রক্তমুখী নীলা

রক্তমুখী নীলা
নীহাররঞ্জন গুপ্ত

১. নিশীথ রাতের আগন্তুক

না—ঘুম আজ আর আসবে না।

হাত বাড়িয়ে বেড-সুইচটা টিপে, শিয়রের কাছে ত্রিপয়ে রক্ষিত টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলাম।

মৃদু নীলাভ আলোয় ঘরটা স্বপ্নাতুর হয়ে উঠল মুহূর্তে যেন।

নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ রাত্রি

কার্তিকের শেষ, কিন্তু ইতিমধ্যেই কলকাতা শহরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। পায়ের দিকের খোলা জানালাটা দিয়ে ঝিরঝির করে রাতের হাওয়া এসে ঢুকছে। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে হিম

ঝরছে, তারই আভাস মধ্যরাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায়।

অন্ধকার আকাশের কোলে শূন্যে স্থির হয়ে আছে ইতস্তত কয়েকটি আকাশ-প্রদীপের আলো। দূরে আরও দূরে বিক্ষিপ্ত তারকার দল নৈরাত্রির শিয়রে জাগো

ভিতরে আসতে পারি? হঠাৎ একটা মোটা গলার স্বর শোনা গেল।

চমকে উঠলাম, এত রাত্রে আবার কে ঘরের মধ্যে আসতে চায়? রক্তলোভী কোন নিশাচর নয় তো? রক্তের লোভে এসে হাজির হয়েছে!

বললাম, কে?দরজাটা বন্ধই ছিল, এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে একটু।

দরজাটা একটিবার খুলুন না?…

কে?—আবার প্রশ্ন করলাম।

চিনতে পারবেন না আমি আপনার পরিচিত তো নই। দয়া করে একবার দরজাটা যদি খোলেন।

দরজাটা খুলতেই যেন এক ঝলক ঝড়ো হাওয়ার মতই, আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে। সরিয়ে আগন্তুক আমার শয়নঘরে এসে প্রবেশ করলেন।

চমকে সরে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। আগন্তুক ততক্ষণে অনাহূতই ঘরের। একটি সোফা অধিকার করে বসে পড়েছেন। তাঁর মাথায় একটা ফেল্টের ক্যাপ, পরিধানে মভ কালারের দামী স্যুটা মুখোনি নিখুঁতভাবে কামানো। চোখে কালো কাঁচের সেলুলয়েডের ফ্রেমে আঁটা চশমা।

কে আপনি?

ভয় পাবেন না—বসুন আমি চোর, ডাকাত বা খুনী নই।

আগন্তুকের সামনে বসে, আমি আর একখানা সোফা অধিকার করে বসলাম। আগন্তুকের দিকে তাকালাম। মুখখানা হাড়-বের-করা, রুক্ষ কঠিন। চোয়ালের দু’পাশের হাড়-দুটো ব’ এর আকারে বিশ্রীভাবে সামনের দিকে উঁচু—সজাগ হয়ে উঠেছে। কপালের দুপাশের শিরাগুলো দড়ির মত জেগে আছে। চোখের দৃষ্টি যেন ধারাল ইস্পাতের ফলার মত ঝকঝক করছে।

বলুন তো কে আপনি? কি চান? আবার প্রশ্ন করি।

আপনিই তো সুব্রত রায়—কিরীটী রায়ের সহকারী ও বন্ধু? হ্যাঁ

। কিন্তু আপনি?

ব্যস্ত হবেন না, বলছি। আমারও পরিচয় একটা আছে বৈকি। …এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়াতে পারেন? অনেকটা পথ তাড়াতাড়ি এসে বড্ড পিপাসা পেয়েছে।

ভোলা! ভোলা!—চীৎকার করে ভৃত্যকে ডাকলাম।

ভোলা আপনার চাকর বুঝি? বোধহয় সে বাড়িতে নেই। বাড়িতে ঢুকবার সময় দেখলাম সদর দরজাটা শুধু ভেজানো রয়েছে। প্রথমে কড়া নাড়লাম, কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। সামনেই সিঁড়ি দেখে সোজা উপরে উঠে এসেছি। ওদিককার জানালা দিয়ে আলো জ্বলতে দেখে বুঝেছিলাম এ-ঘরে কেউ নিশ্চয়ই আছেন। তবে জেগে আছেন ভাবি নি বড্ড পিপাসা পেয়েছে, যদি আমাকে এক গ্লাস জল…

ভদ্রলোক কথাগুলো একটানা বলতে বলতে থেমে গেলেন।

আমি সোফা হতে উঠে গিয়ে সোরাই থেকে কাঁচের গ্লাসে করে জল এনে ভদ্রলোকের সামনে ধরে বললাম, এই নিন।

জলের গ্লাসটা আমার হাত থেকে নিয়ে এক চুমুকে গ্লাসটা শূন্য করে পাশের ত্রিপয়ের ওপর রাখতে রাখতে আগন্তুক বললেন, ধন্যবাদ।

তারপর একটু থেমে বললেন, এত রাত্রে হঠাৎ এমনি করে বলা নেই, কওয়া নেই আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই সুব্রতবাবু। অবশ্য তা হবারই কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক যেন অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে চোখের পাতাদুটি বোজালেন।

ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম চোখ দুটি তখন আর দেখবার উপায় নেই, কেননা নিমীলিত আঁখিপল্লবের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। টেবিল ল্যাম্পের আলোর খানিকটা রশ্মি তির্যক ভঙ্গীতে আগন্তুকের ডানদিকের কপাল ও গালের খানিকটা আলোকিত করে তুলেছে। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপচাপ আবার বসে রইলেন, তারপর আবার এক সময় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাত্রির স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, সুব্রতবাবু, আপনি হয়ত আমার পরিচয় পাবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছেনা আমার নাম শৈলেশ্বর সেনা কোন একটা বিশেষ কারণে নিজেকে অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করে এত রাত্রে আমাকে আপনার কাছে গোপনে রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আসতে একপ্রকার বাধ্য হতে হয়েছে। দাঁড়ান এক মিনিট বলতে বলতে শৈলেশ্বরবাবু সোফা থেকে উঠে পড়লেন এবং আমার শয়নঘরের ভেজানো দরজাটা বন্ধ করে এলেনা শৈলেশ্বর বললেন, আসবার সময়ই নিচের সদর দরজাটায় খিল তুলে বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। বলতে বলতে ভদ্রলোক আবার চোখ তুলে চশমার কাঁচের ভিতর দিয়েই আমার দিকে যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

বাড়িতে আর কেউ নেই বুঝি?

সনৎ ও রাজু ওরা দুজনে মাকে নিয়ে কিরীটীর সঙ্গে শিলং গেছে বেড়াতে এখানে আমি একাই। ভোলা চাকর আর রাম ঠাকুর সম্বল দারোয়ানটি পর্যন্ত ভাগলবা…

তা হলে বাড়ি দেখছি খালি! আগন্তুক ভদ্রলোক বললেন।

তা যা বলেন।–হাসতে হাসতে জবাব দিলাম।

শুনুন সুব্রতবাবু, আমি কেন এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি, তাহলে খুলেই বলি। এই যে দেখছেন আমার ডান হাতের অনামিকায় একটি সোনার আংটি—এই বলে ভদ্রলোক ডান হাতখানি আমার সম্মুখে প্রসারিত করে ধরলেন।

আমি চেয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের ডান হাতের অনামিকায় একটি সাপ আংটি আংটির সাপের মাথায় মটরের আকৃতির একখানি নীলা পাথর বসানো। …আংটির পাথরটা বুঝি নীলা? আমিই শৈলেশ্বরবাবুকে প্রশ্ন করলাম

হ্যাঁ, রক্তমুখী নীলা ছিল। ভদ্রলোক মৃদুস্বরে জবাব দিলেন।

ছিল মানে! এখনও তো মনে হচ্ছে–নীলাই।

না, এটা নীলা নয়—সামান্য একটা নীল রংয়ের কাঁচমাত্র।

নীল রং-এর কাঁচ! তবে কি সত্যি ওটা নীলা নয়? এই বলে আমি বিস্মিতভাবে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম।

শৈলেশ্বরবাবু ঘাড় দোলালেন, না।

তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদুস্বরে বললেন, সুব্রতবাবু, আপনাকে এত রাতে অন্যায়ভাবে বিরক্ত করতে আসবার কারণ আমার আংটির রক্তমুখী নীলাটি হারিয়ে গিয়েছে। তাই। যেমন করে যে উপায়েই হোক আপনাকে নীলাটি আমার উদ্ধার করতে দিতেই হবে।

বলতে বলতে সহসা ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে তাঁর দু’হাত দিয়ে আমার ডান হাতটা চেপে ধরে বললেন, সুব্রতবাবু, লক্ষ লক্ষ টাকার লোহার কারবার আমার। ব্যাঙ্কেও আমার বহু টাকা সঞ্চিত আছে। নীলাটির বিনিময়ে আমি সব দিতে রাজি আছি। আপনি আমার নীলাটি শুধু যে করেই হোক উদ্ধার করে দিন আমি আপনার ক্রীতদাস হয়ে থাকব।

উত্তেজনায় শৈলেশ্বরবাবুর কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল।

আমি আমার হাতের উপর রক্ষিত শৈলেশ্বরবাবুর হাতটির উপর মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, ব্যস্ত। হবেন না, শৈলেশ্বরবাবু আমার কথা বিশ্বাস করুন, নীলা যদি সত্যি কেউ চুরি করে থাকে, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব সেটা উদ্ধার করে দিতে …আর আমার বন্ধু কিরীটীকে তো জানেন, আমি যদি না পারি, তাকে আমি তার করে দেব—সে এলে আপনার নীলা ফিরে পাবেনই।

আঃ, আমাকে বাঁচালেন সুব্রতবাবু। ভদ্রলোক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে সব এবারে খুলে বলুন তো শৈলেশ্বরবাবু। কোন কথা গোপন করবেন

জানবেন কোন কথা গোপন করলে আমার অনুসন্ধানে ব্যাঘাত ঘটবো আর তাছাড়া আমার ও আপনার মধ্যে যদি একটা ভালরকম বোঝাপড়া না থাকে তবে আমার পক্ষে কারো হয়ে কাজ করাও সম্ভব হবে না—একথা আপনাকে আগে থেকেই কিন্তু জানিয়ে রাখছি।

নিশ্চয়ই–নিশ্চয়ই সেকথা একশবার।

২. রক্তমুখী নীলার ইতিহাস

শৈলেশ্বরবাবু বলতে লাগলেন, সুব্রতবাবু, নীলাটার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আমার বয়স বর্তমানে ছাপ্পান্ন। বছর পনের আগে আমার বয়স যখন একচল্লিশ তখন আগ্রায় একটা নিলামে এক বিখ্যাত পার্শী মার্চেন্টের অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে হৃত সেই রক্তমুখী নীলাটা আমি কিনেছিলাম নীলাটা এই সাপ আংটির মাথাতেই বসানো ছিল।

সেই পার্শী মার্চেন্টের ছিল প্রকাণ্ড পাবলিশিং বিজনেস। সেই রক্তমুখী নীলার আংটিটা পরবার পর থেকেই তাঁর ব্যবসায়ে হু-হু করে লাভ হতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ একদিন সকালে সেই পার্শী মার্চেন্টকে তাঁর ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। ভদ্রলোক নিজের রিভলবার দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন ভদ্রলোকের সংসারে আপনার বলতে আর কেউ ছিল না থাকবার মধ্যে ছিল এক দূর-সম্পর্কীয় ভাগ্নে। ঐ আকস্মিক দুর্ঘটনার সংবাদ নিয়ে এদিকে ভাগ্নের কাছে তার গেল। ঐ দুর্ঘটনার দিনতিনেক পরে শোনা গেল, সেই পার্শী মার্চেন্টের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি এক লক্ষপতি সুদখোরের কাছে বাঁধা আছে। উনি নাকি নূতন কি একটা ইনভেস্টমেন্টে টাকা ঢালতে গিয়ে মৃত্যুর আগে সাতদিনের মধ্যেই যথাসর্বস্ব খুইয়েছিলেন।

মার্চেন্টের সব সম্পত্তি নিলামে উঠল। আমি তখন আগ্রায় আমার এক বন্ধুর বাসায় পুজোর ছুটি কাটাচ্ছি। বন্ধুর মুখে নিলামের কথা শুনে সেখানে গেলাম। কেননা খুব ছোটবেলা থেকেই নিলামে জিনিসপত্র কেনা আমার একটা নেশা ছিল। সেখানে গিয়ে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে নীলার আংটিটিও দেখলাম চমৎকার আংটিটি।

শুনলাম নীলার আংটিটির একটা ইতিহাস আছে। আংটিটি ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাশেম আলীরা একদিন রাত্রে নবাব যখন ঘুমন্ত অবস্থায় তখন কোন গুপ্তচর তাঁর আঙুল হতে আংটিটি চুরি করে নিয়ে যায়। এবং তারই কিছুকাল পরে উদয়নালা দুর্গের পতন হল ও সেই সঙ্গে সঙ্গে বাংলার শেষ আশার প্রদীপটুকুও নিভে গেল। তারপর বহু হাত ও বহু উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে আংটিটি এক পাঠান দস্যুর হাতে পড়ে। দস্যুটি ধরা পড়ার পর গভর্নমেন্টের হাতে আংটিটি যায় এবং সেখান হতে পার্শী মার্চেন্টটি একুশশ’ টাকায় আংটিটি কিনে নেন। একটা সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত রূপার ডিশে আংটিটি রক্ষিত ছিল। সোনার একটা সাপ-আংটি। একটি সাপ একটি সরু সোনার তারের মত, তারই মাথায় সুবৃহৎ মটরদানার মত একটি রক্তমুখী নীলা বসানো। নীল স্ফটিকের মধ্যে যেন একটি রক্তদ্যুতি নীলাভ এক ফোঁটা জমাট রক্ত যেন আশ্চর্য সুন্দর।

অন্ধকারে আংটির পাথরটা সাপের চোখের মত জ্বলে সমস্ত দিনরাত্রে আলোর তারতম্যের জন্য পাথরের মধ্যেও রঙের রূপান্তর ঘটে। বলা বাহুল্য আংটিটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম এবং তক্ষুনি মনে মনে স্থির করলাম, যত দামেই হোক আংটিটি আমি কিনব।

আমি ও আর একজন আমার চাইতে বয়সে কিছু বড় পার্শী ভদ্রলোকের মধ্যে দর-কষাকষি চলতে লাগল নীলাটা নিয়ে। শেষটায় সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে আংটি আমি কিনে নিলাম এবং তখুনিই আঙুলে পরলাম।

আপনাকে বলব কি সুব্রতবাবু, আংটিটি আঙুলে পরবার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব শরীর আমার যেন সহসা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল, একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ যেন আমার শরীরের সমগ্র স্নায়ুকোষকে তরঙ্গায়িত করে গেল—মাথাটার মধ্যে কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল, বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলাম।

সেদিনই সন্ধ্যাবেলা তাজের দিকে বেড়াতে গেছি, সঙ্গে আছে কলকাতা থেকে আগত জীবনকুমার সেন নামে আমাদের আর এক বন্ধু।

তাজের পাষাণচত্বরে আমরা তিনবন্ধু বসে আছি। এমন সময়ে অদূরবর্তী ধূসর সীমান্তের শীর্ষ ছুঁয়ে চাঁদ দেখা দিল তাজের শ্বেতশুভ্র কঠিন পাষাণগাত্রে চাঁদের আলো যেন গলে পড়ছে।

তিনজনই তন্ময় হয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছি, সহসা আমার ডানহাতের ওপর কার যেন মৃদু স্পর্শ পেয়ে চমকে ফিরে তাকালাম

এক অশীতিপর বৃদ্ধ পার্শী ভদ্রলোক। তাঁর পরিধানে সিল্কের চোগাচাপকান, মাথায় শুভ্র চুল, আবক্ষ-বিলম্বিত শুভ্র দাড়ি।

তিনিই হঠাৎ বেকায়দাভাবে চলতে গিয়ে আমার হাতের ওপরে পা দিয়ে ফেলেছেন অজান্তে।

ভদ্রলোক অনুতাপমিশ্রিত ভাঙা গলায় বললেন, মাফ কিজিয়ে। মুঝে আপকো নেহি…

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না-না-না, এতে আর কী! তাছাড়া আমারও তো তেমন বিশেষ কিছু লাগে নি।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে চলে গেলেন। আমরা আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইলাম। তারপর আমরাও উঠে পড়লাম। বন্ধুর নিজের মটরে করে তাজ দেখতে গিয়েছিলাম, তাজের গেটের বাইরে ড্রাইভার আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমার অন্য দুই বন্ধু উঠে পড়েছেন, আমি গাড়ির ফুটবোর্ডে পা দিয়ে উঠতে যাব, এমন সময় রাত্রির জমাট স্তব্ধতা ভঙ্গ করে পিস্তলের গর্জন শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সামনের কাঁচের খানিকটা ঝনঝন শব্দে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সকলেই তটস্থ হয়ে উঠলাম

আমার বন্ধু জীবনবাবু যেমন সাহসী তেমন গুণ্ডাধরনের। সে গাড়ির দরজা খুলে এক লাফ দিয়ে নেমে পড়ল এবং ডানদিককার সিঁড়ি ভেঙে তাজ বাজারের যেখানে পাথর ও নানাবিধ সৌখিন জিনিসপত্র বিক্রী হয় সেদিকপানে ছুটল।

আমরা হতভম্ব হয়ে গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম অল্পক্ষণ পরে জীবনকুমার ফিরে এল। এসে বলল, না, কাউকেই দেখা গেল না—বেটা পালিয়েছে।

আকস্মিক দুর্ঘটনার কথা ভাবতে ভাবতেই আমরা গাড়িতে চেপে রওনা হলাম বাড়ির দিকে।

তাজ গেট হতে বার হয়ে কংক্রিটের সরু রাস্তা বরাবর আগ্রা ফোর্ট স্টেশন পর্যন্ত চলে গিয়েছে। রাস্তার দুপাশে নানারকমের গাছপালা মৃদু চন্দ্রালোকে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে যেন স্বপ্নের মতা মাঝে মাঝে হাওয়ার মৃদুমৃদু দোলায় পাতাগুলো সিপ সিপ শব্দ করে।

আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ির মধ্যে আমরা সকলেই চুপচাপ বসে আছি। কারও মুখে কোন কথা নেই। ঘটনাটা যেন আগাগোড়া রহস্যময়। …

সেদিন গভীর রাত্রে দোতলার ঘরে আমি আর জীবনকুমার পাশাপাশি শয়ন করেছি। সহসা একসময় একটা খসখস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

ঘর অন্ধকারা খোলা জানলা-পথে আকাশের দিকে তাকালাম তারায়-ভরা একটুকরো আকাশ, যেন ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের একটুখানি ছোঁয়া।

চাঁদ বোধ হয় তখন আকাশের একপ্রান্তে হেলে পড়েছে।

আবার খস খস শব্দ। মনে হল, কে বুঝি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ঘরের মধ্যে চলে বেড়াচ্ছে।

কে?–বলে উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম।

নিশ্চয় কেউ ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে। কিন্তু কে? চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে শুয়ে– শুয়েই মৃদু আলো-ছায়া-ভরা ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগলাম

একসময় চোখে পড়ল একটা লম্বা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি নিঃশব্দ অন্ধকারে দুলতে দুলতে যেন আমার শয্যার দিকে অতি সাবধানে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি বুঝতে পারছি—অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সমগ্র শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

এতক্ষণে ভাল করে শিয়রের কাছে দণ্ডায়মান মূর্তির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। একমুখ ভর্তি কালো কালো দাড়ি নিয়ে সেই মূর্তি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অস্পষ্ট আলোছায়ায় তার চোখের মণি দুটো যেন ধক ধক করে জ্বলছে। দু’খণ্ড অঙ্গারের মতই। কী কুর, বীভৎস সেই দৃষ্টি! যেন কুৎসিত ভয়ঙ্কর একটা বন্য লালসা সে দৃষ্টির মধ্যে লেলিহান হয়ে উঠেছে।

মূর্তির গায়ে একটা কালো রঙের চাদর। চাদরটা মাথার ওপরে ঘোমটার আকারে তুলে দেওয়া। ঘোমটা কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে, হাত দুটি বুকের ওপর ভাঁজ করে মূর্তি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

ইচ্ছা হচ্ছিল চীৎকার করে বাড়ির সকলকে জাগিয়ে তুলি। কিন্তু কী সম্মোহন দৃষ্টি সে ক্ষুধিত চোখের তারায় কণ্ঠের সমস্ত শক্তি আমার অবশ হয়ে গেছে।

ধীরে ধীরে এক সময় লোকটা তার চাদরের ভিতর হতে একটা দীর্ঘ হাত বের করে বিছানার একপাশে রক্ষিত আমার ডানহাতটা চেপে ধরতেই আমি ধড়মড় করে উঠে বসে চীৎকার করে উঠলাম, চোর চোর!

বিদ্যুৎগতিতে আমার ডানহাতের আঙুলে একটা যেন মোচড় দিয়েই মূর্তিটা খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমার চীৎকার শুনে জীবন ততক্ষণে ধড়মড় করে শয্যার উপরে উঠে বসেছে। বাড়ির আর সকলেও জেগে উঠল।

আমার মুখে সব কথা শুনে সকলে মিলে খোঁজাখুঁজি করা হল, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।

মাটি থেকে দোতলার জানালা প্রায় আট-ন হাত উঁচু হবে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেখান দিয়ে লাফিয়ে পালানো একপ্রকার অসম্ভব।

বন্ধুরা বললে, ওই রক্তমুখী নীলাটা হাত থেকে খুলে ফেল। ওটাই হয়তো যত নষ্টের গোড়া। …ওটা আঙুলে পরা অবধি যত ব্যাপার ঘটছে।

আমি বললাম, তা হোক, ওটা আমি খুলব না আঙুল থেকে—যত বিপদই আমার আসুক, শেষ পর্যন্ত মরতে হয় তাও স্বীকার। …

এই পর্যন্ত বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন।

৩. কিরীটী

তারপর?—আমি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

তার পরের দিনই আগ্রা থেকে ফিরে এলাম। দীর্ঘ এক বছর আমার কোন বিপদ-আপদ ছিল না। এদিকে ব্যবসায়েও আমার দিনের পর দিন খুব বেশি উন্নতি হতে লাগল। এমন সময়ে বোম্বাইয়ে এক পার্শী মার্চেন্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। অমন চমৎকার ভদ্রলোক ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমি ইতিপূর্বে দেখি নি। তিনি আমার নূতন হার্ডওয়ার ব্যবসায়ের অংশীদার হলেনা বলা বাহুল্য, নূতন ব্যবসায়েও আমার প্রচুর লাভ হতে লাগল।

এমনি করে আরো বারোটি বছর কেটে গেল। কিন্তু হঠাৎ গত বছর থেকে দেখছি, ব্যবসায়ে আমার অত্যন্ত ক্ষতি হচ্ছে। পর-পর হাজার হাজার টাকার তিন-চারটে ট্রানজ্যাকশন একেবারে। নষ্ট হয়ে গেল। একদিন দুপুরবেলা নিজের প্রাইভেট রুমে বসে বসে এইসব কথা ভাবছি, সহসা আমার আংটির কথাটা মনে পড়ে গেল। আংটিটির দিকে তাকালাম। কিন্তু আংটির পাথরটা যেন কেমন-কেমন মনে হল নীলাভ পাথরটার ভিতর থেকে যে একটা রক্তদ্যুতি ফুটে বের হয়, সেটা তো কই দেখা যাচ্ছে না! চমকে উঠলাম এবং তক্ষুনি গাড়িতে চেপে বৌবাজারের এক জুয়েলারের দোকানে গেলাম

জুয়েলার আমার যথেষ্ট পরিচিত আংটির পাথরটা পরীক্ষা করে বললেন, ওটা আসল নীলা পাথরই নয়। সামান্য একটা নীল রঙের কাঁচ মাত্রা আমার মাথা ঘুরে গেল। চারিদিক অন্ধকার দেখলাম।

বাড়িতে ফিরেই পুলিশে সংবাদ দিলামা বাড়ির সব চাকর-বাকরদের নানাভাবে জেরা শুরু করে দিলাম। কিন্তু কোন সুবিধাই হল না।

আমার কিন্তু মন ভেঙে গেল পাগলের মত দিবারাত্র পাথরটার কথাই চিন্তা করতে লাগলাম এমন সময় সহসা একটা বেনামী চিঠি রেজিস্টারী ডাকে পেলাম—এই দেখুন সেই চিঠি!

ভদ্রলোক জামার বুকপকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা মলিন খাম বের করে দিলেন চিঠিটা টেবিল ল্যাম্পের সামনে উঁচু করে ধরলাম। পরিষ্কার ইংরাজী টাইপে লেখা। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—

প্রিয় শৈলেশ্বর,

তোমার আংটির নীলা হারায় নি। আটমাস আগে আমি সেটা চুরি করেছি তোমার আংটিসমেতা তোমার হাতের আঙুলে যে আংটিটি আছে সেটা একটা মেকি পাথর বসানোে অন্য আংটিা শুনলাম তুমি পুলিশের সাহায্য নিয়েছ। কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। মিথ্যা সময় ও অর্থের অপব্যয় হবে মাত্র কারণ এ জীবনে আর তোমার সেটা ফিরে পাওয়ার কোন আশাই নেই জেনো। অতএব বুদ্ধিমানের মত কোন গোলযোগ না করে চুপচাপ থাকাই ভালা চুপ করে যাও এবং কেস তুলে নাও।

ইতি,–

B.Y.X.IV.IV.I, তোমার ’R’

আমি তিন-চারবার আগাগোড়া চিঠিটা পড়ে শৈলেশ্বরবাবুর মুখের দিকে তাকালাম।

এখন বুঝতে পারছেন বোধ হয়, কেন এত গোপনে এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি!–শৈলেশ্বরবাবু বললেন।

আচ্ছা, আট মাস আগে এমন কোন ঘটনা বা উপলক্ষ ঘটেছিল যে আপনি কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছলেন?

না, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। তাছাড়া অনেক দিন আগের কথা…

আট মাস আগে আপনি কোথায় ছিলেন?

মীরাটো ব্যবসা সংক্রান্ত একটা ট্রানজ্যাকশনের কাজে আমি ও আমার বন্ধুটি সেখানে মাসখানেক ছিলাম।

আপনার এই পার্শী বন্ধু লোক কেমন?

আগেই তো আপনাকে বলেছি, অমন অমায়িক ভদ্র ও রুচিসম্পন্ন লোক বড় একটা আমার চোখেই পড়ে নি।

বয়স কত হবে বলে মনে হয়?

তা পঞ্চাশকি ষাট হবে বোধ করি।

পুলিশ কি এখন আপনার কেস ইনভেসটিগেট করছে মিঃ সেন?

না, এই চিঠি পাবার পরই কেসটা আমি উইথড্র করে নিয়েছি।

বেশ করেছেন কিন্তু আজকের মত এই চিঠিটা আপনাকে আমার কাছে রেখে যেতে হবে। কাল সকালে হোক কিংবা রাত্রেই হোক, সুবিধামত আমিই আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। আপনি বাসা থেকে কোথাও বেরোবেন না। তাছাড়া আপনার বাড়িতে তো ফোন আছে?

আজ্ঞে আছে।

এবারে আপনি তাহলে বাড়ি যান। রাত্রি প্রায় শেষ হতে চলল।

শৈলেশ্বরবাবুকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। ভোলার সন্ধান নিয়ে দেখি, বেটা বাড়ি ফিরে সদর দরজা বন্ধ দেখে রোয়াকে শুয়ে পড়েই দিব্যি নাক ডাকাচ্ছে।

ভোলাকে জাগিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দিলাম এবং তারপর উপরে এসে শুয়ে পড়লাম

পরদিন দুপুরে অপ্রত্যাশিতভাবে কিরীটী শিলং থেকে ফিরে এল আমি ঐ সময়ে বসে মিঃ শৈলেশ্বর সেনের রেজিস্টারী ডাকে পাওয়া চিঠির তলাকার সাঙ্কেতিক অক্ষরগুলো বুঝবার চেষ্টা করছিলাম।

ওহে মিলিয়নিয়ার!

চমকে মুখ তুললাম। দেখি খোলা দরজার সামনে দণ্ডায়মান কিরীটী।

কিরীটী!…আনন্দে আমার গলার স্বর বুজে এল।

হ্যাঁ, কিরীটীই। কিন্তু এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়া হচ্ছিল শুনি?

একটা চিটি।

কার চিঠি? কিরীটী হাসতে হাসতে এগিয়ে এল।

দেখ না।

চিঠিটা আমি কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরলাম।

কিরীটী হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে গুনগুন করে পড়তে লাগল। তারপর সহসা চিঠির শেষে ঐ সাঙ্কেতিক লেখাগুলোর কাছে এসে থেমে গিয়ে পরক্ষণেই আবার বললে, হুঁ, তারিখ দেখছি ১০.৪.৪১—আজ হচ্ছে ২০.০৪.৪১, দিনদশেক আগেকার চিঠি। B.Y. কথাটি কি? আর নীচের এই নামের বদলে ‘R’ অক্ষরটাই বা কী মীন করছে? নামের অক্ষর নয় তো? কি নাম—রজত, রমেন, রমেশ?

আমি কিন্তু কিরীটীকে এবার বাধা দিয়ে বললাম, তোমার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিরীটী?

না, ট্রেন থেকে নেমে সোজা এখানে চলে এসেছি। বলতে বলতে কিরীটী আমার পাশেই একটা খালি সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লা

রাজু ওরা আসেনি?

না, তাদের শৈলাবাসের আকাঙ্ক্ষা এখনো মেটে নি কী আর করি! হাত-পা গুটিয়ে অমন দিন রাত্রি চুপচাপ হয়ে বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন জমাট বেঁধে যাবার যোগাড় হয়ে উঠেছিল কাজে-কাজেই আমি আর থাকতে পারলাম না। জংলীকে নিয়ে সোজা চলে এলাম। জংলীকে ট্যাক্সি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে, বরাবর তোমার এখানেই চলে আসছি। এখান থেকে স্নানপর্ব সেরে তবে গৃহে গমনা ইতিমধ্যে হীরা সিং গাড়ি নিয়ে আসবে। …

আর দেরী করো না তবে, স্নানের ঘরে যাও। আমি ততক্ষণ ভোলাকে দিয়ে কাপড় আর টাওয়েল পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কিরীটী স্নানঘরের দিকে চলে গেল।

৪. মুখোমুখি

বিকালের দিকে কিরীটী আমাদের বাড়িতে এল।

ভোলা গরম গরম চা ও টোস্ট দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে কিরীটীকে গতরাত্রির ঘটনা আনুপূর্বিক সব খুলে বললাম

সমস্ত ঘটনা শোনবার পর কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বলল, মাস্টার, তোমার সকালের সেই চিঠির রহস্য আমার কাছে এতক্ষণে খোলসা হয়ে গেল। কথা কয়টি বলে কিরীটী একগাল পীতাভ ধোঁয়া মুখ থেকে উদগীরণ করলো।

কী,—অর্থ কী? আমি উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলাম।

জলের মত সোজা। কিন্তু কথা হচ্ছে, সত্যি কি তুমি নীলাটা উদ্ধার করতে চাও নাকি?

নিশ্চয়ই।

তবে বোম্বে যেতে হবে।

বোম্বে যেতে হবে? তার মানে?

মানে—মানে আবার কী? বলছি তো বম্বে যেতে হবে–But I am too tired!…

এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে পাশের টেবিলে রক্ষিত টেলিফোন বেজে উঠল। এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললাম, হ্যালো… Yes, Subrata Roy Speaking… অ্যাাঁ, কী। বললেন? বেরিয়ে যাচ্ছেন? জরুরী কাজে? আপনার সেই পার্শী পার্টনারের সঙ্গে?…আজ তাহলে যাব না?

সহসা কিরীটী আমাকে বাধা দিল সুব্রত, ওকে যেতে বারণ কর এবং বল ওর পার্শী পার্টনারের সঙ্গে আজকে যেন কোথাও না যান…আমরা আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওঁর সঙ্গে দেখা করবা …আর জিজ্ঞাসা কর তো—পার্শী মার্চেন্টটি এখানে কোথায় থাকেন?

কিরীটীর কণ্ঠে ভয়ঙ্কর একটা আদেশের সুর।

আমি কিরীটীর কথামত তক্ষুনি মিঃ সেনকে সবই খুলে বললাম মিঃ সেন আপত্তি জানালেন, বললেন, তাঁর পার্শী বন্ধুটি গত সপ্তাহে কলকাতায় এসেছেন। গ্র্যান্ড হোটেলে একটা স্যুট নিয়ে আছেন। আজ রাত্রেই দিল্লী এক্সপ্রেসে মিঃ সেনকে নিয়ে কী একটা বিজনেসের ব্যাপারে তাঁদের পাটনা যাবার কথা।

আমি তখন মিঃ সেনকে কিরীটীর আসবার সংবাদ দিয়ে বললাম, আমি কিরীটীকে তাঁর নীলা সম্পর্কে সমস্ত ঘটনা বলেছি এবং কিরীটীরই ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে আমি থাকতে বলছি।

মিঃ সেন বললেন, বিজনেসের ব্যাপারে পাটনায় তাঁদের যেতেই হবে, না গেলে সমূহ ক্ষতি হবে। তবে ট্রেন সেই রাত্রি সাড়ে দশটায়া বাড়ি থেকে রাত্রি নটার পর রওনা হলেও কোন ক্ষতি নেই। এর মধ্যে যদি আমরা তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করি তো ভাল হয়—তাঁর পার্শী বন্ধুটিও এখুনি সেখানে আসছেন, তাঁর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেবেন। তিনিও সব জানেন নীলা চুরির কথা এবং তাঁকে সব কথা আজ উনি নাকি দুপুরে বলেছেনও।

আমি কিরীটীকে মিঃ সেনের বক্তব্য সব বললাম।

কিরীটী বললে, তবে মিঃ সেনকে বলল যে, আমরা না যাওয়া পর্যন্ত উনি যেন বাড়ি থেকে কোথাও না বের হন। আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই যাচ্ছি।

আমি কিরীটীর নির্দেশমত মিঃ সেনকে ফোনে তাই বলে দিলাম।

মিঃ শৈলেশ্বর সেনের বাড়ি হাজরা রোডে।

টালীগঞ্জে কিরীটীর বাসা হতে আমরা যখন মিঃ সেনের বাসার সামনে হাজির হলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।

হাজরা রোডের উপরেই প্রকাণ্ড ত্রিতল সাদা রংয়ের বাড়ি বাড়ির সামনে লোহার গেটা গেটে নেপালী দারোয়ান গেট থেকে লাল কাঁকর বিছানো পথ বরাবর গাড়িবারান্দার নীচ পর্যন্ত গেছে। দু’পাশে টেনিস লন ও নানাজাতীয় ফুল ও পাতাবাহারের গাছের সৌন্দর্য-সমাবেশ

হীরা সিং গাড়িবারান্দার নীচে গাড়ি থামাতেই আমাদের নজর পড়ল অন্যদিকে আর একখানা সিডানবডি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বেয়ারা আমাদের পথ দেখিয়ে উপরে নিয়ে গেল।

দোতলার কোণের দিককার একটি ঘরে মিঃ সেন ছিলেন।

আমাদের আসার সংবাদ পেয়ে কলস্বরে অভিনন্দন করে ঘরের মধ্যে ডেকে নিলেন, আসুন আসুন!

আমরা তিনজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সর্বাগ্রে আমি, মাঝখানে কিরীটী ও পশ্চাতে মিঃ সেনা

মাঝারি গোছের একখানি ঘর ঘরের মেঝেতে সবুজ রংয়ের মূল্যবান কার্পেট বিছানো, কালো পাথরের তৈরী ঘরের মধ্যখানে একটা ব্রোঞ্জের তৈরী মারকারির প্রতিমূর্তি শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপরে রক্ষিত।

ঘরের দু’পাশে সোফা পাতা তারই একটা অধিকার করে একজন শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধ পার্শী ভদ্রলোক উপবিষ্টা ভদ্রলোকের চোখে কালো কাঁচের চশমা।

আমরা সকলে এক একটি সোফা অধিকার ক’রে বসলামা তারপর কিরীটীকে দেখিয়ে মিঃ সেনকে বললাম, মিঃ সেন, ইনিই আমার পরম বন্ধু কিরীটী রায়। …আর কিরীটী, ইনি মিলিয়নিয়ার আয়রন মার্চেন্টমিঃ শৈলেশ্বর সেন।

দু’জনে দু’জনকে অভিবাদন ও প্রত্যাভিবাদন জানালেন। এবারে মিঃ সেন অদূরে উপবিষ্ট কালো চশমা চোখে পার্সী ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন, ইনি আমার অংশীদার ও বিশিষ্ট বন্ধু মিঃ রুস্তমজী মেটা। …আর ইনি মিঃ সুব্রত রায়, আমার নবলব্ধ বন্ধু।

মিঃ মেটা হাত তুলে নমস্কার করতে করতে বললেন, Glad to meet you Mr. Roy.

কিছুক্ষণ এটা-ওটা আলাপ-আলোচনার পর সহসা একসময় কিরীটী মিঃ মেটার দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার চোখ কী খারাপ নাকি মিঃ মেটা?

মেটা মৃদুস্বরে জবাব দিলেন, হাঁ, মানে কয়েকমাস যাবৎ আমার একটিমাত্র চোখ উইক হয়ে পড়েছে।

তার মানে?—কিরীটী প্রশ্ন করল।

মানে আমার একটি চোখ ছোটবেলায় নষ্ট হয়ে যায় বাঁ চোখটা একটি মাত্র চোখই আর অবশিষ্ট। অত্যধিক পরিশ্রমে এটাও পাছে উইক হয়ে পড়ে, তাই ডাক্তারের পরামর্শে কালো ফিল্মের চশমা ব্যবহার করছি কিছুদিন হলো।

কতদিন হোল কালো চশমা ব্যবহার করছেন?

বেশিদিন নয়—সাত-আট মাস হবে বোধ হয়, তাই না মিঃ সেন? রুস্তমজী শৈলেশ্বরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

হাঁ, ঐরকমই হবে।

আরো দু’চারটে কথাবার্তার পর রুস্তমজী বললেন, শুনলাম আপনারা আমার বন্ধু সেনের হারানো নীলাটি উদ্ধারের চেষ্টা করছেনা সত্যি নীলাটি হারানো অবধি বন্ধু আমার অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছেন ব্যবসাক্ষেত্রে পর্যন্ত মন দেন না আগের মত নীলাটি যদি উদ্ধার করে দিতে পারেন, আমরা দুজনেই আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

কিরীটী বললে, চেষ্টা করতে পারি, ফলাফলের কথা বলি কেমন করে?

আপনার ক্ষমতার কথা মিঃ সেনের মুখেই আমি শুনেছি মিঃ রায়। কথাটা বললেন রুস্তমজী।

ভৃত্য ট্রেতে করে চা ও জলখাবার নিয়ে এল।

চা পানের পর হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে একসময় রুস্তমজী বললেন, কিন্তু মিঃ সেন, এদিকে আবার বেশি দেরী হলে ট্রেন আমরা ধরতে পারব না।

তারপর রুস্তমজী তাঁর পার্টনার ও বন্ধু শৈলেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবারে উঠুন মিঃ সেন। তারপর আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ আমাদের ছেড়ে দিতে হবে মিঃ রায়। একটা বড় জরুরী কাজ হাতে আমাদের—আপনাদের সঙ্গে আর এক দিন ভাল করে আলাপ করব।

সহসা এমন সময় কিরীটীর কণ্ঠস্বরে আমরা সকলেই চমকে উঠলাম। সে গম্ভীর স্বরে বলল, মিঃ রুস্তমজী মেটা, আপনাকে আমি মিঃ সেনের রক্তমুখী নীলাটা চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করছি।

ঘরের মধ্যে সহসা বজ্রপাত হলেও বোধহয় এতটা কেউ চমকে উঠত না।

মিঃ মেটা যেন কিরীটীর কথায় পাষাণের মত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন এবং কালো কাঁচের চশমা পরা চোখ নিয়ে স্থির অচঞ্চল ভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

অনেকক্ষণ পরে মিঃ মেটা মিঃ সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সবের মানে কি মিঃ সেন?

মিঃ সেনও যেন ভয়ানক বিব্রত হয়ে পড়েছেন।

কিরীটী তখন মিঃ মেটার দিকে তাকিয়ে অচঞ্চল কঠিন আদেশের ভঙ্গিতে বলল, লক্ষ্মী ছেলের মত আসন গ্রহণ করুন মিঃ রুস্তমজী মেটা। শুনুন মিঃ সেন, শোন সুব্রত কয়েক মাস আগে রুস্তমজীর সঙ্গে যখন মিঃ সেন মীরাটে ছিলেন, সেই সময়ে নিশ্চয়ই খাবারের সঙ্গে কোন ঘুমের ঔষধ দিয়ে কোন এক রাত্রে রুস্তমজী মিঃ সেনের আঙুল থেকে রক্তমুখী নীলা বসানো সাপ আংটিটা খুলে নিয়ে অন্য একটি নকল পাথর বসানো আংটি পরিয়ে দেন। রুস্তমজীকে হয়ত চিনতে পারছ না, বোম্বের বিখ্যাত পার্শী পাবলিকেশন বিজনেসম্যান—একদা যাঁকে তাঁর নিজ শয়নকক্ষে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়—ইনি তাঁরই ভাগ্নে। কেমন রুস্তমজী? আমার কথা ঠিক কি না? রুস্তমজী নিশ্চয়ই তাঁর মামার কাছে কোন এক সময় হয়ত ঐ নীলাটার সম্পর্কে শুনেছিলেন এবং তাতেই হয়তো নীলাটার ওপরে ওঁর লোভ জন্মায়। মামার মৃত্যুর পর যখন শুনলেন সমস্ত সম্পত্তি নিলামে উঠেছে, তখন তাড়াতাড়ি এলেন নিলামে আংটিটি কিনতে, কিন্তু সেবারে মিঃ সেন বেশি অফার দিয়ে কিনে নিলেন ওঁকে বঞ্চিত করে। ফলে রুস্তমজীর আক্রোশ পড়ল মিঃ সেনের উপর এবং একবার তাঁদের সামনে ও একবার রাত্রে আগ্রাতেই ওঁর বন্ধুর বাসায় আংটিটি নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন ভাবলেন, এভাবে আংটিটি হাতানো যাবে না তখন বন্ধুবেশে ব্যবসার ভাগীদার সেজে এসে মিঃ সেনের সামনে দাঁড়ালেন। কোন পার্শী কোন একজন বাঙালীকে অংশীদার নিয়ে ব্যবসা করবে—এ স্বপ্নেরও অগোচরা মূল উদ্দেশ্য ছিল রুস্তমজীর, এ নীলাটি কোনমতে হাতিয়ে নিজের অধিকারে আনা। মিঃ সেনের ব্যবসার গতি দেখে নীলাটির জন্য আরো লালায়িত হয়ে উঠলেন। দিনের পর দিন কলকাতায় থেকে নীলাটা চুরি করা সম্ভব হবে না জেনেই ব্যবসার ছল করে মিঃ সেনকে মীরাটে নিয়ে গেলেন এবং অনায়াসেই কাজ হাসিল করলেন। বলতে বলতে এবারে কিরীটী হঠাৎ রুস্তমজীর দিকে ফিরে তাকিয়ে কঠোর নির্দেশের ভঙ্গিতে বললে, রুস্তমজী, এবারে বের করে দিন মিঃ সেনের রক্তমুখী নীলাটা!

এতক্ষণে রুস্তমজী কথা বললেন, মিঃ রায়, একজন ভদ্রলোককে এভাবে আপনার মত একজন ভদ্রলোকের পক্ষে অপমান করবার কোন সঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছি না!

মিঃ মেটা, আর রহস্য কেন? আমি জানি নীলাটা আপনার সঙ্গেই আছে!

কি বলছেন আপনি পাগলের মত মিঃ রায়?

ঠিকই বলছি।

বেশ খুঁজে দেখুন…কিন্তু জানবেন, এ অপমান আমিও সহজে হজম করব না।

নিজেই রুস্তমজী তন্ন-তন্ন করে জামাকাপড়, মনিব্যাগ, জুতো, মোজা, টুপি, চুল সবকিছু খুঁজে দেখালেন, কিন্তু নীলাটা পাওয়া গেল না। কিরীটী তখন যেন ক্ষেপে উঠেছে এবং বলে ওঠে, ওসব খুঁজলে কি হবে, ওখানে তো নেই বলতে বলতে সহসা এগিয়ে এসে এক টান দিয়ে রুস্তমজীর চোখ থেকে গগলসটা ছিনিয়ে নিল এবং এক তীক্ষ্ণ আদেশের সুরে বলল, রুস্তমজী, রক্তমুখী নীলা অতি ভয়ঙ্কর জিনিস ভেবে দেখুন আপনার মামার কথা কিভাবে যথাসর্বস্ব খুইয়ে তাঁকে শেষ পর্যন্ত একদিন আত্মহত্যা করতে হয়েছিল কে জানে কোন ভয়ঙ্কর পৈশাচিক মৃত্যু আপনার জন্যও অপেক্ষা করছে কিনা…সর্বনাশ যদি না চান যাঁর জিনিস তাঁকে ফিরিয়ে দিন। ও নীলা— বিশেষ করে রক্তমুখী নীলা সকলের সহ্য হয় না। এই যে দীর্ঘকাল নীলাটার লোভে হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, চুরি করেও কী সেটা লুকোনো রইল? ধরা পড়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। ওর সাহচর্যেও বিষ আছে মিঃ মেটা। রক্তমুখী নীলা বড় সাংঘাতিক বস্তু। এখনও ভাল চান তো যাঁর নীলা ফেরৎ দিন তাঁকেই।

রুস্তমজী কঠিন নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, বললাম তো, আমি জানি না।

কিরীটীর দু’চোখের তারায় যেন আগুনের ঝলকা ক্রমে সে এক পা এক পা করে রুস্তমজীর দিকে আসতে আসতে বজ্রকঠোর কণ্ঠে বলে, আপনি—হাঁ, আপনি জানেন—আপনি জানেন! আপনার চোখ, ঐ পাথরের চোখ—ঐখানেই সেই নীলা! ঐ রক্তমুখী নীলা!…

কিরীটীর ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে তখন। রুস্তমজীও সহসা যেন কেমন চঞ্চল হয়ে খপ করে চোখের ওপরে হাত চাপা দিলেন এবং চীকার করে বললেন, না, না— আমি জানি না, আমি জানি না।

কিরীটী তখন মিঃ সেনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, মিঃ সেন, আপনার এই বন্ধুর চোখের মধ্যেই লুকানো আছে নীলাটা নিয়ে নিন!

বাঘের মতই মিঃ সেন রুস্তমজীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, খুন করব তোকে…চোর…আমার রক্তমুখী নীলা—দে, দে—

অনায়াসেই মিঃ সেন বৃদ্ধ রুস্তমজীকে চিৎ করে মাটিতে ফেলে আঙুল দিয়ে খাবলিয়ে রুস্তমজীর পাথরের চোখটা ছিনিয়ে নিলেন।

ঝরঝর করে রক্ত ছুটে এসে রুস্তমজীর সমস্ত জামা নিমেষে রাঙা করে তুলল এবং সেই রক্তের সঙ্গে চোখের কোটর হতে নীলাটা ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। পাগলের মতই মিঃ সেন নীলাটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন।

বাড়িতে ফিরে একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে মৃদু টান দিতে দিতে কিরীটী বলল, প্রথমে চিঠির সাঙ্কেতিক অর্থ আমি বুঝতে পারি নি, পরে তোমার মুখে মিঃ সেন বর্ণিত সমস্ত ঘটনা শুনে বুঝলাম B. Y. Bombay, R মানে রুস্তমজীর নামের প্রথম অক্ষর—তখনই আমার কাছে ব্যাপারটা সহজ হয়ে এল। তাই বলেছিলাম, বম্বে যাব। কেননা শুনেছিলাম তোমার মুখে, রুস্তমজী বোম্বেতেই নাকি থাকেন। তারপর ফোনে যেই শুনলাম মিঃ সেনের পার্শী বন্ধু এখানেই এখন আছেন, তখন বোম্বে যাওয়ার প্রয়োজন আর থাকল না।

একটা কথা, নীলাটা যে রুস্তমজীর সঙ্গেই আছে, কেমন করে বুঝলে?

এ তো খুবই সহজ। তুমি হয়ত জানো না সুব্রত, কোন পাথর ইত্যাদি মানুষ যখন ব্যবহার। করে, সেটা দেহের চামড়ার সঙ্গে স্পর্শ করে থাকা চাই, নচেৎ সকলের ধারণা পাথরের কোন উপকার নাকি পাওয়া যায় না। রক্তমুখী নীলাটা যখন রুস্তমজী চুরিই করেছেন, তখন যাতে সেটা থেকে উপকার পান সেই চেষ্টাই করবেন এবং তা করতে হলেই গায়ের চামড়ার সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে হবে। সেভাবে রাখতে হলে এক আংটি অথবা ‘তাগা’র সঙ্গে পাথরটা যুক্ত করে রাখতে হয়। কিন্তু তাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে ওঁর পক্ষে সবচাইতে ভাল ও সহজ উপায় ছিল, নীলাটা তাঁর পাথরের চোখের তলায় রাখা এবং তা করতে পারলে কারও চোখে পড়বারও সম্ভাবনা নেই…কাজও হবে এবং করলেনও তাই। দোষীর মন কিনা, তাই সর্বদা একটা কালো সান-গগলস ব্যবহার করতে শুরু করেন রুস্তমজী। রুস্তমজীর হাতে আংটি নেই দেখে তাই প্রথমেই তাঁর চোখের গগলস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর চোখের অসুখের সময় ও নীলাটা চুরি যাবার সময় মিলিয়ে দেখো—একটা সুন্দর মিল আছে।

আমার সমস্ত সন্দেহ মিটে গেল। এবং সম্পূর্ণ অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই সোজাসুজি তাঁকে আক্রমণ করলাম

চমৎকার তোমার যুক্তি কিরীটী!

এমন সময় পশের ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল, ক্রিং…ক্রিং…ক্রিং…

সুব্রতবাবু?—ওপাশ থেকে প্রশ্ন এল।

হাঁ, বলুন!

আপনার ও মিঃ রায়ের নামে পাঁচ পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা চেক পাঠালাম আমার সেক্রেটারীর হাত দিয়ে। অনুগ্রহ করে ওই সামান্য টাকাটা নিয়ে আমায় বাধিত করবেনা আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলতে পারব না। আমি ফোনটা রেখে এঘরে এসে দেখি সোফার ওপরে হেলান দিয়ে ইতিমধ্যেই কিরীটী কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *