২২. ধীরে ধীরে কিরীটী

ধীরে ধীরে কিরীটী তার বক্তব্য শুরু করে :

শুনে নিশ্চয়ই সুখী হবেন আপনারা, গত এক মাস ধরে পর পর যে চারটি নিষ্ঠুর হত্যা এই সরকার ভিলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই হত্যা-রহস্যের পশ্চাতে যে আছে সে যত চালাক ও চতুর হোক না কেন, আমার চোখে শেষ পর্যন্ত সে ধুলো দিতে পারেনি–

এসব আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? তবে কি গোকুল হত্যাকারী নয়? প্রশ্ন করলেন বৃন্দাবন সরকার।

শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে ওঠে, না, না বৃন্দাবনবাবু, ইট ওয়াজ নট গোকুল।

তবে কে-কে?

একসঙ্গে সকলেরই কণ্ঠ হতে যেন ঐ কথাগুলি উচ্চারিত হল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় একই সময়ে।

সে কে—সেই কথাই তো আজ আপনাদের আমি বলব। সারদাবাবু ও দশরথের মৃত্যুর ব্যাপারটা হত্যাকারী খুব ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করলেও, বিজনবাবুর হত্যার পরই খুনী আমার চোখের সামনে-ব্যাপারটা আগাগোড়া স্থিরচিত্তে ঐদিনই রাত্রে চিন্ত করবার পর থেকেই ক্রমশঃ-হ্যাঁ, আমার চোখের সামনে আকার নিতে থাকে একটু একটু করে। আর আমার সেই সন্দেহের ব্যাপারটা খুনী যে মুহূর্তে অনুমান করতে পারলে সেই মুহূর্ত থেকেই সে বিচলিত হয়ে ওঠে।

কিন্তু সে কে? অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ডাঃ অধিকারী।

বলছি ডাঃ অধিকারী। ডোনট বি ইমপেসেট! যা, খুনী বিচলিত হবার সঙ্গে সঙ্গে অনন্যোপায় হয়েই সে শেষ চালটি চালে।

শেষ চাল? প্রশ্ন করল বিমল সেন।

হ্যাঁ, রাদার ইউ ক্যান সে-দি লাস্ট অ্যাটেমণ্ট। কিন্তু দুটি মারাত্মক ভুল সে করে বসে ঐ শেষবারের মত আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে গিয়ে, যার ফলে যেটুকু তখনও আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল তাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে দিনের আলোর মতই সঙ্গে সঙ্গে।

তাহলে গোকুলের মৃত্যুই রাতেই–

ডাঃ অধিকারীর কথাটা শেষ হল না, কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বললে, হা ডাক্তার, আমি সেই রাত্রেই জানতে পেরেছিলাম কে সে-কে হত্যা করেছে এমন নৃশংসভাবে পর পর এতগুলো লোককে। সেদিন আপনাকে আমি বলেছিলাম যে অর্থ অনর্থম। তা এ ব্যাপার অর্থ অনর্থম্ তো বটেই-সেই সঙ্গে পঞ্চশরের খেলাও ছিল, যেজন্য হত্যাকারী সর্বপ্রথম সারদাচরণকে হত্যা করে। সত্যি অত্যন্ত ট্যাক্টফুলি সে সারদাচরণকে হত্যা করেছিল ছদ্মবেশে এই সরকার ভিলাতে এসে

ছদ্মবেশে? উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করেন বৃন্দাবন সরকার।

হ্যাঁ বৃন্দাবনবাবু, হি ওয়াজ ইন ডিসগাইজ অ্যাট দ্যাট টাইম! কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সকলের চোখে, এমন কি আপনার চোখে ধুলো দিতে পারলেও, কিন্তু এ বাড়ির একজনের চোখে ধুলো দিতে পারেনি-সে হচ্ছে পুওর দশরথ।

দশরথ? ডাঃ অধিকারী বললেন।

হ্যাঁ, দশরথ। এবং দশরথ তাকে চিনতে পেরেছে সন্দেহ করেই খুনী আর কালবিলম্ব করে তাকেও শেষ করে বা করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু কে সে? বললেন বৃন্দাবন সরকার আবার।

আপনাদের সরকার ভিলার নবনিযুক্ত ভৃত্য শ্রীমান কেতু।

কেতু!

হ্যাঁ। কিন্তু কে সে কেতু? কি তার আসল পরিচয়? আর কেনই বা হত্যাকারীকে কেতু পরিচয়ে ছদ্মবেশে এই সরকার ভিলাতে আসতে হয়েছিল?

একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, সে অন্য পরিচয়ে এসেছিল এই জন্য যে, তার সত্যকারের পরিচয়ে সারদাচরণ বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই সরকার ভিলায় প্রবেশ দুঃসাধ্য ছিল। অথচ সারদাচরণকে হত্যা করতে হলে এখানে তাকে প্রবেশ করতেই হবে। তাই অনেক কৌশল খাটিয়ে সে কেতু হয়ে এই সরকার ভিলায় এসে প্রবেশ করল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, সে ধরা পড়ে গেল পুরাতন ভৃত্য দশরথের চোখে। যা হোক, সেই কারণেই। কেতু পরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার কোন সন্ধানই আর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কারণ কেতু বলে কেউ সত্যই ছিল না সেদিন আর আজও নেই।

কিন্তু কে-কে সেই কেতু? অধীরভাবে আবার মধুসূদন সরকারই প্রশ্ন করলেন।

বলছি-সবই বলব একে একে। এবারে আমি আসছি হতভাগ্য বিজনবাবুর হত্যার ব্যাপারে। বিজনবাবুকে হত্যাকারী সরিয়েছে তার সম্পত্তিটা হাত করবার জন্য। আর বিজনবাবুর হত্যার ব্যাপারটাই হচ্ছে হত্যাকারীর চরম নৃশংসতা। একটু আগেই আপনাদের আমি বলেছি, ঐ বিজনবাবুর হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী ক্রমশঃ আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু কেন? কি ভাবে? এ ধরনের হত্যারহস্যের মীমাংসায় পৌঁছতে হলে প্রধানতঃ তিনটি কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক প্রত্যেকেরই। মোটিভ, প্রবাবিলিটি ও চান্স। প্রথমেই ধরা যাক প্রবাবিলিটি-বিজনবাবু নিহত হবার পরই সর্বপ্রথম যে কথা আমার মনে উদয় হয়েছিল সেটা হচ্ছে বিজনবাবু সিমপ্লি বাই অফ মিসটেক নিহত হয়েছেন কিনা। যে কথাটা সেদিনও কিছুটা আপনাদের সামনে আমি আলোচনা করেছিলাম। অর্থাৎ কোন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশতঃ বিজনবাবুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল কিনা। কিন্তু অনেক ভেবেও কোন কূল-কিনারা না পেয়ে শেষে স্থির করলাম, না, ভুল নয়-ইচ্ছা করেই এবং খুনীর প্রয়োজনেই তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিজনবাবু এক চুমুক চা পান করার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেলেন। আগেই অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছি আমি, কি ভাবে নিকোটিন বিষপ্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষ একমাত্র সেক্ষেত্রে মেশাতে পারে কে এবং কার পক্ষে সর্বাপেক্ষা সেটা সম্ভব ছিল তা পরে বিবেচ্য, কিন্তু বর্তমানে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যেভাবে মারা গেলেন সেভাবে আমাদের মধ্যে অন্য কেউই সে সন্ধ্যায় মারা যেতে পারত কিনা। হ্যাঁ, পারত। কিন্তু খুনী এখানে প্রবাবিলিটির উপরে একটা স্রেফ চান্স নিয়েছিল মাত্র সে সন্ধ্যায়। সৌভাগ্যবশতঃ খুনীর সে চান্স ফলে গেল। হি ওয়াজ সাকসেসফুল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিজনবাবুর মৃত্যুর পর-পরের দিন মধুবাবুকে নিয়ে যখন আমি তার আগের সন্ধ্যার অভিনয়টা করি সে সময়ও যদি একবারও ডাঃ অধিকারী—আপনি—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি আমার অনুরোধ সত্ত্বেও মুখ না বন্ধ করে থাকতেন তো পুওর গোকুলকে ঐভাবে সে রাত্রে প্রাণ দিতে হত না হয়ত।

না, না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? আমি-আমি সত্যিই কিছু জানি না। ব্যাকুল কন্ঠে প্রতিবাদ জানালেন ডাঃ অধিকারী।

এখনো আপনি সত্যকে ঢাকবার চেষ্টা করছেন ডাঃ অধিকারী—সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী বলে ওঠে কঠিন কণ্ঠে। সেদিন মধুবাবুর অভিনয়কালে ব্যাপারটা সত্য ভেবে যে উদ্বেগ আপনার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল, সেটা আর কারও চোখে না পড়লেও আমার চোখকে ফাকি দিতে পারেনি। শুনুন ডাক্তার-অর্থের লোভই সেদিন আপনার মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। বলুন-বুকে হাত দিয়ে আপনি বলুন তো একটা কথা—আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু মৃত সারদাবাবুর সঙ্গে তার মৃত্যুর তিনদিন আগে যখন দেখা করতে এই সরকার ভিলাতে এক বেলার জন্য আপনি এসেছিলেন সে সময় ছদ্মবেশী কেতুকে কি আপনি চিনতে পারেন নি? আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারেননি আসলে সে কে?

আমি–আমি–

হ্যাঁ, কেতুই যে ছদ্মবেশে আমাদের মধুসূদনবাবু তা কি বুঝতে পারেননি আপনি সেদিন, বলুন?

ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।

বৃন্দাবন চিৎকার করে উঠলেন, কেতুই দাদা?

হ্যাঁ–কেতুই ছদ্মবেশী আপনার দাদা মধুসূদনবাবু। আপনি-আপনিও বোধ হয় সন্দেহ করেছিলেন বৃন্দাবনবাবু? কিন্তু কেন আমাকে সে কথা বলেননি-তাহলে তো হতভাগ্য বিজনবাবু ও গোকুলকে ঐভাবে ঐ শয়তানের হাতে নিষ্ঠুরভাবে মরতে হত না!

ঘরের সব কটি প্রাণীই যেন বিমূঢ়।