১ম খণ্ড – ডাক্তারের কথা

গোবিন্দরাম (ডিটেকটিভ উপন্যাস)

বিজ্ঞাপন
একই গ্রন্থকারের ইংরাজী ভাষায় দুইখানি সর্বশ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ উপন্যাসের ছায়াবলম্বনে গোবিন্দরাম সঙ্কলিত। ইহা সঙ্কলন করিতে আমাকে সর্বত্র বড়ই স্বাধীনতা প্রকাশ করিতে হইয়াছে। মূলগ্রন্থ হইতে বাহুল্য বোধে অনেকস্থান পরিবর্জিত হইয়াছে; কোন কোন স্থান একেবারে স্বকোপলকল্পিত। ইহাতে যদি কোন দোষ হইয়া থাকে, তাহা আমারই। আর যদি আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ এই উপন্যাসখানি প্রীতনেত্রে দেখেন, তাহা হইলে আমার সকল শ্রম সার্থক হইবে।
গ্রন্থকার।
গোবিন্দরাম।

প্রথম খণ্ড। (ডাক্তারের কথা।)

প্রথম পরিচ্ছেদ। ডাক্তারী পাস করিয়া দিন-কতক উপার্জনের চেষ্টায় রহিলাম, কিন্তু কোন দিকে কোন সুবিধা না হওয়ায়,-এবং গৃহেও অর্থ প্রচুর পরিমাণে থাকায়, অবশেষে সরকারী চাকরী লইয়া পশ্চিমে রওনা হইলাম।

কয়েক মাস নানাস্থানের হাসপাতালে চাকরী করিয়া আমি বদলী হইয়া রাওলপিণ্ডি আসিলাম। তথায় ১৭নং শিখ-পদাতিদলের হাসপাতালের ভার পাইলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ শীঘ্রই কাবুল যুদ্ধ বাধিল। ১৭ নং শিখ-পদাতি যুদ্ধের জন্য কাবুলের দিকে রওনা হইল; আমিও বাধ্য হইয়া ঐ পল্টনের সহিত চলিলাম।

প্রায় বৎসরাবধি আফগানিস্থানে থাকিয়া নানা ক্লেশে ও অত্যধিক পরিশ্রমে আমার শরীর একেবারে ভগ্ন হইয়া গেল। অনেক কষ্টে ছুটি পাইয়া দেশে ফিরিবার ইচ্ছা করিলাম; কিন্তু সকলেই বলিল, দেশে ফিরিলে বাঁচিবে না। দিনকতক পাঞ্জাবে থাকিয়া শরীরটা সারিয়া তবে দেশে যাইয়ো। আমিও মনে মনে ইহাই স্থির করিলাম। আগে দিন-কতক লাহোরে থাকিয়া শরীরকে সুস্থ করিয়া পরে দেশে যাইব, স্থির করিয়া লাহোরে আসিলাম।

অপরিচিত স্থানে কোথায় যাই, কি করি, কোথায় বাসা স্থির করি, এই সকল ভাবিতে ভাবিতে আমি চকে আসিলাম; অন্যমনস্ক ভাবে চারিদিকে চাহিতেছি, এমন সময়ে সহসা পাদ্দিক হইতে কে আমার ঋন্ধে হস্ত স্থাপন করিয়া বলিল, ডাক্তার বসু যে!

আমি চমকিত হইয়া ফিরিলাম। দেখিলাম, আমার রাওলপিণ্ডির বন্ধু রামেশ্বর প্রসাদ। ইনি রাওলপিণ্ডিতে ওকালতী করিতেন; আমার সহিত বিশেষ বন্ধুত্ব হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, অপরিচিত স্থানে একটি পূর্ব বন্ধুর সাক্ষাৎ পাইয়া আমার হৃদয়ে বিশেষ আনন্দের সঞ্চার হইল।

বন্ধু বলিলেন, কাবুল হতে কবে ফিরিলে হে? মনে করিয়া এ অধমকে কি একখানা চিঠি লিখিতেও নাই?

আমি বলিলাম, পল্টনের সঙ্গে গেলে যে কি অবস্থায় থাকতে হয়, তাহা যাহারা না গিয়াছে তাহারা বুঝিবে না। দেখিতেছ ত আমার অবস্থা।

তিনি বলিলেন, তাই ত, একেবারে যে অস্থিচর্মসার হয়েছ? দিনকতক এ দেশে থেকে শরীর ভাল না করে দেশে যেয়ো না।

আমি বলিলাম, তাই কিছুদিন লাহোরে থাক্‌ব বলে এসেছি। ছ মাসের ছুটিও পেয়েছি।

তিনি। কোথায় থাকবে? 

আমি। একটা বাসা খুঁজছি। অচেনা জায়গা, তাতে শরীর বড় খারাপ। একটা মনের মত জায়গা না হলে বড় কষ্ট পেতে হবে। লাহোরে তোমার ত সবই চেনা-শোনা আছে। আমাকে একটা ভাল বাসা ঠিক করে দাও দেখি।

তিনি। কি আশ্চর্য! আজ আর একজনও আমাকে বাসা খুঁজে দিতে বলছিলেন।

আমি। তিনি কে?

তিনি। তিনিও বাঙ্গালী। সম্প্রতি লাহোরে বেড়াতে এসেছেন। দিন-কতক-এখানে থাকবেন। বোধ হয়, কিছু কাজ-কর্ম আছে। কিন্তু লোকটার সঙ্গে তোমার পোযাবে কি না, সেটা ঠিক বলতে পারি না।

আমি। কেন?

তিনি। লোকটার অনেক রকম খেয়াল আছে বলে, বোব

আমি। তা থাক, একলা থাকার চেয়ে দুজনে থাকলে অনেকটা ভালই কাটবে।

তিনি। তবে চল, তার সঙ্গে তোমার আলাপ করে দিই। আমার সন্ধানে একটা বেশ ভাল ছোট বাড়ী আছে। তোমাদের দুজনের থাবার পক্ষে সেটি বেশ হবে।  

আমি। তিনি এখন কোথায় আছেন?

তিনি। মসাফেরখানায় আছেন।

আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, মসাফেরখানায়! তিনি বলিলেন, হাঁ, আলাপ হলেই বুঝবে। তবে পোয় পোষায় সে তুমি বুঝে নিয়ে।

আমরা উভয়ে তখন মসাফেরখানার দিকে চলিলাম। তথায় আসিয়া দেখিলাম, একটি বাঙ্গালী ভদ্রলোক কতকগুলি বোতল, শিশি আরক লইয়াই বড় ব্যতিব্যস্ত। আমাদের পদশব্দে তিনি চকিতে একবার মস্তক তুলিলেন। মহেশ্বর প্রসাদকে দেখিয়া বলিলেন, আসুন, আসুন, কি সৌভাগ্য!

মহেশ্বর প্রসাদ বলিলেন, আগে আপনাদের দুজনের পরিচয় করিয়া দিই। ইনি আপনাদেরই দেশের লোক, ডাক্তার বসু। তৎপরে তিনি আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, গোবিন্দ বাবু আমার বিশেষ বন্ধু।

তখন গোবিন্দ বাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া আমার হস্ত সবেগে বিলোড়ন করিয়া বলিলেন, কাবুল থেকে কবে ফিরিলেন?

আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কিরূপে জানিলেন যে, আমি কাবুলে গিয়াছিলাম?

তিনি মৃদু হাসিয়া বলিলেন,সে কথা থাক্‌,আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে বড়ই সুখী হলেম। দেশের লোক–বিদেশে দেখা হলে স্বভাবতঃই বড় আনন্দ হয়।

মহেশ্বর বাবু বলিলেন, আপনি বাসা খুঁজছিলেন,ইনিও খুঁজছেন। আমি একটা ছোট বাড়ী ঠিক করেছি, সেখানে আপনারা দুজনে খুব ভালই থাকবেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আরও ভাল, তবে একসঙ্গে থাবার আগে দুএকটা কথা হওয়া ভাল। আমি তামাকটা বড় ঘন ঘন খাই—চুরুট ত সৰ্ব্বদা মুখেই থাকে—আপত্তি আছে কি?

আমি বলিলাম, কিছু না,আমিও খাই।

গোবিন্দ। ভাল। সব আগে বলা ভাল। আমার মাঝে মাঝে একটা রোগ আছে। মৌনী হয়ে যাই। তখন কারও সঙ্গে কথা কই না। ক্রমে দুই চার দিনে আবার ঠিক হয়ে আসি।

আমি। আমারও যে এ রোগ নাই, তা নয়; তবে রোগটা এক সময়ে দুজনের হলেই বড় ভাল হয়।

গোবিন্দ। বেশ, খুব ভাল। আরও একটা কথা, আমার কাছে রং-বেরংয়ের লোক আসে, তাতে আপনার কোন আপত্তি আছে?

আমি। আপনার কাছে আসিবে, তাতে আমার আপত্তির কারণ কি?

গোবিন্দ। আমি মাঝে মাঝে সেতার বাজাই। বাদ্যি-বাজনা পছন্দ করেন?

আমি। সুমিষ্ট বাজনা, বিশেষতঃ সেতার, কে না পছন্দ করে?

গোবিন্দ। ভাল খন আপনার বিষয় বলিতে পারেন।

আমি লোকটি কথাবার্তায় বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম। বলিলাম, দেখিতেছেন ত আমার শরীর। শরীর শোধরাইবার জন্যই দিন-কতক লাহোরে থাকা, একটু নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলেই হইল।

তিনি বলিলেন, পোষাবে। তৎপরে মহেশ্বর প্রসাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, চলুন, এখন বাড়ীটা একবার দেখা যাক।

আমরা তিন জনে একখানি এক্কা ভাড়া করিয়া সহরের এক প্রান্তে, আসিলাম। তথায় মহেশ্বর প্রসাদ একটী ছোট বাড়ীতে আমাদের লইয়া গেলেন। বাড়ীটি বেশ, চারিদিক খোলা, সামনে একটু বাগানও ছিল। আমাদের উভয়েরই বাড়ীটি বেশ পছন্দ হইল। আমরা সেইদিনেই তথায় আসিব, স্থির করিলাম।

সন্ধ্যার পূর্বেই আমাদের জিনিষপত্র লইয়া আমরা সেই বাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। মহেশ্বর বাবু, পাচক ও ভৃত্য স্থির করিয়া দিলেন।

মহেশ্বর বাবু বিদায় হইবার সময় আমি তাঁহার সঙ্গে রাস্তা পর্য্যন্ত আসিলাম; তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবুকে বুঝিলে?

আমি বলিলাম, না, ক্ৰমে বুঝিব।

তিনি আবার হাসিয়া বলিলেন, তুমি বুঝিতে পার আর না পার, উনি তোমাকে এক ঘণ্টাতেই বুঝিয়া লইবেন। লোকটা বড়ই ক্ষমতাপন্ন।

আমি বলিলাম, তাত কতক বুঝিতেছি। ইনি কি কাজ-কর্ম করেন, জান?

ক্রমে জাতে পাবে। বলিয়া তিনি হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

প্রথমে গোবিন্দ বাবুর সঙ্গে বসবাস করা পোষাইবে কি না, এ সম্বন্ধে আমার একটু ভাবনা হইয়াছিল, কিন্তু কয়েক দিন একত্রে থাকায় দেখিলাম যে, তাঁহার সহিত বাসে কোনরূপ অসুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই। যখন তিনি বাসায় থাকিতেন, তখন তাঁহার শিশি বোতল, কাগজ-পত্র, বই লইয়াই ব্যস্ত থাকিতেন। আহারাদির পর প্রায়ই বাহির হইয়া যাইতেন। রাত্রে কোন কোন দিন আমার সহিত কথোপকথন করিতেন, কোন দিন বা তিনি আমাকে তাঁহার প্রিয় সেতার শুনাইতেন। দেখিলাম, তিনি সুন্দর সেতার বাজাইতে পারেন।

প্রথমে আমি ভাবিয়াছিলাম, আমারও যেমন এখানে কোন বন্ধুবান্ধব নাই, বোধ হয় ইহারও তাহাই; কিন্তু ক্রমে দেখিলাম, তাহা নহে। এক দিন একজন পুলিসের ইনস্পেক্টর তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিলেন; আর এক দিন সূরযমল বলিয়া একটি ভদ্রলোক আসিলেন। পূর্বে যে তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে তাহার নিকট রং-বেরংয়ের লোক আসে, এখন দেখিলাম তাহা সত্যই। প্রায় প্রত্যহই তাহার নিকট রকমের নানা লোক আসিতে লাগিল। তিনি তাহাদের সহিত গোপনে কথা-বার্তা কহিতেন। কি কথা হইত, তাহা আমি জানিতে পারিতাম না। জানিবার ইচ্ছা করা অন্যায় বিবেচনা করিয়া আমি কখনও সে বিষয়ে উৎসুকও হই নাই। তিনি কি কাজ কর্ম করেন, তাহাও তাহাকে কখনও জিজ্ঞাসা করি নাই। ভাবিলাম, তিনি নিজেই একদিন কথায় কথায় বলিয়া ফেলিবেন, আমার জিজ্ঞাসা করা ভাল দেখায় না।

একদিন দেখিলাম, একখানা পাওনিয়র কাগজ তাহার পার্শ্বে পড়িয়া আছে। একটা প্রবন্ধের পার্শ্বে লালকালীর দাগ দেওয়া রহিয়াছে; দেখিয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম। দেখিলাম, প্রবন্ধটির নাম জীবন-পৰ্যবেক্ষণ। নূতন নাম দেখিয়া একটু বিশেষ আগ্রহে সহিত পড়িতে লাগিলাম। পড়িয়া কিন্তু সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না। একজন লোক আশে পাশের সকল বিষয় বিশেষরূপে দেখিলে যে কত দূর শিক্ষা লাভ করিতে পারেন, তাহাই প্রমাণ করিবার চেষ্টা হইয়াছে। লেখক বলেন, চেষ্টা করিলে যে-কেহ অপরের চক্ষু দেখিয়া, মুখের ভাব দেখিয়া, তাহার হাবভাব বুঝিয়া, অনায়াসে সেই লোকের হৃদয়ের অন্তস্তম প্রদেশের কথাও জানিতে পারেন। এরূপ লোকে নিকট কিছু গোঁন করা বা মনের ভাব লুকাইয়া রাখা বা কোন রূপ প্রতারণা করা অসম্ভব। লেখক বলেন–

যেমন চিন্তাশীল নৈয়ায়িক এক ফোঁটা জল দেখিয়া অদৃষ্টপূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের অস্তিত্ব অনায়াসে স্থির করিতে পারেন, সেইরূপ যে ব্যক্তি সকল বিষয় বিশিষ্টরূপে দেখেন, তিনি মনুষ্য জীবনের সকল কথাই অনায়াসে অবগত হইতে পারেন। তবে এ বিদ্যা শিক্ষা বিশেষ পরিশ্রন সাধ্য। ইহা শিক্ষার জন্য আশে-পাশের লোকদিগকে বিশেষরূপে দেখা আবশ্যক। সকল বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন। এইরূপে চেষ্টা করিলে সকলেই একজন লোককে দেখিয়া অনায়াসেই তিনি কি কাজ করেন, তাহার মনের কথা কি, তাহা বলিয়া দিতে পারেন–ইত্যাদি।

আমি কাগজখানা ফেলিয়া দিয়া বলিলাম, বলা সহজ, করা শক্ত। এ যদি হত, তাহা হলে জগতের অনেক দুঃখ ঘুচিত।

গোবিন্দ বাবুর কর্ণে সে কথা প্রবেশ করিবামাত্র তিনি আমার দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিলেন, ব্যাপার কি?

আমি বলিলাম, এই প্রবন্ধটা দেখিতেছি আপনিও পড়িয়াছেন; কেবল পড়া নয়,দাগ দিয়াও রাখিয়াছেন। ঘরে চেয়ারে বসিয়া এ রকম লেখা সহজ, কিন্তু কাজে করাই শক্ত। আমার এ বিশ্বাসই হয় না। এই লেখককে যদি ভীড়ের সময়ে একখানা থার্ডক্লাস রেল গাড়ীর ভিতর বসাইয়া বলি, বাপুহে, বল দেখি, যে এই সকল লোকের কার কি ব্যবসা? কার কি মনের ভাব? যদি কেউ তা ঠিক বলতে পারে, তা হলে আমি তার কাছে সেই মুহূর্তে হাজার টাকা হাতে প্রস্তুত আছি।

গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, আপনাকে তাহা হইলে টাকা হারিতে হয়। এ প্রবন্ধ আমিই লিখেছি।

আমি একটু অপ্রস্তুত হইলাম। আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, আপনি লিখেছেন?

গোবিন্দরাম। গোবিন্দ। হাঁ, আমিই লিখেছি। ছেলে বেলা থেকে দেখে শুনে চেষ্টা-চরিত্র করে কিছু শিখেছি। এ বিষয়ে আমার একটু ঝোঁক আছে। আপনি যা বছেন, একেবারেই হয় না,অসম্ভব,-আমি বলি, অসম্ভব নয়, খুব সম্ভব। চেষ্টা করিলে সকলেই পারে। শুধু বলা নয়, প্রকৃত পক্ষে এই বিদ্যার উপর আমার গ্রাসাচ্ছাদন নির্ভর করছে।

আমি। কি রকম?

গোবিন্দ। আমার নিজের একটা ব্যবসা আছে। আপনি ডাক্তার, কন্সালটিং ডাক্তার কাকে বলে, তাতে নিশ্চয়ই জানেন।

আমি। হাঁ, বড় ডাক্তার। কঠিন পীড়া হলে ছোট ডাক্তারেরা যার পরামর্শ নিয়ে থাকে।

গোবিন্দ। সেই রকম আমি একজন কন্সালটিং ডিটেকটিভ। যখন সরকারী বেসরকারী ডিটেটিভেরা কোন বিষয় স্থির করতে পারেন না, বা কোন খুন জাল জুয়াচুরির কিনারা করতে পারেন না, তখন তারা আমার পরামর্শ আবশ্যক মনে করেন। আমি তাদের ঠিক পথ বলে দি, তাঁরা সেই পথ ধরে ঠিক রহস্যভেদ করতে পারেন। আমিও আমার ফি পাই।

আমি। আপনি কি বলতে চান যে আপনি ঘরে বসে কিছু না দেখে, কেবল শুনে ঠিক পথ বলে দিতে পারেন? ভাল ভাল ডিটেটিভেরা যা পারে না, আপনি ঘরে বসে তাহাই পারেন?

গোবিন্দ। হাঁ, এ বিদ্যা আমি অনেক পরিশ্রমে শিক্ষা করেছি। ইহাই আমরা ব্যবসা। তবে সব সময়েই যে ঘরে বসে পরামর্শ দিই, তা নয়। যদিও আমি পুলিশে কাজ করি না, তবুও লোকে আমাকে গোবিন্দ দারোগা বলে। ভারতবর্ষের সকল স্থানের বড় বড় ডিটেকটিভ আমার পরামর্শ নিতে আসেন। নানাস্থান আমাকে দেখতে হয়। এই দেখুন না, এখন লাহোরে; আবার এক সময় হয়ত দেখবেন বিহারে বিরাজমান।

আমি সে কথার কোন উত্তর করিলাম না, দেখিয়া তিনি বলিলেন, আমার কথা আপনার বিশ্বাস হয় না। আপনার সঙ্গে আমার যে দিন প্রথম দেখা হয়, সেদিন আমি আপনাকে দেখবামাত্র বলেছিলাম,

কাবুল হতে কবে এলেন, স্মরণ আছে?

আমি। আছে।

গোবিন্দ। কেমন করে বলে? 

আমি। নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে আগে বলেছিল।

গোবিন্দ। না, তা নয়। শুনলেম আপনি ডাক্তার। দেখলাম, আপনার পরা খাকি,পায়ে আমোনিসন বুট,শরীরের জীর্ণাবস্থা, কাজেই তখনি বুঝ লেম যে, আপনি নিশ্চয়ই কাবুলের যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ছুটী নিয়ে ফিরেছেন।

আমি। বুঝিয়ে দিলে খুব সহজ, সন্দেহ নাই। আপনার কথায় বিখ্যাত ফরাসী গোয়েন্দা লিকোর কথা, আমার মনে পড়ল।

গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, লিকো খুব উদ্যমশীল গোয়েন্দা বটে, তবে বৈজ্ঞানিক নয়, লিকো যা ছ মাসে কতো আমি তা একদিনে করি।

আমি গোবিন্দ বাবুর কথায় মনে মনে বড় বিরক্ত হইলাম। ভাবিলাম, লোকটা ভারি অহঙ্কারী। আর কিছু না বলিয়া আমি জানালা দিয়া। মুখ বাহির করিয়া রাস্তার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, একটা লোক যেন কোন বাড়ী খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। বলিলাম, রাস্তায় একটা লোক কার বাড়ী খুঁজে বেড়াচ্ছে।

গোবিন্দবাবু সেইদিকে চাহিয়া বলিলেন, কে, ঐ লোকটা? পল্টনের পেন্‌সনী সুবেদার দেখছি, এখন পুলিসের জমাদারী কছে।

আমি মনে মনে বলিলাম, আমাকে বাহাদুরী দেখান হচ্ছে। নিশ্চয়ই একে চেনেন। আর না চিলেও জানেন যে, উনি যা বলবেন, আমি তাই বিশ্বাস করব।

এই সময়ে সেই লোক আমাদের বাসায় প্রবেশ করিল। আমরা উভয়ে অগ্রবর্তী হইলাম। সে বলিল, আমি গোবিন্দ দারোগা সাহেবকে খুঁজছি। এই কি তার বাসা?

গোবিন্দ। আমিই গোবিন্দ দারোগা। কি চাও বাপু?

সে সেলাম দিয়া বলিল, ডিটেকটিভ-ইনেস্পেক্টর সূরযমল সাহেব এই পত্র দিয়েছেন।

গোবিন্দ বাবু পত্ৰ লইয়া খুলিলেন। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি কাজ কর?

সে বলিল, আগে পল্টনে সুবাদারী করতেন, এখন পেন্‌সন নিয়ে পুলিসে জমাদারী কচ্ছি।

পত্রের কোন উত্তর নাই, শুনিয়া সে সেলাম দিয়া চলিয়া গেল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু পত্র পাঠ করিয়া আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি মনে করেন এই লোকটাকে আমি আগে চিনতেম, তা নয়। আমি কোন জন্মে ওকে আগে দেখি নাই।

আমি বলিলাম, তবে কি করে জানলেন যে, ও আগে পল্টনে ছিল, এখন পুলিসে আছে?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, অতি সহজে জানা যায়। আপনি যদি এ বিদ্যা শিক্ষার চেষ্টা করতেন, তা হলে আপনিও সহজে বলতে পাতেন। আমি দেখলেম, লোকটার বুকে একখানা মেডেল ঝুলছে, চলন সাধারণ সিপাইয়ের মত নয়, আফিসারের ধাঁজা; সুতরাং বুঝলেম, লোকটা পল্টনে সুবাদার ছিল। তার পর দেখলেম, বয়স হয়েছে; যদিও পুলিশের পোষাক পরা নেই, তবে মাথায় জমাদারের পাগণ্ডী রয়েছে, কাজেই তখনই বুঝলেম যে, লোকটা পেন নিয়ে এখন পুলিশের জমাদারী করছে। দেখলেন, সব বিষয়ে দৃষ্টি থাকলে কত শীঘ্র কত বিষয় জানা যায়।

আমি বলিলাম, যথার্থই আশ্চর্যজনক,সন্দেহ নাই। তিনি সেই পত্রখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, পড়ুন।

আমি পড়িলাম; প্রিয় গোবিন্দ বাবু!

কাল রাত্রে সেটী-মহল্লায় একটা ভয়ানক কাণ্ড হইয়া গিয়াছে। গোলযোগ বলিয়া বোধ হইতেছে। রাত্রি প্রায় দুইটার সময় বিটের কনেষ্টবল একটা খালি বাড়ীর ভিতর একটা আলো অলিতেছে,দেখিতে পায়। সে গিয়া দেখে সদর দরজা খোলা; ভিতরে গিয়ে দেখে যে, সম্মুখের ঘরের মেয়ে একটি ভদ্রলোকের মৃতদেহ পড়িয়া আছে। খবর পাইয়াই আমরা গিয়ে উপস্থিত হই। পোষাক-পরিচ্ছদে দেখি লাম, লোকটা মারাঠী, ঘর রক্তময়, অথচ মৃতদেহের কোনখানে আঘাতের চিহ্নমাত্র নাই। পকেটে পঁয়তাল্লিশটা টাকা আর দুখানা চিঠী ছিল। ঠিকানায় লেখা শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাং, কেয়ার অব পোষ্ট মাষ্টার লাহোর, আর একখানিতে বালকিষণ লক্ষ্মণ রাও, কেয়ার অব পোষ্ট মাষ্টার লাহোর। চিঠী একখানা খোলা, একখানা বন্ধ। আমরা যেখানকার যা সেই রকমই রেখেছি; আপনি যদি একবার অনুগ্রহ করিয়া আসেন, তবে বড়ই উপকৃত হই। আপনার জন্য অপেক্ষা করিতেছি। ইতি।
বশংবদ
শ্ৰীসূরযমল।

আমার পত্র পাঠ শেষ হইলে গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সূরযমল লাহোর-পুলিশের একজন প্রধান ডিটেকটিভ। আর যে ইনস্পেক্টরটি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, গোয়েন্দাগিরীতে তারও খুব সুখ্যাতি আছে। তার নাম রাম সিং; কিন্তু দুজনে আদা-কাচকলার বন্ধুত্ব। দুজনেই খুব চালাক বটে, কিন্তু পূর্ব ভাবটা ঠিক বজায় রেখেছে। এই জন্যই এরা প্রায়ই খুন জাল জুয়াচুরীর কোন কিনারা করতে পারে না। তাড়াতাড়ি করে মরে। এই দুজনকে যদি এই ব্যাপারের একটু কিছু সূত্র ধরিয়ে দেওয়া যায়, তবে বড়ই মজা হয়।

তিনি যে রূপে স্থির ভাবে এই কথা বলিলেন, তাহাতে আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম। বলিলাম, বোধ হয়, আপনার আর দেরি করা উচিত নয়। আপনার জন্য কি একখানা গাড়ী ডেকে এনে দিব।

তিনি হাসিয়া বলিলেন, আমি যাব কি না ঠিক নাই?

আমি। কেন? আপনি ত এই চান।

গোবিন্দ। সত্য বটে, কিন্তু আমার লাভ কি? প্রশংসা হলে সে প্রশংসা সূরযমল রাম সিং এণ্ড কোম্পানীরই হবে।

আমি। এমন সময় একদিন আসবে, যখন আপনার নাম জগদ্বিখ্যাত হবে।

তিনি হাসিয়া বলিলেন, আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। তৎপরে একটু ভাবিয়া বলিলেন, আচ্ছা গিয়েই একবার দেখা যাক্। আসুন।

আমি বলিলাম, আমিও যাব কি?

গোবিন্দ। ক্ষতি কি? যদি কোন কাজ না থাকে, আসুন না; একটা নূতন বিষয় দেখা হবে।

আমরা উভয়ে রওনা হইলাম। বাহিরে আসিয়া একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া কোচম্যান্‌কে সেটী-মহল্লায় লইয়া যাইতে বলিলাম। গোবিন্দ বাবু ঝিঁঝিট-খাম্বাজের গৎ ভাঁজিতে ভাঁজিতে চলিলেন।

আমি তাহার ভাব দেখিয়া বলিলাম, আপনি দেখছি, যে কাজে। যাচ্ছেন, সে বিষয়ে একটুও ভাবছেন না।

তিনি বলিলেন, সব না দেখে-শুনে মনে মনে কিছু আন্দাজ করে আগে থাকতেই ধারণাটা খারাপ করা বড়ই ভুল। এতে আর পরে বাধীন চিন্তার ক্ষমতাটা থাকে না।

কিয়ৎক্ষণ পরে গাড়োয়ান গাড়ী থামাইয়া বলিল, এই সেটী-মহল্লা।

গোবিন্দ বাবু গাড়ী হইতে নামিলেন; সঙ্গে সঙ্গে আমিও নামিলাম। তিনি কোচম্যানকে গাড়ী লইয়া সঙ্গে সঙ্গে আসিতে বলিয়া হাঁটিয়া চলিলেন। নিকটস্থ একজন কনেষ্টবলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কাল রাত্রে কোন্ বাড়ীতে খুন হয়েছে?

সে দেখাইয়া দিল। আমরা বাড়ীর সম্মুখে আগিয়া দেখিলাম, বাটার চারিদিকে প্রাচীর আছে, সম্মুখে একটি গেট, ঐ গেট হইতে একটি পথ বাড়ীর সদর দরজার সিঁড়ী পর্যন্ত গিয়াছে। বাড়ীর সম্মুখে এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে হিন্দীতে লেখা আছে। কাল রাত্রে বৃষ্টি হইয়াছিল, সুতরাং রাস্তায় গভীর চাকার দগ অনেক মানুষের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাইতেছে।

আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবু প্রথমেই বাড়িতে প্রবেশ করিয়া লাস দেখিবেন; কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া সদর রাস্তা ও বাড়ীর রাস্তা বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। চারিদিক দেখিয়া ধীরে ধীরে পথের ধারে ঘাসের উপর দিয়া চলিতে আরম্ভ করিলেন। আমাকেও সেইরূপ করিতে বলিলেন।

* *****

বাড়ীর দরজায় একজন কনেষ্টবল দাঁড়াইয়া জনতা দূর করিবার চেষ্টা পাইতেছে; চেষ্টা বৃথা, কেহ সেখান হইতে নড়িতেছে না। বাড়ীর ভিতর কি হইয়াছে ও হইতেছে দেখিবার জন্য উৎসুক হওঁ। সেই দিকে মাথা তুলিয়া চাহিতেছে। আমরা উপস্থিত হইলে সেই দ্বার রক্ষক কনেষ্টবল একটা সেলাম করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।

এই সময়ে সূরযমল নিকটে আসিয়া বলিলেন, আপনার আসায় বড়ই বাধিত হলেম। যা যেখানে ছিল, আপনার জন্য তা সব ঠিক সেই রকমই রেখেছি।

গোবিন্দরাম। গোবিন্দ বাবু পথের দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কেবল ঐটী। এক দল মহিষের আমদানী হলেও ত বোধ হয়, রাস্তা এমন বখৎ হত না। নিশ্চয়ই, সূরযমল সাহেব, রাস্তাটা এ রকম হতে দেবার আগে আপনি এটা বিশেষ লক্ষ্য করেছিলেন।

সূরযমল একটু অপ্রস্তুত হইলেন। বলিলেন, আমি ভিতরের ব্যাপার নিয়েই বড় ব্যস্ত ছিলাম। রাম সিং সাহেব এখানে ছির ন, তিনি নিশ্চয়ই সব লক্ষ্য করেছেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আপনাদের মত দুজন সুদক্ষ লোক যখন রয়েছেন, তখন সকলবিষই লক্ষ্য করেছেন সন্দেহ নাই।

সূরযমল উৎসাহের সহিত বলিলেন,না—না, কিছু ফাঁক পড়ে নাই। গেল। আপনি এখানে গাড়ী করে এসেছেন কি?

সুরয। না।

গোবিন্দ। রাম সিং সাহেব?

সূরয। না।

গোবিন্দ। তবে চলুন ভিতরটা একবার দেখা যাক।

আমরা সকলে একটি প্রকোষ্ঠে প্রবিষ্ট হইলাম। বহুদিন লোকের বসবাস না হওয়ায় গৃহতলে প্রায় চার আঙ্গুল ধূলা জমিয়াছে। মধ্যস্থলে একটি মৃতদেহ পড়িয়া আছে। লোকটি ছাদের দিকে বিকটভাবে চাহিয়া রহিয়াছে। আমি যুদ্ধে অনেক অনেক ভয়াবহ মৃতদেহ দেখিয়াছি, কিন্তু এই লাসের মুখের মত বিভীষিকাময় বিকৃত মুখ আর কখনও দেখি নাই। দেখিলে বোধ হয়,যেন লোকটা গুরুতর পাপী, মৃত্যু সময়ে কি ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল। এই মৃতদেহ দেখিয়া আমার শিরায় শিরায় প্রবল বেগে রক্ত ছুটিল। আমি গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, তিনি অতি স্থির চিত্তে এই মৃতদেহ বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিতেছেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

আমরা দেখিলাম, রাম সিং আশে-পাশের ঘর সকল দেখিতেছেন। তিনি আমাদের দেখিয়া নিকটে আসিয়া বলিলেন, খুব গোলমেলে মালা, সন্দেহ নাই। আমি অনেক খুন দেখেছি, কিন্তু এই খুনের মর্ম কিছুই বুঝতে পারছি না।

সূরযমল ও বলিলেন, হাঁ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

গোবিন্দ বাবু হাঁটু পাতিয়া বসিয়া মৃতদেহ বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন যে কোনখানে কোন অস্ত্রের দাগ নাই। ঘরময় তো রক্ত।

উভয়েই বলিলেন, আমরা বিশেষ করে দেখেছি। লাসের কোন খানে অস্ত্রাঘাতের কোন চিহ্ন নাই।

গোবিন্দ। তা হলে এই রক্ত নিশ্চয়ই আর এক জনের। সম্ভবত সেই লোকই এই খুন করেছে।

রাম। সেটা কিরূপে সম্ভব?

গোবিন্দ। সম্ভব সব। আপনি কি বোম্বের পেষ্টনজী তোরাবজীর খুনের কথা পড়েন নাই?

রাম। না।

গোবিন্দ। পড়া উচিত। সংসারে প্রায়ই নূতন কিছু হয় না। যা হয়েছে তাই হয়।

বলিয়া গোবিন্দ বাবু মৃতদেহের সর্বাঙ্গ বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, তবে কোন অস্ত্রে এর মৃত্যু হয় নাই— রক্ত অন্যের। পকেটে টাকা ছিল, সুতরাং টাকার জন্যেও কেহ একে খুন করে নাই। যাক্, যা দেখবার দেখা হয়েছে। এখন লাশ চালান দিতে পারেন।

লাস চালান দিবার বন্দোবস্ত পূৰ্বেই স্থির ছিল। শববাহিগণ লাস তুলিবার উদ্যেগ করিলে লাসের বস্ত্র মধ্য হইতে একটি সুন্দর ইয়ারিং ইক করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। রাম সিং গিয়া এস্তে সেটা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, দেখছি, এটি কোন স্ত্রীলোকের ইয়ারিং, তবে এখানে একজন স্ত্রীলোকও উপস্থিত ছিল।

আমরা সকলে সেই ইয়ারিংটি বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলাম।

সূরবমল বলিলেন, এতে আরও রহস্য ক্রমে বেড়ে উঠছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কেন? এতে কি আপনি মনে করেন যে, এ খুনের কিনারা করা সহজ হবে? পুলিশ কৰ্ম্মচারিদ্বয়ের কেহই কোন উত্তর করিলেন না।

তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ডাকঘরে খবর নেওয়া হয়েছে কি?

সূরয। হা, পত্ৰ এরা ডাকঘর থেকেই নিয়ে যেতেন; তবে, একজন পিয়ন একবার এদের বাসা দেখেছিল, সে চিঠী বিলি কছিল, এই সময় এদের একজন একটা বাড়ী হতে বার হচ্ছিলেন। সে সেলাম করলে একজন বলেন, এই বাড়ীতে আমরা থাকি। সকালে সে পিয়ন ডাকঘরে ছিল না। তার সন্ধানে আবার লোক পাঠিয়েছি।

গোবিন্দ। ভাল, এর পকেটে যে চিঠী আছে তা নাসিক থেকে এসেছে দেখছি। নাসিকে টেলিগ্রাফ করেছেন?

সূরয। হাঁ, এখনও উত্তর পাই নাই।

গোবিন্দ। কি টেলিগ্রাফ, করেছেন, শুতে পাই?

সূরয। ঘটনা সব জানিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা কিছু খবর দিতে পারেন কি না।

গোবিন্দ। কেবল এই? সূরয। আর বিশেষ কি টেলিগ্রাফ করব?

এই সময়ে রাম সিং পশ্চিম দিক্কার গৃহ-প্রাচীর দেখাইয়া দ্বিয়া বলিলেন,দেখুন, দেখুন। আমরা সকলে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, তথায় বড় বড় অক্ষরে কি লেখা আছে। নিকটে গিয়া দেখিলাম, সুস্পষ্ট রক্তে লেখা–

সাজা

রাম সিং সোৎসাহে বলিলেন, দেখুন এটা রক্তে স্পষ্ট লেখা। লিখিবার সময় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়েছিল, তাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা হোক্, এতে লোকটা যে আত্মহত্যা করে নাই, তা জানা যাচ্ছে। যে একে খুন করেছে, সেই কাল রাত্রে এটা লিখে গেছে।

সূরয। তা তো বুঝতে পারা গেল, কিন্তু তুমি এ দেখে কি ভাবছ বল দেখি?

রাম। আমার স্পষ্টই বোধ হচ্ছে, এই ব্যাপারে কোন-না-কোন স্ত্রীলোক জড়িত আছে; পরে জানা যাবে। বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোকের, নাম সাজাদী। লোকটা লিখতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে চলে গেছে।

গোবিন্দ বাবু এতক্ষণ নীরবে দাড়াইয়া ছিলেন ; এক্ষণে বলিলেন, ঘরটা এতক্ষণ আমি বিশেষ পরীক্ষা করি নাই। আপনাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে ত এখন দেখতে পারি।

উভয় পুলিশ-কর্ম্মচারীই বলিয়া উঠিলেন, নিশ্চয়ই দেখিতে পারেন।

তখন গোবিন্দ বাবু পকেট হইতে একটা মাপের টেপ, বাহির করিয়া ঘর ও প্রাচীরের নানা স্থান মাপিতে লাগিলেন। ঘরের মেজে বিশেষ রূপে পৰ্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। এক স্থান হইতে কতক গুলি সাদা ধূলা বা ছাই যন্ত্রে সংগ্রহ করিয়া একটা কগজে মুড়িয়া পকেটে রাখিলেন। তৎপরে চারিদিক বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া পকেট হইতে ধীরে ধীরে একখানি ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস বাহির করিলেন। ঐ গ্লাস দ্বারা নানা স্থান দেখিলেন। রক্তে লেখা কথাটি উহার দ্বারা খুব ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন। আমরা সকলে নীরবে; দাঁড়াইয়া তাহার কাৰ্য-কলাপ দেখিতে লাগিলাম।

কিয়ৎক্ষণ পরে ধীরে ধীরে গ্লাসখানি পকেটে রাখিয়া গোবিন্দ বাবু বলিলেন, হয়েছে। এখন যেতে পারা যায়।

সূরযমল বলিলেন, আপনি কি মনে করেন?

গোবিন্দ। আপনারা যেরূপ এ বিষয়ে চেষ্টা করছেন, তাতে আমার এখন কিছু বলা ধৃষ্টতা মাত্র। তবে আপনারা কতদূর কি করেন, যদি তা আমায় জানান, তবে পরে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যতদূর সম্ভব হয়, তা আমি বলতে পারি। কাল রাত্রে এ বিটে যে কনেষ্টবল ছিল, তার সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।

রাম। সে এখন থানায় আছে। সেখানে গেলেই দেখা হতে পারে।

গোবিন্দ। আমি এখনই তার সঙ্গে দেখা কব মনে করেছি।

আমরা সকলে বাড়ীর বাহিরে আসিলাম। বিদায় হইবার সময়  গোবিন্দ বাবু গম্ভীর ভাবে বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনি কোন স্ত্রীলোকের সন্ধানে বৃথা সময় নষ্ট করবেন না। কোন স্ত্রীলোক এখানে কাল রাত্রে ছিল না—দুজন মাত্র লোক ছিল। লোকটা খুন হয়েছে, আত্মহত্যা করে নি। যে খুন করেছে-সে পুরুষ, স্ত্রীলোক নয়। সে ছয় ফুটের চেয়ে লম্বা, বয়সে যুবক, পা দেহের পরিমাণে ছোট। অতি মোটা, নাগরা জুতা পায়ে ছিল। বর্ম্মা চুরুট খাচ্ছিল। সে এই লোকটাকে একখানা এক্কায় এখানে এনেছিল। এক্কার ঘোড়ার তিনটা লাল পুরাণ ও একটা নূতন ছিল। লোকটার সম্ভবমত যক্ষ্মা বা রক্ত পিত্তের ব্যারাম আছে। এখন এই পর্যন্ত বলতে পারি।

গোবিন্দ বাবুর কথা শুনিয়া আমরা তিন জনই বিশেষ আশ্চৰ্য্যাম্বিত হইলাম। কেহই কোন কথা কহিলাম না। অবশেষে সূরযমল বলিলেন, যদি খুনই হয়ে থাকে, তবে কি করে খুন হল?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বিষে। তৎপরে রাম সিংহের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, লোকটা সাজা লিখতে গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল। সাজা উর্দ্দু, কথা, মানে প্রতিহিংসা; সুতরাং আপনি সাজাদী নামের মেয়ে মানুষ খুঁজতে অনর্থক সময় নষ্ট করবেন না। এই বলিয়া তিনি আমার হাত ধরিয়া দ্রুতপদে বাহিরে আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন।

গাড়ী থানার দিকে ছুটিল।

সরমল আমাদের সঙ্গে একজন কনেষ্টবল দিলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

তথা হইতে বহির্গত হইয়া গোবিন্দ বাবু গাড়োয়ানকে তার অফিসে যাইতে আজ্ঞা করিলেন। তথায় একটি টেলিগ্রাফ করিয়া তিনি আবার আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন; তৎপরে বলিলেন, যদিও এ সম্বন্ধে আমি একটা স্থির ধারণ করিয়াছি, তবুও আরও কিছু জানা ভাল।

আমি বলিলাম, আমি আপনার কথায় আশ্চর্যান্বিত হইয়াছি। সত্য সত্যই কি আপনি উহাদের দুইজনকে যাহা বলিলেন, তাহা বিশ্বাস করেন?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ইহাতে ভুল হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। আমি প্রথমেই পথে লক্ষ্য করিলাম যে একখানা এক্কার চাকার দাগ কাদায় স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। কাল রাত্রি বারটা-একটার সময় বৃষ্টি হইয়াছিল, সুতরাং এই এক্কা নিশ্চয়ই এখানে একটার পরে আসিয়াছে। বোধ হয়, আপনাকে বলিতে হবে না যে, একার চাকার দাগ আর অন্যান্য গাড়ীর চাকার দাগ সকলই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র। তার পর একটা ঘোড়ার পায়ের দাগ পড়িয়াছে; পায়ের তিন পায়ের অপেক্ষা এক পায়ের দাগ বেশী বসিয়াছে, সুতরাং বুঝিতে বেশী কষ্ট হয় না যে ঐ নালটা অপর তিনটা হতে নূতন ছিল।

আমি। যথার্থই আপনার কথায় আমি অবাক হচ্ছি।

গোবিন্দ। না না,অবাক হবার কিছুই নাই। চেষ্টা করিলে সকলেই এরূপ পারেন। তার পর এই গাড়ীখানা ভিন্ন যে আর কোন গাড়ী এখানে আসে নি, তা আর কোন গাড়ীর চাকার দাগ না দেখতে পেয়েই স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। আর দুজনের বেশী লোক যে এক্কায় আসে নাই তাও আমি বুঝলেম, ঘোড়র পায়ের দাগ দেখে। ঘোড়াটা স্থির হয়ে দাড়িয়ে ছিল না। পায়ের দাগ দেখে বোঝা যায়,এদিক ওদিক করছিল। যদি কেউ এর রাস ধরে বা মুখ ধরে থাকত, তবে ঘোড়া কখনও এমন করতে পারে না। লোকটা অপর লোককে নিয়ে বাড়ীর ভিতর গিয়েছিল, গাড়ী এমনই রাস্তায় দাড়িয়ে ছিল। গাড়ীর কাছে কোন লোক ছিল না। আর সাক্ষী সঙ্গে করে কেউ খুন করতে আসে না। আর কেবল দুজন লোক যে বাড়ীর ভিতর গিয়েছিল, তা তাদের পায়ের দাগেই বেশ জানা যায়। আমি কেবল দুজন লোকের পায়ের দাগই লক্ষ্য করেছিলাম, আর অধিক লোকের পায়ের দাগ দেখা যায় না। আরও লক্ষ্য করেছি, একজনের পায়ে নাগরা জুতা,একজনের পায়ে বিলাতী জুতা; যাঁর বিলাতী জুতা, তিনি এই মরে পড়ে আছেন; কাজেই নাগরা জুতাধারী মহাশয় এই হত্যা ক্রিয়া সম্পন্ন করে স্বস্থানে প্রস্থান করেছেন।

আমি। আপনি যথার্থই অদ্ভুত লোক, কিন্তু লোকটা যে ছয় ফুট লম্বা, তা কিরূপে জালেন?

গোবিন্দ। লেকের পা ফেলার দাগ দেখে শতকরা নিরনই জনের দৈর্ঘ্য বলা যায়। যে যেমন লম্বা বা বেঁটে সে তেমনই দূরে বা কাছে পা ফেলে। এ সব অনেক কথা; আর একদিন বলব।

আমি। তার পর বয়স?

গোবিন্দ। এও পা ফেলার দাগ দেখে, বলা যায়। একজন বালক যত দূরে দূরে পা ফেলে বা যেমন করে পা ফেলে, একজন যুবক বা বৃদ্ধ তেমন পারে কি? এসব বিশেষ লক্ষ্য করতে হয়, রীতিমত মনোযোগ দিয়ে শিখতে হয়। শিখতে পারূলে পা ফেলার দাগ দেখে লোকের বয়স বলা খুব সহজ।

আমি। এও যেন মানিলাম; তারপর রক্ত-পিত্তের ব্যারাম।

গোবিন্দ। এটা কতকটা আন্দাজ, তবে খুব সম্ভব। লাসের কোন থানে আঘাতের দাগ নেই, তবে ঘরে এত রক্ত এল কোথা থেকে? তা হলে এ রক্ত যে খুন করেছে তারই। কিন্তু যদি সে এই লোক টার দ্বারা আঘাতিত হয়ে থাকে, তবে, সে চুপ করে দাড়িয়ে হয় নাই। তা হলে একটা ছোটাছুটি ঠেলাঠেলি ধস্তাধস্তি হতো। তা হলে ঘরেও তার চিহ্ন থাকত। সুতরাং সে আহত হয় নি। নিজে নিজে আহত হবারও কোন কারণ নাই। যদি আত্মহত্যা করতে যেত, তা হলে সে এইখানেই পড়ে থাকৃত; এক্কায় উঠে চলে যেতে পারে না। তাই ভাবছি লোকটার রক্ত-পিত্তের বোগ ছিল। এ রোগে খুব বেশি রাগ হলে বা কোন রকমে উত্তেজিত হলে, অনর্গল রক্ত মুখ দিয়ে বার হতে থাকে। এ রক্তারক্তি ব্যাপার দেখে আমার ত তাই মনে হয়।

আমি। আর বর্মা চুরুট।

গেবিন্দ বাবু এবার একটু হাসিয়া বলিলেন, চুরুটের ছাই আমি যতটা চিনতে পারি, বোধ হয় আর কেউ ততটা পারে না। আপনি দেখলেন না, মেজে থেকে কতকটা ছাই তুলে আমি কাগজে মুড়ে পকেটে রেখেছি। এ ছাই বৰ্ম্মা চুরুটের।

আমি। যে খুন করেছে, সেই যে খাচ্ছিল তার মানে কি?

গোবিন্দ। বিলাতী জুতার এলোমেলো পা ফেলা দেখেই বুঝেছি লোকটাখুব মাতাল হয়েছিল; তারপর এর মুখ শুকেও দেখলেম, মুখে কেবল মদের গন্ধ। আর এ লোকটা যে মনে অজ্ঞান ছিল, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। নতুবা এ ইচ্ছে করে খুন হতে এই বাড়ীতে আসে নাই। লাসের মুখের বিকট ভাব দেখে বুঝলেন না যে, মবার সময় লোকটা তার হত্যাকারীকে চিন্‌তে পেরেছিল। বিস্ময় ভয়, রাগ, সব মিশিয়ে মুখের কি একটা ভয়ানক ভাব হয়েছে।

আমি শিহরিত হইলাম—কিয়ৎক্ষণ কোন কথাই কহিতে পারিলাম না। তৎপরে বলিলাম, ঘটনা খুব রহস্যময় সন্দেহ নাই। এই দুই জন কেন এত রাত্রে এ বাড়ীতে এল, কেনই বা একজন আর একজনকে খুন করলে? কেনই বা সে দেয়ালে সাজ লিখে গেল। বলতে কি, আমি এখনও এর কিছুই স্থির করে উঠতে পারছি না।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ক্রমে সবই পাবেন। সে সাজ লেখে নাই, সাজা–অর্থাৎ প্রতিহিংসা বা দণ্ড লিখতে যাচ্ছিল,তাড়াতাড়িতে সবটা লিখতে পারে নি। সাজার শেষ ‘আ’রের টান মাত্র ধরেছিল। কাজেই বোঝা যায়, লোকটা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্য, খুন করেছে। বিশেষতঃ বুকে একটা বড় রকমের আঘাত না পেলে কেউ কারও প্রাণ নিয়ে টানাটানি করে না। ইয়ারিং দেখে অনুমান হয়, এর স্ত্রী বা প্রণয়পাত্রী সম্বন্ধে কোন হানি করায় এই সাজা। আর অস্ত্র ঘাতের কোন চিহ্ন না থাকায় সহজেই বোঝা যায়, লোকটা বিষে খুন হয়েছে। পরে সব জাতে পারবেন। এখন আসুন,এই পুলিশ-বারিক।

গাড়ী হইতে নামিয়া আমরা উভয়ে কনেষ্টবলের সঙ্গে পুলিশ বারিকে প্রবিষ্ট হইলাম। গত রাত্রে যে কনেষ্টবল যে বাড়ীতে খুন হইয়াছে সেইখানকার বিটে পাহারায় ছিল, সে শীঘ্রই আসিয়া গোবিন্দ বাবুকে সেলাম দিল। গোবিন্দ বাবু আমাকে ইঙ্গিত করিয়া এক খান খাটিয়ায় নিজ দেহভার অর্পণ করিলেন। আমিও বসিলাম।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমিই কি কাল সেই বিটে রাত্রে পাহারায় ছিল।

সে উত্তর করিল, হাঁ হুজুর, রাত দুটা থেকে চারটা পর্যন্ত আমার পাহারা ছিল।

গোবিন্দ। আচ্ছা, তুমি সেখানে কি কি দেখেছিলে, আগাগোড়া আমাদের বল দেখি।

কনেষ্টবল। হাঁ হুজুর, আগাগোড়া যা যা হয়েছিল, সব বলে যাচ্ছি।

গোবিন্দ। হাঁ, কিছু বাদ দিও না।

কনেষ্ট। দুটোর সময় আমার বিটে গিয়ে আমার জুড়ীদারের সঙ্গে মোড়ে দাড়িয়ে কথাবার্তা করে শেষ সেটী-মহল্লার দিকে গেলাম, জুড়ীদার অন্যদিকে গেল। বড় ভারি অন্ধকার, রাস্তার আলো মিট মিট করছে, কিছুই ভাল দেখা যায় না। কোন দিকে কেউ নেই। একটু আগে বৃষ্টি হওয়ায় কাদাও খুব হয়েছে। আমি আস্তে আস্তে যাচ্ছি, এমন সময় আমার নজর হঠাৎ একটা বাড়ীর আলোর দিকে পড়ল। আমি জানতেম, সে বাড়ীটা খালি ছিল। ওলাউঠায় বাড়ীটায় তিন-চার জন মরে যাওয়ায় সেই পৰ্যন্ত বছরখানেক খালি পড়ে আছে, কেউ ভাড়া নেয় না। কেউ কেউ বলে বাড়ীটায় ভূত আছে।

গোবিন্দ। আচ্ছা ভূতের কথা পরে শুনব—এখন থাক্‌, তার পর কি হল তাই বল।

কনেষ্ট। খালি বাড়ীতে আলো দেখে ব্যাপার কি জানার জন্য আমি দরজা পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু

গোবিন্দ। কিন্তু ভিতরে যেতে ভয় পেয়ে ফিরে এলে?

কনেষ্টবল আশ্চর্যান্বিত হইয়া গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিল। গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, ভয় নেই, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না।

কনেষ্টবল কহিল, হুজুর, সে কথা ঠিক। যদিও আমি মানুষকে ভয় করিনে—কিন্তু ভূতের সঙ্গে লড়া শক্ত। তাই মনে করুলেম, জুড়ী দারকে সঙ্গে লওয়া ভাল। সেইজন্য সেখান থেকে ফিরে, রাস্তার জুড়ীদারের সন্ধানে এলেম।

গোবিন্দ। এ অবস্থায় কাকেও দেখতে পেলে?

কনেষ্ট। না, কোথাও কাকেও দেখতে পাই নি।

গোবিন্দ। তার পর তুমি আবার দরজার দিকে এলে?

কনেষ্ট। হাঁ হুজুর-সরকারী চাকরী, এতে ভয় কর চলে না। জবাবদিহি করতে হবে ভেবে আমি দরজার কাছে এসে দরজাটাতে হাত দিতেই যেন সেটা আপনা হতেই খুলে গেল। দেখি, জানালার কাছে একটা বাতি জ্বলছে। তার পর আমি সেই ঘরে ঢুকে দেখি

গোবিন্দ। (বাধা দিয়া) যা দেখলে তা আমরা জানি। তুমি চার-পাঁচ বার ঘরের চারদিকে ঘুরে, লাসের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। ভাল করে সেটাকে দেখতে লাগলে?

কনেষ্টবল এবার বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়া বিস্ফারিত নয়নে গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিল, হুজুর সে সময়ে সেখানে আপনি কোথায় ছিলেন?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন,আমি সেখানে ছিলাম না। তার পর কি হল?

কনেষ্ট। তার পর জুড়ীদারকে চেঁচিয়ে ডালেম। সেও ছুটে সেখানে এল।

গোবিন্দ। সে সময়ে কোন লোককে রাস্তায় দেখতে পেলে?

কনেষ্ট। হাঁ, কিন্তু সে লোকের মত লোকই নয়।

গোবিন্দ। সে কি?

কনেষ্ট। দেখলেম, রাস্তায় একটা লোক মাতাল হয়ে টছে। সে দেয়ালে ঠেস্ দিয়ে গান ধরেছে। দাঁড়াতে পারছে না, গান গলা দিয়ে বেরুচ্ছে না। হুজুর, অনেক অনেক মাতাল দেখেছি, কিন্তু এমন মাতাল কখন দেখিনি।

গোবিন্দ। তাকে ধলে না কেন?

কনেষ্ট। আমাদের তখন খুনই প্রধান কাজ, মাতাল ধরার সময় নয়।

গোবিন্দ বাবু ভ্রূকুটি করিলেন। বিরক্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, লোকটার চেহারা কেমন?

কনেষ্ট। তাও তখন ভাল করে দেখিনি। আমরা দুজনে তাড়াতাড়ি লাস দেখতে ছুটলেম।

গোবিন্দ। তবে তার কিছুই ভাল করে দেখ নাই?

কনেষ্ট। না।

গোবিন্দ। তার পর সে লোকটার কি হল?

কনেষ্ট। তার পর সে কোন গতিকে নিশ্চয়ই নিজের বাড়ীর দিকে চলে গিয়েছিল।

গোবিন্দ। তার হাতে কি একটা চাবুক ছিল ?

কনেষ্ট। মনে নাই, বোধ হয়—ছিল না।

গোবিন্দ। কোন গাড়ী বা একা কাছে দেখেছিলে বা গাড়ীর শব্দ শুনতে পেয়েছিলে?

কনেষ্ট। না।

আচ্ছা, আর কিছু জাবার নাই। বলিয়া গোবিন্দ বাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠিলাম। বাহিরে আসিয়া তিনি বলিলেন, এই গাধা অনায়াসে কাল রাত্রে নিজের প্রমোসন পেতে পাত, যে খুনীর সন্ধানে সূরযমল আর রাম সিং আজ আকাশ পাতাল ভেবে মছে, কাল রাত্রে এ তাকে অনায়াসে ধতে পারত।

আমি বলিলাম, কি রকমে?

তিনি বলিলেন, যে খুন করেছিল, সেই মাতালের ভাণ করে এই গাধার চোখে ধূলা দিয়েছে।

আমি। সে কেন আবার সেই বাড়ীর কাছে আসবে?

গোবিন্দ। ইয়ারিং-ইয়ারিং। এটা আর বুঝতে পারছেন না, ইয়ারিংয়ের তল্লাসে এসেছিল। ডাক্তার, আমি এই খুনীকে ধরেছি, কেবল হাতে হাতকড়ী দিতে বাকী।

আমি। আপনি কি বলতে চান, যে লোক খুন করেছে, সে কে, আপনি জানতে পেরেছেন?

গোবিন্দ। নিশ্চয়। এখন এই পর্যন্ত, পরে সব বলব।

কাজেই আমি আর তাহাকে বেশি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না, নিজেও ক্লান্ত হইয়াছিলাম। বাসায় আসিয়াই শুইয়া পড়িলাম।

পর দিবস প্রাতে গোবিন্দ বাবু আমাকে একখানি সংবাদপত্র, দেখিতে দিলেন। বলিলেন, এই বিজ্ঞাপনটা একবার দেখুন।

আমি দেখিলাম;–

কুড়ান পাওয়া গিয়াছে,–গত রাত্রে সেটী-মহল্লার রাস্তায় একটি ইয়ারিং কুড়াইয়া পাওয়া গিয়াছে। যাঁহার হারাইয়াছে, তিনি সিং দরজার ৪নং বাড়ীতে ডাক্তার বসুর নিকট আবেদন করিলে পাইবেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বিনানুমতিতে আপনার নাম ব্যবহার করিয়াছি, ক্ষমা করিবেন।

আমি বলিলাম,তাতে কিছুই ক্ষতি হয় নাই; তবে যদি কেহ আসে, তবে আমার কাছে ত ইয়ারিং নাই।

গোবিন্দ। ভয় নাই, আমি বাজার থেকে একটা ইয়ারিং কিনে এনেছি। এইটাতেই আমাদের কাজ চলবে।

আমি। আপনি কি মনে করেন, কেউ আসবে? গোব। নিশ্চয়ই। খুব সম্ভব সেই লোকই আবে। সে কোন রকমে ইয়ারিংটা ফেলে এসেছিল, পথে এসে ইয়ারিং সঙ্গে নেই দেখে ইয়ারিং খুঁজতে ফিরে এসেছিল; কিন্তু কনেষ্টবল দেখে মাতালের ভাণ করে চলে যায়। কাজেই সে মনে করতে পারে যে, ইয়ারিংটা হয় ত রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকবে।

আমি। সে কি এখানে আসা নিতান্ত বিপজ্জনক মনে করবে না?

গোবিন্দ। কেন? সে ভাববে যে ইয়ারিংটা নিশ্চয়ই রাস্তায় কোন গতিকে পড়ে গিয়েছিল, সুতরাং খুনের সঙ্গে যে ইয়ারিংটা পার কোন সম্ভাবনা আছে, তা তার মনে হবে না। পাছে সে কোন সন্দেহ করে, সেইজন্যই ত আপনার নামে বিজ্ঞাপন দিয়াছি। একজন ডাক্তার ব্যক্তি যে তাকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতেছে, তা তার মনেই হবে না। কাজেই সে নিশ্চয়ই আসবে।

আমি। যদি আসে তবে কি করবেন?

গোবিন্দ। দেখা যাবে তখন; তবে আপনার রিভলবারটি ঠিক করে রাখুন। লোকটাকে বিশ্বাস নেই। সে এলে তার সঙ্গে বেশ গম্ভীর ভাবে কথা কবেন। যেন প্রথমেই সে কোন রকমে কোন সন্দেহ করতে না পারে।

এই সময়ে সদর দরজায় কে কড়া নাড়িল। গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সাবধান,আমরা যে মহাত্মাকে চাই,তিনি উপস্থিত। নিতান্ত পক্ষে যদি স্বয়ং না হন, তাঁরই লোক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

আমরা উভয়ে উৎকণ্ঠিত ভাবে আগন্তুকের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবুর খুনী-যুবকই সত্য সত্যই আসিতেছে, কিন্তু যে আসিল, সে যুবক নহে—একেবারে পুরুষ মানুষই নয়। একটি অতি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক—অতি কষ্টে ধীরে ধীরে গৃহে প্রবিষ্ট হইল। আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিলাম। দেখিলাম তিনি বৃদ্ধাকে স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিতেছেন।

বৃদ্ধা গৃহ মধ্যে আসিয়া কহিল, ডাক্তার সাহেব কি এখানে থাকেন?

আমি সত্বর বলিলাম, আমিই ডাক্তার।

বৃদ্ধা বহুক্ষণ অনুসন্ধান করিয়া পরিধেয় জীর্ণ বস্তু মধ্য হইতে একখানি সংবাদপত্র বাহির করিল; তাহার পর বলিল, এ খবরটা কি আপনি লিখেছেন?

আমি। হাঁ।

বৃদ্ধা। আমার মেয়ে মুনিয়া কাল রাত্রে তার একটা ইয়ারিং হারিয়ে ফেলেছে। সে কাল তার মামার বাড়ী গিয়েছিল, সেই তার মামা রাম সদনিয়া, সোণার—সেই চকের সোণার, তার বড় ব্যেম, তাই দেখতে যায়, আমার মুনিয়া। আমরা বড় গরিব। সে সন্ধ্যার পর সেটী-মহল্লা দিয়ে আছিল; সেইখানেই তার সোণার ইয়ারিং কোথায় পড়ে যায়। আমরা বড় গরীব, পঁচিশ টাকা দিয়ে তাকে কিনে দিই।

আমি ইয়ারিংটি বাহির করিয়া বলিলাম, এই কি সেই ইয়ারিং?

বৃদ্ধা। হাঁ, হাঁ, এই সেই, এই সেই। আহ, আমার মুনিয়া কত খুসী হবে! সে সেই পৰ্য্যন্ত কঁদছে, বাছা আমার বড় ছেলে মানুষ, তার আর কেউ নেই।

আমি। তুমি কোথায় থাক?

বৃদ্ধা। এই—এই—এই ও মহল্লায়। এই চকের পূবদিকে হামির পল্লীতে।

গোবিন্দ বাবু সঙ্কেত করায় আমি বৃদ্ধার হস্তে ইয়ারিং টা দিলাম; দিয়া বলিলাম, এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, এই ইয়ারিংটা আপনার মেয়ে মুনিয়ারই বটে।

বৃদ্ধা ইয়ারিংটা পাইয়া আমাকে বারংবার ধন্যবাদ দিয়া ধীরে ধীরে গৃহের বাহির হইয়া গেল। গোবিন্দ বাবু সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইলেন; বোধ হইল যেন তিনিও বৃদ্ধার অনুসরণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া জানালার নিকট গিয়া মুখ বাড়াইয়া দাঁড়াইলেন। আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া তাহার পাশে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বৃদ্ধা অতি কষ্টে অতি ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়া যাইতেছে। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিতেছেন। বৃদ্ধা বহির্ভূত হইলে গোবিন্দ বাবু শিশ দিতে দিতে আবার আসিয়া চেয়ারে বসিলেন। তিনি কোন কথা কহেন না দেখিয়া আমি অবশেষে বলিলাম, কি বুঝলেন?

গোবিন্দ বাবু আমার দিকে চাহিলেন। বলিলেন, এ হয় সেই লোক, না হয় তার সঙ্গী।

আমি। যদি সেই লোক, তবে ধরিলেন না কেন?

গোবিন্দ। একটু সন্দেহের জন্য। যদি এ সেই লোক হয়, তবে যে রকম বুড়ী সেজেছে, তাতে খুব বাহাদুরী আছে। একটু সন্দেহ হওয়ায় ধরুলেম না, কারণ যথার্থই এ যদি বুড়ী হয়, তবে আমাকে বড়ই অপ্রস্তুত হতে হত। আরও একটি কথা, এ যদি সেই লোক হত, তবে অন্য ইয়ারিং নিজের বলে নিত না। তাও যদি নিয়ে থাকে লোকটা চতুর চূড়ামণি।

আমি। তা যাই হোক, সে নিজে না হলে—তার সঙ্গী ত নিশ্চয়। এর অনুসরণ করা আমাদের উচিত ছিল।

গোবিন্দ। বৃথা। এর অনুসরণ করলে,এখন এ বুড়ীটা–খুবই সম্ভব বুড়ী নয়—কিছুতেই সে সঙ্গীর নিকট যেত না। সচরাচর ডিটেক্‌টিভেরা তাই করে থাকে বটে, কিন্তু আমার প্রথা সেরূপ নয়। অনুসরণ করে অনেক সময়ই ঠিক ফল পাওয়া যায় না।

এই সময়ে সহসা ঘরের মধ্যে আট দশটা ধূলা মাখা নেংটী পরা ছোঁড়া প্রবেশ করিল। আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া, চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম।

গোবিন্দ বাবু আমার ভাব দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, এরা আমারই তাল-বেতালের দল।

তাহার পর তাঁহার তাল-বেতাল দলস্থ একজনের দিকে চাহিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি ননীয়া, কোন খবর আছে? তাকে খুঁজে পেয়েছ?

ননীয়া। না হুজুর, এখনও পাই নি।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আচ্ছা, খবর পেলে ননীয়া, তুমি একলা এসে আমায় খবর দিও, আর সকলে যেন রাস্তায় থাকে। এই লও, তোমাদের জল-খাবারের পয়সা। বলিয়া পকেট হইতে কতক গুলা পয়সা বাহির করিয়া ননীয়ার হাতে দিলেন। দাতা ও গৃহীত কেহই পয়সাগুলি গণনা করিলেন না। ননীয়া পয়সাগুলি তাহার নেটীংর এটা খুটে বাঁধিলে গোবিন্দ বাবু বলিলেন, সন্ধান পাইলেই আমাকে খবর দিবে।

ননীয়া বলিল, হাঁ হুজুর।

গোবিন্দ। এখন যাও।

তাহারা উৰ্দ্ধশ্বাসে পলাইল; আমি অত্যন্ত বিস্মিতভাবে গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিলাম। তিনি বলিলেন, ভাল ভাল ডিটেকটিভ যা পারে না, এদের দ্বারা আমার সে কাজ হয়।

আমি। আপনি এদের সেটী-মহল্লার ব্যাপারে লাগিয়েছেন না কি?

গোবিন্দ। হাঁ।

আমি। কেন?

গোবিন্দ। পরে দেখতে পাবেন। আমি যাকে চাই, এরাই তার সন্ধান দিতে পাবে।

আর কিছু জিজ্ঞাসা করা ভাল দেখায় না ভাবিয়া আমি কিছু বলিলাম না। জানালা দিয়া রাস্তার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, দি সুরমল সাহেব ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে উৎফুল্লমুখে আমাদের বাসার দিকেই আসিতেছেন। আমি সে কথা গোবিন্দ বাবুকে বলিলাম; গোবিন্দ বাবু উঠিয়া আসিয়া তাহাকে দেখিয়া বলিলেন, হাঁ। এবার কতকটা মজার কথা শুনতে পাওয়া যাবে।

আমি। কি রকম?

গোবিন্দ। দেখতেই পাবেন এখনই।

ক্ষণপরে সূরমল সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবু, আমাকে প্রশংসা করুন, এক মুখে নয় শতমুখে।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, শত মুখ আমার ত নাই ব্যাপার কি?।

সূরযমল সাহেব মশুকান্দোলন করিয়া খুব উৎসাহের সহিত বলিলেন,ব্যাপার! সেটী-মহল্লার মামলার আমিই একটা কিনারা করে ফেলেছি।

গোবিন্দ। ইতিমধ্যেই, বাঃ বেশ, আপনি তবে ঠিক সূত্র ধরতে পেরেছেন?

সূরয। কেবল সুত্র ধরা নয়। সূত্র ধরতে–

গোবিন্দ বাবু বাধা দিয়া সপরিহাসে বলিলেন, তবে কি একেবারে রজ্জু ধরা নাকি–

সূরয। রজ্জুই বটে—আসামী একেবারে হাজতে।

গোবিন্দ। বলেন কি! তার নাম কি?

সূরয। তার নাম লালা গোকুল প্রসাদ, লোকটা রেলে কাজ করে।

গোবিন্দ। বটে, সব আমাদের খুলে বলুন। আমরা দুজনেই শুনে বিস্মিত হবার জন্য উৎসুক হয়ে রয়েছি।

সূরয। বলছি, শুনুন, শোনবার কথাই বটে।

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

সূরযমল সাহেব বলিতে লাগিলেন। আমরা উভয়ে নীরবে তাহার কথা শুনিতে লাগিলাম।

সূরযমল বলিলেন, আসল মজা হচ্ছে যে গাধা রাম সিং ভায়া উল্টা ধাঁধায় ঘুরছেন। তিনি শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাংয়ের সন্ধানে গেছেন। হা! হা! হা! আমি সন্ধান করে সেই ডাক পিয়নটার সঙ্গে আগেই দেখা করলেম। সে এই দুজন লোক যে বাসায় থাকত, তা দেখিয়ে দিল। বলা বাহুল্য, আমি তখনই সেই বাড়ীতে গিয়ে সেখানে কে থাকে সন্ধান নিলেম। সে বাড়ীতে লালা গোকুলপ্রসাদ বলে একটা লোক বাস করে। তার সংসারে এক বুড়ী মা ও এক যুবতী বিধরা ভগ্নী ভিন্ন আর কেহ নাই। এই গোকুল প্রসাদ রেলে কেবল পনের টাকা মাহিনা পায়, তাতে তাদের চলে না দেখে বাড়ীর বার দিকটা ভাড়া দেয়। এই বার বাড়ীতে মাসখানেক দুজন মারাঠী এসে বাসা নিয়েছিল। আমি বাড়ীতে গোকুলপ্রসাদের সন্ধান নিয়ে জানলেম যে, সে রেলে কাজে গেছে। বুড়ী মা বাড়ীতে আছে। আমি তার সঙ্গে দেখা করলেম। তার মেয়েও তার পাশে বসে রয়েছে। দেখলেম, দুজনেই বড় বিষন্না; বিশেষত মেয়েটা যে খুব কেঁদেছে, তা তার চোখ দেখলেই বোঝ। যায়। আমি বুড়ীকে জিজ্ঞাসা কলাম, তোমাদের ভাড়াটিয়ার মধ্যে একজন খুন হয়েছে তা শুনেছ? বুড়ী ঘাড় নাড়িল, কিন্তু কোন কথা কহিল না, মেয়েটি কেঁদে উঠল। তখনই আমি বুঝলেম যে এরা এ খুনের ভিতরকার অনেক কথা জানে। তখন জিজ্ঞাসা করলেম, কাল কখন এরা দুজন তোমার বাড়ী থেকে বার হয়ে যান? সত্য কথা বল, আমি পুলিশের লোক। বুড়ীর মুখ আরও পাংশুবর্ণ হয়ে গেল,তার মুখ দিয়ে আর কথা সরে না। সেই সময় মেয়েটি বলে উঠল, মা, মিথ্যা কথা বলা মিছে। যা যা হয়েছে সব একে বল। দাদা তাতে সন্তুষ্ট ভিন্ন অসন্তুষ্ট হবেন না। মেয়ের কথা শুনে বুড়ী ভয়ানক রেগে উঠল। পাগলী হতভাগী, তুই ত তোর দাদাকে মালি। বলে বুড়ী কঁদতে আরম্ভ করে দিল। আমি বললেম,আমাকে সত্য কথা বল,সব ঠিক ঠিক বলে বরং তোমাদের উপকার হবে। তখন বুড়ী চোখের জল মুছে বলতে লাগল,-মনে করবেন না, যে আমার ছেলে এই খুন করেছে, সে এর কিছুই জানে না। তবে পাছে আপনারা তাকে খুনী বলে সন্দেহ করেন, এইজন্যই আমার ভয়। বলেই বুড়ী থেমে গেল। আমি তখন বললেম,সব খুলে বলে উপকার আছে। বুড়ী বলে,দুজন মারাঠী ভদ্র লোক আমাদের বাড়ীতে এক মাস বাসা করে আছেন। আমরা বড় গরীব, খরচ চলে না বলে বার দিটা ভাড়া দিই। এমন হবে জালে কে এমন কাজ করে। সে যা হক, কাল একজন মারাঠী খুন হয়েছে শুনে, আমি তাকে দেখতে যাই; গিয়ে দেখি যার নাম বালকিষণ লক্ষ্মণ রাও, তিনিই খুন হয়েছন। ইনি খুব বড় লোক বলে বোধ হয়, দু হাতে টাকা খরচ করতেন। আর একজন যার নাম শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাং, সে বোধ হয় এর মোসাহেব ছিল। কিন্তু বড় লোক হলে কি হয়,-লোক বড় ভাল নয়। ভয়ানক মাতাল, রোজই বোতল বোতল মদ খেত, আর বলতে বলতে বুড়ী মধ্যপথে আবার থেমে গেল। আমি বললেম, কিছু গোপন কর না, সব সত্য বল। বুড়ী বলে,আয় এরা দুজনেই একদিন রাত্রে আমার মেয়ের উপর অত্যাচার করতে চান, আহা। বাছা আমার কত কেঁদেছে। সেই কথা শুনে গোকুলপ্রসাদ আমার, এদের উঠিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। এমন সময়ে–এই পরশু এরা একটা তারের খবর পেয়ে নিজেই জিনিষ-পত্র গুছিয়ে দেশে যাবার জন্য আন্দাজ রাত আটটার সময় ষ্টেশনে রওনা হয়। তারা চলে যেতে আমি খুব খুসী হলেম। কিন্তু রাত্রি এগারটা কি বারটার সময় আবার দেখি হঠাৎ বালকিষণ আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত হল। বাছা গোকুলপ্রসাদের রাত্রে রেলে কাজ ছিল, সে তখনও ফিরে নাই বলে দরজা খোলা ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলেম, হাঁ, বালকিষণ এসে কি করলে? বুড়ী বলে, দেখি ভয়ানক মাতাল হয়ে এসেছে। আমার মেয়েকে ছুটে ছুটে টলে টলে ধরতে যায়, আমার সমুখে তাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। আমি একলা কি করব, এই মাতালের হাত থেকে কেমন করে রক্ষা পাব, চেঁচিয়ে লোক ডাক্ব মনে কছি, ঠিক সেই সময়ে আমার ছেলে গোকুলপ্রসাদ এসে পড়ল। সে এসে সেই মাতালটার গলা ধরে তাকে রাস্তায় দিয়ে এল। তাতেও সে যায় না। দরজার সমুখে ভারি মাতলামী করতে লাগল, তখন আবার গোকুলপ্রসাদ একটা লাঠী নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিতে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর তোমার ছেলে কখন ফিরে এল?বুড়ী বলে,প্রায় ঘণ্টা দুই পরে।আমি জিজ্ঞাসা করলেম, এতক্ষণ কোথায় ছিল, কিছু বললে? বুড়ী বলে, হ, আমরা তার জন্য বসেছিলাম। এসে বলে যে তাকে রেল থেকে ডাক্ত এসেছিল, তাই রেল-আফিসে গিয়েছিল। আমি দেখলেম, সন্দেহের আর কিছুই নাই, ঠিক পথেই এসে পড়েছি; তথাপি বুড়ীকে জিজ্ঞাসা করলেম, আর সেই লোকটার কোন কথা তুমি তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা কর নাই? বুড়ী বলে,  জিজ্ঞাসা করেছিলাম বই কি। তা সে বললে যে, তার হাতে লাঠী দেখে সে ভয়ে পালিয়ে গেছে। গোকুলপ্রসাদ পেছনে তাড়া করায়, সেইখান দিয়ে একখানা একা যাচ্ছিল, তাতে চড়ে সে পালিয়ে গেল। তখন আমি, হ, এতেই হবে, বলে বিদায় হলেম। সেখান থেকে বেরিয়ে একেবারে রেল-আফিসে গিয়ে গোকুল প্রসাদকে গ্রেপ্তার করলেম। আর প্রমাণ কি চাই? নিশ্চয়ই এ মারাঠীকে তাড়া করে নিয়ে যায়। পেটে সজোরে লাঠীর গুতো মারায় হঠাৎ লোকটা মারা পড়ে। তখন গোকুল প্রসাদ লাসটা সেই থালি বাড়ীতে টেনে নিয়ে ফেলে রেখে বাড়ী ফিরে আসে।

গোবিন্দ। রক্ত?

সূরয। পুলিশের চোখে ধূলা দেবার জন্য মুর্গী-টুগী একটা যা হয় কিছু কেটে ঘর ময় রক্ত ছড়িয়ে গেছে।

গোবিন্দ। গোকুলপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করাতে সে কি বলে?

সূরয। সে প্রথমেই বলে উঠল, বোধ হয়, আপনারা সেই মারাঠীর খুনের জন্য আমায় গ্রেপ্তার করছেন। আমরা, হ, বলায় সে বলে,আমি খুন করি নাই, আমি এর কিছুই জানি না। আমি তাকে তাড়া করায় সে একখানা একায় চড়ে পালিয়ে যায়? হা-হা-হা, খুব সাদা কথা। কোন আদালত এ কথা বিশ্বাস করবে না।

এই সময়ে রাম সিংহের তথায় অভ্যুদয় হইল। আমরা সকলেই তাহার দিকে চাহিলাম। সূরযমল হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ভায় আসামী যে গারদে।

রাম সিং বলিলেন, আসামীর সাজা হবে, তবে ত খুনের কিনারা হবে। শুধু গ্রেপ্তারে কি হয়?

সূরয। কেন?

রাম। কেন? এই তোমার গোকুলপ্রসাদ কি শঙ্কর রাম পাণ্ডুরাংকেও খুন করেছে ?

আমরা সকলেই অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত বলিয়া উঠিলাম,সে কি?

রাম নিং বলিলেন, হাঁ, শঙ্কররাম পাণ্ডুরাংও খুন হয়েছে। তার লাস মোসাফের-খানায় পড়ে আছে। তারও ঘরের দেয়ালে রক্তে লেখা সাজা।

আমরা সকলই স্তম্ভিত হইলাম। সূরযমল এরূপ ভাবে বিস্ফারিত নয়নে রাম সিংহের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন যে, তাহাকে দেখিলে প্রকৃতই বড় কষ্ট হয়; যেন তিনি সাত হাত উপর থেকে একেবারে স্নাত হাত মাটীর নীচে বসিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এই করুণরসাভিনয়ে কিছু মাত্র মনোযোগ না দিয়া গোবিন্দ বাবু হো হো শব্দে উচ্চৈস্বরে হাসিয়া উঠিলেন।

নবম পরিচ্ছেদ।

ইহাতে পুলিশ-কর্মচারীদ্বয় উভয়েই যে বিশেষ বিরক্ত হইলেন, বলা বাহুল্য। গোবিন্দ বাবুও যে তাহা বুঝিলেন না, এমনও নহে। বলিলেন রাগ করিবেন না, আমার বাচালতা ক্ষমা করিবেন। এখন রাম সিং সাহেব যে আশ্চৰ্যজনক সংবাদ দিলেন, তাহার বিষয় সব শোনা যাক।

সূরমল বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনি কি এ সংবাদ ঠিক পেয়েছেন?

রাম। ঠিক পাওয়া-পায়ি কি দাদা-আমি নিজে মসাফের-থানায় গিয়ে স্বচক্ষে তার লাস দেখে এসেছি।

গোবিন্দ। আচ্ছা, সব ব্যাপারটা শোনা যাক।

রাম। মান গেল মনে বিশ্বাস হয়ছিল যে এখন এই মারাঠীর বন্ধুই করেছে,এ আমি স্বীকার করি। আমি তাই তখন হতেই লোকটার সন্ধানে থাকি। পিয়নের কাছে ঠিকানা পেয়ে আমি গোকুল প্রসাদের বাড়ী যাই, কিন্তু ঐ বাড়ীর পাশের দোকানীর কাছে খবর পাই যে মারাঠী দুজন তাদের জিনিষ পত্র নিয়ে ষ্টেশনে চলে গেছে। তখন আমি ষ্টেশনে গিয়ে সন্ধান করি। কুলীর বলে যে, হাঁ, দুজন মারাঠী রাত্রি আটটার পর ষ্টেশনে এসেছিল, তারা তাদের জিনিষ-পত্ৰ মামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ভারি মাতাল, সে অপরের সঙ্গে বকাবকি করে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে। অপর মারাঠী তার জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে, গাড়ীর সময়েও কিন্তু সে ফেরে না। তখন সেই মারাঠী মুটেদের জিনিষপত্র নিয়ে তার সঙ্গে ষ্টেশনের সম্মুখের মোসাফের-খানায় যেতে বলে। তারা জিনিষ-পত্র নিয়ে সেইখানে রেখে আসে। মারাঠীও সে রাত্রের জন্য মোসাফের-খানায় বাসা নেয়।

সূরয। তার পর?

রাম। তার পর আমি এই খবর পেয়ে তখনই মোসাফের থানায় যাই। সন্ধানে জানি যে সত্যই একজন মারাঠী ভদ্রলোক কাল অনেক রাত্রে মোসাফের-খানায় বাসা নিয়েছিল; কিন্তু এখন তিনি কোথায়, কেউ সে কথা বলতে পারে না দেখে, আমি মোসাফের থানায় দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে উপরে গিয়া দেখি, একটা ঘরের দরজা বন্ধ। অনেক ঠেলাঠেলিতে কেহ দরজা না খোলায় আমি দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকি। ভিতরে গিয়ে দেখি, মারাঠীর মৃতদেহ পড়ে আছে। তার বুকে কে ছোরা মেরেছে। যে ছোরা মেরেছিল, সে বিছানার চাদরে ছোরার রক্ত মুছেছে, পাশের লোটার জলে হাত ধুয়েছে, আর দেয়ালে রক্তে লিখে গেছে সেই, সাজা।

আমি বলিয়া উঠিলাম, কি ভয়ানক!

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আর কিছু দেখিলেন?

রাম। লাসের পকেটে ছাপান্নটা টাকা ছিল,আর একখানা টেলিগ্রাফ।

গোবিন্দ। টেলিগ্রাফে কি লেখা ছিল?

রাম। নাসিকের বামন রাও লাহোরে পাণ্ডুরাংকে টেলিগ্রাফ করছে। ত্ৰিম্বক লাহোরে গিয়াছে। সাবধান।

গোবিন্দ। আর কিছু?

রাম। হাঁ, একটা কৌটা, আর তাতে দুটা বড়ী।

গোবিন্দ বাবু বিদ্যুদ্বেগে লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন—কোন নিরন্ন ভিক্ষুকও সহসা লক্ষ টাকার সমাগমে এতখানি আনন্দ প্রকাশ করে না। গোবিন্দ বাবু খুব ৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, হে হহ হে, আমার কেস এতক্ষণে সম্পূর্ণ হল। আমি যা খুঁজছিলাম, এতক্ষণে তাই পেয়েছি।

তাঁহার তাবগতিক দেখিয়া আমরা সকলেই আশ্চর্যান্বিত হইয়া তাঁহার দিকে চাহিলাম। সূরযমল বলিলেন, আপনি ক্ষমতাপন্ন লোক সন্দেহ নাই, সেইজনা আপনাকে সম্মান ও ভক্তি করি, কিন্তু আপনার কোন কথায়ই আমরা বুঝতে পারছি না।

গোবিন্দ। শীঘ্রই সব বুঝিয়ে দিব। এখন রাগ করবেন না। রামসিং সাহেব, সে কৌটাটা হস্তগত করেছেন ত?

রাম। হাঁ, এই যে সঙ্গেই এনেছি।

গোবিন্দ। দিন, একটা পরীক্ষা করে দেখা যাক।

গোবিন্দ বাবু কৌটা হইতে একটা বড়ীর আধখানা কাটিয়া তাহা জলে লিলেন। তৎপরে তাহাতে একটু দুধ মিশাইয়া রাস্তার একটা জীর্ণ মীd না তা পান করিতে দিলেন। ক্ষুধার্ত কুকুর তাহা তৎক্ষণাৎ খাইয়া ফেলিল। গোবিন্দ বাবু উৎসুক হৃদয়ে সেই কুকুরটাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই কুকুরের কিছুই হইল না, সে আরও দুগ্ধ পাইবার জন্য মুখ তুলিয়া ঘন ঘন লাল আন্দোলন করিতে লাগিল। তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আশ্চৰ্য্য বটে। আমার কি ভুল হবে? কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন, আমি কি গাধ—একেবারে নিরেট! এমন সহজ কথাটাও একবার আগে মনে পড়ে নাই।

তিনি অপর বড়ীটার অর্ধেক কাটিয়া পূর্বের ন্যায় জল ও দুগ্ধের সঙ্গে মিশাইলেন; পূর্বের ন্যায় কুকুরকে পান করিতে দিলেন। সে পান করিবামাত্র বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল, তখনই মাটিতে পড়িয়া ছট ফটু করিতে লাগিল। ক্ষণপরে আমরা সকলে তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া দেখিলাম, কুকুর মরিয়া আড়ষ্ট হইয়াছে।

তখন গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই বড়ীতেই মারাঠীর প্রাণ গিয়াছে।

আমি বলিলাম, একটা বিষাক্ত আর একটা অব্যিক্ত বড়ী রাখবার মানে কি?

গোবিন্দ। এখন ঠিক বলতে পারি না। তবে বোধ হয়,যে লোক এই বড়ী এনেছিল, সে নিজে জোর করে বিষ-বাড়ী খাওয়ায় নাই। লোকটা দুটা বড়ার একটা নিজে বেছে নিয়ে তাকে খেতে বলেছিল। যে কোন কারণে হো, লোকটা অনিচ্ছাসত্ত্বে একটা বড়ী খেতে, বাধ্য হয়েছিল। সৌভাগ্য বশতঃ ভগবান্ পাপীর দণ্ডের জন্য তাকে দিয়া এই বিষ বড়ই তাকে খাইয়েছিলেন।

সূরযমল বলিলেন, আপনি কি প্রকৃতই এই খুনের সমস্ত ব্যাপার জানতে পেরেছেন।

গোবিন্দ। নিশ্চয়—কেবল জানা কেন, আমি তার নাম পর্যন্ত বলতে পারি।

রাম। তবে তাকে গ্রেপ্তার করতে তিলার্ধ দেরী করা উচিত নয়।

গোবিন্দ। নাম জানা যত সহজ, তাকে গ্রেপ্তার করা ঠিক ততটা সহজ নয়। আমি এখন আপনাদিগকে সব কথা বলতে পারি না—হয় ত তাতে তাকে গ্রেপ্তার করা সহজ না হতেও পারে। এমন কি তাড়াহুড়ো দিলে সে এ সহর ছেড়ে পালাতেও পারে।

আমি। কিন্তু সে আরও ত খুন করতে পারে।

সূরয। ডাক্তার বাবু ঠিক বলেছেন।

গোবিন্দ। সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, সে আর কাকেও খুন করবে না। আমি তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য যে বন্দোবস্ত করেছি, তাতে বোধ হয় শীঘ্রই কাজ সফল হবে। তখন আপনাদের সব খুলে বলব। এখন আমাকে আপনারা মাপ করুন। একদিন চব্বিশঘণ্টা মাত্র চুপ করে থাকুন।

সূরয। আমরা দুজনই যখন এর কিছুই এ পর্যন্ত কিনারা করতে পারি নাই, তখন আমরা চুপ করে না থেকে আর কি করব?

গোবিন্দ। রাগ করবেন না। শীঘ্রই আসামী গ্রেপ্তার হবে।

তবে এখন আমরা বিদায় হই, আবার দেখা করব, বলিয়া পুলিশ-কর্মচারীদ্বয় উঠিলেন।

দশম পরিচ্ছেদ।

এই সময়ে সহসা তথায় সেই ননীয়া বালক উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া গোবিন্দ বাবু পুলিশ-কৰ্ম্মচারীদ্বয়কে বলিলেন, একটু অপেক্ষা করুন। তাহারা উঠিয়াছিলেন, বসিলেন। তখন গোবিন্দ বাবু ননীয়াকে বলিলেন, তবে ননীয়া, খবর কি?

ননীয়া! হুজুর, একা দরজায়।

গোবিন্দ! বেশ ননীয়া,—তাকে একবার এইখানে ডাক,—সে আমার জিনিষ গাড়ীতে তুলুক।

গোবিন্দ বাবু কোন্‌খানে যে যাইবেন, তাহা তিনি আমাকে বলেন নাই, সুতরাং তাহার কথা শুনিয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম; কিন্তু কোন কথা কহিলাম না। গোবিন্দ বাবু একটা নুতন ধরণের হাতকড়ী বাহির করিয়া বলিলেন, রাম সিং সাহেব, আপনারা এই নুতন ধরণের হাতকড়ী চলতি করেন না কেন? দেখুন দেখি, এ কেমন স্প্রিং দেওয়া,—এক সেকেণ্ডে পরিয়ে দেওয়া যায়।

রাম সিং বলিলেন, পুরাণতেই কাজ চলতে পারে—যদি পাইবার লোক পাওয়া যায়।

এই সময়ে ননীয়া, এক্কাওয়ালাকে লইয়া তথায় উপস্থিত হইল। তখন গোবিন্দ বাবু নিজ পোর্টম্যান্ট আঁটিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। তিনি এক্কাওয়ালাকে বলিলেন, এস দেখি বাপু, এইটা একটু চেপে ধর, এটাকে এঁটে নি।

সে আসিয়া পোর্টম্যান্টটি চাপিয়া ধরিল। পরমুহূর্তেই ক্রিং করিয়া একটা শব্দ হইল। গোবিন্দ বাবু লম্ফ দিয়া দণ্ডায়মান হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই নিন্ আপনাদের খুনী, ত্রিম্বক রাও খণ্ডেকার। আমরা তিনজনই লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। এক্কাওয়ালাও লম্ফ দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। দেখিলাম, তাহার হাতে হাতকড়ী। সে একবার সবলে হন্তস্থ হাতকড়ী ভাঙ্গিবার চেষ্টা পাইল, পরে দ্বারের দিকে চাহিল; বোধ হইল যেন পলায়নের উদ্যম করিল। কিন্তু রাম। সিং ও রমল লম্ফ দিয়া তাহার গলার কাপড় ধরিয়া তাহাকে টানিয়া গৃহের এক কোণে ফেলিলেন। অমনি সেই ব্যক্তির মুখ ও নাক দিয়া অনর্গল রক্ত পড়িতে লাগিল। সে কাপড়ে রক্ত মুছিয়া ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ভয় নাই, পালাব না। পালাবার ইচ্ছা রেখে খুন করি নাই।

গোবিন্দ বাবু আমার দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, তবে আমার অনুমান মিথ্যা নহে; লোকটার রক্ত পিত্তের ব্যারাম ও ঠিক।

খুনী ত্ৰিম্বক রাও বলিল, আপনার বাহাদুরী আছে। আপনি আমাকে ধরায় আমি অসন্তুষ্ট নই।

রাম সিং বলিলেন, আর দেরী করা নয়। চলুন আসামীকে নিয়ে থানায় যাই।

সূরয। ঠিক কথা,-পরে গোবিন্দ বাবুর কাছে সব শুনব।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বেশ কথা, তাই চলুন। তৎপরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ডাক্তার মহাশয় ও আসুন; আপনি এই মাল্লার গোড়া থেকেই আছেন।

সূরবমল ও রাম সিং আসামীর গলার কাপড় তখনও ছাড়েন নাই। ত্ৰিম্বক রাও হাসিয়া বলিল, ভয় নাই, পালাব না। ছেড়ে দিন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, ছেড়ে দিলে পালাবে না।

তখন ত্ৰিম্বক রাওয়ের এক্কায় রাম সিং তাহাকে লইয়া উঠিলেন। সূরযমল হাঁকাইয়া চলিলেন। আমি ও গোবিন্দ বাবু আর একখানা এক ডাকিয়া তাহাতে চড়িয়া বসিলাম।

থানায় আসিয়া আমরা সকলে আসামীকে সইয়া সুপারিন্টেন্টে সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। তিনি আসামী গ্রেপ্তারের সকল বিবরণ রাম সিং সাহেবের নিকট শুনিয়া এক রাওয়ের দিকে চাহিলেন। তৎপরে বলিলেন, তোমার কিছু বলবার আছে? তুমি কি এই দুই খুন করেছ? ত্রিম্বক কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সাহেব তাহাকে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলেন, তোমাকে আমার সাবধান করে দেওয়া উচিত। জেন, এখন তুমি যা বলবে, আমি সমস্তই লিখে রাখব। বিচার সময়ে তোমার কথা তোমারই বিরুদ্ধে প্রাণরূপে ব্যবহৃত হবে। যা বল্‌বে, বুঝে বল্‌বে।

ত্রিম্বক রাও বলিল, আমি কোন বিষয়ের জন্যই আর ভীত নই। আমি স্বীকার করছি, পা ও রং ও সর্দার বুলকিষণকে খুন,আমিই করেছি—নিজহস্তে।

সাহেব। ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে স্বীকার করবে?

ত্রিম্বক। কেন করব না। এই দুই দুরাত্মাকে খুন করে মরু বলেই ত খুন করেছি।

সাহেব। কেন খুন করলে? ত্রিম্বক। সে অনেক কথা। জগতের লোক না মনে করে যে আমি অন্যান্য খুনীর মত নরাধম। তাই সকল কথা লিখে রেখে যাব মনে করেছি। আপনারা কি অনুগ্রহ করে আমাকে কালি কল কাগজ হাজতে দিবেন? আমি আমার সমস্ত বিবরণ লিখে রাখুন। এই দুই পাপাত্মা আমার সর্বনাশ করেছিল, তাই এদের উপযুক্ত সাজা দিয়াছি।

সাহেব। এ সব কথা বিচারের সময় বলতে পার।

ত্রিম্বক। বিচার পর্যন্ত বাঁচব না।

সাহেব আসামীর মুখের দিকে চাহিলেন। ত্রিম্বক বলিল, ভয় নাই সাহেব, আত্মহত্যা করে পাপ করব। আমার যে ব্যারাম হয়েছে, তাতে আর আমি বেশি দিন বাঁচব না। কেবল বেঁচে ছিলাম, প্রতিহিংসা সাধনের জন্য। তা হয়েছে।

সাহেব আমাদের সকলের দিকে চাহিলেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আমার বন্ধু একজন ডাক্তার। একবার আসামীকে পরীক্ষা করিতে ক্ষতি কি?

সাহেব বলিলেন, আপনি ভালই বলেছেন।

তখন সাহেবের অনুরোধে আমি ত্রিম্বক রাওকে বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া বলিলাম, আসামী ঠিকই বলছে। এর রক্তপিত্তের উপর যক্ষ্মা রোগ হয়েছে, সুতরাং কোন কারণে মন উত্তেজিত হলে,এর সহসা মৃত্যু হওয়া সম্ভব।

সাহেব ত্রিম্বক রাওয়ের দিকে চাহিয়া বলিলেন, তোমাকে হাজতে কালি কলম কাগজ দেওয়া যাইবে। সমস্ত বৃত্তান্ত আমাদের জানা আবশ্যক। তৎপরে রাম সিংএর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, এখনই আসামীকে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাও। তার সম্মুখে স্বীকার পত্রে এর সহি করা আবশ্যক। তার পরে আসামীকে হাজতে রেখে কালি কলম কাগজ দিয়ো। আমাদিগকে বলিলেন, আপনারা কাল এগারটার সময় আদালতে হাজির থাকবেন।

আসামীকে লইয়া আমরা সকলে বাহিরে আসিলাম। গোবিন্দ বাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, একটা কথা তোমাকে আমার জিজ্ঞাসা করবার আছে।

ত্রিম্বক। বলুন—কি।

গোবিন্দ। ইয়ারিং নিতে এসেছিল কে?

ত্রিম্বক। আমিই। ছেলে বেলা থেকে বহুরূপী সাজা আমার অভ্যাস ছিল। এই দুই দুরাত্মাকে সাজা দেবার জন্য আমাকে অনেক সাজেই সাজতে হয়েছে। দেখুন, আপনার মত লোকের চোখেও ধূলা দিয়েছিলাম।

গোবিন্দ। স্বীকার করি, তোমার বাহাদুরী আছে।

ত্রিম্বক। আপনারও বাহাদুরী খুব।

রাম সিং আসামীকে লইয়া হাজতের দিকে গেলেন। আমরাও বাসায় ফিরিলাম।

একাদশ পরিচ্ছেদ।

সেইদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত গোবিন্দ বাবুর সহিত অনেক কথা বার্তা হইল। আমি বলিলাম, প্রকৃতই আপনি অদ্ভুত ক্ষমতাপন্ন লোক। আপনি পূর্বে যা যা বলেছিলেন, এখন দেখছি সকলই ঠিক।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এ ব্যাপারে কিছুই কঠিন ছিল না।

আমি আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, কঠিন কিছুই ছিল না, বলেন কি!

গোবিন্দ। হাঁ, সামান্য বিবেচনা শক্তি ব্যবহারে আমি তিন দিনের মধ্যে জানতে পেরেছিলাম, আসামী কে?

আমি। সে কথা সত্য। আপনি পূৰ্বে এ কথা বলেছিলেন।

গোবিন্দ। এ রকম ব্যাপারের রহস্যভেদ করতে হলে উল্টা দিকে বা পিছন দিকে বিচার করে যাওয়াই উচিত। লোকে সাধারণত তা করে না-সমুখ দিকেই দেখে। মেঘ হয়েছে, বাতাস বন্ধ হয়েছে, খুব গুমট বোধ হয়েছে, এই সকল বিবেচনা করে লোকে বলে শীঘ্র বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টি হয়ে গেলে কে ভাবে যে, কি কি ঘটনার সংযোগে বৃষ্টি হল। ফল দেখে সেই ফল কিসে ফল তা কয় জন ভাবে?

আমি। আমি আপনার কথার ঠিক ভাবার্থ বুঝতে পারুলেম না।

গোবিন্দ। এই খুনের ব্যাপারটিই ধরুন। আমি দেখলেম,

গোবিন্দরাম। একটা ঘটনার ফল, এই এক বা দুই খুন। কেন খুন হল, আর কে খুন করিল, এই আমাকে জানতে হবে। আমি উল্টা দিকে বিচার করতে আরম্ভ করলেম। আগেই বলেছি, গাড়ীর চাকার আর পায়ের দাগ, ঘরের অবস্থা দেখে আমি কতক স্থির করি। যা যা স্থির করে ছিলাম, তা আপনাকে ও রামসিংকে সেদিন বলেছিলাম।

আমি। হাঁ, বলেছিলেন বটে।

গোবিন্দ। জেনেছিলাম দুটা লোক একখানা এক্কায় এসে এই বাড়ীটায় যায়; একজন আর একজনকে বিষ খাইয়ে মারে। এখন এ লোকটা কে? জানেন, নাসিকে আমি টেলিগ্রাফ করি।

আমি। হাঁ, আমি ত সঙ্গেই ছিলাম।

গোবিন্দ। উত্তরে জানলাম, বালকিষণ রাও একজন বড় সর্দার। তার নামে ত্রিম্বক রাও নামে একটা লোক স্ত্রী ছিনিয়া লওয়ার জন্ম পুলিশে নালিশ করে। পুলিশ বড় লোকের দাসানুদাস, ত্ৰিম্বককে হাঁকাইয়া তাড়াইয়া দেয়। তার পর এই বালকিষণ রাই আবার পুলিশে খবর দেয় যে, ত্রিম্বক তাকে খুন করবার চেষ্টায় আছে। তখন কি বোঝ শক্ত যে ত্ৰিম্বকই এই খুন করেছে।

আমি। নিশ্চয়ই নয়।

গোবিন্দ। এ কথা আরও সপ্রমাণ হল পাণ্ডুরাংয়ের পকেটের টেলিগ্রাফ দেখে। তাতে লেখা—সাবধান, ত্রিম্বক লাহোরে। এই দুইটা লোক টেলিগ্রাফ পেয়েই ভয়ে লাহোর থেকে পালাইয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ভগবান দুষ্টের দমনের জন্য তা হতে দিলেন না।

আমি। আপনি ঠিক বলেছেন।

গোবিন্দ। আমি আগে দেখেছিলাম,এক্কায় দুজনের অধিক শো ছি–তা এowথা চিল না। নাগরা তা দেখে বললেন

গোবিন্দরাম।

এক্কাওয়ালা হয়েছে। ইহাই খুব সম্ভব, কারণ একা হলে যত সহজে একজনের পেছনে পেছনে থাকা যায়, পায়ে হেঁটে তা হয় না।

আমি। তা নিশ্চয়ই।

গোবিন্দ। আর এক্কাওয়ালা হলে সহজে কেউ চিতেও পাবে। এইজন্যই আমি ছোঁড়াদের এক্কাওয়ালা খুঁজতে লাগিয়া দিয়েছিলেন।

আমি। আপনার কথায় আমি আশ্চর্যান্বিত হয়েছি।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, একটু বুঝে দেখলে আশ্চর্যান্বিত হবার কিছুই নাই। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এ নাম বদলেছে; বদলে থাকলেও আমি এর চেহারা যেরূপ অনুমান করেছিলাম,তাতে সহজেই ধরা পড়ত। দ্বিতীয়তঃ আমি ভেবেছিলাম, এ নাম বলায় নাই। কেন বদলাবে? এত দূরে এক্কাওয়ালার মধ্যে নিজের নাম রাখলে ক্ষতি কি? আমার অনুমানই ঠিক, এ নিজের নামেই ছিল। আমার ননীয়া একে সহজেই ভাড়ার নাম করে ডেকে আনতে পেরেছিল।

আমি। কিন্তু এ ভাড়ায় এল কেন?

গোবিন্দ। না এলে পাছে কেউ সন্দেহ করে।

আমি। এত অনায়াসে খুন করে লাহোর থেকে চলে যেতে পাত।

গোবিন্দ। ত্রিম্বক গাধা নয়। সে স্পষ্টই জান্ত, পুলিশ এখন ষ্টেশনে বিশেষ দৃষ্টি রেখেছে। হঠাৎ একজন এক্কাওয়ালা অন্তর্ধান হলে পুলিশের তার উপর সন্দেহ হবে। তখন পুলিশের হাত এড়িয়ে পালান বড় শক্ত। একটু গোল চুকলেই সরে পড়বার ইচ্ছা ছিল।

আমি। আপনার ক্ষমতা অদ্ভুত। আপনি অদ্বিতীয় লোক।

গোবিন্দ। তা ঠিক নয়, তবে আমার গোয়েন্দাগিরি সম্পূর্ণ নুতন, পুরাণ ধাঁজায় নয়।

আমি। তা ত চোখের উপর দেখলেম। আপনি যা বলেছিলেন, তাই করলেন। ঘরে বসে দু-দুটো এমন জটিল খুনের আসামী গ্রেপ্তার করলেন।

গোবিন্দ। আমার রীতি অবলম্বন করলে সকলেই তা পারবে।

আমি। একটা কথা জান্বার আছে।

গোবিন্দ। বলুন।

আমি। ইংয়ারিংএর বিষয়টা কি?

গোবিন্দ। ত্রিম্বকের ইতিহাসেই সব জানা যাবে। কালই সব জানতে পারবেন।

অনেক রাত্রি পর্যন্ত এইরূপ কথোপকথনে কাটিল। প্রাতেই রাম সিংএর একখানা পত্ৰ আসিল। তিনি আমাদিগকে তথনই থানায় যাইতে অনুরোধ করিয়াছেন। আমরা আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব করিলাম না, একখানা গাড়ী করিয়া থানায় উপস্থিত হইলাম। রাম সিং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখনই আমাদিগকে হাজতে লইয়া গেলেন।

******

আমরা দেখিলাম, ত্রিম্বক রাও শয়ন করিয়া আছে। তাহার চতুষ্পর্শে কালি কলম কাগজ বিক্ষিপ্ত; অনেকগুলি কাগজ লেখা কিন্তু ত্রিম্বক রাও আর নাই; নিম্নের বিচারকের হাত এড়াইয়া এখন সে সেই সর্বজ্ঞ সৰ্বশক্তিমান্ বিচারপতির আসন সম্মুখে নীত হইয়াছে। তাহার মুখ দিয়া যথেষ্ট রক্ত নির্গত হইয়াছে। রক্তপিত্ত রোগেই ত্রিম্বক রাওয়ের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার মৃত্যুতে রাম সিং মহাশয়কে বিশেষ দুঃখিত দেখিলাম, কারণ আসামীর ফাঁসী হইলে তাহার প্রমোসনের একটা আশা ছিল। আমি কিন্তু ত্রিম্বকের মৃত্যুতে হৃদয়ে বড়ই ব্যথা পাইলাম।

গোবিন্দ বাবু ত্রিম্বকের লেখা কাগজ গুলি গুছাইয়া লইয়া পড়িতে লাগিলেন। আমিও কতকটা পড়িলাম। দ্বিতীয়াংশে ত্রিম্বকের আত্ম কাহিনী লিপিবদ্ধ হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *