১২. বনলতা চলে যাওয়ার পর

বনলতা চলে যাওয়ার পর ক্ষণিক বিমুঢ় বসে রইল গোবিন্দ। মহিম এল এই সময়। গোবিন্দ তাড়াতাড়ি দু হাত বাড়িয়ে মহিমকে টেনে নিয়ে বলল, মহী আসছিস! এখুনি ছুটতাম তোর কাছে।

কেন, কী হইল?

মুই কোনও কিছুর দিশা পাই না মহী। জগৎ বড় বেরতাল লাগে মোর কাছে।

মহিম দেখল গোবিন্দের মুখে একটা দুশ্চিন্তা ও চাপা যন্ত্রণার ছাপ। দিশেহারা চোখ। বলল, রাতে ঘুমাস নাই নাকি?

ঘুম তোরে ত্যাগ দিছে— গোবিন্দ বলল— বুকে মোর পাষাণ। দুঃখ দিয়া কানাই মালারে গাঁ-ছাড়া করলাম।

মহী বলল, সেই নাকি তোর ভাবনা?

বলে সে কুঁজো কানাই ও হরেরামের বাড়ির সমস্ত ঘটনা বলল গোবিন্দকে। আশা করেছিল, গোবিন্দের চোখেও আশা আনন্দ ফুটে উঠবে তার মতো। কিন্তু অন্ধকার ঘুচল না তার মুখ থেকে। বলল, পাগলা বামুন মোর মাথায় বাজ ফেলেছে।

পাগলা বামুন? মহিম জিজ্ঞেস করল, কী হইছে?

গোবিন্দ বলল, মুই গেছলাম পাগলা বামুনের কাছে কুঁজো কানাইয়ের কথা বলতে। ভাবলাম, পাগলাবামুন এত বোঝে, এত কথা বলে। গাঁয়ে ঘরে জ্ঞানী বলে তার কত নাম। সে কি বুঝবে না কুঁজো কানাইয়ের এ দুঃখের দায় মানুষের নয়, মানুষের হাত নাই এতে। কিন্তু…বলতে বলতে স্তব্ধ হয়ে গেল গোবিন্দ। অসহায়, চিন্তাচ্ছন্ন।

মহিমের শোনবার আকাঙ্ক্ষা অদমনীয় হয়ে উঠল। যেন, এ প্রশ্নের জবাবটা তারই পাওনা। বলল, তারপর?

পাগলাবামুন দু-হাতে সাপটে ধরে আদর করে বসাল মোরে। বলল, গোবিন্ দুঃখ পাসনি। কুঁজো কানাইয়ের ছিষ্টিকত্তা মানুষ, দায়টাও মানষেরই। মুই ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে বললাম, মিছে বলো মা পাগল ঠাকুর, পাপ হবে। পাগলা বামুন হাসল। মহী, মিথুক আর পাপী কখনও হাসতে পারে না অমন করে। এ আমি হলপ করে বলতে পারি। হেসে বলল, মোরা দৈব দুর্ঘটনা দেখে ভাবি কেমন করে ঘটল। উপায় না দেখে সেই এক নাড়ার মা ভাড়া ভগবানের দোহাই পেড়ে খালাস পাই। কিন্তু তাই কি? না। খুব সম্ভবত জন্মসময়টিতে কানাই কুঁজো হয়েছে, নয় তো মায়ের পেটে থাকতেই। হুতোশে মোর ঘাম ঝরল। বললাম, কেমন করে? ঠাকুর বলল, সে যে অনেক কথা গোবিন্। তার পর খানিক কাদা-মাটির ড্যাল নিয়া আঙুলের ফুটো দিয়ে বার করে দিল, সোজা বার করে দিল, সোজা বার হইয়া আসল। আবার গলিয়ে আবার বার করল, দেখলাম বেঁকে গেছে। ঠাকুর বলল, দেখলি গোবি, এই হইল কাণ্ড। মায়ের পেট থেকে কানাই প্রমাণ দরজা পায়নি। কুঁজো অর্থে, কানাইয়ের পিঠের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে।

মোর পুরো পেত্যয় হইল, হায়, পাগল বামুন সত্যি পাগল। কিন্তু অন্তর্যামীর মতো বলল ঠাকুর, ভাবছিস বুঝি পাগলের কথা বলছি? না রে না। এ মোদের জীবনের অভিশাপ, অন্ধকারে মোদের বাস। দেখলাম, ঠাকুরের চোখে আলোয় আলো, যেন কোন্ জগতে চলে গেছে। বলল, কানাইয়ের মা যদি সেই দেশের মেয়ে হত সেখানে সন্তান প্রসবের সমস্ত বাধা উচ্ছমে গেছে, সেখানে কানাইয়ের জীবনে এ অভিশাপ নেমে আসত না। নয়তো বলি, কানাইয়ের বাপের জবর অত্যাচার ছিল নিজের বউয়ের উপর, গতিক বোঝেনি। কিন্তু দোষ কার? কুঁজো কানাই এ অভিশাপের বোেঝা কি একলা বইবে? না, মোদেরও বইতে হইবে, তেমন দেশটি মোদের বানাইতে হইবে? সেই বানানোর তাগিদ চাই, বাধা থাকলে তারে সরাইতে হইবে। গোবিন, মানুষ হইয়া খামোখা ওই ভগবানের ঘাড়ে সব চাপিয়া হাঁটু মুড়ে থাকি না। শুনে বুকের মধ্যে মোর বক বক করতে লাগল। হায়, এ কী মানুষ, ভগবানের সব বোঝা নিজের ঘাড়ে নিয়া চিত্তি করতে চায়। কিন্তু সে মুখের দিকে তাকিয়ে সাধ্যি কার বলে, তুমি মিছে বলছ। ঠাকুর যে কত কথা বলে গেল, আমি তার সব কথার মানে বোঝলাম না। আর বার বার বলল, দুঃখ পাসনি, মানুষের কুসংস্কার একটা সোনার শেকল। হোক শেকল, সোনার যে! যাদের চোখে সে সোনা চটে গেছে, তাদের ওই শেকলটুকু ছাড়া সবই গেছে। তাই তারা আজ ঘোর বিবাদ লাগাইছে শেকল ভাঙবে বলে।

মুই আর থির থাকতে পারলাম না। বললাম, ঠাকুর, বামুনের ছেলে, ঈশ্বরে পেত্যয় নাই তোমার? আবার হাসল। মোরে উপহাস্য করে নয়, বড় দুঃখে। বলল, আমি তোর মনের উপর জুলুম করতে চাই না। মোর কথা যদি বলি, তবে বলি, যা দেখতে পাই না, হতে পাই না, যার কোনও হদিসই পাই না, তার কথা ভাবি না আমি। আমি সবকিছুর অস্তিত্বে বিলী। তোর ঈশ্বরের সাধনা, তবু সে কিছু তো? বললাম, নিশ্চয়। বলল, একবার চোখ বুজে বল, সে কিছুটা কী?

আমি চোখ বুজে দেখলাম, কিছু পেলাম না। আবার বুজলাম, দেখলাম, ছাইভমমাখা বাবা শ্মশানে বসে আছে। আবার বুজলাম, দেখলাম, রাজপুরের আচায্যি বসে বসে আছে। মোর মাথা ঘুরতে লাগল। বসে থাকতে পারলাম না। মোরে ধরে বসাল আবার, তার পর মানুষের জন্মের কথা শুরু করল পাগলাঠাকুর। কিন্তুক মোর যেন কী হইল শুনতে, দিশা রাখতে পারলাম না। ছুটে বার হইয়া আসলাম।

গোবিন্দ স্তব্ধ হল। বলতে বলতে তার সে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু মহিমেরও প্রাণটা এ ঘরে আছে বলে মনে হল না। চোখ দুটো তারও শুন্যে নিবদ্ধ অথচ অনুসন্ধিৎসু। সে অনুসন্ধান মনে মনে। গোবিন্দ দেখল, মহিমের চোখে আলোর ছড়াছড়ি, কী যেন সে খুঁজছে। কিন্তু তার চোখে জল জমে উঠল বড় বড় ফোঁটায়। মহিমের কাঁধে মাথা পেতে বলল, মহী, এ সব যদি সত্য হয়, তবে মোর বাপ জীবনভোর এ কী করল? সে কি সব মিছে?

মহিম তাড়াতাড়ি দু-হাতে গোবিন্দর মুখ তুলে ধরে বলল, সত্য মিথ্যা তো বিচারের বিষয় গোবিন ভাই, তার জন্য তুই উতলা হইস কেন?

গোবিন্দ বলল, সেই তো হইল গেরো। ছুটে গেলাম রাজপুরে আচায্যির কাছে বললাম। তিনি তখন খাওয়ায় ব্যস্ত। বললেন, কাল আইস, জবাব দেব। কিন্তু পাগল ঠাকুরকে কেবলি গালাগাল দিতে লাগল। সে মোর সইল না। বড় খারাপ লাগল আচায্যিকে। চলে আসলাম।

মহিম বলল, বেশ তো, এর সন্ধান তো মস্ত বড় কাজ গোবিন্ ভাই। সকলের কথা শোন তুই। বলল, কিন্তু সে স্পষ্টই বুঝল পাগল বামুন কোথায় যেন গোবিনের মনে এক মস্ত ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। অপরের মনে হয়তো লাগত না এত, গোবিন বলেই এতখানি লেগেছে। কেন না, তার ধর্মবিশ্বাস তো আর দশজনের মতো নয়, সে যে তার জীবনের আর সব কিছুকে অন্ধকারে রেখে দিয়ে একটা শক্ত বেড়ার মধ্যে আটকে রেখে দিয়েছে।

গোবিন্দ চোখের জল মুছে বলল, মহী, বাবার ব যদি মিছে, তবে মোর মায়ের দুঃখ বুঝি বুকের রক্ত দিয়েও শোধ করা যাবে না। মাকে মোরা দ্বাই মিলে মেরে ফেলছি।

উঠোন থেকে পিসির গলা শোনা গেল। গোবিন আসি রে, গোবিন। পর মুহূর্তেই গলার স্বর রুক্ষ হয়ে উঠল। তুই ওখানে কী করছিস লা?

গোবিন্দ মহিম বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বনলতা, খানিকটা অপ্রতিভভাবে। চকিতে সেটুকু কাটিয়ে সে বলল, মহীরে ডাকতে আসছি।

সেই মুহূর্তেই সকলের চোখ পড়ল, পিসির সঙ্গে একটি ফুটফুটে শাড়িপরা ছোট্ট মেয়ে। নাকে নোলক, পায়ে মল। বিস্ময়াম্বিত দুটো বড় বড় চোখ। যেন জয়ে অবধি বিশ্ব দেখা হয়নি তার। আর এক মাথা ঝাঁপানো কালো চুল।

মহিম জিজ্ঞেস করল, পিসি ও কে?

পিসি সে কথার জবাব না দিয়ে বলল ভারী তুষ্ট হয়ে, মাকে মোর এ উঠোনটিতে কেমন মানিয়েছে দেখ দিকিনি, যেন সাক্ষাৎ নক্ষ্মী। পরমুহূর্তেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ছলছল চোখে বলল, পরের মেয়ে দু-দিনের জন্য নিয়ে আসলাম বেড়াতে। চেরদিনের জন্য ঘরে তোলা যাবে কি?

মহিম তাকাল বনলতার দিকে, বনলতা তাকাল গোবিন্দের দিকে। গোবিন্দের চোখ আর মন তখন এখানে নেই, এ জগতেই কি-না সন্দেহ।

বনলতার নিশ্বাস পড়ল একটা। তা স্বস্তির না সুখের সেই জানে।

সবাইকে এ রকম নির্বাক দেখে পিসি হাঠৎ অত্যন্ত কষ্ট হয়ে মেয়েটির হাতে টান দিয়ে বলল, আয় তো মা, মোর ঘরে উঠে আয় তুই।

পিসির নবীনা কিশোরীর চোখে চাপা সংশয় ও অস্বস্তি দেখা গেল। গোবিন্দর দাওয়ায় মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে তার চোখ যেন বলল, মোর পানে তাকিয়ে। কিন্তুক হাসো না কেন তোমরা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *