২০. আর্তকণ্ঠে যেন কথাটা প্রশ্নের মত

ডেড! আর্তকণ্ঠে যেন কথাটা প্রশ্নের মতই পুনরুচ্চারণ করলেন বৃন্দাবন সরকার।

হ্যাঁ, স্টোন ডেড!

সকলে স্তম্ভিত নির্বাক।

ডাঃ অধিকারী একটু পরে মৃতদেহের সামনে একসময় ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত নির্বাক হলেও—মধুবাবুর চায়ের কাপটা কোথায় গেল?-বলতে বলতে কিরীটী নিচু হয়ে হাত ঢুকিয়ে উপবিষ্ট মধুসূদনের সোফার তলা থেকে চায়ের কাপটা তুলে নিল। তারপরই কাপটা হাতে নিয়ে মধুসূদন সরকারকে লক্ষ্য করে বললে, স্পেনডিড! সত্যিই চমৎকার অভিনয় করেছেন মধুবাবু, উঠুন—এতটা সাকসেস্ সত্যিই আমি আশা করিনি।

বিস্মিত হতবাক সকলের চোখের সামনে এবারে মধুসূদন সরকার চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলেন।

কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে চেয়ে এবারে বললে, বাধ্য হয়েই আজকের এই অভিনয়টুকু মিঃ সরকারকে দিয়ে আমাকে করাতে হল ডাক্তার অধিকারী। কিন্তু কেন করেছিলাম এবারে

আমি সেই কথাটাই বলব।

কিরীটীর কথায় ও মধুসুদনকে চোখ মেলে উঠে বসতে দেখে এতক্ষণে যেন সকলে সম্বিৎ ফিরে পান। সকলেই একটা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

সকলেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।

কিরীটী তখন আবার বলছে, হ্যাঁ, কোন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের এই অভিনয়ের অনুষ্ঠানটি আমি মধুবাবুর সঙ্গে গতরাত্রে পরামর্শ করে করেছি এবং আজকের ব্যাপারটা নিছক একটা অভিনয় হলেও, গতকাল সন্ধ্যায় ঠিক অনুরূপ ব্যাপারটি নির্মম ও নিষ্ঠুর সত্য বলেই আমরা জানি। কারণ গত সন্ধ্যায় ঠিক আজকের মতই কাপে এক চুমুক দিয়েই বিজনবাবু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন আমাদের সকলেরই চোখের সামনে-এবং যদিও ময়না তদন্তের ফলাফল এখনো আমরা জানতে পারিনি, তথাপি আমি আপনাদের সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি, হতভাগ্য বিজনবাবুর মৃত্যুর পশ্চাতেও আছে আগের দুবারের মতই মারাত্মক নিকোটিন বিষপ্রয়োগই।

ঘরের মধ্যে সকলেই স্তব্ধ, বিমূঢ় ও নির্বাক।

কিরীটী আবার বলে, নিকোটিন বিষপ্রয়োগেই যদি বিজনবাবুর মৃত্যু হয়ে থাকে তো কাল নিশ্চয়ই তার চায়ের কাপের মধ্যেই আমাদের অলক্ষ্যে হয় নিজ হাতে বা অন্য কারও সহযোগিতায় হত্যাকারী ঐ মারাত্মক নিকোটিন বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। রান্নাঘরের পাশের ঘরে গত সন্ধ্যায় শকুন্তলা দেবী গোকুলের সাহায্যে আমাদের জন্য চা তৈরী করেছিলেন বলেই আমরা জানি। এবং ঐ সময় তারা দুজনেই বাইরে গিয়েছিলেন—শকুন্তলা দেবী দুবার ও গোকুল একবার। কাজেই ঐ গোকুল বা শকুন্তলা দেবী যদি চায়ে না বিষ মিশিয়ে থাকেন–

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলের দৃষ্টি অদূরে উপবিষ্ট শকুন্তলার উপর গিয়ে পতিত হল।

না, না, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, সহসা যেন চাপা আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল শকুন্তলা, বিষ আমি দিইনি—

কিন্তু কিরীটী শকুন্তলার সেই আর্ত চিৎকারে যেন কর্ণপাতও করল না। সে যেমন বলছিল বলতে লাগল, যা, কেবল শকুন্তলা দেবী বা গোকুলই নয়—কাল এ-বাড়িতে যাঁরা ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন তাদের যে কারও পক্ষেই বিজনবাবুর চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল। অর্থাৎ যে কেউ বিষ মেশাতে পারেন।

আবার ঐ সময় চিৎকার করে উঠলেন বৃন্দাবন সরকার, হাউ অ্যাবসার্ড! এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?

ঠিকই বলছি বৃন্দাবনবাবু, একমাত্র আমি ও শচীবিলাসবাবু ব্যতীত কাল সকলেই আপনারা এ ঘর থেকে ঐ সময়ের মধ্যে বেরিয়েছেন আমার স্পষ্ট মনে আছে।

সকলেই এবারে চুপ।

তাই যদি হয়, তাহলে আপনাদের যে কারো পক্ষেই গতকাল চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল এ কথাটা নিশ্চয়ই কেউ ডিনাই করতে পারবেন না! যাক যা বলছিলাম, তারপর ট্রেতে করে চায়ের যে কাপগুলো গোকুল নিয়ে এল তার মধ্যেই কোন একটি কাপে নিকোটিন বিষমিশ্রিত চায়ে চুমুক দিয়েই নিজের অজ্ঞাতে বিজনবাবু আমাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলেন। কথা অবিশ্যি এর মধ্যে একটা আছে। গোকুলই সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছিল। নিজে যদি দোষী হয় তো সে জেনেই পূর্বাহ্নে বিজনবাবুর হাতে বিষমিশ্রিত চায়ের কাপটি তুলে দিয়েছিল; আর সে যদি নির্দোষী হয়ে থাকে তো অজ্ঞাতেই সে বিজনবাবুর হাতে ঐ বিষের কাপটি তুলে দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আর একটা সন্দেহ জাগতে পারে আমাদের মনে। বিজনবাবুর হাতে অজ্ঞাতে বা না জেনে যদি গোকুল বিষের কাপটি তুলে দিয়েই থাকে, তাহলে কি বিজনবাবুর মৃত্যুটা অ্যাকসিডেন্টাল! আর তাই যদি হয়, হত্যাকারীর এইম কার উপরে ছিল? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বিজনবাবুর মৃত্যুটা একেবারে অ্যাকসিডেন্টাল নয়। বিজনবাবু হত্যাকারীর লিস্টে তত ছিলেনই-আরো কেউ ছিল!

সে কি! অধস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করেন এবারে ডাঃ অধিকারী।

হ্যাঁ, ডাঃ অধিকারী। আরও কেউ ছিল এবং এখনও তিনি পূর্ববৎ হত্যাকারীর লিস্টে আছেন।

কিরীটীর শেষের কথায় সকলে আবার ভীতদৃষ্টিতে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।

মৃত্যু–আবার কার জন্য মৃত্যু এখানে ওৎ পেতে আছে কে জানে?

এ কি সর্বনেশে কথা!

কিরীটী একটু থেমে আবার তখন বলতে শুরু করেছে, তবে আমার বিশ্বাস, বেচারী গোকুল হয়ত দোষী নয়। তা সে যাই হোক, বর্তমানে আমাদের সব চাইতে বেশী ভাববার কথা হচ্ছে, পর পর যেভাবে তিনটি মৃত্যু এ বাড়িতে ঘটেছে সেরকম নাটকীয় ব্যাপারের আর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই দিকেই আমাদের দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য নয় কি?

কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়-সহসা কিরীটীকে বাধা দিয়ে ডাঃ অধিকারী বললেন, দশরথের কথা ছেড়ে দিলেও সারদা আর বিজনের মৃত্যু যদি ঐ নিকোটিন বিষপানেই তাদের অজ্ঞাতে হয়ে থাকে তো গ্লাসে ও কাপে–

কিরীটী শেষ করতে দিল না ডাঃ অধিকারীকে কথাটা, বললে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে, নিকোটিন বিষ গ্লাসে পাওয়া উচিত ছিল ও কাপেও পাওয়া উচিত ছিল, তাই না?

হ্যাঁ, মানে–

ডাঃ অধিকারী, গ্লাসেও যেমন নিকোটিনের নামগন্ধ পাওয়া যায়নি, ঐ কাপেও পাওয়া যেত না। তাই মিথ্যে আমি কাপটা আর কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য বিমলবাবুকে পাঠাতে বলিনি।

তবে?

কিন্তু কেন? গ্লাসে ও কাপে যদি সত্যই নিকোটিন দেওয়া হয়ে থাকে তো কেন নিকোটিন অ্যানালিসিসে কাপে বা গ্লাসে পাওয়া যাবে না? সহসা কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা ঋজু ও ধারাল হয়ে ওঠে। সে বলতে থাকে, পাওয়া যায়নি ও যাবে না—তার কারণ সারদাবাবুর ঘরে যে গ্লাসটা পাওয়া গিয়েছিল এবং গতকাল সোফার তলায় যে কাপটা পাওয়া গিয়েছে, আদপেই। সে গ্লাস এবং সেই কাপ সারদাবাবু বা বিজনবাবু ব্যবহার করেননি তাদের মৃত্যুর পূর্বে।

হোয়াট ড়ু ইউ মিন, মিঃ রায়? তার মানে?

তীক্ষ্ণ একটা চীৎকারের মতই যেন ডাঃ অধিকারীর প্রশ্নটা কিরীটীর প্রতি নিক্ষিপ্ত হল।

এবারে শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে কিরীটী বললে, একসাটলি তাই ডাঃ অধিকারী। বলতে বলতে সহসা জামার পকেট থেকে একটা কাপ বের করে সম্মুখস্থিত টেবিলের উপরে রক্ষিত ক্ষণপূর্বের যে কাপটি মধুসূদনের সোফার তলা থেকে নিচু হয়ে কিরীটী বের করেছিল সেই কাপটি অন্য হাতে তুলে নিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বললে, দেখুন সকলে, এই দুটি কাপ হুবহু এক। অথচ আপনাদের চোখের সামনে—এই কিছুক্ষণ পূর্বে যে কাপটি আমি সোফার নিচে থেকে বের করেছিলাম সে কাপে আদৌ মধুবাবু আজ চা পান করেননি তার মৃত্যুর অভিনয়ের সময়। তিনি চা পান করেছিলেন আসলে এইমাত্র আমার জামার পকেট থেকে যে কাপটি বের করলাম সেই কাপে!

সর্বনাশ! তবে কি—

ঠিক তাই ডাঃ অধিকারী। সেই কারণেই সারদাবাবুর ঘর থেকে যে গ্লাসটা পাওয়া গিয়েছিল সেই গ্লাস কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে যেমন কোন নিকোটিনের ট্রেস মাত্রও পাওয়া যায়নি, তেমনি গত সন্ধ্যায় বিজনবাবুর মৃত্যুর পর যে কাপটি আমি সোফার নিচে পেয়েছিলাম সে কাপটিতেও নিকোটিনের ট্রেস বা নামগন্ধও পাওয়া যেত না। সো ইউ অল অ্যানডারস্ট্যাও নাউ? আসল ব্যাপার, গতকাল অত্যন্ত ট্যাক্টফুলি তার কাজ হাসিল করেছিল হত্যাকারী। যদিও প্রথম দুবারে ট্যাক্টফুলনেসের তার প্রয়োজন হয়নি, কারণ বিষপ্রয়োগের সময় নো বডি ওয়াজ প্রেজেন্ট দেয়ার!

কিন্তু হাউ, কেমন করে? প্রশ্ন করলেন আবার ডাঃ অধিকারী।

কেমন করে, তাই না ডাক্তার? আসল বিষমিশ্রিত কাপটি হত্যাকারী গতকাল কি ভাবে আমাদের চোখের সামনে ম্যানেজ করে অন্য একটা কাপ রিপ্লেস করল! ওয়েল-ভাবতে গেলে যদিও ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ও অবিশ্বাস্য, তথাপি হত্যাকারী বা খুনীর পক্ষে গতকাল কাপটা রিপ্লেসের ব্যাপারে যা প্রয়োজন ছিল সেটা হচ্ছে তার খানিকটা তত্রপ, ক্ষিপ্রতা এবং খানিকটা নার্ভ-যে দুটোই অবিসংবাদিত ভাবে হত্যাকারীর ছিল। কালকের ব্যাপারটা একবার সকলে আবার কুল ব্রেনে ভেবে দেখুন। অতর্কিতে যখন বিজনবাবু হঠাৎঅসুস্থ হলেন বিষপান করে, আর অজ্ঞাতে আমরা সকলেই যেন কিছুটা ননপ্লাসড় হয়ে পড়েছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায় ও আমাদের সকলের মনই তখন বিজনবাবুর দিকে-আমাদের সকলের সেই অসতর্ক মোমেন্ট-টুকুরই ত্বরিত সদ্ব্যবহার করেছিল হত্যাকারী অর্থাৎ ঐ মুহূর্তেই সে ঠিক আজকের আমার মতই আসল কাপটি অন্য একটি নির্দোষ কাপ দিয়ে সবার অলক্ষ্যে রিপ্লেস করেছিল। আশা করি এবারে আপনারা সকলেই আমার আজকের অনুষ্ঠানের সত্যকার উদ্দেশ্যটা উপলব্ধি করতে পারছেন।

কিরীটীর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধস্ফুট চিৎকার করে বললেন মধুসূদন সরকার, কে-কে তবে কাপটা সরিয়েছিল?

নিঃসন্দেহে এ সে-ই মিঃ সরকার, যে সারদাবাবু দশরথ ও বিজনবাবুকে হত্যা করেছে। গম্ভীরকণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দিল।

কিন্তু কে-কে সে?

কে—সেটাই তো আমাদের খুঁজে এখন বের করতে হবে মিঃ সরকার—এবং সেটা যতক্ষণ

সম্ভব হচ্ছে, হত্যাকারীকেও আমরা স্পট-আউট করতে পারব না। সে আমাদের নাগালের বাইরেই অন্ধকারে থেকে যাবে।

আপনি-আপনি জানেন মিঃ রায়?

হয়ত জানি বা হয়ত জানি না, মিঃ সরকার। কিন্তু তার চাইতেও বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ। যে কথাটা সেটা হচ্ছে-আপনারা সকলেই কাল যাঁরা ঐ দুর্ঘটনার সময়ে এ ঘরে উপস্থিত ছিলেন, আজও আছেন এবং আবার কিছুক্ষণ পূর্বে যা আমি আপনাদের বলেছি সেটাই রিপিট করছি। যে মৃত্যুর অভিনয় আজ মধুসূদনবাবুকে দিয়ে করিয়েছি ক্ষণপূর্বে এই ঘরে সেটা অভিনয় এবং নিছক মিথ্যা হলেও, আবার আচমকা যে কোন মুহূর্তেই হয়ত ঠিক ঐভাবেই কারো না কারো আপনাদের মধ্যে মৃত্যু তার সত্য নিয়ে দেখা দিতে পারে। ঠিক হয়ত ঐভাবেই। হত্যাকারী আবার কারও উপরে অ্যাটেম্পট নিতে পারে, যদি তার হত্যার প্রয়োজন না এখনও ফুরিয়ে গিয়ে থাকে। তাই সকলের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, যাতে গত তিনবারের হত্যার মত আবার ঐ নৃশংস ব্যাপার ভবিষ্যতে না ঘটে। যদি আপনাদের মধ্যে কেউ এমন। কিছু জানেন যা এখনও পর্যন্ত পুলিস জানতে পারেনি, অথচ যার সাহায্যে পুলিসের এই হত্যা-রহস্যের তদন্ত সহজ হয়—সে কথাটা অন্তত আমাকে খুলে বলুন। জানবেন এই সময় কোন কিছু ঐ হত্যা-রহস্য সম্পর্কে গোপন রাখা মারাত্মক হবে। বলুন, আমি আবার অনুরোধ জানাচ্ছি সকলের কাছে, বলুন!

কিন্তু সকলেই চুপ। নির্বাক। যেন পাথর।

ছুঁচ পতনের শব্দটুকু পর্যন্তও বুঝি শোনা যাবে।

ধীরপদে ঐ সময় থানা-অফিসার বিমল সেন ও সুশান্ত এসে ঘরে প্রবেশ করল। সত্যি কথা বলতে কি, সকলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।