সাহিত্য
ভাষার কথা
ভারতবর্ষ
সমাজ
বিচিত্র

তেল নুন লকড়ি

তেল নুন লকড়ি

যেমন আমরা অতীতে বিদেশীয়তা স্বদেশীরকমে অভ্যাস করেছি, তেমনি আমাদের ভবিষ্যতে স্বদেশীয়তা বিদেশী নিয়মে চর্চা করতে হবে। আমরা সাহেব হয়েছিল বাঙালি ভাবে। সে ব্যাপারটার মধ্যে আমাদের স্বাভাবিক ঢিলেমি এবং এলোমেলো ভাবেরই শুধু পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা দল বেধে বিধিব্যবস্থাপক সাহেব হই নি। প্রতিজনেই নিজের খুশি কিংবা সুবিধা-অনুসারে নিজের চরিত্র এবং ক্ষমতার উপযোগী হঠাৎ-সাহেব হয়ে উঠেছি। ইগবগ-সমাজে আমরা সবাই স্বাধীন, সবাই প্রধান। স্বদেশী আচার-ব্যবহার ছাড়বার সময় আমরা পুরুষেরা পহিলা সমিতি করি নি, এখন ফিরে ধরবার ইচ্ছেয় আমরা মহিলা-সমিতি পর্যন্ত গঠন করেছি। এই যথেষ্ট প্রমাণ যে, আমাদের নতুন ভাব কার্যে পরিণত করতে হলে ভাবনা-চিন্তা চাই; কি রাখব, কি ছাড়ব, তার বিচার চাই; পাঁচজনে একত্র হয়ে কি করতে পারব এবং কি করা উচিত, তার একটা মীমাংসা করা চাই; এক কথায়, ইংরেজ যে উপায়ে কৃতকার্য হয়েছে সেই উপায়-একটা পদ্ধতি অবলম্বন করা চাই। সমাজ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবার ভিতর নিয়ম নেই। ঝোঁকের মাথায় রোখের সহিত কাজ করতে গেলে দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হওয়াই দরকার। কিন্তু সমাজে থাকতে কিংবা ফিরতে হলে সকলেরই মানসিক গতি একই কেন্দ্রের অভিমুখী হওয়া চাই, এক নিয়মে অনেককে ধরা দেওয়া চাই। আমাদের বিদেশীয়তার ভিতর হিসাব ছিল না, স্বদেশীয়তার ভিতর হিসাব চাই। যে পরিবর্তনের জন্য আমরা উৎসুক হয়েছি, তার বিষয় হচ্ছে প্রধানত বাহ্যবস্তু। কিন্তু সেই পরিবর্তন সসাধ্য করতে হলে মনকে অনেকটা খাটাতে হবে। সমাজে থাকতে হলে বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষ কোনো চর্চা করবার দরকার নেই, প্রচলিত নিয়মের নির্বিচারে দাসত্ব স্বীকার করলেই হল; ছাড়তে হলেও দরকার নেই—নির্বিচারে নিয়ম লঙ্ঘন করলেই হল। কিন্তু ফিরতে হলে মানুষ হওয়া চাই; কারণ যে ফেরে, সে নিজের জ্ঞান এবং বুদ্ধির যারা কর্তব্য স্থির করে নিয়ে স্বেচ্ছায় ফেরে। আমরা বাঙালি-সাহেবই হই, আর খাঁটি বাঙালিই হই, আমরা সকলেই এক পথের পথিক হয়েছিলুম; কেউ-বা বিপথে বেশি দূর এগিয়েছি, কেউ-বা কিছু পিছিয়ে আছি। আমাদের সমাজ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকেই বর্ণচোরা বাঙালি-সাহেব। আমাদের হিন্দুসমাজে শখলা অতীতে গঠিত হয়েছিল, আজকালকার দিনে নতুন অবস্থায় কতকাংশে তা সকলেরই পক্ষে শখল মনে হয়। আমরা জনকতক শুধু উচ্ছল হয়েছি, বাদবাকি সকলে সমাজকে বিশখল করে ফেলেছেন। সুতরাং সকলে মিলেই ঘদেশীয় আচারব্যবহারে ফিরে যাবার জন্য ব্যগ্র হয়েছি। সকলেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, সুতরাং যে পরিমাণে সাধ্য এবং উচিত সেই পরিমাণে ফিরব, তার বেশি নয়। জাতীয় জীবনের বিশেষ কোনো লক্ষ্য ছিল না বলে এতদিন আমরা গা ঢেলে দিয়ে স্রোতে ভাসছিল, তার ভিতর কোনো আয়াস, কোনো চেষ্টা ছিল না; এখন গমনের একটা ঠিকানা পাওয়া গেছে, সুতরাং সাঁতার কাটতে হবে। শুধু এলোমেলোভাবে, অতিবেগে হাত-পা ছুড়লে চলবে না; তাতে পাঁচজনে হাসবে, দশজনে ‘বাহবা কি বাহবা, কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ’ বলবে, কিন্তু আমরা লাভের মধ্যে শীঘ্রই এলিয়ে পড়ব এবং নাকানিচোবানি খাব।

পূর্বেই বলেছি যে, আমরা বাঙালিমাত্রেই ঐ একই বিলেতি ক্ষরে মাথা মুড়িয়েছি। শুধু কারো মাথায় কাকপক্ষ অবশিষ্ট, কারো মাথায়-বা শুধু টিকি; যাঁর যেটকু অবশিষ্ট আছে, তিনি সেইটেই স্বদেশীয়তার ধজাম্বরপ আস্ফালন করেন। এ ব্যাপারে আমাদের ইগবগ-দলের মন ভারি করবার কোনো কারণ নেই। ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে আমাদের জাতি যদি কোনো স্থায়ী সফল লাভ করে থাকে তো সে মনে, আর যা যা ক্ষণস্থায়ী কুফল লাভ করেছে, সে বাহ্য আচারব্যবহারে। মোটামুটি ধরতে গেলে এ ব্যাপারের লাভলোকসানের হিসাবটা ঐরূপ দাঁড়ায়। সেই আচার-ব্যবহারের বিজাতীয়তা আমাদের মধ্যে যেমন স্পষ্ট এবং জাজল্যমান হয়ে উঠেছে, এমন আর অন্য কোনো শ্রেণীর লোকের মধ্যে হয় নি। সকলেই অল্পবিস্তর বিলেতি মধু পান করেছেন, কিন্তু পুরো নেশা শুধু আমাদেরই ধরেছে। বিদেশী বন্ধুর বড়ো বস্তা আমরা মাথায় বহন করছি, অপরে পটলিপাঁটলা নিয়ে চলেছে। আমরা যদি আমাদের মাথার সে ভার নামাতে পারি, তা হলে অপরের পক্ষে তাদের মাথার সে ভার ঝেড়ে ফেলা কঠিন হবে না। এই ঘদেশীয়তার কথা শুধু দেশের কথা নয়, এ ঘরেরও কথা। বাঙালি যখন নিজের সমাজ ছাড়ে, তখন সেইসঙ্গে নিজের স্বভাব ছাড়ে না। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে; অর্থাৎ সেখানেও অপরের পায়ের চাপ না পেলে তার দিন চলে না। আমাদেরও স্বভাব তাই। নিজের সমাজের চাপ থেকে বেরিয়ে এসে বিদেশী সমাজের পায়ের চাপ আমরা পিঠে তুলে নিই। বাঙালিজাতকে পিটে গড়া হয় নি। আমরা ঢালাই হতে ভালোবাসি। এক ছাঁচ থেকে বেরোলে আমরা অন্য ছাঁচে না পড়লে ঠাণ্ডা হই নে। অনুকরণ আমাদের স্বাভাবিক। এবং অনুকরণে যেহেতু শুধু উপকরণ সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু কিছুই আত্মসাৎ করা যায় না, সেই কারণে আমরা বিলেতি সভ্যতার উপকরণে আমাদের দৈনিক জীবন নিতান্ত ভারাক্রান্ত করে তুলেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো অস্থি-মজ্জায় অনুভব করেছেন যে, বিলেতি সভ্যতার কুলিগিরির মজুরি পোষায় না। কিন্তু দু-একজন ছাড়া মুখ ফুটে সে কথা বলতে বড়ো কেউ সাহসী হন নি। দেশীয় সমাজের রীতিনীতির অধীনতার মধ্যে, কার্যের না হোক, চিন্তার স্বাধীনতা আছে। যার মন আছে, তার সামাজিক আচার-ব্যবহার সঘধে স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার এবং মতামত ব্যক্ত করবার অধিকার আছে; কিন্তু বিলাতের অনুকরণে যে বাঙালি ঘর বাঁধে, তার একল-ওকল দুলে যায়। আমাদের মধ্যে যার মন যত ঢিলে, তার সাহেবিয়ানার আঁটাআঁটি তত বেশি। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণ কোথায় যে বুঝতে পারে না, সে তার সর্বাঙ্গে হাতড়ে বেড়ায়। আমরা অনেকে একটা খোরপোশর বন্দোবস্ত করতে বিলেত যাই, সুতরাং বিলেতি সভ্যতার যে শুধু খাওয়া-পরার অংশটা আয়ত্ত করতে চেষ্টা করব, এর আর আশ্চর্য কি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, যে আরামের লোভে আমরা সর্বস্ব খোয়াতে বসি, সেই আরামই আমাদের জোটে না; দেশীয় সমাজের চালচলন শৈশব হতে অভ্যস্ত বলে সেদিকে মন দিতে হয় না, ঠিক ঠিক জিনিসটে অবলীলাক্রমে করে যাই; কিন্তু বিদেশী চালচলন সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই একটা বয়সে কেচেগণ্ডষ করতে হয়। একটু বয়েস হলে একটি বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করা যেমন কষ্টসাধ্য, একটি বিদেশী সমাজের হাজারো-এক খুঁটিনাটি আচার-ব্যবহার আয়ত্ত করাও তেমনি কঠিন। বিলেতি সভ্যতার সম্মুখে বাঙালি-সাহেবের আচল টানতে টানতে প্রাণ যায়। খানায়-পোশাকে যাঁরা সভ্যতা খোঁজেন, তাঁদের খানার-পোশাকের কায়দা-কানুন কস্ত করতে নাস্তানাবুদ খানেখারাপ হতে হয়। যাঁরা মাছিমারা নকল করতে চান, তাঁদের নিত্য দেখতে পাই, অক্ষরের পর অক্ষর ধরে বিদেশী হালচাল অভ্যেস করতে প্রাণান্ত-পরিচ্ছেদ হচ্ছে। অন্যকে বানান করে পড়তে শুনলে মায়াও করে, বিরক্তিও ধরে। সাধারণ ইবঙ্গের প্রতিও আমাদের ঐ মনোভাব। কাবো কারো বা বিলেতি সভ্যতার বর্ণপরিচয় হয়েছে, কিন্তু অর্থবোধ হয় নি। এতদ্দেশীয় মুসলমান মহিলার কোরানপাঠের মতো তাঁদের সভ্যতাচর্চার পরিশ্রমটা বৃথা যায়।

সংস্কারবশত হিন্দুসমাজের প্রতি যাঁদের প্রাণের টান আছে, অথচ শিক্ষাবশত যাঁরা সংস্কারমাত্রেরই অধীন নন, যাঁদের ধারণা যে ইউরোপের শিষ্য হওয়া এবং দাস হওয়ার ভিতর আকাশপাতাল প্রভেদ, যাঁরা বিলেতি আচার-ব্যবহার কতকপরিমাণে অবলম্বন করেন–হয় বুদ্ধির দ্বারা পরীক্ষা করে, নয় জীবনে পরীক্ষা করবার উদ্দেশ্যে—এক কথায় যাঁরা শ্যাম এবং কুল, দুইই রাখবার চেষ্টা করেন, তাঁরা আহেল বিলেতি ইগবগদের মতে কেন্দ্রভ্রষ্ট। বাদ-বাকি যাঁরা নিজের নিজের ব্যাবসা ব্যতীত অপর কোনো বিষয়ে কিঞ্চিন্মাত্র মনোপ্রয়োগ করাটা বুদ্ধিবৃত্তির বাজে-খরচ মনে করেন, তাঁরাই বুদ্ধিমান। কেন্দ্রভ্রষ্ট?-কোথাকার কোন সমাজের, কোন, কেন্দ্রভ্রষ্ট? এ প্রশ্ন করলে সকল বুদ্ধিমানই নিরুত্তর। পড়ানো-কাকাতুয়ার কপচানো বলির মতো যদি তাঁদের কথা নিরর্থক না হয়, যদি তাঁদের বক্তব্যের ভিতর মনের কার্য কিছু প্রচ্ছন্ন থাকে তো সে মনোভাব এই—তাঁরা প্রত্যেকেই এক-একটি কেন্দ্র, তাঁদের কাছ থেকে যে যতটা তফাত, সে ততটা কেচুত, ততটা উন্মার্গগামী। বিলেতফেরত-পাড়ায় প্রতি গৃহ একটি সৌরজগৎ; হয় কতা নয় গহিণী সেই জগতের কেন্দ্র; পরিবারের আর-সকলে গ্রহ-উপগ্রহের মতো তারই চারি পাশে পাক খায়, এখানে-সেখানে দু-একটি ধমকেতুও দেখা দেয়। আমাদের কারো গহ, হিন্দুগহের একটি পরিবতিত যুগপৎ পরিবর্ধিত ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণ মাত্র; কারোবা গৃহ বিলেতি গহের একটি নিকৃষ্ট ফোটোগ্রাফ মাত্র। আমরা কেউ-বা বিদেশীয়তাব দু-চার সিঁড়ি ভেঙেছি, কেউ-বা একলফে বিলেতি সভ্যতার মন্দিরের চড়ার উপরিথিত ত্রিশালের উপর গিয়ে চড়ে বসেছি।।

সাহেবিয়ানার প্রচণ্ড নেশায় বঙ্গসন্তানকে যে কতদূর বে-এক্তিয়ার করে ফেলতে পারে, তার প্রমাণ ধর্মতলার রঙ্গমন্দিরে ধর্মমন্দিরের প্রতিষ্ঠাথে করণ যাচাল বিদেশীয় পণ্ঠপোষকতায় ব্লো Tablcaux হ্বিভা Vivants অভিধেয় বিচিত্র চিত্র-অভিনয়। নেশা ধরা পড়ে দুই জিনিসে অবিক্ষেপে এবং বাক্যবিপর্যয়ে। এ ব্যাপারে দুই লক্ষণেরই সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। ঐ দশ-কাব্যের পিছনে একটি দর্শন আছে, একটি কবিত্ব আছে; সেই কবিত্বপর্ণ দর্শন কিংবা দার্শনিক কবিত্বের প্রকাশ নিউ ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে। উক্ত ব্যাপারের সপক্ষে নিউ ইন্ডিয়ার মতামত, ইন্ডিয়া না হোক নিউ বটে। জস্টিস অনকল মোজির জীবনীর ভাষা যেমন নতুন, এর ভাবও তেমনি নতুন; এবং উভয় রচনাই এক উপায়ে সিদ্ধ হয়েছে। ইংরেজি ফরাসি লাটিন গ্রীক এবং ইটালিয়ান নানা ছোটো-বড়ো বাছা-বাছা বাক্য ও পদের অসংগত সমাবেশে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের জীবনীলেখকের রচনা ভাষার রাজ্যে যেমন এক অপূর্ব কীর্তি, জীবতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব ইতিহাস পরাণ ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সকল শাস্যের ছোটো-বড়ো নানা বাছা-বাছা শব্দ এবং বাক্যের অসংগত সমাবেশে সম্পাদক মহাশয়ের রচনা চিতার রাজ্যে তেমনি এক অপরকীর্তি। লেখক কিছুই বাদ দেন নি-চিত্রকলাও নয়, নত্যকলাও নয়। কলাবিদ্যার কতকটা জ্ঞান অনেকটা চার উপর নির্ভর করে, কিন্তু অসমসাহসী লেখকের পক্ষে ঠিক তার উলটো। দাম্ভিকতার বলে অজ্ঞতা বিজ্ঞতার সিংহাসনে অধিরোহণ করতে পারে। কলাবিদ্যার শুধু শেষাংশ দেখাবার চেষ্টা করে অনেকে, তাঁরা যে শুধু তার প্রথমাংশ জানেন, এই প্রমাণ করেন। এ বিশ্ব ভগবানের লীলাখেলা হতে পারে, কিন্তু সমাজের সৃষ্টি স্থিতি এবং উন্নতি মানুষের লীলাখেলার ফল নয়। এই প্রবধে উক্ত ব্যাপারের অবতারণা করবার একটু বিশেষ সার্থকতা আছে। আমাদের নকল সভ্যতা এর উধে আর উঠতে পারে না। আমাদের দোলের ঐ শেষসীমা, পেণ্ডুলমকে ঐখান হতেই ফিরতে হবে, এবং কার্যত ফিরতে আরম্ভ করেছে। ঘরে বিদেশী অনাচারের ঠেলা এবং বাইরে বিদেশী অত্যাচারের চাপ, এই দুয়ের ভিতর পড়ে যাঁরা কিঞ্চিৎ বেদনা অনুভব করছিলেন, তাঁদের অনেকেরই আজ চৈতন্য হয়েছে। ঐ ঘটনায় আমাদের মধ্যে অনেক অন্যমনস্ক লোকেরও মনে পড়ে গেছে যে, আমাদের একটা সমাজ ব’লে কোনো জিনিস নেই। আমরা ঝরাপাতার দল, হাওয়ায় আমাদের কখনো-বা একত্র জড় করে, কখনো-বা ছড়িয়ে দেয়। গাছের অসংখ্য পাতা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র হলেও তাদের সকলের ভিতর নাড়ির এবং রক্তের বন্ধন আছে; তাদের একের প্রাণের মূলও যেখানে, অপরের প্রাণের মূলও সেখানে দেশের মাটিতে। কিন্তু আজ আমাদের অনেকেরই চোখ ফটেছে। আমরা নিজের নিজের সংকীর্ণ সমাজ ত্যাগ করলেও হিন্দুসমাজ আমাদের ত্যাগ করে নি। আমরা নিজেরা শুধু সেই বহৎ সমাজের মধ্যে আর-একটি সংকীর্ণ সমাজ গড়তে চেষ্টা করেছিলুম, সৌভাগ্যক্রমে তাতে কৃতকার্য হই নি। আজকাল ভারতবাসীর দেহে নতুন প্রাণ এসেছে; হিন্দুসমাজ একটি সবহৎ স্বদেশী সমাজে পরিণত হচ্ছে, জাতের ভাব দূর হয়ে জাতীয় ভাব উপস্থিত হয়েছে, আমরা পরস্পরের পার্থক্য ভুলে গিয়ে স্বদেশীর সঙ্গে বিদেশীর পার্থক্য অনুভব করতে আরম্ভ করেছি। এ অবস্থায় আমাদের স্বদেশীয়তায় ফেরার অর্থ আমরা যে বরাবর স্বদেশ ও জাতির অন্তর্ভুত হয়েই আছি, সেই বিষয়ে পণ্টজ্ঞান জন্মাননা। আমরা যে-সমাজে ফিরছি, সে-সমাজ পূর্বে ছিল না, আজও পর্ণাবয়বপ্রাপ্ত হয় নি, ভবিষ্যতে তার রূপ যে কি হবে, তাও আমরা আজ ঠিক ধরতে পারি নে। তার স্বরূপ জানবারও কোনো আবশ্যক নেই; শুধু এই জানি যে, আমাদের জাতির মূলশতি উদবোধিত হয়েছে। সেই শক্তি আমাদের সকলেরই প্রাণে জাগরুক হয়ে উঠেছে, যে শক্তির কার্য হচ্ছে আমাদের সমগ্র জাতির অপরূপ শ্ৰী এবং উন্নতি সাধন করা। জড়পদার্থ নিয়ে একটা কিছু গড়তে হলে আগে হতেই একটা প্ল্যান এবং এসটিমেট করতে হয়; কিন্তু প্রাণ নিজের আকৃতি নিজে গড়ে নেয়, বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপও ক্রমে পষ্ট হয়ে আসে। প্রকৃতি যে ফুল ফোঁটাবে, মানুষ তার সাহায্য করতে পারে কিংবা বাধা দিতে পারে, কিন্তু তাতে স্বকপোলকপিত বর্ণ গন্ধ আকার এনে দিতে পারে না। কাগজের ফুল রচনায় আমাদের যে স্বাধীনতা আছে, গাছের ফল ভালো করে ফোঁটানোতে সে স্বাধীনতা নেই। আমাদের স্বদেশী সমাজের অক্ষয়-বটে নতুন পাতা দেখা দিয়েছে, আমাদের কর্তব্য এখন তার গোঁড়ায় প্রচুর সার এবং জল জোগাননা, আর চার পাশের জঞ্জাল ও জঙ্গল দূর করা। আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক-সকল স্বদেশী সমাজ অবলম্বন করেও আমাদের স্বাতন্য রক্ষা করব, কিন্তু সে তার শাখাপ্রশাখা হয়ে, পরগাছা হয়ে নয়। সুতরাং আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশী না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। আমাদের তন মন ধন দেশের পায়ে বিকতে হবে, বিদেশের পায়ে নয়। আমাদের এই ধারণাটকু জন্মানো উচিত যে, আমাদের কেউ নিজের শক্তি বিক্ষিপ্ত করে ফেলবার অধিকারী নন; সকলের শক্তি একত্র করে, সংহত করে, স্বদেশের জাতির উন্নতির কার্যে প্রয়োগ করতে হবে। অল্প হোক, বিস্তর হোক, আমাদের প্রত্যেকের আত্মশক্তি যাতে ব্যর্থ না হয়, যাতে তা সামাজিক গতির সহায়ভূত হয়, তার জন্য প্রথমত দিকনির্ণয় করা দরকার। তার পর, কোথায় কি উপায়ে নিজশক্তি প্রয়োগ করতে পারি, তার হিসাব জানতে হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার বক্তব্য দেখতে পাচ্ছি ক্ৰমে ফলাও এবং গুরতর হয়ে আসছে। এই স্থানেই সুতরাং আমাকে মনের রাশ টেনে ধরতে হবে। এ প্রবন্ধে আমার কতকগুলো সাদাসিধে ছোটোখাটো দৈনিক আচার-ব্যবহারের আলোচনা করবার অভিপ্রায় আছে। কিন্তু হঠাৎ দেখছি ধান ভানতে শিবের গীত শর করে দিয়েছি। এখন ভূমিকা ছেড়ে জমিতে নামাই আমার পক্ষে কর্তব্য। আয়একটি কথা বলেই আমি প্রকৃত প্রস্তাব আরম্ভ করব। সে কথাটি হচ্ছে এই, ভারতবর্ষের লন্ত সভ্যতা উদ্ধার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়; আজকের দিনে নিজের দেশে আপনার ভিতর যে নতুন সভ্যতার বীজের সন্ধান পেয়েছি, তাকেই পত্র-পল্পফল-মণ্ডিত মহাবকে পরিণত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। স্বদেশের জ্ঞান লাভ করতে গিয়ে ঘ-কালের জ্ঞান যেন না হারাই। আমাদের নূতন সভ্যতা যে পেই ধারণ করুক-না কেন, মাটির গুণে তাকে স্বদেশী হতেই হবে। জীবনীশক্তির ক্ষতি পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই হয়। বীজ থেকে বক্ষ একটা ধারাবাহিক পরিবর্তনের সমষ্টি মাত্র। আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজ, ভূত সমাজও হবে না, অদ্ভুত সমাজও হবে না। ইংরেজিয়ানার মোহে আমরা অতত্বের চর্চা করছিলুম, কিন্তু ভূতে না পেলে যে অদ্ভুতত্ব বর্জন করা যায় না, এমন নয়। আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের জাতির ভিতর প্রাণ আছে। বর্তমান অশান্তি শুধু নতুন জীবনের চাঞ্চল্য, মত্যর অব্যবহিতপব বিকারের ছটফটানি নয়। যে সমাজে প্রাণ আছে, সে সমাজে প্রাণের যে প্রধান লক্ষণ-বাইরের অবস্থার উপযোগী আত্মপরিবর্তন সে লক্ষণ প্রচুর পরিমাণে দেখা যাবে। এ জগৎ গম, ধাতু হতে উৎপন্ন, এমন গুণী আমরা কেউ নই যে জগতের ধাত বদলে দিতে পারি। স্বদেশীভাবের মূল হতে অনেক আশার ফল ফটবে, কিন্তু ফল ধরবে না। দেশের মাটি ভালোবাসি বলে যে, মাটি নিতে হবে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে, শেষটা মাটি হতে হবে, এ ভুল যেন কেউ না করেন। আমরা আজ যখন জীবনের পথে অগ্রসর হতে চলেছি, তখন এইটে মনে রাখতে হবে যে, দেশের মাটি আমাদের পদক্ষেপের পক্ষে ভগবান দত্ত অটল নির্ভর। অতীতের যে আগুন নিবেছে, যার এখন ভস্মমাত্র অবশিষ্ট আছে তাতে অতি ভক্তিভরে বাতাস দিলেও শুধু ছাই উড়িয়ে সমাজের চোখে ফেলব। কিন্তু আমাদের জাতির প্রাণে যেখানে আজও আগুন আছে, সেখানেই ফ; দিতে হবে, পাখা করতে হবে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, কোথায় শুধু ছাই আর কোথায় ছাই-ঢাকা আগন আছে কি করে জানব? তার উত্তর, যদি পশু করে আগন না চিনতে পারতো পাঁজি-পথির সাহায্যে তা পারবে না। অতঃপর ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, আমাদের এগোতে হবে। বড়োগোছের একটা লাফ মারবার পরে মান কিঞ্চিৎ পিছ, হটে পাল্লা নেয়; আমাদের সমাজ এখন পাল্লা নিচ্ছে। সরীসপের মতো সমাজও ক্রমাগত দেহকে আকুঞ্চন-প্রসারণ করে অগ্রসর হয়। কি উপায়ে কতদূর পর্যন্ত আমাদের সামাজিক দেহের আজ আকুঞ্চন করা কর্তব্য, সেই সম্বন্ধে গোটাকতক কথা বলতে উদ্যত হয়েছি।

২.

বিবাহিত জীবনের পরিণাম সম্বন্ধে পাঞ্জাবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে –

ভুল গেয়া রাগরঙ্গ, ভুল গেয়া ইয়কড়ি,
ইয়াদ রহা আজ খালি তেল নুন লকড়ি।

ইংলন্ডের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্বন্ধ আজকাল কতকটা ঐ ভাবের দাঁড়িয়েছে। আমরা শিক্ষিত ভারতবাসীরা এতদিন প্রভুর চিত্ত আকর্ষণ করবার জন্য কতই-না হাবভাব লীলাখেলার চর্চা করেছি। ওনার মনোমত কেশবিন্যাস বেশবিন্যাস বাগবিন্যাসের চাতুরী অভ্যাস করেছি। আত্মহারা হয়ে ইউরোপের আত্মীয় হতে যত্ন ও পরিশ্রমের এটি করি নি। এত করেও যখন মন পেলাম না, তখন মান-অভিমানের পালা শুরু করলুম। ফল তাতে উলটো হল–দাম্পত্য প্রণয়ের দাবি করাতে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়েছে। তাই আজ তেল নুন লকড়ির কথাই আমাদের মনে প্রাধান্য লাভ করেছে। মানবজাতিকে আমরা যে যেই ভাবে দেখি-না কেন, মানবজীবনে সকলেই তেল নন লকড়ির গুরত্ব স্বীকার করতে বাধ্য। দেহকে আত্মার কারাগারই মনে করি, আর আত্মার মন্দিরই মনে করি, এ পৃথিবীতে দেহমনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের ভিত্তির উপর ব্যক্তিগত ও জাতিগত জীবন গড়তে হবে। ইহলোকেব সত্যকে মিথ্যা জ্ঞান করলে শুধু পরলোকপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হিন্দুশাঘের মতে অন্ন প্রাণ। সুতরাং অন্নচিন্তাই প্রাণীমাত্রেরই আদিম চিতা। এই অন্নচিন্তা হতে উদ্ধার না পেলে অন্য চিতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তেল নন লকড়ির অধীনতাপাশ মোচন না করতে পারলে মনের এবং আত্মার পুরো স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। মেটিরিয়াল প্রসপারিটি সভ্যতার চরম লক্ষ্য নয়, কিন্তু একটি বিশিষ্ট উপায়। তেল নুন লকড়ির অধীনতা হতে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় –তেল নন লকড়ির সংস্থান করা। আমাদের আজ হঠাৎ চৈতন্য হয়েছে যে, ভারতবাসীর সে সংস্থান নেই। আমরা শুকিয়ে যাচ্ছি, কেননা দেশের রস বিদেশে টেনে নিচ্ছে। নিজ দেশের রস নিজ দেহের রক্তে কিরূপে পরিণত করতে পারি, সেই আমাদের প্রধান সমস্যা। আমরা যদি ভুলে গিয়ে না থাকি, তা হলে আমাদের ‘রাগরঙ্গ ইয়কড়ি’ ভুলে যেতে হবে, আর আমাদের মনে যদি না থাকে, তা হলে মনে রাখতে হবে শুধু ‘তেল নন লকড়ি’। রাকিন সমস্ত জীবন ধরে ইংলণ্ডকে এই বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, ইকনমিকস-এই গ্রীক শব্দের আদিম অর্থ হাউসহোন্ড ম্যানেজমেন্ট, অর্থাৎ গেরস্থালি। প্রতি গহে যদি লক্ষ্মী না থাকেন, তা হলে সমগ্রজাতি লক্ষ্মীছাড়া হবে। ঘর যদি অগোছাল রাখ, তা হলে হাটে-বাজারে যতই কেনা-বেচা কর-না কেন, তাতে নিজে কিংবা জাতি যথার্থ স্ত্রী এবং সখ লাভে সমর্থ হবে না। এ মতের মধ্যে এইটকু খাঁটি সত্য নিহিত আছে যে, দশে মিলে জাতীয় সমন্ধিলাভের যে সমবেত চেষ্টা করি, তার সফল আমরা ঘরে ঘরে স্বেচ্ছাচারিতায় নিষ্ফল করে দিতে পারি। আমরা যদি সকলে একত্র হয়ে বাইরে এক দিকে টানি, আর প্রতি লোক ঘরে এসে তার উলটো টান টানি-তা হলে ঘর বার দুই নষ্ট হবে। আমি গ্রাফিনের শিষ্যস্বরূপে এই কথা প্রচার করতে উদ্যত হয়েছি যে, সুগৃহিণীর প্রথম এবং প্রধান কাজ গহের সম্মার্জনা করা।

৩.

আমরা যে গহে বাস করি, সে যে কোন দেশীয় বলা কঠিন। বাংলার বাইরে, কি স্বদেশে কি বিদেশে, কোথাও তার জুড়ি দেখতে পাই নে। গৃহ যেমন সমাজের মূল, তেমনি আবার শহরেরও বুনিয়াদ। গৃহ হতে পল্লি, পল্লি হতে নগর, নগর হতে শহর-ক্রমবিকাশের এই নিয়ম। রোম প্যারিস প্রভৃতি বনেদি শহরের আকি, টেকচরেতেই তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ। ঐ আর্কিটেকচরের প্রসাদেই নাগরিকগুণ বর্তমানে অতীতের সঙ্গে ঘর করে, অতীতের সুখ দুঃখ আশা ভরসা সফলতা ও বিফলতা, গৌরব ও লজ্জা অলক্ষিতে তাদের মন অধিকার করে নেয়; প্রত্যেকেই নিজের আত্মার ভিতর বহত্তর জাতীয় আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে। তাদের পক্ষে স্বজাতীয়তার ও ঘদেশীয়তার কাছে নিজেদের ধরা দেওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক; তা হতে মুক্তি পাওয়াই আয়াসসাধ্য। আমাদের ভিতর মহদতঃকরণ বাকিরা যেমন অহংজ্ঞান খর্ব করে স্বজাতির পায়ে আত্মসমর্পণ করাটা জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেন, তেমনি ইউরোপের মহদন্তঃকরণ ব্যক্তিরাও স্বজাতিজ্ঞান খর্ব করে মানবজাতির পায়ে আত্মসমর্পণ করাটা জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেন। আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে ন্যাশনালিজম, তাদের উচ্চ সাধনার বিষয় হচ্ছে ইনটারন্যাশনালিজম। সে যাই হোক, কলিকাতার মতো ভুইফোঁড় শহরে শ্রীহীন অর্থহীন কিভূতকিমাকার ভুইফোঁড় গহে বাস করে আমাদের পক্ষে স্বদেশী ভাব রক্ষা করাটা সহজ নয়। চকমেলানো বাড়ি হালফ্যাশানে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। একটি সবা গোছের ঘর, তার এপাশে দুটি, ওপাশে দুটি–এই পাঁচ কামরা নিয়ে আমাদের গহ। মধ্যের ঘরটি হচ্ছে বাইরের ঘর, এবং উভয় পাবের বহির্দিকের ঘর-কটি হচ্ছে অন্দর। বাসস্থানের এই উলটোপালটা ভাবের সঙ্গে আমাদের সামাজিক জীবনের বরাবর যোগ রয়ে গেছে। আমাদের গ্রীষ্মের দেশে ঘরে হাওয়াও চাই ছায়াও চাই, একসঙ্গে দুই পাওয়া অসম্ভব বলে এ দেশের গৃহ দু ভাগে বিভক্ত হওয়া দরকার। এক অংশ বায়ুর পক্ষে যথেষ্ট ভোলা, অপর অংশ সূর্যের পক্ষে যথেষ্ট রন্ধ। পৃথিবীর সর্বত্রই পঞ্চভূত মিলে মানুষের গৃহনির্মাণের হিসাব বাতলে দেয়। প্রকৃতিই এ দেশের গৃহ সদর এবং অন্দরে ভাগ করতে শিখিয়েছিলেন। এবং আমাদের সমাজের গঠনও গহের গঠনের অনেকটা অনুসরণ করেছে। এই কারণে গ্রীষ্মপ্রধান দেশেই অবরোধ একটি সামাজিক প্রথা। আমার বিশ্বাস, এই কড়া রোদ এবং চড়া আলোর দেশে অসম্পশ্যা হবার লোভেই রমণীজাতি স্বেচ্ছায় অন্তঃপুরবাসিনী হয়েছেন। যেখানে গহে শ্রীপুরুষের স্বতন্ত্র রাজ্যের সীমা নির্দিষ্ট নেই, সেখানে সমাজেও শ্রীপুরুষের সাম্য অর্থে ঐক্য—এই ভুল বিশ্বাস জন্মলাভ করে। ইংরেজিয়ানার প্রসাদে আমাদের বাসগৃহের সদর অন্দর ভেস্তে যাবার প্রধান ফল এই যে, আমাদের স্ত্রীপুরুষ উভয়েই গহে অনেকটা সংকুচিত ভাবে বাস করে। আমাদের ড্রয়িংরুম পাড়াপড়শীর বৈঠকখানা হতে পারে, এবং বাড়ির কোনো অংশই মেয়েদের দুর্গে নয়। এ দেশটি যে বিদেশ, সেটা সর্বদা মনে জাগরুক রাখবার জন্য ইংরেজ দেশীয় সমাজ হতে আলগোছ হয়ে থাকেন, নইলে ভয় পাছে জাতিরক্ষা না হয়। আমরা তাঁদের অনুকরণে বাসা বাঁধলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্ব-সমাজ হতে দূর হয়ে পড়ি। মোটামুটি আমার বক্তব্য কথা এই, মানুষমাত্রেরই দেশের সঙ্গে প্রধান যোগ গৃহ দিয়ে; স্বদেশীয়তার গোঁড়াপত্তন ঐখানেই, গৃহ্যসূত্র হতেই মানবধর্মশাস্ত্রের উৎপত্তি। গহের রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে গহীর রুপান্তরও অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও আমি কাউকে বাড়িবদলানোর পরামর্শ দিয়ে লোকসমাজে নিজেকে বিষয়বুদ্ধিহীন বলে প্রমাণ করতে রাজি নই। এ বিষয়ে আমার ভবিষ্যতের আশার একমাত্র ভরসা-একটা বড়োগোছের ভূমিকম্প।

গৃহে প্রবেশ করেই এক অপূর্ব দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। আমরা দেখতে পাই যে, বিদেশী বস্তু আমাদের গৃহ আক্রমণ করেছে, এবং তার অন্তরতম প্রদেশ পর্যন্ত অধিকার করে বসে আছে। সাহেবিয়ানার খাতিরে আমাদের গৃহসজ্জা অসম্ভবরকম জটিল হয়ে পড়েছে। আসবাবের ভিড় ঠেলে ঘরে ঢোকাই মুশকিল, চলে-ফিরে বেড়াবার স্বাধীনতা তো একেবারেই নেই। এই জটিলতার মধ্যে সকলকেই কুটিল গতি অবলম্বন করতে হয়। প্রথমেই মনে হয় যে, এ ঘর বাসের জন্য নয়, ব্যবহারের জন্য নয়—সাজাবার জন্য, দেখাবার জন্য, গহস্বামীর ধন এবং শিক্ষার পরিচয় দেবার একটা প্রদর্শনী মাত্র, লক্ষ্মী-সরস্বতীর মিলনের অপ্রশস্ত ক্ষেত্র। আমাদের নূতন ধরনের গৃহসজ্জার বর্ণনা করবার কোনো দরকার নেই, কারণ তা সকলেরই নিকট সুপরিচিত। চেয়ার টেবিল কোচ টিপয় পিয়ানো আয়না, ছিটের পরদা, ব্রাসেলসের কারপেট, চীনের পুতুল, ওলিয়োগ্রাফের ছবি-এই আমাদের নূতন সভ্যতার উপকরণ এবং নিদর্শন। গৃহস্থের অবস্থা অনুসারে এই-সকল উপকরণ হয় লাজারস এবং অসল্যর, নয় বৌবাজারের বিক্রিওয়ালার দোকান হতে সংগ্রহ করা হয়। যিনি ধনী, তাঁর গৃহ হঠাৎ দেখতে দোকান বলে ভুল হয়। আর যিনি লক্ষ্মীর কৃপায় বঞ্চিত, তাঁর গৃহ হঠাৎ দেখতে যুদ্ধক্ষেত্রের হাঁসপাতাল বলে ভ্রম হয়; আসবাবপত্র সব যেন লড়াই থেকে ফিরে এসে, হয় মেরামত, নয় দেহত্যাগের জন্য অপেক্ষা করছে। কোনো চৌকির হাত নেই, কোনো টিপয়ের পা নেই, কোনো টেবিলের পক্ষাঘাত হয়েছে; পরদার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে গেছে, কৌচের নাড়িভুড়ি নিগত হয়ে পড়েছে, চীনের পুতুলের ধড় আছে কিন্তু মণ্ড নেই, পারিস পালেস্তারার ভিনাসের নাসিকা লণ্ড, ওলিয়োগ্রাফ-সুন্দরীর মুখে মেচেতা পড়েছে, আয়নার গা দিয়ে পারা ফটে বেরিয়েছে, পিয়ানো দন্তহীন এবং হারমোনিয়ম বাসরোগগ্রস্ত। এ অবস্থাতেও আমরা এই-সকল অব্যবহার্য দর্য আবর্জনা দূর করে তার পরিবর্তে ফরাশ বিছিয়ে বসি না কেন?–কারণ ইংরেজের কাছে আমরা শিখেছি যে দৈন্য পাপ নয়, কিন্তু স্বদেশীয়তা অসভ্যতা।

আমাদের এই নবসভ্যতার আজবঘরে স্বর্গীয় পিতামহগুণ যদি দৈবাৎ এসে উপস্থিত হন, তা হলে নিঃসন্দেহ সব দেখেশুনে তাঁদের চক্ষুশির হয়ে যাবে। অবাক হয়ে তারা ঊর্ধ্বনেত্রে চেয়ে থাকবেন, নির্বাক হয়ে আমরাও অধোবদনে বসে থাকব। উভয় পক্ষে কোনো বোঝা-পড়া হওয়া অসম্ভব। অপরিচিত অশন-বসন আসন-ভূষণের ভিতরে কিরূপে জাতি রক্ষা হয়, তা তারা বুঝতে পারবেন না; কৈফিয়ত চাইলে আমাদের মধ্যে যাঁর কিছু বলবার আছে তিনি সম্ভবত এই উত্তর দেবেন যে, ‘জাতি শব্দের অর্থ আপনাদের নিকট সংকীর্ণ ছিল, আমাদের নিকট তা প্রশস্ততর হয়েছে; রক্ষা অর্থে আপনারা বুঝতেন শুধু স্থিতি, আমরা বুঝি উন্নতি; আপনাদের গর, ছিল মন, আমাদের গর, হার্বাট স্পেনসার; আমাদের নূতন চাল আপনাদের হিসাবে জাতিরক্ষার প্রতিকল, কিন্তু আমাদের হিসাবে অনুকূল।’ এ কথা যদি সত্য, যদি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তা হলে আমার আপত্তির কোনো কারণ নেই; কেননা যে প্রথা অবলম্বন করলে ব্রাহ্মণ-শদ্রের, এমন-কি, হিন্দুমসলমানের মধ্যে আচার-ব্যবহারের চিরবিরোধ থেকে যাবে, আমার পক্ষে সে প্রথার পক্ষপাতী হওয়া অসম্ভব। যে সামাজিক শাসন জাতীয় জীবনের প্রসারতা লাভের বিরোধী, আমি তার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু আমাদের সমাজকে যে ইউরোপের পশ্চাধাবন করতেই হবে তার কোনো প্রমাণ নেই। গতিমাত্রেরই একটি স্বতন্ত্র প্রধানভূমি আছে, একটি দিক নির্দিষ্ট আছে, যা তার পূর্বাবস্থার দ্বারা নিয়মিত। উন্নতির অর্থ আকাশে ওড়া নয়। কোন দেশে জন্মগ্রহণ করি সেটা যেমন আমাদের ইচ্ছাধীন নয়, তেমনি কোন সমাজে জন্মগ্রহণ করি সেও আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। পরিবর্তন যেমন কালসাপেক্ষ, পরিবর্ধন তেমনি দেশ ও পাত্র -সাপেক্ষ। আমাদের প্রত্যেকেরই দেহ ও মনের মূলে পূর্বপুরুষরা বিরাজ করছেন, এবং আমাদের জাতীয় সভ্যতা অর্থাৎ সামাজিকতার মূলে পূর্বে পরিষদের সমাজ বিরাজ করছে। বংশপরম্পরা হেরিডিটি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো উন্নতি অসম্ভব। যে গহে পূর্বপুরুষদের স্থান হয় না, সে গহে ভোগবিলাসের চরিতার্থতা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মানব জীবনের সার্থকতা লাভ হয় না। স্মৃতি যেমন প্রতি মানবের অহংজ্ঞানের মূলপূর্বাপরের যোগসূত্র-বরূপ স্মৃতির অস্তিত্ব না থাকলে, আত্মোন্নতি দূরে থাকুক, কেহই আত্মার সন্ধানও পেতেন না—তেমনি অতীতের স্মৃতি জাতীয় অহংজ্ঞানেরও মূল। অতীতের জ্ঞানশূন্য হয়ে কোনো জাতি জাতীয় আত্মার সন্ধান পায় না, জাতীয় আত্মোন্নতি দূরে থাকুক। সামাজিক জীবের পক্ষে অতীতের প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয় হচ্ছে পিতা-পিতামহ ইত্যাদি, এবং ক্ষেত্র হচ্ছে বাস্তু। সেই বাস্তুজ্ঞানরহিত হলে আমাদের বস্তুজ্ঞানশূন্য হওয়া সহজ হয়ে পড়ে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তর্ক তুলে ইশবগ-নামক খেটে-খাওয়াদূলের লোককে বিরক্ত করবার কোনো সার্থকতা নেই। এরা বিজ্ঞানের দোহাই দেন আলোচনা বন্ধ করবার জন্য, আরম্ভ করবার জন্য নয়। হার্বাট স্পেনসার এদের গর, কিন্তু শিক্ষাগর, নন, দীক্ষাগুর। ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিকদের কাছে এরা কিছুই শিক্ষালাভ করেন নি, শুধু দুটি-একটি বীজমল গ্রহণ করেছেন, যথা সভ্যতা উন্নতি ইত্যাদি। অন্যান্য তান্ত্রিকদের মতো এই তান্ত্রিকদেরও নিকটে বীজমন্ত্র যত দুবোধ, সম্ভবত যত অপশন্য, তত তার মাহাত্ম। ইউরোপীয় সভ্যতা এরা জ্ঞানের দ্বারা পেতে চান না, ভক্তির দ্বারা পেতে চান। দাস্যভাব-সখ্যভাবের চর্চাই এরা মুক্তির একমাত্র উপায় স্থির করেছেন। আমরা এদের যে অবস্থাটাকে দুর্দশা বলে মনে করি, সেটি শুধু ইউরোপভক্তির দশা মাত্র।

যাঁরা তর্ক করতে প্রস্তুত, তাঁরা তর্কে হার মানতেও প্রস্তুত; কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। অধিকাংশ ইঙ্গবঙ্গের মনোভাব এই যে, নগদ দামে নাহয় ধার করে দোনা কৌচ মেজ কিনব, এর মধ্যে আবার দর্শন-বিজ্ঞান কোথায়? নিজের কি আবশ্যক এবং নিজের কি মনোমত, সেটা ঠিক করতে সমাজতত্ত্ব আলোচনা করবার দরকার নেই। সুতরাং সাহেবিয়ানার সপক্ষে এরা হয় সুবিধা, নাহয় সুচির দোহাই দেন। যখন বিউটির দোহাই চলে না, তখন ইউটিলিটির দোহাই দেন; যখন ইউটিলিটির দোহাই চলে না, তখন বিউটির দোহাই দেন। যখন এ শ্রেণীর লোকেরা বিজাতীয় আচার-ব্যবহারের ইউটিলিটির ব্যাখ্যান শুর করেন, তখন মনে হয় এরা জন স্টুয়ার্ট মিলের কৃষ্ণপক্ষীয় সন্তান; আর যখন এরা বিলাতি ছিট, বিলাতি কারপেটের বিউটির ব্যাখ্যান শর করেন তখন মনে হয় অস্কার ওয়াইল,ডের মাসতুতো ভাই। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ এদের জিজ্ঞাসা করে যে, জেল কিংবা পাগলাগারদের অধিবাসী না হয়েও চুলের অবস্থা ওরকম কেন, এরা হেসে উত্তর করবেন আমরা কবি নই, কাজের লোক। এদের বিশ্বাস দো-অসিলা কুকুরের ল্যাজের মতো ইবঙ্গের চুল যত গোঁড়াঘেঁষে কাটা যায়, তার তেজ তত বৃদ্ধি হয়, তত রোখ বাড়ে। এবং এই বিশ্বাস Mill মিলের মতানুযায়ী। এদের রুচি সম্বন্ধেও এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সুতরাং ইংরেজি আসবাবের আবশ্যকতা এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা আবশ্যক।

বিদেশী রকমে ঘর সাজানোতে যে আমাদের কি পর্যন্ত অর্থের শ্রাদ্ধ হয়, তা তো সকলেই জানেন। অধিকাংশ ইঙ্গবঙ্গের পক্ষে ঠাট বজায় রাখতেই প্রাণান্তপরিচ্ছেদ হতে হয়। ধার-করা সভ্যতা রক্ষা করতে শুধু ধার বাড়ে। আমাদের এই দারিদ্রপীড়িত দেশে অনাবশ্যক বহব্যয়সাধ্য আচার-ব্যবহারের অভ্যাস করা আহাম্মকি তো বটেই, সম্ভবত অন্যায়ও; ক্ষমতার বহির্ভূত চাল বাড়ানো, গৃহ হতে লক্ষ্মীকে বিদায় করবার প্রশস্ত উপায়। তা ছাড়া বিদেশীর অনুকরণে বিদেশী কতুতে যদি গৃহ পণ করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, দেশের ধনে যদি বিদেশীর পকেট পূর্ণ করতে হয়, তা হলে হিতাহিতজ্ঞানসম্পন্ন ভদ্রসন্তানের পক্ষে সে অনুকরণ সর্বতোভাবে বর্জনীয়। ইউরোপে সাধারণ লোকের একটা ভুল ধারণা আছে যে, খাওয়া-পরার মাত্রা যত বাড়ানো যায়, জাতীয় উন্নতির পথ ততটা পরিষ্কার হয়। যদি আমার এত না হলে দিন চলে না এমন হয়, তা হলে তত সংগ্রহ করবার জন্য পরিশ্রম স্বীকার করতে হবে; এবং যে জাতি যত অধিক শ্রম স্বীকার করতে বাধ্য, সে জাতি তত উন্নত, তত সৌভাগ্যবান। কিন্তু ফলে কি দেখতে পাওয়া যায়? ইউরোপবাসীরা এই বাহুল্যচর্চার দ্বারা জীবন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত করে ফেলেছে বলে কর্মক্ষেত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এশিয়াবাসীদের নিকট সর্বত্রই হার মানছে। এই কারণেই দক্ষিণ-আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা প্রভৃতি দেশে চীনে জাপানী হিন্দুস্থানী শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে নানা গহিত বিধিব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এশিয়াবাসীরা খাওয়া-পরাটা দেহধারণের জন্য আবশ্যক মনে করে, মনের সুখের জন্য নয়; সেইজন্য তারা পরিশ্রমের অনুরূপ পুরস্কার লাভ করলেই সন্তুষ্ট থাকে। এই সন্তোষ আমাদের জাতিরক্ষার, জাতীয় উন্নতির প্রধান সহায়। আমরা যদি আমাদের পরিশ্রমের ফলের ন্যায্য প্রাপ্য অংশ লাভ করতুম, আমরা যদি বঞ্চিত প্রতারিত না হতুম, তা হলে দেশে অন্নের জন্য এত হাহাকার উঠত না। আমাদের এ দোষে কেউ ‘দোষী করবেন না যে, আমরা যথেষ্ট পরিশ্রম করি নে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের পরিশ্রমের ফল অপরে ভোগ করে। আমাদের দেশে আজকাল শিক্ষিত লোকেরবিশেষত ইঙ্গবগ সম্প্রদায়ের মনোভাব এই যে, স্ট্যান্ডার্ড অব লাইফ বাড়ানো সভ্যতার একটি অঙ্গ। এ সর্বনেশে ধারণা তাঁদের মন থেকে যত শীঘ্ন দর হয় ততই দেশের পক্ষে মঙ্গল। উপরোক্ত যুক্তি ছাড়া জীবনযাত্রার উপযোগ ইউরোপীয় সরঞ্জামের সপক্ষে আর কোনো যুক্তি শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে অনেকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে বলে থাকেন, “আমার খুশি। আমাদের দেশের রাজা সমাজের অধিনায়ক নন। বিদেশী বিধর্মী রাজা এ দেশে কখনো সামাজিক দলপতি হতে পারেন না, সুতরাং আমাদের সমাজে এখন অরাজকতা প্রবেশ করেছে। যে সমাজে শান্ত আছে কিন্তু শাসন মানাবার কোনো উপায় নেই, সেখানে শাসন না মেনে যে কাজে কোনো বাইরের শান্তি নেই সে কার্যে যথেচ্ছাচারী হয়ে এরা যে নিজেদের বিশেষরুপে নিভীক স্বাধীনচেতা এবং পুরুষশাদল বলে প্রমাণ করেন, তার আর সন্দেহ কি। অবশ্য এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, এদের খুশি প্রভুদের খুশির সঙ্গে অক্ষরে-অক্ষরে মিলে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। সে তো হবারই কথা। এরাও সভ্য, তাঁরাও সভ্য, সুতরাং পরস্পরের মিল-সে শুধু সেয়ানায় সেয়ানার কোলাকুলি। যদি কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন যে, চেয়ার টেবিল কোচ মেজ ইত্যাদি দেহ আত্মা রিবা মনের উন্নতির কিরূপে এবং কতদূর সাহায্য করে, তা হলে আমি তার কাছে চিরবাধিত থাকব, কারণ সত্যের খাতিরে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, চৌকি কোঁচ অনেকটা আরামের জিনিস এবং আমরা অনেকেই অভ্যস্ত আরামভোগে বঞ্চিত হতে নিতান্ত কুণ্ঠিত। আমাদের সকলেরই পৃষ্ঠদণ্ড কিঞ্চিৎ কমজোর এবং ঈষৎ বক, সুতরাং আমরা পষ্ঠের একটা আশ্রয়ের জন্য সকলেই আকাক্ষী। এবং আরাম-চৌকি এখন আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। যোগশাস্ত্রে বলে, সকলপ্রকার আত্মোন্নতির মূলে সরল পদণ্ড বর্তমান। সুতরাং যোগের প্রথম সাধনা হচ্ছে আসন অভ্যাস করা, পৃষ্ঠদণ্ড ঋজ করা। দাসজাতির দেহভঙ্গি মীলোকের মতে, সম্মুখ দিকে ঈষৎ আনমিত-অতিপ্রবদ্ধ যৌবনভারে নয়, অতি অভ্যস্ত সেলাম এবং নমস্কার-চর্চা বশত। আমাদের জাতীয় কুলকুণ্ডলিনী যদি জাগ্রত করতে হয় তা হলে আমাদের পিঠের দাঁড়া খাড়া করতে হবে, অনেক অভ্যস্ত আরাম ত্যাগ করতে হবে। সুতরাং একমাত্র দৈহিক আরামের খাতিরে বিদেশী আসবাবের প্রচার এবং অবাধন সমর্থন করা যায় না। সকলেই জানেন যে, জাপান ইউরোপের কাছে যা শিখেছে আমরা তা শিখি নি; কিন্তু খুব কম লোকেই জানেন যে, ইউরোপের কাছে আমরা যা শিখেছি জাপান তা শেখে নি। ফলে ইউরোপের সঙ্গে কারবারে জাপান নিজের শক্তি সঞ্চয় করেছে, ইউরোপের সঙ্গে কারবারে আমরা শুধু শক্তির অপচয় করেছি। এই কারণেই আমাদের জাপানের কাছে এই শিক্ষালাভ করতে হবে যে, ইউরোপীয় সভ্যতার কি আমাদের গ্রহণ করা উচিত এবং কি আমাদের বর্জন করা উচিত। এই বিষয়ে জ্ঞানলাভ করাটাই আমাদের সর্বপ্রধান দরকার, এবং জাপান ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ আমাদের গুরু হতে পারে না, কারণ জাপান শুধু এ কঠিন সমস্যার মীমাংসা করেছে। খাওয়া-পরা-থাকা-শোওয়া সম্বন্ধে জাপান স্বদেশের সনাতন প্রথা ত্যাগ করে নি। বিলেতি আসবাব জাপানের ঘরে স্থান পায় নি। আজও সমগ্র জাপান মাদুরের উপর বীরাসনে আসীন।(১)

৪.

বিলেতি জিনিসের আবশ্যকতা সম্বন্ধে বিচার শেষ করে, এখন তার সৌন্দর্য সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা আবশ্যক। আমাদের দেশে যে ছেলের কিছু হবার নয় তাকে আর্টকুলে পাঠানো হয়; এবং ঐ একই কারণে যুক্তি যখন অন্য কোনো দাঁড়াবার স্থান না পায় তখন তা আর্টের নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ধর্ম সম্বনে আলোচনায় ‘আমি বিশ্বাস করি’ এ কথার উপর যেমন আর কোনো কথা চলে না, আর্ট সম্বন্ধে আলোচনায় ‘আমার চোখে সুন্দর লাগে’ এ কথার উপরও তেমনি আর কোনো কথা চলে না। সৌন্দর্য অনুভূতির বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়। ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে তার প্রমাণ দেওয়া যায় না। অতএব যিনি আট জিনিসটা অপরকে যত কম বোঝাতে পারেন, নিজে তিনি তত বেশি বোঝেন। ধর্ম সম্বন্ধে বিশ্বাস অথ হলেও সম্ভবত লোক ধর্মজ্ঞ হতে পারে, কিন্তু রূপ সম্বন্ধে অন্ধ হয়ে লোকে সৌন্দর্যজ্ঞ হতে পারে না। কারণ সৌন্দর্য প্রকাশ। সৌন্দর্যের পরিচয় এবং অস্তিত্ব উভয়ই কেবলমাত্র প্রকাশের উপর নির্ভর করে। সেই পদার্থকে আমরা সুন্দর বলি, যার স্বরূপ পর্ণেব্যক্ত হয়েছে। রূপ হচ্ছে বিশ্বেরভাষা এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির শেষ কথা। প্রকৃতিও বোয় কিছু করেন না, মানুষেও বিনা উদ্দেশ্যে কোনো পদার্থে হাত দেয় না। যা মানবজীবনের পক্ষে আবশ্যকীয়, মানুষে তাই হাতে গড়ে; সেই গঠনকার্যের সার্থকতা এবং কৃতার্থতার নামই আর্ট। নিরর্থক দ্রব্য সুন্দর হয় না। আবশ্যকতার বিরহে সৌন্দর্য শুকিয়ে মারা যায়। সুতরাং যে জাতির পক্ষে যে-সকল জিনিস জীবনযাত্রার জন্যে আবশ্যকীয় নয়, সে জাতির পক্ষে সে-সকল জিনিসের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা কঠিন। আর্ট একটি সৃষ্টিপ্রকরণ, একটি ক্রিয়া মাত্র, সুতরাং আর্টের প্রাণ কর্তার হাতে এবং মনে, ভোতার চোখে এবং কানে নয়। আর্টের সন্ধান তার স্রষ্টার কাছে মেলে, দর্শক কিংবা শ্রোতার কাছে নয়। সৌন্দর্য সৃষ্টি করবার ভিতর যেটকু আনন্দ প্রাণ ও ক্ষমতা আছে, সেইটক অনুভব করার নাম সৌন্দর্য ভোগ করা। এ কথা যদি সত্য হয়, তা হলে যে আর্টিস্টের সঙ্গে আমাদের চরিত্রের, ধর্ম এবং জ্ঞানের, রীতি এবং নীতির মিল আছে, আমরা অনেক পরিমাণে যার সখদুঃখের ভাগী, যার সঙ্গে আমরা একই বাহ্যপ্রকৃতির ভিতর একই সমাজের অন্তর্ভূত হয়ে বাস করি, তার আর্টই আমাদের পক্ষে যথার্থ আর্ট। বিদেশী এবং বিজাতীয় আর্টের আদর কেবল কাপনিক মাত্র। এই কারণেই আমাদের অনেকেরই পক্ষে বিদেশী আর্টের চর্চাটা লাঞ্ছনা মাত্র হয়ে পড়ে। আমরা প্রথমে বিদেশব দোকানদারের দ্বারা প্রবঞ্চিত হই, পরে নিজেদের মনকে প্রবঞ্চিত করি। আমাদের কাছে রূপের পরিচয় রপিয়া দিয়ে। আমরা ছবি চিনি নে, তব কিনি নাম দেখে এবং দাম দেখে। ইউরোপে যারা শিব গড়তে বাদর গড়ে, তাদেরই হস্তরচিত বিগ্রহ আমরা সংগ্রহ করে সখী না হই, খুশি থাকি। আট সম্বন্ধে ইউরোপের গোলামচোর হওয়ার লজ্জা পাওয়া দুরে যাক, আমাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

আমার মতের বিরুদ্ধে সহজেই এই আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে যে, আমরা যদি ইউরোপীয় আর্টের মর্যাদা না বুঝতে পারি, তা হলে ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মর্যাদা বোঝা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং ইউরোপীয় সাহিত্যবিজ্ঞান-চর্চাও আমাদের ত্যাগ করা কর্তব্য। এ আপত্তির উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, বিভিন্ন দেশের লোকের ভিতর পার্থক্য যতই থাকুক, মানুষে মানুষে প্রবৃত্তির বাসনার মনোভাবের মিলও যথেষ্ট আছে। সাহিত্যের বিষয় হচ্ছে প্রধানত মানবপ্রকৃতি; সুতরাং উচ্চশ্রেণীর সাহিত্য দেশকাল-অতিরিক্ত মানবহৃদয়ের চিরন্তন অথচ চিরনবীন ডাকসকল নিয়ে কারবার করে। এই হেতু সকল দেশের উচ্চ আগের সাহিত্যে বিমানবের সমান অধিকার আছে। কিন্তু ইউরোপীয় সাহিত্যে যে অংশটুকু আর্ট, সে অংশ আমরা ঠিক ধরতে পারি নে। বিদেশী লেখকের লেখনীর পরিচয় আমরা অনেকেই পাই না। সে যাই হোক, সাহিত্যে এবং আর্টে, কাব্যে এবং কলায় প্রধান পার্থক্য এই যে, কাব্যের উস্করণ অন্তর্জগৎ হতে আসে, কলার উপকরণ বাহ্যজগৎ হতে আসে। মনোজগতে দেশভেদ নেই, এশিয়া ইউরোপ নেই, এক কথায়, মনোজগতের ভূগোল নেই। কিন্তু বাহ্যজগতে ঠিক তার উলটো। এক দেশের ভৌতিক গঠন অপর দেশ হতে বিভিন্ন। দেশভেদে বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শরসের জাতিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। সেইজন্যই কাব্য অপেক্ষা কলার ক্ষেত্র সংকীর্ণ। এই উপকরণের বিশেষত্ব হতে প্রতি দেশের শিল্পকলার বিশেষত্ব জন্মলাভ করে। আর্ট সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয়তা অসম্ভব; সুতরাং এ ক্ষেত্রে স্বদেশের অধীনতাপাশ মোচন করবার জো নেই। বিজ্ঞানের বিষয়ও কস্তুজগৎ; কিন্তু বিজ্ঞান বিশ্বজনীন, কেননা বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বস্তুজগতের বিশেষত্ব বাদ দিয়ে তার সামান্য ক্রিয়াগুলির সন্ধান নেওয়া। আর্টের সম্পর্ক বসুজগতের শুধু বিশেষ্য ও বিশেষণের সঙ্গে। বিজ্ঞানের অভিপ্রায় বিশ্বকে এক করে আনা, আর্টের কার্য নিত্য বৈচিত্র্য সাধন। বিজ্ঞানের লক্ষ্য মূলের দিকে, আর্টের লক্ষ্য ফলের দিকে। বিজ্ঞানের দেশ নেই, আর্টের আছে। এই-সকল কারণে নিউটন এবং ডারউইন আমাদের জ্ঞাতি, শেকসপীয়ার এবং মিলটন আমাদের কুটুম্ব, কিন্তু রাফায়েল এবং বীঠোফেন আমাদের পর। এইজন্যই জাপান ইউরোপের বিজ্ঞান আয়ত্ত করেছে, কিন্তু নিজের আর্ট ছাড়ে নি। আমাদের মধ্যে যদি কেহ ইউরোপের উচ্চাঙ্গের আর্টের যথার্থ মর্ম গ্রহণ করতে পারেন, তিনি অবশ্য ভক্তির পাত্র। পৃথিবীর যে দেশের যা-কিছু শ্ৰেষ্ঠকাতি আছে, তার সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করা মানবের মুক্তির একটি প্রকৃষ্ট উপায়। কিন্তু যখন প্রায়ই দেখতে পাই যে, যিনি বরগ্রামের গা’ থেকে ‘পার প্রতে ধরতে পারেন না, তিনিই বীঠোফেনের প্রধান সমজদার; এবং যিনি রঙটা নীল কিংবা সবুজ বিশেষ ঠাওর করেও বলতে অপারগ তিনিই টিশিয়ানের চিত্রে মুখ, তখন যজাতির ভবিষ্যতের বিষয় একটু হতাশ হয়ে পড়তে হয়। সে যাই হোক, উপখিত প্রবধে যে-সকল বস্তুর আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছি—যথা ছিটের পরদা, ব্রসলসের কারপেট, চীনের পুতুল, কাচের ফলদানি, কি স্বদেশী কি বিদেশী সকল প্রকার আর্টের অভাবেই তাদের বিশেষত্ব। বিলাতের সচরাচর গহ-ব্যহাব বস্তুগুলি প্রায়ই কদাকার এবং কুৎসিত। এর দুটি কারণ আছে। পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞানের ন্যায় আর্টেরও বিষয় বাহ্যজগৎ। যা ইন্দ্রিয়গোচর নয়, তা বিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, আর্টেরও বিষয় হতে পারে না। ইন্দ্রিয় যে উপকরণ সংগ্রহ করে, মন তাই নিয়ে কারিগরি করে। এই বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ-ময় জগতে যে ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ে মন সুখলাভ করে শুধু তাই আর্টের উপকরণ। কতুর সেই সখদায়ক গুণের নাম এসথেটিকাল কোয়ালিটি, অর্থাৎ ‘রুপ’; এবং মনের সেই সুখলাভ করবার ক্ষমতার নাম এসথেটিক ফাঁকালটি, অর্থাৎ ‘পজ্ঞান। ইংরেজ বিশেষ খোসাপুরু জাত। ভগবান, ইংরেজকে নিতান্ত স্থূলভাবে গড়েছেন; তার দেহ প্ৰল, প্রকৃতি স্কুল, ইন্দ্রিয়ও তাদৃশ সক্ষম নয়। বস্তুমাত্রেই ইংরেজের হাতে ধরা পড়ে, কিন্তু রূপমাত্রেই ইংরেজের চোখে কিংবা কানে ধরা পড়ে না। সচরাচর শিক্ষিত ইংরেজের চেয়ে আমাদের দেশের সচরাচর রগরেজের চোখ রঙ সম্বন্ধে অনেক বেশি পরিমার্জিত। এই কারণেই বিলাতের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যজাতসকল নয়নের তৃপ্তিকর নয়। এই গোঁড়ায়গলদ থাকবার দরুন, ইংরেজের হাতগড়া জিনিস প্রায়ই আটিসটিক হয় না। ইউরোপের অন্যান্য জাতিসকল এ বিষয়ে ইংরেজের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হলেও অপর আর-একটি কারণে ইউরোপের আর্টের আজকাল হীনাবস্থা। ইউরোপে এখন বিজ্ঞানের যুগ। পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞান বিশ্বকে একভাবে দেখে, আর্ট আর-একভাবে দেখে। বিজ্ঞানের চেষ্টা সোনামঠোকে ধলোমঠো করা, আর্টের চেষ্টা ধলোমঠোকে সোনামঠো করা। বিজ্ঞান আজকাল ইউরোপীয় মানবের মনের উপর অযথা প্রতিপত্তিলাভ করেছে, কেননা বিজ্ঞান এখন মানুষের হাতে আলাদিনের প্রদীপ। সে প্রদীপের সাহায্যে যে শুধু অসীম ঐশ্বর্য লাভ করা যায় তাই নয়, আলোকও লাভ করা যায়। সে আলোকে শুধু প্রকাশ করে বিশ্বের কায়া, বাদবাকি সব ছায়ায় পড়ে যায়, যথা—মন প্রাণ ইত্যাদি। সেই বিজ্ঞানের আলোকে আমরা যদি একমাত্র আলোক বলে ভ্রম করি, তা হলে মানবজীবনের প্রকৃত অর্থ, চরম লক্ষ্য এবং অচ্যুত আনন্দ হতে আমরা বিচ্যুত হয়ে পড়ি। বিবকে শুধু জড়ভাবে দেখলে মনেরও জড়তা এসে পড়ে। কেবলমাত্র পরমাণুর স্পন্দনে হৃদয় স্পন্দিত হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ধর্মের সখী হয়েই কলাবিদ্যা পৃথিবীতে দেখা দেয়। সে সখ্যবধন ছিন্ন করে আর্টকে জীবন্ত রাখা কঠিন। বৈজ্ঞানিক জীবতত্ত্বের মতে মানবের আদিম চেষ্টা নিজের এবং জাতীয় জীবন রক্ষা করা। নিজে বেচে থাকা এবং সন্তান উৎপাদন করা, এই দুটি জীবজগতের মূল নিয়ম। এই দুটি আদিম দৈহিক প্রবত্তির চরিতার্থতা সাধন যদি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তা হলে ‘আবশ্যকতা’র অর্থ অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। যা দেহের জন্য আবশ্যক তাই যথার্থ আবশ্যকীয় বলে গণ্য হয়, আর যা মনের জন্য আত্মার জন্য আবশ্যক, তা আবশ্যকীয় বলে মনে হয় না। ইউরোপে ইউটিলিটির এই সংকীর্ণ অর্থ গ্রাহ্য হবার দরুন ইউটিলিটি এবং বিউটির বিচ্ছেদ জমেছে। ইউরোপের আবশ্যকীয় জিনিস কদর্য এবং সুন্দর জিনিস অনাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এই কারণে আর্ট এখন ইউরোপে ত্রিশঙ্কুর মতো শূন্যে ঝলছে। আহার বিহার এখন ইউরোপের প্রধান কাজ হয়ে ওঠার দরন, যে আর্টিস্ট আর্টকে জীবনের ভিতর নিয়ে আসতে চান তিনি আটকে পূর্বোক্ত প্রবত্তিদ্বয়ের দাসী করে তোলেন। এই কারণেই ইউরোপে এখন নগ্ন শ্রীমতির এত ছড়াছড়ি। শতকরা একজনে যদি ঐরূপ মুতিতে সৌন্দর্য খোঁজেন, অবশিষ্ট নিরানব্বই জনে তার নগ্নতা দেখেই খুশি থাকেন। এ অবস্থায় আট যে শুধু ভোগবিলাসের অঙ্গ হয়ে উঠবে, তার আর আশ্চর্য কি। ইউরোপের পক্ষে কি ভালো কি মন্দ, তা ইউরোপ স্থির করবে। কিন্তু এ কথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে, আমাদের জাতির পক্ষে বিলাসের প্রবত্তি আর বাড়ানো ইচ্ছনীয় নয়। ইউরোপের যথার্থ আর্ট আমাদের অধিকাংশ লোকের পক্ষে আয়ত্ত করা অসম্ভব, কিন্তু ইউরোপীয় সভ্যতার ভোগের অংশটা আমরা সহজেই অভ্যাস করতে পারি। আমার প্রথম কথাও যা, শেষ কথাও তাই। আর্টকে ভোন্তর দিক থেকে দেখা দুরবিনের উলটো দিক থেকে দেখার তুল্য, দুষ্টব্য পদার্থ আরো দুরে চলে যায়। কর্তার দিক থেকে দেখাটাই ঠিক দেখা। আমরা নিজে যা রচনা করেছি, তারই মর্ম তারই মর্যাদা আমরা প্রকৃষ্টপে বুঝতে পারি। আমাদের স্বদেশের কীর্তি থেকেই আমাদের স্বজাতির কৃতিত্বের পরিচয় পাই। আমরা জাতীয় আত্মসম্মানের চর্চা করব বলে চিৎকার করছি, কিন্তু জাতীয় কৃতিত্বের যদি জ্ঞান না থাকে, তবে জাতীয় আত্মসম্মান কিসের উপর দাঁড় করাব, বোঝা কঠিন। জাতীয় আর্ট যে শ্রেণীরই থোক, তার চর্চায় আমাদের জাতীয় কর্তৃত্ব-বুদ্ধি বিকশিত হয়ে উঠবে। এই পরম লাভ। সলভ এবং সহজপ্রাপ্য বিলাতি জিনিসের পক্ষে আবশ্যকতার দোহাই চলতে পারে, কিন্তু আর্টের দোহাই একেবারেই চলে না। বিলাতি-ছিটগ্রস্ত না হলে বিলাতি-ছিটভক্ত হওয়া যায় না। আর যিনি আদর করে দুয়োরে বিলাতি পর্দা ঝোলান তাঁর পর্দানশিন হওয়া উচিত।

সভ্যজাতির পক্ষে দেশের কথা অনেকটা বেশের কথা। পরিচ্ছদের ঐক্য সামাজিক ঐক্যের লক্ষণও বটে, কারণও বটে। আমরা প্রতিবাসীকে প্রতিবেশী বলেই জানি। হিন্দুরা সমাজের সঙ্গে সঙ্গে বস্তু ত্যাগ করেন। সন্ন্যাসের প্রথম দীক্ষা ডোরকৌপীন ধারণ। আমাদেরও বিদেশীয়তার প্রথম সংস্কার কোট-পেণ্টলন ধারণ। বিলেতের বেশ যে ভারতবাসীর পক্ষে সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ অনুপযোগী, সে কথা বলাই বাহুল্য। কথাটা এতই সাদা যে, যিনি তা বুঝতে পারেন না, তাঁর ঔষধ মধ্যমনারায়ণ তৈল, যুক্তি নয়। দেহকে কষ্ট দিলেই যদি মনের উৎকর্ষ লাভ করা যেত, তা হলেও নয় এই বোতাম-কলসের অধীনতা এবং বন্ধন একরকম কায়ক্লেশে সহ্য করা যেত। কিন্তু সখ শরীরকে ব্যস্ত করবার মাহাত্ম্য প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ। যিনিই ‘কলার’ ব্যবহার করেছেন, তিনিই কোনো-না-কোনো সময়ে রাগে দুঃখে এবং ক্ষোভে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে–

ভূষণ ব’লে কিনব না আর
পরের ঘরে গলার ফাঁসি।

 ইউরোপ যে আমাদের বুকে পাষাণ চাপিয়ে দিয়েছে এবং হাতে হাতকড়ি ও পায়ে বেড়ি পরিয়েছে, তার নিদর্শনস্বরূপ আমরা কামিজের প্লেট ও কাফ এবং বুটজুতা ধারণ করি। আমাদের স্বদেশী বেশের প্রধান দোষ যে, তা যন্ত্রণাদায়ক নয়। বিলাতি সম্প্রদায়ের অনেকেরই বিশ্বাস যে, অহর্নিশি গলদঘর্ম হওয়াতেই সভ্যমানব-জীবনের চরম সার্থকতা। সহজ বুদ্ধিতে যা দোষ বলে মনে হয়, বিলাতি সভ্যতার প্রতি অতিভক্তিপরায়ণ লোকের নিকট সেইটিই গুণ। ইংরেজি পোশাক যে নয়নের সুখকর নয়, এ কথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু ভকদের মতে সেই সৌন্দর্যের অভাবেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। ঐ প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে, ও বেশ পযোচিত বেশ। আমাদের পৌরুষের একান্ত অভাববশত পুরুষ সাজবার ইচ্ছাটা অত্যন্ত বলবতী। কাজেই আমরা ইংরেজের অনুকরণে অন্য-সব রঙ ত্যাগ করে কাপড়ে ছাইপাঁশ মাটির রঙ চাপিয়েছি। আমাদের ধারণা, সবচেয়ে সভ্য এবং সবচেয়ে পরষালি রঙ হচ্ছে কালো রঙ। সুতরাং আমাদের নূতন সভ্যতা শুভ্রবসন ত্যাগ করে কৃষ্ণচ্ছদ অবলম্বন করেছে। শ্বেতবর্ণ আলোকের রঙ, সকল বর্ণের সমাবেশে তার উৎপত্তি; আর কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকারের রঙ, সকল বর্ণের অভাবে তার উৎপত্তি। আমরা করজোড়ে ইউবোপীয় সভ্যতার কাছে প্রার্থনা করেছি যে আমাদিগকে আলোক হইতে অন্ধকারে লইয়া যাও এবং আমাদের সে প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে। আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার খিদমতগারির পুরস্কারস্বরূপ হ্যাট-নামক কিম্ভূতকিমাকার এক চিজ শিরোপা লাভ করেছি, তাই আমরা আনন্দে শিরোধার্য করে নিয়েছি। কিন্তু ইংরেজি পোশাক আমাদের পক্ষে শুধু যে অসুখকর এবং দৃষ্টিকট, তা নয়। বেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ লোকের মনের পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী। পুরোহিতের বেশ ধারণ করলে মানুষকে হয় ভণ্ড নয় ধার্মিক হতে হয়। সাহেবি কাপড়ের সঙ্গে মনেও সাহেবিয়ানার ছোপ ধরে। হ্যাট-কোট ধারণ করলেই বঙ্গসন্তান ইংরেজি এবং হিন্দি এই দুই ভাষার উপর অধিকার লাভ করবার পূর্বেই অত্যাচার করতে শর করেন। গলায় ‘টাই’ বাঁধলেই যে সকলকেই ইউরোপীয় সভ্যতার নিকট গললনীকৃতবাস হতে হবে, এ কথা আমি মানি নে। যে মনে নস, সে উত্তরীয়কেও গলববরপ ব্যবহার করে থাকে। তবে ‘টাই’ যে মনকে সাহেবিয়ানার অনকল করে নিয়ে আসে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইউরোপের মোহ কাটাতে হলে ইউরোপীয় বসন বয়কট করাই শ্রেয়। ইউরোপবাসীর বেশে এবং এশিয়াবাসীর বেশে একটা মূলগত প্রভেদ আছে। ইউরোপের বেশের উদ্দেশ্য দেহকে বাঁধা, আমাদের উদ্দেশ্য দেহকে ঢাকা। আমাদের চেষ্টা দেহকে কানো, ওদের চেষ্টা দেহকে ফলানো। আমাদের অভিপ্রায় লজ্জা নিবারণ করা, ওদের অভিপ্রায় শীত নিবারণ করা; তাই আমরা যেখানে ঢিলে দিই, ওরা সেখানে কষে। ইংরেজরা মধ্যে মধ্যে রমণীর বেশকে কবিতার সঙ্গে তুলনা করেন। ইংরেজরমণীর বেশের ভিতর একটা ছন্দ আছে, তার গতি বিলাসিনীদের দেহভঙ্গি অনুসরণ করে; সে ছন্দের ঝোঁক উন্নত-অবনত অংশের উপরই পড়ে। লজ্জা আমাদের দেশে নারীর হদয় অবলম্বন করে থাকে, ওদের দেশে চরণে শরণ গ্রহণ করে। আমাদের মহাসৌভাগ্য এই যে, ভারতরমণী স্বদেশী লজ্জা পরিহার করে বিদেশী সজ্জা গ্রহণ করেন নি। শ্রীজাতি সর্বত্রই স্থিতিশীল, আমরা পুরুষরা গতিশীল বলেই দুর্গতি বিশেষরূপে আমাদেরই হয়েছে। যদি ইংরেজি বেশ উপযোগিতা সৌন্দর্য ইত্যাদি সকল বিষয়েই স্বদেশী বেশের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হত, তা হলেও বিদেশী বেশ অবলম্বন অনুমোদন করা যেত না। ইংরেজি বেশের আর-একটি বিশেষ দোষ এই যে, ও পদার্থে দেহ মণ্ডিত করবামাত্রই অধিকাংশ লোকের মস্তিষ্কের গোলযোগ উপস্থিত হয়। অতিশয় বুদ্ধিমান লোকেও বেশের পক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে অতিশয় নির্বোধের মতো তর্ক করেন। এ বিষয়ে যে-সকল যুক্তি সচরাচর শোনা যায়, সে-সকল এতই অকিঞ্চিৎকর যে বিচারযোগ্য নয়। যাঁরা বেশ পরিবর্তন করেন তাঁরা তর্কের দ্বারা যুক্তির দ্বারা নিজেরাই সাফাই হতে চান, অপরকে ভজাতে চান না। তাঁদের অভিপ্রায়, ফাঁকি দিয়ে নিজেরা সভ্য হওয়া, স্বজাতিকে সভ্য করা নয়। তাঁদের বিশ্বাস, এ সমাজের এ জাতির কিছু হবার নয়, সুতরাং সমাজ ছাড়াই তাঁদের মতে একমাত্র মুক্তির উপায়। এ মনোভাব যে স্বদেশীয়তার কতদূর অনুকূল, তা সকলেই বুঝতে পারেন। কেবলমাত্র সমাজত্যাগে কি করে মুক্তিলাভ হতে পারে? এ প্রশ্ন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, তার উত্তর হচ্ছে, এরা যে চিরকালই স্বদেশী সমাজের অন্তস্থ বণ হয়ে থাকবেন এরূপ এদের অভিপ্রায় নয়; এদের চরম লক্ষ্য হচ্ছে ইংরেজি সমাজে লীন হয়ে যাওয়া। এদের আশা ছিল যে, ক্ৰমে গগাযমুনার মতো সাদায়-কালোয় একদিন মিশে যাবে। কিন্তু আজ বোধ হয় এদের সকলেই বুঝতে পেরেছেন যে, সে আশা মিছে। আমরা সকলেই এ সত্যটি আবিষ্কার করেছি যে, প্রয়াগ পৌঁছবার পূর্বেই আমাদের কাশী প্রাপ্তি হবে।

৬.

আহার সম্বন্ধে বেশি কিছু বলবার দরকার নেই। অপরের বেশ যত সহজে অবলম্বন করা যায়, অপরের খাদ্য তত শীঘ্র জীর্ণ করা যায় না। বিদেশীয় সভ্যতা আমাদের পিঠে যত সয়, পেটে তত সয় না। আমাদের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা দেশে আহার্যদ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করবার কোনোই দরকার নেই। তবে যদি কেহ এমন থাকেন যে, বিদেশী মাছ-তরকারি না খেলে তাঁর প্রাণ বাঁচে না, তা হলে তাঁর প্রাণ বাঁচাবার কোনো দরকার নেই; আর যদি বেচে থাকাটা নিতান্ত দরকার মনে করেন, তা হলে স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে বাস করাটাই তাঁর পক্ষে শ্রেয়।

আহার সম্বন্ধে বিধিনিষেধ-সংবলিত পঞ্জিকাশাকে গঞ্জিকাশাস্য বলে গণ্য করে অমান্য করলেই যে তৎপরিবর্তে কেল নারের কাটালগের চর্চা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিদেশীয়তা প্রধানত আহারের পদ্ধতিতেই আমরা অবলম্বন করেছি। বিলাতি বসন পরে স্বদেশী আসনে বসা এবং স্বদেশী বাসনে খাওয়া চলে না।

ঐ পোশাকের টানেই চেয়ার আসে, সেইসঙ্গে টেবিল আসে, এবং সেইসঙ্গে চীনের কিংবা টিনের বাসন নিয়ে আসে। এর পর আর হাতে খাওয়া চলে না; কারণ হাতে খেলে হাত মুখ দুইই প্রক্ষালন করতে হয়, কিন্তু ছুরিকাটা ব্যবহার করলে শুধু আঙুলের ডগা ধুলেও চলে, না ধলেও চলে। এক কথায় বলতে গেলে, খানায় পোশাকে ‘অঙ্গ-অগী’র সম্বন্ধ বিরাজ করে। আহারের বিষয় উত্থাপন কবে পানের বিষয় নীরব থাকলে অনেকে মনে করতে পারেন যে, প্রবন্ধটি অঙ্গহীন হয়ে রইল; অতএব এ সম্বন্ধেও দু-এক কথা বলা আবশ্যক। পানের বিষয় হচ্ছে-হয় ধম নাহয় তেজ মরৎ এবং সলিলের সন্নিপাতে যে পদার্থের সৃষ্টি হয়, তাই। গাঁজা গলী এবং চরসের পরিবর্তে ভদ্রসমাজে যদি তামাকের প্রচলন বধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে তো সে দুঃখের বিষয় নয়। সুরাপান বেদবিহিত এবং আয়ুর্বেদনিষিদ্ধ। ‘প্রবৃত্তিরেষা নরাণাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা’ এ মনুর বচন। এবং শাস্ত্রমতে যেখানে স্মৃতিতে এবং শ্রুতিতে বিরোধ দেখা যায়, সে খলে শ্ৰতি মান্য। রসিকতা ছেড়ে দিলেও সুরাপানের দোষগুণ বিচার করা এ প্রবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। পানদোষ নীতির কথা, রীতির কথা নয়। সুরাপান একটি ব্যসন, ফ্যাশন নয়। পানাসক্ত লোক পানের প্রতিই আসক্ত, ইংরেজিয়ানার প্রতি নয়। মোহ এবং মদ দুটি স্বতন্ত্র রিপ। আমার উদ্দেশ্য ইউরোপের মোহ নষ্ট করা, তার বেশি কিছু নয়। মানবজাতিকে সুশীল সচ্চরিত্র করবার ভার সমাজনীতি এবং ধর্মপ্রচারকদের উপর ন্যস্ত রয়েছে।

৭.

আমার শেষ বক্তব্য এই, কেহ যেন মনে না করেন যে, কোনো সম্প্রদায়-বিশেষের নিন্দা করবার জন্যই আমি এ-সকল কথার অবতারণা করেছি। যে-সকল ইউরোপীয় হালচাল আমি এ দেশের পক্ষে অনাবশ্যক এবং অবাঞ্ছনীয় মনে করি, সে-সকল কম-বেশি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রবেশলাভ করেছে। আমি নিজে উপরোক্ত সকল দোষে দোষী। আমার সকল সমালোচনাই আমার নিজের গায়ে লাগে। দৈনিক জীবনে আমরা নকলেই অভ্যস্ত, আচার-ব্যবহারের অধীন। ভুল করেছি এই জ্ঞান জন্মানে মাত্র সেই ভুল তৎক্ষণাৎ সংশোধন করা যায় না। কিন্তু মনের স্বাধীনতা একবার লাভ করতে পারলে ব্যবহারের অনুরূপ পরিবর্তন শুধু সময়সাপেক্ষ।

ফাল্গুন ১৩১২

——

(১) জাপানের অভ্যুদয়ের কারণ যাঁরা জানতে চান তাঁদের আমি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থগুলি পড়তে অনুরোধ করি : K. Okakura deals of the East এবং The Awakening of Japan; Y. Okakuraর Spirit of Japan; Nitobeর Bushido; Lafcadio Hearnএর Kokora প্ৰ্মুখ গ্রন্থবলী। যদি কারো এত বই পড়বার সময় এবং সুবিধা না থাকে এবং ফরাসি ভাষা জানা থাকে, তা হলে তাঁকে আমি Felicien Challayeর Au Japan নামক গ্রন্থ পড়তে অনুরোধ করি। লেখক গুটি পঞ্চাশ পাতায় আসল কথা অতি পরিষ্কার করে বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *