উৎসবের ছায়ায়

উৎসবের ছায়ায়

সানাই বসেছে, আবার লাউডস্পিকারও। গোটা পাড়াটাই গমগম করছে। কাল দুপুরে যখন বর-বউ এল তখনই সানাই, বিকালে রেকর্ড। আজ সকালে সানাই, দুপুরে রেকর্ড। সারি সারি চেয়ার রাস্তার দু-ধারে। পথ-চলতি মানুষরা সসংকোচে চেয়ার বাঁচিয়ে টুক করে জায়গাটা পার হয়ে যাচ্ছে। এঁটো পাতার বালতি নিয়ে দুটি ঝি বাড়ি থেকে বেরোতেই চেয়ারের মানুষরা নড়েচড়ে বসল। এক ব্যাচ শেষ হল। খুরি গেলাস ফেলার শব্দ পাশের নন্দী বাড়িতে পৌঁছোতেই কতক–গুলো মানুষ বেরিয়ে এসে চেয়ারে বসল।

ভূতের মতো মানুষগুলো উবু হয়ে এঁটো পাতা গেলাসের মধ্য থেকে খাবার বাছছে। উবু হয়ে ঘাড় নামিয়ে মঞ্জু তাই দেখছিল। ওদের জানলার নাকের তলাতেই আঁস্তাকুড়টা। দেখতে দেখতে মঞ্জু দাঁড়িয়ে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে খুব আস্তে ডাকল—মা।

কণিকা ঘরের ঠিক বাইরের রকটাতেই রাঁধছিল, ডাক শুনে সাড়া দিল মাত্র।

মা, আস্ত আস্ত ছ-টা সন্দেশ।

আচ্ছা আর গুনতে হবে না।

মঞ্জু আর বসল না। দাঁড়িয়েই সে গরাদের ফাঁকে ঠোঁট আর নাকটুকু বার করে দিল। আস্তাকুঁড় থেকে বিয়েবাড়ির গন্ধ আসছে। এ পাড়ায় তারা নতুন এসেছে তাই নেমন্তন্ন হয়নি। সামনের বাড়ির মেয়েরা এখনও সাজছে। হান্টিদি আজ সকালেও ফ্রক পরেছিল, শান্টিদি বিকেলের খোঁপাটা বদলেছে। ওদের সঙ্গে সান্যালদের খুব ভাব। বিয়েবাড়ির ঝি আবার দু বালতি এঁটো ফেলে গেল। ভূতগুলো মাথা নুইয়ে খাবার খুঁজছে।

মা, দেখে যাও কত ফেলে দিয়েছে।

ওদিকে থেকে সাড়া এল না। তাতে কিছু এসে যায় না মঞ্জুর। নাক ফুলিয়ে খুব আস্তে আস্তে নিশ্বাস টানল।

বেড়িয়ে ফিরল কিরণ, অঞ্জু আর রঞ্জ। আর জানলার কাছে মঞ্জুর বসে থাকার উপায় নেই। ওদের নিয়ে এখন খেলতে হবে, নয়তো রান্নার কাছে গিয়ে বিরক্ত করবে।

ঘরের আলো জ্বালল কিরণ। স্কুল ফাইনাল পাস করে মামার কাছে এসেছে। মন্মথ চেষ্টা করছে একটা কাজ ওকে জুটিয়ে দিতে। ডিপো ম্যানেজারকে বলা আছে। সময় হলেই অ্যাপ্রেন্টিস করে ঢুকিয়ে দেবে।

ঘরের আলো নিবিয়ে কিরণ বেরিয়ে গেল। মঞ্জু, অঞ্জু, রঞ্জু অন্ধকারে বসে রইল। আলো জ্বালালে মিটার খরচ বেশি হয়। কণিকা লক্ষ জ্বালিয়ে রান্না করে। জানলার কাছে গুটিগুটি ওরা তিন ভাই-বোন দাঁড়াল। শুধু একটা লোক তখনও খাবার খুঁজছে। আর সবাই দূরে রাস্তার আলোয় নিজের নিজের পুটলি গোছাচ্ছে। রান্না হয়ে গেছে কণিকার। হেঁশেল ঘরে ঢুকল। অন্য দিনের মতো বাচ্চারা হুটোপাটি করেনি তাই সে অবাক ছিল রান্নার সময়, আলো জ্বেলেই দেখল তিন জন জানলায় ঠাসাঠাসি করে রয়েছে। ওদের ওপর দিয়ে উঁকি দিল কণিকা।

কী করছ এই নোংরার সামনে বসে?

দেখছি তো।

দেখার কী আছে, আঁস্তাকুড় কখনো দেখনি?

মা দিদি বলছিল অনেক সন্দেশ ফেলে দিয়েছে। ওখানে আছে। দোষটা আসলে তার নয়, অঞ্জু এই কথাটাই বোঝাতে চাইল। মা বুঝেছে কি না এই কথাটা জানতে তিন জোড়া চোখ কণিকার মুখে বিঁধে রইল। কী বুঝল কণিকা, আলোটা নিভিয়ে জানলার ধারে দাঁড়াল, মাথাটা হেলিয়ে কোনোরকমে এক চোখ দিয়ে সান্যাল বাড়ির দরজা পর্যন্ত দেখা যায়। কণিকা দেখতে লাগল।

ঘাঁটতে ঘাঁটতে লোকটা খাবার মুখে পুরছিল। হঠাৎ হেঁচকি তুলতে শুরু করল।

কণিকা সেই একভাবে এক চোখ দিয়ে দেখছে। হঠাৎ সে বলল, হ্যাঁ রে মঞ্জু, ওই মেয়েটা বাসে করে ইশকুল যায়?

মঞ্জু ঘাড় কাত করে কণিকার মতো এক চোখ দিয়ে দেখল।

হ্যাঁ, ও টিনাদি।

আর ওর পাশেরটা?

দেখতে পাচ্ছি না।

কণিকা মঞ্জুকে আর একটু জায়গা ছেড়ে দিল।

ও তো বাসু, হেঁটে ইশকুল যায়।

দ্যাখ দ্যাখ ওই কোলের ছেলেটাকে।

নিমন্ত্রিত কয়েক জন মহিলাদের একজনের কোলে বাচ্চা। মাস ছয়েক বয়স।

ঠিক ওইরকম একটা ফ্রক বড়োমামি তোকে দিয়েছিল, ঠিক ওই রকম রং। কবে মা?

তোর ভাতের সময়।

রঞ্জু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সানাই বেজে উঠল, ওরা চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরেই রঞ্জু বলল, ওই লোকটাকে ঠিক বাবার মতো দেখতে।

কোনটা?

ওই যে সিগারেট খাচ্ছে।

দূর, ও তো মোটা আর পাঞ্জাবি পরেছে।

মঞ্জুর কথা শেষ হতেই কণিকা বলল, তোদের শম্বুকাকার বিয়েতে তোর বাবা বরযাত্রী গেছল। পাঁচ-ছটা সিগারেট এনেছিল।

তুমি গেছলে?

ওরা তিন জনে মুখ তুলে তাকাল।

মা তুমি নেমন্তন্ন খেয়েছ?

তিন জোড়া চোখ বিধে আছে। কণিকা জবাব দিল না। ওরা একসময় চোখ সরিয়ে নিল।

মঞ্জুর ভাতে অনেকে আমাদের বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে।

আবার তিনটে মাথা ঘুরে গেল। গরাদে নাক চেপে কণিকা হাসল, ওরা তা দেখতে পেল না।

দুটো রসুই বামুন ভাড়া করা হয়েছিল। রাসবিহারীবাবুদের ছাদে লোক খেয়েছিল। এমনি রাস্তার দু-ধারে চেয়ার পেতে লোক বসেছিল কত যে খাবার ফেলা গেছল।

রেখে দিলে না কেন? পরের দিন খেতে।

অনেক বেঁচেছিল। বিষ্ণুদের বাড়ি, হরিঠাকুরঝিদের বাড়ি, তোর বাবার বন্ধুদের বাড়ি খাবার পাঠানো হয়েছিল।

সান্যাল বাড়ি থেকে একসঙ্গে অনেকে বেরোচ্ছে, কণিকা তাড়াতাড়ি গরাদের ফাঁকে চোখ রাখল। বোধ হয় মেয়ের বাড়ির লোক, বর নিজে এগিয়ে দিতে এসেছে।

মা, আর ভাত হবে না আমাদের বাড়ি?

মা, মঞ্জু কি বোকা দ্যাখো, বড়ো হয়ে গেলে আবার ভাত হয় নাকি?

হঠাৎ জানলা থেকে সরে গেল কণিকা। মন্মথ আসছে।

কলঘর বাড়িওয়ালার এক্তিয়ারে। বাড়িওয়ালার বউ খুঁচিবেয়ে, পাইখানা যেতে গিয়ে মন্মথ এক ফোঁটাও জল পেল না। অশ্রাব্য দু-একটা গাল শুরু করেছিল মন্মথ। কণিকা তাড়াতাড়ি খাবার জলের কলসি থেকে ঢেলে দিল। মন্মথ এলেই ভাত বেড়ে দেবে। ছেলে-মেয়েরাও বসবে ওর সঙ্গে। যাওয়ার সময়কার বিরক্তিটুকু সঙ্গে নিয়ে মন্মথ ফিরে এল। চানের জল নেই। গামছা ভিজিয়ে বুকে-পিঠে জোরে জোরে ঘষল।

টিউকলে যাও-না।

কল টিপবে কে? কিরণ কোথা?

ও তো বেরিয়েছে, সেই খাওয়ায় সময় আসবে। ভালো কথা, ও শোবে কোথা? রকে তো আজ শুতে পারবে না।

শোবে আমার মাথায়।

ঝড়াৎ করে বালতিটা তুলে নিল মন্মথ। মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বলল, আয়। বলেই মন্মথ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।

দাঁড়িয়ে আছিস যে?

যেন ঘুম ভাঙল মঞ্জুর। দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়েই ফিরে এল। লাল টুকটুকে রবারের চটিটা পরে সান্যাল বাড়ির সামনে দিয়ে গুটিগুটি করে ও টিউবওয়েলে পৌঁছোল। মন্মথ বালতি হাতে দাঁড়িয়ে। ওর আগে এসেছে মিষ্টির দোকানের অমূল্যচরণ। কলে বাসন মাজছে টিনের বাড়ির এক বউ। মন্মথকে দেখে বগল চুলকে অমূল্য হাসল।

এয়েচেন।

হুঁ।

ঠক করে বালতি রাখল মন্মথ। বউটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখে আবার মাজতে লাগল।

একটু তাড়াতাড়ি করো গো। তারপর মন্মথবাবু খবর কী?

খবর আর কী, পাপের ভোগ বয়ে যাচ্ছি। চালের কন্ট্রোল তুলে কই দাম তত কমল না। আজ তো বারো আনা দে কিনলুম। দেশে চালের মন সাঁইত্রিশে, তাল খাচ্ছে মানুষে। তোমার আর কী; ছোটো সংসার, দোকানও চলছে ভালো, ছেলেপুলের ঝামেলা নেই।

ভালো আর চলছে কই।

কলে পাম্প করছে বউটি। অমূল্য অন্যমনস্ক হল আবার। মন্মথও দেখছে। কতভাবে কত বারই তো কণিকার পিঠ বগল সে দেখেছে। কই মনের মধ্যে তো এমনটি হয় না।

চাল তুমি কোথেকে কেন?

শ-বাজারে সুধীর সাহার দোকান থেকে। পাড়ার দোকান, ধারেও পাওয়া যায়।

আপনাদের এক সুবিধে, মাস গেলেই বাঁধা মাইনের টাকা। বাসেও টিকিট কাটতে হয় না। সুমুন্ধিটাকে কণ্ডাক্টর-মণ্ডাক্টর করে ঢুকিয়ে দিন-না। দু-বছর ফেল করে বসে আছে।

বউটি চলে গেল। কলে বালতি পাতল অমূল্য। মঞ্জু ওদের থেকে কিছুটা দূরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। বিয়েবাড়ির আলো ওর মুখে পড়েছে। আর একদফা খাওয়া শেষ হয়েছে। ভরপেট মানুষগুলো মঞ্জুর পাশ দিয়েই চলে গেল। সিগারেট ধরাতে দাঁড়িয়ে একজন তার সঙ্গীকে বলল, তুই একটা নেলা। গুচ্ছের পোলাও বসে বসে গিললি। মাছ খাবি তো।

ছ-টা মাছ খেয়েছি।

আমি শালা তেরোটা।

মন্মথর কানেও কথাগুলো গেছে। অমূল্য জল নিয়ে চলে গেল। মঞ্জু ডাক শুনেই দৌড়ে এল। ঘাড় নুইয়ে বাবু হয়ে মন্মথ বসেছে। হেঁচকি তোলার মতো হ্যাণ্ডেলটা তুলে বুক দিয়ে সাপটে মঞ্জু ঝুলে পড়ল। সরু ধারায় জল পড়ছে। মন্মথ মাথা চাপড়াল, পিঠ-বুক রগড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠল মঞ্জু।

সাবান ঘষতে শুরু করল মন্মথ। ডিপোয় গোলা সাবান দেয়। তাই দিয়ে তেল-কালি ওঠে কিন্তু ডিজেলের গন্ধ চামড়ায় বসে থাকে। গন্ধ সাবান মেখে সেই গন্ধ মারতে হয়। চুলে সাবান ঘষল মন্মথ। গাড়ির তলায় শুলে কি বনেটের মধ্যে মাথা ঢোকালেই চুলে কালি লাগবে। সেই কালি বালিশের ওয়াড় ময়লা করবে।

নেমন্তন্ন খেয়ে আরও কয়েক জন ফিরছে। টিউবওয়েলের কাছটা অন্ধকার। রাস্তার ধারে একজন পেচ্ছাব করতে বসল। সঙ্গীরা তার জন্য দাঁড়িয়ে রইল।

বউটা মাইরি বড় বোগা।

বিয়ের জল লেগে ঠিক হয়ে যাবে। আরে তুই কচ্ছিস কী? শেষকালে পাড়ার লোকদের যে আর একটা ডিভিসি তৈরি করতে হবে।

তাহলে তোকে চেয়ারম্যান করব।

এবার একটু মোটা হয়ে জল পড়ছে। মন্মথ খুশি হল। মাথা পেতে রাখল অনেকক্ষণ। মঞ্জু হাঁপাচ্ছে। ওকে কল টিপতে বারণ করে উঠে দাঁড়াল সে।

এবার বাড়ি চলে যা। দাঁড়া, সাবানটা নিয়ে যা। সাবান হাতে গুটিগুটি মঞ্জু ফিরে এল। সান্যাল বাড়ির সামনে সে একটুখানি দাঁড়িয়েছিল। হাত থেকে সাবানটা পড়ে গিয়েছিল। সাবানে-লাগা-ধুলো ফ্রকে ঘষতে ঘষতে সে দেখতে পেয়েছিল টিনাদি লাল-নীল কাগজ লোকেদের বিলোচ্ছে। ঠিক ওইরকম কাগজ দিয়েই মোড়া ছিল সাবানটা, যখন দোকান থেকে আসে।

রঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছে, অঞ্জর প্রায় সেই অবস্থা। কণিকা ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। মন্মথর পাশে বসেছিল মঞ্জু। কিরণ ফিরবে ঠিক যখন কণিকা খেতে বসবে।

তুমি তেরোটা মাছ খেতে পার?

চান করে তাজা বোধ করছে মন্মথ। মঞ্জুর পাত থেকে ফেলে দেওয়া কাঁচালঙ্কাটা নিজের থালায় ঘষতে ঘষতে বলল, তারও বেশি পারি।

কণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মন্মথ হাসল, কণিকাও। ব্যাপারটা মঞ্জুর চোখে পড়ল। বাবা-মার একসঙ্গে হাসি সে দেখেনি, আশকারা পেয়ে। বলল, যাঃ, মিথ্যে কথা।

গ্রাসটা মুখের কাছাকাছি একটু থামিয়ে গিলে ফেলল মন্মথ। অঞ্জু ঢুলে পড়ছে। বাঁ-হাতে ওর ঘাড়টাকে সিধে করে ধরে কণিকা ভাত গুজে দিল।

বিশ্বাস না হয় তোর মাকে জিজ্ঞেস কর। তোর এক মেজদাদু ছিল। মণিমাসিমার বাবা। ভীষণ খাইয়ে। এত্ত ভাত খেত আর গামলা গামলা মাংস। তোর ভাতের সময় নেমন্তন্ন খেয়ে যখন বাড়ি যাবে তখন বলেছিলুম, কাকাবাবু, আপনার আর আগের মতো খাওয়া নেই। শুনেই বললেন, তুমি যা খাবে, আমি এখুনি তার ডবল খেতে পারি। কেউ বিশ্বাস করে না তার কথা। কম করে অন্তত পঁচিশটা লেডিকেনি, এক হাঁড়ি দই আর পাঁচ-ছ গন্ডা মাছ খেয়েছে, এরপর আর কত খেতে পারবে। তাই দুম করে আমিও রাজি হয়ে গেলুম। বোধ হয় পনেরোটা মাছ খেয়েছিলুম, তাই না?

আ…হা পনেরোটা কোথায়? ছোটো বউদিই তো তোমার পাতে খান বারো দিয়েছিল, তারপর মেজকাকি এক খামচা।

কিরণ এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। মন্মথর সঙ্গে চোখাচোখি হল। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে। ওর চাউনির বাইরে সরে যাবার চেষ্টা করতেই মন্মথ বলল, যাচ্ছিস কোথায়? খেয়ে নে।

তারপর কী হল বাবা?

ও আজ শোবে কোথায়?

ঘরেই শুক।

বাবা, তারপর?

তারপর তো মেজদাদু খেতে বসল।

যেখানে যত লোক ছিল সবাই ছুটে এল। মেজদিদিমা খালি বললেন, ওর শরীরটা ক-দিন ভালো যাচ্ছে না, একটু নজর রেখে পাতে দিয়ো।

থালার কানায় হাতের চেটো ঘষল মন্মথ, কাদার মতো ভাতের চাঁছি জমল। আঙুল দিয়ে সেটুকু মুখে পুরে সে উঠে পড়ল।

কিরণ ভাতে হাত দিয়ে গল্প শুনছিল, এইবার সে তাকাল কণিকার দিকে। খেয়াল হল কণিকার, অঞ্জু এতক্ষণ কিছুই খায়নি। বাকি ভাতটুকু একগ্রাসে ওর মুখে গুঁজে দিল।

কলঘরটা অন্ধকার। মেঝেয়-বসানো বালতিটায় ঠোক্কর লাগল। ঝন ঝন শব্দের মধ্যেই মঞ্জু বলল, মেজদাদু তোমার ডবল খেল?

হ্যাঁ খেল। পইপই বলি বালতি চৌবাচ্চার পাড়ে রাখবে। কে কথা শোনে!

মঞ্জু গা ঘেঁষে এল, কিরণের খাওয়া হয়ে গেছে। কণিকারও প্রায় শেষ। মন্মথর কথার পিঠে কেউ কথা বলল না, সেও চুপ করে রইল। বাইরে একটা লোক বোধ হয় কুকুর তাড়াচ্ছে। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল মন্মথ। ঘরের মধ্যে ভীষণ গরম। রাস্তার হাওয়ায় শরীরটা জুড়োতে সে বেরিয়ে পড়ল।

দাঁ-দের রকটায় মন্মথ বসবার জায়গা পেল। পুঁটলি নিয়ে একটা লোক ওর সামনেই পথে বসল। লোকটা সন্দেশ আর লেডিকেনির দুটো স্থূপ আলাদা করে বেছে রেখে লুচি আর অন্য কীসব দিয়ে খাওয়া শেষ করল, মিষ্টি খেল না। গলা খাঁকিয়ে মন্মথ জিজ্ঞেস করল, ওগুলো খেলি না যে।

ওগুলো বেচব।

কোথায়?

মিষ্টির দোকানে।

লোকটা আর কথা বাড়াল না। হাঁটা শুরু করল। তাড়াতাড়ি মন্মথ ওর পিছু নিল। ও যেদিকে চলেছে সেদিকেই তো অমূল্যের দোকান। ট্রাম-রাস্তায় পৌছে মন্মথ হাঁপ ছাড়ল।

বন্ধ করবে কখন?

বন্ধের অনেক দেরি, সেই সাড়ে এগারোটা-বারোটা। খাটুনি কি কম, সেই সাড়ে পাঁচটা থেকে ভূতের মতো চরকিবাজি শুরু হয়েছে।

একটু অন্যমনস্কর মতো মন্মথ বলল, তোমার তো তবু ছোটো সংসার। চার-পাঁচটার মুখে অন্ন দিতে হয় না।

কথাটা বোধ হয় শুনতে পেল না অমূল্য। খদ্দের এসেছে। দই ওজন করা দেখল মন্মথ। ধারের খাতায় দাম টুকে রাখল অমূল্য। আবার খদ্দের এল, মন্মথ উঠে পড়ল। আর বসে থাকা যায় না, বসলেই বিড়ি খেতে হবে। ঘরে গিয়ে বসলে আঁস্তাকুড়ে ফেলা বিয়েবাড়ির খাবারের গন্ধ শুকতে হবে। গন্ধটা এমন যে গোগ্রাসে গেলার ইচ্ছে জাগে। অমূল্যর দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা যদি ধারে কেনা যায় কত আর পড়বে? পাঁচ-সাত টাকা। পাঁচ সিকে কি দেড় টাকায় প্রায় অতগুলো মিষ্টিই পাওয়া যেত।

হঠাৎ মন্মথর ভীষণ খিদে পেল। প্রায় পঁচিশটা মাছের টুকরো একসঙ্গে খেতে পারার মতো খিদে। ছ্যাঁৎ করে উঠল ওর বুক। একটা লোক পুঁটলি হাতে আসছে। অবিকল সেই লোকটার মতো। লোকটা চলে গেল পাশ দিয়ে, আর আশ্চর্য, খিদেটাও কমে গেল। বিয়েবাড়ির জলুস নিবু নিবু, হইচইটা হচ্ছে ফুলশয্যার অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে। এবার বর-বউ ঘরে ঢুকবে।

গন্ধ পেল মন্মথ। শব্দ না করে নিশ্বাস টেনে ফিসফিস করে বলল, সাবান মেখেছ বুঝি? আর একটু এগিয়ে এসে মন্মথর চিবুকে প্রায় গাল ঠেকাল কণিকা। হ্যাঁ, কিরণকে দিয়ে এক বালতি আনালুম। গা থেকে বড় টক টক গন্ধ বেরোয়।

দুজনে মাখলে তাড়াতাড়ি ফুরোবে।

আমি কি আর রোজ মাখছি।

সান্যাল বাড়িতে কিছু-একটা হল। অনেকে মিলে হেসে উঠছে। অনেক বাড়ির দেয়াল টপকে হাসিটা কণিকার নিশ্বাসের মতো দ্রুত চাপা হয়ে ঘরে পৌঁছোল।

অঞ্জু আজ কী বলছিল জান?

কী?

বলছিল মা আমাদের বাড়ি আর ভাত হবে না।

অত কাছে আসছ কেন, কিরণ ঘরে রয়েছে না?

মন্মথ কনুই দিয়ে ঠেলল কণিকাকে। কণিকা আরও সরে আসতে চাইল।

কী হচ্ছে কী?

চাপা ধমক দিল মন্মথ, শিথিল হয়ে গেল কণিকা। একটু সরে গেল, আর একটু বাদে কাত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওর পিঠে আলতো হাত রাখল মন্মথ। টিউব ওয়েলের বাসনমাজা বউটিকে মনে পড়ল। কণিকার পাঁজর চেপে মন্মথ টেনে আনল।

অঞ্জু কী বলছিল?

জানি না।

বলো না?

বললুম তো।

মন্মথর বুকে হাত বুলোতে শুরু করে কণিকা। হাতে ঠেকল গামাচি। নখ দিয়ে মেরে দিল। পুট করে উঠল।

বেশ শব্দটা, না?

হ্যাঁ।

মেরে দাও-না।

থাক এখন।

কণিকা হিঁচড়ে নিজেকে মন্মথর বুকের উপর তুলল। মন্মথর ঘাড়ে মুখ ঘষে বলল, সাবানের গন্ধটা বেশ না?

হ্যাঁ, কিন্তু কিরণ ঘরে রয়েছে।

ফিসফিস করে ঠিক একই সুরে কণিকা বলল, বাইরের রকে চলো-না।

রকে নর্দমার গন্ধ।

না, গন্ধ নেই। বিকেলে বাড়িউলি পরিষ্কার করেছে।

রাতে বাড়িউলি কলঘরে নামবে।

এখন নামবে না।

না না, না।

বিরক্তি ভয় আর উত্তেজনা মন্মথর কথাগুলোকে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল। আর ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল কিরণ।

কী হল তোর?

দরজা বন্ধ আছে?

হ্যাঁ আছে, তুই ঘুমো।

কিরণ শুয়ে পড়ল। নিঃশব্দে সাপের মতো শরীরটাকে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে কণিকা সরে গেল। আর একটু পরেই চটাস করে রঞ্জুর পিঠে চড় মেরে উঠে বসল কাঁথা বদলাবার জন্য।

মারলে কেন?

না মারবে না, খেটেখুটে একটু শোব তারও উপায় নেই, শত্তুর এসে জুটেছে।

আঃ, গাল দিচ্ছ কেন।

চুপ করে রইল কণিকা। মন্মথও। সারা ঘরে শুধু নিশ্বাস আর রঞ্জুর বিনিয়ে কান্নার শব্দ, তাও একটু পরে থেমে গেল। খলখল করে মজুমদার বাড়ির মেয়েরা ফিরল। দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে। চাকরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওরা লুটোপুটি খেয়ে গল্প জুড়ল। খড়খড়ির পাখির ফুটো দিয়ে হান্টি কী যেন দেখছে।

কণিকা জলের মতো মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে জানলার কাছে সরে এল। ওদের হাসির জন্য কিছু কিছু কথা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কনুই দুটো পিলসুজের মতো করে দু-হাতের চেটোয় সে মুখটাকে রাখল।

মন্মথ বলল, জানলাটা বন্ধ করে দাও নয়তো আস্তাকুঁড়ের গন্ধ আসবে।

থাক, রোজই তো খোলা থাকে।

আজ জঞ্জাল বেশি।

কণিকা শুধু চাউনিটা নামিয়ে আস্তাকুঁড়টা দেখল। আর দেখতে দেখতেই বলল, জঞ্জাল আর কোথায়, খাবারই তো।

একটু বুঝি হাওয়া দিল। শরীরটা ঠাণ্ডা লাগছে। মন্মথ চোখ খুলল। একভাবেই কণিকা জানলার দিকে তাকিয়ে। শান্ত, নিথর মন্মথর মনে পড়ল বাসনমাজা বউটিকে, তার শরীরের নড়াচড়াকে। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে একটা ম্যাজম্যাজে অস্বস্তির চলাফেরা বোধ করল। উপুড় হয়ে দু-হাতে নিজের মাথা জড়িয়ে ধরল সে। সাবানের গন্ধ সরে গেছে শরীর থেকে, শরীরে এখন অস্বস্তি। কণিকার দিকে আড়ে তাকাল। শান্ত, নিথর। আবার একটু হাওয়া এল। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্মথ টের পেল উৎসববাড়ির গন্ধ। বুঝে গেল কেন এখনও কণিকা জানলার দিকে মুখ করে জেগে আছে। কণিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন্মথ ভাবল, এইবার ওকে টেনে হিঁচড়ে বাইরের রকে নিয়ে গেলে কেমন হয়। ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই মন্মথ হাত বাড়াল আর চমকে হাতটা সরিয়ে নিল। মঞ্জু অঞ্জু কারোর গায়ে হাতটা পড়েছে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা শরীরের ম্যাজম্যাজে অস্বস্তিটা গুটিয়ে দলা পাকাল পাকস্থলীর মধ্যে। সারা শরীরটা গুলিয়ে উঠে প্রচন্ড খিদেয় আচ্ছন্ন হল। ক্রমশ সে ঝিমিয়ে পড়ল। ঘুম আসবার আগের মুহূর্তে সে দেখতে পেল পুঁটলি হাতে লোকটা ট্রামলাইন পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *