ঘর

ঘর

চারটি ভাই এবং তাদের বউ-ছেলে-মেয়েরা থাকতেও অমলা জানে পৃথিবীতে তার একটি মাত্র ভরসা অন্ধ বুড়ি মা-টি। ছাদের এই ঘরটিতে সে থাকতে পারছে যেহেতু মাকে দেখাশোনা করার আগ্রহ কারুর নেই; এবং মা বলেই বারান্দায় ফেলে না রেখে আস্ত একটি ঘরে থাকতে দিয়েছে। ছোটোভাই কমলের আজও বিয়ে হয়নি, কারণ আলাদা কোনো ঘর নেই। মা মারা গেলে অর্থাৎ তিন-তলার ঘরটি খালি হলে তার বিয়ের উদ্যোগ করা হবে। মেজোবউয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া একটি মেয়েকে পছন্দ করে রাখা হয়েছে।

সিঁড়িতে পিছলে পড়ে মা যেদিন মাথায় চোট পেল সেদিন থেকেই অমলার ভাবনামা তো আর বাঁচবে না, তাহলে কী হবে? একদিন পনেরো টাকার টিউশনিতে যাবার পথে এই কথা ভাবতে ভাবতেই সে হাজির হল প্রভাসের বাড়ি।

প্রভাস মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছিল, অমলাকে দেখে অবাক হল; কেননা গত চব্বিশ বছরের মধ্যে অর্থাৎ প্রভাসের বিয়ে হওয়ার পর পাঁচ-ছ বারের বেশি তাদের সাক্ষাৎ ঘটেনি। মক্কেলটি বিদায় নিতেই অমলা গম্ভীর হয়ে বলল, একটা ব্যাপারে পরামর্শ নিতে এলুম।

প্রভাস তার পেশাগত গাম্ভীর্য মুখে ছড়িয়ে তাকিয়ে রইল।

মা-র অবস্থা তো গত কয়েক মাস থেকেই সুবিধের নয়। মারা গেলে আমি কী করব?

কী করব মানে?

আমার ভাইদের তো জান, তখন আমি কোথায় দাঁড়াব? ঘর জুড়ে থেকে কমলের বিয়ে বন্ধ করে আছি, ওর বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। মেজো বউ আমাকে দেখতে পারে না, অথচ মেজদাই সংসারের বড়ো খুঁটি। বড়দা আর সুবল কোনোক্রমে দিন চালায়। মা আছে। তাই আমিও আছি, কিন্তু মা বেশিদিন আর বাঁচবে না।

মোটা পেনসিলটা টেবলে ঠুকতে ঠুকতে প্রভাস পেশাদারি পরামর্শ দিল–তোমার উচিত খোরপোশ দাবি করে মামলা করা, বহুদিন আগেই অবশ্য করা উচিত ছিল।

কিন্তু স্বামী তো আমায় ত্যাগ করেনি, আমিই চলে এসেছিলাম।

শুনেছি আবার বিয়ে করেছে। তোমায় যখন ডিভোর্স করেনি তাহলে আইনের চোখে সে বিয়ে অবৈধ, তুমিই তার বৈধ স্ত্রী। আর কে কাকে ত্যাগ করেছে সে নয় উঁকি লে বুঝবে, মোটকথা তোমার ভরণপোষণে সে এখনও বাধ্য।

অমলা ঘাড় হেঁট করে চিন্তা শুরু করল। প্রভাস নাগাড়ে ঠক ঠক করে যাচ্ছে। দেমাক দেখিয়ে যার কাছ থেকে চলে এসেছে এই বাইশ বছর পর তার কাছেই হাত পাততে হবে এটা ভাবতে অমলার অস্বস্তি হচ্ছে। অন্য কিছু উপায়ে যদি একটা ব্যবস্থা করা যায়…

কী, রাজি নও? ভারী গলায় প্রভাস জানতে চাইল।

তাই তো ভাবছি।

পরিহাস করে প্রভাস বলল, মামলা-টামলা না হলে উকিলদেরই-বা চলে কী করে? দু চারটে ফি তো খাব।

অমলা হেসে বলল, মামলা করার টাকা কোথায়? ওটা তোমাকেই দিতে হবে।

গম্ভীর হল প্রভাস, পেশাগত গাম্ভীর্যটা আবার মুখে লাগিয়ে বলল, আগে তুমি বরং দেখা করো। কী বলে শোনো, যদি কিছু করতে রাজি না হয় তখন মামলার কথা ভাবা যাবে। ও কোথায় থাকে তা জান তো?

বাড়ি জানি না, ভাড়াবাড়িতে থাকে। তবে দোকানটা জানি। মনোহারী দোকান

বাগবাজারে।

তাহলে আগে সেখানে গিয়েই দেখা করে কথা বলল।

অমলার মনে হল তার থেকে বরং মামলা করাই ভালো। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আমাকে খেতে-পরতে দাও বলার মতো লজ্জা আর কী থাকতে পারে। কিন্তু মামলার খরচ কে দেবে?

মামলার খরচ তুমিই দাও-না। অমলার অজান্তে স্বরটা কাকুতির মতো শোনাল।

আমার ফি নয় ছেড়ে দিলুম, কিন্তু কোর্ট খরচ তো আছে।

আশ্চর্য! হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল অমলা, আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? আর কয়েকটা টাকার জন্য সাহায্য করবে না?

প্রভাস এমনভাবে তাকাল যেন শেখানো সাক্ষীটি বক্সে উঠে উলটো কথা বলছে। কে দায়ী, আমি?

তোমার চিঠিগুলোই তো সর্বনাশ করে ওর হাতে পড়ে।

সে তো আর তোমায় তাড়িয়ে দেয়নি। এই তো বললে—নিজেই চলে এসেছি।

হ্যাঁ, তোমার ওপর ভরসা করেই চলে এসেছিলুম।

আমি তো তোমায় চলে আসতে বলিনি, কোনো চিঠিতে কি সেরকম কথা ছিল? বোকামি করেছ যেমন তার ফল তো ভোগ করবেই।

অমলা থিতিয়ে গেল। প্রভাসের মুখে বিরক্তি, অস্বস্তি। শীতকালেও কপালে ঘাম ফুটল, দুটো কাঠি ভেঙে সিগারেট ধরাল।

চিঠিগুলো কি তোমার স্বামী রেখে দিয়েছে?

না।

কী বলেছিল? শুধু বলেছিল, একেই কেন বিয়ে করলে না। ওকে বলিনি যে তুমি আগেই বিয়ে করেছ, বড়োলোকের একমাত্র মেয়েকে।

তাতে কী হয়েছে, প্রভাস জবরদস্ত সাক্ষীর মতো রোখা সুরে বলল, তোমার কি হিংসে হচ্ছে? লীলার বাবা না হলে কি ওকালতিতে দাঁড়াতে পারতাম?

আমি ওসব ভেবে বলিনি, তুমি চটছ কেন? অমলা টেবলে কনুই রেখে ঝুঁকে পড়ল।

গলার স্বর দ্রুত নামিয়ে প্রভাস সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, চটেছি কে বলল? বয়েস পঞ্চাশ পেরোল, এসব ব্যাপার নিয়ে চটাচটি করার ইচ্ছেও হয় না। অল্প বয়সে ছেলে মেয়েতে মেলামেশা হয়, বিয়ে-থা করে সেসব ভুলে যায়। তুমিই-বা ভুলে যাওনি কেন?

আমি পারিনি প্রভাস, আমি পারিনি।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল অমলা।

থামো। প্রবাস রূঢ় ধমক দিল, কান্নাকাটি কোরো না। মনে রেখো, আমার স্ত্রী, ছেলে মেয়েরা এ বাড়িতে রয়েছে। তোমার মামলা আমি করে দেব, একটি পয়সাও লাগবে না, এখন এসো।

কান্নার যে-ইচ্ছেটা অমলাকে পেয়ে বসেছিল, তা প্রভাসের দ্রুত একটানা কথাতে মুছে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলল, যা সব লিখেছিলে তার সব মিথ্যে ছিল?

কী যেন বলতে গিয়ে প্রভাস থেমে গেল। টেবলে গ্লাসভরা জল রয়েছে। এক চুমুকে শেষ করে গ্লাস হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, মুখে মাথায় জল দিয়ে ফিরল।

আমি যাচ্ছি, অমলা উঠে দাঁড়াল। প্রভাস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমার কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা সব কিছুরই একটা ছক তৈরি হয়ে গেছে অমু, তা ভেঙে বেরোনোর সাধ্য এখন আর আমার নেই। আমি সুখে আছি, আমায় তাই থাকতে দাও, আমায় কিছু মনে করতে বোলো না।

অমলা নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল, প্রভাসের কেশবিরল মাথাটা নুয়ে পড়ল টেবিলের উপর। ঘর থেকে বেরিয়ে যখন সে সদর দরজায় পৌঁছেছে, তখন ছুটে এল প্রভাস।

তোমায় আমি বরং মাসে মাসে কিছু দিয়ে সাহায্য করব, মামলা করে দরকার নেই।

অমলার মনে হল প্রভাস যেন প্রায়শ্চিত্ত করতেই কথাটা বলল। ওর ভঙ্গিতেও অপরাধী অনুকরণ। দেখে মায়া হয়, সংসার নিয়ে যেমন আছে থাকুক।

তার দরকার নেই। মনে হবে তোমায় ভয় দেখিয়ে আদায় করেছি।

অমলা আর দাঁড়াল না। বোকামি করেছি কি? আনমনে ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির দিকে চলল। মায়া হয়। প্রভাস এখনও বুকে মোচড় দেয়, ও এখনও অমানুষ হয়ে যায়নি। এর থেকে বেশি আর কী চাইবার আছে? এ বয়সে এ জেনেই সুখ। কিন্তু আমি কী করব এখন? শেষে কি ভিখিরির মতো হাত পেতে খোরপোশ নিতে হবে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতে যাচ্ছে, এখন আর কোনোরকমে বোকামি করা চলবে না। প্রভাসের প্রস্তাবটা এক কথায় নাকচ করাটা বোধ হয় ঠিক হল না।

রাস্তা পার হবার জন্যে সে দাঁড়িয়েছে, পিছন থেকে দিদিমণি বলে সরস্বতীবালা ডাক দিল! অমলাদের বাড়িতে কাজ করত, মেজোবউ মাস তিনেক আগে হঠাৎ ছাড়িয়ে দেয়।

দিদিমণি বাড়ি যাচ্ছ নাকি, চলো আমিও যাব।

কেন গো?

হেস্তনেস্ত করব একটা, নয়তো আত্মঘাতী হব। দ্যাখো ছোটোবাবু কী সর্বনাশ করেছে আমার। সরস্বতীবালা দেহের সামনে থেকে আঁচল সরাল।

কদ্দিন! অমলা আঁতকে উঠল।

চার মাস। এখন আমি কী করব বললা তো, ললাকে সন্দেহ শুরু করেছে। ছোটোবাবু বলেছিল আলাদা ঘর ভাড়া নিয়ে আমায় রাখবে।

চোখে জল নিয়ে কথা শুরু করে গনগনে রাগে শেষ করল সে। অমলা সিঁটিয়ে গেল কেলেঙ্কারির কথা ভেবে।

আমার একটু কাজ আছে সরস্বতী, আমি যাই।

বলেই অমলা হাঁটতে শুরু করল। ব্যাপারটা জানাজানি হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? কমল যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করুক ওর। এসব মেয়েমানুষরা তো টাকা পেলেই খুশি। তবে কমল টাকা পাবে কোত্থেকে? তা যদি থাকত আলাদা বাসা করে বিয়েই করতে পারত। এখন যদি এই ঝিটাকেই বিয়ে করে বসে!

হাঁটতে হাঁটতে অমলা বাগবাজারের দিকে চলে এসেছে। আর কিছুটা গেলেই প্রফুল্লর দোকান। আজকেই কথা বলে দেখি, মানসম্মান নিয়ে বসে থাকলে এ বয়সে চলে না। তেজ দেখাবার বয়স চলে গেছে, লজ্জা কীসের, বিয়ে তো হয়েছিল, এই ভেবে অমলা দোকানের সামনে দাঁড়াল।

খদ্দের ভেবে এগিয়ে এসে প্রফুল্ল কাউন্টারে ঝুঁকে বলল, বলুন।

বাইশ বছর দেখেনি, সুতরাং পরিচয় না দিলে চিনতে পারবে না। নিজের নাম বলতে অমলার সংকোচ হল।

কিছু কিনতে আসিনি। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে সে বলল।

চশমার পুরু কাচের পিছনে প্রফুল্লের দুটি চোখ বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে, হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। দোকানের আলো মলিন। সামগ্রীগুলোও মলিন। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে অমলার যাবতীয় উত্তেজনা স্বাভাবিক হয়ে গেল।

তাহলে কী চাই?

স্বরে গাম্ভীর্য পরিমাপ করে অমলা বুঝল, চিনতে পেরেছে।

কথা ছিল।

প্রফুল্ল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ডান গালের আঁচিলটার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেনি, গোঁফটা আগের থেকেও মোটা, জামার কলারে ময়লা, নখগুলো বড়ো, চামড়া খসখসে। এইসব জিনিস অমলাকে একদা বিরক্ত করেছিল। এখন সে তাই বোধ করল।

আমার সম্বন্ধে কী ভেবেছ? স্পষ্ট করে উচ্চারণের জন্য অমলা কেটে কেটে বলল।

আমার তো ভাবার কথা নয়।

স্ত্রীর সম্পর্কে স্বামী ভাববে, এটাই তো নিয়ম।

স্ত্রীরও তো নিয়ম মানার অনেক কিছু আছে। তা ছাড়া তুমি যে আমার স্ত্রী, কে বলল?

আইন।

ওঃ, আইন দেখাতে এসেছ! বোধ হয় তার কাছ থেকেই তালিম পেয়েছ?

ঝগড়া করার জন্য প্রফুল্লর অবয়ব প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। অমলা ধীরকণ্ঠে বলল, তার কাছ থেকে তালিম পেলে এখানে না এসে কোর্টেই যেতাম।

প্রফুল্ল থতমতো খেল। বিচলিত হয়েছে বোঝা গেল হঠাৎ ঝাড়ন নিয়ে প্লাসটিক ব্যাগগুলো ঝাড়ার বহর দেখে। এই সময় এক খদ্দের এল পাঁউরুটি কিনতে। অমলা একধারে। সরে দাঁড়াল। যাবার সময় লোকটি অভিযোগ করল, কালকের রুটি শক্ত বাসি ছিল।

কোম্পানি যেমন দেয়, আমি কী করব বলুন?

কোম্পানিকে জানান।

লোকটি চলে যেতেই অমলা বলল, তাহলে কী? ভাইদের সংসারে আছি। তাদের অবস্থা এমন কিছু ভালো নয়। এই বয়সে রোজগারই-বা কী করব? শাড়ি-গয়না চাই না, খাইখরচের টাকাটা তো দেবে।

কেন, আর কেউ কি দেবার নেই?

আর কেউ মানে?

প্রফুল্ল চুপ করে রইল। অমলা কাউন্টারে চাপড় দিয়ে বলল, তোমাকে দিতে হবে।

যদি না দিই?

তাহলে মামলা করে আদায় করব।

যদি বলি তুমি স্বেচ্ছায় গেছ, আমি বরাবরই তোমাকে কাছে রাখতে রাজি ছিলাম, এখনও আছি।

বলব মিথ্যাকথা। বলব প্রমাণ করো যে আমি স্বেচ্ছায় চলে গেছি। বলব, আর একটা বিয়ে করার জন্য আমায় তাড়িয়ে দিয়েছ; বলব, এখনও আমি তোমার কাছে যেতে চাই।

এ সবই তো মিথ্যাকথা। তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য কি তোমাদের বাড়ি আমি যাইনি? কী বলেছিলে মনে আছে কি? —যখন দরকার বুঝব যাব। দু-বছর অপেক্ষা করে তবেই বিয়ে করি। সেই চিঠিগুলো যদি তোমায় ফেরত না দিতাম, তাহলে কি বলতে পারতে প্রমাণ করার কথা?

চিঠিগুলো রাখনি কেন?

বোকামি করেছি।

খদ্দের ঢুকতেই প্রফুল্ল থেমে গেল। জুতোর ক্রিম চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে নেই বলে দিয়ে কাউন্টারের ডালা খুলে সে বেরোল। দোকানের দরজার পাল্লা বন্ধ করে মাত্র একটুখানি খুলে রাখল।

দাঁড়িয়ে কেন, এই টুলটায় বসো।

অমলা বসল, কী কাজে লাগবে ভেবেছিলে?

প্রফুল্ল কাউন্টারে কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, অন্তত ওগুলো দিয়ে বাধ্য করতে পারতে তোমাকে বিয়ে করতে।

আমার তো বিয়ে হয়ে গেছল। ওরও হয়ে গেছল। ওসব চিন্তা আমি করিনি, করে লাভ হত না।

তোমার না হোক আমার তো হত। তাহলে খোরপোশের কথা আজ উঠত না। এই তো দোকান দেখছ, মাসে কতই-বা রোজগার, বড়োজোর শ-দুই টাকা। এর থেকে চল্লিশ কা করে যদি দিতে হয়, তাহলে আমার সংসার অচল হয়ে পড়বে। তা ছাড়া এখন যদি বলি তোমাকে নিতে রাজি আছি, আসবে তুমি? পারবে আমার সংসারে থাকতে?

প্রফুল্ল চোখ সরিয়ে গণেশমূর্তিটার উপর রাখল। অমলা ইতস্তত করে কোনোক্রমে বলল, ছেলে-মেয়ে ক-টি?

বড়োটি মেয়ে, আঠারোয় পড়ল। সম্বন্ধ করছি, তবে সকলেরই খাঁই বেশি। পরে চার ছেলে, সবাই পড়ছে। এই আয়ে চালাতে পারি না অমলা। ভিখিরিরও অধম হয়ে থাকি। করুণভাবে প্রফুল্ল তাকিয়ে রইল। অমলা বাধ্য হল অন্যত্র তাকাতে।

ওরা কি আমার কথা জানে?

জানে।

কী বলে?

তোমায় নিয়ে কোনো আলোচনাই হয় না।

আর কেউ কিছু বলে না?

গীতা তোমায় শুধু এক বার দেখতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলুম কিনা তুমি ওর থেকেও সুন্দরী।

অমলা উঠে দাঁড়াল। প্রফুল্ল ধড়মড়িয়ে সিধে হয়ে বলল, চললে?

হ্যাঁ।

তুমি কী করবে?

কী আর করব, আমাকে তো বাঁচতে হবে। তোমরা সবাই বলছ বোকামি করেছি। এখন মনে হচ্ছে সত্যি তাই করেছি।

তুমি দাবি করবে? তা অবশ্য পারো। কিন্তু সেটা ফাঁকি দিয়ে ঠকিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না। কী করেছ স্ত্রী হিসাবে, যেজন্য দাবি জানাতে পার?

ফ্যাকাশে মুখে শুনে যাচ্ছিল অমলা, প্রফুল্লের ভাবভঙ্গিতে ভয় পেল। হয়তো ঝাঁপিয়ে গলা টিপে ধরতে পারে। দরজার দিকে এগোতেই প্রফুল্ল দরজা আগলে দাঁড়াল।

যেতে দাও। নইলে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব।

অমলা, আমার সংসারের এই সামান্য আয়ে ভাগ বসিয়ো না। জোড়হাতে মিনতি করছি, ছা-পোষা মানুষ আমি!

তাহলে আমি কী করে বাঁচব! এই বলে ধাক্কা দিয়ে প্রফুল্লকে সরিয়ে অমলা রাস্তায় নেমে এল। ওর সঙ্গে যাবার জন্য কয়েক পা এগিয়ে, দোকান খোলা আছে খেয়াল হতেই প্রফুল্ল দাঁড়িয়ে পড়ল। অমলা ঊর্ধ্বশ্বাসে হেঁটে শীঘ্র দূরে চলে যেতে যেতে ভাবল, এমন একটা জায়গা কি কোথাও নেই, যেখানে মাথা কুটে রক্তারক্তি করা যায়।

বাড়ি ফিরে অমলা নিঃসাড়ে দোতলায় উঠল। মেজোবউয়ের ঘরের দরজায় তালা, বোধ হয় সিনেমা দেখতে গেছে। বড়োবউ দালানে বাচ্চার দুধ গরম করছে। ফিসফিস করে অমলা জিজ্ঞাসা করল, কেউ এসেছিল?

কে আবার আসবে। বড়োবউ কাজে মন দিল। অমলা তিন-তলার সিঁড়ি ধরল। যেখানে বাঁক নিয়েছে সিঁড়িটা, একফালি চাতাল বেরিয়ে গেছে। কমল তার ক্যাম্প-খাটে শুয়ে আছে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। ওর পাশ দিয়ে পা টিপে অমলা উপরে উঠে গেল।

মাঝরাতে অমলার মনে হল সিঁড়িতে কী-যেন একটা হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে পা টিপে সিঁড়ির মাথায় এসে উঁকি দিল। অন্ধকারটা চোখে সয়ে যাবার পর বুঝল, উঁচুমতো কিছু একটার উপর দাঁড়িয়ে একটা ছায়ামূৰ্তি কড়িকাঠে কিছু-একটা বাঁধছে। কমলকে ধমক দেবার জন্য নিশ্বাস টেনে এবং ওকে ব্যাঘাত না করে বিছানায় ফিরে এসে অমলা সেই নিশ্বাস ত্যাগ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *