খাব—

নির্মলা দু-তিন দিন চেষ্টার পরে অতিকষ্টে এই যুদ্ধের বাজারে ইলিশমাছ জুটিয়ে এনেছিল, কিন্তু জা-কে খেতে দিতে পারেনি।

নিস্তারিণীর অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে ঝুঁকল পরদিন দুপুর থেকে।

সে অসুখের ঘঘারে কোন বিস্মৃত পথ বেয়ে ফিরে গেল তার যৌবনদিনের দেশে। বাঁড়ুজ্যেদের ন-গিন্নি যেন এসে হেসে হেসে বলচেন, “আমায় আজ দু কাঠা চাল ধার দিতে হবে বউ। বউমা তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে—তুমি না দিলে দাঁড়াব কোথায়?”…যেসব লোক কতকাল আগে চলে গিয়েছে, তারা যেন এসে দিনরাত ওর বিছানার চারিপাশে ওকে ঘিরে ভিড় করচে। বহুদিন শরৎ অপরাহ্রে মতো হাট থেকে ফিরে ওর স্বামী যেন হাসিমুখে বলচেও বড়োবউ, কলা বিক্রির দরুন টাকাগুলো এই নাও, তুলে রেখে দাও—আর এই ইলিশমাছটা—ভারি সস্তা আজ হাটে–

ওর সব দুঃখ, সব অপমান, অনাদরের দিনের হঠাৎ আজ এমন অপ্রত্যাশিতভাবে অবসান হল কীভাবে? নিস্তারিণী অবাক হয়ে যায়, বুঝতে পারে না কোনটা স্বপ্ন—কোনটা সত্য, সে একগাল হেসে স্বামীর হাত থেকে ইলিশমাছটা নেবার জন্যে হাত বাড়ায়।

 

নির্মলা চোখ মুছতে মুছতে বললে—সতী নক্ষ্মী সগগে চলে গেল—বউমা পায়ের ধুলো–নে—তারপর সে নিজেও ঝুঁকে পড়ে মাতৃসমা বড়ো জা-এর পায়ে হাত ঠেকায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *