২৩. মধুসূদনবাবু তখন ধীরে ধীরে

মধুসূদনবাবু তখন ধীরে ধীরে বোধ হয় সোফাটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার আর উঠে দাঁড়ানো হল না। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণকণ্ঠে কিরীটী মধুসূদন সরকারকে লক্ষ্য বললে, উঁহু মিঃ সরকার, উঠবার চেষ্টা করবেন না কারণ আজ আমরা প্রস্তুত হয়েই এসেছি।

সকলকে আরও আশ্চর্য করে দিয়ে আরও শান্ত ও একান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে মধুসূদন এবারে কথা বললেন, ওঠবার চেষ্টা আমি করিনি মিঃ রায়—আর তার প্রয়োজনও নেই। তবে এটা ঠিকই, আপনার উর্বর কল্পনাশক্তির প্রশংসা না করেও আমি পারছি না। মিঃ সুশান্ত ঘোষালের কথায় সেদিন এখন দেখছি আপনাকে একটু ওভার-এস্টিমেট করে ভুলই করেছিলাম।

ভুল করেছিলেন বৈকি! ভেবেছিলেন আপনার চাতুরী বুঝি কেউ ধরতে পারবে না। মধুবাবু, আমাদের দেশে একটা চলতি প্রবাদ আছে-অধিক লোভে তাঁতি নষ্ট। সারদাবাবু যে উইল করে গিয়েছিলেন সেটা যদি মাস-চারেক আগে আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু আমাদের সলিসিটার মিঃ শচীবিলাসবাবুর কাছ থেকে না জানতে পারতেন

শচীবিলাস বললেন, আশ্চর্য! আপনি-আপনি সেকথা জানলেন কি করে মিঃ রায়?

অনুমান–নিছক সেটা অনুমান মাত্র শচীবিলাসবাবু।

অনুমান?

হ্যাঁ। মধুসূদনবাবু বর্মা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে এসেছেন দু-সপ্তাহকাল আগে নয়—চার মাস পূর্বে। এবং তিনি যে এসেই আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন সেকথা প্রথম আমি মাত্র পরশু জানতে পারি আপনার ফার্মের পার্টনার রথীন বোসের কাছ থেকেই। তারপর বাকিটা অনুমান করে নিতে আমার কষ্ট হয়নি।

চুপ কর শচী, ওর দৌড়টা একবার শেষ পর্যন্ত আমাকে দেখতে দাও। লেট হিম স্পিক। বললেন আবার মধুসূদন সরকার।

কিন্তু সব কথা আমার বলবার আগে–বিমলবাবু, আমার অনুরোধ, সরকার সাহেবের রক্তাক্ত হাত দুটি আপনি লৌহবলয়াকৃত করুন! বললে কিরীটী।

নিশ্চয়ই। উঠে দাঁড়াল বিমল সেন এবং মধুসূদনের দিকে এগিয়ে গেল।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন মিঃ সরকার, আইআই মাস্ট নট আলাউ দিস ইনসাল্ট!

কিন্তু তার কোন প্রতিবাদই কাজে লাগল না।

মধুসূদন সরকারের হাতে বিমল সেন হ্যাণ্ডকাপ পরিয়ে দিলেন।

হ্যাঁ, এবার সব কিছুই এক্সপ্লেন করে আপনাদের বলব।

কিরীটী নিশ্চিন্ত কণ্ঠে আবার শুরু করল, অবশ্যই এই খেলাটি ইস্কাবনের সাহেবেরই খেলা নয়—সাহেবের বিবিও আছেন-হরতনের বিবি।

চকিতে সুশান্ত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

আশ্চর্য হচ্ছেন সুশান্তবাবু আমার কথা শুনে, তাই না? সেই জন্যেই সে রাত্রে আপনাকে ফিরবার পথে সাবধান করে দিয়েছিলাম, অল দ্যাট গ্লিটারস ইজ নট গোেল্ড এবং কেয়ার ঝোপের পাশেই থাকে বিষধর কালনাগ বলে। যাক গে সে কথা, যা বলছিলাম বলি। ইস্কাবনের সাহেব অর্থাৎ আমাদের ঐ সরকার সাহেবের দিকে চেয়ে দেখুন, ঠিক তাসের ইস্কাবনের মতই মুখখানি নয় কি ওঁর?

ঘরের মধ্যে উপস্থিত যাঁরা ছিলেন সকলেরই দৃষ্টি মধুসুদন সরকারের মুখের উপরে গিয়ে নিবন্ধ হল এবং সকলেরই যেন মনে হল কিরীটী মিথ্যা বলেনি। মধুসূদনের মুখখানি যেন হুবহু তাসের ইস্কাবনের সাহেবের মতই দেখতে।

সত্যিই আশ্চর্য!

কিরীটীর কণ্ঠস্বরে পরমুহূর্তেই আবার সকলে তার মুখের দিকে তাকাল।

কিরীটী বলছিল, এবারে চেয়ে দেখুন সকলে আমাদের শকুন্তলা দেবীর মুখের দিকে? হুবহু হরতনের বিবি নয় কি এবং ওঁদের দুজনের ঐ বিচিত্র মুখাকৃতিই—সত্য বলতে কি, প্রথম দিন ওঁদের দেখেই ওঁদের প্রতি মন আমার আকৃষ্ট হয়েছিল।

সকলের দৃষ্টি আবার ঘুরে গেল শকুন্তলা দেবীর মুখের দিকে।

এতটুকু অতিশয়োক্তি নয়-আশ্চর্য, হুবহু যেন হরতনের বিবিটিই! কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, এবারে শুনুন ঐ সাহেব-বিবির খেলা। মধুসূদনবাবুর সঙ্গে যে কারণে বিবাদ হয়েছিল তাঁর কাকা সারদাবাবুর এবং যে কারণে একদিন বিতাড়িত হতে হয় তাঁর পিতৃগৃহ থেকে সে হচ্ছে ওঁর অতিরিক্ত জুয়াখেলায় আসক্তি—কেমন কিনা বৃন্দাবনবাবু?

বৃন্দাবনবাবু নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।

আমাদের বিতাড়িত ইস্কাবনের সাহেব অনন্যোপায় হয়ে চলে গেলেন তখন একেবারে ভাগ্যান্বেষণে সুদূর বর্মা দেশে মগের মুল্লকে। সেখানে এ ধনীকাষ্ঠব্যবসায়ীর নজরে পড়ে কিঞ্চিৎ ভাগ্যও একটু একটু করে ফিরিয়ে আনছিলেন, কিন্তু যার রক্তে একবার জুয়ার নেশা ধরেছে-সে যে বাঘের মতই নররক্তের আস্বাদ পেয়েছে—সে নেশা সে ভুলবে কি করে? তাই ছুটলেন আবার জুয়ার আড্ডায় যেই হাতে কিছু জমেছে। এবং সেইখানেই অর্থাৎ প্রেমের এক জুয়ার আড্ডাতেই পরিচয় ঘটল সাহেব-বিবির পরস্পরের। দেবা চিনলেন দেবীকে, দেবী চিনলেন দেবাটিকে। সেও আজ থেকে বৎসর দেড়েক আগেকার কথা। এসব সংবাদ অবিশ্যি আমাকে রেঙ্গুন পুলিসের দপ্তর থেকেই সংগ্রহ করতে হয়েছে কষ্ট করে। তথাপি ভুলভ্রান্তি অবশ্য থাকতে পারে। এবং ভুলভ্রান্তি যদি থাকেও, সরকার সাহেব আশা করি সংশোধন করে দিতে পারবেন।

কথাগুলো বলে কিরীটী তাকাল মধুসূদনের মুখের দিকে।

রোমকষায়িত দৃষ্টিতে তাকালেন মধুসূদন সরকার কিরীটীর দিকে নিরুপায় পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত।

আর শকুন্তলা চোখ নামিয়ে নিল একান্ত অসহায়ের মতই যেন।

আবার কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কাহিনীর বিবৃতির মধ্যে ফিরে যায়, জুয়োতে সর্বস্বান্ত হয়ে অনন্যোপায় সাহেব আবার ফিরে এলেন বাংলাদেশে দীর্ঘ দশ বৎসর পরে এবং সঙ্গে এবারে এলেন তাঁর বিবিসাহেবা, কারণ জুয়োর আড্ডায় পরিচয়টা উভয়ের তখন নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ফিরে সরকার সাহেব কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গলাধাক্ক খেলেন। এবারে কি উপায় করা যায় যখন ভাবছেন, ঐ সময় কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সারদাচরণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন শকুন্তলাকে। এবারে কিন্তু হার হল না, কারণ শকুন্তলার রূপ দেখে প্রৌঢ় সারদাচরণের মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। অতএব বহাল হল কুন্তলা তার। কাজে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সরকার সাহেবের। যে প্ল্যান করে শকুন্তলাকে তিনি কাকার কাছে চাকরি করার জন্য পাঠালেন সেটা গোড়াতেই বানচাল হয়ে গেল। কারণ পঞ্চশরের বানে কাহিল হলেন সারদাচরণ আর ঐশ্বর্যের লোভে শকুন্তলা তার পূর্ব চুক্তি বোধ হয় ভুলে গেলেন। যা হয়েছিল সাহেবের সঙ্গে। ফলে নাটকের দৃশ্যান্তর হল। মধুসূদন দেখলেন বেগতিক। কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়বার পাত্র তিনি নন। তাতেই কেতুর আবির্ভাব ঘটল সরকার ভিলায়, কাজও হাসিল হল বটে সারদাচরণেরই নিজ হাতে তৈরী রোজ স্পেইং সলুশনের মধ্যস্থিত বিষ নিকোটিনের সাহায্যে, কিন্তু দশরথ আসল পরিচয়টা জেনে ফেলল, ফলে হতভাগ্য দশরথকেও মরতে হল ঐ মারাত্মক নিকোটিন বিষে।

এই পর্যন্ত বলে কিরীটী একটু থামল।

তারপর? প্রশ্ন করল সুশান্ত।

তারপর? তারপর আসতে হল আমাকে। এদিকে উইলের আসল মর্মকথা মধুসুদন তার বন্ধুর কৃপায় পূর্বাহ্নেই জেনেছিলেন। এবং দশরথ ও সারদাচরণকে সরিয়ে সাহসও তার বেড়ে গিয়েছিল—অতএব অর্থের লোভে হতভাগ্য বিজনবাবুকেও এবারে মরতে হল। পূর্বেই বলেছি সারদাবাবু ও দশরথের মৃত্যু ও তাদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে আমার মনে দুটি সন্দেহ হয়। এক—যেভাবে তাদের মৃত্যু ঘটেছে তাতে করে হত্যাকারী বাইরের কেউ নয়—ভিতরেরই। দুই-প্রথম মৃত্যুর সঙ্গে দ্বিতীয় মৃত্যুর যোগাযোগও আছে এবং ঐভাবে হত্যা করা কোন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভবপর নয়। তখনো হত্যার মোটিভ বা উদ্দেশ্যটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। পরিষ্কার হল উইলের মর্মকথা শোনবার পর। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে সারদাচরণের গৃহে তার ড্রয়ারের মধ্যে প্রসাধনদ্রব্যগুলো দেখে ও বাগানে সেদিন শকুন্তলা দেবীর খোঁজে সেই চায়না বাঁশের ঝাড়ের কাছে গিয়ে চুরুটের শেষাংশ দেখে, শকুন্তলা ও মধুসূদনবাবুকে ঘিরে যে সন্দেহটা আমার মনে দানা বাঁধবার চেষ্টা করছিল সেটা যেন ক্রমশঃ শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। এবং সেই মুহূর্তেই এল আকস্মিকভাবে বিজনবাবুর মৃত্যু।

কিরীটী এই পর্যন্ত বলে আবার থামল।