১১. আকাশে ঘন মেঘের ভিড়

আকাশে ঘন মেঘের ভিড় দক্ষিণ থেকে পাড়ি জমিয়েছে উত্তরে। আকাশে তাকিয়ে মনে হয়, বুঝি ভুমণ্ডলই চলেছে দক্ষিণদিকে। হালকা হাওয়ায় শীতের আভাস। দিবাগতিকে আপনা থেকেই মনে হয় গা যেন ম্যাজমেজে লাগছে। এ ঘোর কাটলেই বোধ হয় হেমন্তের উজ্জ্বল আকাশ দেখা দেবে।

আখড়া থেকে খোল করতাল সহযোগে নসিরামের বৃদ্ধগলার গান শোনা যাচ্ছে : প্রাণ ভরিয়ে প্রাণনাথ তোমায় ডাকি হে, প্রাণে আশা, প্রাণে আমার তোমায় পাব হে। মাঝে মাঝে সেই গলাকে ছাপিয়ে উঠছে প্রাণেশের মোটা গলা, পাব হে, পাব হে। পাব হে কথাটা যেন তার গলায় জেদের মতো শোনাচ্ছে।

আগল ঠেলে বনলতা ঢুকল গোবিন্দর বাড়িতে। ডাকল, পিসি। সাড়া না পেয়ে গোবিন্দর ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল সে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। গোবিন্দের দরজা বন্ধ! এত বড় ব্যতিক্রম আর কোনওদিন চোখে পড়েনি বনলতার। সামান্য অসুখে-বিসুখে তো কখনও সাধুর দরজা বন্ধ দেখা যায়নি। তবে কি কোনও ভারী ব্যামো হল তার।

ভাবতেই বনলতার বুকের মধ্যে শঙ্কায় ভরে উঠল। সে দাওয়ায় উঠে ডাকল, সাধু, সাধু ঘরে আছ।

জবাব পেল না। তাকিয়ে দেখল পিসির ঘরের দরজায় শিকল তোলা। গোবিন্দর দরজায় সামান্য ঘা দিতেই দরজা খুলে গেল। দেখল, গোবিন্দ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। বাসি বিছানা কেমন যেন বড় বেশি দোমড়ানো এলোমেলো। ঘুম না অচৈতন্য গোবিন্দ? কাছে গিয়ে বনলতা ডাকল, সাধু, সাধু!

গোবিন্দ নিশ্চুপ নিথর।

এবার অসহ্য উল্কণ্ঠায় বুকের মধ্যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল বনলতার, সে গায়ে হাত দিয়ে ডাকল গোবিন্দকে। সাধু, কী হইছে? বেলা যে শোহর গড়ায়।

একটা বিরক্তির শব্দ করে গোবিন্দ উঠে সরে বসল। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে সাধুর। আচমকা ভয়ে ও বিস্ময়ে বনলতার প্রাণ কেঁপে উঠল। চোখ লাল, গাল বসা। সমস্ত মুখে একটা যন্ত্রণার চাপা আভাস। কেন? জিজ্ঞেস করল সে, কী হইছে তোমার সাধু? অসুখ-বিসুখ করল নাকি?

বনলতার আকুল মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্ত স্তব্ধ রইল গোবিন্দ। এই দুর্জয় বৈরাগীর মেয়েটির চোখে রুদ্ধ দুষ্টামির আভাস পেলে সাধক মন খুলে তবু যা খুশি তাই বলতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তেই এই সুরটি তাকে বড় থমকে দেয়। সে অস্বস্তি বোধ করে এই ভেবে যে, এ বুঝি দামাল মেয়েটার নতুন কোনও কিছু ঘটানোর ভুমিকা। যত ভাবে মন কষে গোবিন্দ। বলল, কিছু হয় নাই। মোর। কিন্তু তুই এই সাত সকালে এখেনে কেন?

মুখের অন্ধকার ঘুচল না বনলতার। বলল, তোমার কেন শুনলে মোর গা জ্বালা করে সাধু। কী হইছে কও। শরীল কি খারাপ করছে?

গোবিন্দ বলল, না।

কিন্তু কী এক গভীর দুশ্চিন্তা যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে গোবিন্দকে। মুহূর্তে চোখের দৃষ্টি অন্তবদ্ধ হয়ে উঠল, বুঝি ভুলেই গেল বনলতার কথা। তার শান্ত সাধক জীবনের কোথায় যেন একটা অশান্তির দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। মনটাকে তার দু-হাতে বেড় দিয়ে রেখেছে যেন এক গভীর সমস্যা–যা নাকি তার দৈনন্দিন জীবনে এনে দিয়েছে ব্যতিক্রম।

এ ব্যতিক্রম ও অশান্তির ধোঁয়া যে বনলতার নিশ্বাস আটকায় বোধ হয় গোবিন্দ জানে না। বনলতা বলল, কোনও কিছুর মধ্যে নাই, তোমার আবার এত ভাবনা কীসের?

অর্থাৎ গোবিন্দ এ সংসারের বাইরে, জীবন তার ভাবনাহীন। খোঁচাটা তার দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন মগজে বাজল বড় রূঢ়ভাবে। বুঝল, তার চিন্তার, কাজের কোনও মূল্য নেই এদের কাছে। বলল, তোর কি কোনও কাজ নেই ঘরে আখড়ায়?

চোরা হাসি ফুটল বনলতার ঠোঁটে। ভ্রূ তুলে বলল, নাই আবার? কত কাজ। শেষ নাই তার। হাসিটুকু চোখে না পড়লেও মনের হাসির আঁচ পায় গোবিন্দ। বলল, তবে মোর ঘরে কেন তুই?

মুখ ফিরিয়ে হাসি গোপন করল বনলতা। চেষ্টা করল গম্ভীর গলায় বলতে, তাই তো বলি তোমার ওই কেন শুনলে গা জ্বলে মোর। ঘর আখড়া মোর এইটাই।

স্তম্ভিত হল গোবিন্দ। তার দিকে মুখ ফেরাতেই ত্ৰাস ফোটে গোবিন্দের চোখে। বনলতার গায়ে জামা নেই, শাড়িতে ঢাকা। তবু গোবিন্দর মনে হল তার বলিষ্ঠ উদ্ধত যৌবন যেন সবটুকুই উন্মুক্ত, সুস্পষ্ট। যেন তার ভারে আর সমস্ত কিছুকে সে দলে দিয়ে যাবে। চন্দন কাঠের কষ্ঠি তার শ্যামল নিটোল গলার হার মানিয়েছে সোনার হারকে। তার চোখ মুখের এই বিচিত্র নাম-না-জানা হাসি, আর সাংঘাতিক নির্লজ্জ উক্তি, সব মিলিয়ে গোবিন্দর গভীর দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন মনে নতুন বিপর্যয় সৃষ্টির উপক্রম করল। তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে বলল, কুকথা বলতে কি তোর বাধে না বনলতা?

মোর কথা কুকথা, তোমারই সব সুকথা বুঝিন্‌?

তোর কথা মেয়েমানুষের মুখে শোভা পায় না।

কেন কও তো? সত্য কথা বলে?

ছিঃ! সত্য নিয়া খেলা করিস না।

সাধু, সে খেলা করো তুমি। মিছের কারবারে সাধ ছিল না কভু, আজও নাই।

গোবিন্দ আজ উত্তেজিত হল আরও বেশি। বনলতার কথা বুঝি এতখানি আর কোনওদিন বাজেনি তার। বলল, সত্য নিয়া খেলা করি আমি?

নয়? বনলতার কথার ধার তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। বলল, মোয়র কথা মেয়েমানুষের মুখে শোভা পায়

না, তুমি মোরে গালি দিলা। তোমার কথা কি পুরুষের মুখে শোভা বাড়াইছে?

বনলতার এ কণ্ঠ ও মূর্তি এতখানি চমকপ্রদ যে, গোবিন্দ তার নিজের উপর মিথ্যা দোষারোপের কথা ভুলে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইল।

বনলতা আবার বলল, মোর কথা মেয়েমানুষের নয়, মুই নই মেয়েমানুষ। তবে বলি, তোমার এ ভগমানের পিথিমিতে পুরুষ নাই, নাই, নাই!

সমস্ত ব্যাপারটাই অবুঝ ও অভাবনীয়। তাড়াতাড়ি এটাকে চাপা দেওয়ার জন্য গোবিন্দ ডাকল, লতা!

হ্যাঁ, ওই মোর নাম। রাতবিরেতে লোকে নাগিনীর নাম করে না, বলে লতা! তুমি.মোরে তাই

ভাবো।

গোবিন্দ অসহায়ের মতো বলে উঠল, থাম থাম বনলতা। কাল পাগলাবামুন বুকটারে মোর টুণ্ডা করে দিছে। আজ আর মুই সইতে পারছি না কিছু।

বনলতা থামল কিন্তু দারুণ কান্নায় ফুলে ফুলে উঠল তার শরীর, বিশাল তরঙ্গের মতো বুক দুলে উঠল। বার বার মরণ কামনা করল সে। এ কান্না আর কামনা বুঝি থামতে নেই কোনও দিন। এ পোড়া দেহ ও মনের দৌরাত্ম্য আর সয় না।

পরমুহূর্তে লজ্জায় সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে গেল তার। কই, এমন করে তো সাধুকে সে বলেনি কখনও, ভাবেনি কোনওদিন! ছি, এ মুখ বুঝি আর দেখানো যাবে না সাধুকে। তাড়াতাড়ি কাপড় গুছিয়ে ঘোমটা টেনে বনলতা উঠে দাঁড়াল। বলল অন্যদিকে মুখ করে, মুই অভাগিনী, মোর কথায় কান দিয়ো না। পাগলাবামুন তোমারে দুঃখ দিছে, তোমার যাতনা দেখেউ তো চুপ থাকতে পারি নাই। তুমি মোরে খেদাই দিলা।

বলতে বলতে তার গলায় আবার কথা আটকাল। গোবিন্দ স্তব্ধ। একবার প্রতিবাদ করতে চাইল বনলতার কথার। কিন্তু বাধা পেল। উঠোন থেকে নরহরির মিষ্টি আবেগমাখা গলা গুনগুনিয়ে উঠল :

আমি অভাগিনী রাই,
কাঁদিয়া বেড়াই
কানু সঙ্গ আশে।
মজিয়ে কুলমান
সে তো পলাইছে
মোর হিদয় ভরিয়া বিষে।

বনলতা বেরিয়ে এল। চোখে তার তখনও জলের দাগ, মনের স্পষ্ট ছাপ মুখে। সেই মুখে ছড়িয়ে পড়ল নরহরির গানের সুর। বৈরাগী যেন তার অন্তর্যামী, কিছুই তাকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। নরহরির ঠোঁটে বেদনামুগ্ধ হাসি। বলল, তাই ভাবি সেই গেল কুঠাই। চলো বাইরে যাই।

বনলতা বাড়ির বাইরে এল। নরহরি বলল, তোমার চোখের জল যে শুকায় না সই। পরানটা খানিক কঠিন করো।

বনলতা বলল, পরান যে মোর বশ নয়।

কিন্তুক্‌ পরান বশ না হইলে আর সব যে বশ হইবে না।

তবে এ ছার পরান শেষ হউক।

ছি, বেয়ীতির কথা বলল না। পরান যে অনেক বড় বস্তু। চাই বললে আসে না, যাও বললে যায় না। তার একটা ধর্ম আছে তো?

তারপর ক্ষণিক নিশ্রুপ থেকে সে বলল, বাপ বলছিল তোমার, বেটি বড় মুষড়ে থাকে নরহরি, তোমার সঙ্গে যদি ভিক্ষায় বার হয় তো ওরে নিয়ে যেয়ো। যাবে সই?

কী আকুল আগ্রহই না ফুটে উঠল নরহরির জিজ্ঞাসু চোখ দুটোতে! একটি জবাবের জন্য বুঝি তার সর্বাঙ্গই উত্তর্ণ হয়ে উঠল।

এ হল এই দেশ-গাঁয়ের রীতি। বোষ্টম বোষ্টমী গান গাইতে আসে। বাড়ি ভাল জায়গাটিতে দুখানা আসন পেতে দেয়। তারা জগৎ ভুলে কৃষ্ণগাথা, বিরহ-মিলনের গানে গানে হাসিতে বেদনায় মানুষের মনকে ক্ষণিকের জন্য আতুর নিষ্কর্ম করে দিয়ে যায়।

আগে যেত বনলতা। আজকাল আর সচরাচর যায় না। নরহরিও ডাকে না বিশেষ।

বনলতা বলল, শরীর অবশ লাগে, তুমি যাও। তা ছাড়া, সাধুর কী যেন হইছে।

নিমিষে নরহরির চোখের সমস্ত আলোটুকু নিভে গিয়ে অন্ধকার চোখে এক বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি বলল, সে-ই ভাল সই। আমি যাই।

হনহন করে পথ চলে তেপান্তরের বুকে এক বার দাঁড়ায় নরহরি। একতারাটার তারে ঘা দেয় কয়েক বার। তার পর উজোন ফিরে চলে খালের মোহনার দিকে। সারা দিনমান আজ তার সেখানেই কাটবে, গান গাইবে। আর নির্জনে সে গান হবে তার স্বগতোক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *