৩. বস্তিটা আবার জমে ওঠার চেষ্টা করে

তার পর ঘণ্টাকয়েক বাদে বস্তিটা আবার জমে ওঠার চেষ্টা করে। সবাই ঝটপট আসে, খায়, খেয়ে চলে যায়। যত তাড়াতাড়ি আসে, তত তাড়াতাড়ি খায়। ছোটে তার চেয়েও তাড়াতাড়ি।

কোনও কোনও ঘরে হঠাৎ মারামারি লেগে যায়। সেখানে রান্না হয়নি, ক্লান্ত ক্ষুধিত পেটে দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু পেট আর মেজাজ তা মানবে কেন। শুরু হয়ে যায় মারপিট বউ বাচ্চাগুলোর উপরেই। ফলে শুরু হয় কান্না, গালাগালি। ঠিক এ সময়েই হয়তো ওঠে সেই বুড়োটে গুরুগম্ভীর গলার গান। এত নির্বিকার, নির্বিবোধ সেই গলার সুর।

হাঁক পড়ে বাড়িওয়ালার বাজখাই গলার, আবির্ভাব হয় তার বিরাট লোমশ বপুর।

তার পর সারা দুপুরটা যেন বস্তিটা ঝিম মেরে পড়ে থাকে। বেকার মেয়েরা ও ছোট বাচ্চারা থাকে ঘাটে মাঠে রেললাইনে গোবর, পোড়া কয়লা কাঠের সন্ধানে। সমস্ত বস্তিটা থেকে যেন ভাপ উঠতে থাকে, ভ্যাপসা দুর্গন্ধ একটা এসময়েই যেন ফাঁক পেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। পাশের সুদৃশ্য বাড়িটার নরনারীদের কথাবার্তার দু-চারটে হালকা টুকরো ভেসে আসে নিরালা পেয়ে, নয়তো রেডিয়োযন্ত্র বা কণ্ঠ সংগীতের রেশ ভেসে আসে, যেন কোন্ সুদূর অমরাপুরী থেকে সুরের মায়া ঢেউ দিয়ে যায় মর্তের এ অন্ধ পাতালে। জানালার সুদৃশ্য পরদা খুলে যায় কখনও। একটি মুখ, কিংবা বিচিত্র রং জামা উঁকি দেয় জানালা থেকে।

আর অন্যান্য সময় ঝামেলায় হট্টগোলে যখন নজর করা যায় না, সেটা এখন দেখা যায় যে, ওই বাড়িটার দোতলা জানালা থেকে সব সময়েই কিছু না কিছু খোলার চালটায় পড়ছে। থুতু, মেয়েদের আঁচড়ানো চুলের ঝরা গুচ্ছ, কাগজের টুকরো, পরিত্যক্ত ন্যাকড়ার ফালি, এক ঝলক জল। যেন খোলার চালাটা একটা আস্তাকুঁড়। আর বাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে কিছু ফেলতে গেলে ওখানে এসে সর পড়বেই।

গোবিন্দের নজরে পড়ল, সেই সকাল থেকে একটা ঘর একইভাবে দরজা খোলা পড়ে আছে কোণের দিকে। দরজাটার সামনে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের বাসন পড়ে আছে এঁটোর শুকনো দাগ নিয়ে। কেউ সারা দিন সেদিকে একবার তাকিয়েও দেখেনি। বোধ হয় ঘরটায় মানুষ নেই। কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যায় না।

সে আস্তে আস্তে গিয়ে দরজাটা খুলে ফেলতেই ধ্বক করে উঠল তার বুকটার মধ্যে। আড়ষ্ট কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। বুঝি দম নেই তার, বুকের ধুকধুকিটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। অসাড়!

সে ভয়বিস্মিত চোখে দেখল, বাঁশের খাটিয়ার ময়লা স্যাঁতসেঁতে কাঁথার উপর কঙ্কাল শশায়ানো রয়েছে একটা! একটা ময়লা শাড়ি দিয়ে গলা থেকে পা অবধি তার ঢাকা। সেই কঙ্কালের কপালের নীচে আছে শুধু এক জোড়া অসহ্য ঝকঝকে বড় বড় চোখ, মণি দুটো যেন আগুন ধরানো মানিক। সমস্ত খাটিয়ার নোরা বিছানাটার মধ্যে ওই চোখজোড়া ছাড়া আর কিছু নেই।

দরজা খোলা ও মানুষের সাড়া পেয়ে সে চোখ যেন তীব্র অভিশাপে জ্বলে উঠল যেন নিঃশব্দে। অথচ ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল পাতালের অন্ধ শান্তি। একবার বোধ করি নড়েও উঠল সেই কঙ্কালমুর্তি, একবার কেঁপে উঠল বা তার নাকে পরানো রূপোর নাকছবি।

এমনি একটু সময় তাকিয়ে থাকার পর অন্ধকারটা থিতিয়ে এল, তখন গোবিন্দ চমকে উঠে আরও দেখল, একটা পাথরে কোঁদা কালো মূর্তি ড্যাব ড্যাবা চোখে ভূতের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে ঘরের কোণে। খালি গা, খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি মুখ ভরতি।

গোবিন্দের মনে হল যমের দোসর চুপে চুপে এসেছে আত্মাহরণ করতে। কী করবে সে হঠাৎ

ভেবে পেল না। চলে যেতেও পারল না, জিজ্ঞেস করতেও পারল না কিছু।

ওখানে কী দেখছ ফোরটুয়েন্টি? বলতে বলতে কালো এসে পড়ল এখানে।

গোবিন্দ যেন ধড়ে প্রাণ পেল। কালোও একবার সে দৃশ্য দেখে আপন মনে মাথা নাড়ল। বলল, ও আমাদের লড়াকু গণেশ আর ওইটে ওর বউ, ব্যামো হয়েছে। ওরা দুটোয় একদিন এ বস্তি মাথায় করে রাখত। বলে সে এক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, গণেশ, কতদিন তুই এ ভাবে পড়ে থাকবি?

অন্ধকারের মূর্তি সে কথার কোনও জবাব দিল না। চোখ ফিরিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ সেখান থেকে উঠে খাটিয়ার পাশে এসে একটু দাঁড়াল। তার পর ঝুঁকে পড়ে গোবিন্দ ও কালোর দিকে ফেরানো বউয়ের মুখটা ঘুরিয়ে দিল আস্তে আস্তে অন্যদিকে। পিঠের তলে চাপা পড়া চুলের গোছা আলতো করে সরিয়ে শিয়রের দিকে এনে ছড়িয়ে দিল। তার পর যেন সেই কতদূর থেকে ডাকল ধীরে ধীরে, দুলারী বউ। …

কঙ্কাল মেয়ের সেই চোখের পাতা যেন আরও খানিক খুলে গেল আর সে দৃষ্টি হয়ে উঠল এক প্রেমবতীর অনুরাগ ভরা। একটু বুঝি বা নড়ল তার ঠোঁট। নিরালঙ্কার হাত একটু তোলার চেষ্টা করল, পারল না।

গণেশ তাড়াতাড়ি সেখানে বসে পড়ে কাঠি কাঠি হাত দুটো তুলে নিল। মুখের কাছে গিয়ে দুলারীকে জিজ্ঞেস করল, দরদ হচ্ছে? দে একটু হাত বুলিয়ে দিই।

তারপর হাতটার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেঙে না যায়!

কালো তার স্বভাবগত থমধা ভাব থেকেই হঠাৎ বলে উঠল, শালা নিজেই মেরে ফেলেছে বউটাকে, তা বুঝবে না, বুঝবে না।

গোবিন্দ নিঃশব্দে তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। কালো সেই চাউনির জবাবেই বলল, তা নয়তো কি? ও কামে যাবে না বউ ছেড়ে, কামাই করবে তো কী হবে? কোথায় ডাক্তার কোথায় দাওয়াই? বলে, কী করে ছেড়ে যাই, কখন মরে পড়ে থাকবে। আমি সামনে বসে থেকে ওর মরণ দেখব। বেতমিজ!

বলতে বলতে কালোর গলাটা অস্বাভাবিক মোটা আর ধীর হয়ে এল, অথচ ওর কামাইয়ের পয়সা এ বস্তির সবাই হাত পেতে নিয়েছে তাদের দুঃখ ধান্দায়। ওদের দুটো প্রাণ ছিল, হ্যাঁ! কিন্তু বউটা ব্যামোয় পড়ল আর ডাক্তারও শালা তেমনি এত এত টাকা চায় খালি। বলে, আজ দশ, কাল বিশ, কী ব্যামো রে বাবা। এত এত টাকার দরকার, আর তার মধ্যে ও ক-দিন ধরে কলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এত নিরাশ এত উদাস…

আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল কালো, রুদ্ধশ্বাস গলায় বলল, হ্যাঁ তেরো দিন হাজত খেটেছে এই আমাদের জন্য। আধপেটা রেশনের খিদায় হরতাল হয়েছিল। তখন এই গণেশ ফটিচার ম্যানেজারের গলা ধরে কারখানা থেকে বার করে দিয়েছিল। হ্যাঁ…আর ওর বউ ওদের…এত মহব্বত।

হারিয়ে গেল কালোর গলার স্বর এবং এদের সেই গভীর মহব্বতের কথা বলতে গিয়ে বোধ হয় তার বুকের ক্ষতটা খোঁচা খেয়ে দগদগে হয়ে উঠল। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে এত কথা, সে একবারও মুখ তুলল না। গোবিন্দ কেবলি ভাবল, এ কী সর্বনেশে, কর্মনাশা সব-ভণ্ডুলকরা ভালবাসা! বুঝি তার প্রাণটা মস্ত বড় বলেই!…গণেশ আর দুলারীর দিকে তাকাতে গিয়ে তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠল সেই ছুতোর বউয়ের ছবি, সেই কঙ্কালসার মায়ের উঠোনভরা দাপাদাপি।

ইস্! এ কী হতভাগা জায়গায় এসে পড়েছে সে। যেখানে সমস্ত কিছুই প্রাণান্তকর, কালোর সেই উপহাসের মতোই মৃত্মগামী, অবসাদগ্রস্থ নিরাশার জঞ্জালে ভরা! যেখানে আছে শুধু রোগ শোক পীড়ন আর তাকে এড়াতে গিয়ে ক্ষণিকের লালসা চরিতার্থতা, মুহূর্তের ফুর্তি। যেখানে কেবলি জীবনের ফেলে আসা গ্লানির ছবি বার বার সামনে এসে দাঁড়ায় সেখান থেকে পথে পথে নিঃসঙ্গ জীবনই ভাল নয় কি। করাত হাতে পথে পথে ছুতোর মিস্তিরি চাই বলে শ্রমের কথা হেঁকে হেঁকে দেশ হতে দেশান্তরে যাব। গাঁয়ের মারী ব্যায়ো গাঁয়ে থাকবে, ঘরের শোক মুখ দিয়ে পড়ে থাকবে ঘরে, ভালবাসা বাসা বেঁধে থাকবে, হৃদয়ে ছাড়াছাড়ির পোড়ানির জন্য। আকাশ ছুঁড়ে বৃষ্টি আসবে, শুকোবে আবার, ঝড় আসবে সেও যাবে।…থাকবে শুধু পথ। আমি সব পেছনে ফেলে চলে যাব দিক হতে দিগন্তে মুক্ত পাখির মতো। মরণও যেদিন আসবে, আসবে মৃত্যুদূত একাকী হঠাৎ পথের উপর, তার কাছে প্রাণ সঁপে দিয়ে বলব, চলো। আর কিছুই চাইনি, তোমার জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম। আজ এসেছ। কী ভাগ্যি, দশজনের সামনে আমার এ পোড়া প্রাণ হারাতে হয়নি। আমি সে ভিড় চাইনি।

পেছনে তাকিয়ে দেখল বাড়িওয়ালা এসে দাঁড়িয়েছে। তার ঘন গোঁফ ও খোঁচা দাড়িভরা মুখটা দলা পাকিয়ে উঠেছে কুঁচকে। চোখ নেই, আছে একজোড়া মোটা মোটা লোমশ ভু। ফোলানো নাকের পাটার পাশে গভীর কোঁচ দুটিতে তার ব্যথা না রাগ কিছু বোঝবার জো নেই। সে আপন মনে বলতে লাগল, কোনও দোষ নেই আমার, আমি কী করব। কলে যাবে না, কামানো বন্ধ করল। আমি কী করব।

তার পর আশেপাশে কেউ নেই দেখে বলল, হাসপাতালের মতো পাকা বাড়ি হলে এরকম ব্যামো হত না। বস্তি কিনা!..কিন্তু ওকে এবার আমি মেরে কাজে পাঠাব, ঠিক দেখে নিয়ো।

তবু গণেশ মুখ তুলল না দুলারীর উপর থেকে। দুলারীর রুগ্ন দেহের বেদনায় লয় হয়ে গিয়ে সে হাত বুলোচ্ছে। বুঝি, না সে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে, না মৃত্যুকে প্রতিরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো।

সে দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে এক সময় অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল গোবিন্দ। যেন দুলারীর ব্যামো এসে গ্রাস করতে চাইছে তাকে, নোংরা দুর্গন্ধ কাঁথা কাপড়গুলো জড়িয়ে ধরছে তাকে। ছুতোর বউ যেন শুয়ে শুয়ে দাপাচ্ছে খাটিয়াটার উপর, মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে তার সামনে। এমনি করেই মরবে ছুতোরের বউয়ের মতো বউয়েরা।

দেহের রক্তবিন্দুতে অণুমাত্র শক্তি থাকলেও মানুষের হৃদয় অথর্ব হয়ে থাকতে পারে না। দুর্বিপাকে সে মানে না কোনও সঙ্কোচ, কোনও লজ্জা। একদিন সে তার উত্থানশক্তি রহিত এ শরীরকে দিয়েছে। ধিক্কার দিয়েছে কৃপণ মৃত্যুকে, যে তাকে না মেরে চোখ ভরে দেখিয়েছে ছুতোর বউয়ের মরণ। আজ সে কেমন করে চুপ করে থাকবে! তবু সামনে এগুতে গিয়ে সে যেন চকিতে কীসের এক সংকোচে থেমে গেল। পরমুহূর্তে সে হঠাৎ ঘরে ঢুকে শক্ত হাতে গণেশকে টেনে দাঁড় করাল। তার পর স্থির চোখে কঠিন গলায় বলল, সরে দাঁড়াও, সরো।

মনে হল, মৃত্যুদূতের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল স্বয়ং জীবন।

গণেশ আচমকা ভ্যাবাচাকা খেয়ে উঠে দাঁড়াল। অর্থহীন বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল গোবিন্দের দিকে।

কোনও এক অন্য জগৎ থেকে যেন ফিসফিস করে বলল গোবিন্দ, তুমি আবার ঘর করবে বউ নিয়ে?–কিন্তু মৃতপ্রায় দুলারীর চোখে ধ্বকধ্বক করে আগুন জ্বলে উঠল। আশ্চর্য! এখনও এত আগুন আছে তার চোখে! যেন ফণিনীর মাথার মণি কেউ কেড়ে নিয়েছে। গোবিন্দ তাড়াতাড়ি গণেশের জায়গাটিতে এসে বসল। পরিবেশ বিস্মৃত এক বিচিত্র মানুষ সে। চোখে তার অদ্ভুত আলো। দুলারীর দিকে চেয়ে আকুল গম্ভীর গলায় বলল, মরবে? কোন সুখে? মরে তুমি লড়িয়ে মানুষটাকে মারবে? তুমি চাইলে তোমাকে সবাই দেখবে। গণেশের এখনও কত ক্ষ্যামতা, ওকে কাজ কামে পাঠাও, মাইরি বলছি।

বলতে বলতে গলাটা চেপে এল গোবিন্দের। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। তবুও বলল ফিসফিস করে, মাইরি কোন্ শালা মিছে কথা বলে।

কালো বাড়িওয়ালা, সবাই কাট! যেন সত্যি কোনও গুণতু করছে ফোরটুয়েন্টি গোবিন্দ, এমনি তাদের ভাব।

দুলারীর অপলক জ্বলন্ত চোখ যেন আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে এল, খানিকটা সংশয় ও বিস্ময়ের ছায়া এসে পড়ল সেই চোখে। খানিকক্ষণ এমনি তাকিয়ে থাকতে থাকতে কয়েকবার চোখের পাতা কেঁপে উঠে তা বন্ধ হয়ে গেল। দু-ফোঁটা জল চকচক করে উঠল চোখের কোণে। তার কানে লেগে রইল, বাঁচো, বাঁচো গণেশের বউ।

কয়েক মুহূর্ত একেবারে স্তব্ধ। গোবিন্দ নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে গণেশকে বলল, আর কাঁথাটাথা আছে?

গণেশ ঘাড় নেড়ে জানাল আছে।

গোবিন্দ বলল, বার করো।

গণেশ জাদুকরের মন্ত্রদণ্ড-নির্দেশচালিতের মতো একটা চটের বোঁচকা খুলে একখানা নক্সী কাঁথা বের করল। কাঁথাটির চারপাশে লাল সুতো দিয়ে গোলাম কুঁড়ির বেড়া। মাঝখানে নীল সুতোর ঘন ঘন ফোঁড়ের মধ্যে মস্ত একটি পদ্মফুল। গণেশ হয়তো তার দুলারী বউয়ের এ স্মৃতি রেখে দিতে চেয়েছিল।

গোবিন্দ তার হাত থেকে কাঁথাখানি নিয়ে বলল, বউকে কোলে করো, আস্তে করে তোলে।

গণেশ মুহূর্ত দ্বিধা করে স্থির রইল, তারপর দু-হাতে ভাল করে সাপটে তুলে নিল দুলারীকে বুকের মধ্যে।

কালো এবং বাড়িওয়ালা স্তব্ধ বিস্ময়ে এ দৃশ্য দেখছিল। তাদের বাক্য রহিত হয়ে গেছে একেবারে। গোবিন্দ দুলারীর পরিত্যক্ত বিছানা ধরে টান দিল। ইস, বিছানা শুধু স্যাঁতসেঁতে নয়, খানে খানে ভেজা এবং ময়লা গন্ধ ও দাগ রয়েছে। কিন্তু সে থামল না। সে বিছানা তুলে ছুড়ে ফেললে বাইরে। খাটিয়াটা থেকে যেন রোগের ভাপ বেরুচ্ছে। তার পর সে খাটিয়াটা ঘরের বাইরে নিয়ে এসে রাখল খোলার ছাউনি ছায়ায়। বার কয়েক জোরে জোরে মাটিতে ঠুকে ঝেড়ে নিল। তার পর সেই কাঁথাখানি দিল পেতে।

পেতে দিয়ে বলল গণেশকে–দেও, শুইয়ে দেও।

গণেশের এক মুহূর্ত দ্বিধার ফাঁকে কালো জিজ্ঞাসা করল, বাইরে?

হ্যাঁ, এই আকাশের তলায়, এই রোদে হাওয়ায়, দরকার হলে মাঠের ধারে রেখে আস্ব ওকে সারাদিন। দৃঢ় গভীর গম্ভীর গলায়, শান্ত অথচ আবেগের সুরে বলল গোবিন্দ, রোগ তো ওই নোরা বিছানায়।…ওই ঘরে, ঘরের ওই অন্ধকারে। রোগ তো ভাঙা টুণ্ডা বুকে, মরণ যেখানে সব শেষের ভরসা নিয়ে বসে আছে। গণেশের বউ যদি বাঁচে, তো বাঁচবে গণেশের বাঁচার সাধের জন্য। গণেশ আস্তে করে শুইয়ে দিল দুলারীকে সেই বিছানায়। প্রথম আলোর পলকটা সইল না তার চোখে। কয়েকবার পিটপিট করে চোখ বুজে রইল সে। আলোতে তার কঙ্কালসার শরীরের বর্ণ বদলে গেছে। ভাবলেশহীন মুখে তার ভাবের সঞ্চার হয়েছে যেন, সুশীতল আরামের একটা উদার ছাপ পড়েছে যেন তার মুখে।

গণেশ দুলারীর চোখে জলটুকু মুছিয়ে দিল।

গোবিন্দের বার বার মনে হল, কালে আজ ফুলকির পায়ের কাছে বসে কালো যে মরণ চেয়েছিল, সেই মরণের নেশায় ঝুঁদ হয়ে দুলারী তাড়াতাড়ি মরতে চেয়ে মুক্তি দিতে চেয়েছিল গণেশকে। কিন্তু সে কি মুক্তি?

হ্যাঁ, মুক্তি সে পথের, দূর-দূরান্তরের, সব ছাড়ার, সব হারানোর।…তবু হায়রে মানুষের মন। যে আকাশটুকু না হলে তোর বাঁচন নেই, সেই আকাশের তলায় তুই আবার গডিস ঘর, বেঁচে থাকিস রোগ বালাই নিয়ে, ঝড়ে বন্যায় দাঁড়াস বুক দিয়ে, নাড়ি-ঘেঁড়া তোর রক্ত বীজের ধন দিয়ে করিস সোহাগ। পৃথিবী ছাড়ালে কি ছাড়িয়ে যাওয়া যায় মানুষকে। আর পৃথিবী জুড়ে আছে পথ, কিন্তু তার ধারে ধারে আছে কোটি ঘর।

ভাবতে ভাবতে বুকটা বড় টনটন করে উঠল গোবিন্দের। গণেশকে বলল নোংরা বিছানাগুলো দেখিয়ে, যাও, ধুয়ে নিয়ে এসো এগুলো। গোমড়া মুখে এট্ট হাসসা, হাসো, আমার মুখের দিকে  দেখলে আর কী হবে। জানটা অত শস্তা নয়, বুঝেছ।

তার পর স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রূপের ভঙ্গিতে হেসে বলল, জানো কালো, মরব তো সবাই, এ ব্যাটা আগেই ফাঁকি দিয়ে মরতে চায়। তা কি হয় চাঁদ! হা হা হা! মনে মনে বলল, পথ, যদি সময় আসে তোমার কাছে যাব। কিন্তু ছুতোর বউ, তুই বাঁচিস দুলারী হয়ে, প্রাণ ভরিস দশজনার গণেশের, নইলে ছাড়ান নেই আমার।

গণেশ খানিকটা অবাক নির্বোধের মতো বিছানাগুলো নিয়ে চলে গেল। কিন্তু গোবিন্দের হাসিতে কেউ যোগ দিতে পারল না। তারা তেমনি তাকিয়ে রইল গোবিন্দের দিকে।

গোবিন্দ এক মুহূর্ত সবাইকে দেখে সেখান থেকে চলে গেল। সে লজ্জা পায়নি। তার হাসি পায়নি। তার গলার কাছে ঠেলে আসছিল কিছু একটা। মনে মনে বলছিল সে, উল্লুক! দুনিয়াটা শালা এক একসময় উল্লুক হয়ে যায়।

বাড়িওয়ালা তেমনি হতবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ ফিরিয়ে তাকাল কালোর দিকে। যেন এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।

হঠাৎ বাড়িওয়ালা বলে উঠল, এ যদি ফোরটুয়েন্টি না হয় তো, আর কী হতে পারে আমি জানি। নইলে শালা জরুর কেরেস্তানদের পারিবাবা ছিল।

কালো বলল, দাগা খাওয়া মাল কি না। শালা পাগলও হতে পারে।

অমনি বাড়িওয়ালা খেকিয়ে উঠল, তোর মততা, না?

কালো ভাঙা দাঁত দুটো বার করে বলল, তোমার মতোও হতে পারে।

একটা ঘুষি শূন্যে তুলে থেমে গেল বাড়িওয়ালা।

ফিরে যেতে যেতে খালি বলল, সব শালা চারশো বিশ। সব কটাকে হাটাব এখান থেকে দাঁড়া।

তবুও তারা বুঝল, তাদের মনে একটা বিস্ফোটক তীব্র ব্যথায় টনটন করছিল। সাহস এবং ভরসা করে গোবিন্দ মুক্ত করে দিয়েছে বিষটুকু।

 কেবল নির্বাক দুলারী অপলক চোখে তাকিয়ে রইল শুন্যে। আর তার বুকের ধীর ধুকধুকিতে বাজতে লাগল, বাঁচতে চেয়েছি। আর কেন যেন তার বার বার মনে হল, গণেশ ভালবেসে মরতে চায়নি। জীবনের উপর রাগ করে সে মরতে চেয়েছিল। ও মানুষটা এসে সব ভেঙে দিল। মানুষটা, কে মানুষটা। মনে হয়, কতকালের চেনা, যেন তার জীবনের চিরদিনের বন্ধু ওই আদমিটা।

দু-দিন কেটে গেল।

সন্ধ্যায় ঘনায়।

গোবিন্দ কয়লা ভাঙছে।

সারা বস্তিতে কোলাহল শুরু হয়েছে। বাইরের মানুষেরা ঘরে ফিরেছে সব। তাদের কথাবার্তা, গান গল্প ঝগড়া বিবাদের শেষ নেই। অভাব নেই প্রসঙ্গের। এর মধ্যে আছে মাতালের নেশামত্ত ধ্বনি, দুনিয়াকে থোড়াই কেয়ার করার বুক-ঠোকা বাহাদুরি কিংবা ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ কোনও দুঃখের কথা মনে করে সুর করে শুরু হয় ফুঁপিয়ে কান্না। কেউ কেউ টেরি, পোশাক বাগিয়ে শরিফ মেজাজে বেরিয়ে পড়ে, কারও কারও থাকে অভিসারের তাড়া।

এর মধ্যেই চলেছে দিল-ছিপছুপ মহব্বতের রঙ্গ খেলা, ইশারার গান দু-এক কলি। যারা একই কারখানায় অনেকে কাজ করে তাদের বসেছে মজলিশ। কোন্ সাহেব ভাল আর মন্দ সে কথায় আছে বহু পরস্পরবিরোধী যুক্তিতর্ক, কোন্ সদার কার কাছে কত টাকা খেয়েছে, কোন্ কেরানিবাবু কতটা ভাগ বসিয়েছে তাতে, ইত্যাদি থেকে শুরু করে এ দফার পাট ভাল না মন্দ, ঘড়িকলটা কী করে বিগড়েছে, ছাঁটাই, নয়া মেশিন, খারাপ আওরত এবং ওয়ার্কস কমিটির মাথায় হাত বুলোনো চাল পর্যন্ত। কোনও কিছু বাদ নেই। এমন কী সাহেবদের কে কতটা মাতাল হয় ও ঘড়ি ঘড়ি সিগারেট ফোঁকে, কে একটু মজাদার ও মেয়ে মজুরের সঙ্গে জমাবার চেষ্টা করেছে এবং মেমসাহেবেরা কে কার স্বামীকে ফেলে দোরা সাহেবের সঙ্গে ফুর্তি করতে গিয়েছিল, ফলে কোঠিতে মারামারি লেগেছিল সাহেবদের মধ্যে–সে সব আলোচনাও এর মধ্যে যুক্ত হচ্ছে। ঘরোয়া আললাচনার মতো।

বস্তির বাইরের রকে বসেছে বাড়িওয়ালার নিজস্ব মজলিশ। আসলে সেটা গাঁজার মজলিশ। সেখানে যার যা খুশি তাই বলে। বলে বেশি বাড়িওয়ালাই, সবাই তা শোনে। একটি বাঁধা আড্ডা। কিন্তু হট্টগোল নেই। আর যাদের একটু ঝামেলা কম, তারাই এসে বসে এখানে। সেখানে খানিকক্ষণ উশখুশ করে কালো উঠে এল। সে চাকরি পেয়েছে, দৈনন্দিন উনুন আর হাঁড়ি ধোয়ার কাজ শেষ হয়েছে তার! তবু অনেক দিনের অভ্যেসের জন্য তার মনটা পড়েছিল রান্নাঘরের দিকে। তা ছাড়া গোবিন্দের উপর তার মনটা কেমন পড়ে গিয়েছিল। সে এসে দেখল গোবিন্দ উনুনে ঘুটেতে ফেঁসোর আগুন ধরিয়ে কয়লা ছেড়ে দিচ্ছে। বেশ হাত চালিয়ে কাজ করছে গোবিন্দ। কয়লা ঢেলেই সে শিলনোড়া নিয়ে পড়ে।

বাঃ তুমি বেশ কাজের আছ তো? কালো হেসে হেসে বলল। তা দেখো, এ শালার কাজে দু-এক ছিলিম না হলে জমে না। জুত হয় না।

তা ফোকটিয়া পেলে–গোবিন্দ আড়চোখে তাকিয়ে হাসল।

কালো চোখ ঘোঁচ করে বলল, হুঁ? না বলতেই…?

বলে সে উঠে চলে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এল বেশ দুরস্ত করে সাজানো, হাতের চেটোয় ঘষা চকচকে কলকে নিয়ে। গোবিন্দের পাশে বসে বলল, নেও, টেনে নেও।

না আগে তুমি।

তা কী হয়। তুমি একটা পাঁড় ওস্তাদ।

ও শালা যে টানে সে-ই মহাদেব হয়, ওস্তাদ বনে। নেও নেও।

উঁহুঁ, তুমি পেসাদ করে দেও।

শালা পাক্কা ফোরটুয়েন্টি। বলে অগত্যা কালো গোটা কয়েক টান দিয়ে কলকে তুলে দিল গোবিন্দের হাতে।

গোবিন্দের কলকে বাগিয়ে ধরার কায়দা দেখেই কালো ভ্রূ কোঁচকাল। তার পর টানের কেরামতি দেখে বেশ উল্লসিত গলায় তারিফ করে উঠল গোবিন্দের পিঠে চাপড় মেরে, বাঃ বাহরে ওস্তাদ, সবই জানো দেখছি।

গোবিন্দ কোনও কথা না বলে চোখ বুজে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কলকেট তুলে দিল কালোর হাতে। কালো অবশিষ্টটুকু শেষ করে কলকে উপুড় করে দিল।

তার পর তারা দুজনেই কিছুক্ষণ ধোঁয়া তপ্ত রক্তচক্ষু দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ কালো বলে উঠল, তুই শালা পাগল আছি।

গোবিন্দও বলল, আমি যদি পাগল হই, তুই শালা ডবলপাগলা তালে।

কথা শেষে তারা দুজনেই হো-হো করে হেসে উঠল। পরস্পরের মধ্যে তাদের অদ্ভুত জমে গেছে।

কালো বলল, আচ্ছা, তোর আর কে আছে বল তো, সত্যি বলবি।

গোবিন্দের গলাটা গাঁজার নেশায় পালটে গেছে। বলল, কেউ নেই।

মাইরি?

মাইরি।…তবে এই তোমরা আছ।

বে শাদি কিছু—

হয়েছিল।

কী হল?

কেটে পড়ল। বলে হাসতে গিয়ে মুখটা বিকৃত হয়ে গেল গোবিন্দের।

কালো ঠিক বোধ হয় বুঝতে পারল না লোকটা তাকে ফোরটুয়েন্টি করছে কি না।

গোবিন্দ নোড়া নিয়ে শিলের উপর উপুড় হতে গিয়ে হাত নেড়ে আবার বললে, আর আটকুঁড়ো নই, ছেলেমেয়েও হয়েছিল। সবসুদ্ধ গায়েব হয়ে গেছে। কালো বিশ্বাস করতে না পেরে গোবিন্দের মুখটা তুলে ধরল তার দিকে। গোবিন্দের লাল চোখ দুটো তখন যেন কোন দূরে পড়ে আছে, কী দেখছে।

কালো জিজ্ঞেস করল, কাটল কী রকম?

খাবি খেয়ে খেয়ে, দাপিয়ে, ঠিক যেভাবে পোড়া মাছ মরে। বলতে বলতে গোবিন্দের গলাটা অত্যন্ত তীব্র আর চাপা হয়ে এল।

কালো গোবিন্দের মুখরে কাছে মুখটা এনে তাকিয়ে রইল একটু, তারপর গোবিন্দের হাঁটুতে হাত রেখে যেন ঝিমিয়ে পড়ল, আর এক হাতে গোবিন্দের একটা হাত চেপে ধরল জোরে।

বাড়িওয়ালা কিছুক্ষণ আগেই এসেছিল কিন্তু এদের কথাবার্তা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল দরজার আড়ালে। তার পর যখন দেখল ওরা পরস্পর ওইভাবে বসে রইল তখন প্রায় একটা হুঙ্কার দিয়ে সে ঘরে ঢুকল। হুঁ! বাঃ সাজানো কলকেটি এনে এখানে দুজনে বেড়ে জমে গেছ? আর আমি ওখানে গলা শুকিয়ে–

হাত ঝটকা দিয়ে বলল কালো, তুমি বুঝবে না বাড়িওয়ালা, এ-সব আমাদের কথা।

বাড়িওয়ালাও তাদের পাশে বসে পড়ল এবং বিদ্রূপের স্বরে বলল, ওঃ দুনিয়ায় খালি তোদেরই ঘর সংসার ছিল, তোদেরই খালি সুখ দুঃখের কথা আছে, আর কোনও মানুষের কিছু নেই।

না—তা বলছি না।

থাম্! ধমকে উঠল বাড়িওয়ালা। তার পর আপনমনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে চাপা গলায় বলে উঠল, কী হবে, কী হবে সে প্যানপ্যানানি গেয়ে? কী দাম আছে? আশমান থেকেও এক ফোঁটা পানি পড়বে না। তবে? ওই তো গণেশ, দুঃখ নিয়ে পড়ে আছে। গোবিন্দ বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলেছ তুমি বাড়িওয়ালা, ওতে কিছু হয় না।

হ্যাঁ, এই তুমি বুঝবে। বলে সে গোবিন্দের আরও ঘন হয়ে এল। বলল, বলল তো এই সংসারে দুঃখ কার নেই? কার শালা কোন্ বাসনাটা পুরেছে, কে কী চেয়ে পেয়েছে?

পায় না, ঠিক। গোবিন্দ বলল, আর পায় না বলেই জানো কেউ শালা পাগল হয়, আর কেউ শালা সব ছেড়ে পথ ধরে। কিন্তু যাবে কোথায়? আর পাগল হলেও তার রেহাই কোথায়? মানুষের আশা কখনও মরে?

বলতে বলতে গোবিন্দের চোখের উপর ভেসে উঠল দুলারীর কঙ্কাল মুখ। হ্যাঁ, আশা যদি মরবে তবে দুলারীর ওই মরণােন্মুখ মুখ দেখে তার ছুতোর বউয়ের কথা মনে হয়েছিল কেন? আর কী বলে সে ছুতোর বউকে বাঁচতে বলল দুলারীর মধ্যে? নিজের জীবনে পোড় খেয়ে খেয়ে বুঝেছে, হতাশা সাপের চেয়েও বেইমান। একবার প্যাঁচ দিয়ে ধরলে ফোঁস করে ফণা তোলে মাথার উপরে। আবার বলল, জানো, বাংলায় এট্টা কবিতা আছে।

কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভু আশিবিষে দংশেনি যারে। আমি যে শালা জানি। হাত-হপ্তা মিটিয়ে পেটের তেজটি মেরে যে ছেড়ে দেয়, সে এক দুশমন। আমাদের প্রাণে আর মনে আরও অনেক দুশমন আছে। সে-সব তাড়াতে হবে, বুঝলে। ওই যে গণেশ, ওকে এট্টা দুশমন ধরেছিল, শালা, শুষে খেয়ে ফেলত ওকে।

কালো রক্তচক্ষু বড় বড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বলল, বা বা বা, শুনলে বাড়িওয়ালা। শালা যেন আমাদের গুপ্ত মাস্টারের চেয়েও খাঁটি কথা বলে। বাড়িওয়ালা ভাবছিল অন্যদিক, সন্তর্পণে বলল, হ্যাঁ, মানুষের আশা কখনও মরে না। এই ধরো সত্যি বলছি আমার টাকা খুব বেশি নেই, তবে জমিটা মৌরস করাতে পারছি না বলে—

বলতে বলতে হঠাৎ থেমে শামুকের মতো চোখ দুটো সুর তলায় ঢেকে তাকাল গোবিন্দের দিকে। বলল, মুখ ফেরালে কেন তুমি? মুখ ফেরালে কেন?

গোবিন্দ বলল, তো কী করব। তোমার মাথা একটু খারাপ আছে মাইরি।

আমার মাথা খারাপ, আর তোমাদের মাথা খুব সাফ? প্রায় মারতে উঠল বাড়িওয়ালা।

তা তোমার মতো অত খারাপ নয়। তোমার যেন বাই। গোবিন্দও বলল খুব সন্তর্পণে।

চোপ! আমি বলছি চোপ! শালা ফোরটুয়েন্টি, তোমাকে আমি কালকেই তাড়াচ্ছি, দাঁড়াও। বলতে বলতে বাড়িওয়ালা উঠে পড়ল। বলল, কালো, এক কলকে সাজবি চল। বলে বেরিয়ে গেল।

কালো বলল, খেপিয়ে দিলি তো?

ও খেপেই আছে। বলে গোবিন্দ তাড়াতাড়ি উঠে জ্বলন্ত উনুনে ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দিল। তার পর বসল বাটনা বাটতে। কালো বেরিয়ে গেল।

নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে লোটন বউয়ের। অপলক কিন্তু যেন ঠাণ্ডা শিরশির চোখে সে দেখছে নন্দ আর হরিশের কাণ্ডটা। ঠোঁট টিপে আছে, তবু কিছু বলছে না।

এও বড় বিচিত্র যে, নন্দ-হরিশ কল থেকে এসে বসেছিল চুপচাপ, কিন্তু নিতান্ত অকারণেই যেন কী কারণে হঠাৎ তাদের ঝগড়া লেগে গেল।

কোনও কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ নন্দই হয়তো একটা দমকা নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, নাঃ, একটা আলাদা ঘর দেখে চলে যেতে হবে। হরিশও চুপ করে থাকতে পারে না। কথাটা গায়ে পেতে নিয়ে বিদ্রূপ করে বলে, খালি ফুটানি। যেতে তো দেখি না।

লোটন বউ হয়তো কোনও কাজ করছিল। এদের কথা শুনেই তার দৈনিক অভিজ্ঞতা থেকে দূরাগত অ্যাসিড গন্ধ পাওয়া সাপের মতো সচকিত হয়ে মুখ তোলে আর তার মোটা নাক উঠতে থাকে ফুলে ফুলে। আর ওরা দুজন ভাই ভাই সুনিশ্চিত, তবু নন্দ বলে ওঠে, যাই না তো তোর বাপের কী?

তবে বলিস্ কেন বানচোত?

আমার খুশি হয়েছে বলেছি।

তবে আমারও খুশি হয়েছে।

লোটন বউ নীরব।

শালা খুশি মানাচ্ছ। নন্দই এক ঘা প্রথম কষিয়ে দেয় হরিশকে। কেননা সে হরিশের চেয়ে বড়। তার পর শুরু হয়ে যায় রাম রাবণের লড়াই, গালাগাল। বস্তির আর সব গোলমালকে এ ব্যাপারটা ছাপিয়ে ওঠে বলেই, সকলের কান এবং নজরটা এদিকেই এসে পড়ে।

যে যার নিজের ব্যাপার ভুলে এদিকেই এগিয়ে আসে।

বাড়িওয়ালাও এল। যমদুতের মতো এসে ধরল দুটোকে।

গোবিন্দ রান্নাঘর থেকে সব শুনতে লাগল কিন্তু গেল না। প্রায় কালকের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। সে মনে মনে বলল, তিনটের যে কোনও একটা না মরলে এর ফয়সালা হবে না। কিন্তু যে নন্দ আর হরিশ পরস্পরের মধ্যে এত মারামারি করে, কালকে তারাই আবার একই সঙ্গে কেমন করে লোটন বউয়ের ডাক ছেড়ে কান্নায় সান্ত্বনা দিচ্ছিল। আর মার খেয়েই বা কেন তারা বিনা বিবাদে ঘাড় ভেঙে বসেছিল পহররাত অবধি ওই ঘরে দরজায়।

লোটন বউয়ের সেই ডাক ছেড়ে কান্না উঠল, ওরে আমার কেউ নেই রে। দুটো কুত্তা আমাকে জ্বালিয়ে খেল রে, আমাকে সকলে বেইজ্জত করছে গো!…

কে একজন অসমসাহসী বিহার সুললিত টানা সুরে গেয়ে উঠল,

আরে লোটনোয়া তু কঁহা গেইল্‌হ
কসম তোহার আরে মুঝে লে চলহ্‌।

কে একজন অমনি সরু গলায় বলে উঠল, আরে কৌন জানে কঁহা পতা মিলে।

একটা হাসির রোল পড়ে যায়।

লোটন বউও শুরু করে, তোদের গানে আমি এই করি, সেই করি।

নন্দ হরিশ করুণ চোখে সকলের দিকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। দুজনেই এক পা এক পা করে গিয়ে লোটন বউয়ের দু-পাশে বসে।

গোবিন্দ বেরিয়ে এসে বলল বাড়িওয়ালাকে, এখনই তিনটেকে ঘরে ঢুকিয়ে দেও না, সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

সে ওরা নিজেরাই যাবে।

তবে মারামারি করে কেন ওরা?

জিজ্ঞেস করো।

গোবিন্দ হরিশ-নন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, কেন করো?

অমনি লোটন বউ তাকে যেন খেতে এল, তোর কী রে, তোর কী তাতে?

গোবিন্দকে চমকে উঠতে দেখে সবাই হেসে উঠল। কে একজন গোবিন্দকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে উঠল। দেওনা ওদের ফোরটুয়েন্টি করে।

সবটাই যেন লোটন বউয়ের ব্যাপার, হরিশ নন্দকেও কেউ কিছু বলতে পারবে না।

গোবিন্দ তাড়াতাড়ি হকচকানিটা কাটিয়ে বলল, তুমি যে আমার ভউঝি লাগো। জবাবে লোটন বউ আরও কঠিন কটুক্তি করে নন্দ হরিশকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ধরাশায়ী করে ঘরে ঢুকে পড়ল। বন্ধ ঘরের ভিতর থেকেও তার বিলাপের সুর আসতে লাগল ভেসে।

কেবল নন্দ আর হরিশ সেই দরজাটাতে মুখ দিয়ে পড়ে রইল। কেন? কী দাসখত ওরা লিখে দিয়েছে লোটন বউয়ের পায়ে। কিন্তু গোবিন্দের আবার মনে পড়ল লোটন বউ হয়তো বাধ্য হয়েই থাকে। হয়তো পেটের জন্যই তাকে নন্দ হরিশের ঘরে থাকতে হয়।

তবু নন্দ আর হরিশকে দেখে মায়া লাগে। যেন দুটো অভিশপ্ত জানোয়ার বহু লোকের সামনে চুপচাপ পড়ে আছে।

কালো এসে গোবিন্দের হাতে একটা টান দিয়ে বলল, তুই এ-সব বেতমিজদের ব্যাপারে কথা বলতে গেছিস্? চলে আয় দোস্ত, এখানে কোনও ফোরটুয়েন্টি চলবে না। গোবিন্দ রান্নাঘরের দিকে চলে গেল কালার সঙ্গে।

কালো আবার বলল, কুত্তা ঘেউ ঘেউ কেন করে, ষাঁড় কেন গোঁ ধরে, যাবত তোমার পিখিমির অনেক কাণ্ডই অনেকে বোঝে কিন্তু বেগড়াননা মেয়েমানুষকে বোঝে তেমন সাধ্যি কারও নেই। অমন যে একটা জোয়ান পাট্টা ছিল লোটন, সেটাকেও দেখতাম মাগীটার কাছে কেঁচোর মতো পড়ে থাকত। বলি কেন? না, ওর প্রাণে বিষ আছে।

গোবিন্দের মুখটা যেন কী অসহায়তায় থম ধরে রইল।

আশ্চর্য! নন্দ আর হরিশ আবার পরস্পরের দিকে তাকায়, আর মুখ নামিয়ে থাকে। যেন পরস্পরের কাছে তারা অনুশোচনা প্রকাশ করতে থাকে। বিচিত্র আদিম তাদের এই জীবন। একজনকে নিয়ে তাদের কখনও বিদ্বেষ, কখনও বন্ধুত্ব। আর তার চেয়েও বিচিত্র আদিম নারী ললাটনের বউ, যে সমস্ত ঝগড়া, মারামারি, কলঙ্ক, লজ্জা, ভয়, সব ভুলে আবার ডেকে নেবে ওদের।

ঠিক এই হট্টগোলের ঝোঁকেই সেই গুরুগম্ভীর বুড়োটে গলার গান উঠছে,

ওরে, অমর কেউ থাকবি না তো, মরতে হবে সবারে,
তবে সমসারে তোর এত ভেদ-জ্ঞান কীসের তরে।

আর ঠিক প্রত্যহের মতো সেই রুগ্ন ছেলেটা তখনও ঘুমায়নি কিংবা জেগে গেছে। গান তার কানে যেতেই ভেংচে উঠল সে তারস্বরে।

এমন সময়ে এল তার বাপ। হঠাৎ মনে হয় লোকটা মানুষ নয়, একটা পাঁশটে রং-এর মন্থরগতি ক্রুদ্ধ মোষ বিশেষ। সে এসেই হেঁকে উঠল ছেলেটার প্রতি, অ্যাই, অ্যাই, শুয়োরের বাচ্চা, চুপ মার। নইলে–

নেশায় টলমল, জড়ানো গলা। একবার তার রক্তচক্ষু দিয়ে চেয়ে সামনে দেখল বউটা রয়েছে। বিনা বাক্য ব্যয়ে সে হঠাৎ বউটাকে ঠ্যাঙাতে আরম্ভ করল। মত্ত বলে তার জায়গা অজায়গা বলেও খেয়াল রইল না।

মার খেলেও কি মানুষের মুখের কোনও ভাবান্তর হয় না। গাইগোরুও মার খেলে তার চোখে একটা ভীতভাব ফুটে ওঠে, অসহায় উর্ধ্বশ্বাস গতিতে ছুটতে চায় সে। কিন্তু এ মধ্যবয়সী মেয়েমানুষটির সে বোধও নেই। সে বৃষ্টি আটকাবার মতো ঘাড় পেতে, হাত তুলে খানিকক্ষণ সেই মার খেল। স্বামী মারতে মারতে যে সব কথাগুলি বলছিল, তার একবর্ণও বোঝা যাচ্ছে না। কেবল কতকগুলি গালাগাল খানিকটা স্পষ্ট। লোকটা হাঁপিয়ে উঠেছে মারতে মারতে।

বউটি তেমনি নরম এবং শান্ত গলায় বলল, হয়েছে, এবার থামো, চলো ঘরে চলো।

বলে সে তার স্বামীকে হাত ধরে ঘরের দিকে নিয়ে গেল। কিন্তু স্বামীর তখনও থামার নাম নেই। সে ওর মধ্যেই এক হাতে ধপাধপ পিটিয়ে চলেছে।

ঘরের রকে ফেঁসোর আলো জ্বলছিল, তার এক টুকরো আলো অন্ধকার ঘরটার এক কোণে একটু পড়েছিল। ঘরের মধ্যে মত্ত স্বামী ধপাস্ করে তার বউকে নিয়ে মাটিতে পড়ল।

রকের উপর বসা রুগ্ন ছেলেটা অপলক জ্বলন্ত চোখে ঘরের অন্ধকার কোণটার দিকে তাকিয়েছিল। গলার শিরাগুলো তার ফুলে উঠেছে। জিরজিরে হাড়সার শরীরটা উঠেছে শক্ত হয়ে। বুকের বাঁ দিকটা টুক টুক করে নড়ছে। সমস্ত পৃথিবীটাই এমনি দমবন্ধ করে রয়েছে কি না কে জানে। চটের ফেঁসোর জ্বলন্ত শিখাটাও অকম্পিত স্থির।

কিছুক্ষণ পরে তার মা কোমরের নেকড়াটা গুছিয়ে বেরিয়ে এল, জটপড়া মাথাটা খসখস করে চুলকোল একটু তার পর খ্যাপা ছেলেকে ধরে বুকের কাছে নিয়ে এল। তার জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এসো বাপ, অত খেপছিস কেন? মরে যাবি যে!

সেই অন্ধকার কোণের দিকে তাকিয়েই ছেলে বলল, ও শালাকে আমি মেরে ফেলব।

ছি, ও যে তোর বাপ হয়।

হোক। ও তোকে মারে কেন?

আর কাকে মারবে বাবা? ওর আর বউ কোথায়, কে ওরটা খায় আর পরে? আর কার জন্য ও সারা দিন পড়ে পড়ে খাটে?

তা বলে মারবে?

মারবে। ইচ্ছে করলে খুনও করতে পারে। গাওনার সময় আমার বাপ ওকে যে দুটো বলদ দিয়েছিল, তার একটাকে ঠেঙিয়েই মেরে ফেলেছিল। আমার কানের রূপোর মাড়ি দুটো একটা চামারনীকে দিয়ে দিয়েছিল। সেই রাক্ষুসী চামারনীটা ওকে তুক করেছিল। ইচ্ছে করলে আমাকেও মেরে ফেলতে পারে।

এত নির্বিকার, এত শান্ত, এত সুরহীন গলাটা মায়ের যে, ছেলেটা ওই বুড়োর বেসুরো গানকে ভেংচানোর মতো ভেংচে ওঠে মাকে। ধাক্কা দিয়ে খামচি কেটে সরিয়ে দিতে চায়। খিঁচিয়ে ওঠে, পারে সব পারে। তোরা দূর হ আমার কাছ থেকে, দূর হ।

মা আরও মিষ্টি করে ছেলেকে কাছে টেনে বলে, ওরই জন্য তো তোদের পেয়েছি বাপ, নইলে কোথায় পেতুম। তার পর একটু চুপ থেকে মা অন্য কথা বলে, কালকেই তো তুই বড় হবি।

জাদুমন্ত্রের মতো ছেলেটার মুখভাব পরিবর্তন হয়, খ্যাপাটে ভাবটা কেটে গিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে আসে। বলে তুই তো রোজই তাই বলিস। হই না তো!

হবি বাবা হবি।

তবে কালকেই মাকি সায়েবের কাছে নিয়ে চল্‌।

আচ্ছা।

আর আমি বিলেতে গিয়ে সায়েবদের কারখানায় কাজ শিখব, বিকেলে রোজ সায়েবদের কোঠির পেছনে গঙ্গার ধারে বসে থাকব। সেই অনেক দূর গঙ্গার নৌকাগুলিকে চেঁচিয়ে ডাকব।

সেখানে কি গঙ্গা আছে?

মায়ের এ প্রশ্নে সে নির্বিকারভাবে বলল, হ্যাঁ খুব বড় গঙ্গা আছে।

আর রহমত আদালির সঙ্গে বেশ গল্প করব।

রহমতও আছে?

সায়েব থাকলেই তো আদালি থাকবে?

ও!

মায়ের মুখটা যেন দূরবিসারী ঘাস বনের দিকে তাকানো এক হাঁ-মুখো গোরুর মতো। ছেলেটা বুঝতে পারলে না যে মায়ের চোরা দোলানিতে তার দুলুনি আসছে। সে মায়ের দুই স্তনের মাঝে মাথা রেখে দূরে মিলিয়ে যাওয়া সুরে হেসে বলল, মেমসায়েব বউটা যদি তোর মতো ভাল হয়, তবে আমি একদম পিটব না।

মা ভাবলেশহীন মুখে ফোঁস ফোঁস করে হাসল।

তার পর যখন ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ল, তখন মায়ের চোখ দুটোতে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে আসে ছেলের রুগ্ন শান্ত স্বপ্নভরা মুখটার দিকে চেয়ে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, মাকি সায়েবের বিলেত দেখা তোর আমি মলেও হবে, কিন্তু বাবা, রোগের বালাই কাটিয়ে এ শরীলটুকু তোর বড় হবে কবে?

জল পড়ছে ঝিমঝিম করে। খুশি গলায় ডাকছে কোলা ব্যাঙ, হাট বসিয়েছে উঠোন জুড়ে। ঝি ঝি ডাকছে একটানা। বস্তির হট্টগোল শান্ত হয়েছে। ঘরে বাইরে কাঁচা মাটি খুঁড়ে উঠছে মোটা মোটা কেঁচো, মাংস-খেকো কালো কালো ডেয়ো পিপড়ে এখানে সেখানে চলেছে লাইনবন্দি হয়ে। যে সব ঘরগুলোয় জল পড়ছে, সে সব ঘরের লোকেরা গালাগালি দিচ্ছে বাড়িওয়ালাকে। বাড়িওয়ালার কানে তা যাচ্ছে না। আর গেলেও বুঝি কিছু আসত যেত না। নন্দ আর হরিশ বসে আছে তেমনি।

এদিককার খাওয়ার পাট চুকে গেছে। কিন্তু কালোর এখনও খাওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ আগে সে কোথায় বেরিয়ে গেছে। বোধ হয় তার কারখানার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করতে গেছে। আর খেতে বাকি আছে ফুলকি।

গোবিন্দ রান্নাঘরের দরজা ভেজিয়ে রেখে গেল ফুলকির ঘরের দিকে, সে এসেছে কিনা তাই দেখতে। সে আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে চায় না। খিদে পেয়েছে। কালোর ভাত ঘরে নিয়ে রাখলেও হবে।

বৃষ্টির জল লেগে শিরশির করে উঠছে গায়ের মধ্যে। উঠোনটায় যেন দই জমে আছে কাদার। ফুলকির ঘরের দিকে যেতে গিয়ে মনটা বারবারই থমকে যাচ্ছে গোবিন্দের। কেউ দেখে ফেললে না জানি কী ভাববে। ফুলকি যে বেওয়ারিশ!…বেওয়ারিশ। কথাটা মনে হতেই গোবিন্দের কৌতূহল বেড়ে উঠল। ফুলকির জীবনে তা হলে কী আছে, শরীরের রেখায় রেখায় অত বাহার নিয়ে কী মনে সে চলে। কালো বলেছে সে প্রেমযোগিনী। সে প্রেমযোগিনী কেমন? সে কি ঈশ্বরের প্রণয়িনী-সন্নাসিনী? তাই বা কেমন করে সম্ভব। এ জগতের কথা তো সে জানে! দুর্বিনীত পুরুষের হাত থেকে বাঁচার কী অস্ত্র থাকতে পারে ফুলকির? বিশেষ করে এই সমস্ত এলাকায় ও মহল্লায় সেখানে খলিফা ওস্তাদ সদারদের কুটিল ও লোলুপ দৃষ্টি থেকে কারও রেহাই নেই। বাপ সোয়ামীর আশ্রয় থেকে যেখানে মেয়ে ছিনিয়ে নেয়, সেখানে ফুলকির মতো মেয়ে অমন বুক ফুলিয়ে চলে কী করে।

গোবিন্দ দেখল অন্ধকারে আর একটি মূর্তি তার আগে আগে চলছে ফুলকির ঘরের দিকে। একবার চমকে উঠল বাড়িওয়ালা ভেবে। কিন্তু না লোকটা একটু বেঁটে।…ও! নগেন। গরিলার মতো বেঁটে ও মোটা নগেন। ফুলকির ঘরের দিকে সে কেন চলেছে এমন চুপিসাড়ে? তার মনে পড়ল কালোর কথা।

গোবিন্দ যেতে না যেতেই দেখা গেল নগেন ফিরে আসছে ফুলকির দরজার অন্ধকার কোল থেকে।

জিজ্ঞেস করল গোবিন্দ, নেই?

নগেন চমকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। —কে নেই?

ফুলকি।

জবাব দিতে গিয়ে এক মুহূর্ত স্তব্ধ রইল নগেন। চাপা গলায় জবাব দিল, না। বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গোবিন্দের মুখটা দেখতে চেষ্টা করল। বলল, খুঁজছ তাকে?

হ্যাঁ, ভাত দেওয়ার জন্য।

হুঁ হুঁ করে একটা শব্দ হল নগেনের গলা দিয়ে। সেটা রাগের না বিদ্রূপের বোঝা গেল না। বলল, শালা দুনিয়ার নিয়মটাই এমনি।

কেমনি?

এই কাউকে সেধেও খাওয়ানো যায় না, কেউ চেয়েও দুটো পায় না। লিয়ে এসো না বাবা সেঁটে দিই।

কারখানা বস্তির বাসিন্দা হিসাবে গোবিন্দ অনন্য। বালাইহীন ভবঘুরের জীবনে যা থাকা উচিত ছিল না, সেই ধিক্কার, সংকোচ, ভয়, লজ্জা তার অতীতের চরিত্রটার মধ্যে এখানে অনেকখানিই রয়ে গেছে। কেননা, তার যে আর একটা জীবন ছিল, দশ বছর আগের সে জীবনের চিহ্ন এখনও কিছুটা বুঝি রয়ে গেছে বুকে। সে সপ্রতিভ, হাসকুটে, গপ্পে, তার জীবনের গতির খেল অনেকের অনেক এলানো পালে হাওয়া লাগিয়ে আকাশে মেলে দিয়েছে, কিন্তু তার মনের কোথায় লুকিয়ে আছে অনেকখানি আড়ষ্টতা, বিনয়, বেদনা। আবার এও সত্যি যে, তার প্রতি পদক্ষেপে আছে এক বিচিত্র দ্বিধা, নিজের কাছে নিজের দুর্বোধ্যতা আর সেই কারণে মানসিক গ্লানিরও কমতি নেই। নিজের হৃদয়ের কাছে সে ফকির হুকুমবরদার, যার কাছে যখন সে আত্মসমর্পণ করে হুকুমমতো থাকে তারই হাতে। এ-সব মানুষের জীবনে দুঃখই সার হয়। কিন্তু তেমন দুঃখবাদী নয় গোবিন্দ, প্রাণ তার আনন্দের সন্ধান করে, ঝাঁপ দেয় দুঃখ চাপা জগদ্দল পাথরের বুকে।

নগেনের কথায় মনটায় বড় ধিক্কার লাগল তার। আবার রাগও হল। সেধে খাওয়ানোর জন্য ফুলকির সন্ধান করেছে সে সত্য, নগেন যদি খেতে আসত তা হলেও কি সে খোঁজ করত না? মন থেকে কোনও স্পষ্ট জবাব এল না তার। কে জানে সে নগেন হলেও সত্যি খোঁজ করত কি না।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে নগেন বিদঘুটে গলায় হেসে উঠল। বলল, লাও ঠ্যালা, মাথায় বিষ্টি লিয়ে তুমি কি সত্যি ভাবতে লাগলে নাকি? না বাবা ফোরটুয়েন্টি, আমাকে দিতে হবে না, সে ভাত যারটা তাকেই গিলিয়ে!

গোবিন্দ হঠাৎ ক্রুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাকে কি তোমার মতো মাগীর পেছনে ঘোরা মানুষ ভাবো?

নগেনের মুখটাও চকিতে কঠিন হয়ে উঠল। পরমুহূর্তে হেসে বলল, ভাবলেই বা কী। কোন শালা মা ঘোরে?

নিজের মনটাকে কিছুতেই ঠাণ্ডা রাখতে পারল না গোবিন্দ। অত্যন্ত তিক্ত গলায় বলে উঠল, তাই বেওয়ারিশ মেয়ের দরজায় রাতে ঢু মারো।

তুমিও তো যাচ্ছিলে বাবা। বলে আবার হেসে উঠে বলল নগেন, কালোও শালা এমনি বড় বড় রাত মারত, সে শালাও দেখি লটকে পড়েছে। মগর চুঁ চুঁ। দেখো ঘোড়া কোশিশ করে। তবে অনেক জল, তল পাবে না।

গোবিন্দ দেখল গোঁয়ার নগেনের সঙ্গে তর্ক বৃথা। সে যা বুঝেছে তার আর নড়চড় হবে না। সু বলল, কালোর সঙ্গে তুমি কারও তুলনা করো না। তার দিল অনেক বড়।

হাঁ, শালা হিজড়ের দিল তো অনেক বড়ই হবে। তবে ওদের হাতে মেয়েমানুষের পুতুলই থাকে ভাল। খেলবে আর কপাল ঠকবে। ও-সব ফুলকি টুলকির পেছনে কেন? একটা দুর্বোধ্য শব্দ করে সরে গেল সে। খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে এসে দাঁড়াল গোবিন্দের মুখোমুখি। হঠাৎ যেন কীসের জ্বালা ধরে গেছে তার মনে। বলল, ক-দিন এসেই সব বুঝে ফেলেছ না? বলছ, ফুলকি বেওয়ারিশ। তুমি আর কালো তাই ভাবো, কিন্তু ফুলকি তো আমাদের। কবে সে বেওয়ারিশ ছিল? আর এখন ছুকরিটা রেন্ডি হয়ে গেছে কালসাপ। কী জানো…কী জানো তুমি?

বলতে বলতে নগেনের গলাটা চেপে এল একেবারে। তার পর হঠাৎ কেশো গলায় বিদ্রূপ করে হেসে উঠে বলল, তুমি সোহাগ করে ভাত নিয়ে বেড়াচ্ছ। কিন্তু–

কী বলতে গিয়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে ফিরে যেতে যেতে শোনা গেল তার চাপা গলা, শালাদের খালি বড় বড় বাত আর বলিহারি ধৈর্য বাবা।

হঠাৎ গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে হাওয়ার ঝাপটা দিয়ে গেল। পাশের পাকা বাড়ির একটি জানালা চকিতে খুলে বন্ধ হয়ে গেল। উঁকি দিয়ে গেল এক ঝলক আলো।  

গোবিন্দের ক্রুদ্ধ মনটা হঠাৎ অবশ হয়ে গেল যেন। নগেনের তীব্র চাপা গলার কথাগুলো শুনে তার মনে হল, সত্যি কালো ভিক্ষুকের মতো দুর্বল আর অন্ধকার নিরালাতে সে বুঝি সত্যি ফুলকির কাছে যাওয়ার জন্যই মাত্র যেতে চেয়েছিল। তবু দাঁতে দাঁতে পিষে সে হিসিয়ে উঠল, শুয়োরর বাচ্চা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *