০১. খালের ধারে শাবল দিয়ে

খালের ধারে শাবল দিয়ে খুঁড়ে মাটি তুলছিল—মহিম। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে চটকে টিপে টিপে মাটির এক একটা ড্যালা নিয়ে পরখ করে দেখছিল। কিন্তু পছন্দ হচ্ছিল না, আবার শাবল নিয়ে উবু হয়ে খুঁড়ে চলছিল মাটি।

এখন ভর দুপুরবেলা। নিস্তব্ধ খালপার। সূর্য হেলে পড়েছে খানিক পশ্চিমে। খালের জলের রঙ আর গতি দেখলেই বোঝা যায় নদী খুব কাছেই। তা ছাড়া, খালের এপার ওপারও ছোটখাটো একটি নদীর মতোই চওড়া। যত দূরে গেছে, তত সরু হয়ে এসেছে খাল। নদী কাছে বলেই হাওয়র গতি একটু বেশি।

খালের ধারে বাড়ি ঘরদোর চোখে পড়ে না। খানিকটা দূরেই দু পারেই গ্রামের চিহ্ন চোখে পড়ে। পশ্চিমদিকে গিয়ে খাল দক্ষিণে মোড় নিয়েছে প্রায় আধমাইলটাক দূরে। এ আধমাইল পর্যন্তই গ্রামের চিহ্ন ক্রমশ কালচে ক্ষীণ রেখাতে দিগন্তে মিশে গেছে। মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে কয়েকটা বেমানান তাল, নারকেল, দেবদারু জাতীয় উঁচু মাথা। ওগুলো দূরাগত যাত্রীদের গ্রাম বা পাড়া চিনতে সাহায্য করে।

উঁচু পাড়। দেখলেই বোঝা যায় এ দেশের জমি উঁচু, মাটি শুকনো কিন্তু ফলবন্ত। বিশেষ করে খালের ধারে ধারে এ গ্রামগুলো ঐশ্বর্যবান যে বেশি, তা খালধারের সবুজ শস্যে ভরা মাঠের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। খালের উঁচু পাড়ের জমিগুলো যে পর্যন্ত চোখে পড়ে, প্রায় সম্পূর্ণই দিগন্তবিসারী ধানখেত। সবুজের সোনা। কোথাও কোথাও পাঁশুটে ছেপের হালকা আভাস দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ ধান পাকার দেরি নেই আর।

অজস্র ধারা সূর্যের আলোতে কিশোরী ধানগাছ তার উত্তোলিত গ্রীবা বাঁকিয়ে উঁচিয়ে ধরেছে রসে-গন্ধেবর্ণে-সম্ভারে পূর্ণ যৌবনকে গায়ে ধরতে। তারই নাচন লেগেছে তার হেলানো-দোলানো নরম মাথায় কোটি মানুষকে তার মাতাল ডাকের মাথা দোলানি-ঘরে ঘরে নেশা, চোখে চোখে স্বপ্নের ছায়া ঘনিয়ে নিয়ে আসার মাথা দোলানি।

খালের ধারে ধারে সাদাকালো বকের ঘাড় কাত করে বিচক্ষণ শিকারির ভঙ্গিতে ধীর বিচরণ চলেছে। পানকৌড়ি পাখি একটা টুকটুক করে জলে ড়ুবছে আর উঠছে পাতিহাঁসের মতো আর ঘন ঘন তার তীক্ষ্ণ ঠোঁটের ডগায় চকচক করে উঠছে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফটানো জ্যান্ত ছোট মাছ। আর তাই দেখে দেখে মাঝে মাঝে দুএকটা লোভী বক পানকৌড়ির ঠেটি থেকে মাছটা ছিনিয়ে নেবার জন্য সাঁ সাঁ করে উড়ে যাচ্ছে তার মাথার উপর দিয়ে। কিন্তু হার মানতে হচ্ছে বকগুলোকে। সামনেই একটা বেলগাছের উপর, বোধ হয় পাকা বেল দেখেই একটা দাঁড়কাক নিস্তেজ গলায় কা কা করছে। মাঝে মাঝে আকাশের কোল থেকে শিকারি চিল ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রায় খালের বুকে। শিকার নিয়ে চি-চিঁ কান-ফাটানো ডাক ছেড়ে আবার সোঁ সোঁ করে উঠে যাচ্ছে বহু দূর আকাশে।

সূর্যের তেজ আছে, কিন্তু নারকেল গাছের পাতাগুলো কী সুন্দর শ্যামল চিকনধারে চকচক করছে। ঋতু শরতের রঙ এটা। খণ্ড খণ্ড সর-পড়া মেঘে-ছাওয়া আকাশ, দেশ হতে মহাদেশান্তরে পাড়ি জমানো চলন্ত মেঘ। বলা যায় না, খেয়ালি শরৎ কোন মুহূর্তে বলাকওয়া নেই বাদল ডেকে নিয়ে আসে।

প্রকৃতির এ খেলা দেখবার এখন সময় নেই মহিমের। সে এখনও শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলেছে। তার ঘর্মাক্ত শ্যামলাঙ্গে সুর্যের আলো পড়ে নারকেল পাতার শ্যামল চিকন বর্ণের মতোই চকচক করছে। একমাথা কোঁচকানো এলোমেলো চুল। বহুদিন না কাটার জন্য ঘাড়ের উপর দিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে বেয়ে পড়ছে চুল। মাঝে মাঝে ওই মাটি হাতেই রুক্ষ মাথাটা চুলকে, ধূসর মাটির রঙে ছেয়ে ফেলেছে মাথাটা। ভেজা কাদা মাটিতে অনেকখানি ড়ুবে গেছে পা দুখানি।

তার সামান্য লম্বাটে মুখখানি বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজে উঠেছে। পরিশ্রমে আর রোদের তাপে চোখ দুটো হয়ে উঠেছে লাল, কোমল মুখখানিতেও রক্ত জমে শ্যামল মুখ বেগুনী রঙ ধারণ করেছে।

আরও খানিকক্ষণ খুঁড়ে শাবল দিয়ে খোঁড়া অন্ধকার সরু গর্তটায় হাত ঢুকিয়ে দিল সে। আঁচড়ে আঁচড়ে তুলে নিয়ে এল এক খামচা মাটি। মাটির বর্ণ দেখেই তার হাসি ফুটল মুখে। টিপে টিপে দেখল। ভারী নরম আর মিহি, যেন বহু কষ্টে চটকানো এক নম্বর ময়দার দলা। টেনে টেনে দেখল। সজনে আঠার মতোই লম্বা হয়ে যায় মাটি, অল্পতেই ছাড়া মাটির মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় না।

এবার দ্বিগুণ উৎসাহে খুঁড়ে খুঁড়ে গর্তের মুখটা বড় করে নিয়ে খামচা খামচা মাটি তুলে সঙ্গে নিয়ে আসা বালতিটা ভরে তুলল।

ইতিমধ্যে সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে। গাছের ছায়াগুলো বদিকে লম্বাটে হয়ে পড়েছে।

খালের জল পালটা গতি নিয়ে গা দিয়েছে ভাঁটার টানে। মধ্যাহ্নের স্তব্ধতা ভেঙে, ধানখেতের পর-পার গাঁয়ের ভিতর থেকে মানুষের সাড়া-শব্দের ক্ষীণ শব্দ আসছে।

নদীর দিক থেকে জ্বলে বৈঠার ছপছপ শব্দ তুলে ডিঙি নাচিয়ে নাচিয়ে এল শম্ভু মালা।

এপার নয়নপুর, ওপার রাজপুর।

মহিমকে দেখে শম্ভুর বোজা মুখটা একটু হাঁ হয়ে গেল। মুখে একটা দুঃখ প্রকাশ করবার বিচিত্র শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠল সে, ওগো, ও মহিম, বলি খাল ধারডারে কাটবা নাকি সবখানি?

মহিম তখন শাবল রেখে দিয়ে কোমরে বাঁধা গামছাটা খুলে গায়ের ঘাম মুছছে। শম্ভুর কথায় তার ক্লান্ত শুকনো ঠোঁটে একটু সলজ্জ হাসি দেখা দিল। কথার কোনও জবাব দিল না।

আরে বাবারে বাবা! ছেলের কাণ্ড দ্যাখো দিনি। শম্ভু তার তামাক-খাওয়া কেশো গলায় হেসে বলল, সে কোন্ বেলাতে দেখে গেলাম, মাটি মিলল না এখনও মনের মতো।

তারপর গলা ছেড়ে হেসে উঠল ছোট ছোট শাবল দিয়ে খোঁড়া অনেকগুলো গর্তের দিকে চেয়ে। এ যে কাঁকড়ার গর্ত করে ফেলছ গো কুড়িখানেক।

সত্যি, মহিম করেছে কী? তাকিয়ে দেখল এবার সে নিজের চোখে। এলোমেলো গর্ত করেছে সে অনেকগুলো। আবার তাকাল সে অবিকল একটি মেয়েমানুষের মতো সলজ্জ হাসিচোখে শঙ্কুর দিকে।

ভারী দিলদরিয়া শম্ভু মালা আবার হেসে উঠে আচমকা থেমে গেল। কিন্তু একেবারে হাসি তার মিলিয়ে গেল না। বলল, বেঁচে থাকো, বেঁচে থাকো।

তারপর তার প্রৌঢ় দেহের পেশিগুলোর ওঠা-নামার তালে তালে বৈঠার চাড় দিল জলে। ভাঁটার টান কেটে কেটে ডিঙি এগিয়ে চলল রাজপুরের সদরঘাটের দিকে। কী যেন সে বিড়বিড় করছে ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা নিচু করে।

যেন কিছু মনে পড়ে যাওয়ার মতো থেমে যায় সে। যেন কেউ তাকে বারণ করে দিয়েছে অসতে, কথা বলতে। কিন্তু এও লক্ষ করেছে মহিম, সেটা আর কাউকে দেখে নয়, একমাত্র মহিমের সামনেই ঘটে থাকে তার এ ভাবপরিবর্তন।

কিন্তু না, এ-সব কথা এখন ভাববার সময় নেই মহিমের। মাটি ভরা বালতিটা নিয়ে খাল পাড় থেকে গাঁয়ের পথ ধরল সে।

বাড়ি এসে বালতি থেকে মাটি তুলে নিয়ে একটা কাঠের পাটাতনের উপর রাখল। ঘটিতে জল এনে দুহাত দিয়ে যদৃচ্ছা মতো ঘেঁটে চটকে কুটো কাঁটা কাঁকর সমস্ত একটি একটি করে বেছে ফেলল। সে মাটি মোটা চ্যাঁচাড়ি দিয়ে চেঁছে ঠেছে তুলল একটা মালসায়। তাতে ঘটিখানেক জল ঢেলে সাবধানে আলগোছে তুলে রাখল ঘরের এক কোণে।

মহিমকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ইতিমধ্যে ভিড় করেছে গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে। অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে, কৌতূহলে বড় বড় চোখগুলো দিয়ে তারা মহিমের কাজকর্ম দেখছিল। রোজই দেখে। ভিড় করে, গোল হয়ে বসে সবাই দেখে। কথা বলতে বারণ আছে মহিমের। অখণ্ড নীরবতার সঙ্গে বিস্মিত কৌতূহলে ড্যাবড্যাবা চোখগুলো নিয়ে চিরকালই ছোট ছেলেমেয়ের দল ভিড় করে থাকে তার দরজাটির কাছে।

তাকে সমস্ত গুটিয়ে রাখতে দেখে একটি ছোট ছেলে জিজ্ঞাসা করল, এবার কী বানাবে মহিমকাকা?

এবার?

মহিমের টানাটানা চোখ দুটোতে হঠাৎ যেন স্বপ্ন নেমে আসে। চোখের দৃষ্টি অন্তরাবদ্ধ হয়ে যায়। ঠোঁট অদ্ভুত হাসিতে ফাঁক হয়ে যায়। কী অপূর্ব দৃশ্য যেন তার চোখের সামনে রয়েছে, এমনি পলকহীন বিস্ময়ে, মুগ্ধতায় স্বপ্নাচ্ছন্ন তার চোখ। এমনি বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন থাকে সে অনেকক্ষণ।

ছেলেমেয়েরা তর্কযুদ্ধ চালায় নিজেদের মধ্যে। মহিমের দিকে তাদের আর ততটা খেয়াল থাকে। মহিমের এমনি খেয়ালিপনা তারা অনেক দেখেছে। এমনি কথা বলতে বলতে থেমে যাওয়া, কী যেন ভাবা এমনি অন্য জগতে চলে যাওয়া। পাগলের মতো।

হ্যাঁ, পাগলই হয়ে যায় মহিম তার নিস্পাপ কল্পনারাজ্যে বিচরণ করতে করতে। সে শিল্পী। ভাবরাজ্যেই তার বিচরণ। তার সে ভাবরাজ্য আনন্দ-বেদনায়-আশায় ভরপুর। সমস্ত হৃদয়টুকুর সবখানি অনুভূমি দিয়ে সে তার ভাবরাজ্যকে স্পর্শ করতে চায়, চায় হৃদয়ের সমস্ত সঞ্চিত রূপখানি চোখের সামনে এনে হাজির করতে। সিমিশ্রিত এক অদ্ভুত কান্নায় উদ্বেল হয়ে ওঠে সে, বুকটার মধ্যে অযথা টনটনানিতে ফেটে পড়তে চায় যেন! কেন? কেন মনে হয়, বুকটা যেন বড় ভারী, দীর্ঘশ্বাসে তা শুধু আরও ভারী হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে মুখখামুখি তর্ক থেকে হাতাতাতি লেগেছে।

মহিম গিয়ে সামনে পড়ে থামায়, ধমকায়। দু-একজন ওস্তাদ ছেলেকে কানমলাও দেয়।

গরু নাকি এগুলা, আঁ? মারামারি করছে দ্যাখো।

ও কেন আগেতে মারল, সেটা বলো। একজন অভিযোগ করতেই পালটা আর একজনের কান্না মাখানো গলা জবাব দেয়, দ্যাখোনা মহিমকাকা, আমি বলছি বলে কী, তুমি এবার একটা গণেশঠাকুর গড়বে, আর ও অমনি কুঁজো কানু মালার মতো করে ভ্যাংচাল।

এ দরবার এবং বিচার-প্রহসন কতক্ষণ চলত বলা যায় না। হঠাৎ সভাস্থল একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল একজনের আবির্ভাবে। ছোটরা সব টুকটুক সটকে পড়তে লাগল এপার ওপার।

মহিমের বড় ভাইয়ের বউ অহল্যা। এ সংসারের বহুদিনের গিন্নি। ন বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। আজ পঁচিশ বছর বয়সে সন্তানহীনা এই নারী পরিবারটির মধ্যে একমাত্র মেয়েমানুষ। ভাল-মন্দ আপদ-বিপদসমস্ত কিছুই যার উপর দিয়ে অহর্নিশ বয়ে চলেছে। সবকিছুতেই তাকে মানিয়ে চলতে হয়, সমস্ত দিক বজায় রেখে এই পঁচিশ বছরের বউটি সংসারের সমস্ত কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে। নিরবচ্ছিন্ন সুখ না হোক, সুখে-দুঃখে এ সংসারকে সে চালিয়ে আসছে। স্বার্থপর নীচ তার স্বামী, মহিমের বৈমাত্রেয় দাদা ভরতের সমস্ত দুঃশাসনকে মুখে বুজে সয়েও সে শান্ত। ভরতের স্বার্থপরতা, নীচতা ঘরের চেয়ে বাইরেই বেশি, আর তারই বিষাক্ত ঢেউ ঘরে ঢুকে অপমানে জ্বালিয়ে দেয় তাকে। ভরত ঘর ভরাতে বাইরে যে আঘাত করে, যে নিষ্ঠুরতা নিয়ে চলে—সে তো জানে না—সে নিষ্ঠুরতা তার ঘরের অন্তঃস্থলকেই কী অপমানিত বিষ-তীব্রতায় বিদ্ধ করে।

ন’ বছর বয়সে তার বিয়ের সময় মহিম পাঁচ বছরের শিশু। দুরন্ত স্বামীকে জব্দ করতে না পারলেও, এ অতিশিশু আপমভোলা দেওরটিকে সে ভাই বন্ধুর মতো তার বালিকা চঞ্চল হরিণীর ভীত বুকটাতে জড়িয়ে ধরতে পেরেছিল। আশ্রয় পেয়েছিল তার বাপ-মা-ছেড়ে-আসা ছোট বুকটা ওই শিশুটিরই কাছে।

শিশুটি সেদিন ওকে বুকে করে নিয়ে খেলতে দেখে অহল্যাকে ভুল ভাঙিয়ে দিতে চেয়েছিল, তোমার কিন্তু দাদার সঙ্গে বিয়ে হইছে, মোর সাথে নয়।

অ্যাঁ? তাই নাকি গো বুড়ো? খিলখিল করে হেসে কুটোপাটি হয়েছিল অহল্যা। সই বান্ধবীদের ডেকে ডেকে বালিকা সেদিন তার শিশু অবাচীন দেওরটির গম্ভীর বুড়োর মতো ভুল ভাঙানোর গল্প বলেছিল। ও মা গো! এ কী বুড়ো ছেলেরে বাবা।

শাসন বলতে যা বোঝায়, অহল্যার পক্ষে মহিমকে তার প্রয়োজন হয়নি কোনওদিন! তবু মাঝে মাঝে ধমক দিতে হয় বই কী। থাকতে হয় রাগ করে, না খেয়ে, কথা না বলে, যদি শান্ত মহিম কখনও-সখনও বেআদবি করে বসে।

সবই ঠিক ছিল, তবু নিতান্তই অহল্যার বাঁধা বীণার তারে কোথায় যেন কোন্ তারে একটুখানি বেসুর বাসা বেঁধেছিল। কোথায় যেন ছিল ছোট্ট একটি কাঁটা, আর একটুখানি ক্ষত, সেখানে অনুক্ষণ ক্ষতে আর কাঁটার খোঁচাখুঁচিতে অনুদিন রক্ত ঝরে। সে কি অহল্যার এই পঁচিশ বছরের রসে-গন্ধে ভরা, মহান যৌবনের ভারে বলিষ্ঠ দেহবৃক্ষটির মূল ফলহীনা বলে? অহল্যার সন্তানহীনতাই কি সেই হারানো সুর?

কিন্তু সেদিক থেকে সকলেই নির্বাক। ভরতের কোনও অভিযোগ থাকলেও সে আশ্চর্যরকম নীরব এই ব্যাপারে। মহিমের এ চিন্তা কখনও মনে এসেছে কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এ সংসারটির যত সমস্ত চিন্তা-ভাবনা অহল্যার একলার।

অহল্যা মুহূর্ত নিস্তব্ধ থেকে, ভ্রূ কুঁচকে ঠোঁট চেপে খুদে পলাতকদের চেয়ে দেখে। মহিম ইতিমধ্যেই একবার:অহল্যার মুখভাব দেখে নেয়। বউদি যে রেগেছে একথা বুঝতে পেরেই সে কিছু একটা বলবার উদ্যোগ করতেই অহল্যা ধমকে উঠল, থাক্। মাটি কাটা হইছে তোমার?

বড় ভাল মাটি পেয়েছি আজ, জানলে? হাতে নিলে মুখে দিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়।

ত, তাই দেখলেই পারতা!

যেমন চকিতে এল, তেমনি চকিতে দড়াম করে দরজা ঠেলে অহল্যা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল।

এ রাগ অনর্থক নয়, মহিম তা বুঝতে পারে। খুব সম্ভবত তার মাটি কাটার দেরির জন্যই এ রাগ। কিংবা হয়তো ভরত কিছু বলেছে, না হয় তো ঝগড়া করেছে পড়শীদের কারও সঙ্গে। সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যাপারেও এমনি রাগ মাঝে মাঝে করে থাকে অহল্যা।

সে কিছু না বলে বড় ঘরের দাওয়া থেকে খড়মজোড়া আর গামছাখানা নিয়ে বাড়ির পিছনের ডোবায় গিয়ে নামে। তাড়াতাড়ি হাত-পা ধুয়ে, গুটনো কাপড়টা ঠিকঠাক করে একেবারে রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হয়।

নেও, কী হইছে কও। অপরাধজনিত হাসি নিয়ে অহল্যার কাছখানটিতে বসে সে।

কিছুক্ষণ কোনও জবাব দিল না অহল্যা। ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি থেকে হাতায় করে আধসেদ্ধ চাল নিয়ে টিপে টিপে দেখে। দেখে ভাত কটা হাঁড়িতে ফেলে দিয়ে বাঁ হাত দিয়ে কাত করে ঘটি থেকে জল নেয় ডান হাতে। হাত শুদ্ধ করে বড় একটা মানকচুর আধখানা কেটে নিয়ে ফেলে দিল হাঁড়িতে।

হাত চলে, কাচের আর পিতলের চুড়িগুলো টুনটুন করে বাজে। কিছুক্ষণ মহিমও কোনও কথা বলে না। দেখে আর শোনে। নিস্তব্ধ থমথমে মুখখানি অহল্যার ধোঁয়ায় আর আলোতে ঝাপসা। সাবেক নাকছাবিটা চিকচিক করে ওঠে থেকে থেকে। বউদিকে দেখলে মাঝে মাঝে বনলতাকে মনে পড়ে মহিমের। বৈরাগীর মেয়ে বনলতা। তিনটি স্বামীকে সে পর পর হারিয়েছে। লোকে বলে, খেয়েছে। সত্যই তাই, বনলতার সঙ্গে কণ্ঠিবদল করতে ভরসা হয় না কারও বড় একটা। বনলতাও মাঝে মাঝে এমনি কারণে অকারণে মহিমের উপর রাগ প্রকাশ করে থাকে অহল্যার মততা, নিস্তব্ধ থমথমে মুখে। তবে সে হল অন্য কারণে, অন্যরকম।

অহল্যার অভিযোগ তো তাকে শুনতেই হবে। এ যে ঘর, ঘরের ব্যাপার। সম্বন্ধ আলাদা, আলাদা কারণ।

এখানেও আছে মান-অভিমান রাগ-দুঃখ, আছে বন্ধুত্ব। তার সঙ্গে আছে দায়িত্ব, কর্তব্য। বনলতা প্রতিবেশিনী, শৈশবের বন্ধু, একসঙ্গে পাঠশালায় পড়েছে। সেখানকার বন্ধুত্বে দায়িত্ব নেই, কর্তব্য নেই—নেই ভার!

কী করেছি, কও, মহিম অধৈর্যের সঙ্গেই বলে, কিন্তু হাসেও।

অহল্যা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ চোখে একবার মহিমের দিকে তাকায়। তারপর হঠাৎ কেঁজে ওঠে, তোমরা ভেবেছ কী বলল তো! মোরে কি পাগল করে ছাড়বা?

তা কী করেছি, বলবা তো?

বলব? দেখে মনে হয় আরও রেগে উঠেছে অহল্যা, সেই সকালে তোমাকে বলে রাখছি কী যে, ও বেলাতে পাতুর দোকান থে’ মশলাপাত আর তেলটুকুন এনে দিয়ে। তা, খুব তো দিলে?

মহিম প্রকাণ্ড বড় করে জিভ কেটে একেবারে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, ইস, মাইরি বলছি বউদি, একেবারে ভুলে গেছি।

তো ওই রকম ভুলে থাকো। তা হলেই রান্না খাওয়া সব হবেনে।

বলে সে উনুনে আগুন উস্‌কে দিতে দিতে আপনমনে বলে, কে বলবে এ বাড়িতে দুটো পুরুষমানুষ আছে। আজ এরে বলি, কাল ওরে বলি—এটা এনে দাও, ওটা এনে দাও। কেন রে বাপু?

সাংসারিক অভিযোগ যতগুলো আছে, সবগুলো যেন হুড়মুড় করে এখনই মনে আসতে লাগল সব অহল্যার। কদিন ধরে বলছি ডোবাটাতে আর নামা যায় না কোদাল কুপিয়ে ধাপ দুটো কেটে দিয়ো। তো সে কাকে বললাম। যেমন দাদা, তেমনি ভাই। একজন বেরুল, এর পেছনে কাটি দিতে, অমুকের মাথা ফাটাতে, মামলা লড়তে। আর একজন তো ড্যালা মাটির কারবার কেঁদে

বসেছেন।

এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল অহল্যা, তোমরা আর জ্বালিয়ো না বাপু। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যাই, যেদিকে যায় দুচোখ। এক সকালবেলা চেয়েচিন্তে তেল-মশলার কাজ চলল কোনও রকমে। চাইব আর কত মানুষের কাছে। নেও, আর জিভ বের করে মা কালীর মতো

পেছন ফিরে হঠাৎ থেমে গেল। ওমা, কাকে বলছে সে এত কথা। যাকে বলা, সে কোন্ ক্ষণে বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ কেমন মায়া লাগে, হাসিমিশ্রিত করুণায় বুকটার মধ্যে নিশ্বাস একটু ভারী হয়ে উঠল তার। আহা, অমন করে না বললেই হত। সেই জিভ কেটে লাফিয়ে ওঠা দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল, মানুষটা ভুলে গিয়েছিল। আপনভোলা গোবিন্দ একেবারে।

কিন্তু রাগ না করে, না বিরক্ত হয়েই কি উপায় আছে অহল্যার। অত ভুলোকে নিয়ে তো সংসার। চলে না। একজন যদি ভুলো হয়েছে আর একজন হয়েছে নষ্টামোর মহারাজা। মহিমকে তবু দুটো কথা বলা চলে, ভরতকে মুখের কথা বললে সে এক কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে তুলবে। তবে সংসারে পুরুষ মানুষের কাজগুলো করবে কে? আপসে আপসে চলবে না তো। ডোবার ধার কেটে না হয় অহল্যাই নিয়েছে, নেয় না হয় ছোটখাটো এদিক ওদিককার দু-চারটে কাজ চালিয়ে কোনও রকমে করে কম্মে। তা বলে পাতুর দোকানে ওই মিনসের মেলায় তো পারে না অহল্যা সওদা আনতে যেতে। যেতে অবশ্য কোনও বাধা নেই, যেয়ে থাকে তাদের ঘরের কত বউ-ঝি বাজারে দোকানে হামেশাই। কিন্তু ভরত সেদিক থেকে ভদ্দরলোক হয়েছে। মেয়েমানুষের আব্রু রাখতে শিখেছে সে। শিখেছে তার বাপের কাছ থেকেই। অবস্থাবিশেষে যে একদিন মহাজন সেজে বসেছিল গাঁয়ে। যা, কামিয়েছিল ভাল ভরতের বাপ দশরথ। কিন্তু রেখে তো যেতে পারেনি কিছুই, কিছু পরিমাণ জমি ছাড়া। কিন্তু ওই জমির সঙ্গেই দশরথ রেখে গেছে এই আবরুটুকু বামুন কায়েতদের মতো, আর জাতছাড়া সৃষ্টিছাড়া যত ফষ্টিনষ্টি।

কই গো, মহিম বাড়ি আছ নাকি?

বাড়ির সামনে দেবদারু গাছের অন্ধকার তলাটা থেকে মোটা ভারী গলায় ডাক শোনা গেল। গলাটা পরিচিত, কিন্তু মানুষটাকে চিনল না অহল্যা। জবাব না দিয়ে সে চুপ করে রইল। উদ্দেশ্য, সাড়া না পেয়ে ফিরে যায় যাক। কিন্তু আবার বলল লোকটা এবার দু-চার পা এগিয়ে এসে। ঘরে আলো রইছে দেখছি। বাড়ির লোকজন গেল কই?

কেন, কে তুমি? কেরোসিনের ল্যাম্পটা নিয়ে এবার অহল্যা রান্নাঘরের দরজাটার সামনে দাঁড়ায়।

মহিম আছে?

ল্যাম্পের আলোয় অহল্যা লোকটাকে ভাল করে চিনতে পারল না। বলল, না।

আমি বাবুদের বাড়ি থে আসছি। মহিম এলে পরে বাবুদের সঙ্গে একটু দেখা করতে বলল, বুঝলে? লোকটা কথা শেষ করে চলে যাওয়ার পরিবর্তে আরও দুপা এগিয়ে এল।

বাবুদের বাড়ি মানে, জমিদারের বাড়ি। সেখানকার এ আকস্মিক ডাকে চকিতে মনটা উৎকণ্ঠায় ভরে গেল অহল্যার।

কী জানি, কী গোলমাল বাধিয়ে এসেছে হয়তো আবার।

লোকটা হঠাৎ দ্রুত আরও কয়েক পা এসে হেসে বলল, কে, ভরতের বউ নাকি?

অহল্যা একটু চমকে উঠল। ভাল করে আলো ধরে লোকটার মুখ চিনে এবার হাসল, কে, পরানদাদা? আমি বলি—কে না জানি। তা ঠাকুরপোরে ডাকল যে হঠাৎ তোমাদের বাবু?

হাত উলটে বলল পরান, কী জানি, কী পিতিমে না কী করবে বুঝি তাই।

এমন সময় মহিমও এল পাতুর দোকান থেকে সওদাপত্র নিয়ে। বলল, কী হয়েছে পরানদা?

তোমার ডাক পড়েছে ভাই, একবার বাবুর সঙ্গে দেখা করে এসোগে।

পরান চাকর, ছোট জাত, কিন্তু বড় মিষ্টি তার স্বভাব। জাতে বাগদী হলেও আজীবন বাবুদের বাড়িতে থেকে বাবুদের মতোই তার মোলায়েম কথাবার্তা। তা ছাড়া, বাবুরা যখন কলকাতায় গিয়ে বসবাস করে, পরানও বরাবর তাদের সঙ্গী হয়।

আমার যে আবার একটু অন্য জায়গায় দরকার ছিল। ক্ষণিক দোমনা করে আবার বলল, আচ্ছা চলো দেখি, ঘুরে আসি একটু।

রাতটুকুন পুইয়ে এসো না যেন। পিছন থেকে কথাটা ছুড়ে দেয় অহল্যা মহিমের প্রতি।

মহিম বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আসি তো আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *