১০. সপ্তাহখানেক পরের কথা

সপ্তাহখানেক পরের কথা।

মহিম সারা নয়নপুর ও তার আশেপাশে আঁতিপাতি করে খুঁজল কুঁজো কানাইকে। কিন্তু কোথাও দেখা পেল না তার। না, এতে নয়নপুরের বুকে কোনও দুশ্চিন্তা, তার চলতি জীবনে কোনও ব্যতিক্রমই দেখা দেয়নি। শুধু মহিমের ঘুচেছে নাওয়া-খাওয়া, চোখে মুখে অনুক্ষণ দুশ্চিন্তা, বুকের মধ্যে এক অজানা শঙ্কা তাকে বড় মুষড়ে দিয়েছে; কুঁজো কানাইয়ের প্রাণের হদিস্ তো আর কারও জানা নেই! সকলের চোখে সে জানোয়ারের সামিল। জানোয়ারের আবার প্রাণ কীসের! সত্য, কুঁজো কানাইয়ের কিছু নেই, তবু আর দশজনের হিসেবনিকেশ যে তারও হিসেবনিকেশ। সুখ দুঃখ ভাল মন্দ সব কিছুতে আর দশজনের চেয়ে তার প্রাণের বোধ যে আরও বেশি। তার প্রাণের শিশু-বৃদ্ধের যুগপৎ বিচিত্র খেলা আর কেউ না জানুক, মহিম তো জানে। আর জানে বলেই তার উৎকণ্ঠা।

মালাপাড়ার নামকরা সুন্দরী মেয়ে সে কালু মালার মেয়ে। টাকার লোভে কালু মেয়ে দিয়েছিল ঘাটের দিকে এক-পা বাড়ানো এক বুড়োকে। তাইতেই কুঁজে কানাইয়ের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। মহিমকে এসে বলেছিল, পিশাচ শুধু নয়নপুরের শ্মশানেই থাকে না, ঘরেও থাকে।

এই ক্ষোভই একদিন ফেটে পড়েছিল কুঁজো কানাইয়ের–যেদিন চোখের সামনে দেখল, সেই মেয়েকে তার বুড়ো সোয়ামী এলোপাথারি পিটছে। ছুটে এসে তার সেই মস্ত হাত দিয়ে বুড়োকে সাপটে ধরে সে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল উঠোনে, বুড়ো হারামজাদা, তোর ওই নোনাধরা, ও পোড়া কাঠের হাতে ঠ্যাঙা কচি মেইয়াটারে। …মালা পাড়ার মালারা সেদিন বেধড়ক মার দিয়ে বার করে দিয়েছিল কুঁড়ো কানাইকে।

কানাই এসে মহিমাকে বলেছিল, মোরে বেড়ন দিলে, সেটা বড় লয়। মালাদের এ মতিগতি দেখতে এ ছার পরান আর রাখতে ইচ্ছা যায় না।

আর সেই হল মহিমের সবচেয়ে বড় ভয়। এ-সব পাগলেরা থাকে একরকম কিন্তু বিগড়ে গেলে এক মস্ত সমস্যা। মানুষের মতিগতিতে যার নিজের প্রাণের স্বাদ বিস্বাদ, তাকে নিয়ে খেলা করেছে যে ভগবান, সেই ভগবানের বিভ্রমের প্রতিশোধ তুলতে যে সে প্রাণত্যাগ করে বসবে না তার ঠিক কী?

মহিম শিল্পী, কিন্তু হাত চোখ আর মন আজ বেয়াদপ ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বসল। হাতের মাটি হাতে রইল, প্রাণ রইল নিঃসাড়।

অবস্থাটা বুঝল মাত্র একজন। মহিমের সবকিছুই প্রতি গ্রন্থিটি যে, ধরতে পারে সে অহল্যা। যমুনার মতো উপরে শান্ত, তলে তার খরস্রোতের তীব্র বেগ। অহল্যার হল তাই। সে ডাকল তার প্রিয় অনুচর মানিককে। বলল, যেখান থেকে পারিস কুঁজো মালার খোঁজ নিয়ে আয়। এ জগতে। তো তোর কোনও ঘাট-অঘাটের বেড়া নেই। এ খবরটা মোরে এনে দে বাবা, নইলে সোয়ান্তি নাই তোর কাকির পরানে।

ব্যাপারটা বড় ছোট নয়। মানিক ছুটল কোমরে চিড়েগুড়ের পোঁটলা বেঁধে।

ভারত এ-সবের কোনও খোঁজ রাখে না। সে একথা জানতে পারলে সামান্য দরদ তো দূরের কথা, এ পাগলামিকে সে তার স্বাভাধিক বিষয়ী ও রুঢ় ভাষায় শাসনই করবে।

এ অবস্থায় পথ চলতে হরেরাম একদিন ডাকল মহিমকে। দুপুর গড়ায়। উঠোন থেকে উঠে এসে হরেরাম ডাকল, মহিম নাকি গো?

মহিম ফিরল। বলল, কিছু বলছ হরেরামদা?

বলতে ভাই ইচ্ছে করে অনেক কথা। ঠিক বিরূপ নয়। কেমন যেন একটা চাপা আফসোস ফুটে উঠল হরেরামের গলায়। বলল, যেতে পারিনে কোথাও। জ্বর-জারিতে শরীলও বশ থাকে না। আর–

কথা শেষ করল না হরেরাম। মহিম দেখল কেমন বিতৃষ্ণায় ঠোঁট জোড়া কুঁচকে উঠেছে হরেরামের। বলল, আর কী বলে?

তোমার দাদার ভিটেয় পা বাড়াতে মনটা বড় ছোট হয়। নইলে গাঁ জোড়া যার এত নাম, একবার কি প্রাণে সাধ যায় না, তার হাতে গড়া কাজ দু-দণ্ড দেখে আসি?

কথাটি বড় সত্য। সেজন্য মহিমের শুধু লজ্জা নয়, ক্ষোভও বড় কম নেই। মামলাবাজ, রূঢ়ভাষী ভারতের উপর গ্রামের মানুষ, বিশেষ জাতভাই চাষীরা সকলেই মর্মাহত, ক্রুদ্ধ। বুঝি ঘৃণাও করে। মানুষের সঙ্গে তার সম্বন্ধ বড় তিক্ত, জ্ঞাতিকে করে হেয়জ্ঞান। অথচ কীসের অহঙ্কারে, তা বোধ হয় ভরতই জবাব দিতে পারে না। এ কথা নিয়েই দাদা বউদির মাঝখানেও যেন এক মস্ত প্রাচীর উঠেছে খাড়া হয়ে।

তবু অনেকেই তো যায় মহিমের কাছে। কত মানুষকে মহিম হাত ধরে ডেকে নিয়ে যায় নিজের কাজ দেখাতে, কেউ আসে ডাকের আগে। এই নয়নপুর, ওপারে রাজপুর, আশেপাশে মহিম তো কোথাও পর নয়। মহিম বলল, আমার কাছে তো সকলেই যায় হরেরামদা।

যায়, সে তোর টানে ভাই।

নয় কেন? তা ছাড়া, ভিটে তো একলা দাদার নয়।

কথাটা বলে ফেলে বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল মহিমের।… যেন তার মনে হল সে বুঝি চিৎকার করে লোককে তার অধিকারের কথা জানিয়ে দিচ্ছে, যেন ভারত বিস্মিত ক্রোধে বাকহারা, তার দিকে তাকিয়ে আছে অহল্যা। না না, মহিম তো তাই ভেবে কথা বলেনি।

যেন কৈফিয়ত দেওয়ার মতন হরেরামকেই বলল সে, দশজন ছাড়া আমি নয় হরেরামদা। তোমরা কেবলি দাদার কথা বলল, আমি কি কেউ নই?

হঠাৎ হরেরাম অত্যন্ত আপনভাবে বলে উঠল, আয় না কেন, খানিকটা বসবি।

মহিম দ্বিরুক্তি না করে ঢুকল বাড়িতে। যে ঘরে নিয়ে এল তাকে হরেরাম, সেখানে এসে চমকে উঠল মহিম। দেখল, গাঁয়ের চাষী, মালা, কামার সকলেই এসে সেখানটিতে ভিড় করেছে। রাজপুরেরও কেউ কেউ এসেছে। আশেপাশের গাঁগুলিও বাদ যায়নি। কী ব্যাপার। এমন একটা পরিবেশের কথা মহিম কল্পনাও করতে পারেনি। সকলেই তাকে বাবা, ভাই বলে ডেকে বসাল। এক কোণে অহল্যার বাবাকে বসে থাকতে দেখে মহিম উঠে গিয়ে প্রণাম করল। অহল্যার বাবা পীতাম্বর তাড়াতাড়ি মহিমের হাত ধরে বলল, থাক থাক বাবা, বেঁচে বর্তে থাকো, পায়ে হাত দিয়ে না।

পায়ে হাত দিয়ো না কথাটা অভিমানের। নিজের জামাই যাকে ভুলে কোনও দিন নমস্কার করে, তারই বিমাতার সন্তান প্রণাম করলে মনে আর লাগে না কার? ও পীতাম্বর শুধু তুষ্ট নয়। মনে প্রাণে আশীর্বাদ করল মহিমকে আর একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস সে কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না। মেয়ের মুখে তার এই দেবরটির অনেক কথাই শুনেছে সে তার মেয়ের বড় মেহের দেবর শুধু নয়কথায় আঁচ করেছে পীতাম্বর, বুঝি বড় সোহগের।

পীতাম্বরের কথার প্রতিবাদ করল দয়াল কামার। বলল, এ তোমার রাগের কথা পীতু ভাই। গুরুজনকে পেন্নাম করবে না। এ তোমার কোন্ শান্তরের কথা?

ও সব শাস্তর ফাস্তরের কথা ছাড়া, এখন কাজের কথা বলো, নয় তো বললা ঘরে যাই।

কেবল চেঁচানি নয়, কথাটা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ধমকানির মতো শোনাল। সকলেই তাকিয়ে দেখল বক্তা পীতাম্বরের বড় ছেলে ভজন। কেউ লক্ষ করেনি, কিন্তু এতক্ষণের সমস্ত ব্যাপারটা তাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। এবং এ ক্ষিপ্ততার বর্তমান কেন্দ্র মহিম হলেও আসলে ভরতই। ভগ্নীপতির সঙ্গে ভজনের সম্পর্কটা এমনই তিক্ত যে, অনেকদিনই তার ইচ্ছে হয়েছে ভরতকে পথে ঘাটে ধরে অপদস্থ করে দেয়। কিন্তু অহল্যা তার বড় আদরের বোন। ভরতের উপর আঘাত যে বোনের উপরে গিয়েই শেষ পর্যন্ত পড়বে এটা সে জানত, জানত বলেই নীরব। ভরতের জন্যই ভজন কোনও দিন মহিমকে ডেকে কথা বলেনি। অহল্যার কাছে তার দেবরের গুণপনা শুনলেও রাগটা ভজন মনে মনে জমিয়ে রেখেছে, শত হলেও একই ঝাড়ের বাঁশ তো! আর চাষীর ছেলে কুমার হল, তাও কি না শহরের লেখাপড়া জানা বাবুদের স্কুলে শেখা কুমোরগিরি। একটা ফারাক ভজন কিছুতেই ভুলতে পারে না। সে মাটিতে চাপড় মেরে বলল, চাষী চাষীর পেন্নাম লেয়, আর কারও লয়।

মহিম চকিতে ফিরে দু-হাতে ভজনের পায়ের ধুলো মাথায় তুলে নিল, দাদা বইসে আছেন, দেখি নাই।

ভজন দু-হাত বাড়িয়ে বাধা দিয়ে কী একটা বলতে গেল, কিন্তু মহিমের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে স্তব্ধ হইল সে। ঘরের আর সবাই ভজনের গোঁয়ারপনার কথা স্মরণ করে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। না জানি ভজন কিছু ঘটিয়ে বসে।

হাত জোড় করে মহিম বলল, ঠিকই বলছেন দাদা, চাষীর পেন্নাম চাষী নেয়, মোর তো অপরাধ নাই। এট্টু ঠাঁই দেন মোরে বসবার।

সকলেই জায়গা দেবার আগ্রহে নড়ে চড়ে উঠল। কিন্তু তার আগেই ভজন মহিমের জোড় হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে নিল। বলল, বসো বসো ভাই, মোর ভুল হইছে। মানুষ তো বাঁশের ঝাড় নয়। মানুষ-মানুষই।

মহিমা ছাড়ল না। ভজনকে আরও খানিক যাচাই করে নেওয়ার জন্যই বলল, চাষীর ছেলের মূর্তি গড়া কি অপরাধ দাদা? মাঠে লাঙল দেওয়া ছাড়া চাষীর ছেলে কি আর কিছু করবে না কোনও দিন? মেলা লেখাপড়া শিখি নাই, কিন্তু যা করছি মোর সে সাধনা কি অন্যায়? আমি কি চাষীকুলের কলঙ্ক?

ভজন লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ছি ছি, সে কী কথা ভাই? তোমার নাম যে ঘরে ঘরে।

মহিম বলল, মোর কাজ দশজনার। আপনাদের জন্য আমি কাজ করতেই চাই। বোঝা গেল, ঘরের সকলেই তুষ্ট হয়েছে তার কথায়। দয়াল কামার উঠে এসে মহিমের মাথায় হাত দিয়ে বলল, মুই আশীর্বাদ করছি, তুমি আরও উন্নতি করো বাবা, বেঁচে থাকো। তুমি চাষীকুলের রত্ন।

সকলেই বলে উঠল, নিশ্চয় নিশ্চয়।

রাজপুরের জহীর মিয়া বলে উঠল, নইলে বাপজান মোর এক কথায় জমিদারের কথার পিতিবাদ করে আসল পিতিমে গড়তে পারবে না বলে!

শ্রদ্ধার বিস্মিত সকলের চোখ গরীয়ান করে তুলল শিল্পীকে। মহিম বুঝল, এটা গা ঘরে ভরত্রে ঢাক-পেটানো রটনা। উঠে হাত জোড় করে বলল সে পিতিবাদ নয় জহীর চাচা। যা মোর মন চায় না, তা আমি অস্বীকার করছি।

সেই হইল বাপজান, সেই হইল। সে হিম্মতই বা ক’জনার আছে?

কথাটা দয়ালের ছেলের গায়ে লাগল। সে ফুসে উঠল, আছে। আছে বলেই আজ হরেরামদার ভিটেয় সব একত্র হইছি।

জহীর হেসে বলল, কথাটা মোর ভুল বুইঝ না কামারের পো। জমিদারের সোহাগ আর চাঁদির লোভ সামলানো বড় চাট্টিখানি কথা নয়, বুঝলা? বাপজান মোদের সে পথ মাড়িয়ে দিয়ে আসছে।

ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা টিকটিকির টিক টিক শব্দের সঙ্গে একত্রে কয়েকজন মাটিতে টোকা দিয়ে বলে উঠল, সত্য সত্য সত্য।

অদৃশ্য টিকটিকির এ দৈব ঘোষণা যেন সমস্ত সত্যকে পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়ে গেল। এ ঘরের সমস্ত মানুষগুলোর কাছে ওই জীবটি ঈশ্বরের প্রতিনিধির মতনই।

মহেশ মালা বলল, আর তো দেরি করা যায় না হরেরাম, বেলা যে গড়ায় ওদিকে।

মহিম বলল, মোরে কি থাকতে হইবে হরেরামদা?

হরেরাম বলল, তা তো হইবেই ভাই। সকলের কাজ, সকলের কথা। জোড়া জোড়া মহকুমার চাষী-মনীষরা আজ একটা পিতিবিধেন করতে বসছে। তোমার কথা তোমারে বলতে লাগবে না? কেন, শরীলটা কি বেগতিক বোঝো?

শরীল না, মনটার বড় হুতাশ রইছে। কুঁজো মাল তার উপর গাঁ ছাড়া। সে বড় দুঃখু পেয়ে গেছে। যদি কিছু করে বসে—বলতে বলতে তার চোখ উঠল ছলছলিয়ে।

হরেরাম হেসে উঠল। ও হরি, এই কথা।

সকলেই প্রায় উঠল হেসে। দয়াল বলল, এরেই বলে পাগল। পাগলে পাগলে কেমন জোড় বাঁধে দেখছ তোমরা! তা মোদের জিজ্ঞেস করতে লাগে তো?

মহিমের চোখে যেন আলোর রেখা দেখা দিল, বলল, তা হইলে—

বাধা দিয়ে হরেরাম বলে উঠল, তোমার কানাইদা যে কাজে বার হইছে গো। তারে যে মোরা ন’হাট মহকুমায় পাঠাইয়াছি।

বটে! কুঁজো মালা গেছে কাজে? আর এরাই তাকে পাঠিয়েছে? হায়। মহিমের মনে হল কুঁজো কানাই বুঝি আজও তার কাছে তেমনি দুজ্ঞেয় রয়ে গেছে। জীবনে এই বোধ হয় প্রথম কুঁজো কানাইয়ের উপর মহিমের একটু অভিমান হল। কই, তার কানাইদা তো তাকে কিছু বলে যায়নি।

একটি নিশ্বাস ফেলে সে ভাবল, যাক। প্রাণটা তবু আশ্বস্ত হল। হরেরাম প্রথমে কাজের কথা শুরু করল। তার আগেই পিছনের দিকে অল্পবয়স্ক কয়েকজন জোয়ানকে লক্ষ করে বলল সে, তোমরা এবার হাসি কথায় একটু চুপ দেও ভাই। তারপর অখিল চাষীকে বলল, অখিলদা, ধার দেনা কি তোমার কিছু কম আছে যে, মাটিতে দাগ কাটতেছ?

অখিলের এটা অভ্যাস। বসলে নানান রকম দাগ কাটা। সে লজ্জায় হেসে হাত গুটিয়ে নিল। প্রচলিত প্রবাদ, মাটিতে দাগ কাটলে নাকি দেনা হয়।

পেছনের জোয়ানের দল হেসে উঠল। ভজনের পাশে বসে মহিমও মুখ টিপল। দেখল হরেরামের গাম্ভীর্যের আড়ালে ঠোঁটে রয়েছে চোরা হাসি।

ঘরটা মানুষে আর তামাকের ধোঁয়ায় ভরপুর। সকলেই নীরব।

হরেরাম বলল, কুঁজো মালা আজই কিবা আসবে, না, হাট মহকুমা অরাজি হইবে না। শোনেন দাদাভাই দশজনায়, নিজে না চষে, পরকে দিয়ে চাষ করায় এমন মানুষও যখন এখানে আসছেন, তখন মনে লয় মোদের বেগার বন্ধের লড়ায়ে জয় হইবে। পেছনের জোয়ানের দল থেকে হঠাৎ একজন উঠে বলল, পাগল বামুন না আসতেই শুরু করলা যে?

হরেরাম বলল, পাগলা বামুন আসতে পারবে না, খবর দিছে। তবে সে যা যা বলে দিছে সব কথাই আপনারা শোনবেন।

বলে সে আরম্ভ করল, জমিদারে ফাঁকি দিচ্ছে অ্যাদ্দিন সরকারের খাজনা। সে ফাঁক ধরা পড়ে জমিদার তার দেনা শুধতে চায় মোদের মাথা কেটে। কথা নাই বাত্তা নাই, হুট বলতে খাজনা বেড়ে গেল, কিন্তুক মোরা কেন তা দিব? এ বাড়তি খাজনা না দিলে জমিদার হুজ্জোত করবে। করুক, মোরা তবু মানব না। তা ছাড়া, জমিদারে আজকাল আমাদের হাত থেকে জমি নিয়ে একুনে হাজার হাজার বিঘা অন্য লোকের হাতে তুলে দিচ্ছে। চাষ জমির খাজনার বিধেন তার আলাদা। তার ফলে আমরা উচ্ছেদ হইলাম। এই জমিদারে আর মালিকে মিলে যা শুরু করেছে তার এট্টা পিতিবিধেন না করলে মোদের কম্মো সারা।’ বলে সে, এমন কী, শত শত বছরের পুরনো প্রথা, ঈশ্বরের বিধানরূপে যা সকলের মনে শিকড় গেড়ে বসেছিল, সেই শিকড়ে টান পড়তে অনেকে কিছুটা সংশয়ান্বিত হয়ে উঠল। কিন্তু হরেরামের অকাট্য যুক্তি ও উদাহরণ সাপের মতো কুটিল এই অবুঝ সংশয়ের মাথা দিল নত করে। এই চাপানো বিধানের প্রতিরোধের নীতি ও কৌশলের ব্যাখ্যা করে গেল, কথায় কথায় অভিমত চাইল সকলের। সম্মতি পেল, প্রতিজ্ঞা শুনল, পেল আশা ও উৎসাহ। সগৌরবে জানিয়ে দিল, আর নয়নপুরই প্রথম শুরু করবে তিনটি মহকুমার মধ্যে। এবারকার হেমন্ত নয়নপুরের বুকে নতুন চেহারায় পদক্ষেপ করবে, নতুন তার স্বাদ গন্ধ। শুধু তাই নয়, আগামী বছরে এই সূত্র ধরেই আসবে ভাগচাষীর ভাগের লড়াই সে কথাও ঘোষণা করা হল।

ভজন দেখল, মহিমের চোখ দুটো যেন মোটা সতের প্রদীপের মতো জ্বলছে।

জ্বলবে না। তার মনে পড়ছে একটি উজ্জ্বল মুখ, একটি আবেগদীপ্ত কণ্ঠ। লক্ষ গ্রামের এ অনাগত গৌরবের কাহিনী একদিন সেই কষ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। নয়নপুরের খালের জলে আসার মতো প্লাবিত করেছিল তার অন্তর। কিছু ভাঁটা আসতে দেরি হয়নি। আজ আবার জোয়ার এসেছে। কিশোরের সেই কানে শোনা কথা আজ চলেছে কাজে হতে। আর শুনেছিল, শিল্পসাধনা আপসের পথ ধরবে যদি না তুমি এ মানুষের বাঁচার তাগিদে ভাসো।

সে কণ্ঠ, সে মুখ পাগলা গৌরাঙ্গের। বুঝলে সে মানুষটি তার কাজ করে চলেছে অহর্নিশ। কোনও কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। আর এই প্রথম সে অনুভব করল, গাঁয়ের সমস্ত কিছু থেকে সে কতখানি দূরে। মূর্তি গড়ায় কাজের মাঝে সে সবাইকে সবরকমে ভুলে বসে আছে, অথচ তার খবর এরা সবাই রাখে সবটুকু। ভরত হয়তো একথা জানে, কিন্তু তার স্বার্থ থাকলেও দায়ে পড়েই বোর হয় নীরব। মহিম কাজের ফাঁকে অনেকের সঙ্গে মেশে, কিন্তু গাঁয়ে ঘরে যে দিনে দিনে কত কাণ্ড ঘটছে, সে কথা কেউ তাকে বলেনি, জেনে নেয়নি সেও কারও কাছ থেকে। মনে হল, সে যেন বহুদিন পরে হঠাৎ দেশে ফিরে এসেছে, এহে আপন মানুষদের কাছে। আর এই হরেরামদা। নিজের উপর শুধু ধিক্কার নয়, বুকটা ভরে উঠল মহিমের। নয়নপুরের চাষী মনিষ্যিরা আজ সকলেই নিধনের জাগ্রত শিব। সমাহত, ক্রুদ্ধ। চোখে চোখে আগুন, সে আগুন ছড়িয়ে পড়ল মহিমের বুকে।

ঘরের মধ্যে তখন নানান জনে নানান কথা বলছে। মহিম এগিয়ে গেল হরেরামের কাছে। বলল, স্বপন দেখছিলাম হরেরামদা, কথা শুনছি অনেক কিন্তুক–এ মনটার ছিরিছাঁদ নাই, তাই চোখ পথ দেখতে পায় না সব সময়। মোন কি কোনও আলাদা কাজ নাই?

নাই কেন? হরেরাম বলল, ধম্মঘটের পুজো দেব মোরা, তোমারে তৈরি করতে হইবে সেই ঘট আর ধম্মেদেবের মূর্তি। তোমার মনের মতো বানাবে।

কে একজন হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠল :

নতুন কন্যের গর্‌ভে সন্তান
ঢালামাটির মাঠে ধান,
অনাবিষ্টির আকাশে জল;
দিন কখনো সমান যাহেনা,
(ও) তোমার গত বিধেন না ভাঙ্গিলে
নতুন বিধেন হবে না
জোড় হাতে বলি একবার কর পিনিধান।

পথ চলতে চলতে মহিমের মনে সেই অতীতের পাগলা গৌরাঙ্গের কথাগুলো গুনগুন করতে লাগল। সেই কথার পাশাপাশি অহল্যার কথাগুলোও মনে পড়ল তার। মোর ভাবনার অন্ত নাই তোমাকে নিয়া। কেবলি ডর লাগে, মোদের ছেড়ে চলে যাবে তুমি, এ গাঁ ঘরের আপনজন বুঝি তোমার পর। এ কথার সঙ্গে পাগলা বামুনের ফারাক কোথায়, বিচারক মন মহিমের খুজে পায় না তা। অথচ কী ছিষ্টিছাড়া রাগে ও ব্রাসে বউদি বলে তার, পাগলা বামুন তোমারে কেড়ে নিতে চায় পর করবে বলে।

না। অহল্যা বউয়ের একথা ভুল। ভুল মনে হতেই তার প্রাণে নতুন আকাঙ্ক্ষা বাসা বাঁধল–তার জীবনের একই নিৰ্বর থেকে বয়ে চলা এই ধারা দুটিকে একত্র করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *