অঙ্গার

অঙ্গার! 

এক.

লম্বা, ঋজু শরীরের কাঠামো।

 কোঁকড়ানো চুল, ইগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো খাড়া নাক।

সুদর্শন। ড্যাশিং।

আইনের তুখোড় ছাত্র। বিনয়ী, নম্র, মার্জিত রুচির পোশাক-আশাক, সব মিলিয়ে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। আপাদমস্তক নিপাট ভদ্রলোক। প্রথম দর্শনে যে কেউই পছন্দ করে বসতে বাধ্য। রহস্য আর মায়ার অদ্ভুতে মিশেলে ভরা চোখ দুটো যেকোনো মেয়ের রাতের ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট। সুদর্শন চেহারা আর ভদ্রলোকের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল অন্য একটা প্রাণী। যেন সে রবার্ট লুই স্টিভেন্সনের গল্পের বই থেকে উঠে আসা বাস্তবের ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড। সে ছিল এক সিরিয়াল কিলার, রেইপিস্ট, নরপিশাচ। ৩০ এরও বেশি মেয়েকে নিজের হাতে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছিল বলে নিশ্চিতভাবে জানা যায়। যদিও আসল সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হবার কথা। সিরিয়াল কিলারদের নানা ধরনের বাকি থাকে। ওর বাতিক ছিল নেক্রোফিলিয়া মৃতদেহের সাথে সেক্স। পচে-ফুলে গলতে শুরু করার আগ পর্যন্ত ও ওর ভিক্টিমদের মৃতদেহগুলোকে ধর্ষণ করত। বাবা-মার দেয়া নাম, থিওডর রবার্ট বান্ডি। মানুষ ওকে টেড বান্ডি বলেই জানত। শেয়ালের মতো ধূর্ত ছিল, বিড়ালের মতো নিঃশব্দ ছিল তার চলাফেরা। নারী শিকারের নিখুঁত প্ল্যান করত। চিতার ক্ষিপ্রতায় শিকার করে সেফ ভূতের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। বাঘা বাঘা পুলিশ অফিসার আর ঝানু গোয়েন্দাদের নাকের জল আর চোখের জল এক করে ছেড়েছিল। সত্তরের দশকে অ্যামেরিকার ৭ টি স্টেইটজুড়ে কায়েম করেছিল এক ত্রাসের রাজত্ব। 

প্রথম আঘাত

ঠিক কখন এবং কোথায় বান্ডি শিকার শুরু করেছিল তা নিয়ে বিস্তর তদন্ত হয়েছে, অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে, কিন্তু আসল তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। একেক সময় একেক জনকে বান্ডি একেক রকম কথা বলত। ধারণা করা হয় মেয়েদের কিডন্যাপ আর ধর্ষণের শুরুটা ১৯৬৯ থেকে শুরু করলেও, বান্ডি খুন আর নৈক্রোফিলিয়া শুরু করে ১৯৭১ সালের পর থেকে। কিছু আলামত, আর তদন্তে পাওয়া কিছু তথ্যের কারণে অনেক ডিটেক্টিভ ধারণ করেন, খুনি হিসেবে বান্ডির হাতেখড়ি আরও অনেক আগে। ১৯৬১ সালে ৮ বছর বয়সের একটা মেয়েকে খুন করার মাধ্যমে। বান্ডির বয়স তখন মাত্র ১৪। বান্ডি অবশ্য চিরকাল এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। টুকটাক কিডন্যাপিং এবং দু-একটা খুন করে হাত পাকানোর পর বান্ডি শুরু করে তার আসল খেলা। ১৯৭৪ সালে, ২৭ বছর বয়সে। 

শিকার

বান্ডি টার্গেট করত হাল ফ্যাশনের আকর্ষণীয় পোশাকের কলেজ, ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া সুন্দরী মেয়েদের। যাদের বয়স সাধারণত ১৫-২৫ বছরের মধ্যে। সুন্দর জামাকাপড় পরে কেতাদুরস্ত হয়ে মুখোশ, টর্চ লাইট, দড়িদড়া, সিঁধকাঠি, হ্যান্ডকাফ ইত্যাদি বাদামি ভৌক্সওয়াগানে চাপিয়ে বান্ডি বেরিয়ে পড়ত শিকারের খোঁজে। টহল দিয়ে বেড়াত এমন জায়গাগুলোতে যেখানে নারীদের আনাগোনা বেশি। কাউকে মনে ধরলে বা একা কোনো সুন্দরীকে পথে চলতে দেখলে নেমে আসত গাড়ি থেকে। এক হাত ঝোলানো থাকত স্লিং-এ অথবা এক পায়ে থাকত প্লাস্টার–ভান করত যেন তার হাতপা ভাঙা। আরেক হাতে থাকত ভারী ব্রিফকেস বা মোটা মোটা বই। টীগেটের খুব কাছে গিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বইগুলো সশব্দে ফেলে দিত বা এমন ভাব করত যে ব্রিফকেসটা বহন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে–জরুরি সাহায্য দরকার। টার্গেট সাহায্য করতে আসলে “শুধু কথা দিয়েই চিড়ে ভিজিয়ে ফেলত” সুদর্শন বান্ডি। অনুরোধ করত ব্রিফকেস বা বইগুলো গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার। গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছানো মাত্রই নরক নেমে আসত টার্গেটের মাথায়। বেশ কিছুদিন পর অসহায় মেয়েটার বিকৃত ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া জামাকাপড় ছাড়া লাশ পাওয়া যেত কোনো এক নির্জন, পরিত্যক্ত জায়গায় পাহাড়-পর্বতে বা বনে-জঙ্গলে। অনেক সময় লাশের চিহ্নটুকুও পাওয়া যেত না। 

লাশ পচেগলে ফুলতে শুরু করার আগ পর্যন্ত বান্ডি মৃতদেহের সাথে সেক্স করত। হয়তো এক জায়গায় খুন করে ২০০ মাইল দূরের কোনো এলাকায় এসে আরেকটা খুন করত। তারপর আবার প্রথম ক্রাইম স্পটে এসে লাশের ওপর ঝাল মিটাত– নির্ভেজাল মানুষরূপী শয়তান।

সিয়াটল, সল্টলেইক সিটি, কলেরাডো, ফ্লোরিডার মেয়েরা আতঙ্কে ভুগছিল। অজানা এক সাইকো ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরে, না জানি কখন কার পালা আসে। এক হোস্টেল থেকে আরেক হোস্টেলে যাবার সময়, থিয়েটার বা সিনেমা হল থেকে ফেরার পথে, এমনকি করিডোর দিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে যাবার সময়ও মেয়েরা গায়েব হয়ে যেত, চিরুনি অভিযান চালিয়েও ধরা যেত না ঘাতককে। একের পর এক মেয়ে রহস্যময়ভাবে গায়েব হয়ে যাচ্ছে অথচ রহস্যের কোনো কিনারা হচ্ছে না, ঘাতক ধরা পড়ছে না। কিং কাউন্টির শেরিফ অফিসের ডিটেক্টিভ আর সিয়াটল পুলিস ডিপার্টমেন্ট কুত্তা পাগল হয়ে গিয়েছিল অপরাধী ধরার জন্য। কিন্তু বান্ডির শিকারের সংখ্যা কুড়ি পার হবার আগ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি, 

তারা সবাই আসলে পৃথক পৃথকভাবে একজন লোকের পেছনে ছুটছে। এর কারণ ছিল অবশ্য। টেড বান্ডির মস্তিষ্ক ছিল ক্ষুরধার, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারত। ক্রাইম মেথোডোলজি নিয়ে গভীর পড়াশোনা তাকে শিখিয়েছিল কীভাবে কারও সন্দেহের উদ্রেক না করে ক্রাইম স্পটে আঙুলের ছাপ বা এই জাতীয় কোনো ক্ল না ফেলে নিমিষেই হাপিশ হওয়া যায়। ওস্তাদ ছিল ছদ্মবেশ ধারণে–চুলে দু-আঙুল চালিয়ে বা মুখের এক্সপ্রেশান বদলে ফেলে খুব তাড়াতাড়িই নিজের চেহারা বদলে ফেলতে পারত। কোনো প্রত্যক্ষদর্শীই সঠিকভাবে পুলিশকে ওর চেহারার বিবরণ দিতে পারত না। ইচ্ছে করেই বন্দুক ব্যবহার করত না, নিজের পরিচয় লুকোনোর জন্য। তার বদলে ব্যবহার করত বাড়ির টুকিটাকি জিনিস–নাইলনের দড়িদড়া, স্টকিং… এত বিশাল পরিধির এলাকায় অল্প সময়ের ব্যবধানে সে খুন আর রেইপগুলো করত যে, পুলিশের পক্ষে বোঝা সম্ভব হতো না এ সবগুলো নারকীয় ঘটনার পেছনে একটা লোকই দায়ী। বান্ডির নিজের ভাষায়, “(I am) the most cold-hearted son of a b***h you’ll ever meet…” বান্ডি মোট কতটা খুন করেছিল নিদিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না–৩০ টি খুনের ঘটনা সে নিজে স্বীকার করেছে। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে বান্ডির ভিক্টিমের সংখ্যা প্রায় এক শ’র কাছাকাছিও হতে পারে। বান্ডির ব্যক্তিগত আইনজীবীর ভাষ্যমতে বান্ডি নিজে তার কাছে স্বীকার করেছিল, সে এক শ’র বেশি খুন করেছে। 

শ্রীঘর দর্শন

কয়েকটা স্টেইটের মেয়েরা একের পর এক রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না কাউকে। কিছুদিন পর পাওয়া যাচ্ছে পচেগলে যাওয়া বিকৃত লাশ। ঘাতককে ধরার জন্য এফবিআই চারিদিকে জাল বিছিয়েছে, কিন্তু ঘাতক প্রতিবারেই সুচতুরভাবে জাল ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। 

অগাস্ট, ১৯৭৫। অ্যামেরিকার সল্টলেইক সিটি থেকে কিছুটা দূরের ইউটাহ হাইওয়ে। ট্রাফিক সিগন্যাল মিস করায় বাদামি রঙের একটী ভৌক্সওয়াগান থামানো হলো। অফিসাররা অবাক হয়ে দেখলেন ভৌক্সওয়্যাগীনের সামনের ড্রাইভারের পাশের সিটটা নেই। সন্দেহ হওয়াতে সার্চ করা হলো গাড়ির ভেতরে। পাওয়া গেল নাইলনের দড়ি, সিঁধকাঠি, হ্যান্ডকাফ, মুখোশ, দস্তানা, ক্রু-ড্রাইভার এবং আরও টুকিটাকি জিনিসপত্র। “এই ব্যাটা সিঁধেল চোর না হয়েই যায় না”, ভাবলেন প্যাট্রল অফিসাররা। একান-ওকান বিস্তৃত মনভুলানো হাসি দিয়ে গাড়ির মালিক অফিসারদের ভুজুং ভাজুং বোঝানোর চেষ্টা করল–বেরসিক অফিসাররা হাতকড়া পড়িয়ে সে হাসির বিনিময় দিলেন। অফিসাররা তখনো জানতেন না এইমাত্র তারা যাকে গ্রেফতার করলেন সে অ্যামেরিকার টপ টেন মোস্ট ওয়ান্টেড লোকদের একজন। থিওডর রবার্ট বান্ডি ওরফে টেড বান্ডি, নারীদের পশুর মতো ভোগ করে গলা টিপে হত্যা করা, তারপর পিশাচের মতো সে মৃতদেহকে ভোগ করা যার নেশা। 

পালাবি কোথায়?

 ১৯৭৭ এর জুনে বান্ডিকে গারফিল্ড কাউন্টি জেল থেকে শুনানির জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পিটকিন কাউন্টি কোর্টহাউসে। বান্ডিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়। খুলে দেয়া হয় হ্যান্ডকাফ। শুনানির বিরতির একপর্যায়ে নিজের কেইস নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য বান্ডি লাইব্রেরিতে যাওয়ায় আবেদন করে। লাইব্রেরিতে গিয়ে একটা বুক সেলফের পেছনের জানালা দিয়ে দোতলা থেকে লাফ দেয় মাটিতে। গোড়ালি মচকে গেলেও কোর্টের সীমানার বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয় সে।

পুলিশের দেয়া রোডব্লক এড়াতে অ্যাস্পেন পর্বতমালার মধ্য দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলে পার্বত্য এলাকায়। ছয় দিন পর ক্ষুৎপিপাসায় ক্লান্ত বান্ডি আত্মসমর্পণ করে পুলিশের কাছে। জেলে ফিরেই আবারও পালাবার ফন্দি আঁটতে শুরু করে বান্ডি । প্রায় ৫০০ ডলারের বিনিময়ে জোগাড় করে ফেলে একটা হ্যাক’স ব্লেইড। সন্ধ্যায় অন্য বন্দীরা গোসল করার সময় নিজের সেলের সিলিং ফুটো করতে থাকে। ছয় মাসের অবিরাম চেষ্টীয় এবং ১৬ কেজি ওজন কমিয়ে প্রায় একফুট বর্গাকার গর্ত দিয়ে সিলিঙের ওপরে উঠতে সক্ষম হয় বান্ডি। বেশ কয়েকবার রিহার্সেল দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় জেল থেকে পালানোর জন্য। ১৯৭৭ এর ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ রাত। জেলের বেশির ভাগ কর্মীই বড়দিনের ছুটিতে। এ সুযোগ কাজে লাগায় বান্ডি। সিলিংয়ের গর্ত দিয়ে বের হয়ে নিমিষেই হাওয়া হয়ে যায় জেল থেকে। ১৭ ঘণ্টা পর ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে যখন জেল কর্মকর্তারা বান্ডির সেলের সিলিংয়ের গর্তটা আবিষ্কার করেন, ততক্ষণে বান্ডি পগারপার। 

মৃত্যুর চৌকাঠে

জেল থেকে পালিয়ে বান্ডি হাজির হয় ফ্লোরিডাতে। এফবিআই আর ফ্লোরিডার পুলিশদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চালাতে থাকে একের পর এক ধর্ষণ আর নারকীয় হত্যাকাণ্ড। 

অবশেষে ফেব্রুয়ারীর ১২ তারিখ রাত ১ টার সময় অ্যালাবামা স্টেইটের কাছে টেড বান্ডিকে অ্যারেস্ট করেন পুলিশ অফিসার ডেভিড লি। মি. লি বান্ডিকে সোজা নিয়ে যান জেলে। পথে বান্ডি আপন মনেই বলছিল, “তুমি আমাকে মেরে ফেললেই ভালো করতে, অফিসার।” টেড বান্ডিকে তার অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮৯ সালের ২৪ শে জানুয়ারি স্থানীয় সময় সকাল ৭:১৬ মিনিটে ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে কার্যকর করা হয় টেড় বান্ডির মৃত্যুদণ্ড। এ সময় জেলের বাইরে জড়ো হয়েছিল প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ। বেশির ভাগই ছিল তরুণী এবং যুবতী। নেচে, গেয়ে, আতশবাজি ফুটিয়ে ওরা উল্লাস করছিল, ক্ষণে ক্ষণে স্লোগান দিচ্ছিল–”বান বান্ডি বার্ন”, “টেড, ইউ আর ডেড!” বান্ডির মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয় এবং তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়। ওয়াশিংটনের অজ্ঞাত স্থানে।১৬৭। কী ছিল বান্ডির এই অন্ধকার জগতের চালিকা শক্তি? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ডিগ্রিও টেড বান্ডিকে মানুষ বানাতে পারেনি? কীভাবে একটা মানুষ এতটা বিকৃত হয়ে ওঠে? জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুক্ষণ… 

.

দুই.

উত্তর প্রদেশ।

ইন্ডিয়া।

 নিরিবিলি এক আখখেতের মধ্যে বসে আছে স্কুলপড়ুয়া একটি মেয়ে।

ওকে ঘিরে আছে কামোন্মত্ত এক দঙ্গল পুরুষ। মেয়েটি অসম্ভব রকমের কাঁপছে, ফাঁদে পড়া হরিণীর মতো বিস্ফারিত চোখে বার বার চারপাশে তাকাচ্ছে। মনে ক্ষীণ আশা, কেউ বুঝি তাকে উদ্ধার করবে এই পশুদের হাত থেকে, হয়তো-বা শেষ পর্যন্ত কারও দয়া হবে। কিন্তু না, শেষ রক্ষা হলো না। বুনো শুয়োরের মতো হেসে উঠল একজন। মানুষরূপী একটা পশু ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। অসহায় একটা মেয়ের ওপর পালাক্রমে অত্যাচারের এ জঘন্য অপরাধ কেউ ভিডিও করে অনলাইনে আপলোড করবে আর হাজার হাজার অথবা লক্ষ লক্ষ মানুষ সেটা দেখে চোখের এবং হাতের সুখ মেটাবে–বিশ্বাস করতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। মানুষের পক্ষে কি এতটা নীচে নামী সম্ভব? যুগ যুগ ধরে মানবতার জয়গান গেয়ে লেখা সবগুলো কবিতাই কি মিথ্যে? কিন্তু বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে ইন্ডিয়ার উত্তর প্রদেশে প্রতিনিয়ত এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুসারে ভারতের উত্তর প্রদেশের দোকানগুলোতে পুলিশ এবং প্রশাসনের নাকের ডগায় অসহায় মেয়েদের ধর্ষণের ভিডিও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত, আসলে শত শত না হাজার হাজার, রেইপ ভিডিও বিক্রি করা হচ্ছে যেগুলোর দাম ৫০ থেকে ১৫০ রুপি। 

পঞ্চাশ থেকে দেড় শ, ব্যস এটুকুই দাম একটা মেয়ের সম্মানের! এক দোকানে কেবল গোঁফ উঠতে শুরু করেছে এমন এক ছোকরাকে এক লোক বলছে, “জানিস, আমি বোধহয় এই নতুন গরম ভিডিওর মেয়েটাকে চিনি।” ভিডিওটাতে সদ্য বিশের কোঠা পার হওয়া একটা মেয়ের ওপর দুটো পশুকে অত্যাচার করতে দেখা যাচ্ছে। অসহায় মেয়েটির কণ্ঠে আকুতি ঝরে পড়ছে, “মাফ কারো, মাফ কারো। কমসে কম ভিডিও তো মাত উঠারো”। সিনিয়র এক পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্যমতে রেইপের দৃশ্য ভিডিও করে রাখা হয় ভিক্টিমকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য। পুলিশের বিভিন্ন উৎস থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে প্রশাসন কোনোমতেই এই জঘন্য ঘটনাগুলো বন্ধ করতে পারবে না।

ধর্ষণের সংস্কৃতি ইন্ডিয়াতে মহামারির আকার ধারণ করেছে। প্রতি ২০ মিনিটে একটা করে ধর্ষণ হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ সংঘটিত হওয়া দেশগুলোর লিস্টে ইন্ডিয়ার নাম আছে প্রথম দশের মধ্যে।১৭° পাশাপাশি ইন্ডিয়াতে প্রচুর শিশু পতিতাবৃত্তি এবং শিশু যৌন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বিশ্বের অনেক দেশের গণমাধ্যমেই এ ব্যাপারে অনেক রিপোর্ট হয়েছে। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শিশু যৌন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এমন পাঁচটি দেশের শর্টলিস্টেও আছে ইন্ডিয়ার নাম।

.

তিন.

অগাস্ট, ২০১৩। ইউএসএ। স্বপ্ন, স্বাধীনতা আর স্বাধিকারের ভূমি।

সদ্য ১৯-এ পা দেয়া সারা (ছদ্মনাম) আজ খুব খুশি। ওর এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত সুযোগে মিলেছে পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। এসেছে সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় রাতে সব ক্লাসমেইটরা মিলে পার্টি করছিল। সারাও ছিল সেখানে। ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে। বেশ আগেই। এক পুরুষ ক্লাসমেইটের সাথে দেখা হয়ে গেল। ছেলেটাকে আগে কখনো না দেখলেও মাঝে মাঝে অনলাইনে কথা হয়েছে। কিছুক্ষণ গল্পগুজবের পর ছেলেটা প্রস্তাব দিলো, “চলো, কিছু ড্রিংক করা যাক”। মাথা নেড়ে সায় জানালো সারা, “ভালো বলেছ, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে”। ছেলেটী গ্লাসে ড্রিংক ঢেলে দিলো। সীরা চুমুক দিলো গ্রীসে। তারপর আর কিছুই মনে নেই… 

নয় ঘণ্টা পর যখন জ্ঞান ফিরল সারা নিজেকে আবিষ্কার করল অপরিচিত এক বিছানায়। মাথাটা ঝিম ঝিম করছিল, গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। চুলগুলো এলোমেলো। বিছানার পাশে চেয়ারে বসে আছে একটা ছেলে। এই ছেলেটাই গত রাতে ওর গ্লাসে মদ ঢেলে দিয়েছিল, মনে পড়ল সারার। স্থানীয় হাসপাতালের মেডিক্যাল চেকআপের রিপোর্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া গেল, সারাকে ধর্ষণ করা 

ইউরোপ-অ্যামেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ রকম ঘটনা খুবই কমন। ধর্ষণ ইউরোপ-অ্যামেরিকার শিক্ষার্থীদের কাছে অতি সাধারণ ঘটনা। বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেয়া অনেক মানুষ তৈরি করছে সত্য, কিন্তু সেই সাথে তৈরি করছে অনেক ধৰ্ষক আর তার চেয়েও বেশি ধর্ষিতা। পাশ্চাত্যের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসগুলোই নারীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ ক্যাম্পাস। কথাগুলো অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে তবে আশা করি কিছু পরিসংখ্যান অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে সাহায্য করবে: ২০০৭ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, অ্যামেরিকার কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছয় লাখ তিয়াত্তর হাজার জন, জীবনে অন্তত এক বার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ প্রতি ২১ ঘণ্টায় অ্যামেরিকার কোনো না কোনো কলেজ-ক্যাম্পাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। প্রতি ১২ জন কলেজেগামী পুরুষ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ জন ধর্ষণের সাথে জড়িত। ইংল্যান্ডের প্রতি তিন জন মহিলা 

লেভেলের অর্ধেক মহিলা শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এমন কাউকে চেনেন যারা নিজেদের ক্যাম্পাসেই নিজেদের বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার 

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে, অ্যামেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বীকার করে যে, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে অ্যামেরিকান কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে প্রতি ৫ জন নারী শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ জন ধর্ষিত হয়েছে। Association of American Universities এর ২০১৫ তে প্রকাশিত একটি নতুন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই প্রতি চার জনে এক জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ২৭ টি শীর্ষ ইউনিভার্সিটির প্রায় দেড়লাখ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে। এ প্রতিবেদনে অ্যামেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী-নির্যাতনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ২০১৪ সালের আগের প্রতিবেদনের (যে প্রতিবেদন দেখে ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ওবামা প্রশাসন White House Task Force To Protect Students From Sexual Assault stay করেছিল) থেকে অনেক ভয়াবহ। 

অবশ্য White house task force এর প্রথম রিপোর্টে বলা হয়েছিল প্রতি চার জন নারী শিক্ষার্থীর মধ্যে তিন জন ক্যাম্পাসে থাকাকালীন যৌন-নির্যাতনের শিকার হন। 

সারী তার ধর্ষকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ করেনি। কে তাকে ধর্ষণ করেছিল তা কখনো জনসম্মুখে প্রকাশও করেনি। এভাবে ধর্ষণের ঘটনা চেপে যাওয়া অ্যামেরিকাতে অস্বাভাবিক কিছু না। American Civil Liberties Union এর রিপোর্ট অনুযায়ী ক্যাম্পাসে ঘটা ৯৫ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনার পর কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয় না। আর ধর্ষণের অভিযোগ করা হলেও, আইনি এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষকের গায়ে ফুলের টোকাটা পর্যন্ত পড়ে না। 

.

চার. 

 “অ্যামেরিকান আর্মির মহিলা সদস্যরা শত্রুদের নিয়ে যতটা শঙ্কিত থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি শঙ্কিত থাকে তাদের পুরুষ সহকর্মীদের হাতে যৌন-নিপীড়িত হবার ব্যাপারে…” গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বলছিল ডোরা হারনান্দেজ, প্রায় দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে কাজ করেছে অ্যামেরিকান নেভি এবং আর্মি ন্যাশনাল গার্ডে। ডোরা হারনান্দেজসহ আরও কয়েকজন ইরাক-আফগানিস্তান ফেরত নারী সেনার সাথে কথা হচ্ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ আর বেপরোয়া যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এই ফ্রন্টগুলোতে কোনোমতে নিজেদের রক্ষা করতে পারলেও, পুরো কর্মজীবন জুড়ে তাদের নীরবে আরও একটি যুদ্ধে লড়তে হয়েছে–আর সে যুদ্ধে বার বার তারা পরাজিত হয়েছে। তাদের সেই নীরব যুদ্ধ ধর্ষণের বিরুদ্ধে। পেন্টাগনের নিজেস্ব রিসার্চ থেকেই বের হয়ে এসেছে যে, অ্যামেরিকান সামরিক বাহিনীর প্রতি চার জন। মহিলা সদস্যের এক জন, তাদের ক্যারিয়ারজুড়ে যৌন-নির্যাতনের শিকার হয়। ডোরা হারনান্দেজ থেমে যাবার পর মুখ খুলল সাবিনা র্যাংগেল। টেক্সাসের এল প্যাসোর অদূরে সাবিনার বাসার ড্রয়িংরুমে বসেই কথা হচ্ছিল, “আমি যখন আর্মির বুট ক্যাম্পে ছিলাম তখন যৌন-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। তারপর যখন নেভিতে গেলাম তখন একেবারে ধর্ষণের শিকার হলাম”। ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউএস নেভিতে কাজ করা জেইমি লিভিংস্টোন বলল, “আমি জানতাম ইউএস আর্মির কালচারটাই এমন যে, সৈনিক এবং অফিসাররা রেইপ করাকে তাদের অধিকার মনে করে। তাই আমি রেইপের ঘটনাগুলো চেপে যেতাম। আর আমার বস-ই আমাকে রেইপ করত, কাজেই আমি কার কাছে অভিযোগ করব?” একে একে এই নারীরা অ্যামেরিকান আর্মিতে তাদের সাথে যৌন-নির্যাতনের ঘটনাগুলো বলছিল। তারা কেউই পরিচিত না, কিন্তু অ্যামেরিকান আর্মিতে নিজেদের সহকর্মী এবং বসদের হাতে যৌন-নিপীড়িত হবার দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাদের একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে। হৃদয়ের সব কটা জানালা খুলে দিয়ে তারা একে অপরের দুঃখগুলো ভাগাভাগি করে নিচ্ছিল। পেন্টাগনের পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত অ্যামেরিকার সেনাবাহিনীর ভেতরে ঘটা যৌন-নির্যাতনের মাত্র ১৪ শতাংশ ঘটনা রিপোর্ট করা হয়। বাকি ৮৬ শতাংশ ঘটনা থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। পেন্টাগনের ২০১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউএস আর্মিতে প্রতিবছর উনিশ হাজারের মতো। ২০১৬ সালে সংখ্যাটা ৭০,০০০! অ্যামেরিকার বেসামরিক মহিলাদের তুলনায় ইউএস আর্মির মহিলা সদস্যরা অধিকমাত্রায় যৌন-নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে।

এমনকি অ্যামেরিকান আর্মির পুরুষ সদস্যরাও সহকর্মীদের দ্বারা যৌন-নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর পরিমাণ নারীদের তুলনায় বেশি। কিন্তু খুব কমসংখ্যক ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলো রিপোর্ট করা হয়। (91001013 Sexual Assault Prevention and Response Office 43 asta গ্যারি প্যাটন বলেন, “আমাদের অবশ্যই ধর্ষণের এ কালচারের পরিবর্তন করতে ইউনিটের সবাইকে যৌন-নির্যাতনের ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।”

শুধু তা-ই না, বিশ্ব উদ্ধার আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত অ্যামেরিকার আর্মির সদস্যদের হাতে নিরাপদ না তাদেরই সহকর্মী আর অধস্তনদের সন্তানেরা। ২০১৪ সালে অ্যামেরিকান আর্মিতে ৭৬৭৬ টি শিশু (তাদেরই সহকর্মীদের সন্তান) নির্যাতনের অফিসিয়াল রিপোর্ট করা হয়েছে। ধারণী করা হয়, রিপোর্ট করা হয়নি এমন কেইসের সংখ্যা আরও বেশি। 

.

পাঁচ.

 বাংলাদেশে দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ধর্ষণ নামের নির্মমতা। শুধু নারীই নয়, শিশু-কিশোরও শিকার হচ্ছে এ বর্বরতার। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণেই শেষ নয়, খুনও করা হচ্ছে নৃশংসভাবে। গত কয়েক মাস ধরে যেন ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের উৎসব চলছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানও দিচ্ছে অভিন্ন তথ্য। একাধিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী গত ছয় বছরে গড়ে প্রতি বছর যতটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, 

২০১৭ সালের ৬ মাসেই ঘটেছে তার চেয়ে বেশি। সে হিসেবে এ ভয়াবহ অপরাধ এখন দ্বিগুণহারে বাড়ছে। 

২০১৭ এর নভেম্বরের ৩০ তারিখ রাজধানীর বাড্ডায় মাত্র ৩ বছর ৯ মাস বয়সী শিশু তানহাকে ধর্ষণের পর খুন করেছে শিপন নামে এক পাষণ্ড। একই বছরের ১৭ই জুলাই বগুড়ায় এক ছাত্রীকে কলেজে ভর্তির নামে ধর্ষণ করে তুফান সরকার। বিচার চাওয়া হলে ন্যক্কারজনকভাবে মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। 

রাজশাহীতে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে চলন্ত ট্রাকে এক কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে গাড়ি চালক ও হেলপার। সেপটেম্বরে কেরানীগঞ্জে ৭ বছরের ফারজানাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে। নবম শ্রেণিতে পড়া আত্মীয়। এভাবে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না-কোথাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী। রেহাই পাচ্ছে না ১৮ বছরের কমবয়সী “কন্যাশিশু”ও। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তিন চার বছরের দুধের শিশুও শিকার হচ্ছে এই বিকৃত যৌনতার। ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে খুনও করা হচ্ছে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে এসব ঘটনার সিংহভাগই প্রকাশ করছে। 

ভিকটিম। সামাজিক অসম্মানের ভয়ে তা লুকিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার। দীর্ঘসূত্রতা আর প্রভাবশালীদের হেনস্তার ভয়ে করছে না মামলী। বরং জানাজানি। হওয়ার ভয়ে ভিকটিম ও তাদের পরিবার এমনভাবে চেপে যাচ্ছে, যেন কিছুই ঘটেনি। তারপরও ছিটেফোঁটা যে ক’টি ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে তাই- আঁতকে ওঠার মতো। এতেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব বলছে গত ছয় বছরের তুলনায় চলতি বছর দ্বিগুণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ চিত্র যেমন রাজধানী শহর ঢাকায়, তেমনই সারা দেশের। এর মধ্যে কিছু কিছু ধর্ষণের নির্মমতা হতবাক করে দিচ্ছে সবাইকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উইম্যান সাপোর্ট ও ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, নারী ও শিশু ধর্ষণসহ তীদের ওপর নির্মমতার স্পর্শকাতর মামলাগুলো তদন্তের দায়িত্ব তাদের কাছে আসে। অতীতের চেয়ে এখন সে ধরনের মামলা বেশি আসছে। নারী এবং শিশু ধর্ষণও বেড়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) হিসাবে দেখা গেছে। ২০১২ সাল থেকে নারী ধর্ষণের হার ক্রমেই (২০১৪ ছাড়া) বাড়ছে। ২০১২ সালে ৮০ নারী ধর্ষণ, ৩০ জন ধর্ষণের পর খুন ও ২৬ নারী গণধর্ষণের শিকার হন। ২০১৩ সালে ১০৭ নারী ধর্ষণ, ১৬ নারী ধর্ষণের পর খুন এবং ৩৫ নারী গণধর্ষণের কবলে পড়েন। ২০১৪ সালে ১৫৩ নারী ধর্ষিতা, ৪৮ জন খুন ও ৮৬ জন গণধর্ষণের শিকার। হন। ২০১৫ সালে ১৩৪ ধর্ষণ, ৪৮ জন ধর্ষণের পর হত্যা ও ১০৩ জন নারী গণধর্ষণের কবলে পড়েন। ২০১৬ সালে ১৪১ নারী ধর্ষিতা এবং ৩৩ জন ধর্ষণ শেষে খুন ও ৭৭ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। চলতি বছর গত জুন পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসে এরই মধ্যে ১৪১ জন নারী ধর্ষণ ও ৪৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর প্রাণ দিতে হয়েছে ১৪ হতভাগীকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং হত্যার সংখ্যাও কম নয়। ২০১৪ সালে ১১৫, ২০১৫ সালে ১৪১, ২০১৬ সালে ১৫৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৭ এর প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৪ শিশু। গত বছর মোট ২৯৯ নারী ও শিশু (এককভাবে) ধর্ষণের শিকার হলেও এ বছর ৬ মাসেই এ সংখ্যা ২৮৫ তে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়। সংস্থাটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি রীতিমতো ভয়াবহতার আভাস দিচ্ছে। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ এর জুলাইয়ে ৮০ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৩২ জনই শিশু। আর ৩ শিশুই ধর্ষণের পর খুনের শিকার হয়েছে।  কেন আজ বিশ্বজুড়ে চলছে ধর্ষণের মহা উৎসব? কেন নারী স্বাধীনতা আর ব্যক্তিস্বাধীনতার ঢ্যারা পেটানো আমাদের এই “মহান সভ্যতায় প্রতিনিয়ত নারীদের নির্যাতিত হতে হচ্ছে? কেন বিশ্বকে নারী-অধিকার ও নারী-স্বাধীনতার সবক দেয়া পশ্চিমা বিশ্বে নারীর নিরাপত্তা এতটা বিপন্ন? কেন “মুক্তমনা” “মুক্ত মানুষ গড়ার কারখানা আর মুক্ত চিন্তার সূতিকাগার পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবিশ্বাস্য হারে ধর্ষিত হচ্ছে নারী? কেন প্রতি ৯৮ সেকেন্ডে একজন অ্যামেরিকানকে যৌন-নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে? কেন অ্যামেরিকার প্রতি ৬ জন নারীর মধ্যে ১ জন এবং প্রতি ৩৩ জন পুরুষের মধ্যে একজন জীবনে একবার হলেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে? কেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” চালানো অ্যামেরিকান আর্মির যৌন-সন্ত্রাস থেকে খোদ অ্যামেরিকান আর্মির সদস্য আর তাদের সন্তানেরা নিরাপদ না? কেন বাংলাদেশের মতো সংরক্ষণশীল দেশে অজস্র ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে? 

কেন “বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাবার” সাথে সাথে বাড়ছে ধর্ষিতা নারীর লাশের মিছিল? কেন? 

.

ছয় 

ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানিটোবাতে ধর্ষণ-প্রবণতা নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। একদল পুরুষকে দেখানো হয় রেইপ পর্ন এবং আরেক দলকে নন-রেইপ পর্ন। তারপর কোনোরকম হাতের স্পর্শ ছাড়া নিজেদের সর্বোচ্চ মাত্রায় উত্তেজিত করতে 

বাকিদের তুলনায় অধিক বর্বর ও যৌন সহিংসতায় পরিপূর্ণ।  তবে সহিংসতার সাথে সম্পর্ক কেবল রেইপ পনের না। গবেষণায় দেখা গেছে পর্নের সাথে সেটা যেকোনো ধাঁচের পনই হোক না কেনো সরাসরি সম্পর্ক আছে অকথ্য গালাগালি, ড্রাগস, অ্যালকোহল আর যৌন আগ্রাসনের। এসবই উপযুক্ত সময় ও পরিস্থিতিতে একজনকে দিয়ে ধর্ষণ করানোর জন্য যথেষ্ট। তাই যারা হার্ডকোর পর্ন দেখে, তাদের ধর্ষকে পরিণত হবার বিপুল সম্ভাবনা থাকে। ধর্ষণ ও যৌন-সহিংসতার সাথে পর্নোগ্রাফির সম্পর্কের বিষয়টি অনেক পরীক্ষায় উঠে এসেছে। Rape Crisis Center থেকে যৌন-নির্যাতনের শিকার ১০০ জন নারীর তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণের পর দেখা গেছে শতকরা ২৮ জন জানিয়েছিলেন তাদের নিপীড়ক পর্ন দেখছিল। শতকরা ১২ জন জানিয়েছেন তাদের ধর্ষণের সময় ধর্ষক পর্ন ভিডিওর দৃশ্য হুবহু অনুকরণের চেষ্টা করছিল। এমনকি পারিবারিক সহিংসতার ওপরও পর্নোগ্রাফির প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া (979 Gold Coast Centre Against Sexual Violence 1976 অস্ট্রেলিয়াতে নিজ পরিবারের সদস্যের হাতে নির্যাতিত হবার মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে পর্নোগ্রাফি। নারীদের ধর্ষণ, গ্রুপ সেক্সে বাধ্য করা, সেক্সের সময় শ্বাসরোধ করা, মারধর করা– কোনো কিছুই বাদ নেই। এসব সহিংসতা ও আগ্রাসন চালিয়েছে তাদেরই পর্ন আসক্ত স্বামী কিংবা বয়ফ্রেন্ড। নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে ভর্তি করতে হয়েছে।

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রচার ও প্রসার যৌন-সহিংসতা ও ধর্ষণ বৃদ্ধির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার প্রশাসন একবার পর্নোগ্রাফির ব্যাপারে বেশ উদারনীতি গ্রহণ করল। পর্ন ভিডিও বানানো, প্রচার, বিক্রি আইনত নিষিদ্ধ থাকলেও প্রশাসন সে সময় চোখবুজে থাকার নীতি গ্রহণ করে। দেখেও না দেখার ভান করত। ফলাফল? দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়াতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেল ২৮৪%। 

অন্যদিকে একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে প্রশাসন খুব কঠোর অবস্থান নিল। কিছুদিন পর কুইন্সল্যান্ড প্রশাসন দেখল ধর্ষণের ঘটনা আগের তুলনীয় মাত্র ২৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। হাওয়াইতেও একবার পর্নোগ্রাফির ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করা হয়। আবার কিছুদিন পর পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে প্রশাসন থেকে খুব কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হলো। তারপর আবার উদারনীতি। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, যখন পর্নোগ্রাফির ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তখন ধর্ষণের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। যখন প্রশাসন কঠোরতা অবলম্বন করেছিল তখন ধর্ষণের মাত্রা কমে গিয়েছিল। পরবর্তী সময় আবারও উদারনীতি গ্রহণ করার পর ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ পর্নোগ্রাফির সংখ্যা ও সহজলভ্যতার সাথে যৌন-সহিংসতা ও ধর্ষণ-প্রবণতার সমানুপাতিক সম্পর্ক। যখন পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা বেশি তখন যৌন-সহিংসতা আর ধর্ষণের হারও বাড়ে। যখন পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা কমে তখন যৌন-সহিংসতা আর 

ধর্ষণের হার কমে। অনেকে এখানে একটি আপত্তি তুলতে পারে যে, যারা পর্নোগ্রাফি দেখে তাদের সবাই ধর্ষণ বা যৌন-সহিংসতায় লিপ্ত হয় না। কথা সত্য। তবে “কিন্তু” আছে। যারা পর্নোগ্রাফি দেখে তাদের সবাই ধর্ষণ বা যৌন-সহিংসতায় লিপ্ত না হলেও যারা ধর্ষণ ও যৌন-সহিংসতায় লিপ্ত হয় তাদের ৯৯% এরও বেশি পর্নোগ্রাফি দেখে। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি ধর্ষক বানায় কি না সেটা আমাদের মূল পয়েন্ট না। বরং এসব গবেষণী থেকে বার বার যে উপসংহার উঠে এসেছে তা হলো, পর্নোগ্রাফি দর্শকদের মধ্যে ধর্ষণ, যৌন-সহিংসতী এবং বিকৃত যৌনাচারের প্রবণতা সৃষ্টি করে। ঠিক যেভাবে হার্ডকোর পর্নোগ্রাফির প্রসার উদ্বেগজনক হারে অ্যানাল সেক্স এবং ওরাল সেক্সের প্রবণতা বৃদ্ধি করে, একইভাবে ধর্ষণ ও যৌন-সহিংসতার হারও বাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণের জন্য ধর্ষণকে একটি অপরাধ হিসেবে চিন্তা করার বদলে একটি বিকৃত যৌনাচার হিসেবে চিন্তা করলে ব্যাপারটা হয়তো বোঝা সহজ হবে। 

আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো ধর্ষণ ও যৌন-সহিংসতার ঘটনাগুলোর সাথে উপযুক্ত প্রেক্ষাপট, সময় ও সুযোগ ইত্যাদির প্রশ্ন জড়িত থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে 

যৌন-নিপীড়কদের Sexual Predator বলা হয়। এ ধরনের অপরাধীরা সুযোগসন্ধানী শিকারির মতো হয়ে থাকে। পর্নোগ্রাফি যা করে তা হলো, দর্শকের মধ্যে ধর্ষণের প্রবণতা সৃষ্টি করে এবং ধর্ষণের একটি গ্রহণযোগ্যতা তাদের মনে সৃষ্টি করে। উপযুক্ত সুযোগ এবং প্রেক্ষাপটের অভাবে এদের অনেকেই হয়তো ধর্ষণের ফ্যান্টাসিকে বাস্তবায়িত করে না, কিন্তু উপযুক্ত প্রেক্ষাপট তৈরি হলে তারা যে তা করবে না, এমন বলা যায় না। ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করুন। পর্ন-আসক্ত হাজার হাজার যুবককে সমাজ থেকে আলাদা করে, তাদের স্ত্রী কিংবা গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হলে এবং যেখানে জবাবদিহিতা বা শাস্তির ভয় নেই ধর্ষণের এমন উপযুক্ত পরিবেশ দেয়া হলে ফলাফল কী হবে? আমেরিকান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ ধর্ষণ ও শিশুকামের সংস্কৃতি থেকেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। অ্যামেরিকার সামরিক বাহিনীতে চলমান ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে মিলিটারি ক্যাম্পগুলোতে পর্নোগ্রাফি, বিশেষ করে সফটকোর পর্ন ম্যাগাযিন এবং অনলাইন পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা। যৌন-নির্যাতনের হার কমানোর জন্য মিলিটারি ক্যাম্পগুলোতে এইসব ম্যাগাযিন বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ বলেছে, “আমাদের বাহিনীতে বিরাজমান এই যৌন-নির্যাতনের সংস্কৃতি পরিবর্তন করতেই হবে। আর এ জন্যই সামরিক ঘাঁটিগুলোতে পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাযিন কেনাবেচা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।” তবে এই পদক্ষেপ অবস্থার কতটা উন্নতি ঘটাবে তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। কারণ, ক্যাম্পগুলো থেকে খুব সহজেই পর্নসাইটে প্রবেশ করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে অ্যামেরিকার বেসামরিক জনগণের মধ্যে প্রতি দশ জনে এক জন ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। কিন্তু সামরিক বাহিনী সদস্যদের মধ্যে পর্ন-আসক্তির হার আরও অনেক বেশি। অ্যামেরিকান নেভির টেনেন্ট মাইকেল হাওয়ার্ডের মতে সামরিক বাহিনীর কমপক্ষে ২০% সদস্য ইন্টারনেট পনে আসক্ত। মার্কিন সামরিক বাহিনীর যাজকদের মতে–যাদের কাছে সেনা সদস্যরা নিয়মিত তাদের ব্যক্তিগত পাপের স্বীকারোক্তি (Confessional) করে মার্কিন সেনা সদস্যরা যেসব ব্যক্তিগত সমস্যায় আক্রান্ত তার মধ্যে ইন্টারনেট পর্ন-আসক্তি শীর্ষে। মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যদের কম্পিউটারে নিয়মিত শিশুদের নিয়ে বানানো পর্ন ভিডিও এবং ছবি পাওয়া যায়। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে সেনা সদস্য ও অফিসারদের শাস্তিও দেয়া হয়েছে। সমকামী পর্ন ভিডিওতে অংশগ্রহণ এবং তা সমকামী পর্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশের কারণে ২০০৬ অ্যামেরিকান এয়ার ফোর্সের ৭ জন। প্যারাট্রুপারকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। অবশ্য অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীতে সমকামিতা এবং সমকামী পর্নোগ্রাফির ইতিহাস বেশ পুরোনো। পর্নোগ্রাফি ও ধর্ষণের পারস্পরিক সম্পর্কের আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো ইন্ডিয়া। সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি দেখা দেশের লিস্টে ইন্ডিয়ার অবস্থান তিন নম্বরে। পুরুষদের পাশপাশি ইন্ডিয়ান মহিলারাও ব্যাপক হারে পর্ন দেখে। বিশ্বব্যাপী পর্নের মহিলা দর্শক-সংখ্যার দিক থেকেও ইন্ডিয়ার অবস্থান তিন নম্বরে। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটা দেশের লিস্টে ইন্ডিয়ার অবস্থান পঞ্চম। খুব বেশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই, সংখ্যাগুলো নিজেরাই কথা বলে। 

২০১৪ সালের একটি জরিপে দেখা যায় ইন্ডিয়ার গোয়া প্রদেশে ৪০ শতাংশ পুরুষ “রেইপ পর্ন দেখে। এদের মধ্যে ৭৬% স্বীকার করেছে, রেইপ পর্ন তাদের মধ্যে ধর্ষণ করার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছে। ৪৭% বলেছে রেইপ পর্ন দেখতে দেখতে একসময় তারা শিশুদের নিয়ে বানানো পর্নোগ্রাফি দেখা শুরু করেছে। এ জরিপ চালানো হয় দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের ক্ষেত্রে। সুতরাং “উচ্চতর শিক্ষার অভাব বা এ-জাতীয় অজুহাত দেয়ার কোনো সুযোগ এখানে। নেই। ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা, রেইপ পনের জনপ্রিয়তা, বলিউডের আইটেম সং কালচার, বলিউড ও মিডিয়ার মাধ্যমে ক্রমাগত একজন পর্ন অভিনেত্রীকে আইকন হিসেবে জনসম্মুখে উপস্থাপন করা, এ সবকিছুর সম্মিলিত প্রভাব পড়ছে সমাজ ও সমাজের মানুষগুলোর আচরণে। আর এভাবে এসব ফ্যাক্টর ইন্ডিয়ার ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের পেছনে ভূমিকা রাখছে। তুলনীয় বাংলাদেশের অবস্থা যে খুব একটা ভালো, এমনটা বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। আর এর পেছনে অন্যতম প্রভাবিক পর্নোগ্রাফি। বিশেষজ্ঞরা এমনটাই বলছেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকোথেরাপি বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মোহিত কামাল দৈনিক মানবজমিনকে বলেন, সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানের মতো আমাদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণেও ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। নারী-পুরুষের যৌনসঙ্গমের ছবি ও ভিডিও, পর্নোস্টারদের নিখুঁত অভিনয়ে তৈরি ঝকঝকে পর্নোগ্রাফিগুলো হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। তা দেখে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্করা নিজেদের যৌন-প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বেপরোয়াভাবে ভোগবাদী হয়ে উঠছে। ফলে নারীকে ভালোবাসা, বিয়ে ইত্যাদির মাধ্যমে জয় করে স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক স্থাপনের পরিবর্তে অরক্ষিত নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করে বসছে। অনেক কারণের মধ্যে এটি এখন নারী ও শিশু ধর্ষণ বড়ির প্রধান কারণ বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) চেয়ারম্যান সিগমা হুদা বলেন, দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একই সঙ্গে পর্নোগ্রাফি হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে নারী ও শিশুরা যখন-তখন ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও খুনের শিকার হচ্ছে।  এ রকম অসংখ্য গবেষণা দ্বারা ধর্ষণ বৃদ্ধির পেছনে পর্নোগ্রাফি এবং পর্নোগ্রাফির প্রভাবে ঘটা সমাজের যৌনায়নের ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে পর্ন-আসক্তি ধর্ষণের অন্যতম কারণ। “আমি তো শুধু দেখছি, কিছুই করছি না”, “পর্ন দেখলে কোনো ক্ষতি নেই”–এ ধরনের কথা বলার আগে 

তাই একবার এ গবেষণাগুলোর কথা মনে রাখবেন আশা করি। এ ছাড়া ১৮-১৯ বছর বয়েসী কিশোর-কিশোরীদের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, পর্ন-আসক্তি শিশু-কিশোরদের যৌন-সহিংসতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। যেসব যৌন-নিপীড়কদের মধ্যে হার্ডকোর পর্ন-আসক্তির হার খুবই বেশি। শিশু যৌন নিপীড়ক বা পেডোফাইলদের শতকরা ৬৭ জন, জোরপূর্বক অজাচারে লিপ্ত এমন ব্যক্তিদের শতকরা ৫৩ জন এবং ধর্ষকদের শতকরা ৮৯ জন হার্ডকোর পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। সিরিয়াল কিলার এবং ধর্ষকদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি খুবই জনপ্রিয়। Journey Into Darkness নামক বইয়ে সাবেক এফবিআই কর্মকর্তা জন। ডগলাস লিখেছেন, সাধারণত সিরিয়াল কিলার ও ধর্ষকদের আস্তানাগুলোতে প্রচুর। পরিমাণ পর্ন ভিডিও পাওয়া যায়। চার্লসের লাইন্ডেকারের Thrill Killers, a Study of America’s Most Vicious Murders, facelict Te 997624 ধরনের হত্যাকারীদের মধ্যে 81% বলেছে, পর্নোগ্রাফি হলো তাদের যৌন-কামনার প্রাথমিক বস্তু। যৌন-নিপীড়ক ও ধর্ষকদের দমনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও ধর্ষণ ও যৌন-নিপীড়নের সাথে পর্নোগ্রাফির যোগসূত্র একবাক্যে স্বীকার করেন। কারণও আছে। এ ধরনের অপরাধ ও অপরাধীদের সাথে। পর্নোগ্রাফির সম্পর্ক কতটা গভীর তার প্রমাণ তারা হাতেনাতে পেয়েছেন। এ ব্যাপারে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা এবং নিউ ইয়র্ক ডিটেক্টিভ ব্যুরোর ক্রিমিন্যাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড প্রোফাইলিং ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা রেইমন্ড পিয়ার্সের একটি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরছি : প্রশ্ন : আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে আপনি কি বিশ্বাস করেন সাধারণ মানুষের তুলনায় যৌন অপরাধীদের পর্ন দেখার অভ্যাস বেশি? রেইমন্ড পিয়ার্স; আমার অভিজ্ঞতা হলো এ ধরনের অপরাধীদের মারাত্মক হারে পর্ন দেখার অভ্যাস থাকে। সাধারণ মানুষের পনের দেখার অভ্যাসের কথা বলতে পারি না, তবে বিভিন্ন ধরনের পর্নোগ্রাফি তাদের হাতের নাগালেই আছে। 

অনেক বারই এমন হয়েছে যে, গুরুতর কোনো অপরাধের অপরাধীকে খোঁজা হচ্ছে–অপরাধটি যৌনতা-সংক্রান্ত হোক আর যা-ই হোক–ওদের ধরার পর যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, “আচ্ছা, গত চার দিন কোথায় ছিলে? কী করেছ?” তারা জবাব দিচ্ছে, “অপরাধ করেছি, পালানো তো লাগবেই।” যখন প্রশ্ন করা হয়, “কোথায় গিয়েছিলে?” জবাব আসে, “সস্তা মোটেলে রুম নিয়েছিলাম, তারপর পতিতা ভাড়া করেছি” অথবা “২৪ ঘণ্টাই পর্ন দেখায় এমন কোনো মোটেলে রুম নিয়েছিলাম…”। এরা এভাবেই রিল্যাক্স করে। টেনশন মুক্ত হয়। প্রশ্ন : আমাদের একটু ধারণা দিতে পারবেন, আপনার তদন্তে কত শতাংশ যৌন অপরাধীদের কাছে পর্নোগ্রাফি পেয়েছেন? পিয়ার্স : একদম কাঁটায় কাঁটায় বলা সম্ভব না, কিন্তু অনেক সময় জিজ্ঞাসা করাও লাগত না, এমনিই বের হয়ে যেত। আমি আর আমার কলিগরা বলতাম, “এই যে আরেকটা… এরা মনে হয় খালি এগুলোই করে…।” আমি বলব, ৭৫% এর বেশি অপরাধীর কাছে আমরা পর্নোগ্রাফি পেয়েছি। সংখ্যাটা ১০০%ও হতে পারে। প্রশ্ন : আপনি আমাদের কারাবন্দী পেডোফাইল (শিশুকামি, শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নকারী) ও তাদের যৌনতার ওপর আপনার গবেষণীর কথা বলেছিলেন। 

এদের পর্ন-আসক্তির ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? আর এ ধরনের কোনো অপরাধ। করার আগে পনের ব্যবহার সম্পর্কেই-বা কী বলবেন? পিয়ার্স : ধরুন, একজন পুরুষ পেডোফাইল (শিশুকামী), যে ছোট ছেলেদের আক্রমণ করে। এদের ক্ষেত্রে আমি “আক্রমণ” শব্দটা ব্যবহার করি, যদিও তারা মনে করে যে তারা বাচ্চাগুলোকে আক্রমণ করছে না। তাদের বিকৃত মানসিকতা অনুযায়ী তারা ধরে নেয় যে তারা এসব আক্রমণের মাধ্যমে বাচ্চাদের সাহায্য করছে… আমি দেখেছি এদের যৌন অপরাধগুলোর ওপর পর্নোগ্রাফির প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। এদের ব্যাপারে যা জেনেছি, হয়তো এদের চাকরি ছিল, দিনে আট ঘণ্টা বা দশ ঘণ্টার। কিন্তু প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তে এদের মাথার মধ্যে এসব ফ্যান্টাসি চলতে থাকত। যতক্ষণ জেগে আছে, কাজ করছে, মনে মনে ক্রমাগত শিশু ধর্ষণের, তাদের যৌন-নিপীড়ন করার কথা কল্পনা করছে। আর তাদের কাছে যে পর্ন ভিডিও থাকে, সেগুলো এসব ফ্যান্টাসির জ্বালানি হিসাবে কাজ করে। 

.

সাত.

শুরু করেছিলাম বান্ডিকে দিয়ে। শেষটাও ওকে দিয়েই করা যাক… 

ভয়ঙ্কর নরপিশাচ সিরিয়াল কিলার টেড বান্ডির অন্ধকার জগতে পা বাড়ানোর পেছনে চালিকাশক্তিগুলোর একটি ছিল এ পর্নোগ্রাফি। বারো-তেরো বছরের ছোট্ট টেড বান্ডি যেদিন বাসার বাইরে পাড়ার মুদি দোকানে এবং ড্রাগস স্টোরে পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিনের সন্ধান পেয়ে গেল, সেই দিনই ছোট্ট টেডের মধ্যে জন্ম নিল এক ধর্ষক সত্তা। ১৯৮৯ সালের ২৪ জানুয়ারি মৃত্যুর অব্যবহিত আগমুহূর্তে মনোবিদ জেমস সি. ডবসনের কাছে একটি সাক্ষাৎকার দেয় টেড বান্ডি। এই সাক্ষাৎকারে সে বিস্তারিত 

মৃত্যুর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলা টেড বান্ডির কিছু কথা এখানে না উল্লেখ করলেই নয় : “…আমাদের মতো যারা মিডিয়ার হিংস্রতা, বিশেষত পর্নোগ্রাফিক হিংস্রতা দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত, তারা কেউই বাহ্যত দানব নই। আমরা আপনাদেরই পুত্র, আপনাদেরই স্বামী। আর সবার মতোই আমরাও একটী পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে বেড়ে উঠেছিলাম। কিন্তু এখন ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, পর্নোগ্রাফি যে কারও বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ে এক ঝটকায় বাসার বাচ্চাটাকে পারিবারিক কাঠামোর বাইরে বের করে নিয়ে আসে। ঠিক যেমনভাবে বিশ-ত্রিশ বছর আগে এটা আমাকে ছোবল মেরে বাইরে বের করে এনেছিল। আমার বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের এসব থেকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন, যেমনটা অপরাপর কট্টর খ্রিষ্টান পরিবারেও হয়, কিন্তু এসব বাহ্যিক প্রভাবকের ব্যাপারে সমাজ অনেকটাই শিথিল। “ “…আমি কোনো সমাজবিজ্ঞানী নই এবং ভান ধরে এটাও বলব না যে, সভ্য সমাজের চিরাচরিত ধারণায় আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু আমি দীর্ঘদিন যাবৎ কারাগারে বন্দী এবং এই সময়ের মধ্যে আমি এমন অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যারা ভায়োলেন্স ঘটানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ। কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের প্রত্যেকেই পর্নোগ্রাফিতে গভীরভাবে আসক্ত ছিল। নরহত্যা-সংক্রান্ত এফবিআই এর নিজেদের রিপোর্ট বলে, সিরিয়াল কিলারদের সাধারণ আগ্রহের বিষয় হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। সুতরাং এটাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায়ই নেই। আমি আশা করব, আমি যাদের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছি তারা আমার অনুশোচনায় বিশ্বাস না করলেও এখন আমি যে কথাগুলো বলব সেগুলো বিশ্বাস করবেন। আমাদের শহর, আমাদের সম্প্রদায় এমন কিছু প্রভাবকের ব্যাপারে খুবই শিথিল, যেগুলোর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। আজ হোক কাল হোক এগুলো প্রকাশ পাবেই। মিডিয়ায় ভায়োলেন্স বিশেষত যৌন-সহিংসতা এখন হরেক উপায়ে গিলিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার ভয় হয় যখন আমি ক্যাইবল টিভি দেখি। আজকাল সিনেমার মাধ্যমে যেসব ভায়োলেন্স আমাদের ড্রয়িংরুম অবধি পৌঁছে গেছে, ত্রিশ বছর আগে সেগুলো এক্স-রেইটেড অ্যাডাল্ট থিয়েটারেও দেখানো হতো নী।” “…যেটা আমি আগেও বলেছি, (এই) প্রভাবকগুলোর ব্যাপারে আমাদের সমাজের শিথিলতা চোখে পড়ার মতো। বিশেষত এ ধরনের ভায়োলেন্ট পর্নোগ্রাফি। যখন সভ্য সমাজ টেড বান্ডিকে দোষারোপ করতে করতে পর্ন ম্যাগাযিনের পাশ দিয়ে দেখেও না-দেখার ভান করে হেঁটে যাচ্ছে, তখন আসলে একদল তরুণ তাদের অগোচরেই টেড বান্ডিতে পরিণত হচ্ছে। আক্ষেপের জায়গাটা ঠিক এখানেই।” সাইকোপ্যাথিক সিরিয়াল কিলারদের তিনটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা বলতে পারা, কোনো ধরনের অনুশোচনা অনুভব না করা  এবং কোনো অবস্থায় নিজের দোষ স্বীকার না করা, কোনো না-কোনোভাবে অন্য কাউকে বা অন্য কিছুকে দায়ী করা। বান্ডির শেষ কথাগুলোকে একজন ঠান্ডা মাথার সিরিয়াল কিলারের অনুশোচনাহীন অজুহাত বলে উড়িয়ে দেয়া যায়। তবে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারির এ ইন্টারভিউয়ের পর গত প্রায় তিন দশক পর সারা বিশ্বজুড়ে যে বাস্তবতা আমরা দেখছি– যার অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ আমাদের এ লেখায় উঠে এসেছে– তীর আলোকে বলতেই হয়, বান্ডি ঠিকই বলেছিল। 

অঙ্গার

অঙ্গার

অঙ্গার
প্রবোধকুমার সান্যাল

বছর আষ্টেক হলো দিল্লীতে আমি চাকরি করছি। কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক কম। কোনো কোনো বছরে কলকাতায় এক-আধবার আসি, ঘুরে বেড়িয়ে সিনেমা দেখে আবার ফিরে চলে যাই। নইলে, ইদানীং আর আসা হয়ে ওঠে না।

বছর তিনেক আগে ফরিদপুর থেকে শোভনা আমাকে চিঠি লিখেছিল–ছোড়দাদা, তুমি নিশ্চয় শুনেছ আজ ছ’মাস হতে চললো আমার কপাল ভেঙেছে। ছেলেটাকে নিয়ে কিছুদিন শ্বশুরবাড়ীতে ছিলুম, কিন্তু সেখানেও আর থাকা চললো না। তোমার ভগ্নিপতি এক আধশো টাকা যা রেখে গিয়েছিলেন, তাও খরচ হয়ে গেল আর দিন চলে না। তুমি আমার মামাতো ভাই হলেও তোমাকে চিরদিন সহোদর দাদার মতন দেখে এসেছি। ছেলেটাকে যেমন ক’রে হোক মানুষ ক’রে তুলতে না পারলে আমার আর দাঁড়াবার ঠাঁই কোথাও থাকবে না। এদিকে যুদ্ধের জন্য সব জিনিসের দাম ভীষণ বেড়ে গেছে। নুটু পাস করে চাকরি খুঁজছে, এখনো কোথাও কিছু সুবিধে। হয় নি মা ভেবে আকুল। ইস্কুলের মাইনে দিতে না পারায় হারুর পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবার কোম্পানীর কাগজ ভেঙে সব খাওয়া হয়ে গেছে। তুমি যদি এ অবস্থায় দয়া করে মাসে মাসে দশটি টাকা দাও, তাহলে অনেকটা সাহায্য হতে পারে। ইতি—

দিল্লীতে আমার এই চাকরির খোঁজ প্রথম পিসেমশাই আমাকে দেন, সুতরাং শোভনার চিঠি পেয়ে স্বর্গত পিসেমশায়ের প্রতি আমার সেই আন্তরিক কৃতজ্ঞতাটা হৃদয়াবেগের সঙ্গে ঘুলিয়ে উঠলো। সেই দিনই আমি পঁচিশটি টাকা পাঠিয়ে দিলুম এবং শোভনাকে জানালুম, তোর ছেলে যতদিন না উপার্জনক্ষম হয়, ততদিন প্রতি মাসে আমি তোর নামে পনেরো টাকা পাঠাবো।

সেই থেকে শোভনা, পিসিমা, নুটু, হারু,—সকলের সঙ্গেই আমার চিঠিপত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। পুজোর সময় এবং নতুন বছরের আরম্ভেও আমি কিছু কিছু টাকা তাদের দিতুম। তিন বছর এইভাবেই চলে এসেছে।

ইতিমধ্যে যুদ্ধের গতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দেশের কি-প্রকার অবস্থা দাঁড়িয়েছে, অথবা শোভনারা কি ভাবে তাদের সংসার চালাচ্ছে, এর পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজখবর আমি নিইনি, দরকারও হয়নি। মাঝখানে বোমার ভয়ে যখন কলকাতা থেকে বহু লোক মফঃস্বলের দিকে এখানে ওখানে পালিয়েছিল, সেই সময় শোভনার চিঠিতে কেবল জানতে পেরেছিলুম, ফরিদপুরে জিনিসপত্রের দর খুব বেড়ে গেছে। অনেক লোক এসেছে ইত্যাদি। কিন্তু টাকা আমি নিয়মিত পাঠাই, নিয়মিতই প্রাপ্তি স্বীকার এবং চিঠিপত্রও আসে। যা হোক এ রকম ক’রে শোভনাদের দিন কাটছে।

কিন্তু প্রায় ছ’মাস আগে মাসিক পনেরো টাকা পাঠাবার পর দিনকয়েক বাদে টাকাটা দিল্লীতে ফেরৎ এলো। জানতে পারলুম ফরিদপুরের ঠিকানায় পিসিমারা কেউ নেই। কোথায় তারা গেছে, কোথায় আছে, কিছুই জানা যায়নি। চিঠি দিলুম, তার উত্তর পাওয়া গেল না। আর কিছুকাল পরে আবার মনি-অর্ডারে টাকা পাঠালুম, কিন্তু, সে টাকাও যথাসময়ে ফেরৎ এলো। ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে চুপ ক’রে গিয়েছিলুম। ভাবলুম, টাকার দরকার হলে তারা নিজেরাই লিখবে, আমার ঠিকানা ত’ আর তাদের অজানা নয়।

কিন্তু আজ প্রায় তিন বছর পরে হঠাৎ কলকাতায় যাবার সুযোগ হলো এই মাত্র সেদিন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সাহেব যাচ্ছেন কলকাতায় তদ্বির-তদন্তের কাজে আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে। ভাবলুম, এই একটা সুযোগ। সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে কোনো একটা শনিবারে যাবো। ফরিদপুরে, সোমবারটা নেবো ছুটি—দিন দুয়েকের মধ্যে দেখাশোনা করে ফিরবো। একটা কৌতূহল আমার প্রবল ছিল, যাদের বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে কোনো সংস্থান হবার কোন আশা নেই, সেই দরিদ্র পিসিমা আর শোভনা পনেরো টাকা মাসোহারার প্রতি এমন উদাসীন হলো কেন? শুনেছিলুম, ফরিদপুর টাউনে ইতিমধ্যে কলেরা দেখা দিয়েছিল, তবে কি তাদের একজনও বেঁচে নেই?মনে কতকটা দুর্ভাবনা ছিল বৈ কি।

সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় এলুম এবং এসে উঠলুম পাঁচগুণ খরচ দিয়ে এক হোটেলে। এসে দেখছি এই বিরাট মহানগর একদিকে হয়ে উঠেছে কাঙ্গালীপ্রধান ও আর একদিকে চলছে যুদ্ধ সাফল্যের প্রবল আয়োজন ফলে, যারা অবস্থাপন্ন ছিল তারা হয়ে উঠেছে বহু টাকার মালিক, আর যারা গরীব গৃহস্থ ছিল, তারা হয়ে এসেছে সর্বস্বান্ত। দেশের সবাই বলছে, দুর্ভিক্ষ গবর্নমেন্ট বলছেন, না, এ দুর্ভিক্ষ নয়, খাদ্যাভাব। দুটোর মধ্যে তফাৎ কতটুকু সে আলোচনা আপাতত স্থগিত রেখে সপ্তাহখানেক ধরে আমার কর্তব্যস্রোতে গা ভাসিয়ে দিলুম এর মধ্যে আর কোনোদিকে মন দিতে পারিনি। এইভাবেই চলছিল। কিন্তু ছোট পিসির মেজ ছেলে টুনুর সঙ্গে একদিন শেয়ালদার বাজারের কাছে হঠাৎ দেখা হয়ে যেতেই কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। একটা ফুলকাটা চটের থলেতে সের পাঁচেক চাল আর বাঁ-হাতে ডাঁটাশাক নিয়ে সে বিকেলের। দিকে পথ পেরিয়ে যাচ্ছিল। দেখা হতেই সে থমকে দাঁড়ালা বললুম, কিরে টুনু?

চমকে সে ওঠেনি, কিছুতেই বোধ হয় সে আর চমকায় না। কেবল তার অবসন্ন চোখ দুটো তুলে সে শান্তকণ্ঠে বললে, কবে এলে ছোড়দা?

তার হাত ধরে বললুম, তোদের খবর কি রে?

খবর?–বলে সে পথের দিকে তাকালো। মিলিটারি কসাইখানার মৃত্যুপথযাত্রী রুগণ গাভীর মতো দুটো নিরীহ তার চোখ যেন এই শতাব্দীর অপমানের ভারে সে-চোখ আচ্ছন্ন। মুখ ফিরিয়ে বললে, খবর আর কি? কিছু না।

হাসিমুখে বললুম, এ কি তোর চেহারা হয়েছে রে? পঁচিশ বছর বয়স হয়নি, এরই মধ্যে যে বুড়ো হয়ে গেলি?

আমার মুখের দিকে চেয়ে টুনু বললে, বাংলা দেশে থাকলে তুমিও হতে ছোড়দা—

কথাটায় অভিমান ছিল, ঈর্ষা ছিল, হতাশা ছিল। বললুম, চাল কিনলি বুঝি?

টুনু বললে, না, অফিস থেকে পাই কনট্রোলের দামে চারজন লোক, কিন্তু সপ্তাহে ছ’সেরের বেশী পাইনে। এই ত’ যাবো, গেলে রান্না হবে তোমার খবর ভাললা, দেখতেই ত’ পাচ্ছি। বেশ আছো। —আচ্ছা চলি, যুদ্ধ থামবার পর যদি বাঁচি আবার দেখা হবে।

বললুম, শোভনাদের খবর কিছু জানিস? তারা কি ফরিদপুরে নেই?

না–বলে একটু থেমে টুনু পুনরায় বললে, তাদের খবর আমার মুখ দিয়ে শুনতে চেয়ো না ছোড়দা!

কেন রে? তারা থাকে কোথায়?

বৌবাজারে, তিনশো তেরোর এফ নম্বরে। হ্যাঁ, যেতে পারো বৈ কি একবার আসি তা হ’লে— এই বলে টুনু আবার চললো নির্বোধ ও ভারবাহী পশুর মতো ক্লান্ত পায়ে।

টুনুর চোখে মুখে ও কণ্ঠস্বরে যেরকম নিরুৎসাহ লক্ষ্য করলুম, তাতে শোভনাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবার রুচি চলে যায়। কলকাতায় এসে তারা যদি শহরতলীর আনাচে কানাচে কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো তাহলে একটা কথা ছিল কিন্তু বৌবাজার অঞ্চলের বাসাভাড়াও ত’ কম নয়। একটা কথা আমার প্রথমেই মনে হলো, নুটু হয়ত ভালো চাকরি পেয়েছে। আজকাল অন্ন দুর্লভ, চাকরি দুর্লভ নয়। যারা চিরনির্বোধ ছিল, তারা হঠাৎ চতুর হয়ে উঠলো এই সম্প্রতি। একশো টাকার বেশী মাসিক মাইনে পাবার কল্পনা যাদের চিরজীবনেও ছিল না, তারা যুদ্ধ সরবরাহের কন্ট্রাক্টে সহসা হয়ে উঠলো লক্ষপতি এবং দুর্ভিক্ষকালে চাউলের জুয়াখেলায় কেউ কেউ হলো সহস্রপতি। হয়ত নুটুর মতো বালকও এই যুদ্ধকালীন জুয়ায় ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলেছে। এ যুদ্ধে কী না সম্ভব?

ওদের খবর নেবো কি নেবো না এই তোলাপাড়ায় আর কাজের চাপে কয়েকটা দিন আরো কেটে গেল। হঠাৎ আফিসের সাহেব জানালেন, আগামী কাল আমাদের দিল্লী রওনা হতে হবে। এখানকার কাজ ফুরিয়েছে।

আমারও এখানে থাকতে আর মন টিকছিল না আমার হোটেলের নীচে সমস্ত রাত ধরে শত শত কাঙ্গালীর কান্না শুনে বিনিদ্র দুঃস্বপ্নে এই কটা দিন কোনমতে কাটিয়েছি—আর পারিনো দুর্গন্ধে কলকাতা ভরা। তবু এখান থেকে যাবার আগে একবারটি পিসিদের খবর না নিয়ে যাওয়ার ভাবনায় মন খুঁৎ খুঁৎ করছিল। বিশেষ করে যাবার আগের দিনটা ছুটি পেলুম জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার জন্য একটা সুযোগও পাওয়া গেল।

বৌবাজারের ঠিকানা খুঁজে বার করতে আমার বিলম্ব হল না। মনে করেছিলাম তারা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, হঠাৎ গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা চমক দেবো। কিন্তু বাড়ীটা দেখেই আমি দিশেহারা হয়ে গেলুম সামনে একটা গেঞ্জি বোনার ঘর, তার পাশে লোহার কারখানা, এদিকে মনিহারি দোকান, ভিতরে ভূষিমালের আড়ত। নীচেকার উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, নীচের তলাটায় কতকগুলি লোক শোণদড়ির জাল বুনচে ক্ষিপ্রহস্তে। উপরতলাটা লক্ষ্য করে দেখি, বহু লোকজন। ওটা যে মেসবাসা, তা বুঝতে বিলম্ব হলো না। একবার সন্দেহক্রমে বাড়ীর নম্বরটা মিলিয়ে দেখলুমা না, ভুল আমার হয়নি—টুনুর দেওয়া এই নম্বরই ঠিক।

এদিক ওদিক দু-চার জনকে ধরে জিজ্ঞেস পড়া করতে গিয়ে যখন গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলেছি, দেখি সেই সময়ে বছর বারো তেরো বয়সের একটি মেয়ে সকৌতুকে উপরতলাকার সিঁড়ি বেয়ে মেসের দিকে যাচ্ছে এবং তাকে দেখে চার পাঁচটি লোক উপর থেকে নানারঙ্গে হাতছানি দিচ্ছে। আমি তাকে দেখেই চিনলুম, সে পিসিমার মেয়ে। তৎক্ষণাৎ ডাকলুম, মিনু?

মিনু ফিরে তাকালো। বললুম, চিনতে পারিস আমাকে?

না।

তোর মা কোথায়?

ভেতরে।

বললুম, আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল দেখি? এ যে একেবারে গোলকধাঁধাঁ! আয় নেমে আয়।

মিনু নেমে এলো বললে, কে আপনি?

পোড়ারমুখি! ব’লে তার হাত ধরলুম,—চল ভেতরে, তোর মা’র কাছে গিয়ে বলব, আমি কে? মুখপুড়ি, আমাকে একেবারে ভুলেছিস?

আমাকে দেখে উপরতলাকার লোকগুলি একটু সরে দাঁড়ালো বেশ বুঝতে পাচ্ছিলুম, আমার হাতের মধ্যে মিনুর ছোট্ট হাতখানা অস্বস্তিতে অধীর হয়ে উঠেছে। উপরে উঠতে গিয়ে সে বাধা পেয়েছে, এটা তার ভালো লাগেনি তার দিকে একবার চেয়ে আমি নিজেই তার হাতখানা ছেড়ে দিলুম। মিনু তখন বললে, ওই যে, চৌবাচ্ছার পাশে গলির ভেতর দিয়ে সোজা চলে যান, ওদিকে সবাই আছে।

এই বলে সে উপরে উঠে গেল। চোখে মুখে তার কেমন যেন বন্য উদভ্রান্ত ভাব। এই সেদিনকার মিনু-পরণে একখানা পাতলা সস্তা জুরে, চেহারায় দারিদ্র্যের রুক্ষ শীর্ণতা—কি এরই মধ্যে তারুণ্যের চিহ্ন এসেছে তার সর্বাঙ্গে। তার অজ্ঞান চপলতার প্রতি ভীত চক্ষে তাকিয়ে আমি একটা বিষণ্ণ নিশ্বাস ফেলে ভিতর দিকে পা বাড়ালুম।

বিস্ময়-চমক দেবার উৎসাহ আমার আর ছিল না। সরু একটা আনাগোনার পথ পেরিয়ে আমি ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলুম, পিসিমা?

কে?—ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে সাড়া এলো এবং তখনই একটি স্ত্রীলোক এসে দাঁড়ালো। বললে, কাকে চান?

অপরিচিত স্ত্রীলোক। রং কালো, নাকে নাকছাবি, মুখে পানের দাগ, পরণে নীল কাঁচের চুড়ি এই প্রকার স্ত্রীলোকের সংখ্যা বৌবাজারেই বেশী। বললুম, তুমি কে?—এই ব’লে অগ্রসর হলুম।

স্ত্রীলোকটি বললে, আমি এখানকার ভাড়াটে।

এমন সময় একটি ছেলে বেরিয়ে এলো। দেখেই চিনলুম, সে হারু হাসিমুখে বললুম, কি হারু, চিনতে পারিস? তোর মা কোথায়?

সে আমাকে চিনলো কিনা জানিনে, কিন্তু সহাস্যে বললে, ভেতরে আসুন। মা রাঁধছে।

অগ্রসর হয়ে বললুম, তোর দিদি কোথায়?

দিদি এখুনি আসবে, বাইরে গেছে। আসুন না আপনি?

বেলা বারোটা বেজে গেছে, কিন্তু এ বাড়ির বাসিপাট এখনো শেষ হয়নি। দারিদ্র্যের সঙ্গে অসভ্যতা আর অশিক্ষা মিলে ঘর দুয়ারের কেমন ইতর চেহারা দাঁড়ায়, এর আগে এমন ক’রে আর আমার চোখে পড়েনি ছায়ামলিন দরিদ্র ঘর-দুখানার ভিজা দুর্গন্ধ নাকে এলো,—এ পাশে নর্দমা ও পাশে কুৎসিত কলতলা। একধারে ঝাঁটা, ভাঙা হাঁড়ি, কয়লা আর পোড়া কাঠকুটোর ভিড়! হেঁড়া চটের থলে টাঙিয়ে পায়খানা ও কলতলার মাঝখানে একটা আবরু রক্ষার চেষ্টা হয়েছে। পিসিমাদের মতো শুদ্ধাচারিণী মহিলারা কেমন ক’রে এই নরককুণ্ডে এসে আশ্রয় নিলেন, এ আমার কাছে একেবারে অবিশ্বাস্যা একটা বিশ্রী অস্বস্তি যেন আমার ভিতর থেকে ঠেলে উপরে উঠে এলো।

রান্নার জায়গায় এসে পিসিমাকে পেলাম। সহসা সবিস্ময়ে দেখলাম, তিনি চটাওঠা একটা কলাইয়ের বাটি মুখের কাছে নিয়ে চা পান করছেনা আমাকে দেখে বললেন, একি, নলিনাক্ষ যে? কবে এলে?

কিন্তু আমি নিমেষের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম তাঁর চা খাওয়া দেখো পিসিমা হিন্দুঘরের নিষ্ঠাবতী বিধবা, স্নান আহ্নিক পূজা গঙ্গাস্নান, দান ধ্যান—এই সব নিয়ে চিরদিন তাঁকে একটা বড় সংসারের প্রতিপালিকার আসনে দেখে এসেছি। সদ্যস্নাতা গরদের থান-পরা পিসিমাকে পূজা-অর্চনার পরিবেশের মধ্যে দেখে কতদিন মনে মনে প্রণাম ক’রে এসেছি। কিন্তু তিন বছরে তাঁর এ কি পরিবর্তন? আমিষ রান্নাঘরে বসে ভাঙা কলাইয়ের বাটিতে চা খাচ্ছেন তিনি?

বললুম, পিসিমা, প্রণাম করবো পা ছুঁতে দেবেন?

পা বাড়িয়ে দিয়ে পিসিমা বললেন, কলকাতায় আমরা ক মাস হলো এসেছি, তোমাকে খবর দেওয়া হয়নি বটে। আর বাবা, আজকাল কে কার খবর রাখে বলো! চারিদিকে হাহাকার উঠেছে!

আমি একটু থতিয়ে বললুম, পিসিমা—আপনাদের মাসোহারার টাকা আমি নিয়মিতই পাঠাচ্ছিলুম…কিন্তু আজ ছ’মাস হতে চললো আপনাদের কোনো খোঁজখবর নেই!

খবর আর আমরা কাউকে দিইনি, নলিনাক্ষ।

 পিসিমার কণ্ঠস্বর কেমন যেন ঔদাসীন্য আর অবহেলায় ভরা। একদিন আমি তাঁর অতি স্নেহের পাত্র ছিলুম, কিন্তু আজ তিনি যে আমার এখানে অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে খুশী হননি, এ তাঁর মুখ চোখ দেখেই বুঝতে পারি।

হ্যাঁগো, দিদি–? বলতে বলতে সেই আগেকার স্ত্রীলোকটি হাসিমুখে চাতালের ধারে এসে দাঁড়ালে। পিসিমা মুখ তুললেন। সে পুনরায় বললে, তুমি বাজারে যাবে গা? বাজারে আজ এই এত বড় বড় টাটকা তপসে মাছ এসেছে…একেবারে ধড়ফড় করছে!

তার লালাসিক্ত রসনার দিকে তাকিয়ে পিসিমার মুখখানা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে এলো। তিনি বললেন, তুমি এখন যাও, বিনোদবালা।

এমন উৎসাহজনক সংবাদে ঔৎসুক্য না দেখে ম্লানমুখে বিনোদবালা সেখান থেকে সরে গেল। পিসিমা বললেন, তোমার কি খুব তাড়াতাড়ি আছে, নলিনাক্ষ?

বিশেষ কিছু না।–বলে আমি হাসলুম—আজকের দিনটা আপনাদের এখানে থাকবো বলেই আমি এসেছিলুম, পিসিমা।

তা বেশ ত’, বেশ ত’—তবে কি জানো বাবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট কিনা–বলতে বলতে পিসিমা চা খেয়ে বাটি সরিয়ে দিলেন আমার থাকার কথায় তাঁর দিক থেকে কিছুমাত্র আনন্দ অথবা উৎসাহ দেখা গেল না।

বললুম, শোভনা কোথায়, পিসিমা?

সে আসছে এখুনি, বোধহয় ও-বাড়ি গেছে।

ঈষৎ অসন্তোষ প্রকাশ করে আমি বললুম, সে কি আজকাল একলা বাসা থেকে বেরোয়?

পিসিমা বললেন, না, তেমন কই? তবে তেলটা, নুনটা মধ্যে মাঝে দোকান থেকে আনে বৈকি। বিনোদবালা যায় সঙ্গে।

পিসিমা তাঁর কথার দায়িত্ব কিছু নিলেন না, কেমন একটা মনোবিকারে আমার মাথা হেঁট হয়ে এলো। বললুম, শোভনার ছেলেটি কোথায়?কত বড়টি হয়েছে?

পিসিমা বললেন, তার খুড়ো-জ্যাঠা আমাদের কাছে ছেলেটাকে রাখলো না, নলিনাক্ষ তাদের ছেলে তারা নিয়ে গেছে।

সে কি পিসিমা, অতটুকু ছেলে মা ছেড়ে থাকতে পারবে? শোভনা পারবে থাকতে?

তা পারবে না কেন বলো? এক টাকায় দু’সের দুধও পাওয়া যায় না, ছেলেকে খাওয়াবে কি? নিজেদেরই হাঁড়ি চড়ে না কতদিন! অসুখ হলে ওষুধ নেই। শাড়ীর জোড়া বারো চোদ্দ টাকা। চাল পাওয়া যায় না বাজারে আর কতদিন চোখ বুজে সহ্য করবো, নলিনাক্ষ? ভিক্ষে কি করিনি? করেছি। রাত্তিরে বেরিয়ে মান খুইয়ে হাত পেতেছি। বলতে বলতে পিসিমা নিঃশ্বাস ফেললেন পুনরায় বললেন, কই, কেউ আমাদের চালডালের খবর নেয়নি, নলিনাক্ষ!

অনেকটা যেন আর্তকণ্ঠে বললুম, পিসিমা, টুনুদেরও এই অবস্থা সবাই মরতে বসেছে আজ, তাই কেউ কারো খবর নিতে পারে না। টুনুর কাছেই আপনাদের ঠিকানা পেলুম।

পিসিমা এতক্ষণ বসে ছিলেন, অতটা লক্ষ্য করিনি। তিনি এবার উঠে দাঁড়াতেই তাঁর ছিন্নভিন্ন কাপড়খানার দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালুম। তিনি বললেন, এ বাড়ির ঠিকানা তুমি আর কাউকে দিও না বাবা।

এমন সময় মীনু এসে দরজার কাছে চঞ্চল হাসিমুখে দাঁড়ালো। বললে, মা, মা শুনছ? এই নাও একটা আধুলি–হরিশবাবু দিল—

মীনুর মাথার চুল এলোমেলো, পরণের কাপড়খানা আলুথালু। মুখখানা রাঙা, গলার আওয়াজটা উত্তেজনায় কাঁপছে। অত্যন্ত অধীরভাবে পুনরায় সে বললে, যোগীন মাস্টার বললে কি জানো মা, আজ রাত্তিরে গেলে সেও আট আনা দিতে পারে।

পিসিমা অলক্ষ্যে আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, বেরো–বেরো হারামজাদি এখান থেকে। ঝেটিয়ে মুখ ভেঙে দেবো তোর।।

মীনু যেন এক ফুৎকারে নিবে গেল। মায়ের মেজাজ দেখে মুখের কাছ থেকে সরে গিয়ে সে অনুযোগ করে কেবল বললে, তুমি ত’ বলেছিলে!

হারু ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, ফের মিছে কথা বলছিস, মীনু? এখন তোকে কে যেতে বলেছিল? মা তোকে রাত্তিরে যেতে বলেছিল না?

পিসিমা ব্যস্তভাবে বললেন, নলিনাক্ষ, তুমি বড্ড হঠাৎ এসে পড়েছ, বাবা। এখন ভারি আতান্তর, তুমি ঘরে গিয়ে বসো গে।

ধীরে ধীরে ঘরের ভিতর এসে তক্তার মলিন বিছানাটার ওপর বসলুম গলার ভিতর থেকে কি যেন একটা বারম্বার ঠেলে উঠছিল, সেটার প্রকৃত স্বরূপটা আমি কিছুতেই বোঝাতে পারবো না। আমি এই পরিবারে মানুষ, আমি এদেরই একজন, এই আত্মীয়-পরিবারেই আমার জন্ম। অথচ আজ মনে হচ্ছে এখানে আমি নবাগত, অপরিচিত ও অনাহূত একটা লোক। যারা আমার পিসিমা ছিল, ভগ্নী ছিল, যাদের চিরদিন আপনার জন্য ব’লে জেনে এসেছি—আর তারা নয়, এরা বৌবাজারের বিনোদবালাদের সহবাসী, এরা সেই আগেকার সম্রান্ত পরিজনদের প্রেতমূর্তি!

মনে ছিল না জানালাটা খোলা। বৌবাজারের পথের একটা অংশ এখান থেকে চোখে পড়ে। যেখানে অসংখ্য যানবাহনের জটলা—ট্রাম, বাস, মোটর, গরুর গাড়ি আর মিলিটারী লরির চাকার আঁচড়ানির মধ্যে শোনা যাচ্ছে অগণ্য মৃত্যুপথযাত্রী দুর্ভিক্ষপীড়িতদের আর্তরব। জঞ্জালের বালতি ঘিরে ব’সে গেছে কাঙ্গালীরা, পরিত্যক্ত শিশুর কঙ্কাল গোঙাচ্ছে মৃত্যুর আশায়, স্ত্রীলোকদের অনাবৃত মাতৃবক্ষ অন্তিম ক্ষুধার শেষ আবেদনের মতো পথের নালার ধারে পড়ে রয়েছে।

জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এদিকে মুখ ফিরাবো, এমন সময় শুনি হারু আর মীনুর কান্না পিসিমা একখানা কাঠের চেলা নিয়ে তাদের হঠাৎ প্রহার আরম্ভ করেছেনা উঠে গিয়ে বলবার ইচ্ছে হলো, তাদের কোনো অপরাধ নেই—নিরপরাধকে অপরাধী করে তোলার জন্য দিকে দিকে যেসব ষড়যন্ত্রের কারখানা তৈরী করা হয়েছে, ওরা সেই ফাঁদে পা দিয়েছে, এইমাত্র। কিন্তু উঠে বাইরে যাবার আগেই, বাইরে শোনা গেল কলকণ্ঠের সম্মিলিত খলখলে হাসি সেই হাসি নিকটতর হয়ে এলো।

ঘরের কাছাকাছি আসতেই দেখি, বিনোদবালার সঙ্গে শোভনা আমি তাকে ডাকতেই সে যেন সহসা আঁৎকে উঠলো। দরজার কাছে এসে শোভনা শিউরে উঠে বললে, একি, ছোড়দাদা? তুমি ঠিকানা পেলে কেমন করে?

বললুম, এমনি এলুম সন্ধান ক’রো কেমন আছিস তোরা শুনি?

নিজের চেহারা এতক্ষণে শোভনার নিজেরই চোখে পড়লো। জড়সড় হয়ে বললে, আমি আশা করিনি তুমি আমাদের ঠিকানা খুঁজে পাবো।

বললুম, কিন্তু আমাকে দেখে কই একটুও খুশী হলিনে ত?

শোভনা চুপ করে রইলো। পুনরায় বললুম, এতদিন বাদে তোদের সঙ্গে দেখা কত দেশ বেড়ালুম, দিল্লীতে কেমন ছিলুম—এইসব গল্প করার জন্যেই এলুম রে তোর ছেলেকে পাঠিয়ে দিলি, থাকতে পারবি?

না পারলে চলবে কেন ছোড়দা?

এদিক ওদিক চেয়ে আমি বললুম, কিন্তু এ বাড়িটা তেমন ভালো নয়, তোরা এখানে আছিস কেন শোভা?

এখানে আমাদের ভাড়া লাগে না।

সবিস্ময়ে বললুম, ভাড়া লাগে না? অমন দয়ালু কে রে?

শোভনা বললে, যাঁর বাড়ি সে ভদ্রলোক আমাদের অবস্থা দেখে দয়া করে থাকতে দিয়েছেন।

আজকালকার বাজারে এমন দয়া দুর্লভ!

শোভনা বললে, তাঁর কেউ নেই, একলা থাকেন কিনা, তাই—

বোধ হয় বিনোদবালা আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, সেই দিকে মুখ তুলে চেয়ে শোভনা সরে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে আবার সে যখন এসে দাঁড়ালো, দেখি পাতলা জালের। মতন শাড়ীখানা ছেড়ে শোভনা একখানা সরুপাড় ধুতি পরে এসেছে।

বললুম, শোভনা, তোর ঠিকানা বদলালি, আমাকে চিঠি দিতে পারতিস!

ঠিকানা ইচ্ছে করে দিইনি ছোড়দা।

কিন্তু মাসোহারার টাকাটা নেওয়া বন্ধ করলি কেন রে?

একটু থতিয়ে শোভনা বললে, ছেলের জন্যেই নিতুম তোমার কাছে হাত পেতে কিন্তু ছেলে ত’ নেই, ছেলে আমার নয়, তাই নেওয়া বন্ধ করেছি।

প্রশ্ন করলুম, তোদের চলছে কেমন করে?

শোভনা বললে, তুমি আজ এসেছ, আজই চলে যাবে—তুমি সে কথা শুনতে চাও কেন ছোড়দা?

চুপ করে গেলুম। একথা শোনবার অধিকার আমার নেই, খুঁচিয়ে জানবারও দরকার নেই। বললাম, নুটু কোথায়?

সে লোহার কারখানায় চাকরি করে, টাকা পঁচিশেক পায়। সপ্তাহে সপ্তাহে কিছু চাল-ডাল আনে। আজকাল আবার নেশা করতে শিখেছে, সবদিন বাড়িও আসে না।

বললুম, সে কি, নুটু অমন চমৎকার ছেলে, সে এমন হয়েছে? হারুর পড়াশুনোও ত বন্ধ। ও কি করে এখন?

শোভনা নত মুখে বললে, এই রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে হারুর কাজ জুটেছিল, কিন্তু সেদিন কতকগুলো খাবার চুরি যাওয়ায় ওর কাজ গেছে। এখন বসেই থাকে।

স্বভাবতই এবার প্রশ্নটা এসে দাঁড়ালো শোভনার ওপর। কিন্তু আমি আড়ষ্ট হয়ে উঠলুম।

কথা ঘুরিয়ে বললুম, কিন্তু একটা ব্যাপার আমার ভালো লাগেনি, শোভা। মীনুটা এখন যাই হোক একটু বড় হয়েছে, ওকে যখন তখন বাইরে যেতে দেওয়া ভালো নয়। বাড়িটায় নানা রকম লোক থাকে, বুঝিস ত!

বাইরে জুতোর মসমস শব্দ পাওয়া গেল। চেয়ে দেখলুম, আধময়লা জামাকাপড় পরা একটি লোক এক ঠোঙা খাবার হাতে নিয়ে ভিতরে এল। মাথায় অল্প টাক, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ লোকটির বয়স বেশী নয়। চাতালের ওপর এসে দাঁড়িয়ে বললে, কই, বিনোদ কোথা গেলে? এক ঘটি জল দাও আমার ঘরে। আরে কপাল, খাবারের ঠোঙা হাতে দেখলে আর রক্ষে নেই! নেড়ি কুকুরের মতন পেছন পেছনে আসে মেয়ে-পুরুষগুলো কেঁদে কেঁদো ছোঁ মেরেই নেয় বুঝি হাত থেকে। পচা আমের খোসা নর্দমা থেকে তুলে চুষছে, দেখে এলুম গো। এই যে, এনেছ জলের ঘটি, দাও। এ-দুর্ভিক্ষে চারটি অবস্থা দেখলুম, বুঝলে বিনোদ? আগে ঝুলি নিয়ে ভিক্ষে, যদি দুটি চাল পাওয়া যায়। তারপর হলো ভাঙা কলাইয়ের থালা, যদি চারটি ভাত কোথাও মেলে। তারপর হাতে নিল হাঁড়ি, যদি একটু ফ্যান কেউ দেয়। আর এখন, কেবল কান্না,—কোথাও কিছু পায় না! আরে পাবে কোত্থেকে গেরস্থরা যে ভাত গুলে ফ্যান খাচ্ছে গো! যাই, দু’খানা কচুরি চিবিয়ে পড়ে থাকি। বলতে বলতে লোকটি ভিতর দিকে চলে গেল।

আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লক্ষ্য করে শোভনা বললে, উনি ছিলেন এখনকার কোন ইস্কুলের মাস্টার। এখন চাকরি নেই। রান্নাঘরের পাশে ওই চালাটায় থাকেন।

একলা থাকেন, না সপরিবারে?

না। ওঁর সবাই ছিল, যখন উপার্জন ছিল। তারপর বড় মেয়েটি কোথায় চলে যায়, স্ত্রী তার জন্যে আত্মহত্যা করেনা ছেলে দুটি আছে মামার বাড়ী ছোড়দা, বলতে পারো আর কত দিন এমনি করে বাঁচতে হবে? এ যুদ্ধ কি কোন দিন থামবে না?

উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের অতীত, সান্ত্বনা দেবারও কিছু ছিল না। চেয়ে দেখলুম শোভনার দিকে। চোখের নীচে তার কালো কালো দাগ, মাথার চুলগুলো রুক্ষ ও বিবর্ণ, সরু সরু হাত দুখানা শির-ওঠা, রক্তহীন ও স্বাস্থ্যহীন মুখখানা। যেন যুদ্ধের দাগ তার সর্বাঙ্গে, যেন দেশজোড়া এই দুর্ভিক্ষের অপমানজনক চিহ্ন মুখেচোখে সে মেখে রয়েছে। তার কথায় ও কণ্ঠস্বরে কেমন যেন আত্মদ্রোহিতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখতে পাচ্ছিলুমা সেদিনকার শান্ত ও চরিত্রবতী শোভনা— আমার ছোট বোন—আজ যেন অসন্তুষ্ট অগ্নিশিখার মতো লকলকে হয়ে উঠেছে। আমার কোন সান্ত্বনা, কোন উপদেশ শোনবার জন্য সে আর প্রস্তুত নয়। কিন্তু আমার অপরিতৃপ্ত কৌতূহল আমাকে কিছুতেই চুপ করে থাকতে দিল না এক সময়ে বললুম, শোভা, এটা ত’ মানিস, সামনে আমাদের চরম পরীক্ষার দিন। চারিদিকে এই ধ্বংসের চক্রান্তের মধ্যে আমাদের টিকে থাকতেই হবে। যেমন করেই হোক নিজেদের মান-সম্ভ্রম বাঁচিয়ে–

মান-সম্ভম?—শোভনা যেন আর্তনাদ করে উঠলো কোথায় মান-সম, ছোড়দা? আগে বুকের আগুন নিয়ে ছিলুম সবাই, এবার পেটের আগুনে সবাই খাক হয়ে গেলুম! কে বলেছে প্রাণের চেয়ে মান বড়? কোন মিথ্যাবাদী রটিয়েছে, আমাদের বুক ফাটে ত’ মুখ ফোটে না? ছোড়দা, তুমি কি বলতে চাও, যদি তিল তিল করে না খেয়ে মরি, যদি পোড়া পেটের জ্বালায় ভগবানের দিকে মুখ খিচিয়ে আত্মহত্যা করি, যদি তোমার মা-বোনের উপবাসী বাসি মড়া ঘর থেকে মুদ্দোফরাসে টেনে বার করে, সেদিন কি তোমাদেরই মান-সম্ভ্রম বাঁচবে? যারা আমাদের বাঁচতে দিলে না, যারা মুখের ভাত কেড়ে নিয়ে আমাদের মারলে, যারা আমাদের বুকের রক্ত চুষে-চুষে খেলে, তাদের কি মান-সম্ভ্রম পৃথিবীর ভদ্রসমাজে কোথাও বাড়লো? যাও, খোঁজ নাও, ছোড়দা, ঘরে-ঘরে গিয়ে। কাঙ্গালীদের কথা ছাড়ো, গেরস্থ বাড়ীতে ঢুকে দেখে এসো কত মায়ের বত্রিশ নাড়ী জ্বলে-পুড়ে গেল দুটি ভাতের জন্যে, কত দিদিমা-পিসিমা-খুড়িমা-বোন বৌদিদিরা আড়ালে বসে চোখের জল ফেলছে একখানি কাপড়ের জন্যো অন্ধকারে গামছা আর ছেড়া বিছানার চাদর জড়িয়ে কত মেয়ে-পুরুষের দিন কাটছে, জানো? বাসি আমানি নুন গুলে খেয়ে কত লাজুক মেয়ে প্রাণধারণ করছে, শুনেছ? মান-সম্ভম নিজের কাছেই কি রইলো কিছু, ছোড়দা?

সপ্রতিভ লজ্জাবতী নিরীহ শোভনাকে এতকাল দেখে এসেছি। তার এই মুখের উত্তেজনায় আমার যেন মাথা হেঁট হয়ে এলো। আমি বললুম, কিন্তু কনট্রোলের দোকানে অল্প দামে চাল কাপড় পাওয়া যাচ্ছে তোমরা তার কোন সুবিধে পাও না?

শোভনা আমার মুখের দিকে একবার তাকালো দেখতে দেখতে তার গলার ভিতর থেকে পচা ভাতের ফেনার মতো একপ্রকার রুগণ হাসি বমির বেগে উঠে এলো। শীর্ণ মুখখানা যেন প্রবল হাসির যন্ত্রণায় সহসা ফেটে উঠলো। শোভনা হা হা করে হাসতে লাগলো। সে-হাসি বীভৎস, উন্মত্ত, নির্লজ্জ এবং অপমানজনকও বটে। আমার নির্বোধ কৌতূহল স্তব্ধ হয়ে গেল।

পিসিমার কাছে মার খেয়ে মীনু ও হারু এসে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। হঠাৎ তাদের দিকে চেয়ে শোভনা চেঁচিয়ে বললে, কেন, কাঁদছিস কেন, শুনি?দূর হয়ে যা সামনে থেকে—

বিনোদবালা যেন কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে গলা বাড়িয়ে বললে, দিদি, মাসি মেরেছে ওদের। ও-বাড়ীর হরিশবাবুর কাছ থেকে মীনু পয়সা এনেছিল কিনা—হারু কি যেন বলে ফেলেছিল, তাই–

শোভনার মাথায় বোধ হয় আগুন ধরে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বললে,? কেন তুমি ওদের মারলে শুনি?

পিসিমা কলতলার পাশ থেকে বললেন, মারবো না? কলঙ্কের কথা নিয়ে দুজনে বলাবলি করছিল, তাই বেদম মেরেছি। বেশ করেছি।

কিন্তু ওদের মেরে কলঙ্ক ঘোচাতে তুমি পারবে?

পিসিমা চীৎকার করে উঠলেন, ভারি লম্বা লম্বা কথা হয়েছে তোর, শোভা! এত গায়ের জ্বালা তোর কিসের লা? দিনরাত কেন তোর এত ফোঁসফেঁসোনি?কপাল পোড়ালি তুই, মান খোয়ালি, সে কি আমার দোষ? পেটের ছেলে-মেয়েকে আমি মারবো, খুন করবো, যা খুশি তাই করবো— তুই বলবার কে?

শোভনা গর্জন করে বললে, পেটের মেয়েরা যে তোমার পেটে অন্ন যোগাচ্ছে, তার জন্যে লজ্জা নেই তোমার? মেরে মেরে মীনুটার গায়ে দাগ করলে তোমার কী আক্কেল? একেই ত’ ওর ওই চেহারা, এর পর ঘর-খরচ চলবে কোত্থেকে? লজ্জা নেই তোমার?

তবে আমি হাটে হাঁড়ি ভাঙবো, শোভা—এই বলে পিসিমা এগিয়ে এলেনা উচ্চকণ্ঠে বললেন, নলিনাক্ষ আছে তাই চুপ করে ছিলুম বলি, ফরিদপুরের বাড়িতে ব’সে বিনোদবালার ঠিকানা কে যোগাড় করেছিল? গাড়িভাড়া কা’র কাছে নিয়েছিলি তুই?

অধিকতর উচ্চকণ্ঠে শোভনা বললে, তাহলে আমিও বলি? মাস্টারকে কে এনে ঢুকিয়েছিল এই বাসায়? হরি-যোগেনদের কাছে কে পাঠিয়েছিল মীনুকে? আমাকে কেরানীবাগানের বাসায় কে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল? উত্তর দাও? জবাব দাও? হোটেলের পাঁউরুটি আর হাড়ের টুকরো তুমি কুড়িয়ে আনতে বলোনি হারুকে? নুটু বাড়ি আসা ছাড়লোকার জন্যে?

মুখ সামলে কথা বলিস, শোভা!

এমন সময়ে বিনোদবালা মাঝখানে এসে দাঁড়াল ঝগড়া মিটাবার জন্য মারমুখী মা ও মেয়ের এই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য অধঃপতন দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলুম না। উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালুম। বললুম, পিসিমা, আপনি স্নান করতে যান। শোভা, তুই চুপ কর, ভাই এরকম অবস্থার জন্যে কার দোষ দিবি বল, তোর, আমার, পিসিমার, হারু-মীনুর,—এমন কি ওই বিনোদবালা, মাস্টারমশাই, হরিশের দলেরও কোন দোষ নেই। কিন্তু অপরাধ যাদের, তারা আমাদের নাগালের বাইরে শোভা। যাকগে, আমি এখন যাই, আবার একসময়ে আসবো।

শোভনা কেঁদে বললে, আর তুমি এসো না ছোড়দা।

আমি একবার হাসবার চেষ্টা করলুম বললুম, পাগল কোথাকার!

পিসিমা বললেন, এত গোলমালে তোমার কিছু খাওয়া হলো না বাবা নলিনাক্ষ কিছু মনে ক’রো না।

বিনোদবালা বললে, চলো, ঢের হয়েছে! এবারে নেয়ে-খেয়ে তৈরী হও দিকি? গলাবাজি করলে ত’ আর পেট ভরবে না। পেটটা যাতে ভরে তার চেষ্টা করো। আমি কি আগে জানতুম তোমরা ভদ্রলোকের ঘর, তাহলে এমন ঝকমারি কাজে হাত দিতুম না!

অপমানিত মুখে পলকের জন্য বিনোদবালার দিকে চোখ তুলে অগ্নিবষ্টি ক’রে আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলুম। পাতালপুরীর সুড়ঙ্গলোকের কদর্য-কলুষ রুদ্ধশ্বাস থেকে মুক্তি নিয়ে এসে দাঁড়ালুম রাজপথের উপর দিগন্ত জোড়া মুমুর্মুর আর্তনাদের মধ্যে এ বরং ভালো, এই অগণ্য ক্ষুধাতুরের কান্না চারিদিকে পরিব্যাপ্ত থাকলেও কেমন একটা দয়াহীন সকরুণ ঔদাসীন্যে এদের এড়ানোে চলো কিন্তু যেখানে চিত্ত-দারিদ্র্যের অশুচিতা, যেখানে দুর্ভিক্ষপীড়িত উপবাসীর মর্মান্তিক অন্তর্দাহ, যেখানে কেবল নিরুপায় দুর্নীতির গুহার মধ্যে বসে উৎপীড়িত মানবাত্মা অবমাননার অন্ন লেহন করছে, সেই সংহত বীভৎসতার চেহারা দেখলে আতঙ্কে গলা বুজে আসে।

কিন্তু এরা কে? সেই ফরিদপুরের ছোট বাড়িটিতে ফুলের চারা আর শাকসজী দিয়ে ঘেরা ঘরকন্নার মধ্যে আচারশীলা মাতৃরূপিণী পিসিমা, লাজুক একটি সদ্য-ফোঁটা ফুলের মত কুমারী ভগ্নী শোভনা, চাঁপার কলির মত নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক হারু, নুটু, মীনু—এরা কি সেই তারা? কেন একটি সুখী পরিবার ধীরে ধীরে এমন সমাজ-নীতিভ্রষ্ট হলো? কেন তাদের মৃত্যুর আগে তাদের মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটলো এমন ক’রে? কোন দয়াহীন দস্যুতা এর জন্যে দায়ী?

এই কয়মাসের মাসোহারার টাকাটা আমি অনায়াসে খরচ করতে পারি বৈকি। অন্তত দিল্লী যাবার আগে ওদের এই অবস্থায় রেখে চুপ ক’রে চলে যেতে পারিনে। সুতরাং অপরাকালটা নানা দোকানে ঘুরে ঘুরে কিছু কিছু খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করা গেল। শতকরা দশগুণ বেশী দামে চাল এবং পাঁচগুণ বেশী দামে আর সব খাবার জিনিসপত্র এখান ওখান থেকে কিনতে লাগলুম। কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেটা মাত্র এই বিগত শ্রাবণের কৃষ্ণপক্ষ, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। স্বল্পলোক কলকাতার পথঘাট পেরিয়ে একখানা গাড়িতে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে চললুম আবার শোভনাদের ওখানে। নিজের বদান্যতায় কোনো গৌরব বোধ করছিনে, বরং সমস্ত খাদ্যসামগ্রীগুলোকে ঘৃণ্য মনে হচ্ছে। খাদ্য আজ জীবনের সকল প্রশ্নকে ছাপিয়ে উঠেছে বলেই হয়ত খাদ্যের প্রতি এত ঘৃণা এসেছে। এসব পদার্থ আগে ছিল ভদ্রজীবনের নীচের তলাকার লুকানো আশ্রয়, সেটার কোনো আভিজাত্য ছিল না—আজ সেটা যেন মাথার ওপর চড়ে বসে আপন জাতিচ্যুতির আক্রোশটা সকলের ওপর মিটিয়ে নিচ্ছে!

তবু দুর্গম পথঘাট পেরিয়ে সেগুলো নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হলুম বৌবাজারের বাড়ির দরজায়। বহু পরিশ্রম আর অধ্যবসায় ব্যয় ক’রে দু-তিনজন লোকের সাহায্যে সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাখলুম সেই সরু আনাগোনার পথের এক ধারে। মাস তিনেকের মত খাদ্যসম্ভার কিনে এনেছিলুম। জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে লোকগুলোকে বিদায় করলুমা।

ভিতর দিকে কোথায় যেন একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছিল, তারই একটা আভা এসে পড়েছিল আমার গায়ে কলতলার ওপাশ থেকে শোনা গেল, নারীকণ্ঠের সঙ্গে ইস্কুল-মাস্টারের কথালাপের আওয়াজ জড়ানো। তা ছাড়া নীচের তলাটা নিঃসাড়–মৃত্যুপুরীর মতো

আমি কয়েক পা অগ্রসর হয়ে গেলুম। ডাকলুম, মীনু? হারু?

কোনো সাড়া নেই। যে ঘরখানায় দুপুরবেলায় আমি বসেছিলুম, সে ঘরখানা ভিতর থেকে বন্ধ। বুঝতে পারা গেল, ক্লান্ত হয়ে পিসিমারা সবাই ঘুমিয়েছে। আবার আমি ডাকলুম মীনু, ও হারু?

বোধ করি বাইরের থেকে আমার গলার আওয়াজটা ঠিক বোধগম্য হয়নি, ঘরের ভিতর থেকে শোভনা সাড়া দিয়ে বললে, দিনরাত এত আনাগোনা কেন গা তোমার? মীনু ও-বাড়িতে গেছে, আজ তাকে পাবে না, যাও। হতভাগা, চামার!

আমি বললুম, শোভা, আমি রে, আর কেউ নয়, আমি—ছোড়দা। দরজাটা খোল দেখি?

ছোড়দা?—শোভনা তৎক্ষণাৎ দরজাটা খুলে দিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে বসে পড়লো। অশ্রুসজল কণ্ঠে বললে, ছোড়দা, পেটের জ্বালায় আমরা নরককুণ্ডে নেমে এসেছি। তুমি আমাকে মাপ করো, তোমার গলা আমি চিনতে পারিনি।

শোভনার হাত ধরে আমি তুললাম। বললুম, কাঁদিসনে, চুপ কর। তোরা ত’ একা নয় ভাই, লক্ষ লক্ষ পরিবার এমনি করে মরতে বসেছে। কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না, এমনি করেই এই অবস্থাকে পেরিয়ে যেতে হবে, শোভা। শোন, কালকেই আমি দিল্লী যাবো, তাই তাড়াতাড়িতে তোদের জন্যে চারটি চাল-ডাল কিনে আনলুম—ওগুলো তুলে রাখ।

চাল-ডাল এনেছ? দুর্বল শরীরের উত্তেজনায় শোভনা যেন শিউরে উঠলো। যেন ভাবী ক্ষুধাতৃপ্তির কল্পনায় কেমন একটা বিকৃত উগ্র ও অসহ্য উল্লাস তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে কাঁপতে লাগলো। রুদ্ধশ্বাসে সে বললে, তুমি বাঁচালে—তুমি বাঁচালে, ছোড়দা তোমার দেনা আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না।–এই বলে আমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে আমার চিরদিনকার আদরের ভগ্নী ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

বললাম, ওর সঙ্গে নতুন জামা-কাপড়ের একটা পুঁটলি রয়েছে, ওটা আগে তুলে রাখ, শোভা। শোভনা আমাকে ছেড়ে দিয়ে কেরোসিনের ডিবেটা নিয়ে এসে খাদ্যসামগ্রীর কাছে দাঁড়িয়ে একবার সব দেখলো। তারপর অসীম তৃপ্তির সঙ্গে কাপড়ের বস্তাটা তুলে নিয়ে ঘরের ভিতরে চৌকীর নীচে রেখে এলো। বললে, ছোড়দা, মনে আছে, কোরা জামা-কাপড় পরে লোকের সামনে এসে দাঁড়ানো আমাদের পক্ষে কী লজ্জার কথা ছিল? দোকান থেকে চাল-ডাল এলে লুকিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতুম—পাছে কেউ ভাবে, চাল কেনার আগে আমাদের বুঝি খাবার কিছু ছিল না! মনে আছে ছোড়দা?

হেসে বললাম, সব মনে আছে রে।

শোভনা করুণকণ্ঠে বললে, তুমি বলতে পারো ছোড়দা, এ দুর্ভিক্ষ কবে শেষ হবে? সবাই যে বলছে, নতুন ধান উঠলে আমাদের আর উপোস করতে হবে না?

তার আর্তকণ্ঠ শুনে আমি চুপ করে রইলুম। কারণ, সরকারী চাকর হলেও ভিতরের খবর আমার কিছুই জানা ছিল না। শোভনা পুনরায় বললে, ফরিদপুরের সেই মস্ত মাঠ তোমার মনে আছে, ছোড়দা? ভাবোত, সেই মাঠে আমনের সোনার শিষ পেকেছে, হাওয়ায় তারা ঢেউ খেলছে আনন্দে, মাঠে মাঠে চাষার দল গান গেয়ে কাটছে সেই ধান,—সেই লক্ষ্মীকে ভারে ভারে তারা ঘরে তুলে আনছে! মনে পড়ে?

শোভনার স্বপ্নময় দুটি চোখ হয়ত সেই সোনার বাঙলার মাঠে মাঠে একবার ঘুরে এলো, কিন্তু আমি কেরোসিন ডিবের আলোয় এই নরককুণ্ড ছাড়া আর কোথাও কিছু দেখতে পেলুম না। কেবল নিঃশ্বাস ফেলে বললুম, মনে পড়ে বৈকি।

কিন্তু এ কি শুনছি ছোড়দা? শোভনা আমার মুখের দিকে আবার ফিরে তাকালো। সভয়ে চক্ষু তুলে সে পুনরায় বললে, গোছা গোছা কাগজ বিলিয়ে আবার নাকি ওরা শুষে নিয়ে যাবে সেই আমাদের ভাঙা বুকের রক্ত?নবান্নর পর আবার নাকি ভরে যাবে আমাদের ঘর কাঙ্গালীর কান্নায়? বলতে পারো, তুমি?

কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলুম, সহসা বাইরে কা’র পায়ের শব্দ পেয়ে শোভনা সচকিত আতঙ্কে অন্ধকারের দিকে ফিরে তাকালো। তারপর কম্পিত অধীরকণ্ঠে সে বললে, ছোড়দা, এবার তুমি যাও, তোমার অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন নিশ্চয় ন’টা—আমার মনে ছিল না, নিশ্চয় ন’টা বেজেছে। এবার তুমি যাও, ছোড়দা!

এগুলো তুলে রাখ আগে সবাই মিলে?

রাখবো, ঠিক রাখবো—একটি একটি চাল-ডালের দানা গুনে গুনে রাখবো—কিন্তু এবার তুমি যাও, ছোড়দা, আলো ধরছি…তুমি যাও, একটুও দেরী ক’রো না…লক্ষ্মীটি ছোড়া…

শোভনা চঞ্চল অস্থির উদ্দাম হয়ে এসে আমাকে যখন এক প্রকার টেনে নিয়ে যাবে, সেই সময় একটি লোকে চাল-ডালের বস্তার ওপর হোঁচট খেয়ে ভিতরে এসে দাঁড়ালো। একেবারে গায়ের উপর এসে পড়ে বললে, ওঃ, নতুন লোক দেখছি! চাল-ডাল এনে একেবারে নগদ কারবার!

লোকটার পরণে একটা খাকি সার্ট, সর্বাঙ্গে কেমন একটা নেশার দুর্গন্ধ। আমি বললুম, কে তুমি?

আমি কারখানার ভূত, স্যার। —এই ব’লে হঠাৎ শোভনার একটা হাত ধরে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে বললে, এসো, কথা আছে।

কথা কিছু নেই, ছাড়ো। ব’লে শোভনা তার হাতখানা ছাড়িয়ে নিল।

বটে!—লোকটি ভুরু বাঁকিয়ে বললে, আগাম একটা টাকা দিইনি কাল?

রুদ্ধশ্বাসে শোভনা বললে, বেরিয়ে যাও বলছি ঘর থেকে?

বাঃ—বেরিয়ে যাবো বলে বুঝি এলুম দেড় মাইল হেঁটে? বেশ কথা বলে পাগলি!

চীৎকার ক’রে শোভনা বললে, বেরোও বলছি শিগগির? চলে যাও দূর হয়ে যাও ঘর থেকে–

লোকটা বোধ হয় তক্তাখানার ওপর বসবার চেষ্টা করছিল। হেসে বললে, আজ বুঝি আবার খেয়াল উঠলো?

শোভনা আর্তনাদ করে উঠলো—ছোড়দা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছ তুমি? এ অপমানের কি কোনো প্রতিকার নেই?…দাঁড়াও, আজ খুন করবো বঁটিখানা…

বলতে বলতে ছুটে সে বেরুলো রান্নাঘরের দিকে চললো। লোকটা এবার উঠে বাইরে এলো। বললে, মশাই, এই নিয়ে মেয়েটা আমাকে অনেকবারই খুন করতে এলো, বুঝলেন? আসলে মেয়েটা মন্দ নয়, কিন্তু ভারি খেয়ালী! তবে কি জানেন স্যার, আমরা হচ্ছি ‘এসেনসিয়াল সার্ভিসের লোক, যুদ্ধের কারখানায় লোহা-লক্কড় নিয়ে কাজ করি—মেয়েমানুষের মেজাজ টেজাজ অত বুঝিনে! এসব জানে ওই ‘আই-ই’ মার্কা লোকগুলো, ওরা নানারকম ভাঁড়ামি করতে পারে!

এমন সময় উন্মাদিনীর মতন একখানা বঁটি হাতে নিয়ে শোভনা ছুটে বেরিয়ে এলো। পিসিমা ধড়মড়িয়ে এলেন, হারু ছুটে এলো লোকটি শান্তকণ্ঠে বললে, আচ্ছা, আচ্ছা, আর খুন করতে হবে না, দেখছি আজ খেয়ালের ভূত চেপেছে ঘাড়ে। আচ্ছা—এই যাচ্ছি স’রে।

বিনোদবালা আর পিসিমা দৌড়ে এসে ধরে ফেললেন শোভনাকে।

লোকটি পুনরায় নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললে, বেশ, সেই ভালো। বিনোদের ঘরে রইলুম এ রাত্তিরটার মতন। কিন্তু মাঝরাত্তিরে আমাকে নিশ্চয় ডেকে ঘরে নিয়ো, নইলে কিছুতেই আমার ঘুম হবে না, বলে রাখলুম। আচ্ছা, বেশ, কাল নাহয় আড়াই সের চাল’ই দেওয়া যাবে। আয় বিনোদ, তোর ঘরে যাই। বলতে বলতে বিনোদের হাতখানা টেনে নিয়ে সেই কদাকার লোকটা ইস্কুল-মাস্টারের ঘরের দিকে চলে গেল।

শোভনা সহসা আমার পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। বললে,

কবে, কবে ছোড়দা, কবে এই রাক্ষুসে যুদ্ধ থামবে, তুমি ব’লে যাও! তুমি ব’লে যাও, কবে এই অপমানের শেষ হবে, আমাদের মৃত্যুর আর কতদিন বাকি?

আস্তে আস্তে আমি পা ছাড়িয়ে নিলুম। শোভনার হৃৎপিণ্ড থেকে আবার রক্ত উঠে এলো। বললে, তুমি যেখানে যাচ্ছ, সেখানে যদি কেউ মানুষ থাকে, তাদের বলো এ যুদ্ধ আমরা বাধাইনি, দুর্ভিক্ষ আমরা আনিনি, আমরা পাপ করিনি, আমরা মরতে চাইনি…

শোভনা কাঁদুক, সবাই কাঁদুক। আমি অসাড় ও অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাইরে এসে পথে নামলুম। অন্ধকারে কোথাও কিছু দেখতে পেলুম না। শুধু অন্ধকার, অনন্ত অন্ধকার। কেবল মনে হলো, অঙ্গারের আগুন যেমন পুড়ে পুড়ে নিস্তেজ হয়ে আসে, তেমনি মহানগরের ক্ষুধাশ্রান্ত কাঙ্গালীরা চারিদিকে চোখ বুজে পথে-ঘাটে নালা-নর্দমায় শুয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি কান পেতে শুনছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *