তিন বিধাতা

তিন বিধাতা
রাজশেখর বসু (পরশুরাম)

সমস্ত উচ্চ স্তরের আলাপ অর্থাৎ হাই লেভেল টক যখন ব্যর্থ হল তখন সকলে বুঝলেন যে মানুষের কথাবার্তায় কিছু হবে না, ঐশ্বরিক লেভেলে উঠতে হবে। বিশ্বমানবের হিতার্থী সাধুমহাত্মারা একযোগে তপস্যা করতে লাগলেন। অবশেষে যা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি তা সম্ভব হল, ব্রহ্মা গড আর আল্লা সুমেরু অর্থাৎ হিন্দুকুশ পর্বতে সমবেত হলেন। আরও বিস্তর দেবতা ও উপদেবতার এই ঐশ্বরিক সভার বিতর্কে যোগ দেবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হতে পারে এই আশঙ্কায় উদযোক্তারা কেবল তিন বিধাতাকে আহ্বান করেছিলেন।

ব্রহ্মার সঙ্গে নারদ, গডের সঙ্গে সেন্ট পিটার, এবং আল্লার সঙ্গে একজন পীরও অনুচর রূপে অবতীর্ণ হলেন। তা ছাড়া অনেক অনাহূত দেব দেবী ঋষি সেন্ট যক্ষ নাগ ভূতপিশাচ এঞ্জেল ডেভিল প্রভৃতি মজা দেখবার জন্য অদৃশ্যভাবে আশেপাশে অবস্থান করলেন।

ব্রহ্মার মূর্তি সকলেই জানেন,—চার হাত, চার মুখ, একবার মনে হয় দাড়ি-গোঁফ আছে, আবার মনে হয় নেই। পরনে সাদা ধুতি-চাদর, কাঁধে পইতার গোছা, মাথায় মুকুটা গড নিরাকার, তাঁকে দেখবার জো নেই। তথাপি ভক্তগণের বিশেষ অনুরোধে বাক্যালাপের সুবিধার জন্য তিনি পুরাকালের জিহোভার মূর্তিতে এলেন। বুকভরা কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফ, কাঁধভরা চুল, বড় বড় চোখ, কোঁচকানো ভ্রূ, দুর্বাসার মতন রাগী চেহারা, পরনে একটি আলখাল্লা। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে চীনাবাজারে ছবির দোকানে খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায় বিশেষের জন্য এই রকম ছবি বিক্রি হত, এখনও হয় কিনা জানি না।

আল্লা গডের চাইতেও নিরাকার, অনেক অনুরোধেও মূর্তি ধারণ করতে অথবা কোনও কথা বলতে মোটেই রাজী হলেন না। পীরসাহেব বললেন, কোনও ভাবনা নেই, আল্লা সর্বত্র আছেন, এখানেও আছেন তাঁর মতামত আমিই ব্যক্ত করব। কিন্তু নারদ আর সেন্ট পিটার বললেন, তুমি যে নিজের কথাই বলবে না তার প্রমাণ কি? পীরসাহেব উত্তর দিলেন, এই চাঁদমার্কা ঝাণ্ডা খাড়া করে রাখছি, এর নীচে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করে আমি কথা বলব আল্লা যদি নারাজ হন তবে এই পবিত্র ঝাণ্ডা আমার মাথায় পড়বো ব্রহ্মা ও গড এই প্রস্তাবে রাজী হলেন, কারণ আল্লার সেবককে খুশী রাখতে তারা সর্বদাই প্রস্তুত।

কিন্তু নারদ আর সেন্ট পিটার বললেন, তুমি যে নিজের কথাই বলবে না তার প্রমাণ কি? পীরসাহেব উত্তর দিলেন, এই চাঁদমার্কা ঝাণ্ডা খাড়া করে রাখছি, এর নীচে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করে আমি কথা বলব আল্লা যদি নারাজ হন তবে এই পবিত্র ঝাণ্ডা আমার মাথায় পড়বো ব্রহ্মা ও গড এই প্রস্তাবে রাজী হলেন, কারণ আল্লার সেবককে খুশী রাখতে তারা সর্বদাই প্রস্তুত।

নারদ, সেন্ট পিটার আর পীরসাহেবের বর্ণনা অনাবশ্যক। এঁদের চেহারা যাত্রার আসরে, প্রাচীন ইওরোপীয় চিত্রে এবং ইসলামী সভায় ও মিছিলে দেখতে পাওয়া যায়।

ব্রহ্মা গড ও আল্লা—এঁদের মেজাজ একরকম নয়। ঠাট্টা তামাশায় কোনও হিন্দু দেবতা চটেন না ব্রহ্মার তো কথাই নেই, তিনি সম্পর্কে সকলেরই ঠাকুরদা। গড় অত্যন্ত গম্ভীর, তবে সম্প্রতি তাঁর কিঞ্চিৎ রসবোধ হয়েছে, তাঁকে নিয়ে একটু আধটু পরিহাস করা চলে। কিন্তু আল্লা শুধু দৃষ্টির অতীত বাক্যের অতীত নন, পরিহাসেরও অতীত। পাকিস্তানী শাসনতন্ত্রের মুখবন্ধে যে আল্লার আধিপত্য ঘোষণা করা হয়েছে তা মোটেই তামাশা নয়।

কালিদাস লিখেছেন, মহাদেবের তপস্যার সময় নন্দীর শাসনে গাছপালা নিস্পন্দ হল, ভোমরা-মৌমাছি চুপ করে রইল, পাখি বোবা হল, হরিণের ছুটোছুটি থেমে গেল,—সমস্ত কানন যেন ছবিতে আঁকা। তিন বিধাতার সমাগমে সুমেরু পর্বতেরও সেই অবস্থা হল…কিন্তু এঁরা ধ্যানস্থ না হয়ে তর্ক আরম্ভ করলেন দেখে স্থাবর জঙ্গম আশ্বাস পেয়ে ক্রমশ প্রকৃতিস্থ হল।

ব্রহ্মাকে দেখেই জিহোভারূপী গড ভ্রুকুটি করে বললেন, তুমি কি করতে এসেছ? তোমাকে তো আজকাল কেউ মানে না, শুধু বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে তোমার ছবি ছাপা হয়। কৃষ্ণ শিব কালী বা রামচন্দ্র এলেও কথা ছিল।

ব্রহ্মা বললেন, তাঁরা আমাকেই প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন।

পীরসাহেব অবাক হয়ে ব্রহ্মার দিকে চেয়ে আছেন দেখে নারদ বললেন, কি দেখছ সাহেব?

পীর চুপি চুপি বললেন, এঁর তো চারো তরফ চার মুহ। বিছানায় শোন কি করে?

নারদ। শোবার জো কি! ভর রাত ঠায় বসে থাকেন। ইনি ঘুমুলে তো প্রলয় হবে।

পীর। ইয়া গজব!

সেন্ট পিটার করজোড়ে বললেন, এখন সভার কাজ শুরু করতে আজ্ঞা হোক।

ব্রহ্মা বললেন, মাই হেভনলি ব্রাদার্স, মেরে আসমানী বরাদরান, আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে। এই সভায় একজন সভাপতি স্থির করা। আমি বয়সে সব চেয়ে বড়, অতএব আমিই সভাপতিত্ব করব।

গড বললেন, তা হতেই পারে না। তুমি হচ্ছ তেত্রিশ কোটির একজন, আর আমি হচ্ছি একমাত্র অদ্বিতীয় ঈশ্বর—

ঝাণ্ডার দিকে সম্ভ্রমে দুই হাত বাড়িয়ে পীরসাহেব বললেন, ইনিও, ইনিও।

গড। বেশ তো, আমি আর ইনি দুজনেই একমাত্র অদ্বিতীয় ঈশ্বর। কিন্তু আমি হচ্ছি সিনিয়র, অতএব আমিই সভাপতি হব।

ব্রহ্মা। দাদা, কত দিন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চালাচ্ছ? জগৎ সৃষ্টি করেছ কবে?

গড। আমার পুত্র যিশু জন্মাবার প্রায় চার হাজার বৎসর আগে।

ব্রহ্মা। তার আগে কি করা হত?

গড। বাংলা বাইবেল পড়নি বুঝি? ঈশ্বরের আত্মা জলমধ্যে নিলীয়মান ছিল।

ব্রহ্মা। অর্থাৎ ডুব মেরে ঘুমুচ্ছিলো আমাদের নারায়ণ ডোবেন না, ভাসতে ভাসতে নিদ্রা যান। আল্লা তালা কি বলেন?

পীর। কোরান শরিফ পড়ে দেখবেন, তাতে সব কুছ লিখা আছে।

গড। ব্ৰহ্মা, তুমি না বিষ্ণুর নাইকুণ্ডু থেকে উঠেছিলে? তোমারও নাকি জন্মমৃত্যু আছে?

ব্রহ্মা। তাতে কি হয়েছে। আমার এক-একটি জীবনকালই যে বিপুল, একত্রিশের পিঠে তেরটা শূন্য দিলে যত হয় তত বৎসর। তুমি যখন জলমধ্যে নিলীয়মান ছিলে তখনও আমি দেদার সৃষ্টি করেছি।

নারদ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, প্রভুরা, আমি বলি কি কে বড় কে ছোট সে তর্ক এখন থাকুক। আপনারা তিনজনই সভাপতিত্ব করুন।

সেন্ট পিটার বললেন, সেই ভাল। পীরসাহেব নীরবে ডাইনে বাঁয়ে উপরে নীচে মাথা নাড়তে লাগলেন।

নারদ বললেন, আপনাদের কষ্ট দিয়ে এখানে ডেকে আনার উদ্দেশ্য—জগতে যাতে শান্তি আসে মারামারি কাটাকাটি দ্বেষ হিংসা অত্যাচার প্রতারণা লুণ্ঠন প্রভৃতি পাপকার্য যাতে দূর হয় তার একটা উপায় স্থির করা।

ব্রহ্মা। গড ভায়া, তুমিই একটা উপায় বাতলাও।

গড। উপায় তো বহুকাল আগেই বলে দিয়েছি। জগতের সমস্ত লোক যিশুর শরণাপন্ন হোক, তাঁর উপদেশ মেনে চলুক, দু-দিনে শান্তি আসবে, পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হবে।

ব্রহ্মা। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছ লোকে যিশুর উপদেশ মানছে না। তবু তুমি চুপ করে আছ কেন? তোমার বজ্র ঝঞ্চা মহামারী অগ্নিবৃষ্টি এসব কি হল?

গড়া সবই আছে, তেমন দেখলে অন্তিম অবস্থায় প্রয়োগ করব, এখন নয়। আমি মানুষকে কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছি, যাকে বলে ফ্রি উইল। মানুষ যদি জেনে শুনে উৎসন্নে যায় তো আমি নাচার।

ব্রহ্মা। তা হলে মানছ যে মানুষের কুবুদ্ধি দূর করবার শক্তি তোমার নেই! আল্লা তালার মত কি?

পীর। দুনিয়ার লোক যদি ইসলাম মেনে নেয় তবে সব দুরস্ত হয়ে যাবে।

নারদ। যারা মেনে নিয়েছে তাদেরও তো গতিক ভাল দেখছি না। আল্লা তাদের খৈরিয়ত করেন না কেন?

পীর। আগে সকলকে পাকিস্তানের সঙ্গে একদিল হতে হবে।

নারদ। তা তো হচ্ছে না আল্লা। জোর করে সকলকে একদিল করে দেন না কেন?

পীর। আল্লার মর্জি।

গড। শোন ব্রহ্মা আমি একজোড়া নিষ্পাপ মানুষ-মানুষী সৃষ্টি করে তাদের ইদং কাননে রেখেছিলুম। তারা শান্তিতে ছিল, কিন্তু তোমাদের তা সইল না। তোমার এক বংশধর সেখানে গিয়ে কুমন্ত্রণা দিয়ে আদম আর হবাকে নষ্ট করলো।

ব্রহ্মা। সে তো শয়তান করেছিল, তোমারই এক বিদ্রোহী অনুচর।

গড। শয়তান অতি বজ্জাত কিন্তু আদম-হবাকে সে নষ্ট করে নি, করেছিল বাসুকি, তোমারই এক প্রপৌত্র।

ব্রহ্মা। বাসুকি? সাপ হলেও সে অতি ভাল ছোকরা, কুমন্ত্রণা কখনই দেবে না। আচ্ছা, তাকেই জিজ্ঞাসা করা যাক। নারদ, ডাক তো বাসুকিকে।

নারদ হাঁক দিলেন–বাসুকি, ওহে বাসুকি—

নিকটেই একটি দেবদারু গাছের ডালে ল্যাজ জড়িয়ে বাসুকি ঝুলছিলেন। ডাক শুনে সড়ক করে নেমে এলেন। দণ্ডবৎ হয়ে ব্রহ্মাকে প্রণাম করে বললেন, কি আজ্ঞা হয় পিতামহ?

ব্রহ্মা। হাঁ হে, তুমি নাকি ইদংকাননে গিয়ে হবা আর আদমকে নষ্ট করেছিলে?

বাসুকি তাঁর চেরা জীব কামড়ে বললেন, ছি ছি, তা কখনও পারি? ভুল শুনেছেন প্রভু যদি অভয় দেন তো প্রকৃত ঘটনা নিবেদন করি।

ব্রহ্মা। অভয় দিলুম। তুমি ব্যাপারটা প্রকাশ করে বল।

বাসুকি বলতে লাগলেন।–সে কি আজকের কথা। সমুদ্রমন্থনের পর আমার সর্বাঙ্গে অত্যন্ত বেদনা হয়েছিল। দুই অশ্বিনীকুমারকে জানালে তাঁরা বললেন, ও কিছু নয়, হাড় ভাঙে নি, শুধু মাংস একটু থেঁতলে গেছে। দিন কতক হাওয়া বদলে এস, সেরে যাবে। তখন আমি পৃথিবী পর্যটন করতে লাগলুম। বেড়াতে বেড়াতে একদিন তৌরস পর্বতের পাদদেশে এসে দেখলুম উপরে একটি চমৎকার উপবন রয়েছে। ঢোঁড়া সাপের রূপ ধরে পাহাড়ের খাড়া গা বেয়ে সড়সড় করে উপরে উঠলুম। দেখলুম দুটি নরনারী সেখানে বন্দী হয়ে আছে। তারা একেবারে অসভ্য, কিছুই জানে না, লজ্জাবোধও নেই। দেখে আমার দয়া হল। মেয়েটির কাছে গিয়ে মধুর স্বরে বললুম, অয়ি সর্বাঙ্গসুন্দরী, তুমি কার কন্যা, কার পত্নী? তোমার পরনে কাপড় নেই কেন? চুল বাঁধনি কেন? নখ কাটনি কেন? গলায় হার পরনি কেন? ওই যে ষণ্ডা জংলী পুরুষটা ঘাস কাটছে, ওটা কে? তোমাদের চলে কি করে? খাও কি?

আমার সম্ভাষণে মেয়েটি খুশী হল। একটু হেসে বললে, আমি হচ্ছি হবা। ওর নাম আদম, আমার বর। আমি কারও কন্যা নই, আদমের পাঁজরা থেকে জিহোভা আমাকে তৈরি করেছেন। আমরা এখানে চাষবাস করি, ফলমূল খাই, মনের আনন্দে গান গাই আর নেচে বেড়াই।

জিজ্ঞাসা করলুম, কি ফল খাও? আম কাঁঠাল কলা আছে?

হবা বললে, আখরোট আঙুর আনার আবজুস আঞ্জীর এইসব মেওয়া খাই। শুধু ওই গাছটার ফল খাওয়া বারণ। জিহোভা বলেছেন, খেলে সর্বনাশ হবে, আক্কেল খুলে যাবে, ভালমন্দের জ্ঞান হবে।

আমি ল্যাজে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সেই জ্ঞানবৃক্ষের একটা ফল কামড়ে খেলুম। দন্তস্ফুট করা একটু শক্ত, কিন্তু বেশ খেতে খোসা নেই, বিচি নেই, ছিবড়ে নেই, যেন কড়া পাকের সন্দেশা পিতামহ, আপনি সর্পজাতিকে আক্কেলদাঁত দেন নি, কিন্তু সেই ফলটি খাওয়া মাত্র আমার চারটি আক্কেলদাঁত ঠেলা দিয়ে বেরুল, বুদ্ধি টনটনে হল, কর্তব্য সম্বন্ধে মাথা খুলে গেল। হবাকে বললুম, ও বাছা, অ্যাদ্দিন করেছো কি, এমন ফল খাও নি?

–প্রভুর যে বারণ আছে।

—দুত্তোর বারণ। বুড়োদের কথা সব সময় শুনতে গেলে কিছুই খাওয়া হয় না। আমি বলছি, তুমি এক কামড় খেয়ে দেখ।

–যদি আক্কেল খুলে যায়?

—কোথাকার ন্যাকা মেয়ে তুমি। আক্কেল তো খোলাই দরকার, চিরকাল উজবুক হয়ে থাকতে চাও নাকি? নাও, এই দুটো ফল পেড়ে দিচ্ছি, একটা তুমি খাও, আর একটা ওই জংলী ভূত আদমকে খাওয়াও।

হবা নিজে বড় ফলটা খেয়ে ছোটটা আদমকে দিলে। তার পরেই জিব কেটে ছুটে পালাল। একটু পরে একটা ডুমুরপাতার ঝালর পরে ফিরে এসে বললে, এইবার কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?

–বাঃ, অতি চমৎকার, কোথায় লাগে উর্বশী রম্ভা মেনকা!

হবা ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ কুঁচকে বললে, আমার হার নেই, চুড়ি নেই, চিরুনি নেই, আলতা নেই, ঠোঁটে দেবার রং নেই—

বললুম, সব হবে, ওই আদমকে বল?

আরও ঠোঁট ফুলিয়ে হবা বললে, ও বিশ্রী, কিচ্ছু দেয় না, ওর কিচ্ছু নেই। তুমি দাও, আমি তোমার কাছে থাকব, হুঁ—

বললুম, আমি ওসব কোথায় পাব? ওর হাত পা আছে, আমার তাও নেই। সাপের সঙ্গে তুমি ঘর করবে কি করে? আমার আবার পঞ্চাশটা সাপিনী আছে, তোমাকে দেখেই ফোঁশ করে উঠবে। ভাবনা কি খুকী, তোমার বরের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে আবদার কর তা হলেই ও রোজগার করতে যাবে, যা চাও সব এনে দেবে।

এমন সময় হঠাৎ ঝড় উঠল, বিদ্যুৎ চমকানির সঙ্গে বজ্রনাদ হতে লাগল। দেখলুম দূর থেকে তালগাছের মতন লম্বা এক ভয়ঙ্কর পুরুষ কোঁতকা নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছেন বুঝলুম ইনিই জিহোভা। আমি হেলে সাপের রূপ ধরে সুড়ুৎ করে পালিয়ে গেলুম।

গড বললেন, শুনলে তো, বাসুকি দোষ কবুল করছে।

ব্রহ্মা। দোষ কোথায়? তুমি দুটি প্রাণী সৃষ্টি করে তাদের অজ্ঞানের অন্ধকারে রেখেছিলে। সামনে জ্ঞানবৃক্ষ রেখেও তার ফল খেতে বারণ করেছিলে। বাসুকি দয়া করে তাদের জ্ঞানদান করেছে।

গড। ছাই করেছে, আমার উদ্দেশ্যই পণ্ড করেছে। সেই আদিম মানব-মানবীর আদিম অবাধ্যতার ফলেই জগতে পাপ আর দুঃখকষ্ট এসেছে।

সেন্ট পিটার বললেন, শ্রীকৃষ্ণও তো অজ্ঞদের বুদ্ধিভেদ করতে বারণ করেছেন।

নারদ। ভুল বুঝেছ বাবাজী তাঁর কথার অর্থ—বোকা লোকদের বাজে তর্ক করতে শিখিও না। যারা চালাক তাদের তিনি বুদ্ধিযোগে চর্চা করতে বলেছেন।

সেন্ট পিটার। কিন্তু হবা আর আদম তো বোকাই।

নারদ। আরে তারা যে আদিম মানব-মানবী, শিশুর সমান। যদি চিরকাল বোকা করে রাখাই উদ্দেশ্য হয় তবে মানুষ সৃষ্টি করার কি দরকার ছিল? ভেড়া গরুর মতন আরও জানোয়ার তৈরি করে লাভ কি? আমাদের পিতামহের কীর্তি দেখ দিকি, প্রথমেই পয়দা করলেন দশজন প্রজাপতি, মরীচি অত্রি প্রভৃতি দশটি বিদ্যাবুদ্ধির জাহাজ।

জলদগম্ভীর স্বরে গড বললেন, চোপ, গোল করো না। আমার আদেশ লঙ্ঘন করে হবা আর আদম যে আদিম পাপ করেছিল তার ফলেই তাদের সন্ততি মানবজাতি অধঃপাতে যাচ্ছে। এখন যদি সকলে যিশুর শরণ নেয় তো রক্ষা পাবে।

ব্রহ্মা। লোকে যখন যিশুর শরণ নিচ্ছে না তখন ফ্রি উইল বাতিল করে শ্রেয়স্করী বুদ্ধি নাও না কেন?

সেন্ট পিটার। ঈশ্বরের অভিপ্রায় বোঝা মানুষের অসাধ্য।

নারদ। আমাদের পিতামহ ব্রহ্মা তো মানুষ নন, তাঁকে অভিপ্রায় জানালে ক্ষতি কি? প্রভু গড হয় প্রভুব্রহ্মার কানে কানে বলুন।

পীর। আল্লার যদি মর্জি হয় তবে এক লহমায় বিলকুল শাইস্তা করে দিতে পারেন।

নারদ। তবে শাইস্তা করেন না কেন?

পীর। যদি মর্জি না হয় তবে শাইস্তা করেন না।

নারদ। বুঝেছি, সব প্রভুই লীলা খেলা খেলেন।

গড। চুপ কর তোমরা। ব্রহ্মা, তুমি কেবল উড়ো তর্ক করছ, যেন আমিই আসামী আর তুমি হাকিম। তোমার প্রজারাও তো কম বদমাশ নয়, তাদের শাসন কর না কেন? তাদেরও ফ্রি উইল আছে নাকি?

ব্রহ্মা। ফ্রি উইল থাকবে কেন? আমার প্রজারা অত্যন্ত বাধ্য, যেমন চালাচ্ছি তেমনি চলছে, আবার কর্মফলও ভোগ করছে।

গড। অর্থাৎ তুমিই তাদের দিয়ে কুকর্ম করাচ্ছ।

ব্রহ্মা। সুকর্ম কুকর্ম সবই করাচ্ছি।

গড। তোমার নীতিজ্ঞান নেই। আমি তোমার মতন পাপের প্রশ্রয় দিই না, এক দল পাপীকে মারবার জন্য আর এক দল পাপী উৎপন্ন করেছি, পরস্পরকে ধ্বংস করবার জন্য দু দলকেই বজ্র দিয়েছি।

পীর। ইয়া গজব, ইয়া গজব! হারামজাদোঁকে দুশমন হারামজাদে!

ব্রহ্মা। তুমি কি মনে কর এই মারামারির ফলে সুবুদ্ধি আসবে?

গড। বেশ ভাল রকম ঘা খেলে ফ্রি উইলই পন্থা বাতলে দেবে, বেগতিক দেখলে সকলেই যিশুর শরণ নেবো।

পীর। নহি জী, নহি জী।

গড। ব্রহ্মা, এইবার তোমার জেরা বন্ধ কর। তুমি নিজে কি করতে চাও তাই বল।

ব্রহ্মা। কিছুই করতে চাই না। বিশ্বের বিধান তৈরি করে আমি খালাস।

গড। কেন, তুমি দয়াময় নও?

ব্রহ্মা। আমি নই। হরিকে লোকে দয়াময় বলে বটে।

গড। তুমি সর্বশক্তিমান নও? তোমার সৃষ্টির একটা উদ্দেশ্য নেই?

ব্রহ্মা। যার শক্তি কম তারই উদ্দেশ্য থাকে। যে সর্বশক্তিমান তার উদ্দেশ্য তো সিদ্ধ হয়েই আছে, তার দয়া করবারই বা দরকার হবে কেন? আসল কথা চুপি চুপি বলছি শোনা লোকে আমাদের সৃষ্টিকর্তা বলে, কিন্তু মানুষও আমাদের সৃষ্টি করেছে। যে লোক নিজে নির্দয় সেও একজন দয়ালু ভগবান চায়। যে নিজের তুচ্ছ শক্তি কুকর্মে লাগায় সেও একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর চায় যিনি তার সকল কামনা পূর্ণ করবেন। মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির আশায় আমাদের দয়ালু আর সর্বশক্তিমান বানাতে চায়।

গড়া ওসব নাস্তিকের বুলি ছেড়ে দাও। স্পষ্ট করে বল—মানুষ পাপ করলে তুমি রাগ কর? ভাল কাজ করলে তুমি খুশী হও?

ব্রহ্মা তাঁর চার মাথা সজোরে নাড়তে লাগলেন।

নারদ গুনগুন করে বললেন, নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ–প্রভু কারও পাপপুণ্য গ্রাহ্য করেন না।

গড। ব্রহ্মা, তুমি অতি কুচক্রী, মানুষ উৎসন্নে যেতে বসেছে, তবু তুমি নিশ্চিন্ত থাকবে? কিছুই করবে না?

ব্রহ্মা। তোমরাই বা কি করছ? ব্যস্ত হও কেন, অনন্ত কাল তো সামনে পড়ে আছে। মানুষ নানারকম সুকর্ম কুকর্ম করে ফলাফল পরীক্ষা করছে, কিসে তার সব চেয়ে বেশী লাভ হয়, তা খুঁজছে। যখন সে পরম স্বার্থসিদ্ধির উপায় আবিষ্কার করতে পারবে তখন মানবসমাজে শান্তি আসবে। যতদিন না তা পারবে ততদিন মারামারি কাটাকাটি চলবে।

গড। তবে তুমিও ফ্রি উইল মান?

ব্রহ্মা। খেপেছ!

নারদ তাঁর কচ্ছপী বীণায় ঝংকার তুলে বললেন, ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদদেশেড়র্জুন তিষ্ঠতি, ভ্ৰাময়ন সর্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়া মায়য়া—হে অর্জুন, ঈশ্বর সকল প্রাণীর হৃদয়ে আছেন এবং ভেলকি লাগিয়ে তাদের চরকিতে চড়িয়ে ঘোরাচ্ছেন।

সেন্ট পিটার বললেন, আমাদের প্রভু প্রেমময় পরম কারুণিক, সর্বশক্তিমান—

নারদ। কিন্তু শয়তানকে জব্দ করতে পারেন না।

পীর। আল্লা মেহেরবান, তাঁর মতলব খুঁজতে গেলে গুনাহ হয়। আল্লার রিয়াসতে কুছ ভি বুরা কাম হয় না।

ব্রহ্মা। শোন ভাই গড—মানুষ নিজে যখন প্রেমময় আর কারুণিক হবে তখন আমরাও তাই হব। তার আগে কিছু করবার নেই।

সেন্ট পিটার। বলেন কি! আপনারা যদি হাল ছেড়ে দেন তবে লোকে যে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারাবে। তিনজনে যখন এখানে এসেছেন তখন কৃপা করে একটা ব্যবস্থা করুন যাতে মানুষে মানুষে মিল হয়।

পীর। কভি নহি হো সকতা। আল্লার প্রজা হচ্ছে মিঠা শরবত, গডের প্রজা তেজী শরাব এদের মিল হতে পারে, শরবত আর শরাব বেমালুম মিশে যায়। কিন্তু এই হজরত ব্রহ্মার প্রজা হচ্ছে বদবুদার অলকতা।

সহসা আকাশ অন্ধকার হল, একটা ঝটপট শব্দ শোনা গেল, যেন কেউ প্রকাণ্ড ডানা নাড়ছে। ব্রহ্মা বললেন, বিষ্ণু আসছেন নাকি? গরুড়ের পাখার শব্দ শুনছি।

নারদ বললেন, গরুড় নয়। দেখছেন না, বাদুড়ের মতন ডানা, কালো রং, মাথায় শিং পায়ে খুর, ল্যাজও রয়েছে। শ্রীশয়তান আসছেন।

সেন্ট পিটার চিৎকার করে বললেন, অ্যাভন্ট, দূর হ! পীরসাহেব হাত নেড়ে বললেন, গুম শো, তফাত যাও! গড তাঁর আলখাল্লার পকেটে হাত দিয়ে বজ্র খুঁজতে লাগলেন।

ব্রহ্মা বললেন, আহা আসতেই দাও না, আমরা তো কচি খোকা নই যে জুজু দেখলে ভয় পাব।

শয়তান অবতীর্ণ হয়ে মিলিটারি কায়দায় অভিবাদন করে বললেন, প্রভুগণ, যদি অনুমতি দেন তো কিঞ্চিৎ নিবেদন করি। গড মুখ গোঁজ করে রইলেন। সেন্ট পিটার আর পীরসাহেব চোখ বুজে কানে আঙুল দিলেন। ব্রহ্মা সহসা বললেন, কি বলতে চাও বৎস?

শয়তান বললেন, পিতামহ, আপনারা তিন বিধাতা এখানে এসেছেন, এমন সুযোগ আর মিলবে না সেজন্য আপনাদের সঙ্গে একটা চুক্তি করতে এসেছি। জগতের সমস্ত ধনী মানী মাতব্বর লোকেরা আমাকে তাঁদের দূত করে পাঠিয়েছেন তাঁরা চান কর্মের স্বাধীনতা, কিন্তু তার ফলে ইহলোকে বা পরলোকে তাঁদের কোনও অনিষ্ট যেন না হয়। এর জন্য তাঁরা আপনাদের খুশী করতে প্রস্তুত আছেন।

ব্ৰহ্মা। অর্থাৎ তাঁরা বেপরোয়া দুষ্কর্ম করতে চান। মূল্য কি দেবেন? চাল-কলার নৈবেদ্য? হোমাগ্নিতে সের দশেক ভেজিটেবল ঘি ঢালবেন?

শয়তান। না প্রভু, ওসব দিয়ে আপনাদের আর ভোলানো যাবে না তা তাঁরা বোঝেন। তাঁরা যা রোজগার করবেন তার একটা অংশ আপনাদের দেবেনা।

ব্রহ্মা। নগদ টাকা আমরা নিতে পারি না।

শয়তান। নগদ টাকা নয়। আপনাদের খুশী করবার জন্য তাঁরা প্রচুর খরচ করবেন। মন্দির গির্জা মসজিদ মঠ আতুরাশ্রম বানাবেন, হাসপাতাল রেড ক্রস স্কুল কলেজ টোল মাদ্রাসায় এবং মহাপুরুষদের স্মৃতিরক্ষার জন্য মোটা টাকা দেবেন, বুভুক্ষুকে খিচুড়ী খাওয়াবেন, শীতার্তকে কম্বল দেবেন। আপনার মানসপুত্রদের বংশধর কে কে আছেন বলুন, তাঁদের বড় বড় চাকরি আর মোটরকার দেওয়া হবে এইসবের পরিবর্তে আপনারা আমার মক্কেলগণকে নিরাপদে রাখবেন।

ব্রহ্মা। কত খরচ করবেন?

শয়তান। ধরুন তাঁদের উপার্জনের শতকরা এক ভাগ।

ব্রহ্মা। তাতে হবে না বাপু।

শয়তান। আচ্ছা, দু পারসেন্ট।

ব্রহ্মা। আমাকে দালাল ঠাউরেছ নাকি?

শয়তান। পাঁচ পারসেন্ট? দশ-পনের—বিশ? আচ্ছা, না হয় শতকরা পঁচিশ ভাগ আপনাদের প্রীত্যর্থে খয়রাত করা হবে তাতেও রাজী নন? উঃ, আপনার খাঁই দেখছি দেশসেবকদের চাইতেও বেশী। ক বছর জেল খেটেছেন প্রভু? আচ্ছা, আপনিই বলুন কত হলে খুশী হবেন?

ব্রহ্মা। শতকরা পুরাপুরি এক-শ চাই।

নারদ। ওহে শয়তান, প্রভু বলছেন, কর্মের সমস্ত ফল সমর্পণ করতে হবে তবেই নিষ্কৃতি মিলবে।

শয়তান। তা হলে তো রোজগার করাই বৃথা যদি সবই ছেড়ে দিতে হয় তবে চুরি ডাকাতি লুটপাট মারামারি করে লাভ কি?

ব্রহ্মা। এই কথা তোমার মক্কেলদের বুঝিয়ে দিও। কিছু হাতে রেখে চুক্তি করা যায় না। গড আর আল্লা তালা কি বলেন? কই, এঁরা সব গেলেন কোথা?

নারদ। সবাই অন্তর্হিত হয়েছেন।

শয়তান। তবে আমিও যাই পিতামহ। আপনি তো নিরাশ করলেন।

ব্রহ্মা। একটু থাম, শুধু হাতে ফিরে যেতে নেই। একটা বর দিচ্ছি—বৎস শয়তান, পুরুত পাদরী মোল্লা, পুলিশ সৈন্য বা মিলিত জাতিসংসদ, কেউ তোমাকে বাধা দেবে না, তোমার মক্কেলদের তুমি নির্বিঘ্নে নরক করতে পারবে। তারপর আমি আবার মানুষ সৃষ্টি করর। নারদ, এখন যাই চল, আমার হাঁসটাকে ডেকে আনা।

নারদ। প্রভু, সে মানস সরোবরে চরতে গেছে, এত শীঘ্র সভাভঙ্গ হবে, তা তো জানত না। আপনি আমার ঢেঁকিতেই চলুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *