১৮. বৃন্দাবন সরকার ইচ্ছা করে

বৃন্দাবন সরকার ইচ্ছা করে ভাগ্নে বিজনকে সরকার ভিলায় আমন্ত্রণ করে আনেননি জরুরী চিঠি দিয়ে।

মৃত সারদাচরণের নির্দেশমতই বিজনকে আসার জন্য তাঁকে চিঠি দিতে হয়েছিল। এবং শুধু বিজনকেই নয়, আরও দুজন ভদ্রলোকও পরের দিন বৃন্দাবন সরকারের সঙ্গে কলকাতা হতে এলেন ঐ উইলের নির্দেশমতই।

একজন সারদাচরণের বিশেষ পরিচিত বাল্যবন্ধু ডাঃ বাসুদেব অধিকারী, অন্যজন সারদাচরণের আত্মীয় অর্থাৎ সারদাচরণের ভগ্নীপতি রতিকান্ত মল্লিক।

ডাঃ অধিকারী ও রতিকান্ত মল্লিক দুজনেরই বয়স হয়েছে, প্রৌঢ়।

সলিসিটার শচীবিলাস বসুও এলেন ওঁদের সঙ্গে।

চল্লিশের ঊর্ধ্বে বয়স হয়েছে শচীবিলাসের।

পরের দিন শুক্রবার সকলে এসে বিকেল পাঁচটা নাগাদ সরকার ভিলার লাইব্রেরী ঘরে জমায়েত হলেন।

মধুসূদন সরকার, বৃন্দাবন সরকার, বিজন, ডাঃ বাসুদেব অধিকারী, রতিকান্ত মল্লিক ও কিরীটী রায়।

মাঝখানে বসলেন সলিসিটার শচীবিলাস এবং তাকে ঘিরে বসলেন অন্যান্য সকলে।

সকলের উপস্থিতিতেই শচীবিলাস তাঁর ফোলিও থেকে একটি সিল-করা পুরু লেপাফা বের করলেন ও সিল ভেঙে সারদাচরণের শেষ উইলটি বের করলেন।

উইলের সারমর্ম শুনে কিরীটী রীতিমত অবাক হয়ে যায়।

বিরাট সম্পত্তির মালিক ছিলেন সারদাচরণ সরকার।

স্থাবর, অস্থাবর, ব্যবসা ও নানা ধরনের সম্পত্তি মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি।

এবং সেই সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারার যে নির্দেশ তিনি দিয়ে গিয়েছেন তা হচ্ছে এইরূপঃ

কলকাতা, বোম্বাই ও দিল্লীর জুয়েলারী ব্যবসার দুইয়ের তিন অংশ দিয়ে গিয়েছেন তিনি বৃন্দাবন সরকারকে এবং বাকি একের তিন অংশ নিরুদ্দিষ্ট মধুসূদন সরকারকে।

কলকাতার বাড়িটা দিয়েছেন বিজনকে। সরকার ভিলা দিয়েছেন শকুন্তলা দেবীকে জীবনস্বত্বে। ব্যাঙ্কের নগদ এক লক্ষ টাকা সমান ভাগে অর্ধেক দিয়েছেন ডাঃ বাসুদেব অধিকারী ও রতিকান্ত মল্লিকের হাতে একটি দাতব্য হাসপাতাল তৈরীর জন্য—তার মৃত জ্যেষ্ঠ রণদাচরণের স্মৃতিরক্ষার্থে এবং বাকী অর্ধেক সমান ভাগে বৃন্দাবনের কন্যাকে এবং বিজনকে। মধুসূদন যদি জীবিত না থাকে, তার অংশ সব পাবে বৃন্দাবন।

উইল পড়া শেষ করে শচীবিলাস উইলটা ভাঁজ করছেন, ভৃত্য ট্রে-তে করে গরম চা নিয়ে এল ঘরে।

ট্রে-টি ছোট এবং তাতে মাত্র চারটি কাপই সাজানো।

মধুসূদন ভূত্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কি, চার কাপ আনলি কেন?

ট্রে-টা ছোট, তাই আনতে পারিনি, এখুনি আনছি। বললে ভৃত্য।

কেন, দুটো ট্রেতে সাজিয়ে দুজনে নিয়ে আসতে পারনি? যত বেটা উজবুক এসে এবাড়িতে জুটেছে! বলে মধুসূদন নিজেই সোফা থেকে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বৃন্দাবন বাধা দিলেন, তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন দাদা, ও এখুনি নিয়ে আসবে, তুমি বোস।

ভৃত্য তখনও বকুনি খেয়ে ট্রে-টা হাতে করেই দাঁড়িয়ে আছে।

আবার হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখ! কোণের ঐ টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে কাপগুলো হাতে হাতে দে না!

মধুসূদন আবার ঝাজিয়ে উঠলেন ভৃত্যকে।

ভৃত্য এধারে ঘরের কোণে যে বড় টেবিলটা ছিল, সেটার উপর নিয়ে গিয়ে ট্রে-টা নামিয়ে রাখল।

মধুসূদন তখন সেই টেবিলের কাছে এগিয়ে যান।

যা, বাকি কাপগুলো নিয়ে আয়। মধুসূদন আবার বললেন ভৃত্যকে।

ভূত্য বাইরে চলে গেল।

এবং একটু পরে বাকি তিন কাপ চা নিয়ে এসে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল।

সকলের হাতেই অতঃপর মধুসূদনের নির্দেশে এক কাপ করে চা এগিয়ে দিল ভৃত্য।

তোমরা শুরু কর, আমি আসছি এখুনি। বলে মধুসূদন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন পুনরায়।

সকলেই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিতে উদ্যত। এবং সর্বাগ্রে বোধ হয় বিজনই চায়ের কাপে চুমুক দিল।

কিন্তু দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার আগেই বিজনের কম্পিত হাত থেকে কাপটা নিচের মেঝের কার্পেটের উপর সশব্দে পড়ে গেল।

এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট একটা কাতরোক্তি করে বিজন যে সোফার উপরে বসেছিল সেই সোফার উপরেই এলিয়ে পড়ল।

কি-কি হল? ব্যাপার কি, বিজনবাবু? বলতে বলতে সকলেই ততক্ষণে যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বিজনের দিকে এগিয়ে আসে।

কিরীটীর এগিয়ে আসে ক্ষিপ্রপদে।

নিদারুণ যন্ত্রণায় বিজনের সমস্ত মুখের পেশীগুলো তখন কুঞ্চিত ও প্রসারিত হচ্ছে।

দুটি চক্ষু বিস্ফারিত। কি যেন বলবার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না বিজন, কথা জড়িয়ে। যায়।

সকলের উৎকণ্ঠিত চোখের দৃষ্টির সামনেই সহসা বিজনের মাথাটা একপাশে কাত হয়ে পড়ল পরক্ষণেই।

অভাবিত আকস্মিক পরিস্থিতি।

সকলেই শুধু নিস্পন্দ বাক্যহারা নয়, বিমূঢ়।

কিরীটী সর্বাগ্রে বিজনের স্থির-নিস্পন্দ দেহটা বারেকের জন্য স্পর্শ করে ডাঃ অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললে, দেখুন তো ডাঃ অধিকারী—

বিমূঢ় ডাঃ অধিকারী কেমন যেন শ্লথ পায়ে এগিয়ে এলেন কিরীটীর নির্দেশে এবং নিস্পন্দ বিজনের পাল্টা একবার দেখেই তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে, বিষণ্ণ কাতর দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন কেবল।

ঠিক সেই মুহূর্তেই মধুসূদন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, বিজনকে ঘিরে সকলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলেন, কি–ব্যাপার কি?

বিজন ইজ ডেড মধুসূদন! ডাঃ অধিকারী বললেন।

সে কি!

হ্যাঁ, হি ইজ নো মোর! ইন্সট্যানটেনিয়াস ডেথ হয়েছে বিজনের!

কিরীটীও যেন ডাঃ বাসুদেব অধিকারীর কথায় স্তব্ধবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল ক্ষণেকের জন্য, কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু হয়ে মেঝের কার্পেট থেকে কাপটা তুলে নিতে গিয়ে দেখল, কিছুক্ষণ পূর্বে তাদের সকলের দৃষ্টির সামনে মেঝেতে বিজনের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল যে কাপটা-ইতিমধ্যে বিজনের সোফার তলায় চলে গিয়েছে। কোন্ এক সময়।

কারও পায়ের ধাক্কায় বোধ হয় কাপটা সোফার নিচে চলে গিয়েছিল।

কিরীটী সোফার নিচে হাত ঢুকিয়ে কাপটা তুলে নিল।

কাঁচের কাপের গায়ে তখন চা লেগে রয়েছে।

ডাঃ অধিকারীর উচ্চারিত কথাটা যেন ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই একেবারে বোবা করে দিয়েছিল।

মৃদুকণ্ঠে কিরীটী যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই বললে, এমন আকস্মিক মৃত্যু—

শচীবিলাস বললেন, হঠাৎ এভাবে হার্টফেল করলেন, কোন অসুখ-বিসুখ ছিল নাকি ভদ্রলোকের মিঃ সরকার?

বৃন্দাবন অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, কই, সেরকম কিছু রোগ ওর ছিল বলে তো শুনিনি!

আকস্মিক হার্টফেল বলেই কি আপনার মনে হয়, ডাঃ অধিকারী? সহসা কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করল।

য়্যাঁ!

বলছিলাম পয়েজনিং নয় তো? কিরীটী আবার বলে।

পয়েজনিং! বিস্মিত ডাঃ অধিকারী এবারে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ, নিকোটিন পয়েজনিং নয় তো?

নিকোটিন পয়েজনিং!

একটা অভিশপ্ত চাপা কান্নার মতই যেন মৃদুচ্চারিত বৃন্দাবনবাবুর কথাটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকে একটা বৈদ্যুতিক শক দেয় অকস্মাৎ।

হ্যাঁ, একান্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি, এটাও বোধ হয় হত্যা। কিরীটী আবার বললে।

হত্যা! কি বলছেন মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলেন মধুসূদন সরকার এবারে।

মনে তো হচ্ছে তাই। তবে ময়না তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত অবিশ্যি কিছু ডেফিনিট বলা যাচ্ছে না। তবু মধুসূদনবাবু, আপনি এখুনি একবার থানার বিমলবাবুকে খবর দিন।

 

আরও ঘণ্টাখানেক পরে। সংবাদ পেয়েই বিমলবাবু ছুটে এসেছে।

বিমল সব শুনে বলে, তাহলে আপনার ধারণা মিঃ রায়, ইটস এ সিমিলার কেস!

আমার তো তাই বলেই মনে হচ্ছে। এই কাপটা একবার অ্যানালিসিস করতে পাঠাতে পারেন?

তবে আমার মনে হয়—

কি?

এবারও হয়ত পূর্বের মতই অ্যানালিসিস করেও কিছুই পাবেন না ওতে।

হুঁ। আচ্ছা মধুসূদনবাবু, চা তৈরী করেছিল কে? বিমল সহসা প্রশ্ন করে।

তা তো জানি না। তবে চাকরদের মধ্যেই কেউ হবে।

কিরীটী ঐ সময়ে বলে, যে ভৃত্যটি এ ঘরে চা ট্রে-তে করে নিয়ে এসেছিল তার নাম গোকুল না, বৃন্দাবনবাবু?

হ্যাঁ।

তাকে একবার ডাকুন তো! কিরীটী বলে।

তখুনি গোকুলকে ডাকানো হল ঐ ঘরে।

ভৃত্যদের মহলেও দুঃসংবাদটা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে।

বেচারী কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে ঢুকল।

গোকুল, চা কে তৈরি করেছিল আজ? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

আজ্ঞে দিদিমনি করেছেন, আর আমি সব যোগাড় করে দিয়েছি।

দিদিমণি অর্থাৎ শকুন্তলা দেবী।

আর সেখানে কেউ ছিল? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে। কি

আজ্ঞে না।

চা করতে করতে তুমি বা দিদিমণি একবারও গিয়েছিলে বাইরে ঘর থেকে?

আজ্ঞে আমি একবার গিয়েছিলাম, দিদিমণিও বার-দুই গিয়েছিলেন বোধ হয়।

সেসময় কেউ সে-ঘরে ঢুকেছিল কি?

তা তো জানি না।

হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পার।

গোকুল কাঁপতে কাঁপতেই আবার চলে গেল।

তাহলে মিঃ রায়–

মধুসূদন সরকারের প্রশ্নে তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, এমনও তো হতে পারে মধুবাবু, এ ঘরে ট্রে-তে করে চা আসবার পর কেউ কিছু কাপে মিশিয়ে দিয়েছে সবার অলক্ষ্যে, বিশেষ করে আমরা তো সবাই তখন কথাবার্তায় অন্যমনস্ক ছিলাম!

কথা বললেন এবারে বৃন্দাবন সরকার, কিন্তু তাই যদি হয়ে থাকে তো এতগুলো কাপের মধ্যে মাত্র একটা চায়েই বিষ মেশানো হল! এবং সেক্ষেত্রেও কেবল ইচ্ছা করেই যদি কেউ কাউকে হত্যা করবার জন্য আপনার ধারণামতই কাপে বিষ মিশিয়ে থাকে, তাহলে যাকে হত্যা করবার জন্য ঠিক বিষ মেশানো হয়েছিল, সেই বিশেষজন সে কাপটা না নিয়ে যদি এ-ঘরের মধ্যে অন্য কেউ সে কাপটা নিত, তবে কি

নিঃসন্দেহে সে-ই ঐ কাপটার চা পান করত তারই মৃত্যু হত বৃন্দাবনবাবু। সেদিক দিয়ে হয়ত হত্যাকারী একটা চান্সই নিয়েছিল!

চান্স?

হ্যাঁ, কিন্তু কেবল বিজনবাবুর কথাই ভাবছেন কেন? হত্যাকারী হয়ত আপনি, মধুবাবু ও বিজনবাবু-তিনজনের উপরেই অ্যাটেম্পট নিয়েছিল আজ।

সে কি?

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো তাই বৃন্দাবনবাবু। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।

কিন্তু শকুন্তলা দেবীকে একবার ডাকলে হত না মিঃ রায়? বিমল বললে।

ডাকিয়েও কোন কিনারা করতে পারবেন বলে তো আমার মনে হয় না বিমলবাবু আজকের এই রহস্যের! কিরীটী শাস্তকণ্ঠে বললে।

তাহলে?

আপাততঃ ঐ মৃতদেহটা এখান থেকে সরিয়ে ময়নাতদন্তে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আর যতক্ষণ না এই হত্যা-রহস্যের তদন্ত শেষ হয়, কেউ যেন এ বাড়ি থেকে না যান সেই নির্দেশই সকলকে আপনি দিন।

কিরীটীর কথায় সকলেই চমকে তার মুখের দিকে তাকাল।

কিন্তু যাকে কথাটা বলা হল সেই বিমলবাবু কারও দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বললে, তাহলে কেউ আমার পারমিশন ব্যতীত এ বাড়ি ছেড়ে যাবেন না—এই কথাই রইল।

কেউ কোন সাড়া দিল না।

সবাই নির্বাক নিস্পন্দ যেন।

কিরীটী যে তখনকার মত সরকার ভিলা থেকে সকলের যাওয়াই বন্ধ করল তাই নয়, নিজেও সে রাত্রের মত সরকার ভিলা থেকে যাবে না বলেই সুশান্তকে একটা সংবাদ তখুনি বিমলের এক সেপাইয়ের সাহায্যে পাঠিয়ে দিতে বলল।

এবং শুধু সে রাত্রেই নয়।

পর পর আরও চারিটি দিন ও রাত সরকার ভিলার চৌহদ্দির মধ্যে ঐ লোকগুলোকে খাঁচায় আবদ্ধ জানোয়ারের মতই যেন বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল।

একমাত্র ছুটি পেয়েছিলেন পরের দিন ঐ দল থেকে সারদাচরণের সলিসিটার শচীবিলাসবাবু।

আর কেউ বাইরে পা বাড়াবার হুকুম পাননি দারোগা বিমল সেনের কাছ থেকে কিরীটীরই নির্দেশে।

সত্যি, সে এক বিচিত্র পরিস্থিতি।

বিশেষ করে কথার ছলে সেই রাত্রেই যখন সকলের সামনে দাঁড়িয়ে কিরীটী বলেছিল, সারদাচরণ, দশরথ ও বিজনবাবুর হত্যাকারী একজনই—এবং সে হত্যাকারী তখনও তাদের মধ্যে ঐ সরকার ভিলাতেই উপস্থিত আছে, তখন কিরীটীর কথায় সেরাত্রে উপস্থিত সকলেই মুহূর্তের জন্য পরস্পরের প্রতি অপাঙ্গে দৃষ্টিপাত করে অজানিত এক দুর্বোধ্য আশঙ্কায় মনে মনে শিউরে উঠেছিল বুঝি।

একটা সত্য কথা উচ্চারণের মধ্যে যে এমন একটা ভয় আতঙ্ক থাকতে পারে, সেটা যেন সকলেই সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল।

অথচ কেউ সেদিন এতটুকু প্রতিবাদও জানাতে পারেনি।

একটা দুর্বোধ্য আতঙ্কে কেমন যেন সব বোবা হয়ে ছিল।

 

থানা-অফিসার বিমল সেন তো তার চরম নির্দেশটা শুনিয়ে দিয়ে সরকার ভিলার চারিদিকে সর্বদা সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করে সে রাত্রের মত বিদায় হল, কিন্তু যারা সেই খাঁচার মধ্যে বন্দী রইল তাদের তো একটা থাকবার ও খাবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

সরকার ভিলাতে অবিশ্যি থাকবার জায়গার অভাব ছিল না।

কিরীটীর নির্দেশে তখুনি মধুসূদন সরকার সকলের ব্যবস্থা করবার জন্য চলে গেলেন।

এবং ঘণ্টাখানেক বাদেই মৃতদেহ ঐ লাইব্রেরী ঘর থেকে সরিয়ে বাড়ির বাইরে উদ্যানের মধ্যে যে মালীদের ঘরটা ছিল সেই ঘরে রেখে আসা হল রাত্রের মত।

সকলে এসে নিচের পারলারে জমায়েত হলেন আবার।

প্রৌঢ় ডাক্তার অধিকারী একসময় কিরীটীকে বললেন, এ কি বিশ্রী ঝাটে পড়া গেল বলুন তো মিঃ রায়!

আমি বুঝতে পারছি ডাঃ অধিকারী আপনার মনের অবস্থাটা, কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনি, এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পথ সত্যিই ছিল না।

কিন্তু সত্যিই কি আপনি মনে করেন মিঃ রায়, আজ যারা এখানে এ বাড়িতে উপস্থিত তাদের মধ্যে সামবডি

তাই আমার ধারণা ডাঃ অধিকারী। এর আগে এই বাড়িতেই দুটি নৃশংস হত্যার ব্যাপার আপনি তো শুনেছেন–

হ্যাঁ, শুনেছি।

একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন, পর পর এই তিনটি মৃত্যুই আকস্মিক ও রহস্যজনক হলেও একই সূত্রে গাঁথা।

কিন্তু–

বুঝতে পারছি ডাঃ অধিকারী, আপনি কি বলতে চান। প্রথম দুটো হত্যার সময় অকুস্থানে তৃতীয় কোন ব্যক্তি ছিল কিনা আপাততঃ সেটা যদিও আমরা জানি না বা জানতে পারিনি বটে, কিন্তু ভেবে দেখুন তৃতীয় মৃত্যুর সময় আমরা এতগুলো লোক সজ্ঞানে অকুস্থানে উপস্থিত ছিলাম!

তাই তো ব্যাপারটা এখন আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।

তা না হলেও এটা তো আপনি স্বীকার করবেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দুটো হত্যাই হয়েছে। তীব্র নিকোটিন বিষপ্রয়োগে?

তাহলে দশরথের মৃত্যুর কারণও আপনার ধারণা মিঃ রায় ঐ একই? ধারণা নয়, তাই। কারণ আজ একটু আগে বিমলবাবু আমাকে সেকথা বলে গেলেন। তাহলেই ভেবে দেখুন, বিষপ্রয়োগের কোন প্রমাণ—অর্থাৎ কে কার দ্বারা, কি উপায়ে তাদের বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল সেটার কোন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত না পাওয়া গেলেও ময়নাতদন্তে তাদের দেহে বিষ পাওয়া গিয়েছে,-যার দ্বারা তাদের যে বিষের ক্রিয়াতেই মৃত্যু ঘটেছে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত। তারপর দেখুন, তিন-তিনটে মৃত্যু একই বাড়ির বিভিন্ন ঘরে হয়েছে এবং একই বাড়ির লোক তারা!

কিন্তু এটাই তো আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, আপনার কথা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়ই, তাহলে এই ধরনের ডায়বলিক্যাল মার্ডারের কি উদ্দেশ্য কার থাকতে পারে?

সেটা তো পরের কথা। কিন্তু একটা কথা কি জানেন ডাঃ অধিকারী, এসব ব্যাপারে বরাবরই আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার দ্বারা দেখেছি, সরলভাবে বিচার করে দেখতে গেলে প্রত্যেকটি এই ধরনের হত্যার ব্যাপারেই মোটিভ বা উদ্দেশ্য, অপরচুনিটি বা সুযোগ এবং প্রবাবিলিটি বা সম্ভাবনা তিনটি জিনিসই থাকবে। অবিশ্যি এর মধ্যে মোটিভই হচ্ছে সর্বপ্রধান-মুখ্য। অন্য দুটি গৌণ। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে প্রথম ও তৃতীয় হত্যার মোটিভ আমাদের চোখের সামনে থাকলেও, দ্বিতীয় হত্যার মোটিভটি অবিশ্যি তত স্পষ্ট নয়।

কি মোটিভ? ডাঃ অধিকারী আবার প্রশ্ন করলেন।

কেন? সেই চিরাচরিত মোটিভ–অর্থ!

অর্থ?

হ্যাঁ, অর্থম্‌ অনর্থম্‌! সারদাচরণ সরকারের সুবিপুল সম্পত্তি, যার হদিস আজই আমরা শচীবিলাসবাবুর কাছ থেকে কিছুক্ষণ মাত্র আগে পেয়েছি–

তাই যদি হয় তো দশরথ কেন নিহত হল?

দশরথ বেচারী প্রথম হত্যার ব্যাপারে এমনভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল,-যে কারণে হত্যাকারীর চোখে তার মৃত্যুটা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।

 

মধুসূদনবাবু অবিশ্যি সেরাত্রে সকলের আহারের ভাল ব্যবস্থাই করেছিলেন। কিন্তু আহারের এতটুকু রুচিও কারো ছিল না বুঝি, তাই সকলেই গিয়ে নিয়মরক্ষার জন্য খাবার টেবিলে বসলেন মাত্র।

এবং একসময় সকলে আবার টেবিল ছেড়ে উঠে যে যাঁর নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে যেন শ্লথপায়ে প্রবেশ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

সেরাত্রে নিদ্রা যে কারও চোখে আসবে না বা আসতে পারে না, সকলেই অবিশ্যি সেটা জানতেন—তবু কেউ যেন আর বসে থাকতে পারছিলেন না।

যে যার নির্দিষ্ট শয়নঘরে প্রবেশ করে যেন সন্ধ্যা থেকেই সেই একটানা দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সে রাতের মত নিশ্চিন্ত হলেন কতকটা।

মধুসূদন সরকারের পাশের ঘরেই কিরীটীর শয়নের ব্যবস্থা হয়েছিল সে রাত্রে।

 

রাত্রি গভীর।

সরকার ভিলার ঘরে ঘরে একে একে আলো নিভে গিয়েছে।

কিরীটী তার ঘরের খোলা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বাইরের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি মেলে ধূমপান করছিল।

ঘর অন্ধকার।

সরকার ভিলার মৃত্যু-রহস্যের সমাধান করে ওখান থেকে চলে আসবার পূর্বে সুশান্ত প্রশ্ন করেছিল কিরীটীকে, ওভাবে সেদিন সকলকে সরকার ভিলায় আটকে রেখেছিলেন কেন মিঃ রায়?

জবাবে কিরীটী বলেছিল, তা না করলে হয়ত হত্যাকারীকে অত সহজে আমি ধরতে পারতাম না সুশান্তবাবু।

তাহলে বলুন, হত্যাকারীকে আপনি মনে মনে চিনতে পেরেছিলেন ঐদিনই?

তা পেরেছিলাম বইকি! মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দিয়েছিল।